Naar e Ishq গল্পের লিংক || তুরঙ্গনা

Naar e Ishq part 1
তুরঙ্গনা

‘বাবা হয়ে নিজের সৎ মেয়েকে বিয়ে করবে!সম্পর্কে ও তোমার মেয়ে হয়। ওকে কি করে তুমি ভালোবাসতে পারো? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তির তীক্ষ্ণ-রুক্ষ কথায়,তার সম্মূখে পায়ের উপর পা তুলে, নির্বিকারে সিগারেট টেনে ধোঁয়া উড়ানো, কালো রঙের পোশাকে সুসজ্জিত সুদর্শন—বিরক্তির সাথে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
“ওহ্,যাস্ট শাট-আপ আঙ্কেল! এসব সম্পর্কের নীতিফীতির ধার ধরি না আমি।ওকে বিয়ে করতে চাই মানে, বিয়ে আমি করবই।”
তার এহেন কথায়, মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটি ভারী শ্বাস ফেলে। এ ছেলে প্রচন্ড উগ্র, বেপরোয়া। সমাজ থেকে বিছিন্ন থেকেছে দীর্ঘকাল। সমাজ-সম্পর্ক,নিয়ম-নীতি সবই যেন তার ইচ্ছের কাছে তুচ্ছ। তবে এবার সে যা চাইছে,তা কি করে সম্ভব হতে পারে!
লোকটি পুনরায় ভারী শ্বাস ফেলে আওড়ায়,

“পাগলামি করো না কেকে! সবকিছুর একটা সীমা আছে। তুমি প্রতিবার এই সীমাগুলো অতিক্রম করতে চাইলেও, এবার কিন্তু তা কোনোমতেই সম্ভব না। তুমি জীবনে যা যা করতে চেয়েছো,তাতে আমি সর্বদা সাহায্য করেছি। কিন্তু এর মানে এই না যে,আমি এখন তোমার এই উদ্ভট আবদারও পূরণ করব।”
ব্যক্তিটির কথায় কেকে শান্ত ভঙ্গিতে তির্যক হাসে। সোফায় পায়ের উপর পা তুলে, দুদিকে হাত ছড়িয়ে,গা এলিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে সে। চোখে-মুখে নির্লিপ্ততার পাশাপাশি, তাচ্ছিল্যের আভাস তীব্র। পরনে তার ম্যাট কালো লেদার জ্যাকেট,কালো টিশার্ট-প্যান্ট। মাথা ভর্তি ওল্ফ হেয়ার কাট দেওয়া, কাঁধ অব্দি একঝাঁক রেশমের ন্যায় সিল্কি ঝাঁকড়া চুলগুলো—বরাবরের মতো এলোমেলো। কিছু চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে কপালের সম্মূখেও পড়ে আছে।
হাতের দুই আঙুলের ভাজে ট্রেজারার লন্ডন এক্সক্লুসিভ ব্ল্যাক নামক ব্র্যান্ডের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কালো রঙের সিগারেট—এটি ব্যতীত ভিন্ন কিছু, সর্বদা নেশায় মত্ত কেকের হাতে তেমন দেখা যায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঠোঁটে সিগারেট ছুঁইয়ে,সে দীর্ঘ টান দিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। চোয়াল শক্ত কেকের ভাবগম্ভীর্যে, তার সম্মূখের মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি খানিক ভেতর ভেতর ঘাবড়ে যায়। এই ছেলে কি করতে চাচ্ছে,কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু ভাবভঙ্গিও তো সুবিধার নয়। এরিমধ্যে কেকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তির্যক হেসে বলল,
“আই’ম কেকে! কেকে চৌধুরী! আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার আমি কাউকে দেইনি।”
কেকে আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। এবং ব্যক্তিটির আর কোনো কথাও শোনার প্রয়োজনও মনে করে না। এদিকে সেই মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটি তথা জাভিয়ান হায়দার এর চোখ-মুখ শুঁকিয়ে গিয়েছে। সে অস্ফুটস্বরেই বলে ওঠে,
“কিন্তু…”
জাভিয়ানের কথা শুরু হবার আগেই,কেকে পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে,নিরেট কন্ঠে আওড়ায়,
“আই ক্রিয়েট মাই ওয়োন রুলস—এন্ড ব্রেক দেম মাই ওয়োন ওয়ে।”

রাত তখন একটা ছুঁইছুঁই। লস অ্যাঞ্জেলেসের আকাশে নীয়ন আলোর গলনধ্বনি।একইসঙ্গে শহরের হৃদয় কাঁপছে সংগীতের নিনাদে। বিশাল স্টেডিয়ামজুড়ে জনসমুদ্রের তরঙ্গ।আকাশে নীয়ন আলোয় অনিশ্চিত রঙের প্রতিফলন,বাতাসে বৈদ্যুতিক কম্পন,
আর জনসমুদ্রে এক অচিন্ত্য উচ্ছ্বাসের স্ফুরণ।
শহর যেন আজ তার নিজস্ব সত্তা ত্যাগ করে,
এক সংগীত-নির্ভর নেশায় আত্মসমর্পণ করেছে।
স্টেডিয়ামের বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে অগণন মুখ—চোখে উজ্জ্বলতা, কণ্ঠে উন্মত্ত ধ্বনি। আজ BLACKVANE মিউজিক ব্যান্ডের লাইভ কনসার্ট। এটি পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ট একটি জনপ্রিয় মিউজিক ব্যান্ড। যা প্রায় বেশ অনেক বছর হতে,এই লস অ্যাঞ্জেলেস নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।
স্টেজের অন্ধকার হঠাৎ বিদীর্ণ হলো ধোঁয়ার ভেতর এক আলোচ্ছটার ঝলকে। পরনে ম্যাট ব্লাক লেদার জ্যাকেট,সাদা টিশার্ট; কালো ও সামান্য সাদার প্রলেপে সজ্জিত ইলেক্ট্রিক গিটার হাতে নিয়ে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির অবয়ব দৃশ্যমান হয়। যাকে দেখমাত্রই র’ক্তগরম উন্মত্ততায় দর্শকগণ একসাথে গর্জে ওঠে,

“K.K.! K! K.K.! K!
BLACKVANE মিউজিক ব্যান্ডের লিডারই হলো এই কেকে। যার নেশাক্ত মোহময় কন্ঠস্বর ও মাত্রাধিক সৌন্দর্যে বরাবরই উৎসুক ভ’ক্ত-জনতা তার জন্য উম্মাদ হয়ে ওঠে। এছাড়া তার তেজস্বী কিংবা বি’দ্রোহী উগ্র ভাবমূর্তিই যেন সকলকে বেশি আকর্ষিত করে। বিষয়টা খানিক নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি যে আকর্ষণ—ঠিক তেমনই।
কেকের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তার চারজন সঙ্গী ও এই ব্র্যান্ডের বাকি সদস্যগণ। তালহা রিজভি, ফারিস তাইমুর, জায়ান সামিদ,

সাদ হাম্মাদি এবং কেকে—এদের নিয়েই এই ব্লাকভেইন মিইজিক ব্যান্ড গঠিত।
তাদের সবারই এক বিশেষত্ব হলো কালো রঙের সাজসজ্জা—কালো পোশাক, কালো গ্লাসেস, কালো মাইক্রোফোন কিংবা বাদবাকি ইনস্ট্রুমেন্ট। সবটাই এই কালো কিংবা সাথে সামান্য সাদা রঙের মিশ্রণে সজ্জিত। আর এই বৈশিষ্ট্যটুকু কেকেই তার নিজস্ব বিশেষত্বের রূপে সাজিয়েছে।
সবমিলিয়ে বলা চলে, কালো তাদের আত্মারও রঙ। কারণ তারা তাদের নিজস্ব একটি বিশেষ ত্বত্ত্বে বিশ্বাসী, ‘Black absorbs everything—pain, fame, and flame.’
‘কালো রঙে নিহিত ধ্বংস এবং সৃষ্টির সমমিতি; এটি যেমন নিঃশেষ, তেমনি প্রতিস্ফুরণশীল আশার এক অন্তর্নিহিত সূত্র।’

দর্শকের ভিড়ের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে লালচুল বিশিষ্ট এক ব্রিটিশ রমণী। গাঢ় লাল রঙের ভেলভেট গাউন পরিধিত এই রমণীর নাম ইসাবেলা রোজি। চোখে লালচে স্পার্ক, ঠোঁটে কেকের নাম। তার চিৎকারে উত্তে’জনা যেন মঞ্চে স্রোতের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত।
হঠাৎ কেকে এগিয়ে এসে স্ট্যান্ড-মাইকটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। গলায় ঝুলিয়ে রাখা গিটারের স্ট্রিপটা খানিক দৃঢ় ভঙ্গিতে ঠিক করে নেয়।এদিকে আলোও নিভে যায় এক মুহূর্তেই। নিঃশব্দে ধ্বনিত হয় তার বজ্র-ঝড়ের ন্যায় কণ্ঠস্বর,
“This song’s not for peace… it’s for the fire you fed.”
তার উপস্থিতি কোনো এক গহীন অন্ধকার জঙ্গলের উন্মত্ত সিংহের ন্যায়। এলোমেলো চুল,ঠোঁটে উন্মাদের ন্যায় তির্যক হাসি,চোখে দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা। তার কথা শেষ হতে না হতেই, চারপাশে বেজে উঠল গিটার, তালে তালে ড্রামের গর্জন। আর কেকে গাইতে শুরু করল, তার নিজস্ব উন্মত্ত কন্ঠস্বরে,

“Zara si dil mein de jagah tu.
Zara sa apna le bana____
Zara sa khwabon mein saja tu.
Zara sa yaadon mein basa____
Main chaahoon tujh ko, meri jaan…bepanaah______
Fida hoon tujh pe, meri jaan, bepanaah______
Whoa-oh-oh, oh-oh-oh, oh-oh-oh, oh-oh-oh.
Whoa-oh-oh, oh-oh-oh, oh-oh-oh, oh-oh-oh.
Whoa-oh-oh, oh-oh-oh, oh-oh-oh, oh-oh-oh________’

পুরো স্টেডিয়াম তখন উন্মাদনায় ভেসে যাচ্ছে। ভক্তরা লাফাচ্ছে, ঝলসাচ্ছে আলো,চারপাশে অদ্ভুত এক উত্তাল আবহ। ব্লাকভেইনের বেশিরভাগ ভ’ক্ত এশিয়ান হওয়ায়,লস-অ্যাঞ্জেলেসের মতো স্থানেও তাদের জনপ্রিয়তা বেশ তুঙ্গে। যথারীতি বেশ রাত-অব্দিই তাদের কনসার্ট হয়। এবং নির্দিষ্ট সময় পর সকলেই বেরিয়ে পড়ে আরেকটি বিশেষ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
স্টেডিয়ামের বাইরে সারি সারি গাড়ি। আলোছায়ার ভেতর কেকে ব্যতীত বাকি চারজন নিজের নিজের কালো পোর্শে গাড়িতে গিয়ে চড়ে বসে। সবকটা পোর্শের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাট-ব্লাক ফেরারি। যার সম্মূখে দৃশ্যমান লম্ফরত ঘোড়া বিশিষ্ট লোগোটি রাতের আঁধারে বেশ জ্বলজ্বল করছে। কেকে এবং ইসাবেলা গিয়ে ফেরারিতে বসে পড়ে। এটা কেকের একান্তই নিজস্ব গাড়ি। এখানে তার অনুমতি ব্যতীত বসার সাধ্য কারো নেই। এছাড়া ফেরারির প্রতি তার যে আকর্ষণ, সেটাও বিশেষ ভাবে বলার মতো কিছু রাখে না।

তাদের গন্তব্য এখন এখান থেকে প্রায় বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত এক রেসিং নাইট ক্লাবে। এমন নির্জন রাতে অহরহই তারা এসব জায়গার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। কেননা ব্ল্যাকভেইন ব্র্যান্ড যেমন কেকে-কে ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমনি সেসব রেসিং ক্লাবগুলোও। সবার মূল আকর্ষণবিন্দুতে কেকেই সর্বদাই শীর্ষে অবস্থান করছে।
এর একটি বিশেষ কারণও রয়েছে। কেকে যে কেবল একজন প্রফেশনাল রকস্টার তা নয়,একইসাথে সে একজন প্রফেশনাল কার রেসারও। প্রায়শই দেশের বিভিন্ন কার রেসিং ইভেন্টে কড়া মূল্যে তাকে স্পন্সর করা হয়ে থাকে। আর এসব করেই,পারিবারিক অর্থ ব্যতীতও, আজ তার প্রচুর অর্থসম্পদ। যার বেশিরভাগই সে তার উগ্র,উশৃং’খল জীবন-যাপনের পেছনে ব্যায় করে থাকে।

এককথায় তার জীবনটাই বেশ অগোছালো। একইসাথে খুবই তুচ্ছ-সামান্য। বাবা-মা, পরিবারহীন একটা উগ্র-উম্মাদ ছেলে যেমন হয়,ঠিক তেমন। কোনো বাঁধা নেই, নিষেধ নেই, যখন যেটা ভাবছে সেটাই করে ফেলছে। এতে কার কতটুকু লাভ-ক্ষতি হবে,তাও যেন তার ভাবনাচিন্তার বহু বাহিরে।
এসব ছাড়া পুরো টিমেরই নানান সব বাজে স্বভাব তো রয়েছেই। সারাক্ষণ নে*শায় মত্ত থাকা। সারারাত কনসার্ট, ক্লাবে সময় পার করে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমানো। অগোছালো জীবনযাত্রা সহ সকল অনিয়মই তাদের সাথে মিলে যায়। এই যেমন আর কিছুদিন পর দেশে ফিরতে হবে বিধায়, উম্মাদ হয়ে এখন এসবে সময় নষ্ট করবে। আজ রাতের বাকি অংশটুকুও রেসিং ইভেন্টে কাটিয়ে,ভোর রাতের দিকে সবকটা বাড়ি ফিরবে। তবুও একেকটা মাতাল হয়ে। এরমধ্যে ইসাবেলা যে বাদ যাবে—এমনটা তো না ভাবাই উত্তম।

কাহসান কুঞ্জ’ কিংবা ‘কেকে মহল’ খ্যাত শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল রাজোচিত বাড়িটিতে আজ, এলাহী আয়োজন শুরু হয়েছে। আভিজাত্য শহরের বুকে অবস্থিত, এ বাড়িটিই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বিলাসবহুল ও রাজোচিত প্রাসাদ সমতুল্য। সাদা-কালো রঙের ক্লাসি সংমিশ্রণ, তার ওপর ছিটেফোঁটা সোনালী ছোঁয়ার স্পর্শ—যেন ঐশ্বর্যের নিজস্ব এক প্রতীক।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে হলে পার হতে হয় বিশাল আকৃতির কালো-সোনালী লোহার গেইট। যার সামনে সদা সতর্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে গাঢ় নীল পোশাকধারী নিরাপত্তারক্ষীরা। গেইট পেরোলেই চোখে পড়ে অপার সৌন্দর্যে ঘেরা বিস্তীর্ণ বাগান। নানা রঙের ফুল, গাছপালা ও সুগন্ধে ভরপুর সেই উদ্যানের মাঝখানে রয়েছে এক বিশাল আকৃতির ফোয়ারা। এছাড়া কাহসান কুঞ্জের পেছন দিকটায় রয়েছে, সুবিশাল এক সুইমিং পুল।
অথচ এতো বিপুল আয়তনের প্রাসাদমস্তক বাড়িটায়, মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। বহু বছর আগেই বাড়ির মালিক তথা শাহমীর কাহসান চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন। উত্তরসূরী হিসেবে রয়ে গেছেন তাঁর একমাত্র ছেলে—কেকে অর্থাৎ ‘কাশিফ কাহসান(KK)চৌধুরী।’ যিনি নিজেও দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাই আজ ‘কাহসান কুঞ্জ’-এর প্রকৃত মালিক বলতে এখানে কেউ নেই।

কুঞ্জজুড়ে এখন বসবাস মূলত অসংখ্য সার্ভেন্ট কিংবা অস্থায়ী মানুষজনের। তবে তাদের ভিড়েও স্থায়ীভাবে বসবাস করে মাত্র দু’জন—একজন জাভিয়ান হায়দার, আরেকজন এক অষ্টাদশী রমণী। আঠারো পার করে উনিশে পা দিতে বাকি আর কিছু মাস মাত্র। অথচ জীবনের প্রায় সমস্ত সময় সে কাটিয়েছে এই প্রাসাদের দেয়ালবন্দি নিঃসঙ্গতায়—পরিবারহীন, অথচ এক অজানা নিয়তির সঙ্গে বাঁধা একাকী জীবন নিয়ে।

একজন চমৎকার সুন্দরী মেয়ে বেশ ব্যস্ততার সঙ্গে, চারপাশের সার্ভেন্টদের নানান দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে। কেউ ফুল সাজাতে ব্যস্ত, কেউ আবার ঝাড়বাতির ধুলো মুছছে—সবাইকে সে নিখুঁতভাবে সামলাচ্ছে। মেয়েটির নাম ‘উম্মে হানি সুহিন’। সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে। তবুও আজ তাকে ক্লাস ফেলে,বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে এক বিশেষ কারণে।
আজ এই প্রাসাদেই ফিরবে কাহসান কুঞ্জের প্রকৃত মালিক, কেকে। বাড়িজুড়ে সাজসজ্জার জোয়ার, তবুও সুহিনের মনে তেমন কোনো আলোড়ন নেই। কেকে কেমন, কী স্বভাবের, এসব বিষয়ে তার আগ্রহের বিন্দুমাত্র ছোঁয়াও নেই। অবশ্য না থাকাটাও স্বাভাবিক। কেকের সাথে তার সম্পর্কটা খুব অদ্ভুত। লোকটা তার চেয়ে বয়সে বড়জোর চৌদ্দ-পনেরো বছরের বড় হবে। সুহিনের ধারণা মতে হিসেবটা ঠিক এমনই। অথচ এই লোকের নাম জড়িয়েই তাকে এক বিদঘুটে পরিচয় নিয়ে,এই সমাজে বাঁচতে হচ্ছে।
বছর বছর ধরে এই বাড়িতে থাকলেও, সে নিজেকে কখনও এর সদস্য ভাবেনি—শুধু আশ্রয়প্রার্থী এক মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থান মেনে নিয়েছে।

আজও বরাবরের মতোই, জাভিয়ানের নির্দেশ মেনে,সে কাজে লেগে পড়েছে। সুহিন জাভিয়ানকে সর্বদা আঙ্কেল সম্মধোন করে। সে একসময় তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। এবং সুহিনের বাবার মৃত্যুর পরই সে এবং তার মা এই কাহসান কুঞ্জে আসেন। যখন সুহিনের বয়স ছিল মাত্র সাত বছর।
অবশ্য এখন সে এক পরিণত রমণী।চোখে চিকন ফ্রেমের কালো চশমা, কোমর পর্যন্ত নেমে আসা গাঢ় বাদামি রঙের, ঢেউখেলানো হালকা কোঁকড়ানো সিল্কি চুল;পরনে সাদা লন কাপড়ের কুর্তি আর নীল জিন্স। সাথে সাদা-নীল ওড়না জড়ানো—সাধারণ কিন্তু পরিপাটি তার সাজসজ্জা। চলাফেরায় তার অদ্ভুত স্থিরতা, যেন দীর্ঘ অভ্যস্ততা তাকে শিখিয়েছে নিঃশব্দ শৃঙ্খলা।
সবচেয়ে নজরকাড়া—তার চোখদুটি। গভীর, নির্মল নীলচে চোখজোড়া যেন শান্ত সমুদ্রের পৃষ্ঠে, সূর্যাস্তের অমায়িক প্রতিফলন। প্রথম দেখায় তাকালে মনে হবে,এই নীল চোখের গহীনতায় লুকিয়ে আছে অজস্র গল্প। কিন্তু সেসব বলার মতো কেউই নেই।

জাভিয়ান তখন ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে, সুহিনের সঙ্গে কিছু আলাপ-আলোচনা করছে—নানান দিকনির্দেশনা নিয়ে।সুহিন মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল, ঠিক তখনই হঠাৎ বাড়ির বাইরের নির্জনতা ভেঙে ওঠে একটানা গর্জনের শব্দে।
ইঞ্জিনের গম্ভীর এক আওয়াজ…।একটার পর একটা কালো চকচকে গাড়ি প্রধান ফটক পেরিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ছে। মুহূর্তেই চারপাশে যেন এক অদৃশ্য উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। সার্ভেন্টদের মধ্যে ফিসফাস শুরু যায়,

“স্যাররা এসে গেছে মনে হয়…”
জাভিয়ান এগিয়ে যায় বিস্তৃত হাসি নিয়ে, ভদ্রতার নিখুঁত ভঙ্গিতে সবাইকে স্বাগত জানাতে। সুহিনও সরে দাঁড়িয়ে, সেদিকে ফিরে তাকায়।
দূর থেকে সে দেখতে পায়,কালো ফেরারি-পোর্শের মতো নামী-দামী গাড়ির দরজা খুলতেই, একে একে নেমে আসছে কয়েকজন সুদর্শন পুরুষ। এসব নতুন চকচকে গাড়িগুলো সব এই বাড়ি থেকেই এয়ারপোর্ট অব্দি পাঠিয়েছে জাভিয়ান নিজেই। কারণ কেকেই চেয়েছে,এতোবছর পর এই দেশে ফিরে তার চারপাশের সবকিছুই যেন তার পছন্দসই হোক। সুহিন এই রুক্ষ স্বভাবের লোকটা সম্পর্কে টুকটাক আন্দাজ রেখেছে। তাই সে এ-ও সিন্ধান্ত নিয়েছে,প্রয়োজন ছাড়া যতটা পারবে সে এদের থেকে দূরে থাকবে।

সুহিন চশমাটা খানিক চোখে ঠেলে নিয়ে,তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গাড়ি হতে নেমে আসা আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ, দামি পোশাকে সুসজ্জিত সেসব সুদর্শনকে সে বেশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। চারজন ব্যক্তির ঠিক মাঝবরার দাঁড়িয়ে আছে, গম্ভীর্যে মোড়ানো কেকে। এছাড়া পেছনের গাড়ি হতে আবার, বডিগার্ডগুলো একটা সাদা-কালো রঙের সাইবেরিয়ান হাস্কি বের করে আনছে। যা দেখে সুইনের চোখ-মুখ তৎক্ষনাৎ শুকিয়ে যায়। কারণ সে কুকুরকে অনেক বেশি ভয় পায়। ফলে সে মনে মনে বিরক্তির সহিত আওড়ায়,
“এসব কি ঝঞ্জাট এলো বাড়িতে।”

কেকে এক মুহূর্ত চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়—নিঃশব্দ, স্থির, কোনো অভিব্যক্তি ছাড়াই।পরনে তার,কালো লেদার জ্যাকেটের নিচে সাদা টিশার্ট। গলায় ব্ল্যাক ম্যাটালিক চেইনে ঝুলে থাকা ‘KK’ অক্ষর দু’টি নিখুঁতভাবে খোদাই করা।হাতে কালো ব্রেইডেড ব্রেসলেট, পায়ে কালো বুট, আর সেইসঙ্গে একদম কাঁধ পর্যন্ত এলোমেলো একঝাঁক চুল।
সবাই তাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে যায়।জাভিয়ানও মুচকি হেসে বলেন,
“Welcome home, K.K.”

তার সৌজন্যে অন্যরা হালকা হাসলেও, কেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে দাঁড়িয়ে থাকে একদম নিরাবেগ মুখে।চোখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, কণ্ঠে নেই একটিও অভিবাদন। যেন সে এসেছে বাধ্য হয়ে, ইচ্ছে নয়।
দূরে, সার্ভেন্টদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুহিনও চুপচাপ দৃশ্যটা লক্ষ্য করছিল।
তার দৃষ্টি একসময় থেমে যায় কেকের উপরেই। লোকটিকে শেষবার দেখেছিল সে ছোটবেলাতেই। এই বাড়িতে কেকের অসংখ্য ছবি রয়েছে। তবে সেসবই কেকের বাচ্চাকাচ্চা হতে টগবগ যুবক অব্দি নানান পর্যায়কালের। কেকে কাহসান কুঞ্জ ছাড়ার পর, তাকে আর তেমন কখনোই দেখার সুযোগ হয়নি সুহিনের।
সুহিন কেকের দিকে চেয়েই থাকতে থাকতেই ভারী শ্বাস ফেলে। তার চোখে বিস্ময় নেই, কৌতূহলও নয়—শুধু এক নিস্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ।লোকটা যে মা’রাত্মক সুদর্শন তা অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই। ফর্সা ত্বক,কাধ অব্দি ওল্ফকাটের একঝাঁক ডার্ক ব্লাক-ব্রাউন চুল,হালকা খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি, এ্যাশ-ব্রাউন চোখজোড়া—সবই যেন একদম নিখুঁত ও প্রচন্ড আকর্ষণীয়। সবমিলিয়ে অদ্ভুত তার উপস্থিতি—অলংকারহীন অথচ দৃশ্যপটে ঝড় তোলার মতো এক সুদর্শন পুরুষ সে।

তবুও সুহিনের মনে কোনো আলোড়ন ওঠে না। তার কাছে যেন, কেকে কেবলই এক অপরিচিত মানুষ। যার ফিরে আসা বা না আসা, তেমন কিছুই পরিবর্তন আনে না তার জীবনে। তাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই সে পেছন ঘুরে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরের দিকে,চলে যেতে থাকে।
আর ঠিক তখনই—কেকের তীক্ষ্ণ চোখজোড়া এক ঝলকে খুঁজে নেয় তাকে। সুহিনকে এখনো সে ঠিক চিনতে পারেনি। তবে সবাই যেখানে তাদের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে, সেখানে এই একটি মেয়ে…যে কিনা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, আগ্রহহীন হয়ে চলে যাচ্ছে!

তার এমন অবজ্ঞাত বিদায় কেকে-র চোখে মুহূর্তেই ধরা পড়ল। চোখের পলকে তার দৃষ্টি খানিক কুঁচকে উঠল। ঠোঁটের কোণে জমে ওঠে কঠিন এক সুক্ষ্ম রেখা। অনিমেষনেত্রেই সে বেশ সন্দিহান ভঙ্গিতে, রুক্ষকন্ঠে হাস্কিস্বরে আওড়ায়,
“হাউ ডেয়ার শী!”

Naar e Ishq part 2

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here