Naar e Ishq part 2
তুরঙ্গনা
রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে চলল। সারাটাদিন সুহিনের এদিক-সেদিক কাজকর্ম করেই পাড় হয়ে গেল৷ পড়াশোনা তো দূরের বিষয়,ঠিকমতো সময়ের খাবারটুকুও খাওয়ার সুযোগ হয়নি। অথচ এদিকে বাড়ির মেহমানদের রাতের খাবারের তোরজোরও শুরু হয়ে গিয়েছে।
অবশ্য সে কখন কি করলো না করলো,এসবের খোঁজখবর নেওয়ার মতো কেউই এই বাড়িতে নেই। বছরের পর বছর এভাবেই তার একাকী বিষন্ন জীবনটা অতিবাহিত হচ্ছে। যাতে নেই কোনো নতুনত্ব, নেই কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সবটাই যেন কেবলই তুচ্ছ্য।
সুহিন নিজের রুমের বারান্দায় একা একা বসে আছে। তার কোলে সাদা-ব্রাউন রঙের তুলোর মতো একটা অস্তিত্ব নড়চড় করছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা বিশিষ্ট তুলতুলে এই প্রাণীটা হলো হ্যামস্টার। প্রায় বেশ কয়েক বছর হতেই,এটি সুহিনের একাকিত্বের সঙ্গী হিসেবে আছে। বাড়িতে সে যতক্ষণ থাকে,ততক্ষণ তার একে নিয়েই সময় কেটে যায়। হ্যামস্টারটার অবশ্য একটা সুন্দর নামও আছে,তা হলো মাফিন। নামটা বেশ আদর-যত্ন করেই সুহিনই দিয়েছিল।
মাফিনের মতো হ্যামস্টারদের বৈশিষ্ট্য হলো এরা সারাদিনে ঘুমায় ও সারারাত জেগে থাকে। যথারীতি সুহিনের রাত জাগার সঙ্গী হওয়ায়, সুহিন তাকে ভীষণ ভালোবাসে।
সুহিন রাতের আকাশের পানে চেয়ে আছে। আশেপাশের কোনোকিছুতে তার খেয়াল নেই। নিজের চশমাটা খুলে নাকের ডগায় নেমে এসেছে। অথচ সে আনমনা। আজ হঠাৎ বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে। কত সুখী পরিবার ছিলো তাদের। অথচ একটি ঘন-কালো ঝড়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। প্রথমে বাবা, অতঃপর তার মা-টাও তাকে ছেড়ে চলে গেল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আজ আরো বেশি বিষন্ন লাগছে। সারাটাদিন চেষ্টা করেছে,ঐ লোকগুলোর সামনে না যাওয়ার। অচেনা-অজানা মানুষজন। তাও সবাই পুরুষমানুষ।বাড়ির বাদবাকি সার্ভেন্টদের বয়সও খানিক বেশি। অথচ পুরো বাড়িতে সে একা একটা অল্পবয়সী মেয়ে। কেমন যেন বিষয়গুলো তার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে, এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু তা-ও কি করে সম্ভব? সে এই মূহুর্তে যাবেটা কোথায়?
সুহিন পুনরায় হতাশায় নিমজ্জিত হয়। পাঁচজন লোকের মাঝে,গম্ভীরমুখো কেকে-কে সে চিনে নিয়েছে। এখন বাকি চারজনের মাঝে না চাইতেও,একজনের সাথে ইতিমধ্যে তার পরিচয় হয়ে গিয়েছে। ঘটনাটা বিকেলের দিকে। সে নিচতলার এককোণায় নিজের মতো কাজে ব্যস্ত ছিল। ফুলের টব সহ নানান জিনিসপত্র এদিক-ওদিক আনা-নেওয়া করছিল।
এরিমধ্যে আচমকা হঠাৎ এক ফর্সা ত্বকের চমৎকার সুদর্শন এসে তার সম্মূখে হাজির হলো। পরনে কালো হুডি-প্যান্ট, চুলগুলোও বেশ সিল্কি ও বড়বড় হওয়ায় এদিক-সেদিক কপালের উপর দিয়ে, হেলে পড়ে আছে। তবে সুহিনকে খানিক ভড়কে দিয়ে ব্যক্তিটি আচমকা তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“ওহ হাই! তোমার নাম কি?”
সুহিন কাজে ব্যস্ত ছিল বিধায়,আচমকা কারো অভিব্যক্তিতে সে খানিক চমকে, ব্যাক্তিটির দিকে ফিরে তাকায়। তার এমন ভাবগাম্ভীর্যের হঠাৎ তিনি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,
“আরে আরে, ভয় পেও না৷ এটা আমি।”
সুহিন ব্যক্তিটির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে। এটা কে সেটাই তো চিনতে পারল না। এরিমধ্যে সে আবারও তার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি সাদ, সাদ হাম্মাদি। তো মিস ভীতু,তোমার নামটা কি?”
এই পর্যায়ে সুইন আবারও খানিক অবাক হয়। মিস ভীতু বলতে কি বোঝালো? আর এমন হুটহাট অচেনা লোকজন এসে এসব কথা বলেই বা কিভাবে? সুহিনের প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগল।তবুও সে নিজেকে সামলে নিয়ে জোরপূর্বক মুচকি হেসে আওড়ায়,
“আ…আমি সুহিন।”
—“ওহ,হাউ সুইট।বেশ ইউনিক আর কিউট নাম তো। একদম তোমার মতোই।”
—“থ্যাংক ইউ।”
—“আচ্ছা তুমি কেকের কি হও? নাকি এই বাড়ির… দেখে তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।”
—“না, আপনি যেটা ভাবছেন আমি তেমন কিছুই। জাভিয়ান আঙ্কেলের জন্যই আমি এখানে থাকি।”
—“ওহ্, আচ্ছা। বেশ ভালোই হলো। এখানে সার্ভেন্ট ছাড়া আর তেমন কেউ নেই। কিন্তু তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে। মাঝেমাঝে আড্ডা দেওয়া যাবে।”
সুহিন সামান্য মৃদু হাসে। লোকটা খা’রাপ নয়, তবে কেমন যেন লাগছে তার। আপাতত এখানে আর থাকার ইচ্ছে নেই। সাদ আরো কিছু বলার আগেই,সুহিন তড়িঘড়ি করে বলল,
“বলছিলাম যে আমার অনেক কাজ বাকি আছে। যদি কিছু মনে না করেন,তবে… ”
এমনই কিছু ছুতো দিয়ে, সুহিন সেখান থেকে পালিয়েছে। এরপর চেষ্টা করেছে, নিচতলাতেও যেন যেতে না হয়। কিন্তু এখন তো বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। ঘড়ি দেখে মনে মনে হিসেব কষলো, সবার খাওয়া ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে কিনা। প্রায় আরো খানিকক্ষণ ভাবনাচিন্তার পর, সে উঠে দাঁড়ায়। মাফিনকে তার সুসজ্জিত খাঁচায় রেখে দিয়ে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। মাফিন এখন রাতভর খাঁচায় চাকা কিংবা টানেলে ঘুরে ঘুরে খেলা করবে।
বাড়ির মাঝবরাবর অবস্থানরত সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল সে। দোতলা হতে চারপাশে নজর ফিরিয়ে দেখে,এখনো ঐ লোকগুলোর কেউ আছে কিনা। তবে আশেপাশে কিংবা ডাইনিংএ তেমন কারো দেখা না পেয়ে, সে স্বস্তিতে ভারী শ্বাস ফেলে। এবং তৎক্ষনাৎ সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল।
সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল,তবে আচমকাই হুট করে কোথা থেকে যেন কালো পোশাকধারী কেকে চলে এলো। গম্ভীরমুখখানা খানিক ঝুঁকিয়ে,কালো জ্যাকেকটায় হাত গুঁজে নির্বিকার ভঙ্গিতে দোতলার দিকে এগোচ্ছে। অথচ এদিকে সুহিনের পা-জোড়া থেমে গিয়েছে। সে সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে কোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে কেকে আশেপাশে একবারও নজর ফেরানোর প্রয়োজন মনে না করে, গটগট করে দোতলায় চলে গেল।
সে চলে যেতেই সুহিন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মাথাটা নুইয়ে দ্রুত পায়ে নিচে চলে এলো। এসব উদ্ভট মানুষজন থেকে যতটা পারা যায়, দূরে থাকাটাই উত্তম।
পরদিন সকাল সকালই ভার্সিটিতে চলে এসেছে সুহিন। ইচ্ছে করেই, আগেভাগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। যথারীতি ক্লাস শুরু হতেও এখন প্রায় বেশ খানিকক্ষণ দেরি। সুহিন ভার্সিটির ক্যান্টিনে চুপচাপ বসে আছে। ভেবেছিল আজ এতো তাড়াতাড়ি আসায় হয়তো,সেভাবে কারো দেখা পাবে না। কিন্তু না! আশ্চর্যজনক ভাবে এখন তার সম্মূখে, এক জলজ্যান্ত মানব বসে আছে।
—“আরহাম ভাই,একটা সলিউশন দিন। আমি বুঝতে পারছি না,আমার কি করা উচিত।”
সুহিন হতাশায় মাথা নুইয়ে বসে আছে। তার সম্মূখে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। অথচ সে এখন প্রায় মনমরা।গাঢ় বাদামী হালকা কোঁকড়ানো সিল্কি চুলগুলো,এলোমেলো ভাবে কোমড় অব্দি ছড়িয়ে আছে। চোখের চশমাটাও নাকের ডগায় নেমে পড়েছে। তাকে সর্বপরি পরখ করল একজোড়া মুগ্ধচাহনি।
সুহিনের সম্মূখে যে বসে আছে,তার নাম ‘দানিয়েল আরহাম’।পরনে তার সাদা লেদার জ্যাকেট,গ্রে-টিশার্ট আর কালো প্যান্ট।চুলগুলো সুসজ্জিত।ঠোঁটের কোণে সর্বদার ন্যায় দৃশ্যমান মৃদু হাসি।
সুহিন সবেমাত্র ভার্সিটিতে উঠলেও,সে এই ভার্সিটিরই মাস্টার্সের স্টুডেন্ট। অথচ সুহিনের সাথে তার পরিচয়টা বেশ পুরোনো। তার এক ছোট বোনের সূত্রপাতেই সুহিনের সাথে পরিচয়। দুজন এতো সিনিয়র-জুনিয়র হওয়ার পরও,তাদের মাঝে দৃঢ় এক সখ্যতা রয়েছে।
দানিয়েল দেখতে চমৎকার সুন্দর। পোশাকআশাক, সাজসজ্জা সবকিছুই তার পরিপাটি। ফর্সা ত্বক,গোছানো সিল্কি চুল,মনোমুগ্ধকর কন্ঠস্বর কিংবা অভিব্যক্তি—সবকিছুতেই এককথায় সে অতুলনীয়।
হতাশায় নিমজ্জিত সুহিনকে দেখে,দানিয়েল মৃদু মুচকি হাসে। ঠোঁটে কফির কাপটা একবার ছুইয়ে,পরক্ষণেই তা টেবিলের উপর রেখে দেয়। অতঃপর সুহিনের নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা আলতোহাতে ঠেলে দেয়। নিমিষেই সুহিন খানিক চমকে ওঠে। তবে তৎক্ষনাৎ সে নিজেকে সামলে নেয়। এদিকে দানিয়েল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলতে লাগল,
“বউপাখি,জীবনে সমস্যা থাকবেই। তাই বলে সব সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে,পালাতে চাওয়াটা কি আবশ্যক?”
দানিয়েলের প্রথম কথাতেই,সুহিনের কপাল কুঁচকে যায়। সে ভ্রুকুটি করে বলল,
“সেসব বাদ দিন। আগে আপনি এটা বলুন—আপনি আমায় ‘বউপাখি’, ‘বউপাখি’ করেন কেনো?”
দানিয়েল তার কথায় অপ্রস্তুত হলো না। বরং সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে বলল,
“কেনো কোনো সমস্যা?”
—“না,সমস্যা নয়… কিন্তু…”
—“তোমাকে আমি আগেও বলেছি,এটাকে স্বাভাবিক ভাবে নাও। বউমাছের মতো বউপাখিও হয়। সে একটা চমৎকার সুন্দর পাখি। যাকে দেখতে সম্পূর্ণ তোমার মতোই। আর এইজন্য আমি তোমায় বউ পাখি বলি।”
সুহিন এবার খানিক জোর দিয়ে বলল,
“মিথ্যে কথা। আমি গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম। বউ পাখি বলতে কোনো পাখি নেই।”
তার এমন সহজসরল অভিব্যক্তিতে, দানিয়েল আবারও হেসে ফেলে। পরক্ষণেই খানিক গম্ভীর স্বরে বলে,
“তাকে তুমি গুগলে পাবে কি করে? সে তো আমার মন-মস্তিষ্কের কল্পনায় থাকে।”
সুহিন ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে রইল। সে কোন টপিকে কথা বলতে এসেছিল,আর এখন এসব কি বকছে। সে যাই হোক, সুহিন পুনরায় নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলল,
“এসব বাদ দিন, আপনার বেশিরভাগ কথাই আমার বুঝে আসে না। সে যাই হোক,এবার বলুন তো, আমি ঐ জল্লাদের পাল থেকে বাঁচবো কি করে? ঐ বাড়িতে আমার এমনিতেও ভালো লাগে না।”
—“জল্লাদ বলছো কেনো? ওরা তোমায় কিছু করেছে?”
—“না, তেমন কিছু করেনি। কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তিকর। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
সুহিন পুনরায় মনমরা হয়ে মাথা নুইয়ে নেয়। এদিকে দানিয়েল ওর বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে ভারী ফেলল। পরক্ষণেই কি যেন মনে হতেই,সে অকস্মাৎ বলে উঠল,
“আচ্ছা কেকে-ই তো তোমার সম্পর্কে বা…”
—“ভাইয়া প্লিজ!”
দানিয়েলের কথা শেষ হবার আগেই,সুহিন তাকে থামিয়ে দেয়। সে-ও তার ভুল বুঝতে পেরে,নিজের প্রতি বেশ বিরক্ত হয়। তৎক্ষনাৎ প্রসঙ্গ ফিরিয়ে নিতে,সে আবারও বলে ওঠে,
“আ’ম সরি।…আ…তুমি কি কিছু ভেবেছো…কি করবে?”
—“জানি না, তবে ভাবছি হোস্টেলে উঠে যাব।”
—“হোস্টেলে?”
—“হুম,এটা করা কি ঠিক হবে?”
—“উমমম…আপাতত মনে হচ্ছে না, এসবের কোনো প্রয়োজন আছে। তুমি এসব নিয়ে যত ভাববে ততই সমস্যা হবে। তারচেয়ে তাদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করাটা বন্ধ করে দাও। আর যদি চাও, তবে একটা কাজ করতে পারো।”
—“কি?”
সুহিন উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। সে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল,
“তুমি নিমরার সাথে ওর বাসাতেই থাকতে পারো। এমনিতেও ও নিজেও একা একাই থাকে। আপাতত দুজনে একসাথে থাকো,তারপর না হয় পরিস্থিতি বুঝে…”
—“আমাকে ছাড়া আমাকে নিয়েই কথা হচ্ছে?”
আচমকা দানিয়েলের পেছন হতে একজন গম্ভীর মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো। সুইন আর দানিয়েল একত্রে নজর ফিরিয়ে সেই মেয়েটির দিকে তাকায়। পরনে কালো ওয়েস্টার্ন গাউন, তার উপর গ্রে-জ্যাকেট। সিল্কি চুলগুলো ঠিক কাঁধ অব্দি লম্বা৷ আর এই বেশ গম্ভীরসরূপ মেয়েটির নাম হুরাইন নিমরা।
নিমরা সুহিনের স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। যথারীতি এখন ভার্সিটিতেও সে তার ক্লাসমেট। অন্যদিকে দানিয়েল আর নিমরা সম্পর্কে কাজিন হয়। তাদের দুজনের পরিবারই চট্টগ্রামে থাকে। আর পড়াশোনার সুবাদে তারা দুজন ঢাকায়।
দানিয়েল মৃদু হেসে নিমরার উদ্দেশ্যে বলল,
“ওহ,তুই। এদিকে এসে বস।”
তার অভিব্যক্তিতে,নিমরা ভ্রু উঁচিয়ে ভারী শ্বাস ফেলল। অতঃপর দুজনের মাঝে টেবিলের একপাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
—“ঘটনা কি? তোমরা কি নিয়ে এতো আলোচনা করছো?”
সুহিন তার দিকে ফিরে ভারী শ্বাস ফেলল। এসব ঘটনা আর কি বাড়িয়ে বলার আছে। তবে নিমরা তার সবচেয়ে ক্লোজ হওয়ায়,না বলেও কোনো উপায় পাচ্ছে না। এদিকে সবকিছু শোনার পর, সুহিনের সাজেশনের পরিবর্তে আচমকা নিমরা বলে ওঠে,
“এক সেকেন্ড, এখানে একটা ঝামেলা আছে।”
—“ঝামেলা মানে? আবার কিসের ঝামেলা?”
নিমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,
“না…মানে…সুহিন তুই শুনেছিস আমাদের ভার্সিটিতে নতুন দুইজন প্রফেসর আসছে।”
সুহিন খানিকটা ভেবে নিয়ে,মাথা ঝাকায়। ওদিকে নিমরা আবারও জিজ্ঞেস করে,
“তুই তাদের নাম জানিস?”
—“কি আশ্চর্য, আমি তাদের চিনি নাকি। আর ওনারা কি আমাদের ক্লাস নিয়েছে এখনো? তাহলে কিভাবে নাম জানবো?”
নিমরা যেন তার কথায় খানিক বিরক্ত হলো। ভার্সিটিতে দুজন প্রফেসর এসেছে,তা নিয়ে সবার মধ্যে কতসব কাহিনি।অথচ এই মেয়েটা দুনিয়ার কোনোকিছুতেই খবর রাখে না।
—“দুজনের মাঝে একজনের নাম কেকে। এখন আমার প্রশ্ন, এই কেকে কি সেই কেকে?”
নিমরার কথা শুনে সুহিনের চোয়াল খুলে এলো।এসব বলে কি? এদিকে দানিয়েলও খানিক ভেবে নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ,এমন কিছু আমার কানেও এসেছে।”
—“মানে কি? ওই লোক এই ভার্সিটিতে? তা কি করে হয়,আমি তো জানি উনি বিদেশে গান গায়।”
—“হতেও পারে, এই ভার্সিটিতে আগে থেকেই তো কাহসানদের বিশেষ প্রভাববিস্তার করছে। তোমার জাভিয়ান আঙ্কেলের সাথেও তো আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপালের ভালো সম্পর্ক। সেক্ষেত্রে এমনটা হলে,তা অসম্ভব কিছু না…”
দানিয়েলের কথা সুহিন শেষ হতে দিলো না। তারমধ্যেই সে বলে উঠল,
“নাহ, এটা কি করে হয়? আচ্ছা, এই প্রফেসর কেকে কোন ডিপার্টমেন্টে পড়াবে?”
—“শুনলাম তো সোসিওলজি। এর মানে আমাদেরও একটা দুইটা ক্লাস নিতে পারে।”
নিমরার কথা শুনে সুহিন কিছুক্ষণ থম মে’রে থাকে। পরক্ষণেই অকস্মাৎ হেসে ফেলে। তার হাসিতে দুজনের কপাল কুঁচকে যায়। নিমরা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“কাহিনি কি? হাসছিস কেনো?”
—“তো হাসবো না? ঐ লোক সমাজ-সংসার মানে নাকি? তার তো নিয়ম-নীতি, সভ্যতা-ভদ্রতা কিচ্ছু নেই। আর সে নাকি স্টুডেন্টদের সমাজ-জ্ঞান দিতে সোসিওলজি পড়াবে।”
তার কথা শুনে দুজনের তেমন যেন হাসি পেল না। দুজনে চোখ ছোট ছোট করে সুহিনের দিকে তাকিয়ে রইল।সবার এমন ভাবগম্ভীর্যে সুহিন খানিক তব্দা খেয়ে যায়।
—“কি হলো?”
—“এটা মোটেও হাসি বিষয় নয় সুহিন।যদি দেখো এটাই সেই কেকে। তখন কি করবে?
দানিয়েলের কথায় সুহিন আবারও থমকে যায়। এ কোন ঝামেলায় পড়ল।
যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এ কথা যেন হাড়ে হাড়ে মিলে গিয়েছে আজ। সন্ধ্যা হওয়ারও প্রয়োজন পড়েনি। বরং সকাল সকালই এই কেকের গম্ভীর মুখখানা দেখতে হচ্ছে সুহিনকে।
জীবনে এমন কিছু কল্পনাও করেনি। অথচ আজ এটাও বুঝে গেল,টাকা আর ক্ষমতা
মানুষকে কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যায়। জীবনে সমাজের ধার না ধরা মানুষটা আজ, ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্টদের সমাজের জ্ঞান দিতে এসেছে।
ক্লাসের একদম কোণায় বসে আছে সুহিন আর নিমরা। নিমরা অতিরিক্ত কথা বলতে পছন্দ করেনা। বেশিরভাগ সময় নিরবেই থাকে। অন্যদিকে সুহিন হলো খাঁটি ইন্ট্রোভার্ট। যথারীতি স্টুডেন্ট হিসেবে তারা যথেষ্ট ভালো হলেও,ক্লাসে তাদের দেখা মেলে একদম শেষের কোণা-কানায়।
সবার নজর এখন ক্লাসের মধ্যিখানে অবস্থানরত কেকের দিকে। সম্পূর্ণ ক্লাসে ছমছমে নিরবতা। কেকে ক্লাসে প্রবেশ করার আগেই, প্রিন্সিপাল নিজে এসে সবাইকে সতর্ক করে গিয়েছে। একইসাথে প্রিন্সিপালের সতর্কবার্তা যেন মিলেও গিয়েছে।
এমন গম্ভীর মানুষ কেউ আগে কখনো দেখেছে কিনা কে জানে। তবে মেয়েগুলো বেশ বেহায়ামি করছে। চুপচাপ রইলেও, এমন সুদর্শনের থেকে কি আর চোখ ফেরানো যায়? যথারীতি অতিউৎসাহী মেয়েগুলোর ছোঁ-ছোঁ করার ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
তবে সবটা টের পেয়েও কেকে সম্পূর্ণ চুপচাপ থেকে নিজের কাজ করছে। হোয়াইটবোর্ডে একটা পর একটা কিসব লিখে যাচ্ছে। চোয়াল শক্ত,ওল্ফ কাটের চুলগুলো বরাবরের মতোই এলোমেলো। গায়ে কালো ট্রেঞ্চ কোট। বাকিসব পোশাকআশাকও কালো। অন্যসবার মতো একদম গোছালো না হলেও, বিদেশী কোনো প্রফেসরের মতো ঠিকই তার আবহ।
এদিকে সুহিন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রইলেও, তার পাশে বসে থাকা নিমরা খানিকটা বিরক্ত। সে আঁড়চোখে সবটা পরখ করার পর, ভারী শ্বাস ফেলে বলল,
“এসব হচ্ছেটা কি? ক্লাস তো নয়, যেন ম’রা শ্মশান ঘাট।”
তার কথায় সুহিন বোকা বোকা চাহনিতে, খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“তোর তো এমন নীরবতাই ভালো লাগে। তাহলে… ”
—“তাই বলে একটা ক্লাস মাছের বাজার থেকে সোজা শ্মশানঘাট হয়ে যাবে? এটা কোনোমতেই মানতে পারছি না।”
তার এমন কথায় সুহিন ভারী শ্বাস ফেলে। এ মেয়ে আরো একটা পাগল। কখন কি চায়, নিজেও জানেনা। এদিকে কেকে সম্পূর্ণ বোর্ডটা লিখে ভরিয়ে দেওয়ার পর, পেছনে ফেরে। অতঃপর আবারও মাথা নুইয়ে বইয়ের দিকে তাকায়। হাতের মার্কারটা নিখুঁত ভঙ্গিতে বারংবার দু’আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে ঘুরাতে থাকে।
সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। কেকে নিজের মুখখানা উৎসুক জনতাকে দেখারও সুযোগ করে দিয়েছিল। তবে এরিমধ্য যখনই নিমরা কেকের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই, সুহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
“এই কেকে মানেটা কি?”
নিমরা কেকের পূর্ণাঙ্গ নামটা জানতে চাইছে। তা সুহিন ভালোমতো বুঝতে পারলেও, কেকের দিকে একটানা বিরক্তির চাহনিতে থাকতে থাকতেই, সে খানিক তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে ফেলে,
“কালা কাউয়া।”
ওমনি নিমরা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে, কপাল কুঁচকে বলে,
“কিহ্?”
সুহিনের ধ্যান ভেঙে আর উত্তর দেওয়ার সুযোগটুকু হয়না। বরং তার আগেই আচমকা, মাথা নুইয়ে বইয়ে নজর রাখা কেকে—নিজের মার্কার ধরা হাতটা সুহিনের দিকে উঁচিয়ে, ভারিক্কি স্বরে নিরেট কন্ঠে বলে ওঠে,
“হেই ইউ,চশমিশ!”
তার অভিব্যক্তিতে চারপাশের সকলে চমকে, তার হাতের দিক-ইশারা পরখ করে সরাসরি সুহিনের দিকে তাকায়। কম করে হলেও,কেকে হতে তার দূরত্বে ব্যাপক ফারাক রয়েছে। অথচ কেকের নিশানাটা ঠিক গিয়ে, তার অব্দিই ঠেকেছে।
Naar e Ishq part 1
এদিকে সুহিন বিস্ময়ে থমকে গিয়েছে। তার আশেপাশে চশমা পড়া সে ব্যতীত আর তেমন কেউই নেই। কিন্তু শুধু যে এই একটি কারণেই,কেকের নির্দেশিত ব্যক্তিটিকে সে নিজে ভেবে নিয়েছে—বিষয়টা তা নয়৷ এই ডাকটার সাথে সে পূর্ব-পরিচিত। যে কারণে সে না চাইতেও ভড়কে গিয়েছে।
এদিকে কেকে মাথা তুলে সরাসরি তার দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এবং সকলের সাথে সাথে সুহিনকেও বেশ অবাক করে দিয়ে, দাঁতে দাঁত পিষে আওড়ায়,
“ক্লাসে কথা বলা, নট এলাউড। সো যাস্ট গেট আউট—রাইট নাউ।”
