Naar e Ishq part 6
তুরঙ্গনা
‘এটা তো কিছুই না। আমার কথা না শুনলে, সোজা টুকরো টুকরো করে কে’টে নর্দ’মায় ভাসিয়ে দেবো। আর তুই খুব করেই জানিস—আমি ঠিক কি কি করতে পারি।”
সুহিন স্তব্ধ নয়নে কেকের দিকে চেয়ে থাকে। কেকে তৎক্ষনাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে তির্যক হেসে বলল,
“গুড নাইট!”
এই বলেই সে চলে যেতে পা বাড়ায়। তবে হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই,পুনরায় পেছন ফিরে সুহিনের উদ্দেশ্যে ভারিক্কি স্বরে, চাপা-গম্ভীর কন্ঠে আওড়ায়,
“খবরদার! প্রয়োজন ছাড়া তোকে যেন, অসময়ে কোথাও না দেখি। আই রিপিট,কোথাও না!”
সুহিন তার এহেন অভিব্যক্তিতে তব্দা খেল। সে আবার কখন কোথায় অসময়ে-অপ্রয়োজনে যায়? বেশিরভাগ সময় তো সবার থেকে দূরেই থাকে। অথচ এই লোক বলে কিনা…
সুহিনের ভাবনার মাঝেই,কেকে সোজাসুজি দরজাটা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এসব নতুন নয়! সুহিন এরূপ কেকের সাথে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। সে জানে কেকে এক অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের মানুষ। এবং কালের পরিক্রমায় যে একইসাথে হয়ে উঠেছে রহস্যময়।
সুহিনের কাছে তার ভাবগম্ভীর্য বেশ অদ্ভুত ঠেকছে। এতোবছর পর এই বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য কি কেবল—সাময়িক সময়ের জন্য কাহসানদের নাম উজ্জ্বল করা, নাকি আদতে তা ভিন্ন কিছু!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজও সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে,সুহিন কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আজ ভার্সিটিও রয়েছে বিধায়, সারাদিনের কাজগুলো সে সার্ভেন্টদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিচ্ছে। কেকেরা যেদিন এসেছে,তার পরদিনই জাভিয়ান কাজের ক্ষেত্রে বাহিরে গিয়েছে। হয়তো আর দুই-এক দিনের মধ্যে ফিরেও আসবে।
এমনটা নতুন না। জাভিয়ান বেশিরভাগ সময়ই কাজের ক্ষেত্রে বাড়ির বাহিরে থাকে। তবে সে বাড়িতে থাকলে,সুহিনের কিছুটা সুবিধা হয়। আবার যবে থেকে সুহিন ঠিকমতো বাড়ির কাজগুলো বুঝে গিয়েছে,তবে থেকে জাভিয়ান আর কারো উপর তেমন ভরসাও করতে পারেনি। এইসবকিছুই সুহিন জানে। তাই কখনো ইচ্ছে জাগলেও,সে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে কোথাও গিয়ে দুদিন থাকতেও পারে না।
সুহিন একজন ছেলে সার্ভেন্টকে সাথে নিয়ে বাড়ির বাহিরে এলো। বাড়ির বাহিরে নাকি ছেলেরা সবাই শরীরচর্চা করছে। আগের দু’দিনও ভোর বেলাতেও করেছে। কিন্তু সুহিন নিজের কাজ আর ঘরে ব্যস্ত থাকায়, এদিকে কি হচ্ছে তা দেখতে আসেনি।
তবে এইমূহূর্তে সার্ভেন্ট ট্রে-তে করে একেকজনের চাওয়া মোতাবেক নানান ড্রিংকস্ বানিয়ে এনেছে। যেসব ইন্টারনেট ঘেঁটে সুহিন নিজেই বানাতে সাহায্য করেছে। আর এখন সেই সার্ভেন্টের সাথে নিজেও এসেছে।
কিন্তু বাড়ির বাহিরে পা দেওয়া মাত্রই, সুহিনের পা’জোড়া থমকে যায়। এটা সে কোথায় এসে পড়ল! ভোর বেলায় বিশাল কাহসান কুঞ্জের বিস্তৃত বাগানের সবত্রে পেঁজা তুলোর ন্যায় কুশায়া উড়ে বেড়াচ্ছে। চারপাশে সজীব গাছগাছালি,নানান রঙের দৃশ্যমান সকল ফুল-ফল।
অথচ সুহিনের নজর আঁটকে গিয়েছে চারপাশের পরিবেশ থেকে। বাগানের বিভিন্ন জায়গায় ম্যাট বিছিয়ে চারজন বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন এক্সারসাইজ করছে। সাথে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছে,ছোট বড় ডাম্বেল, বারবেল, কেটলবেল সহ নানান সব এক্সারসাইজের জিনিসপত্র। বাড়ির বাগান তো নয়, যেন কোনো এক ঘুর্ণিঝড়ে গড়ে ওঠা জিম এরিয়া।
সুহিন সবটা দেখে বেশ হতাশ হলো। এইলোকগুলো কেমন যেন অগোছালো। বাড়িতে এসেই সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে। তবে এইসব বিষয় সুহিন মনের মাঝে চেপেই, তাদের দিকে এগিয়ে যায়। সার্ভেন্ট গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় ড্রিংকস্ সহ বাদবাকি জিনিসগুলো একে একে এগিয়ে দেয়। আজকের মতো প্রায় সকল যোগব্যায়াম শেষ।
এদিকে সাদের নজর সুহিনের দিকে পড়তেই সে খুশিতে বেশ গদগদ হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। সাদের পরনে বাকিদের মতোই টিশার্ট-টাউজার। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সে সুহিনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতেই, আচমকাই নিজের টিশার্ট খুলে ফেলে অর্ধনগ্ন হয়ে যায়। তার ফর্সা ধবধবে পেশীবহুল বলিষ্ঠ দেহ এভাবে দেখতে পেয়ে,সুহিন নিজেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মনে মনে হতাশ হয়ে আওড়ায়,
“এই লোকটা এমন কেনো। হুঁশ-আক্কেল কিচ্ছু নেই।”
এবং তার কথামতোই, সাদ সেসব বিষয়ে কোনো গুরুত্ব না দিয়েই সুহিনের কাছে এসে, হাসতে হাসতে আওড়ায়,
“আরে আরে মিস ভীতু যে। আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে।…উফ সরি,এখনো সূর্য ঠিকমতো ওঠেনি। যাই হোক, গুড মর্নিং। ভালো আছো নিশ্চয়।”
সুহিন তার কথায় অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে শুষ্ক হেসে, ইতস্তত হয়ে আওড়ায়,
“এই তো ভালো। আপনি ভালো আছেন?”
—“অবশ্যই। আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি। আর তোমার মতো ইউনিক পিসকে চোখের সামনে পেলে,আরো বেশি ভালো হয়ে যাই। সচারাচর তোমার মতো দুর্লভ জিনিসের দেখা তো আর মেলে না।”
এই বলেই সাদ হেসে ফেলল। তার সাথে সাথে সুহিনও জোরপূর্বক মৃদু হাসে। এরিমধ্যে সাদ আবারও বলল,
“আচ্ছা শোনো, গতকাল না আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখার মতো তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম না। ঐ ফারিস গাধা নাকি সব চেনে,অথচ…হোয়াট এভার, তুমি তো এখানে ছোটবেলা থেকেই থাকো। তাহলে নিশ্চয় অনেক কিছুই ভালোমতো চেনো। একদিন সময় করে আমাকে কোনো স্পেশাল জায়গায় ঘুরাতে নিয়ে যেও তো!”
এই বলেই সাদ উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সুহিন এতে পুরো বোকা-বনে যায়। এতোমানুষ থাকতে শেষে তাকেই? এই মূহুর্তে আর কথা বাড়াতে না চেয়ে,সে আনমনেই আওড়ায়,
“আচ্ছা ঠিক আছে,নিয়ে যাবো।”
—“কোথায় নিয়ে যাবে?”
সাদ নিজের স্মুদি খাচ্ছে,একইসাথে তার দিকে বারংবার উৎসুক ভঙ্গিতে চেয়ে কথাবার্তা বলছে। কিন্তু সুহিনের ইচ্ছে হচ্ছে এখান থেকে দ্রুত পালাতে। এরিমধ্যে সে আঁড়চোখে কয়েকবার কেকেরও খোঁজ করেছে। সবাই আছে,কিন্তু সে কোথায়?
—“আ…অনেক জায়গাই তো আছে। আপনাকে না হয়… ”
সুহিনের কথা আরম্ভ হবার আগেই, সমাপ্ত হলো। হঠাৎ দূর হতে কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দে সে চমকে উঠল। বাড়িতে কুকুর এলো কোথায় থেকে?সে আশেপাশে ফিরে তাকাতেই অকস্মাৎ নজর আঁটকে গেল।
বাড়ির পেছনের দিক হতে জগিং করতে করতে, ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়ির সামনের দিকটায় কেকে এগিয়ে আসছে৷ ঘাড় অব্দি ছুঁড়ে থাকা এলোমেলো চুল,কপালের পাশে ঝড়ে পড়া মৃদু ঘাম,পরনে কালো ট্রাকসুট-সু। সবমিলিয়ে এমন পরিস্থিতিতেও তার সাজসজ্জা, বহিঃবাহ্যিক রূপ চমৎকার। চোখে-মুখের ভাবভঙ্গি সেই একই রকমের গম্ভীর। আশেপাশে কোনোদিকেও ফিরে তাকানোরও যেন কোনো সময় নেই।
তার সাথে সাথে সাইবেরিয়ার সাদা হাস্কি কুকুরটাও এগিয়ে আসছে। কেকের পছন্দের সবকিছু কালো হলেও,সম্পূর্ণ সাদা রঙের নজরে পড়ার মতো এই কুকুরটাই আছে।
সুহিনের মনে পড়ে গেল,সেই প্রথম দিনের কথা। এই কুকুরটাকে সে গাড়ি থেকে এইলোকগুলোর সাথেই নামতে দেখেছিল। কিন্তু তারপরই আর কখনো নজরে পড়েনি। সে কি অন্ধ নাকি?, বাড়িতে এতো বড় কুকুর ছিল, অথচ এটাকে এইকয়েকদিন তার নজরেই পড়েনি?
এদিকে সুহিনের নজর লক্ষ করে কেকের দিকে পড়তেই, সাদ বিস্তৃত হেসে বলল,
“ঐ তো, কেকে আর টমি এসে পড়েছে।”
তার কথা শুনে, সুহিন আগ্রহবশত বলে ফেলল,
“ঐ কুকুরটার নাম টমি?”
—“হুম, ওটা কেকের জান। আরো একজন আছে। তাকে অবশ্য রেখে আসা হয়েছে।”
সুহিনের জিজ্ঞেস করতে হলো, সে আবার কে! তার নামই বা কি। কিন্তু সেসব প্রশ্ন না করে, দূরে মৃদুমন্থরে ছুটতে থাকা কেকে আর টমির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই,সে বলল,
“এই টমি এতোদিন কোথায় ছিল? এই দুদিন তো ওকে…”
—“আরে মেয়ে,তুমি থাকো কোন দুনিয়ায়?”
সাদের বিস্ময়ে ঘেরা অতিরঞ্জিত ভাবভঙ্গিতে, সুহিন কেকে ও টমি হতে নজর সরিয়ে, তার দিকে ফিরে তাকায়।এদিকে সাদ স্বাভাবিক হয়ে বলতে লাগল,
“এই বাড়িতেই তো থাকো। অথচ… যাই হোক,টমিকে কিছু ট্রিটমেন্টের জন্য পেট-সেন্টারে পাঠানো হয়েছিল। এখন অবশ্য ও ভালোই আছে।”
সুহিন আর কিছুই বলল না। সে নজর ফিরিয়ে আবারও পাশে তাকায়। তৎক্ষনাৎ হৃদপিন্ড থমকে গিয়ে,কলিজটা অব্দি শুকিয়ে এলো।কেকে আর টমি নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে,অনেকটাই তাদের দিকে এগিয়ে এসেছে। হুট করে এরা এতো কাছে কখন এলো?
কেকে গম্ভীরমুখে তাদের দিকেই তাকিয়ে। নাহ্! নেকড়ের ন্যায় সরু-শান্ত তীক্ষ্ণ চোখজোড়া যেন শুধুমাত্র তার দিকেই নিক্ষিপ্ত। টমি নামক নেড়কের ন্যায় দেখতে কুকুরটাও উগ্র ভঙ্গিতে তার পাশেই হাঁক-ডাক করে লম্ফঝম্প করছে। কেকের ওল্ফ কাটের চুলগুলো কিংবা ভাবগাম্ভীর্যের বর্ণনের মতোই টমিটাও দেখতে খানিক নেকড়ের মতো। যা আগে খেয়াল না করলেও,একত্রে দুজনের এমন রূপের ভাবগম্ভীর্যে সুহিন হতভম্ব।
সে অকস্মাৎ তীব্র অস্বস্তিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে। চারপাশে আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখে,কেকের মতো ফারিস নামের লোকটাও খানিকক্ষণ পরপর তাকিয়ে তাকিয়ে সবার সাথে সাথে তাকেও দেখতে। সুহিন কোনো বিশেষ কারণ ব্যতীতই, হুট করে আরো ঘাবড়ে যায়। কোনো দিক-দিশা না পেয়ে, বরাবরের মতোই তড়িঘড়ি করে সাদের উদ্দেশ্যে আওড়ায়,
“সরি,আমি চললাম।আমার… আমার কাজ আছে।”
এই বলেই সে দ্রুত নিজের মাথা নুইয়ে, বাড়ির ভেতরের দিকে ছুটে যায়। অন্যদিকে সাদ তাজ্জব বনে গিয়ে, সুহিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
—“কি আশ্চর্য! এই মেয়ে এমন কেন?”
পরক্ষণেই পাশে ফিরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা, কেকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিরে,তুই আবার এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? এদিকে আয়। তোর কিসব ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসে তো মাছি এসে পড়বে।”
Naar e Ishq part 5
তার কথায় কেকে চোয়াল শক্ত করে।তবে কোনো প্রত্যুত্তর করল না। বরং সুহিনে যাওয়ার পানে শান্ত-ক্ষুব্ধ চাহনিতে আঁড়চোখে তাকিয়ে রয়ে,দাঁতে দাঁত পিষে আওড়ায়,
“বলেছিলাম,প্রয়োজন ছাড়া অসময়ে যেন কোথাও না দেখি। কিন্তু আবারও আমার কথার খেলাপ হলো!”
