মহাপ্রয়াণ পর্ব ১+২
নাফিসা তাবাসসুম খান
সাল ১৫১৪,
বিশাল কামরার মাঝে হীরা খচিত সিংহাসনে চিন্তিত হয়ে বসে আছেন কাউন্ট লিও। তার পাশেই থাকা আরেকটি সিংহাসনের দিকে তার বাদামী চোখের দৃষ্টি স্থির। প্রধান সেনাপতি লুকাস কাউন্টের চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পায়। কাউন্ট লিও বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে কখনো দ্বিতীয় বার ভাবেন না। এই প্রথম নিজের কাউন্টের চোখে এতো দ্বিধা এবং হতাশা দেখতে পায় লুকাস। সে খুব রয়েসয়ে কাউন্টকে প্রশ্ন করে,
” আমার কৌতুহল মার্জনা করবেন কাউন্ট, কিন্তু আপনার সিদ্ধান্ত কি আমি জানতে পারি? খুব শীঘ্রই কোনো সিদ্ধান্তে আমল না করলে সমগ্র রোমানিয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ”
চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে সিংহাসনের হাতলটা শক্ত করে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাউন্ট লিও। উঠে এসে রাজ জোতিষ্যীর সামনে দাঁড়ায় কাউন্ট লিও। কণ্ঠে আকুতি মিশিয়ে বলে,
” এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনো পথই কি খোলা নেই রাজ জোতিষ্যী? ”
” কাউন্ট অধিকাংশ প্রজাদের বাঁচাতে হলে আপনার ট্রান্সিলভেনিয়া শহরের প্রজাদের সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। নাহয় এই অশুভ শক্তি সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যকে গ্রাস করে ফেলবে। আগামীকাল চন্দ্রগ্রহনের আগমুহূর্তেই এই সিদ্ধান্তে আমল না করলে সেই অশুভ শক্তি হতে কেউই নিস্তার পাবে না। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” সিংহাসনে আরোহন করার সময় আমি প্রজাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে তাদের সকল নিরাপত্তা আমার দায়িত্ব। কাউন্টেস ম্যারিকে বিবাহের সময় ওয়াদা করেছি আমি যে তাকে কখনোই একা ছেড়ে দিবো না। বড় সব বিপদেও আমি তার পাশে থাকবো। আমার অনাগত সন্তান যে এখনো পৃথিবীর আলো দেখে নি তাকে আমি কিভাবে মরতে দিতে পারি? ”
” আমার ইতিমধ্যে বহুসংখ্যক সৈন্য পাঠিয়েছি কাউন্টেসকে খুঁজে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু ২ দিন পেরিয়ে গেছে এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। একটাও সৈন্য ফিরে আসে নি সেই মৃত্যুপুরি থেকে। রাজ্যের সুরক্ষার জন্য আপনাকে কঠিন হতেই হবে কাউন্ট। ”
লিও কিছু না বলে রাজসভা থেকে বেরিয়ে নিজের কামরায় চলে আসে। তার কামরার সঙ্গেই আছে একটা সুদীর্ঘ বারান্দা। প্রাসাদের সবথেকে উঁচু কামরাটাই হচ্ছে তার এবং ম্যারির। বারান্দা থেকে সম্পূর্ণ রাজ্যটাই তার দেখা যায়। কেবল ৭ বছরের শাসনে তার সাম্রাজ্যে এতো বড় অভিশাপ লাগবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি। মাত্র বিশ বছর বয়সে পিতা কাউন্ট কার্লস আলবার্টকে হারায় লিও। পিতা গত হওয়ার পরই সাম্রাজ্যের ভার তার উপর এসে পড়ে। আপন বলতে ম্যারি ছাড়া আর কেউই ছিলো না তার পাশে। ম্যারি এবং লিওর প্রণয়ের সম্পর্ক খুব ছোট থেকেই। রাজ পরিবারের কারোরই অবশ্য এতে আপত্তি ছিলো না। সিংহাসনে আহোরণের পরই এতো বছরের প্রণয়কে পরিণতি দেয় লিও। একসঙ্গে মিলে দুজনই সাম্রাজ্যের সকল দায়িত্ব পালন করে তারা। তাদের দাম্পত্য জীবনে সুখের অভাব ছিলো না কোনো। অবশেষে বিয়ের ৭ বছর পর ঈশ্বর ম্যারির গর্ভে একটি সন্তানও দেয়। কিন্তু অন্ত:সত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে ম্যারির শারিরীক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। প্রতি রাতেই দুঃসপ্ন দেখে মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর এই অবস্থা কোনো মতেই মেনে নিতে পারে না লিও। সাম্রাজ্যের সকল চিকিৎসক এনে সে হাজির করে। কিন্তু কেউই ম্যারির অসুখ ধরতে পারে না।
একদিন রাজ জোতিষ্যী জানায় যে কাউন্টনেস ম্যারির জন্য ট্রান্সিলভেনিয়া শহরে ভ্রমণ করা মঙ্গল হবে। তখন ম্যারির ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। লিও কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। রাজ জোতিষ্যী বলে ট্রান্সিলভেনিয়া শহরের আবহাওয়া, বিশুদ্ধ বাতাস এসব কিছুর মধ্যে থাকলে ম্যারির শারিরীক অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। রাজ্যের কাজ রেখে ম্যারির সাথে লিওর যাওয়া হয়ে উঠেনা আর। তবে ম্যারির যেনো সেখানে কোনো কষ্ট না হয় তাই সব ব্যবস্থা করে লিও। ট্রান্সিলভেনিয়ার তুষ দূর্গে ম্যারির থাকার ব্যবস্থা করে। সেখানে দাসী থেকে শুরু করে সৈন্য সবাইকে ম্যারির সেবায় নিযুক্ত করা হয়।
লিওর সব দুশ্চিন্তা কিছুটা কমে আসে যখন সে ম্যারির চিঠি পায়। ম্যারি চিঠিতে জানায় সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ অনুভব করছে এবং সে আরো ১ সপ্তাহ সেখানে থাকতে চায়। স্ত্রীর আবদার ফেলতে পারে না লিও এবং সিদ্ধান্ত নেয় এক সপ্তাহ পরে সে নিজে গিয়ে ম্যারিকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনবে। ম্যারির জন্য উপহার সরূপ নিজ হাতে কালো মুক্তা পাথরের একটি লকেট বানায়। এই কালো মুক্তা পাথর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন । কৃষ্ণ সাগর থেকে পাওয়া এই পাথরটি লিও সযত্নে রেখে দিয়েছিলো তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম উপলক্ষে ম্যারিকে উপহার হিসেবে দিবে বলে।
কিন্তু গত তিনদিন আগে তার কাছে খবর আসে ট্রান্সিলভেনিয়া শহরে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।
মাকড়সার জালের মতো সম্পূর্ণ শহরটাকে গ্রাস করে ফেলেছে এই রোগ। কেউই রেহাই পাচ্ছে না। লিও সাথে সাথে সৈন্য পাঠায় ম্যারিকে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু দুদিন পার হতে চললো এখনো কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না ম্যারির।
ট্রান্সিলভেনিয়া শহর এবং বুখারেস্ট শহরের মাঝে রয়েছে একটি নদী। ট্রান্সিলভেনিয়া শহরটির পশ্চিম ও উত্তর দিকটা পাহাড়ে ঘেরা। এর দক্ষিণ দিকে রয়েছে কৃষ্ণ সাগর এবং পূর্ব দিকে একটি নদী বহমান। বুখারেস্ট শহর থেকে ট্রান্সিলভেনিয়া শহরে পৌঁছাতে হলে নদী পথ হয়ে যেতে হয়। দু শহরের যাতায়াতের জন্য এই একটি পথ রয়েছে। বুখারেস্ট শহরের মূল ফটক বন্ধ করার আদেশ দিয়ে দিলেই ট্রান্সিলভেনিয়া শহর হতে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা দূর হবে।
লিওর এতো সব ভাবনার মাঝেই কামরার দরজায় কড়াঘাতের শব্দ হয়। লিও দু হাত পিছনে ভাজ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
” ভিতরে প্রবেশ করো। ”
প্রধান সেনাপতি লুকাস কামরায় প্রবেশ করে প্রথমে মাথা নত করে কুশল জানায়। তারপর বলে,
” কাউন্ট আপনার সিদ্ধান্ত কি জানতে পারি? কাল সকাল সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাদের কিছু একটা করতে হবে। ”
লিও আরেকবার পাশ ফিরে নিঝুম রাজ্যের দিকে তাকায়। রাজ্যকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য এই মুহুর্তে তার কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতেই হবে। সে তার পিতা আর প্রজাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা একবার মনে করে নেয়। লুকাসের দিকে তাকিয়ে বলে,
” প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নাও লুকাস। ট্রান্সিলভেনিয়া শহরের সাথে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দাও। ট্রান্সিলভেনিয়া শহরের কারো এই শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। এই শহর সহ সম্পূর্ণ রাজ্যে ঘোষণা করে দাও ট্রান্সিলভেনিয়া শহরে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। সুরিক্ষিত থাকার জন্য সবার ওই শহরে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হলো। যে এই নিষেধাজ্ঞা মানবে না তাকে যথার্থ শাস্তি দিবে। ”
” যথা আজ্ঞা কাউন্ট। ”
এই বলে মাথা নত করে বেড়িয়ে যায় লুকাস।
রাজ জোতিষ্যী ভারতান আকাশের তারা দেখে কাগজে একটি সংকেত আঁকছে। সংকেত এঁকে তিনি আতংকে চোখ বড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
” এই চন্দ্রগ্রহণ বদলে দিবে এই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ। কাল সূর্যাস্তের পর থেকে ভোরের প্রথম কিরণ উদয় হওয়ার আগেই সাম্রাজ্যে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। কাউন্টকে আমার এক্ষুনি জানাতে হবে বিষয়টি। ”
এই বলে তিনি কাউন্ট লিওর কামরার সামনে গিয়ে প্রহরীদের বলে,
” কাউন্টকে জানাও আমি এসেছি। উনার সাথে আমার দেখা করা গুরুত্বপূর্ণ। ”
” কাউন্ট বেশ কিছুক্ষণ আগেই বেড়িয়ে গিয়েছেন। ”
রাজ জোতিষ্যী ভারতান গলার ক্রুশ ধরে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠে,
” ঈশ্বর রক্ষা করো। ”
ঘোড়া বড় বড় পা ফেলে গহীন অরণ্যের মাঝ দিয়ে দৌড়াচ্ছে। ঘোড়ার পিঠে বসা লিওর মাথার চুলগুলো বাতাসের তীব্রতায় উড়ছে। কাল রাতে সে সপ্ন দেখে ম্যারি তাকে বলছে তাকে এখান থেকে রক্ষা করতে। ম্যারির চোখে পানি টলমল করছে। তার কোলে তাদের সন্তান। ওইতো লিওর পৃথিবী। এরাইতো লিওর পরিবার। নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে লিও কিভাবে বেঁচে থাকবে?
মাঝরাতে এই সপ্ন দেখে এক প্রহরও অপেক্ষা করে না লিও। তখনই বেড়িয়ে পরে ঘোড়া নিয়ে ট্রান্সিলভেনিয়া শহরের উদ্দেশ্যে। এখন অবশ্য বিকেল হয়ে এসেছে। ট্রান্সিলভেনিয়া শহরের এক অরণ্যের মাঝে সে ঘোড়া নিয়ে ছুটে চলেছে। আর কিছুক্ষণ। পরেই সে তুষ দূর্গে পৌঁছে যাবে।
শহরে প্রবেশ করতেই সে দেখতে পায় পুরো শহরের বিদ্ধস্ত অবস্থা। রাস্তাঘাটে সবকিছু এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পথিমধ্যে অনেক মানুষের নিথর দেহ পড়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে কেউই ভাবতে পারবে না এই শহরেও কখনো শিশুদের হাসিমাখা কলধ্বনি শোনা যেতো। পুরো শহর গোরস্থানে পরিণত হয়েছে। একটি উটকো গন্ধে লিওর পেট গুলিয়ে আসে। সে তাড়াতাড়ি এখান থেকে তুষ দূর্গের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করে।
সূর্য ডুবেছে বেশ ক্ষাণিকক্ষণ হলো। তুষ দূর্গে প্রবেশ করতেই বেশ অবাক হয় লিও। সম্পূর্ণ দূর্গ নিরব। কাউকে না পেয়ে লিও জোরে ডাকতে থাকে ম্যারির নাম ধরে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায় না সে। খুঁজতে খুঁজতে সে দোতলায় এসে পড়ে। হঠাৎ পিছনে কেউ কাউন্ট বলে দৌড়ে আসে। লিও চকিতে পিছনে ফিরে দেখে সেনাপতি এলেক্স দৌড়ে আসছে। এলেক্স লিওর সামনে আসতেই লিও ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে,
” এলেক্স তুমি ঠিক আছো? কাউন্টেস ম্যারি? সে কোথায়? ম্যারি ঠিক আছে? ”
” কাউন্টেস গুপ্ত কক্ষে আছেন। উনার প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে কাউন্ট। আপনি জলদি চলুন। ”
সাথে সাথে লিও নিচে গুপ্ত কক্ষে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে ম্যারি একটি মাদুরের উপর শুয়ে আছে। তার পাশেই একটি মহিলা বসা। সেও অন্তঃসত্ত্বা। ম্যারি লিওকে দেখেই অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে,
” লিও। আমার লিও। ”
লিও দৌড়ে গিয়ে ম্যারিকে জড়িয়ে ধরে।
” ম্যারি আমি এসেছি। আমি কিছু হতে দিবো না তোমাদের। আমাকে ক্ষমা করো। আমি আসতে দেরি করেছি খুব। ”
এমন সময়ই হন্তদন্ত হয়ে কামরায় প্রবেশ করে ড্যানিয়েল। লিওকে দেখে তৎক্ষণাৎ হাটু গেড়ে মাথা নত করে কুশল জানায় সে। লিও উঠে এসে বলে,
” কি হয়েছে ড্যানিয়েল? ”
” কাউন্ট এই দূর্দশার কারণ শুধুমাত্র প্লেগ রোগ নয়। ”
” তুমি কি বলতে চাইছো ড্যানিয়েল? ”
ড্যানিয়েল মাথা উঠিয়ে ম্যারির পাশে বসা নিজের স্ত্রী ক্যামিলোর দিকে তাকায়। লিও ড্যানিয়েলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকায়। ক্যামিলো ম্যারির ঘাড়ের পাশ হতে চুলগুলো সড়িয়ে দেয়। লিও দেখে ম্যারির ঘাড়ে কামড়ের দাগ। ঘাড়ের ক্ষত সম্পূর্ণ রক্তাত্ত হয়ে আছে। লিও অবাক হয়ে ম্যারির মুখশ্রী পানে তাকায়। ম্যারিকে বেশ ফ্যাকাশে লাগছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ড্যানিয়েল বলে,
” আমাদের এখনই বুখারেস্ট প্রাসাদে খবর পাঠাতে হবে কাউন্ট। রাজ জোতিষ্যী এই সম্পর্কে আগেই আমাদের সতর্ক করেছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই প্রতিরোধের একটা বিহিত করতে পারবেন। ”
এলেক্স বলে,
” আপনি অনুমতি দিলে আমি এক্ষুণি বুখারেস্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেই কাউন্ট? ”
লিও মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই এলেক্স বুখারেস্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ক্যামিলো পিছন থেকে তাড়া দিয়ে বলে,
” আপনারা বাহিরে অপেক্ষা করুন। সময় ঘনিয়ে এসেছে। ”
লিও এগিয়ে এসে ম্যারির ডান হাতটা ধরে হাতের উল্টো পাশে একটা চুমু খেয়ে বলে,
” আমি আছি ম্যারি। ভয় নেই কোনো। ”
আধঘন্টা হয়ে গিয়েছে ম্যারি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। লিও আর ড্যানিয়েল বাহিরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে যায়। ভিতর থেকে ভেসে আসে এক সদ্য জন্মানো শিশুর কান্নার প্রতিধ্বনি। কামরায় প্রবেশ করে লিও দেখে ক্যামিলোর কোলে শুভ্র একটি কাপড়ে মোড়ানো একটি শিশু চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। লিও এগিয়ে যেতেই ক্যামিলো বাচ্চাটিকে লিওর কোলে তুলে দিয়ে বলে,
” অভিনন্দন কাউন্ট। রোমানিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তারাধিকারী প্রিন্স ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। ”
লিও বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে ম্যারির সামনে এসে বসে বলে,
” ম্যারি, আমাদের প্রিন্স। ”
ম্যারি এক হাত বাড়িয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” আমার ছেলে। ”
লিও ছেলেকে ম্যারির কোলে দিয়ে পকেট থেকে সেই কালো মুক্তার লকেটটা বের করে ম্যারির গলায় পড়িয়ে দিয়ে ম্যারির কপালে আলতোভাবে অধর স্পর্শ করে। ম্যারির চোখ বুজে আসছে। ব্যাথায় কেপে উঠছে থেকে থেকে। ড্যানিয়েল বলে,
” কাউন্ট। প্রিন্সের জন্য কোনো নাম ভেবেছেন আপনি? ”
লিও ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
” রিকার্ডো আলবার্ট। প্রিন্স রিকার্ডো। ”
এবার শিশুটি কান্না থামিয়ে চোখ মেলে তাকায় লিওর দিকে। রিকার্ডোর চোখের মণি একদম সবুজ রঙের। লিও খেয়াল করে দেখে রিকার্ডো একদম ম্যারির মতো দেখতে হয়েছে। ম্যারির চোখের মণির রঙও সবুজ রঙের। হঠাৎ উপরে দরজা ভেঙে পড়ার শব্দ হয়। ক্যামিলো, ড্যানিয়েল, লিও সবাই আতংকিত হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ড্যানিয়েল তড়িঘড়ি করে তলোয়ার বের করতে করতে বলে,
” কাউন্ট আপনি প্রিন্স, কাউন্টেস ও ক্যামিলো কে নিয়ে শীঘ্রই পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। সেখানে ২ টা ঘোড়া আছে। আমি এদিকে যতক্ষণ সম্ভব প্রতিরোধ করছি। ”
ম্যারি ভাঙা গলায় বলে,
” লিও আমার কাছে আর বেশি সময় নেই তুমি রিকার্ডোকে নিয়ে পালাও। আমার সন্তানের জীবন বাঁচাও। ”
লিও অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
” আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না ম্যারি। আমি কখনোই তোমাকে একা ছেড়ে দিবো না। ”
এই বলে লিও এগিয়ে গিয়ে ড্যানিয়েলের কোলে রিকার্ডোকে দিয়ে বলে,
” আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করবে না। আজ থেকে রিকার্ডো তোমার কাছে আমানত। রিকার্ডো ও ক্যামিলোকে নিয়ে এই মুহুর্তে তুমি প্রস্থান করবে। ”
ড্যানিয়েল বলে,
” কাউন্ট এটা বলবেন না। আমি জেনে-বুঝে আপনাকে এদের মাঝে ফেলে যেতে পারি না। ”
লিও গলা ভারি করে বলে,
” আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি ড্যানিয়েল। আমার বিরোধিতা করো না। ”
ড্যানিয়েল ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে কাউন্টের দিকে। লিও চোখের ইশারায় যেতে বলে তাদের। ড্যানিয়েল ক্যামিলোর কাছে এগিয়ে তার হাত ধরতে নিলেই ক্যামিলো দৌড়ে গিয়ে ম্যারির পাশে বসে নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলে,
” কাউন্টেস আমি রিকার্ডো এবং নিজের সন্তানের মাঝে কখনো পার্থক্য করবো না। আজ থেকে সে আমার প্রথম সন্তান। ”
ম্যারি নিজের গলা থেকে সেই কালো মুক্তা পাথরের লকেটটা খুলে ক্যামিলোর হাতে দিয়ে বলে,
” আমার কাছে আর কিছুই নেই ওকে দেয়ার মতো। এটা আমার শেষ স্মৃতি রিকার্ডোর জন্য। ”
ক্যামিলো লকেটটা হাতে নিতেই ড্যানিয়েল ক্যামিলোর এক হাত ধরে পিছনের দরজা দিয়ে প্রস্থান করে। ড্যানিয়েল বের হওয়ার সাথে সাথেই লিও কাঠের কিছু টুকরো দিয়ে দরজাটা ঢাকার চেষ্টা করে। খুব কাছেই কিছু পদধ্বনির আওয়াজ পেতেই সে এগিয়ে গিয়ে ম্যারির মাথার কাছে বসে বলে,
” আমাদের আছে এখন আর কোনো পথ খোলা নেই ম্যারি। তাদের হাতে মরে যাওয়ার থেকে আত্মহত্যাই শ্রেয়। ”
এই বলে হাতের আংটির পাথরটা সড়িয়ে বিষ বের করে ম্যারিকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নেয়।
কামড়ার দরজা ভেঙে ৪ জন প্রবেশ করতেই দেখে ম্যারি এবং লিওর নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজে তারা। কিছু না পেয়ে সামনের জন বলে,
” আজ রাতের মাঝেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। এই চন্দ্রগ্রহণের সময় তার জন্মই আমাদের আরো শক্তিশালী করে তোলার একমাত্র পথ। সেই আমাদের কোভেন গোত্রের কাউন্ট। ”
সাল ১৬১৪,
সকাল থেকেই বাড়িতে সবাই জামা কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছানোতে ব্যস্ত। ঘরের কর্তা মার্টিন অ্যালভেজ এবং তার স্ত্রী জুলিয়া অ্যালভেজ সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক নেয়া হচ্ছে নাকি সেই তদারকি করছেন। হঠাৎ কাঁচ ভাঙার শব্দে দুজনেই দৌড়ে পাশের কামরায় যায়। নিচে একটি কাঁচের পেয়ালা ভেঙে পড়ে আছে। একটা মেয়ে তাড়াহুড়ো করে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে নিয়ে তার হাত সামান্য কেঁটে যায়। জুলিয়া অ্যালভেজ চেঁচিয়ে উঠে,
” ক্যাথরিন! একটু সাবধানে কাজ করা কবে শিখবে তুমি? ”
” আমি দুঃখিত মা। ”
পাশ থেকে মার্টিন অ্যালভেজ বলে উঠে,
” তোমার বেশি লাগে নি তো হাতে? ”
” আমি ঠিক আছি বাবা। ”
জুলিয়া একটি রুমাল এনে ক্যাথরিনের হাতের ক্ষত পরিষ্কার করে রুমাল দিয়ে বেধে দেয়। কিছুটা রাগ হয়ে বলে,
” তুমি একা এসব করছো কেন? সে কোথায়? কাজ ফেলে নিশ্চয়ই আবার ঘোড়া নিয়ে বেড়িয়েছে? হে ঈশ্বর! আমায় ধৈর্য দাও। ”
৮ বছরের ছোট্ট লিয়াম মনের আনন্দে নিজের সকল খেলনা গুছিয়ে নিচ্ছে। বাসার এতো চেঁচামেচি যেন তার কানেই পৌঁছাচ্ছে না। একটু পর ক্যাথরিন এসে তার পাশে বসে বলে,
” কিরে বাদর! এতো খেলনা নিয়ে কি করবি তুই? শেষে তো গ্র্যানিকে পেলে সারাদিন শুধু এটা খাবো ওটা খাবো বলে মাথা খারাপ করে দিবি। এগুলো দিয়ে খেলার সময় আদৌ হবে তোর? ”
বোনের উপর বেশ রাগ হয় লিয়ামের। মুখ ফুলিয়ে বলে,
” আমি মোটেও কারো মাথা খারাপ করি না। ”
এই বলে কপট রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় সে। পিছনে ক্যাথরিন মুচকি হাসতে হাসতে কাজে মন দেয়।
সূর্যের কিরণ সমুদ্রে প্রতিফলিত হচ্ছে। স্বচ্ছ নীলাভ সমুদ্রের পানির মাঝেই সাঁতার কাটছে এক কিশোরী। তাকে দেখে মনে হচ্ছে দিন দুনিয়া সম্পর্কে সে বেমালুম ভুলে বসেছে। আপাতত সে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষদের একজন। তার ভেজা দীঘল সোনালী চুলগুলোকে সূর্যের কিরণের প্রতিফলণে মনে হচ্ছে মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। তার নীলাভ চোখের রঙ নীল সমুদ্রের জলের সমতুল্য । বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে সে উঠে আসে তীরে। দ্বীপের এদিকটা বেশ নিরিবিলি। ভেজা জামা গায়ে লেপ্টে আছে। বাতাসে কিছুটা ঠান্ডা লাগায় দৌড়ে গিয়ে গাছের সাথে বাধা ঘোড়ার পাশেই রাখা কাপড়ের একটা থলি থেকে জামা বের করে তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করে নেয় সে।
বিকেল প্রায় হয়েই এলো। তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরে সে। ঘোড়াটা বাসা থেকে কিছুটা দূরে রেখে নিশব্দে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। জুলিয়া সালাদ বানাচ্ছে এবং রাগে বিড়বিড় করছে। পাশেই ক্যাথরিন ব্রিয়াম রান্না করছে। চুপচাপ পা ফেলে বাসায় প্রবেশ করবে এমন সময়ই লিয়াম তাকে দেখে চিল্লিয়ে বলে উঠে,
” অ্যানা। ”
জুলিয়া সাথে সাথে পাশ ফিরে ডেকে উঠে,
” আনাস্তাসিয়া! ”
আনাস্তাসিয়া চুপচাপ মাথা নত করে ঘরে প্রবেশ করে। জুলিয়া রাগ দেখিয়ে বলে,
” আদরে বাদর হওয়া প্রিন্সেসের বাসায় ফিরার সময় হলো অবশেষে? ”
” মা ঘোড়া ছুটে গিয়েছিল পথে। ওটাকে ধরে আনতেই এতো সময় লেগে গিয়েছে। ”
” অযথা বাহানা মোটেও দিবে না। এবার তোমার গ্র্যানির বাসা থেকে এসে ক্যাথরিনের বিয়ে শেষ হলেই তোমার একটা ব্যাবস্থা করবো আমি। আর কতকাল এমন উড়নচণ্ডী থাকবে? ”
” মা! ”
” কোনো কথা বলবে না। তাড়াতাড়ি তোমার বড় বোনকে কাজে সাহায্য করো। আজকে রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বে তোমরা খেয়ে। কাল সকাল সকাল আমাদের মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। ”
আনাস্তাসিয়া মুখ ফুলিয়ে কিছু না বলে গিয়ে ক্যাথরিনের সাথে কাজে হাত লাগায়।
কাভালা শহরের থাসোস দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা। দ্বীপে বসবাস করে হাতে গোণা ৩৬ টি পরিবার। মার্টিন অ্যালভেজ দ্বীপের একজন সনামধন্য বণিক। ব্যাবসার কাজে উনাকে প্রায়ই বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করতে হয়। কালকেও উনার দীর্ঘ ১ মাসের জন্য লিরোস শহরে ভ্রমণ করতে হবে। যাওয়ার সময় তাই পরিবারকে মেসিডোনিয়ায় কাস্টোরিয়া গ্রামে নিজের শাশুড়ী অর্থাৎ জুলিয়ার মায়ের বাসায় রেখে যাবে। পরের মাসেই ক্যাথরিনের বিয়ে। তাই ক্যাথরিন, আনাস্তাসিয়া, লিয়াম একসাথে গ্র্যানির বাসা থেকে ঘুরে আসতে চাইছে।
কাভালা শহরে যেমন এখন বসন্তের আমেজ, কিন্তু মেসিডোনিয়া শহরে তেমনই ঠান্ডা। এখানে তাপমাত্রা -৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মেসিডোনিয়া শহর একদম গ্রীক দেশের সীমান্তপ্রান্তে হওয়ায় এখানের আবহাওয়ার সাথে কাভালা শহরের আবহাওয়ার পার্থক্য রয়েছে। মেসিডোনিয়ার কাস্টোরিয়া গ্রামটি চারদিক দিয়ে পাহাড় এবং অরণ্যে ঘেরা। পুরো গ্রামটি বরফে ঢাকা পড়ে আছে। সূর্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর।
ফিটনে পাশাপাশি বসে আছে ক্যাথরিন ও আনাস্তাসিয়া। তাদের মুখোমুখি বসে আছেন জুলিয়া এবং লিয়াম। মার্টিন সামনে কোচম্যানের সাথে বসেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বেশ ক্ষাণিকক্ষণ হলো। হুডযুক্ত লম্বা ক্লক গায়ে পড়ে থাকার পরও বেশ ঠান্ডা লাগছে আনাস্তাসিয়ার। লোকালয় বেশ পিছনে ফেলে এখন অরণ্যের মাঝ দিয়ে তারা কাস্টোরিয়া গ্রামের দিকে যাচ্ছে। যদিও তারা চাইলে আজ রাতটা লোকালয়েই কাটিয়ে দিতে পারতো কিন্তু মার্টিন বলে তারা এর আগেও বহুবার রাতে কাস্টোরিয়া ভ্রমণ করেছে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার রাস্তা হয়ে গেলে তারা এক ঘন্টার মাঝেই পৌঁছে যাবে।
লিয়াম এতদূর ভ্রমণ করার খুব একটা অভ্যাস না থাকায় সে বেশ অনেকক্ষণ আগেই জুলিয়ার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্যাথরিনও চোখ বুজে হেলান দিয়ে আছে। কেবল আনাস্তাসিয়ার চোখেমুখেই ক্লান্তির কোনো লেশমাত্র নেই। সে আপন মনে বারবার পাশের ছোট জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে তাদের পৌঁছাতে আর কতদূর বাকি। এখনো ফিটন জঙ্গলের মাঝপথেই আছে। আনাস্তাসিয়া মনে মনে ঠিক করে রেখেছে গ্র্যানির বাসায় গিয়ে সে প্রতিদিন ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে বেড়োবে। তার এসব জল্পনা কল্পনার মাঝেই হঠাৎ ফিটন থেমে যায়। বাহির থেকে ঘোড়ার দৌড়াদৌড়ির শব্দ পাওয়া যায়। ক্যাথরিন, জুলিয়া এবং আনাস্তাসিয়া তিনজনই নড়েচড়ে বসে। মার্টিন এসে দরজায় কড়া নাড়লে জুলিয়া দরজা খুলে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? ফিটন থেমে গেলো কেন? কিসের শব্দ হলো? ”
” ঘোড়া দুটো হঠাৎ বাধনমুক্ত হয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। কোচম্যান ঘোড়াগুলোকে ধরে আনতে গিয়েছে। কিন্তু এখানে এভাবে অপেক্ষা করাটা নিরাপদ না। কোচম্যান ঘোড়াগুলোকে খুঁজে পরে ফিটন এবং জিনিসপত্র নিয়ে আসবে নে। আমরা পায়ে হেঁটে আর আধঘন্টা গেলেই গ্রামে পৌঁছে যাবো। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” কিন্তু লিয়াম এতদূর কিভাবে হেঁটে যাবে বাবা? সে এভাবেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ”
” তুমি এবং ক্যাথরিন তোমার মায়ের হাত ধরে আসো আমি লিয়ামকে কোলে নিচ্ছি। ”
এই বলে মার্টিন লিয়ামকে কোলে নেয়। আনাস্তাসিয়া এবং ক্যাথরিনও জুলিয়ার হাত ধরে নেমে আসে। মার্টিন ফিটনের সামনে থেকে একটি লণ্ঠন আনাস্তাসিয়ার হাতে তুলে দেয় আরেকটি লণ্ঠন নিজের হাতে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়।
পাঁচ মিনিট ধরে তারা জঙ্গলের মাঝে পথ ধরে হাঁটছে। আনাস্তাসিয়া হাঁটতে নিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ে যেতে নিয়েছে। ক্যাথরিনের হাত ধরে থাকায় সে নিজেকে পড়তে পড়তে সামলে নিতে পেরেছে। লণ্ঠনের আলোতেও অন্ধকার তেমন একটা ঘুচছে না। তাই বেশ সাবধানে পা ফেলে এগোতে হচ্ছে তাদের।
হঠাৎ কিছুদূর হতে কতগুলো নেকড়ের ডাক ভেসে আসে। আনাস্তাসিয়া সহ সকলেই ভীতিদৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। নেকড়েগুলো এদিকেই ধেয়ে আসছে। আনাস্তাসিয়া ভীতি স্বরে বলে,
” বাবা! এখন আমরা কি করবো? ”
মার্টিন নিজেও বুঝতে পারছে না কি করবে। এখন পালানোর চেষ্টা করেও লাভ নেই। সে আনাস্তাসিয়াকে আড়াল করে দাঁড়ায়। কোলে লিয়াম তখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। জুলিয়াও এক হাতে মার্টিনের কোলে থাকা লিয়ামের হাত ধরে এবং ক্যাথরিনকে আড়াল করে দাঁড়ায়।
ছয়টি নেকড়ে জুলিয়া এবং মার্টিনকে ঘিরে ধরে আছে। নেকড়েগুলো হিংস্র এবং ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। জুলিয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে বাইবেল পাঠ করছে। এমন সময়ই একটি নেকড়ে হিংস্র গর্জন তুলে একটি পুরুষ মানুষের রূপ ধারণ করে। এ দেখে মার্টিন এবং জুলিয়া দুজনেরই শিরদাঁড়া হিম হয়ে যায়।
নেকড়েটি এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
” আমাদের ছয়জনের জন্য মাত্র দুটো শিকারে মোটেও চলবে না। ”
মার্টিন বলে,
” কে তোমরা? কি চাও আমাদের থেকে? ”
নেকড়েটি কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চোখ বন্ধ করে একটি শ্বাস নিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। জুলিয়া এবং মার্টিন সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে ভয় পেয়ে যায়। ক্যাথরিন, আনাস্তাসিয়া, নাসোকে তারা ওইদিক হয়েই পালিয়ে যেতে বলেছে। পিছনে আরেকটি নেকড়ে গর্জন দিয়ে উঠে একটা যুবকের রূপ ধারণ করে। সে এগিয়ে এসে সামনের নেকড়েটিকে বলে,
” কি দেখছেন ওদিকে আলফা? ”
” আজকে কাউকে ক্ষুদার্ত থাকতে হবে না। তোমাদের শিকার তোমাদের রইলো। আমি আমার শিকার পেয়ে গিয়েছি।
এই বলে নেকড়ে রূপ ধারণ করে জঙ্গলের উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। জুলিয়া কান্না করতে করতে বলতে থাকে,
” আমার সন্তানদের ছেড়ে দাও। আমাদের মেরে ফেলো ওদের ছেড়ে দাও। ”
মার্টিন তেড়ে এসে একটি নেকড়েকে মারতে নেয়। কিন্তু পাশ থেকে আরেকটি নেকড়ে এসে তাকে ছুড়ে ফেলে। মার্টিন পাশে থাকা এক গাছের সাথে আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায়। জুলিয়া দৌড়ে মার্টিনের কাছে যায়। নেকড়ে পাঁচটি তাদের দিকে এগিয়ে আসে। জুলিয়া জানে তাদের মৃত্যু আজকে নিশ্চিত। সে মার্টিনের এক হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে,
” আমাদের প্রাণ নিয়ে নাও ঈশ্বর কিন্তু আমার সন্তানদের রক্ষা করো। আমার ক্যাথরিন, আনাস্তাসিয়া, লিয়ামকে তুমি রক্ষা করো। ”
ক্যাথরিন, আনাস্তাসিয়া, লিয়াম তিনজনই জঙ্গলের মাঝপথে দৌড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তারা কেউই জানে না। শুধু এতটুকু জানে তাদের পালাতে হবে এখান থেকে। জুলিয়া এবং মার্টিন লিয়ামের দ্বায়িত্ব ক্যাথরিন ও আনাস্তাসিয়াকে দিয়েছে। বলেছে যাই হয়ে যাক তারা যেন পিছনে ফিরে না তাকায়। যেকোনো মূল্যে একে অপরকে রক্ষা করতে। দৌড়ানোর মাঝে হঠাৎ লিয়াম থেমে পড়ে। সে ক্যাথরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” ক্যাথরিন আমি আর দৌড়াতে পারছি না। আমরা কোথায় যাচ্ছি? মা আমাদের সাথে আসে নি কেন? বাবা কেন আমাদের একা এসে পড়তে বলেছে? ”
” লিয়াম। লক্ষি ভাই আমার। আমাদের আরেকটু দৌড়াতে হবে। আরেকটু কষ্ট করো ভাই। আমরা যেকোনো মূল্যে তোমাকে রক্ষা করবো। ”
আনাস্তাসিয়া এগিয়ে এসে ক্যাথরিনকে বলে,
” ক্যাথরিন! মা বাবাকে আমরা আর কখনো দেখতে পাবো না? ”
বোনের অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে এই প্রশ্ন শুনে ক্যাথরিনেরও এতক্ষণ আঁটকে থাকা কান্না বাধ ভাঙ্গে। লিয়াম আর আনাস্তাসিয়ার জন্যই এতক্ষণ সে শক্ত হয়ে ছিলো। কাঁদতে কাঁদতে পাশে থাকা একটা উঁচু পাথরের উপর বসে পড়ে সে। আনাস্তাসিয়া হাতের লণ্ঠন নিচে রেখে বোনের সামনে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। লিয়াম কিছু না বুঝে প্রশ্ন করে,
” ক্যাথরিন, অ্যানা তোমরা কাঁদছো কেন? ”
আনাস্তাসিয়া ও ক্যাথরিন নিজেদের সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আনাস্তাসিয়া এগিয়ে এসে লিয়ামের হাত ধরে বলে,
” কিছু হয় নি লিয়াম। আর কিছুক্ষণ দৌড়াতে হবে আমাদের। গ্র্যানির বাসায় যেতে পারলেই আর ভয় থাকবে না। ”
এই বলে আনাস্তাসিয়া লিয়ামকে নিয়ে এগিয়ে নিচ থেকে এক হাতে লণ্ঠন তুলে নেয়। ক্যাথরিনও আরেকটি লণ্ঠন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাদের পিছনে উঠে আসে। হঠাৎ পিছন থেকে কারো কণ্ঠ ভেসে আসে,
” রাস্তা খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারি? ‘
আনাস্তাসিয়া, লিয়াম ও ক্যাথরিন তিনজনই পিছনে ফিরে তাকায়। কালো বুট জুতো, কালো রঙের ম্যাডিভাল টিউনিক শার্ট, ব্রীচেস প্যান্ট পড়া একজন লোক দাঁড়িয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্যাথরিন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এই ভেবে যে এখন তারা অন্তত কারো সাহায্য নিতে পারবে। কিন্তু তার এই ধারণা মুহূর্তেই বদলে যায় যখন সে লণ্ঠনটি তুলে সামনে ধরে দেখে যে লোকটির চোখের মণির রঙ রক্তিম লাল। আনাস্তাসিয়াও ভয়ে লিয়ামকে জড়িয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। ক্যাথরিন সাথে সাথে আনাস্তাসিয়া আর লিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” এই মুহুর্তে পালাতে হবে। ”
আনাস্তাসিয়া লিয়ামের হাত ধরে সাথে সাথে সামনের দিকে দৌড়ানো শুরু করে। ক্যাথরিনও দৌড় দেয় কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সে পাথরের সাথে পায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। ক্যাথরিনের হাতের লণ্ঠনটাও পড়ে আগুন নিভে যায়। আনাস্তাসিয়া শব্দ পেয়ে থেমে যায়। পিছনে ফিরে দেখে তার বোন পড়ে আছে। আনাস্তাসিয়া চিৎকার করে উঠে,
” ক্যাথরিন! ”
মূহুর্তের মধ্যেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তিম চোখের লোকটি ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। আনাস্তাসিয়া দৌড়ে সামনে আসতে নিবে তার আগেই ক্যাথরিন বলে উঠে,
” অ্যানা আর এক পাও সামনে আগাবি না। লিয়ামকে নিয়ে চলে যা এখান থেকে। ”
” ক্যাথরিন আমি পারবো না আর কাউকে হারাতে। ”
” অ্যানা! আমার কথা শুন। চলে যা এই মূহুর্তে এখান থেকে। পিছনে ফিরে আর তাকাবি না। ”
” নিজের ভাইকে বাঁচানোর জন্য নিজের বোনকে আমি কিভাবে ফেলে যাবো ক্যাথরিন? ”
” তোকে শক্ত হতে হবে অ্যানা। লিয়ামের জন্য হলেও তোকে বাঁচতে হবে। সময় নষ্ট না করে লিয়ামকে নিয়ে চলে যা। ভয় পাচ্ছে ও। ”
আনাস্তাসিয়া অশ্রুভেজা চোখে একবার সামনে ক্যাথরিনের দিকে তাকায়। পাশেই তাকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে থাকা লিয়ামের দিকে তাকায়। তার সতেরো বছরের জীবনের সবথেকে দীর্ঘ আর নিষ্ঠুরতম রাত আজকে। একদিকে একজনকে বাঁচাতে হলে অন্যদিকে আরেকজনকে ফেলে যেতে হচ্ছে তার। এর থেকে মৃত্যুও অধিক শ্রেয় বলে মনে করে সে।
ক্যাথরিন দেখছে সেই রক্তিম চোখের লোকটি তার সামনে এলেও আনাস্তাসিয়া এবং লিয়ামের কাছে যাচ্ছে না। সে ক্রমশ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ক্যাথরিন চোখ শক্ত করে আনাস্তাসিয়ার দিকে তাকায়। আনাস্তাসিয়া বাধ্য হয়ে লিয়ামের হাত ধরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ক্যাথরিন এটা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে যে এই আগুন্তক লোকটা আর আনাস্তাসিয়া ও লিয়ামের পিছু নেয় নি। ক্যাথরিন একা নিজেই হাতের উপর ভর করে উঠে দাঁড়ায়। তার পায়ে ঊরুর পাশ দিয়ে বেশ ক্ষাণিকটা কেটে গিয়েছে। সে সামনে তাকিয়ে দেখে সেই আগুন্তক লোকটা রক্তিম চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্যাথরিন তার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
” তুমি কোনো মানুষ নও। ”
” মৃত্যুপথযাত্রীর এতো তেজ মানায় না। ”
” তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার কাছে জীবন ভিক্ষা চাবো? মেরে ফেলার হলে বিলম্ব না করে এখনই মেরে ফেলো। ”
” আমার শিকারকে আমি কখনোই জীবিত ছাড়ি না। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। ”
মূহুর্তের মধ্যেই রক্তিম চোখের লোকটি গর্জন তুলে একটি নেকড়েতে পরিণত হয়। এই দৃশ্য দেখে ক্যাথরিনের দেহ হিমশীতল হয়ে যায়। ভয় পেলেও সে ভয়ের ছাপ চোখে মুখে ফুটে উঠার আগেই সে নিজেকে সামলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। নেকড়েটি তার আশেপাশে দিয়ে কিছুক্ষণ কর্কশ গর্জন তুলতে তুলতে পায়চারি করে। হিংস্র দৃষ্টিতে ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
ক্যাথরিনের চোখের জল বেশ আগেই শুকিয়ে গিয়েছে। সে অনুভূতিশূণ্য হয়ে আছে। এক রাতেই নিজের মা বাবাকে হারালো, ছোট ভাই বোন দুটো ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারবে নাকি নিশ্চিত না। এসবকিছুর পর এখন সে আর মৃত্যুকে মোটেও ভয় করছে না। নেকড়েটি মানুষের রূপে এসে ক্যাথরিনের কাছে আসে। নিজের এক হাত দিয়ে বেশ শক্ত করে ক্যাথরিনের ঘাড়ের একপাশ ধরে। ঘৃণায় ক্যাথরিনের গা গুলিয়ে আসে। তার ১৯ বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো পরপুরুষ তাকে স্পর্শ করার সাহস করেছে। ক্যাথরিনের বাগদত্তা নাথানও কখনো তাকে ছোয়ার সাহস করে নি।
নেকড়েটি ক্যাথরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
” ক্যাথ। ”
ক্যাথরিন বরফের ন্যায় জমে যায়। ক্লান্ত শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। আবার একই কণ্ঠ ফিসফিসিয়ে বলে,
” তোমার মৃত্যু আমার হাতেই। কিন্তু আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস করেছো তুমি। সেটার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। ”
এই বলে ক্যাথরিনের চোখে চোখ রেখে রুক্ষ গলায় বলে,
” আজকের পূর্ণ চাঁদকে সাক্ষী রেখে বলছি তোমার জীবনকে আমি নরকের থেকেও বেশি বেদনাদায়ক করে তুলবো। যেই চোখে আজকে মৃত্যু ভয় নেই সেই চোখে মৃত্যু ভীতি না দেখে তোমাকে মারবো না আমি। তুমি নিজে আমার কাছে মৃত্যু ভিক্ষা চাইবে। ”
কথাটা বলেই নেকড়েটি অপর হাত দিয়ে ক্যাথরিনের ঘাড়ে আঘাত করে। অজ্ঞান ক্যাথরিনকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নেয় সে। আকাশে জ্বলজ্বল করা পূর্ণিমা চাঁদের আলো এসে ক্যাথরিনের মুখে ঠিকরে পড়ছে। পূর্ণ চাঁদের রাতে এই প্রথম আরোণ নিজের কোনো শিকারকে জীবিত রেখেছে। নেকড়ে জাতের আলফা আরোণ রদ্রিগেজ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই নির্বোধ তুচ্ছ মেয়েকে দিয়ে সে মহাভোজ করবে। তবে তার আগে এই মেয়ের চোখেমুখে মৃত্যু ভয় দেখতে চায় সে। এই সামান্য মেয়ের চোখে মৃত্যু ভয়ই এখন তাকে একমাত্র সবথেকে তৃপ্তি দিতে পারবে।
