মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৭+১৮
নাফিসা তাবাসসুম খান
বসন্ত এসেছে। প্রকৃতি আপন রূপে সেজেছে। বরফের আবরণে ঢাকা শহর নিজের আপন রূপে ফিরে এসেছে। আনাস্তাসিয়া সকালে গিয়েছিল ওরিয়নের সাথে দেখা করতে। কিন্তু ওরিয়ন তখন বাসায় ছিলো না। বিকেলে খবর পাঠিয়েছে নিকোডিমাসকে দিয়ে যে হেলিয়ন পাহাড়ের নিচে সে অপেক্ষা করছে। আনাস্তাসিয়া সাথে সাথেই তৈরি হয়ে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে। সন্ধ্যা নামতে এখনো ঘন্টা দুয়েক বাকি। তার আগেই আবার বাসায় ফিরতে হবে। পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় ওরিয়ন নিজের ঘোড়ার পাশে একটি পাথরের উপর বসে আছে৷ আনাস্তাসিয়াকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় সে। আনাস্তাসিয়া ঘোড়া থেকে নেমে একটি গাছের সাথে সেটি বেধে ওরিয়নের দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,
” এখানে কেন ডাকলে? আমরা তো বাসার সামনেই কথা বলতে পারতাম। ”
ওরিয়ন নিচে রাখা কাপড়ের ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে নিতে নিতে বলে,
” তুমি কি নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছো তা আমি জানি আনাস্তাসিয়া। সেজন্যই আর তোমার বাসার সামনে আপাতত যাই নি। আশেপাশের মানুষ কথা বলার নতুন সুযোগ পেত। ”
” তাহলে এখন এই বিষয়ে কি করা যায় কিছু ভেবেছ তুমি? ”
” উপরে যেয়ে কথা বলি আমরা? আমার কিছু ভেষজ প্রয়োজন ঔষধ বানানোর জন্য। ”
” আচ্ছা। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঢালু পথ বেয়ে উঠতে বেশি একটা সমস্যা হয় নি আনাস্তাসিয়ার। আগেও অনেকবার পাহাড়ে চড়া হয়েছে তার তাই অভ্যাস আছে বলা চলে। পথিমধ্যে দু একবার ওরিয়ন ব্যাগ থেকে কাচি বের করে কিছু ভেষজ পাতা কেটে ব্যাগে ভরে নিয়েছে। পাহাড় চূড়ায় উঠতে প্রায় আধঘন্টার বেশি সময় লেগেছে৷ কিন্তু চূড়ায় উঠে সেটা সার্থক মনে হচ্ছে আনাস্তাসিয়ার। একপাশে ঘন জঙ্গল এবং অপর পাশে কাস্টোরিয়া শহর। তার সদূরে দেখা মিলছে কৃষ্ণ সাগরের। আর কিছুক্ষণ পর নিশ্চয়ই সূর্যাস্তও দেখতে পাওয়া যাবে এখান থেকে। আনাস্তাসিয়ার মুখে হাসি দেখে ওরিয়ন প্রশ্ন করে,
” এই পাহাড়ে এর আগে আসো নি তুমি? ”
” না। হেলিয়নে আগে আসা হয় নি আমার। দু একবার যা উঠেছি তা ও প্লেভিন পাহাড়ে। কিন্তু সেটার উচ্চতা এটার মতো এতো উঁচু না তোমার জানাই আছে। ”
” তোমাকে দেখে তো মনে হলো তুমি পরিপক্ক। আমার সাথে কদম মিলিয়ে তাড়াতাড়ি উঠেছো। দু একবার উঠলেও তো এতো পরিপক্ক হওয়ার কথা না। ”
এবার আনাস্তাসিয়া ওরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি থাসোস দ্বীপে বড় হয়েছি ওরিয়ন। সেখানে শুধু সমুদ্র না পাহাড়ও আছে৷ আমার পাহাড় থেকে ঝাপ দিয়ে সমুদ্রে সাতার কাঁটার অভিজ্ঞতাও আছে। ”
ওরিয়ন একটু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি সাহসী তা আমার জানা আছে কিন্তু এতো সাহসী সেটা আমার ধারণা ছিল না। ”
আনাস্তাসিয়া বলে,
” আমার সাহসের গুণগান আমরা পরেও গেতে পারবো এখন আগে বলো নতুন সমস্যার সমাধান কি? ”
” সমাধান আমি করে ফেলেছি। চিন্তা করো না। ”
আনাস্তাসিয়া এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
” কি সমাধান? ”
” সেটা কালই দেখতে পাবে তুমি। ”
আনাস্তাসিয়া এবার কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
” এই ছোট কথাটা তো তুমি আমাকে নিচেই বলতে পারতে। উপরে আসতে বললে কেন তাহলে? ”
ওরিয়ন এবার হেসে আনাস্তাসিয়ার দিকে একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
” বলছি। এদিকে আসো আগে। ”
আনাস্তাসিয়া একবার ওরিয়নের দিকে তাকায় আবার তার বাড়ানো হাতের দিকে তাকায়। কিছুটা ভনিতা করে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। ওরিয়ন আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে তাকে পাহাড়ের পশ্চিম দিকে এনে দাঁড় করায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
” সামনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকো। ”
আনাস্তাসিয়া ওরিয়নের কথা মতো সামনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তেমন কিছু দেখতে না পেরে প্রশ্ন করে,
” কি দেখবো? ”
” অধৈর্য হয়ো না আনাস্তাসিয়া। আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকো। ”
আনাস্তাসিয়া আবার সামনে তাকায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হওয়ার পর সে দেখতে পায় ধীরে ধীরে সূর্য ডোবার দৃশ্য। কৃষ্ণ সাগরের বুকে সূর্য ঢলে পড়ার দৃশ্য দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে আনাস্তাসিয়া ও ওরিয়ন। আনাস্তাসিয়া সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে,
” অসাধারণ। ”
ওরিয়ন বলে,
” আমি নিশ্চিত থাসোস দ্বীপের সূর্যাস্তের দৃশ্য আরো অনেক বেশি সুন্দর কিন্তু কাস্টোরিয়ায় আমার দেখা সবথেকে সুন্দরতম সূর্যাস্তের দৃশ্যের সাক্ষী কেবলমাত্র হেলিয়ন পাহাড়ের চূড়ায় পাওয়া যায়। ”
আনাস্তাসিয়া প্রশ্ন করে,
” এখানে তাহলে কেউ তেমন একটা আসে না কেন? ”
” এখানে মূলত চিকিৎসকরা বেশি আসে ওষুধ তৈরির জন্য ভেষজের সন্ধানে। আর সেই সুবাদে আমিও এই জায়গা চিনি। সাধারণত তাই অন্য কেউ এদিকে তেমন একটা আসে না বললেই চলে। আজ ভাবলাম তুমি এতদিন ধরে কাস্টোরিয়ায় আছো তাই এই সুন্দর দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ার অধিকার তোমারও আছে।
” শুধু কাস্টোরিয়ায় থাকার সুবাদে? ”
ওরিয়ন এবার হেসে বলে,
” না। আমার বন্ধু হওয়ার সুবাদেও। তুমি চমৎকার একজন মানুষ আনাস্তাসিয়া। আর তোমার মতো চমৎকার একজন বন্ধু অন্তত আমার থেকে এই সামান্য দৃশ্য উপহার প্রাপ্য। ”
আনাস্তাসিয়া এবার হেসে বলে,
” তুমিও অসাধারণ একজন মানুষ ওরিয়ন। ধন্যবাদ তোমাকে এতো ভালো একজন বন্ধু হওয়ার জন্য। ”
ভোরের আলো ছড়ানোর আগেই বুখারেস্ট শহরে প্রবেশ করে ক্যাথরিন ও ক্রিয়াস। পথিমধ্যে একদিন অবশ্য সিবিউ শহরে অবস্থান করেছিলো তারা। সিবিউ শহরেও প্রবেশ করেছিলো লোকচক্ষুর অগচরে। ক্রিয়াসকে দেখে অবশ্য বুঝা গিয়েছে এসব কাজে সে বেশ পটু। সিবিউ তে প্রবেশের আগেই নেকড়ে রূপ পরিবর্তন করে মানব রূপে ফিরে এসেছে সে। আবার সেখান থেকে একটি ঘোড়াও জোগাড় করে সেটাতে করে ভ্রমণ করছে এখন। বুখারেস্টের কোলাহল পরিপূর্ণ বাজার পেরিয়ে একটি মহল্লায় প্রবেশ করে তারা। এই গলির মাঝে সোজা মাটির রাস্তা এবং তার দু পাশে দোতলা ইটের তৈরী দালান রয়েছে সাড়ি বেধে। এখানে অবশ্য বাসকোভ প্রাসাদের চারিদিকের অরণ্য জুড়ে যে বরফে ঢাকা শীতল আবহাওয়া ছিলো তা নেই। হালকা শীত পরেছে সবে এখানে।
একটি দোতলা দালানের সামনে এসে ক্রিয়াস ঘোড়ার লাগাম টেনে সেটিকে থামিয়ে নেমে দাঁড়ায়। ক্যাথরিনও তার পিছু পিছু ঘোড়া থামিয়ে প্রশ্ন করে,
” নেমে আসবো আমি? ”
ক্রিয়াস কিছু বলার আগেই দালানের সামনে দাঁড়ানো দুজন যুবক এগিয়ে আসে। দুজনের চেহারা দেখতেই অনেকটা একরকম। হয়তো ভাই হবে তারা। ক্রিয়াস ধীরস্বরে তাদের কিছু একটা বলতেই একজন এসে ক্রিয়াসের হাত থেকে ঘোড়ার লাগাম নিয়ে তা ধরে দাঁড়ায়। আরেকজন এসে ক্যাথরিনের ঘোড়ার সামনে ঝুকে বসে পিঠ বাড়িয়ে দেয় ক্যাথরিনের নামার জন্য। ক্যাথরিন বুঝতে পেরে ক্রিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এর কোনো প্রয়োজন নেই। ওকে উঠে যেতে বলো। ”
ক্রিয়াস বলে,
” আলফার আমানতের কোনো ধরনের অযত্ন আলফা সহ্য করবে না ক্যাথরিন। তাই যেভাবে যা হচ্ছে তা মেনে নাও। ”
ক্যাথরিন মনে মনে বলে,
” এদের আলফার থেকে দূরে আসা সত্ত্বেও সে আমার পিছু ছাড়ছে না। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে আলফার এই আদেশ সেই আদেশ বলে বলে আমার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে। বিরক্তিকর! ”
এটুকু বলে ক্যাথরিন সেই যুবকের পিঠে পা রেখে নিচে নেমে আসে। ক্রিয়াস সেই যুবক দুজনকে বলে,
” এখানেই থাকবে এবং চারিদিকে নজর রাখবে তোমরা। ”
এই বলে ক্রিয়াস দালানের মূল দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায়। ক্যাথরিন ভিতরে প্রবেশ করতেই সে ও পিছন পিছন ভিতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্যাথরিন পিছনে ফিরে ক্রিয়াসের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে প্রশ্ন করে,
” ওই দুজনও কি নেকড়ে? ”
ক্রিয়াস সাবলীল গলায় উত্তর দেয়,
” না। ”
ক্যাথরিন বলে,
” এখানে কি করে তাহলে তারা? ”
” আপাতত তারা তোমার সেবা ও সুরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত আছে। ”
ক্যাথরিন কথা বাদ দিয়ে ভিতরে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে একটি বসার ঘর,খাওয়ার ঘর,স্নানঘর এবং তার পাশে একটি রান্নাঘর রয়েছে শুধু নিচ তলায়। বসার ঘরের সাথেই রয়েছে কাঠের সিড়ি। ক্যাথরিন সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ক্রিয়াস পিছন থেকে বলে,
” উপরে যে কক্ষ তোমার পছন্দ হয় সেটিতেই চাইলে তুমি থাকতে পারো। আর আলফা বলেছে এতো লম্বা সফরের পর তুমি ক্লান্ত থাকবে। এসে যেন আগেই হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পরিবর্তন করে ঘুম দাও। আমি পানি গরম করে দিচ্ছি তুমি আগে এসে হাতমুখ ধুয়ে নাও। ”
ক্যাথরিন রাগ সংবরণ করতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
” ঈশ্বর! এই পাগলের কারখানায় যেহেতু আমায় এনে ফেলেছো এখন তুমি এদের সহ্য করার ধৈর্য দাও আমায়। যত্তসব আলফা আর তার চামচা। ”
ক্যাথরিনের যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন ইতিমধ্যে রাত হয়ে গিয়েছে। খুব ক্লান্ত থাকায় কক্ষে এসে বিছানায় বসতেই সে ঘুমে ঢলে পড়েছিল। দোতলায় তিনটি কক্ষ রয়েছে। ক্যাথরিন যে কক্ষে আছে সেটাতে একটি খাট, একটি আয়না, একটি ক্যাবিনেট ছাড়া আর কিছু নেই। একপাশে একটি মোটামুটি বড় জানালা রয়েছে। সেই জানালার পাশে বসার জন্য ভালোই জায়গা আছে। ক্যাথরিন এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলে বাহিরে তাকায়। মুহূর্তেই তার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। গলির এই রাস্তায় একদিকে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, আবার কিছু বাসার দরজার সামনে দু চারজন মহিলা একসাথে দাঁড়িয়ে খোশগল্পে মেতে আছে, অন্যদিকে চারজন পুরুষ বসে পাশা খেলছে এবং তাদের ঘিরে আরো কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে সেই খেলা উপভোগ করছে।
ক্যাথরিন তাড়াতাড়ি জামা পরিবর্তন করে অন্য একটি জামা পড়ে নিচে নেমে আসে। ক্রিয়াস বসার ঘরে একজন মেয়ের সাথে কথা বলছিলো বসে। মেয়েটি হলুদ রঙের ম্যাডিভাল ব্লাউজ এবং তার সাথে সাদা রঙের স্কার্ট পড়ে আছে। উজ্জ্বল সোনালী চুলগুলো স্কার্ফ দিয়ে বেধে একপাশে এনে রেখেছে। ক্যাথরিনকে নামতে দেখে ক্রিয়াস বলে,
” তুমি ঘুমিয়ে ছিলে দেখে আমি আর তোমায় ডাকি নি। এর সাথে পরিচিত হও। ওর নাম লোল্যান্ডা। তোমার সেবায় নিযুক্ত থাকবে। ”
ক্যাথরিন হালকা ভ্রু কুচকে ক্রিয়াসকে বলে,
” আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। ”
ক্রিয়াস উঠে ক্যাথরিনের কাছে এগিয়ে যেতেই ক্যাথরিন ফিসফিসিয়ে বলে,
” আমি কি একবারো বলেছি যে আমার কোনো সেবিকা প্রয়োজন? তাহলে এসব নাটক কেন করছো? আর এই ডোল্যান্ডা বা নোল্যান্ডা যাই হোক ও কি তোমাদের মতো নেকড়ে? ”
ক্যাথরিনের মুখে লোল্যান্ডার নামের এই বিকৃতি শুনে হাসি পায় ক্রিয়াসের। কিন্তু হাসি চেপে রেখে সে সাবলীল গলায় বলে,
” প্রথমত তোমার কি প্রয়োজন সেটা বুঝার দায়িত্ব আপাতত আমার। আর আমি আমার দায়িত্ব পালনে কোনো ক্রুটি রাখতে চাই না। দ্বিতীয়ত এই মেয়েটির নাম লোল্যান্ডা। আর তৃতীয়ত ও আমাদের মতো নেকড়ে না। এই মহল্লার স্থানীয়। এবং আমাদের পরিচয় সম্পর্কেও সে খুব ভালো করেই জানে। ”
এটুকু বলেই ক্রিয়াস লোল্যান্ডার দিকে তাকিয়ে রোমানিয়ান ভাষায় বলে,
” লোল্যান্ডা! ক্যাথরিনের সাথে পরিচিত হও তুমি। ওর খেয়াল রেখো। আমার বাহিরে কিছু কাজ আছে। কিছু প্রয়োজন হলে দরজার সামনেই লোনাট এবং কোদ্রিন আছে তাদের জানাবে। ”
লোল্যান্ডা হেসে সম্মতি জানায়। ক্রিয়াস বের হয়ে যেতে নিলেই ক্যাথরিন এগিয়ে এসে তার হাত ধরে দাঁড় করায়। ক্রিয়াস বলে,
” তোমার কিছু প্রয়োজন? ”
ক্যাথরিন বলে,
” তোমাদের আলফা বলেছে তুমি ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস না করতে। তাহলে এদের বিশ্বাস কেন করবো আমি? ”
ক্রিয়াস হেসে বলে,
” লোল্যান্ডা, লোনাট এবং কোদ্রিন আমার বিশ্বস্ত মানুষ। তুমি তাদের সাথে সুরক্ষিত না থাকলে আমি কখনোই তোমায় ওদের কাছে আনতাম না। এতদিন বাসকোভ প্রাসাদে থেকে একা লাগছিলো তোমার আমি নিশ্চিত। ওদের সাথে কথা বলো, মিশো, ওদের সেবিকা হিসেবে না ভাবে বন্ধু হিসেবে ভাবো। দেখবে খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠবে ওরা তোমার। ”
ক্রিয়াস এটুকু বলে বেরিয়ে যায়। ক্যাথরিন পাশ ফিরে দেখে লোল্যান্ডা তার দিকে হেসে তাকিয়ে আছে। ক্যাথরিন তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসতেই লোল্যান্ডা এগিয়ে এসে বলে,
” ক্যাথরিন। আমি শুনেছি তুমি এখানে পৌঁছে এখনো কিছু খাও নি। তুমি কি খেতে চাও আমাকে বলো। আমি এখনই রেধে দিচ্ছি। ”
খাবারের কথা শুনতেই ক্যাথরিনের মনে পড়ে তার আসলেই ক্ষিদে পেয়েছে। কিন্তু রোমানিয়ান কোনো খাবারের নাম সে ঠিকঠাক জানে না। মার্থাকেও কখনো জিগ্যেস করা হয় নি কোনো খাবারের নাম। ক্যাথরিন ইতস্তত করে বলে,
” আমি আসলে কোনো খাবারের নাম জানিনা রোমানিয়ান। আপাতত কিছু একটা হলেই হবে। ”
লোল্যান্ডা হেসে বলে,
” ওহ! ক্রিয়াস আমায় বলেছে যে তুমি গ্রীক থেকে এসেছ। এখানকার খাবারের নাম না জানাই স্বাভাবিক তোমার। আমি তোমার জন্য সিওর্বা দে বুর্তা রান্না করি? এটা একটি স্যুপের নাম। আশা করছি তোমার পছন্দ হবে। ”
ক্যাথরিন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। লোল্যান্ডা রান্নাঘরে গিয়ে ভেড়ার মাংস কাটা শুরু করে। ক্যাথরিনও লোল্যান্ডার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
” আমিও তোমায় সাহায্য করি ডোল্যান্ডা? ”
লোল্যান্ডা অবাক হয়ে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে। তারপর হতাশ স্বরে বলে,
” ডোল্যান্ডা না। আমার নাম লোল্যান্ডা। তুমি তো আমার নামের সম্মানের জানাজা করে দিলে ক্যাথরিন। ”
ক্যাথরিন অনুশোচনা করে বলে,
” আমি দুঃখিত লোল্যান্ডা। তোমার নামটা খুবই ব্যাতিক্রমি। তাই আমার মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছিলো। ”
লোল্যান্ডা হেসে বলে,
” সমস্যা নেই। তুমি চাইলে এখানে দাঁড়িয়ে রান্না দেখতে পারো। কিন্তু তোমাকে রান্না করার অনুমতি আমি দিতে পারবো না। ক্রিয়াস বলেছে আলফা নিষেধ করেছে তোমাকে কোনো কাজ করতে দিতে। ”
ক্যাথরিন তেতে উঠে বলে,
” তুমি আর একবার আলফার নাম নিলে আমি না খেয়ে চলে যাবো। গতকাল থেকে ওর নাম শুনতে শুনতে বিরক্ত আমি। এখানে আমার সাথে না থেকেও আমার সব বিষয়ে ও নাক গলাচ্ছে। অসভ্য একটা। ”
লোল্যান্ডা চোখ বড় করে তাকায় ক্যাথরিনের দিকে। মনে মনে বলে,
” কি সাহস বাপরে! ”
রান্না শেষ করে খাবার টেবিলে সব পরিবেশন করে লোল্যান্ডা। সিওর্বা দে বুর্তা, সরমলে, জাকুসকা এবং সালতা বোয়েফ করেছে সে। এতো আয়োজন দেখে কিছুটা অবাক হয় ক্যাথরিন। মেয়েটা রান্নাবান্নায় বেশ দক্ষ তা বুঝাই যাচ্ছে। খাবারের গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করছে। লোল্যান্ডা ক্যাথরিনকে খেতে বসতে বলে। ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” তুমি খাবে না? ”
” না। তুমি খেতে বসো। আমি বেড়ে দিচ্ছি তোমাকে। ”
ক্যাথরিন বলে,
” আমি মানুষ, রাক্ষস না। এতো খাবার কিভাবে খাবো আমি? তুমিও আমার সাথে খেতে বসো। ”
লোল্যান্ডা যেন ক্যাথরিনের এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে খুশি হলো। এগিয়ে এসে সে ক্যাথরিনের পাশে বসে। ক্যাথরিন প্রশ্ন করে,
” বাহিরে ওই দু জন যুবক কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? ”
” লোনাট এবং কোদ্রিন বাহিরেই আছে। কোনো প্রয়োজন? ”
ক্যাথরিন বলে,
” ওদের ভিতরে আসতে বলো। ”
লোল্যান্ডা উঠে গিয়ে লোনাট এবং কোদ্রিনকে ডেকে আনে। ক্যাথরিন বলে,
” এবার সবাই মিলে আমরা খেতে বসবো। ”
কোদ্রিন সাথে সাথে আঁতকে বলে উঠে,
” অসম্ভব! ক্রিয়াস অথবা আলফা যদি জানে যে আমরা পাহাড়া না দিয়ে বসে তোমাদের সাথে খাচ্ছি জীবন নিয়ে নিবে। ”
ক্যাথরিন ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
” আর তোমরা যদি আমার সামনে তোমাদের আলফার হুকুম জারি করো তাহলে আমি রেগে যাবো। আর আমি রেগে গেলে না খেয়ে উঠে যাবো। তখন তোমাদের আলফা আরো বেশি রেগে যাবে। ”
লোল্যান্ডা আকুতি করে বলে,
” ক্যাথরিন আমার ভাই দুটো শুধু শুধু মরবে। ওদের বাহিরে যেতে দাও। ”
ক্যাথরিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
” ওরা তোমার ভাই? ”
” হ্যাঁ। আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। জমজ ওরা দুজন। ”
ক্যাথরিন বলে,
” তাহলে তো আরো আগে আমি ছাড়ছি না। তোমরা তিনজনই বসো। তোমাদের আলফা কিছুই বলবে না। ”
এটুকু বলে ক্যাথরিন মনে মনে বলে,
” তার লাগাম আমার হাতে আছে। ”
কোদ্রিন এবং লোনাট ইতস্ত বোধ করে। তারা বসে খেতে। লোল্যান্ডা ও বসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার টেবিলে রমরমা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সকলেই গল্পে মেতে উঠে। বেশি চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে ক্যাথরিন এবং লোল্যান্ডাকে। কোদ্রিন এবং লোনাটও কথা বলছে টুকটাক। সদর দরজা হালকা ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দেয় ক্রিয়াস। এই দৃশ্য দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। হেসে দরজা চাপিয়ে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। দরজার সামনে লোনাট এবং কোদ্রিনকে না দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে। কিন্তু এখন এই দৃশ্য দেখে ভালোই লাগছে। আকাশে ভরাট চাঁদ উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে ক্রিয়াস মনে মনে বলে,
” গরম মাথার আলফার নরম মনের প্রেয়সী। ”
আটটা ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে বিশাল হলরুমের মধ্যেখানে। দু পাশে বসে থাকা আঠারো জন রক্তচোষা পিশাচের চোখে ক্ষোভের ছায়া। শুধুমাত্র শান্ত দেখা যাচ্ছে একজোড়া সবুজ নেত্রের অধিকারীকে। রিকার্ডো খুব ঠান্ডা চোখে একবার লাশ গুলোকে দেখে নিলো। তারপর একজন ভৃত্যকে ডেকে বললো লাশ গুলোকে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে। এরকম এক ঘটনায় রিকার্ডোর এমন ঠান্ডা প্রতিক্রিয়ায় কেউই তেমন একটা অবাক হয় নি। সকলেই রিকার্ডোর এমন আচরণে অভ্যস্ত। সেই আঠারো জন বাদেও আরো তিনজন এই হলরুমে অবস্থান করছে। তারা হচ্ছেন ক্যামিলো, ড্যানিয়েল এবং ম্যাথিউ। ম্যাথিউ পায়ের উপর পা তুলে বসে রিকার্ডোকে পরখ করছে। রিকার্ডোর এই নীরবতা যে ঝড়ের আগের পূর্বাভাস তা নিয়ে সে নিশ্চিত।
উপস্থিত হলরুমের মাঝে হঠাৎ ডাকিয়ানা ফোস ফোস করতে করতে দাঁড়িয়ে বলে,
” কাউন্ট। আটজন কোভেনকে খুন করা হয়েছে। আপনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন না? ওই নেকড়ে আমাদের সীমানায় এসে আমাদের কোভেন সদস্যদের খুন করে বেরাচ্ছে আর আমরা এর জবাব দিবো না। ”
রিকার্ডো স্মিত হাসে। হাসতে হাসতে একহাত দিয়ে ঘাড় বাকা করে সেখানে হাত দিয়ে ঘসে হালকা৷ তারপর মেঝেতে লেপ্টে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এদের সৌভাগ্য যে এরা নেকড়ের হাতে মরেছে। কারণ এখানে ফিরে এলে আমি এদের এমন মৃত্যু দিতাম যা কেউ কল্পনাও করে নি। ”
ডাকিয়ানা বলে,
” কি বলছেন এসব কাউন্ট। এদের দোষ কোথায় ছিলো? ”
” যেই ভ্যাম্পায়ারের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, শত্রুকে মারার ক্ষমতা নেই, সেই ভ্যাম্পায়ারের বেঁচে থাকার অধিকারও নেই। ”
ডাকিয়ানা রাগ পুষে বসে পড়ে। রিকার্ডো একবার হলে উপস্থিত সকলকে পরখ করে নেয়। তারপর ঠান্ডা স্বরে বলে,
” আরোণ রদ্রিগেজ আসছে। ”
ম্যাথিউ ব্যতিত সকলে চমকে তাকায় রিকার্ডোর দিকে। ড্যানিয়েল বলে,
” তুমি কিভাবে বুঝলে? ”
” আরোণের প্রধান উদ্দেশ্য আমার সাথে দেখা করা। মাঝে এই আটজন পথের কাঁটা ছিলো। তাই এদের শেষ করে দিয়েছে। ”
এটুকু বলে রিকার্ডো বোগডানের দিকে তাকায়। তারপর বাকা হেসে বলে,
” বোগডানের জীবন নেওয়াও আপাতত তার অন্যতম উদ্দেশ্য। ”
বোগডান কাপা স্বরে বলে,
” আমি কি করেছি কাউন্ট? ”
” অভিনয় করো না। আরোণের পালের সদস্য সোফিয়াকে খুন করেছো তুমি। আমার জানা আছে। ”
উপস্থিত সকলে বোগডানের দিকে তাকায়। বোগডান নিচে তাকিয়ে বলে,
” কোনো ভুল করি নি আমি। উল্টো প্রমাণ করেছি যে আমরা সেই নেকড়েদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। ”
গর্জে উঠে রিকার্ডো। চোখ ছোট করে বোগডানের দিকে তাকিয়ে বলে,
” পিঠে ছুড়ি মেরে কাউকে খুন করে নিজের শক্তি জাহির করছো তুমি? কাপুরুষ কোথাকার! আমরা ভ্যাম্পায়ার। শত্রুর জীবন শত্রুর চোখে চোখ রেখে নেই আমরা। কাউকে বোকা বানিয়ে মিথ্যা প্রেমের জ্বালে ফেলে খুন করাটা কাপুরুষোচিত কাজ ছাড়া আর কিছুই না। ”
বোগডান বুঝতে পারে রিকার্ডো বেশ রেগেছে। সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে নিবে তখনই হলরুমে ঝড়েরবেগে প্রবেশ করে আরোণ এবং তার পাল। রিকার্ডো বাদে সকলেই উঠে দাঁড়ায়। হিংস্র হয়ে উঠে সকল ভ্যাম্পায়াররা। সরু সূঁচালো দুটি দাঁত বেরিয়ে আসে সকলের। রিকার্ডো সকলকে অবাক করে দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” কাউন্ট রিকার্ডোর তুষ দূর্গে স্বাগতম তোমাকে আলফা আরোণ রদ্রিগেজ। ”
আরোণ একবার রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ হলরুমে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের পলকে বোগডানের কাছে গিয়ে তাকে ছুড়ে হলরুমের মাঝে ফেলে। সকল ভ্যাম্পায়াররা রেগে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়। রিকার্ডো সাথে সাথে সকলকে বলে উঠে,
” বোগডানকে কেউ বাঁচানোর চেষ্টা করলো মানে সে আমার বিপক্ষে গেল। ”
ভ্যাম্পায়াররা সকলেই ক্ষোভে ক্ষুব্ধ হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রিকার্ডো আরোণের দিকে তাকিয়ে বলে,
” এর মতো কাপুরুষের এভাবেও বাঁচার অধিকার নেই। তাই যা ইচ্ছা এর সাথে করতে পারো। ”
আরোণ দ্রুত গতিতে হলরুমের মাঝে থাকা বোগডানের কাছে গিয়ে এক পা তার বুকের উপর রেখে চেপে ধরে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমার প্রাসাদে ভ্যাম্পায়ারদের প্রবেশের সাহস কি করে হয় রিকার্ডো? ”
রিকার্ডো বাকা হেসে বলে,
” বোগডান সেই প্রাসাদে প্রবেশ না করলে জানতেই পারতাম না যে নেকড়েদের রাজ্যে আজকাল মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। ”
” আমার প্রাসাদে আমি নেকড়ে রাখবো না মানুষ সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেই বিষয়ে কথা বলার অধিকার আর কারো নেই। ”
রিকার্ডো ঝড়ের গতিতে এসে আরোণের সামনে দাঁড়ায়। এক পা বোগডানের বুকের উপর রেখে আরোণের চোখে চোখ রেখে বলে,
” কে সেই মেয়ে? যাকে বাঁচানোর জন্য তার কক্ষে ক্রুশ রেখে দিয়েছো? আরোণ রদ্রিগেজের কাছে এক সাধারণ মানব কন্যা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো? আমি তার পরিচয় জানতে আগ্রহী। ”
” তোমার সকল শত্রুতা আমার সাথে, ওই মানব কন্যার সাথে না। তাই তাকে এই বিষয়ে জড়াবে না। ”
জোরে হেসে উঠে রিকার্ডো। পুরো হলরুম কাপিয়ে হাসে সে। ম্যাথিউ সহ আরো কিছু ভ্যাম্পায়ারের মুখেও হাসি ফুটে উঠে। রিকার্ডো দু হাত মেলে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
” নেকড়ে পালের আলফা আরোণ রদ্রিগেজ এক সামান্য মানব কন্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছে। যেই হিংস্র নেকড়ের মানুষের জীবন নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি মোহ মায়া ছিলো না সে এক সামান্য মানবীর মায়ায় জড়িয়েছে। ”
আরোণের রক্তিম চোখ যেন আরো কয়েক গুন বেশি লাল হয়ে উঠে রাগের চোটে। সে রিকার্ডোর থেকে চোখ সরিয়ে পায়ের নিচে ছটফট করতে থাকা বোগডানের দিকে তাকায়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
” আমার প্রাসাদে রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করে আমারই অধীনে থাকা কারো রক্ত পান করার আগে সেটার পরিণাম ভেবে নেওয়া উচিত ছিলো তোর। ”
এটুকু বলেই আরো জোরে পা দিয়ে চেপে ধরে আরোণ। এবার মেঝে ভেঙে ভিতরে তলিয়ে যায় বোগডানের দেহ। এখনো ছটফট করছে সে। আরোণ হুংকার দিয়ে বলে উঠে,
” ওই মেয়ের দিকে যে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করবে আমি ধরে নিবো সে নিজ হাতে নিজের মৃত্যুর সনদপত্রে স্বাক্ষর করেছে। ”
এই বলে আরোণ এক পা বোগডানের উপরে রেখেই নিচে ঝুঁকে একহাতে বোগডানের মাথা এক টান দিয়ে ঘাড় থেকে আলাদা করে ছুড়ে ফেলে। রিকার্ডোর মুখে এখনো লেপ্টে আছে বাকা হাসি। সে এগিয়ে আরোণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,
” ভালোবেসে ফেলেছো সেই মেয়েকে? ”
আরোণ ঠান্ডা স্বরে উত্তর দেয়,
” ওর ক্ষতি করার জন্য এগিয়ে আসলে তার সামনে ঢাল হিসেবে আমায় পাবে। ”
এতটুকু বলেই আরোণ বেড়িয়ে যায় তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে। নেকড়ে পালের বাকিরাও প্রস্থান করে। ড্যানিয়েল চাপা রাগ দেখিয়ে বলে,
” শত্রু নিজে আমাদের আস্তানায় এসেছে আর তুমি তাদের কিছু না বলে জীবিত যেতে দিলে? ”
রিকার্ডো বিড়বিড়িয়ে বলে,
” শত্রু নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে। মৃত পথযাত্রীকে যেতে দেওয়াই উত্তম। ”
রিকার্ডো হলরুম থেকে প্রস্থান করে। সকলে তাকিয়ে থাকে হলরুমের এক কোণে পড়ে থাকা বোগডানের মাথার দিকে।
ম্যাথিউর কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানিয়েল। ম্যাথিউ দু হাত মেলে বিছানায় শুয়ে আছে। ড্যানিয়েল কক্ষে পায়চারি করতে করতে বলে,
” দেখেছ তুমি রিকার্ডোর কাজ? এই ছেলে এই কোভেনদের ডুবিয়েই দম নিবে। ওর কার্যকলাপে কোভেনদের প্রতি ওর উদাসীনতা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। বোগডানকে কিভাবে সে নেকড়েদের হাতে তুলে দিতে পারলো? ”
ম্যাথিউ চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বললো,
” ভুল তো কিছু করে নি। বোগডানের মতো নির্বোধের এটাই প্রাপ্য ছিলো। ”
ড্যানিয়েল চোখ ছোট করে ম্যাথিউর দিকে তাকায়। রাগে মিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন করে,
” তুমি কি ভুলে যাচ্ছো রিকার্ডোকে তুমি সবথেকে বেশি ঘৃণা করো? ”
” আমি তাকে ঘৃণা করি তার মানে এই না যে যেটা ভুল সেটাকে ভুল এবং যেটা সঠিক সেটাকে সঠিক বলতে পারবো না। ”
রাগ গাঢ় হয় ড্যানিয়েলের। সে বুঝে না ম্যাথিউর মাথায় কি চলে। যাকে ঘৃণা করবে তার হয়ে আবার সাফাই কেন গাইতে হবে? ম্যাথিউ চোখ মেলে ড্যানিয়েলের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,
” আমি নাহয় ঘৃণা করি মানলাম। কিন্তু সেটা নিয়ে তোমার এতো মাথা ব্যাথা কেন? ”
” আমি শুধু চাই তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক। ”
” আমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে আবার সেটাকে সুন্দর করার চেষ্টা করা অনেকটা কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো হয়ে গেলো না? ”
” তোমার ভবিষ্যৎ তোমার মা ধ্বংস করেছে। আমি না। আমি শুধু ক্ষতিপূরণ করতে চাচ্ছি। ”
এটুকু বলে ড্যানিয়েল কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। ম্যাথিউ উঠে বসে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। ধীরে ধীরে গায়ে পড়ে থাকা ম্যাডিভাল শার্টটি খুলে ফেলে। শ্যামবর্ণের পাকাপোক্ত দেহের গড়নের মধ্যে ঘাড়ে থাকা কামড়ের দাগটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আয়নায়। ম্যাথিউ নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে মনে মনে বলে,
” ঘৃণা করি সকলকে আমি। কখনো ক্ষমা করবো না আমি। কখনো না। ”
আনাস্তাসিয়া স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। গতকাল যখন ওরিয়ন বলেছিলো সে সবকিছু ঠিক করে দিবে তখন সে ভেবেছিলো আসলেই আজকে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। তার নামে রটা কুৎসা মুছে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ভুল ছিলো। ওরিয়নকে তার বিশ্বাস করা উচিত হয় নি। আজ সকাল সকাল গ্র্যানি এসে তাকে জানায় যে ওরিয়নের বাসা থেকে বর্গেসরা আনাস্তাসিয়ার জন্য সম্মন্ধ পাঠিয়েছে। অফিলিয়া এ নিয়ে দ্বিমত করে নি। তার মতে এর থেকে ভালো কোনো সম্মন্ধ আর হতেই পারে না। ওরিয়ন ছোট বেলা থেকে তাদের চোখের সামনেই বড় হয়েছে, ভালো ঘরের বেশ শিক্ষিত এবং মার্জিত একজন ছেলে, কোনো বদভ্যাস নেই, আর তাছাড়া বর্গেসদের বেশ নামডাক আছে মেসিডোনিয়ায়। অতএব না করার প্রশ্নই আসে না। নিশ্চিত দেলিলাহ থিয়াকে ওরিয়নই এই কথা বলেছে? বিরক্ত হয়ে আছে সে। চরম বিরক্ত! এই মুহুর্তে এই বিয়ের জন্য রাজি হওয়া মানে এটা স্বীকার করা যে তার এবং ওরিয়নের মাঝে বন্ধুত্বের বাহিরে অন্য কোনো সম্পর্ক আছে। আর তাছাড়াও আনাস্তাসিয়া ওরিয়নকে শুধু বন্ধু মনে করে। এসব বিয়ের মতো এতো বড় বিষয়ের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত নয়। তারই কিছু একটা করতে হবে এখন। ওরিয়নকেই সোজাসুজি মানা করতে হবে এই বিষয়ে।
দুপুরে খাওয়া শেষ করে কক্ষে ফিরে এক ঘুম দিয়ে উঠে ক্যাথরিন। এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। ক্যাবিনেট খুলে একটা সাদা রঙের ম্যাডিভাল গাউন বের করে। লোল্যান্ডা সকালে এই গাউনটা তার জন্য কিনে এনেছিলো। ক্যাথরিন গাউনটা পড়ে নেয়। আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। বেশ সুন্দর লাগছে। তার চোখ পড়ে ক্যাবিনেটের উপরে রাখা আরোণের দেওয়া খঞ্জরটার দিকে। খঞ্জরটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে সে গাউনটা হাটুর উপরে তুলে। তারপর হাটুর কিছুটা নিচে আরোণের দেওয়া রুমালটা বেধে সেখানে খঞ্জরটা বেধে নেয়। তখনই দরজায় খট খট শব্দ হয়। ক্যাথরিন উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। লোল্যান্ডা কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলে,
” যাক ঘুম ভেঙেছে তোমার। ”
এটুকু বলে ক্যাথরিনকে সে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার লক্ষ্য করে দেখে বলে,
” ক্যাথরিন! কি সুন্দর লাগছে তোমায়! একদম রোমানিয়ান মনে হচ্ছে তোমাকে। ”
ক্যাথরিন হালকা হেসে বলে,
” তোমাকে ধন্যবাদ। গাউনটা আসলেই অসম্ভব সুন্দর। ”
লোল্যান্ডা তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে এসে বলে,
” হালকা সাজ ছাড়া এই সৌন্দর্য অসম্পূর্ণ। ”
ক্যাথরিনকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয় লোল্যান্ডা। তারপর তার চুল মাঝখান দিয়ে বিলি কেটে আঁচড়ে দেয়। ক্যাবিনেট থেকে একটা সাদা পাথরের লকেট এবং জলপাই রঙের হুড ছাড়া ক্লক এনে সেটা পরিয়ে দেয়। ক্যাথরিন আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,
” এখন সম্পূর্ণ রোমানিয়ান লাগছে আমাকে? ”
লোল্যান্ডা হেসে বলে,
” একদম। ”
হঠাৎ ক্যাথরিন বলে উঠে,
” এখানে কোনো চার্চ আছে লোল্যান্ডা? ”
” হ্যাঁ। আছে তো। ”
ক্যাথরিন আবার প্রশ্ন করে,
” ক্রিয়াস কোথায়? ”
” নিজের কক্ষে আছে। ”
ক্যাথরিন দরজা খুলে পাশে ক্রিয়াসে কক্ষের দরজায় কড়া নাড়ে। ক্রিয়াস সাথে সাথেই দরজা খুলে। ক্যাথরিনকে দেখে বলে,
” কিছু প্রয়োজন? ”
” চার্চে যেতে চাই আমি। ”
ক্রিয়াস হালকা চোখ কুচকে প্রশ্ন করে,
” কেন? ”
ক্যাথরিন এবার বিরক্ত হয়ে বলে,
” চার্চে মানুষ কেন যায়? ”
” যে কারণেই যাক। তুমি যেতে পারবে না। ”
” কেন? ”
” আমি চার্চের ভিতর প্রবেশ করতে পারবো না। তাই তোমার সুরক্ষা ও নিশ্চিত করতে পারবো না। ”
লোল্যান্ডা পিছন থেকে বলে,
” আমি সাথে যাবো। কোদ্রিন এবং লোনাটও ভিতরে থাকবে আমাদের সাথে। তুমি চার্চের বাহিরেই অপেক্ষা করো ততক্ষণ। ”
ক্রিয়াস রাগ দেখিয়ে লোল্যান্ডাকে বলে,
” মোটেও ওকে প্রশ্রয় দিবে না তুমি। ”
লোল্যান্ডা উল্টো বলে,
” ক্যাথরিন আমার বন্ধু। তোমার কি মনে হয় আমি কখনো ওর বিপদ হতে পারে এমন জায়গায় ওকে নিয়ে যেতে বলবো? ”
ক্রিয়াস এক মুহূর্ত লোল্যান্ডার দিকে তাকিয়ে বলে,
” এভাবে চেহারা দেখিয়ে বাহিরে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি নেই। যেতে চাইলে গিয়ে এমনভাবে তৈরী হও যাতে কারো দৃষ্টিতে না পড়ো তোমরা। ”
লোল্যান্ডা ক্যাথরিনের হাত ধরে কক্ষে ফেরত যেতে যেতে হেসে বলে,
” আমরা এখনই আসছি। ”
চার্চের ভিতর প্রার্থনা শেষ করে উঠে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয় ক্যাথরিন। পিছনেই লোল্যান্ডা দাঁড়িয়ে আছে। লোল্যান্ডা হালকা তাড়া দেখিয়ে বলে,
” জলদি স্কার্ফ পড়ে চলো। ক্রিয়াস নাহয় আমাকে কথা শুনাবে। ”
ক্যাথরিন সাদা স্কার্ফটি মাথায় জড়িয়ে নেয়। তারপর লোনাট, কোদ্রিন এবং লোল্যান্ডার সাথে বেরিয়ে আসে চার্চ থেকে। ক্রিয়াস বাহিরেই অপেক্ষা করছিলো। ওদের বের হতে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
” তাড়াতাড়ি চলো এখন এখান থেকে। ”
ক্যাথরিন এক পা বাড়িয়েই কিছু মনে করার মতো করে বলে,
” উফফ! আমি ফাদারের থেকে পবিত্র পানি নিয়ে নিতে ভুলে গিয়েছি। ”
ক্রিয়াস ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” সেটা দিয়ে তোমার কি কাজ? ”
” চার্চে যেহেতু এসেছিই নিয়ে নিতে সমস্যা কোথায়? বাসকোভ প্রাসাদে গেলে আর কখনো বেরোনোর সুযোগ না-ও পেতে পারি। ”
” আচ্ছা কোদ্রিন গিয়ে নিয়ে আসুক। ”
ক্যাথরিন নাকোচ করে বলে,
” কোদ্রিন এবং লোনাট গিয়ে ঘোড়া ছাউনির এখান থেকে নিয়ে আসুক। আমি এক দৌড়ে গিয়ে এখনই ফিরে আসছি। ”
এটা বলেই ক্যাথরিন দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। লোনাট এবং কোদ্রিনও ঘোড়া আনতে চলে যায়। ক্রিয়াস বিড়বিড়িয়ে বলে,
” এই মেয়ের মনে কোনো ডর ভয় নেই। ”
লোল্যান্ডা পাশে থেকে কথাটা শুনে ফেলে। সে প্রতুত্তরে বলে,
” এজন্যই আমার ওকে এতো ভালো লাগে। আমার মতোই সাহসী ও। ”
ক্রিয়াস বিদ্রুপ করে বলে,
” নিজের মিছে প্রশংসা করার অভ্যাস তোমার দূর হলো না। ”
লোল্যান্ডা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিয়াসের দিকে তাকায়। হঠাৎ ক্রিয়াসের শার্ট ধরে টেনে তার ঠোঁটে আলতোভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। ক্রিয়াস চমকে তাকায় লোল্যান্ডার দিকে। লোল্যান্ডা ক্রিয়াসের শার্ট ছেড়ে দিয়ে বলে,
” আমার সাহস নিয়ে যতবার প্রশ্ন তুলবে ততবারই একটা করে চুমু খাবো আমি। ”
ক্রিয়াস হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,
” কে বলেছে শুধু নেকড়েরা ভয়ংকর হয়? এই মানব কন্যারা আরো বেশি ভয়ংকর। ”
তখনই কোদ্রিন এবং লোনাট দৌড়ে আসে সেখানে। কোদ্রিন এবং লোনাটকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে ক্রিয়াস প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? এভাবে দৌড়ে আসছো কেন তোমরা? ”
লোনাট হাপাতে হাপাতে উত্তর দেয়,
” ক্রিয়াস ভাই। ছাউনির নিচে ক্যাথরিন বাদে আমাদের সবার ঘোড়া আছে। ”
লোল্যান্ডা বলে,
” হয়তো ঠিক করে বাধন বাধিস নি তোরা। আশেপাশে খুঁজে দেখ পেয়ে যাবি। ”
ক্রিয়াস এক মুহূর্ত দম নেয়। সামনে চার্চের দিকে তাকায়। আতংক মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
” ক্যাথরিন এখনো বাহিরে আসে নি কেন? ”
লোল্যান্ডার কপালেও এবার চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। সে বলে,
‘ আমি ভিতরে গিয়ে দেখে আসছি। ”
মহাপ্রয়াণ পর্ব ১৫+১৬
কোদ্রিন এবং লোনাটও পিছনে পিছনে যায়। ক্রিয়াস মনে মনে বলতে থাকে,
” ক্যাথরিন তোমার ঠিক থাকার উপর আমার জীবন নির্ভর করছে। ”
লোল্যান্ডাকে দৌড়ে বাহিরে আসতে দেখে ক্রিয়াসের দম আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়। লোল্যান্ডা এসে বলে,
” চার্চের পিছনের দরজা খোলা। ক্যাথরিন ভিতরে নেই। ”
ক্রিয়াস ভয়ে, রাগে নিজের দু’হাতে নিজের চুল মুঠোয় নিয়ে বলে,
” আলফা সব ভস্ম করে দিবে লোল্যান্ডা। উনার আসার আগে ক্যাথরিনকে খুঁজে পেতে হবে। ওর উপর একটা আঁচ আসা মানেও আমাদের সবার জীবন যাবে। ”
