মহাপ্রয়াণ পর্ব ৪১+৪২

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৪১+৪২
নাফিসা তাবাসসুম খান

একটা হালকা আকাশী রঙের গাউন পড়ে আয়নায় নিজেকে ঘুরে ফিরে দেখছে আনাস্তাসিয়া। সোনালী হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলোকে পিঠ জুড়ে ছেড়ে রেখেছে। কানে একজোড়া পাথরের দুল পড়ে নিজের বানানো জেসমিনের সুগন্ধি গলার একপাশে অল্প একটু লাগিয়ে নেয়। তৈরী হওয়া শেষ হতেই সে তড়িঘড়ি করে ক্যাথরিনের কক্ষে প্রবেশ করে। ক্যাথরিনের কক্ষে প্রবেশ করতেই সে দু’হাতে মুখ চেপে উল্লাসিত কণ্ঠে বলে উঠে,

” ঈশ্বর! কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে। ”
লাল এবং কালো রঙের মিশেলের একটি গাউন পড়েছে ক্যাথরিন। গাউনের বুকের দিক থেকে কোমরের দিক পর্যন্ত কালো পাথরের কাজ। কব্জি সমান লাল পাতলা কাপড়ের উপরও কালো পুতির কাজ। হাতে তার একগুচ্ছ লাল ক্যামেলিয়া ফুল। কানেও এক জোড়া কালো পাথরের দুল। আনাস্তাসিয়ার মুখে এই কথা শুনে লজ্জা পেয়ে ক্যাথরিন সামান্য হাসে।
লোল্যান্ডা একপাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
” ওকে এতো সুন্দর করে আমি তৈরী করেছি। অ্যানা তোমার উচিত আমাকে চমৎকার করে একটা ধন্যবাদ জানানো। ”
আনাস্তাসিয়া ক্যাথরিনের সামনে এসে লোল্যান্ডার দিকে তাকিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” যদিও আমার বোন দেখতে এভাবেই বেশ সুন্দর তবুও তোমাকে ধন্যবাদ পোল্যান্ডা। ”
সাথে সাথে লোল্যান্ডার হাস্যজ্জ্বল মুখে অভিমানের রেশ ফুট উঠে। ক্যাথরিন আনাস্তাসিয়ার কথায় এবার শব্দ করে হেসে দিয়ে বলে,
” অ্যানা! পোল্যান্ডা নয় লোল্যান্ডা হবে। ”
লোল্যান্ডা মুখে ভার করে বলে,
” আজকে ক্যাথরিনের বিয়ে তাই বেঁচে গেলে অ্যানা। নাহয় আমাকে পোল্যান্ডা ডাকার অপরাধে তোমার নামে আমি মামলা ঠুকতাম। ”
আনাস্তাসিয়া দাঁত বের করে হেসে বলে,
” ইশশ! আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম তোমার কথায়। ”
এটা বলেই আনাস্তাসিয়া আর ক্যাথরিন হাসতে থাকে। লোল্যান্ডা অভিমানী সুরে বলে উঠে,
” বোনকে পেয়ে তুমি বন্ধুর সাথে পল্টি মারছো ক্যাথরিন। এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। ”
আনাস্তাসিয়া হেসে বলে,

” আচ্ছা আর মজা নিবো না আমি। ”
লোল্যান্ডা ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে বলে,
” আমাদের আলফার পছন্দ আছে বলতে হয়। এই প্রথম আমি কোনো নববধূকে লাল এবং কালো রঙের গাউন পড়ে বিয়ে করতে দেখছি৷ কিন্তু এই সাজে তোমাকে সম্পূর্ণ নেকড়ে পালের রাণী মনে হচ্ছে। ”
আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” আসলেই! ক্যাথরিন তোকে দেখে আজ আরোণ ভাই নিশ্চিত জ্ঞান হারাবে। ”
ক্যাথরিন আনাস্তাসিয়ার পিঠে একটা আলতো থাপ্পড় দিয়ে বলে,
” মজা নিবি না তো। ”
ওদের কথার মাঝেই কক্ষের দরজায় করাঘাতের শব্দ হয়। ক্যাথরিন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতেই ক্রিনা কক্ষে উপস্থিত হয়ে বলে ক্যাথরিনের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। আনাস্তাসিয়া ক্রিনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” তুমি যাও আমরা আসছি। ”

ক্রিনা বেরিয়ে যাওয়ার পর আনাস্তাসিয়া এবং লোল্যান্ডা ক্যাথরিনের মাথায় একটি কালো টিয়ারা পড়িয়ে দেয় এবং মুখের উপর কালো পাতলা পর্দা ফেলে দেয়। আনাস্তাসিয়া হেসে বলে,
” যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। ”
ক্যাথরিন আনাস্তাসিয়ার একহাত ধরে বলে,
” আমার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে। ”
আনাস্তাসিয়া বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” আরোণ ভাইয়ের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত মনে করতে থাক, দেখবি আর ভয় করবে না। ”
ক্যাথরিন জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ বুজে। মনে করতে থাকে আরোণের সাথে অতিবাহিত প্রতিটি মুহূর্ত। তার ভালোবাসার মানুষকে সে নিজের স্বামী হিসেবে পেতে চলেছে। আজ ওর সবথেকে খুশির দিন। ক্যাথরিন চোখ খুলে আনাস্তাসিয়াকে প্রশ্ন করে,

” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আর কিছুক্ষণ পর আরোণ চিরজীবনের জন্য আমার হয়ে যাবে। ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া এতোটা সহজ হয়? ”
আনাস্তাসিয়া থমকায়। এক মুহূর্তের জন্য ওর চোখের সামনে রিকার্ডোর চেহারা ভেসে উঠে। থমথমে গলায় আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” না। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া এতোটা সহজ হয়। কারো কারো জন্য এটা সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার থেকেও বেশি কঠিন। ”
আনাস্তাসিয়ার কথা শুনে লোল্যান্ডার চেহারাও মলিন হয়ে আসে। তবুও সে মুখে হাসি একে ক্যাথরিনকে বলে,
” ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া যতটা কঠিন তাকে নিজের করে রাখা তার থেকেও বেশি কঠিন। আর আমার বিশ্বাস এই কঠিন কাজটা তুমি খুব ভালো করেই করতে পারবে। ”
ক্যাথরিন আত্মবিশ্বাসের সহিত হাসে। কক্ষ থেকে বের হয় তারা নিচে যাওয়ার জন্য।

প্রাসাদের ভেতর চারিদিকটা বিভিন্ন ফুল এবং মোমবাতির আলোয় ঝলমল করছে। আকাশে চাঁদের পাশাপাশি আজ তারার মেলা। আরোণ এবং ক্যাথরিনের বিয়ের খুশিতে যেন তারাও আকাশে উপস্থিত থেকে নিজেদের জানান দিচ্ছে।
কালো স্যুট পড়ে প্রধান হলরুমে দাঁড়িয়ে আছে আরোণ। অপেক্ষা করছে ক্যাথরিনের। আজকে এক মুহূর্তের অপেক্ষাও বেশ লম্বা মনে হচ্ছে তার। হঠাৎ সকলের সোড়গোলে আরোণ চোখ তুলে সামনে তাকায়। ক্যাথরিন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে। মুখের উপর তার কালো পর্দা ফেলা। তবুও সেই পর্দা ভেদ করে আরোণ ক্যাথরিনকে পরখ করে। তার ক্যামেলিয়া পর্দার আড়ালেও লাজে লাল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। ক্যাথরিন যতই তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে আরোণের হৃদয় ততই দ্রুত চলছে। সিঁড়ির নিচে হলরুমের দু’পাশে সকল নেকড়েরা খুশিতে মত্ত্ব হয়ে এক নেকড়ে মানব এবং মানব কন্যার প্রণয়ের পবিত্র পরিণতির সাক্ষী হচ্ছে। ক্যাথরিন আরোণের কাছাকাছি আসতেই আরোণ হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। ক্যাথরিন নিজের হাত আরোণের হাতে দিয়ে আরোণের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। আরোণের ঠোঁটের কোণের হাসি প্রসস্থ হয়। ধীর স্বরে ক্যাথরিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

” মোহনীয় দেখাচ্ছে তোমাকে। ”
ক্যাথরিন লজ্জায় যেন সামান্য নুইয়ে পড়ে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিয়াস গলা খাকড়ি দিয়ে বলে উঠে,
” বিয়েটা হয়ে গেলে আপনি মন ভরে ক্যাথরিনকে দেখে নিয়েন আলফা। ”
আরোণ এবং ক্যাথরিন সহ উপস্থিত সকলেই হেসে উঠে ক্রিয়াসের কথায়। বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। পালাক্রমে শপথ বাক্য পাঠের মুহূর্ত আসে। ক্যাথরিন আরোণের দিকে তাকিয়ে শপথ বাক্য পাঠ শুরু করে।
” আমার এই ঘৃণা থেকে ভালোবাসার যাত্রার প্রতিটা মুহুর্তে তুমি যেভাবে আমাকে আগলে রেখেছো আমি কথা দিচ্ছি বাকি জীবন আমি একইভাবে তোমাকে আগলে রাখবো। নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সবটুকু দিয়ে কেবল তোমায় ভালোবাসাবো ওয়াদা করছি। সকল পরিস্থিতিতে এবং সবসময় তোমার পাশে থাকার ওয়াদা করছি। তোমার এতো বছরের এই দীর্ঘ জীবনের একাকিত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার ওয়াদা করছি। আমি ক্যাথরিন অ্যালভেজ আজ থেকে তোমাকে নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলাম। ”

আরোণ সামান্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার কাছে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তার সামনে বধূবেসে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাথরিনকে এই মুহুর্তে তার আকাশের চাঁদ মনে হচ্ছে। যা সে বামণ হয়েও পেয়ে গেলো। আরোণ ঘোর মেশানো স্বরে নিজের শপথ বাক্য পাঠ করা শুরু করে।
” ওয়াদা করছি আমার হৃদয় এবং জীবনে কেবল তোমার নামই থাকবে। ওয়াদা করছি কোনো কষ্ট তোমাকে ছোঁয়ার আগে সেই কষ্টের কারণ আমি নিশ্চিহ্ন করে দিবো। ওয়াদা করছি স্বামী হিসেবে তোমাকে কখনোই কোনো অভিযোগের সুযোগ দিবো না। ওয়াদা করছি তোমার ঠোঁটের কোণে থাকা হাসির কারণ হয়ে থাকবো। ওয়াদা করছি তোমার হাত কখনোই ছেড়ে যাবো না। ওয়াদা করছি ঠিক যতটা ভালোবাসলে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ কাজ করবে না ঠিক ততটা ভালোবাসবো তোমাকে। আমি আরোণ রদ্রিগেজ আজ থেকে তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলাম। ”

ক্যাথরিনের ঠোঁটে লেপ্টে আছে হাসি। আনাস্তাসিয়া একটা পাথর খচিত কাঁচের থালা হাতে এগিয়ে আসে। আরোণ এবং ক্যাথরিন হেসে সেই থালা হতে দুটি আংটি নেয়। আরোণ ক্যাথরিনের অনামিকা আঙুলে একটি লাল পাথরের হীরার আংটি পড়িয়ে দেয়। ক্যাথরিনও আরোণকে নিজের হাতে থাকা আংটিটা পড়িয়ে দেয়। ক্রিয়াস হেসে আরোণ এবং ক্যাথরিনকে স্বামী স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করতেই আরোণ ক্যাথরিনের মুখের উপরের পর্দাটা তুলে পিছনের দিকে ছেড়ে দেয়। সন্তর্পণে ক্যাথরিনের কপালে আলতো করে চুমু খায়। সাথে সাথে সমগ্র হলরুমে করতালির রোল পড়ে যায়। নব দম্পতির জন্য সকলেই মন থেকে আর্শীবাদ করে।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আনাস্তাসিয়া আজ খুব খুশি নিজের বোনের জন্য। কেন যেন রিকার্ডোকেও খুব মনে পড়ছে তার। সকলের নব দম্পতিকে শুভেচ্ছা জানানো শেষ হলে আনাস্তাসিয়া এগিয়ে যায় তাদের দিকে। প্রথমেই সে ক্যাথরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে,

” আজ মা, বাবা এবং লিয়াম থাকলে খুব খুশি হতো। কিন্তু তারা আমাদের সাথে না থাকলেও তাদের আর্শীবাদ সবসময় আমাদের সাথে আছে। ঈশ্বর তোকে সবসময় খুশি রাখুক। ”
বলতে বলতে আনাস্তাসিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ক্যাথরিন বোনকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। ক্যাথরিনকে ছেড়ে আনাস্তাসিয়া আরোণের দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমার বোন আজ থেকে আপনার কাছে আমানত ভাই। সবসময় ওর খেয়াল রাখবেন। ”
আরোণ হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়। আনাস্তাসিয়া এগিয়ে গিয়ে আরোণকে জড়িয়ে ধরে। আরোণ আনাস্তাসিয়ার কানে কানে বলে,

” ক্যাথরিনের পাশাপাশি একটা ওয়াদা তোমাকেও করতে চাই আমি। ”
আনাস্তাসিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। আরোণ বলে,
” ভাই হিসেবে তোমার প্রতি নিজের সকল দায়িত্ব পালন করবো। সেজন্য যদি নিজের শত্রুর জীবন ছাড় দিতে হয় সেটা করতেও রাজি আমি। ”

আবেগে আনাস্তাসিয়া আবার আরোণকে জড়িয়ে ধরে। তার এখন আর নিজেকে একা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তারও পরিবার আছে। ক্যাথরিন হেসে আরোণ এবং আনাস্তাসিয়াকে দেখছে। তার এখন পুরোপুরি বিশ্বাস হয়ে গিয়েছে সে ভুল মানুষকে ভালোবাসে নি। ক্যাথরিন সবসময়ই এমন কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলো যে মানুষ কেবল ক্যাথরিনকে নয় তার পরিবারকেও ভালোবাসবে। আরোণ ঠিক তেমনই একজন।

আনাস্তাসিয়া আরোণকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে হঠাৎ প্রাসাদের মূল দরজা জোরে শব্দ করে খুলে যায়। সকলেই হততম্ভ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রবল বেগে বাতাস বইছে। বাতাসের তীব্রতায় হলরুমের অধিকাংশ মোমই নিভে গিয়েছে। আরোণ সামনের দিকে এগিয়ে ক্যাথরিনকে আড়াল করে দাঁড়ায়। দরজার এদিকে একটি ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। নেকড়েদের মধ্যে হতে একজন চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে উঠে,
” কে ওখানে? ”
ছায়াটা আর কয়েক কদম সামনে আসতেই নিভু নিভু কিছু মোমের আলোয় তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠে। আরোণ ভ্রু কুচকে বলে উঠে,
” রিকার্ডো? ”

রিকার্ডো কোনো কথা না বলে পুরো হলরুমে একবার নজর বুলিয়ে নেয়। সাথে সাথেই তার চোখ গিয়ে আটকায় আরোণের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনাস্তাসিয়ার দিকে। চোখে তার অশ্রু এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয়। রিকার্ডো কোনো কথা না বলে সোজা আরোণের দিকে এগিয়ে যায় হিংস্রতার সহিত। আনাস্তাসিয়া আরোণের পাশেই থাকায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আরোণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রিকার্ডোকে বলে উঠে,
” তুমি ভুল বুঝছো। আমার কথা শুনো। ”

রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার দিকে হিংস্রতার সহিত তাকাতেই আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” তুমি আমার সাথে চলো আমি তোমাকে সব খুলে বলছি। ”
রিকার্ডোর আকস্মিক আগমন এবং এমন ব্যবহারে আরোণও রেগে যায়। সে আনাস্তাসিয়াকে বলে উঠে,
” তুমি একা এই পিশাচের সাথে কোথাও যাবে না অ্যানা। ”
ক্যাথরিন বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে। সে আনাস্তাসিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,
” এটা কে অ্যানা? ”
আনাস্তাসিয়া বলে উঠে,
” রিকার্ডো। ”

ক্যাথরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় রিকার্ডোর দিকে। আনাস্তাসিয়া যেমন বর্ণনা করেছিলো ঠিক তেমন দেখতে। রিকার্ডো রেগে আনাস্তাসিয়াকে বলে উঠে,
” আমি তোমাকে সামনে থেকে সরানোর আগে নিজ থেকে সরে যাও নাহলে খারাপ হয়ে যাবে। ”
আনাস্তাসিয়া বিপাকে পড়ে যায়। রিকার্ডো তার কোন কথাই শুনছে না। চারিদিকের সকল নেকড়ের’ হিংস্র দৃষ্টিতে রিকার্ডোর দিকে তাকিয়ে আছে। আরোণ গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
” অ্যানার সাথে খারাপ করার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল রিকার্ডো। ”
রিকার্ডো দ্বিগুণ স্বরে হুংকার দিয়ে বলে উঠে,

” তোর জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো আরেকবার ওর নাম মুখে নিলে। তোর সামনে থেকে ওকে আমি নিজের সাথে নিয়ে যাবো সাহস থাকলে আটকে দেখা। ”
এটা বলেই খপ করে আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে সামনের দিকে যেতে নেয় রিকার্ডো। কিন্তু পিছনে টান অনুভব করতেই পিছনে ফিরে দেখে আরোণ আনাস্তাসিয়ার আরেক হাত ধরে বলে,
” আমি জীবিত থাকতে অ্যানার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুই ওকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবি না। ”
ক্যাথরিন অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি আরোণের হাত থেকে আনাস্তাসিয়ার হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

” তুমি শান্ত হও। ওদেরকে যেতে দাও। কিছু হবে না। আনাস্তাসিয়া সামলে নিবে। ”
আনাস্তাসিয়াও চোখে আকুলতা নিয়ে আরোণের দিকে তাকিয়ে বলে,
” কিছু হবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি ওর সাথে নিরাপদ। ”
এতটুকু কথা শুনে আরোণের হাতের বাধন আলগা হয়ে আসে। সে ছেড়ে দেয় আনাস্তাসিয়ার হাত। তবে রিকার্ডোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। রিকার্ডো সাথে সাথে আনাস্তাসিয়ার হাত ধরে সেই প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসে। খানিকটা দূরে আসতেই আনাস্তাসিয়া এক ঝটকায় নিজের হাত ছুটিয়ে নেয়। রিকার্ডোর রাগে চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে। সে রাগান্বিত সুরে প্রশ্ন করে,

” এই প্রাসাদে কি করছিলে তুমি? তোমার কোনো ধারণা আছে ওরা কারা? ”
আনাস্তাসিয়া শান্ত স্বরে বলে,
” আমি জানি ওরা কারা। ”
রিকার্ডো অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
” তবুও? ”
আনাস্তাসিয়া এবার থমথমে গলায় জবাব দেয়,

” নেকড়েদের আলফা আরোণ রদ্রিগেজ আমার বোনের স্বামী। একটু আগে ওদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। ”
রিকার্ডো এবার অবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে। তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে আসে,
” কিভাবে সম্ভব? ”
আনাস্তাসিয়া এবার চেঁচিয়ে উঠে,
” সম্ভব। সে একজন নেকড়ে হলেও তার হৃদয় আছে। তারা একে অপরকে ভালোবাসে। বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে জড়িয়েছে। সকলে তোমার মতো ভীত না। তোমার মতো সকলে নিজেদের অনুভূতি নিয়ে এতো লুকোচুরি করে বেড়ায় না। তার সৎ সাহস আছে। তোমার মতো কাপুরষ নয়। ”
রিকার্ডোর মস্তিষ্ক মুহুর্তেই দপ করে জ্বলে উঠে। সে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠে,

” বাজে বকা বন্ধ করো। ”
আনাস্তাসিয়া থামে না। উল্টো রিকার্ডোর বুকে দু’হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে আরো জোরে চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
” বন্ধ করবো না আমি। কি করবে তুমি? হ্যাঁ? নিজেকে খুব শক্তিশালী মনে করো তুমি? আসল কথা হলো তুমি সাহসী নয় বরং একজন ভীত কাপুরষ। যার নিজের অনুভূতি জাহির করারও ক্ষমতা নেই। ভ্যাম্পায়ারদের কাউন্ট তুমি অথচ তোমার এই সামান্য সাহস নেই যে নিজের মনের কথা সজোরে স্বীকার করতে পারবে। ”
আনাস্তাসিয়ার কথা যেন রিকার্ডোর কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। শুনশান নীরব জঙ্গলের গহীনে সে চিৎকার করে বলে উঠে,

” এতো সত্যি শোনার ইচ্ছে তোমার? হ্যাঁ? ”
” হ্যাঁ নাসিয়া। ভালোবাসি তোমাকে আমি। অনেক বেশি ভালোবাসি৷ আকাশের বিশালতার থেকেও বেশি ভালোবাসি। কৃষ্ণ সাগরের গভীরতার থেকেও বেশি ভালোবাসি। ”
আনাস্তাসিয়া শান্ত হয়ে শুনে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তি। খুশিতে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার। রিকার্ডো আনাস্তাসিয়ার আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে আবার বলে উঠে,
” আর আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলে না? আমি ইচ্ছে করে তোমাকে দূরে ঠেলে দেই প্রতিবার তোমার ভালোর জন্য। আমি যা ছুঁই তা ধ্বংস হয়ে যায় নাসিয়া। তাই তোমাকে ভালোবাসলেও কখনো ছোঁয়ার সাধ্যি নেই আমার। ”
রিকার্ডোর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আনাস্তাসিয়া রিকার্ডোর শার্টের কলার ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে তার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। আনাস্তাসিয়ার আকস্মিক কাণ্ডে রিকার্ডো হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আনাস্তাসিয়া কি তার কথার অর্থ ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে নি? আনাস্তাসিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রিকার্ডোর চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,

” আমি ধ্বংস হতেও রাজি রিক। ”
রিকার্ডোর মাঝে জড়তা কাজ করছে। পুরো জীবন সকলের কাছে বর্বর হিসেবে পরিচিত রিকার্ডো নিজের ভালোবাসার মানুষকে ছোঁয়ার সাহস করে উঠতে পারছে না। আনাস্তাসিয়া সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। এই দৃষ্টি উপেক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠে না রিকার্ডোর দ্বারা। আনাস্তাসিয়ার কোমর ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজেদের মাঝে সামান্য দূরত্বটাও ঘুচিয়ে দেয় সে আনাস্তাসিয়ার অধরে গভীর ভাবে চুমু দিয়ে। কিছুক্ষণ এভাবেই থেকে আনাস্তাসিয়ার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে তার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে রয় রিকার্ডো। দুজনের নিঃশ্বাসের গভীর ওঠানামা মাপা যাচ্ছে। আনাস্তাসিয়া চোখ বুজে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
” ভালোবাসি রিক। ”
রিকার্ডো ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
” মরবে। ”
” তোমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে শতবার মরতেও রাজি। ”

ক্যাথরিনের মুখ হতে আনাস্তাসিয়ার সাথে রিকার্ডোর পরিচয় পর্ব থেকে শুরু করে সব শুনে আরোণ শান্ত হয় কিছুটা। ক্যাথরিন আরোণের কাধে হাত রেখে বলে,

” আমাদের ভালোবাসা সম্ভব হলে ওদের ভালোবাসাও অসম্ভব কিছু নয় আরোণ। শুধু ওদের একান্তে কিছু সময় দাও। এমনও তো হতে পারে ভালোবাসার জন্য রিকার্ডোও একদিন বদলে গেলো। ”
আরোণ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর ক্যাথরিনের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। আরোণের কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে এই মুহুর্তে তারা। এসবকিছুর মাঝে আরোণ ক্যাথরিনের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। ক্যাথরিনের গালে হাত রেখে আরোণ বলে,
” দুঃখিত আমি। আমার এখন তোমাকে সময় দেওয়ার কথা অথচ আমি রিকার্ডোর দোষ গুন খুঁজতে বসে পড়েছিলাম। ”
ক্যাথরিন হেসে বলে,

” সমস্যা নেই। তুমি নেকড়ে মানব। তোমার ঘুম না হলেও চলবে কিন্তু আমি মানুষ। আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি গেলাম। শুভ রাত্রি। ”
এটুকু বলে ক্যাথরিন যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আরোণ ওকে সাথে সাথে কোলে তুলে নেয়। ক্যাথরিন আরোণের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,
” কি হচ্ছে? ”
আরোণ হেসে বলে,
” দুঃখিত ক্যাথ। কিন্তু আজ রাতে আমি তোমাকে ঘুমানোর অনুমতি দিতে পারছি না। ”
ক্যাথরিন দু’হাতে আরোণের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমার অনুমতির প্রয়োজন নাকি আমার? ”
আরোণ কক্ষে যেতে যেতে বলে,
” একরাত নির্ঘুম কাটালে খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না। ”

মাঝরাতে বেঘোরে নিজেদের কক্ষে ঘুমিয়ে আছে কাউন্ট লোনেল এবং কাউন্টেস সিসিলিয়া। নীরবে হঠাৎ দরজা খুলে যায়। কক্ষে গোপনে প্রবেশ করে ড্যানিয়েল এবং জ্যাকসন। দুজনের চোখেই হিংস্রতা স্পষ্ট। ড্যানিয়েল এসে দাঁড়ায় সিসিলিয়ার পাশে এবং জ্যাকসন এসে দাঁড়ায় লোনেলের পাশে। কাউন্ট লোনেল হঠাৎ সামান্য নড়ে উঠে। সামান্য এপাশ ওপাশ করে হঠাৎ চোখ মেলে তাকায় তিনি। সাথে সাথে জ্যাকসনকে দেখে ভয়ে মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে নেয়। তার আগেই জ্যাকসন লোনেলের মুখ চেপে ধরে। লোনেল হাত পা নাড়িয়ে ছটফট করতে থাকে। ধস্তাধস্তির শব্দে সিসিলিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলেই চোখের সামনে অপরিচিত একজনকে এভাবে লোনেলকে ধরে রাখতে দেখে তাৎক্ষণিক উঠে বসে পড়ে সে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করার আগেই পিছন থেকে ড্যানিয়েল তার গলা চেপে ধরে। লোনেল এবং সিসিলিয়া বুঝে উঠতে পারছে না এসব কি হচ্ছে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে না পেরে হাত বা পায়ের সাহায্যে শব্দ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে না।

হঠাৎ কারো পদধ্বনি শুনে লোনেল এবং সিসিলিয়া দরজার দিকে চোখ তুলে তাকায়। কক্ষে ড্রাগোস প্রবেশ করে। মুখে তার হাসি। ড্রাগোসকে দেখে সিসিলিয়া এবং লোনেলের মনে জাগা বাঁচার আকাঙ্খা মিলিয়ে যায় ড্রাগোসের মুখের হাসি দেখে। তারা বুঝতে পারছে না ড্রাগোস এভাবে হাসছে কেন। লোনেল কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু আর বলতে পারে না। ড্রাগোস নিজ থেকেই বলে উঠে,
” দুঃখিত কাউন্ট এবং কাউন্টেস। কিন্তু এখন সময় এসে পড়েছে আমার সিংহাসনে বসার। আর নতুন কাউন্টের আগমনের জন্য পুরনো কাউন্টকে তো মরতে হবেই। ”
সিসিলিয়া এবং লোনেল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না ড্রাগোসের বলা কথা। তাদের ছেলে খারাপ হতে পারে কিন্তু নিজের মা বাবাকে খুন করতে পারে এই কথা কখনো ভাবে নি তারা। ড্রাগোস লোনেলের সামনে এসে বলে,

” কি করবো কাউন্ট? আলবার্টদের উত্তরাধিকারী যে ফিরে এসেছে। তাকে রুখতে আমার এই সিংহাসনে বসা অতিব জরুরি। ”
ড্রাগোসের এই কথা শুনে লোনেল এবং সিসিলিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আলবার্টদের উত্তরাধিকারী ফিরে এসেছে মানে? কিভাবে সম্ভব? কে সেই উত্তরাধিকারী? কোথায় সে? তবে কি রাজ জোতিষ্যী ভারতানের কথা সত্যি হচ্ছে? তাদের এসব ভাবনার মাঝে ড্রাগোস বলে উঠে,
” কাউন্ট লিও আলবার্টের ছেলে রিকার্ডো আলবার্ট ফিরে এসেছে। সে নিজের সিংহাসন ঠিকই ছিনিয়ে নিতে আসবে। সেই সিংহাসন যেই সিংহাসন এক সময় তার পিতার ছিলো। তার পিতার মৃত্যুর পর যেই সিংহাসন হেনরিকসরা দখল করে নিয়েছিলো। ”

এটুকু বলেই দাঁড়িয়ে পড়ে ড্রাগোস। তারপর বলে উঠে,
” কিন্তু আপনারা চিন্তা করবেন না অহেতুক। তা আমি কখনো হতে দিবো না। এই সিংহাসন আমি নিজের করেই ছাড়বো। রিকার্ডোকে মরতে হবে। কিন্তু তার আগে এখন আপনাদের মরা প্রয়োজন। ঈশ্বর আপনাদের ডাকছে। যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। ”
লোনেল এবং সিসিলিয়া চোখের ইশারায় আকুতি করতে থাকে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না। ড্রাগোস চোখের ইশারা দিতেই জ্যাকসন এবং ড্যানিয়েল একটানে তাদের গর্দান হতে মাথা আলাদা করে ফেলে। গর্দানহীন দুটি দেহ কিছুক্ষণ গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে শান্ত হয়ে পড়ে। ড্রাগোস লাশ দুটির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
” বিদায় কাউন্ট লোনেল এবং কাউন্টেস সিসিলিয়া। ”

সকাল সকাল আনাস্তাসিয়াকে বাসায় ফিরে আসতে দেখে জোসেফ অবাক না হয়ে পারে না। সে একবার আনাস্তাসিয়াকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলে,
” তুমি? এই সময়? এখানে? কাউন্ট রিকার্ডো? তিনি কোথায়? ”
আনাস্তাসিয়া রহস্যময়ী হাসি দিয়ে জোসেফকে পাশ কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
” জোয়ান্দ্রা আর বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে এখনো? ”
জোসেফ আনাস্তাসিয়ার পিছু আসতে আসতে বলে,
” ওরা তো ঘুমিয়ে আছে কিন্তু আমার ঘুম তো উড়ে গিয়েছে। কাউন্ট সিবিউ গিয়েছিলো। উনার সাথে দেখা হয়নি তোমার? আর তোমার বোনের বিয়ে? বিয়ে হয়ে গিয়েছে? ”
আনাস্তাসিয়া পিছনে ফিরে জোসেফকে চিল্লিয়ে বলে উঠে,

” চুপ! কত্তো প্রশ্ন করো তুমি? আমাকে প্রশ্নের ভান্ডার বলে বেরাও অথচ নিজে এখন কি করছো? ”
জোসেফ হালকা রেগে তাকাতেই আনাস্তাসিয়া আবার রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলে,
” কিছু হয় নি। বিয়ে শেষ। আমি ফেরত এসে পড়েছি। আসার সময় পথে তোমার কাউন্টের সাথে দেখা হয়েছিলো। তাকে কৃষ্ণ সাগরের অমৃততুল্য পানি খাইয়ে এসেছি। ”
এটুকু বলতে বলতেই আনাস্তাসিয়া নিজের কক্ষে চলে যায়। জোসেফ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মাথা চুলকাতে চুলকাতে সে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
” কাউন্ট? কৃষ্ণ সাগর? অমৃত পানি? এসব কি হচ্ছে? ”
জোসেফ আর কোনো কথা না বলে রওনা হয় তুষ দূর্গের উদ্দেশ্যে। আজকে এভাবেই বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে তার।

” প্রিন্স! উঠুন দয়া করে। প্রিন্স ড্রাগোস! ”
দাসীর ডাকে আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলে ঘুম থেকে উঠে ড্রাগোস। বিরক্তিমাখা সুরে প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে? এতো চেঁচামেচি করছো কেন? ”
দাসী বলে উঠে,
” কাউন্ট এবং কাউন্টেস! আপনি জলদি চলুন। সব শেষ! ”
ড্রাগোস আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি উঠে কাউন্ট লোনেলের কক্ষের দিকে দৌঁড় দেয়৷ কক্ষের সামনে যেতেই সে দেখে দুজন প্রহরীর মরদেহ দরজার বাহিরে পড়ে আছে। ড্রাগোস ধীরে ধীরে কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখে বিছানায় দুটি গর্দানহীন নিথর দেহ পড়ে আছে। সাথে সাথে ড্রাগোস মিথ্যা আর্তনাদের নাটক শুরু করে দেয়। সে এগিয়ে লাশ দুটির কাছে যেতে নিলেই দুজন ভৃত্য তাকে বাধা দেয়। প্রধান সেনাপতি স্টেফেন এসে ড্রাগোসকে সড়িয়ে কক্ষের বাহিরে নিয়ে আসে। বেঞ্জামিনের কাছে ড্রাগোসকে দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠে,

” তুমি প্রিন্সকে নিয়ে এখান থেকে যাও সেনাপতি বেঞ্জামিন। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। ”
বেঞ্জামিন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ড্রাগোসকে ধরে সেখান থেকে নিয়ে যায় সে। ড্রাগোসকে তার কক্ষে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে উঠে,
” আপনি বসুন প্রিন্স। আমি পানি নিয়ে আসছি। ”
এটুকু বলেই বেড়িয়ে যায় বেঞ্জামিন। সাথে সাথেই ড্রাগোস নিজের চোখের পানি মুছে হালকা হাসে। মনে মনে বলে উঠে,
” কোনো কাক পক্ষীও কখনো বের করতে পারবে না কাউন্ট এবং কাউন্টেসের মৃত্যু কিভাবে হয়েছে। আমাকে সিংহাসনে বসা থেকে এখন কেউ আটকাতে পারবে না। এই সাম্রাজ্য এখন আমার শাসনে চলবে। ”
এটুকু বলতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ড্রাগোস।

দূর্গে আসতেই দোতলার লম্বা করিডরে রিকার্ডোর সাথে দেখা হয় জোসেফের। রিকার্ডোকে দেখতেই সে মাথা নত করে এক পাশ হয়ে দাঁড়ায়। নিচু স্বরে বলে উঠে,
” সুপ্রভাত কাউন্ট। ”
রিকার্ডো মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে নিলে জোসেফ পিছু ডেকে উঠে। রিকার্ডো থেমে দাঁড়িয়ে পড়তেই জোসেফ রিকার্ডোর সামনে এসে মাথা নত করে বলে,
” আপনি কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি কাউন্ট? ”
রিকার্ডো ভ্রু কুচকে তাকায়। সে বুঝে উঠতে পারে না জোসেফের তাকে কি প্রশ্ন করার থাকতে পারে। তবুও মাথা নেড়ে অনুমতি দেয়। জোসেফ বলে উঠে,

” আনাস্তাসিয়া সকাল সকাল বাসায় ফিরে এসে কেমন অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিলো। আমি যখন ওকে প্রশ্ন করি আপনার সাথে ওর দেখা হয়েছিলো নাকি ও তখন আমাকে জবাবে বলে যে ওর নাকি পথিমধ্যে আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো এবং আপনাকে নাকি সে কৃষ্ণ সাগরের অমৃততুল্য পানি পান করিয়েছে। এটা কি সত্যি? ”
জোসেফের কথা শুনে রিকার্ডোর কুচকে থাকা ভ্রু জোড়া শিথিল হয়ে আসে। সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে সামান্য হাসে। পরক্ষণেই মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে সে জোসেফের দিকে তাকিয়ে বলে,
” না। এটা সত্যি না। ও ভুল বলেছে। ”

এতটুকু শুনে জোসেফের মন শান্ত হয়। তারমানে আনাস্তাসিয়া তার সাথে মজা নিচ্ছিলো। আর সে কিনা আনাস্তাসিয়ার কথায় কাউন্টকে এসব প্রশ্ন করতে এসেছিলো। জোসেফের এসব ভাবনার মাঝেই রিকার্ডো সামান্য এগিয়ে রহস্যময় স্বরে বলে উঠে,
” পথিমধ্যে আমি ওকে কৃষ্ণ সাগরের মাতাল হাওয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে এনেছি। ”
এটুকু বলেই রিকার্ডো সাথে সাথে সেখান থেকে প্রস্থান করে। দ্বিধায় থাকা জোসেফ মাথা চুলকাতে চুলকাতে চুলকাতে বোকার সুরে বলে উঠে,

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৩৯+৪০

” কৃষ্ণ সাগরের অমৃততুল্য পানি? কৃষ্ণ সাগরের মাতাল হাওয়া? ”
জোসেফ বিড়বিড়িয়ে বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠে,
” আমি বুঝতে পেরেছি এদের সাথে কি হয়েছে। কাউন্ট আর আনাস্তাসিয়া পাগল হয়ে গিয়েছেন। পথিমধ্যে এদের মাথার উপর বড়সড় এক গাছের ডাল পড়েছে। তাই এসব বাজে বকছে। ”

মহাপ্রয়াণ পর্ব ৪৩+৪৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here