লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৬
Fatima Fariyal
ভোরের আলো ফুটতেই নাখাফুম ঝর্নার ঝলমলে অপরুপ সৌন্দর্য ফুঁটে উঠল। ঝর্নার গর্জন আর পাহাড়ি জঙ্গলের ঠান্ডা বাতাস মিশে এক অদ্ভুত রহস্যময় নীরবতা তৈরি করেছে, যেন প্রকৃতিই তাকে ঘিরে রাখার জন্য এক নরম চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। এমন সময় পাখিদের কিচিরমিচির আর কাঠ কাটার ঠক ঠক শব্দে রিদিতার ঘুম ভাঙালো। সারারাত জঙ্গলভীতি আর টুকটাক শব্দে তার বুক ধড়ফড় করেছে। শেষ রাতের দিকে গিয়ে একটু চোখ লেগেছে।
ঘুম ভাঙতেই সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। চোখ কচলাতে কচলাতে প্রথমেই লক্ষ্য করল, আহাদ রাজা পাশে নেই। বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল। দ্রুত তাবুর পর্দা সড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
সূর্যের কোমল তাপ গায় লাগতে কেমন উষ্ণতা অনূভব করলো সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। সবুজে ঘেরা পাহাড়, ঝর্নার পানি, রোদের আলো, সব মিলে এই অপূর্ব দৃশ্য যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল।
ঠিক তখনই তার চোখ আটকে গেল ডানদিকের ঢিবির কোণায়। সেখানে আহাদ রাজা কুড়ালের সাহায্যে কাঠ ফালি করছে। তার গায়ে কালো ম্যাগি-হাতা টি-শার্ট, যার কারনে তার বাহুর টানটান পেশি পুরো উন্মুক্ত। সকালের হালকা রোদে তার কপালের ঘাম চিকচিক করে উঠছে। কাঠ তোলার সঙ্গে সঙ্গে তার বুক ওঠানামা করছে। প্রতিটা নড়াচড়ায় শরীরের পেশিগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রিদি একদম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেমন যেন আনমনে। হঠাৎ আহাদের নজর পড়তেই সে থেমে রিদির দিকে তাকালো। ক্লান্ত হাঁপানোর শব্দ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। রিদির ঘোর ভাঙল। সে অপ্রস্তুতভাবে চোখ নামিয়ে নিল, কিন্তু ততক্ষণে আহাদ দু’আঙুল দিয়ে ইশারা করে তাকে কাছে ডাকছে। রিদি ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো। আহাদের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়াতেই তার গায়ের ঘামের গন্ধ, আর তীব্র নিশ্বাসের শব্দ পরিষ্কার শোনা গেল। আহাদ তার প্রেয়সীর ওড়নার এক কোণা ধরে নিজের কপালের ঘাম মুছতে লাগল। রিদি নীরব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আহাদ ভ্রু কুঁচকে, নাক ঘষে নিয়ে বলল,
“কোথায় নিজের স্বামির একটু সেবা-যত্ন করবে? ঘাম টাম মুছে দেবে… তা না করে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছো। আমার কী রূপ বেড়েছে? নাকি অন্য কোন চিন্তা ভাবনা আছে, মিসেস মীর!”
রিদি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মাথা নিচু করে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“ন… না, দিচ্ছি।”
অতঃপর নিজের হাতেই ওড়না তুলে আহাদের মুখ মুছতে লাগল। আহাদ তার সেই বোকা বোকা চাহনি দেখে ঠোঁট চেপে হাসি সামলাতে ব্যাস্ত। এবার সে মাথা তুলে গলা এগিয়ে ধরল,
“এখানেও।”
রিদি আপত্তি করল না। বরং পরম মনোযোগে স্বামীর সেবা করতে করতে পুরো দুনিয়াটা যেন ভুলে গিয়েছিল। ঠিক তখনই, দু’বার গলা খাকড়ির আওয়াজ এলো। রিদি চমকে ফিরে তাকাতেই দেখে, একটু দূরে তুহিন আর রিয়াদ। দুটো ছোটছোটো কাঠের টুকরোর ওপর কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের টুকরো এতটা ছোট ছিল যে তাদের পা ও ঠিকঠাক রাখতে পারছে না, যেনো এক ধরনের ব্যালান্সিং স্টান্ট! দুজনের মুখ গম্ভীর, তবে চোখে দয়ার আকুতি। রিয়াদ কেঁদে ফেলার মতো গলায় বলল,
“ভাবি, শুধু ভাইয়ার সেবাই করবেন? এই বেচারা দেবরদের ওপর একটু দয়া করেন। খুব খিদে পেয়েছে… সকাল থেকে এভাবে দাঁড়িয়ে আছি!”
রিদি হতবাক হয়ে বলল, “এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
তুহিন অভিযোগের স্বরে বলল,
“কেন আছি? কারণ আপনার বজ্জাত স্বামি আমাদের শাস্তি দিয়েছে! আমরা তো শুধু একটু মজা করছিলাম। তাই বলে নিজের বন্ধুকে এত বড় শাস্তি দেবে? দেখেন দেখেন, আবার কেমন হায়েনার মতো তাকিয়ে আছে!”
রিদি আড়চোখে পাশে থাকা আহাদকে দেখল। আহাদের মুখোভাব এতটাই কঠিন যে মনে হচ্ছিল পাহাড়ের পাথর থেকেও শক্ত। সে রুক্ষ গলায় বলল,
“কোন ভাবি-টাবি বলে লাভ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাঠ কাটা শেষ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এভাবেই থাকতে হবে। এরপর নেক্সট ডেমো।”
“এ্যাহহ! এর পর আবার কিসের ডেমো? ভাই, এত নিষ্ঠুর হোস না, ধর্মে সইবে না!”
তুহিন অসহায় স্বরে বলল। আহাদ চোখ গোল করে চটকে উঠল,
“যখন কুকর্ম করছিলি তখন ধর্মের কথা মাথায় ছিল না? এখন ধর্ম! তোদের আইডিয়া ছিল না, আমি তোদের কি কি শাস্তি পারি?”
রিয়াদ মিনতি করে বলল,
“ভাই, ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো মাফ করে দেন। আর জীন্দেগীতেও আপনারে ভূতের ভয় দেখাব না।”
রিয়াদের কথায় আহাদ আরও তেঁতে উঠল,
“আহাদ রাজার কাছে ভুলের ক্ষমা নেই! ভুল যখন করেছিস এর শাস্তিও পেতে হবে।”
তুহিন আর রিয়াদ দুজনেই অসহায় মুখ করে রিদির দিকে তাকাল। কিন্তু রিদিই বা কি করবে, এই আহাদ রাজা তো তার সাথেও এমন করে। শুধু ভুল শব্দটা যদি ভুলেও মুখ থেকে বের হলে হয়! তাহলে তার জন্য শাস্তি রেডি থাকে।
তবুও তাদের দুইজনের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে তার করুনা হলো। সে আলতো স্বরে আহাদকে বলল,
“শুনুন না…”
“হুম, শুনছি।”
“বলছি… এবারের মতো ওনাদের ছেড়ে দিন না?”
আহাদ চোখ সরু করে বলল,
“আমি কি ওদের ধরে রেখেছি?”
রিদির মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল,
“সত্যি? তাহলে ওনাদের নামতে বলি?”
আহাদ কটমট করে তাকালো তার দিকে। ঝাঁঝাল গলায় বলল,
“একদম না! শাস্তি খতম হয়নি এখনো।”
আহাদ রাজার সেই কথায়, রিদি সহ তিনজনেরই মুখ পুরু বেলুনের মতো চুপসে গেল। আহাদ আবার রিদির ওড়না নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“চলো।”
“কোথায়?”
“আমি যেখানে নিয়ে যাবো, সেখানেই। আপত্তি আছে?”
রিদি ডানে বামে মাথা দুলিয়ে না জানাল। আহাদ এগিয়ে যেতেই সে তার পিছু নিল। দুজন পাহাড়ের বুক বেয়ে নামতে লাগল, ঝর্নার দিকে। তুহিন আর রিয়াদ ঠায় কান ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রিয়াদ গোমড়া মুখে বলল,
“এই বয়সেও এসে কিনা আমাদের কান ধরতে হচ্ছে! আল্লাহ তুমি কই!”
তুহিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“শুকরিয়া কর, যে আমরা ঘন জঙলে আছি। আমাদের এই বেহাল দশা দেখার কেউ নেই। তা না হলে নিশ্চিত মান সম্মান দক্ষিনা হাওয়ায় বাঁশঝাড়ের মাথায় উঠত!”
পাহাড়ি মনোমুগ্ধকর সেই পরিবেশের মাঝেই আহাদ রাজা কায়দা করে লোহার শিকের ওপর টানটান করে মাংস বসিয়ে বার-বিকিউ করছে। আলো-ছায়ায় তার মনোযোগী মুখটা আরও কঠোর লাগছে। এক হাতে ধরা হাতপাখার মতো পাতাটা দিয়ে আগুনের ধোঁয়া সরিয়ে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে কাঠ উল্টে দিচ্ছে। মাংসের ওপরের চর্বি গলে টুপটাপ আগুনে পড়ছে আর সিজলিং শব্দ উঠছে, চটচট.. করে। পাশেই রিদি সবুজ ঘাসের উপর নরম চাদর বিছিয়ে খাবার সাজাচ্ছে। তার কাজ করার ভঙ্গিটা খুব শান্ত, খুব কোমল। চুলগুলো কেমন এলোমেলো, কিন্তু তাতে একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। আহাদ রাজা চোরা চোখে সেদিকে তাকায় মাঝেমধ্যে। কিছুটা দূরে তুহিন আর রিয়াদ এখনো কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে, প্রত্যেক সেকেন্ড যেন তাদের কাছে একেকটা যন্ত্রণা। বারবিকিউর পোড়া মাংসের গন্ধে তাদের পেট মোচড় দিচ্ছে, মুখে পানি চলে আসছে, কিন্তু আহাদ রাজার আদেশ ভেঙে তারা নড়তেও পারছে না। তুহিন নিচু স্বরে রিয়াদকে ফিসফিস করে বলল,
“আমার তো মনে হচ্ছে , আজকেই আমার আত্মা দেহ ত্যাগ করে দিবে।”
রিয়াদ মুখে আসা পানিটা গিলে নিয়ে বলল,
“মাংসের গন্ধে আমার মুখে পানি আসতেছে। পেট চো চো করছে। আমাদের সামনে এতো এতো খাবার আর আমরা খেতে পারছি না। এইটা বেঁচে থাকা না ভাই!”
দুজনেই আবার কাতর চোখে তাকিয়ে আছে আহাদের দিকে। রিদি সব কিছু সাজানো শেষ করতেই আহাদ রাজা বারবিকিউ হাতে নিয়ে চাদরের পাশে এসে বসল। মাংস এতটা লোভনীয় যে তাকালেই জিভে পানি এসে যায়। রিদি এবার অনুনয়ের কোমল কণ্ঠে বলল,
“শুনুন না, তুহিন ভাইয়ারা তো না খেয়ে আছে। ওনাদেরও ডাকুন না এবার।”
আহাদ রাজার চোখে সেই মুহূর্তে খানিক শীতলতা দেখা গেল। তার প্রেয়সীর কণ্ঠের অনুরোধ, সে খুব একটা অ-গ্রাহ্য করতে পারে না। সে ঠাণ্ডা মুখে তুহিন আর রিয়াদের দিকে চোখের ইশারা করল। দুজন আর এক সেকেন্ডও দেরি করল না, মনে হলো যেন ট্র্যাকে রাখা স্প্রিং-এর মতো লাফ মেরে নেমে হুড়মুড় করে দৌড়ে চলে এলো। কোন কিছুর উপেক্ষা না করে ক্ষুধার্ত পশুর মতো দুই হাত দিয়ে মাংস, রুটি, সালাদ, যা পাচ্ছে তাই মুখে ভরে খাওয়া শুরু করল। তুহিন মুখে একগাল ব্রেড চেপে রেখে বলল,
“থ্যাংক ইউ ভাবি! আপনি না থাকলে এই আহাদ রাজা, আমাদের আরও ভাজা ভাজা করতো।”
রিদি হেসে ফেলল। তার হাসির সুরে হালকা স্নেহ মেশানো মজা ছিল। আহাদের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিল। আহাদ কোন দ্বিধা ছাড়াই নিয়ে চুমুক বসাল। তবে সে লক্ষ্য করলো, রিদি এরই মাঝে পরপর দুবার হাঁচি দিয়েছে।আবার নাকও টানছে। তার কপাল কুঁচকে গেল। কফির কাপ রেখে উদ্বেগ নিয়ে আগিয়ে এলো, হাত বাড়িয়ে রিদির কপালে ছুঁয়ে দেখল। হ্যাঁ, সে যেটা আন্দাজ করেছে, সেটাই হলো! রিদির শরীর কিছুটা উষ্ণ। এখানকার ঠাণ্ডা আবহাওয়া তার উপর কিছুক্ষণ আগেই তো দুজনে ঝর্নার জমাট ঠাণ্ডা পানিতে ভালোই ভিজেছে। রিদির নাজুক শরীর সেটা ঠিকমতো নিতে পারেনি। আহাদ হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেল। কণ্ঠ ভারী, চাপা দুশ্চিন্তায় ভর্তি,
“তুহিন! রিয়াদ! এখনই ব্যাবস্থা কর। আমরা ঢাকায় ফিরব। যত দ্রুত সম্ভব। কুইক!”
তিনজনই একসাথে থমকে গেল। মুখে খাবার নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি হলো বুঝলো। তাদের বলদের মত তাকিয়ে থাকতে দেখে আহাদ চেঁচিয়ে উঠল,
“কি বললাম শুনতে পাসনি? আমরা এখনই ঢাকায় ফিরব, ব্যাবস্থা কর।”
রিয়াদ আলুথালু গলায় খাবার গিলে ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“কেন ভাই? কি হয়েছে?”
আহাদ সোজাসাপটা উত্তর দিল,
“রিদির শরীর খারাপ। এখানে থাকলে ও আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। এক মিনিটও আর দেরি করা যাবে না।”
তুহিন রিদির দিকে তাকাল, তাকে দেখে তেমন অসুস্থ মনে হচ্ছে না। কিন্তু আহাদ রাজার দৃষ্টি দেখে বোঝা গেল এটাই ফাইনাল সিদ্ধান্ত। দুজনেই আর সময় নষ্ট করল না। দ্রুত উঠে জিনিসপত্র গুছানো শুরু করল। রিদি চুপচাপ এসে আহাদের পাশে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বলল,
“আপনাকে কে বলল, আমি অসুস্থ! আমি ঠিক আছি।”
আহাদ ভ্রু তুলে তাকালো, “তাহলে চল।”
“কোথায়?”
আহাদ শুধু চোখের ইশারা করল। ইশারাটা বোঝা মাত্র রিদির চোখ বড় বড় হয়ে গেল,
“ব…বজ্জাত বেডা!”
আহাদ হেসে ফেলল, সেই হাসিতে ছিল একটু দুষ্টুমি, একটু আদর আর স্নেহ। অতঃপর তাবুর ভিতরে গিয়ে একটা নরম চাদর এনে রিদির কাঁধে জড়িয়ে দিল। মৃদু স্বরে বলল,
“এটা পেঁচিয়ে নাও। ঠাণ্ডা কম লাগবে।”
রিদি চাদরটা নিজের শরীর জড়িয়ে নিল। ভেতরে অদ্ভুত এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো। শুধু চাদরের নয়, আহাদ রাজার যত্নেরও। ততক্ষণে তুহিন আর রিয়াদ সব গুছিয়ে ফেলেছে। অতঃপর একসাথে তারা বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো।
রাত তখন প্রায় দুইটা। মীর হাউজ রাতের নিস্তব্ধতায় ঢেকে আছে। যেন পুরো বাড়িটাই ঘুমন্ত প্রাসাদ। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার বুক চিরে আহাদ আর রিদি বাড়ির গেট পেড়েলো। দুজনে বাসায় ঢুকতেই ঘরের ভেতরকার হিমশীতল নিরবতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। রিদি দরজা পার হয়েই টলমল করে থমকে দাঁড়াল। লম্বা জার্নি, পাহাড়ি কুয়াশা, ঝর্ণার বরফ শীতল পানি, তার উপর জ্বর। সব মিলিয়ে পায়ের শক্তি যেন প্রায় শেষ। তার ফর্সা মুখটা লালচে, নাক টানছে বারবার। চোখ আধঘুমে ঝাপসা। চাদর মুড়িয়ে শরীরটা গুটিয়ে আছে, তবুও ঠাণ্ডা তাকে ছাড়ছে না। ঢুকতেই আবার,
“হাচ্ছো!! … হাচ্ছো! … হাচ্ছো!”
তিনবার টানা হাঁচি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে মাথাটা নামিয়ে ফেলল।
নাকের ভিতর কিড়কিড় করে উঠতেই সে হঠাৎ আহাদের বাহুতে নাক ঘষে পরিষ্কার করে নিল। আহাদ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার দিকে, এই মেয়েটা এমন অসুস্থ হয়ে পরলে তো সে পাগল হয়ে যাবে।
“এখানে বসো।”
কড়া গলায় বললেও সেই কণ্ঠে অস্থিরতার কম্পন। সে রিদিকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল। অতঃপর হলঘরের প্রতিটা লাইট জ্বালিয়ে দিল। অন্ধকার ভেদ করে ঘরটা একদম জীবন্ত হয়ে উঠলো, কিন্তু বাড়ির ভেতরে কোনো সাড়া নেই। চারদিক শুধু গভীর রাতের ঘুম। রিদি চারদিকে তাকালো। এত বড় বাড়ি, এত মানুষ, কারোর দেখা নেই। তার মাথা ঘুরছে, চোখ জ্বালা করছে। ঠাণ্ডা আর জ্বর মিলেমিশে শরীর গরম হয়ে উঠেছে। কিন্তু তখন আহাদের ভেতরে রাগের আগুন জ্বলছে। সে বাড়ির সাবাইকে ডাকবে। সবাই এসে তার বউকে দেখবে। সেবা করবে। এটাই যেন তার মাথায় গেঁথে গেছে। কিন্তু কাউকে না দেখে, আহাদ গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“আম্মা! আম্মাআআ! চাচি আম্মা? চাচু? রিতু! বানি খালাআআ!”
প্রাসাদের মতো বিশাল এই বাড়িতে তার কণ্ঠ যেন দেওয়ালে ঠেকে ফিরে আসছে। তার ডাক কারোর কানের কার্নিশ পর্যন্ত পৌঁছাল না। সবাই ঘুমে অচেতন, উটকো ডাক শুনেই না! সে আরও কয়েকবার ডাকল। কিন্তু ঘর নিস্তব্ধ। এবার আর সহ্য হলো না আহাদের। তার চোখ লাল, চোয়াল শক্ত, গটমট করে সে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। বের হলো একটা বড় স্টিলের থালা আর একটা চামচ হাতে। পরের মুহূর্তেই, ঝনননন! ঝনঝনঝন! স্টিলের থালা আর চামচ দিয়ে এমন শব্দ উঠল যেন বাড়ির মাঝখানে যুদ্ধের ঢোল বাজছে। পুরো হলঘর কেঁপে উঠলো। ঘরের দেওয়ালগুলোতে শব্দ গুমগুম করে বাজতে লাগলো। হঠাৎ করে ঘুমন্ত বাড়ির সকলে চমকে উঠে রুম থেকে ছুটতে লাগল একে একে। সবাই জড়ো হলো। ঘুমো ঘুমো চোখে দেখলো, আহাদ হাতে থালা-চামচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ রাগে লাল। সামনে সোফায় চাদরে মুড়ে বসে আছে রিদি।
“কি হয়েছে টা কি? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি? এমন হট্টগোল করছো কেন?”
আহাদ রাজা চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। আসফাক মীর এবার দুলতে দুলতে সোফায় বসলেন। পিছনে শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে হাই তুলতে তুলতে গম্ভীর গলায় বললেন,
“ডাকাত আসলেও তোমার ছেলের মত এমন হরতাল করত না ভাইজান! ডাকাতরা ডাকাতি করে চুপচাপ চলে যেত। আমরা অতন্ত্য শান্তিতে ঘুমাতে তো পারতাম!”
আহাদ রাজার রাগ আরো কয়েক গুন বেড়ে গেলো চাচার কথায়। তার বউ অসুস্থ আর তারা শান্তির ঘুমের কথা বলছে! হাতে থাকা থালাটা ছুড়ে মারতেই ঝনঝন করে শব্দ হলো। রাগান্বিত গলায় বলল,
“এতোদিন পর বউ নিয়ে ফিরেছি, কোথায় আমার বউয়ের সেবা যত্ন করবে! তা না করে একেকজন ভেটকি মাছের মতো ভ্যাকায়া ঘুমায় আছে।”
আসফাক মীর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,
“কই এত দিন? মাত্র চারদিন ছিলে!”
আহাদ রাজা দাঁত চেপে বললো,
“চাচুউউউ! এখন কথা বাড়াইয়ো না। রিদির শরীর ভালো না।”
ঠিক তখনই রিদি আবার তিনবার টানা হাঁচি দিল। আফরোজা শেখ ছুটে এসে রিদির পাশে বসলেন। তার মুখটা বিষণ্ণ লাগছে। তিনি উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ?”
তিনি কপালে হাত দিলেন। গরম। বেশ গরম। রিদি নাক টেনে নিয়ে খুব নিচু গলায় বলল,
“আমি ঠিক আছি… আন্টি।”
“আন্টি?”
আহাদ এক ভ্রু তোলে তাকাল। আফরোজা শেখের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। নিজের ছেলের বউ তাকে ‘আন্টি’ ডাকলো, এটা তিনি গভীরভাবে মেনে নিতে পারলেন না।
মুখ গোমড়া করে বললেন,
“নিজের ছেলের বউয়ের মুখ থেকে এখন আন্টি ডাক শুনতে হবে? আম্মা কি বলা যায় না!”
রিদির মুখ লাল হয়ে গেল। মাথা নিচু। লজ্জা যেন তাকে গিলে ফেলছে। স্বরে লাজুক খচখচানি,
“ঠিক আছে আন্টি.. এরপর থেকে আম্মা ডাকবো।”
আফরোজা শেখ হতাশায় মাথা নাড়ালেন। এই মেয়ে আন্টি বলে বলছে কিনা, আম্মা ডাকবে! এমন সময় আহিয়াও সিঁড়ি বেয়ে নামছিল। তার পায়ের ব্যাথা নাই বললেই চলে। তবুও অভ্যাসটা রয়ে গেছে, সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটা। সিঁড়ির দুই ধাপ নামতেই, পেছন থেকে কারো ভারী পায়ের শব্দ। আর তারপরই সেই পরিচিত গলা,
“তোর পায়ের ব্যাথা কমেনি?”
আহিয়া চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল। সামনে দাঁড়িয়ে আদনান। ঠাণ্ডা আলোয় তার চোখ দুটো কেমন তীক্ষ্ণ লাগছে। সিঁড়ির রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়ানো আদনান চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে, রাগ নয়, বিরক্তিও নয়, বরং একধরনের খোঁচামারা উদ্বেগ। আহিয়া হকচকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কয়েকবার চোখ পিটপিটিয়ে বলল,
“কমেছে।”
“তাহলে এভাবে হাটছিস কেন? আর নিচে আসা কি খুব জরুরি?”
আহিয়া নিচু হয়ে ফিসফিস স্বরে বলল,
“আসলে… রিদি এসেছে তাই…”
আদনান ঠাণ্ডা মুখে তাকিয়ে রইল। অতঃপর আবারও সামান্য ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কই? আমি আসলে তো আমার জন্য কখনো এভাবে নামতে দেখি নাই।”
আহিয়া একটু থমকাল। বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি। স্বরে অভিমান লুকোনোর চেষ্টা,
“আপনি তো বাসাতেই থাকেন।”
“রিদি যখন তোর ভাইয়ের বউ… তাহলে এখন থেকে সেও বাসায়ই থাকবে। এত আয়োজন করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নামতে হবে না।”
কথাটা শুনে আহিয়া চোখ নামিয়ে নিল। আদনানের স্বরটা এমনভাবে আসে যেন তার প্রতিটি কথাই আইন, কথা কাটাকাটি করা যায় না। দুজনেই নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক তখনই, হালিমা বেগম দেখলেন তারা দুজন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। কি নিয়ে যেনো দুজনের মধ্যে কথা কথপকথন হচ্ছে। হালিমা বেগম বলে উঠলেন,
“তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে কি ফুসুরফাসুর করছিস?”
সবার চোখ সেদিকে ঘুরে গেল। আহিয়া হালকা হাসার ভান করে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“না, কিছু না।”
বলেই সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। রিদিকে সোফায় বসে থাকতে দেখেই দৌড়ে গিয়ে পাশে বসলো। ঠাণ্ডা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে। রিদিও অনেকটা আরাম পেল। এতদিন পর কাছের মানুষ পেয়ে মন ভরে গেল। দূর থেকে আহাদ দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখছে। তার চোখ জ্বলে উঠছে রাগে নয়, আবেগে। রিদির ম্লান মুখ, শুকনো ঠোঁট, নাক টানা সবকিছু তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে তুলছে। সে তাকিয়ে থাকতে না থাকতেই আবারও হাঁচি দিতে দেখলো রিদিকে। আহাদ এবার রাগ সামলাতে না পেরে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,
“চাচি আম্মা, রিদির জন্য গরম পানি আনো তো। আর খালা, ভিটামিন সি জাতীয় কিছু ফল আনেন। এখনই। কুইক!”
তার নির্দেশ অনুযায়ী হালিমা বেগম আর বানি খালা তড়িঘড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আদনান তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছে। শান্ত, নির্বিকার চোখে। আহাদ এবার তাক করল তাকেই,
“ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিস? ডাক্তার হয়েছিস কী শো উপভোগ করার জন্য? রিদি অসুস্থ দেখতে পাচ্ছিস না? ওকে ঔষুধ লিখে দে।”
আদনান নড়েচড়ে দাঁড়াল। স্বভাবসুলভ ভঙিতে বলল,
“সামান্য ঠাণ্ডা জ্বর। নাপা আর হিস্টাসিন খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আলাদা ওষুধ লাগে না।”
আহাদের চোখ লাল, চোয়াল শক্ত করে গর্জে উঠল,
“কোন বা’লে’র ডাক্তার তুই?! সামান্য ঠাণ্ডার ওষুধও দিতে পারিস না!”
“কে বলল দিতে পারি না! আমি তো বলেছি…”
“পারিস। কিন্তু দিবি না ইচ্ছা করে। অপেক্ষায় আছিস ও যেন আরও অসুস্থ হয়! ভাবছিস আমি কিছু বুঝি না?”
আদনান চোখ ঘুরিয়ে রিদির দিকে তাকাল। রিদি কিছুটা বিব্রত। আদনান কিছুটা লজ্জা পেল। সে এমনটা কেন করবে? সে তো ভালোর জন্যই বলেছে। কিন্তু তার উত্তেজিত ভাই তাকে ভুল বুঝছে। আদনান ঠোঁট চেপে বলল,
“আজব! আমি কেন চাইব তোর বউ অসুস্থ হোক? আমি তল সত্য কথাই বলেছি। নাফা আর হিস্টাসিন খেলেই সেরে যাবে। আর না সারলে এরপর এন্টিবায়োটিক দিতে হবে।”
আহাদ কড়া হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ তোমার সত্যবাদিতা জানা আছে আমার।”
আফরোজা শেখ বিরক্তিতে চোখ বন্ধ করলেন। ছেলের আচরণ তাকে প্রতিবারই বিব্রত করে। কিন্তু তার চোখের সামনে অসুস্থ রিদিকে দেখে তার মায়া যেন বেড়ে গেল। তিনি রিদির মুখের সামনে ঝুঁকে তার চুলগুলো সরিয়ে দিলেন। স্নেহশীল হাতের ছোঁয়া পেয়ে রিদির চোখ ভিজে উঠলো। এমন সময় হালিমা বেগম আর বানি খালা গরম পানি, সুফ ও ফল নিয়ে এসে হাজির। পুরো ঘর তখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রিদির যত্ন করার জন্য। রিদি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এরা কারা? এরা কি সবসময় এমন? এমন খেয়াল, এমন উদ্বেগ, এমন হট্টগোল, সব তার জন্য? অথচ এই মানুষগুলোকে সে এখনো পুরোপুরি জানেও না। আর তারা কিনা শেষ রাতের দিকেও তাদের ঘুম হারাম করে তার যত্নে মগ্ন! আফরোজা শেখ এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওকে হাসপাতালে না নিয়ে বাসায় কেন আনলে? আমাদের ফোন করলে আমরা আসতাম! মেয়েটা মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে দেখছো না? কি দরকার ছিলো ওকে নিয়ে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর?”
“বনে জঙ্গলে না আম্মা! হানিমুনে গেছিলাম!”
ঘড়ভর্তি মানুষের সামনে আহাদ রাজার মুখের এমন লাগামহীন কথায় রিদি লাজুক লতার ন্যায় নুইয়ে গেলো। আহিয়া তার হাসি ধরে রাখতে পারলো না। মুখ টিপে হেসে রিদির কানের কাছে ফিসফিস করল,
“এক হানিমুনেই তোর এই দষা রিদি!”
রিদি লজ্জায় আরো কুঁকড়ে গেল,
“চুপ কর! দুটো হাঁচি দিয়েছি শুধু! তোর ভাই তো তোড়পাড় করে ফেলছে, মনে হয়েছে মরেই যাচ্ছি আমি! আমার মান-সম্মান সব শেষ!”
আমজাদ মীর এবার রিদির দিকে তাকালো। মেয়েটা তখনও গুটিশুটি হয়ে বসে আছে আহিয়ার পাশে। সে একটু এগিয়ে এলেন। কপালে স্নেহের হাত রাখলেন, মৃদু স্বরে বলেন,
“নিজের যত্ন নিতে শিখো মেয়ে। এত অসাবধানী হলে হবে না। তোমার কিছু হলে, এই বজ্জাত ছেলে আমাদের মাথায় বসে নাচবে।”
রিদি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল। কিন্তু আহাদের চোখে এক অদ্ভুত রাগ। নিজের বাবাকে নিজের প্রেয়সীর কাছে দেখে, তার শরীরে রাগ ঝলকে উঠল। কেন জানি তার সুদর্শন বাবাকে তার প্রেয়সীর আসে পাশে দেখলে তার গা জ্বলে যায়। ঈর্ষা হয় তার, তার বাবা এই বয়সেও তার থেকে সুন্দর। নিজের প্রেয়সীর মুখে নিজেকে রেখে নিজের বাবার তারিফ দু’বার শোনা হয়ে গেছে। এখন আবার তার বাবা সুযোগে আহ্লাদ দেখিয়ে সুনমা অর্জন করছে? দাঁত কিড়মিড় করে সে চেঁচিয়ে উঠল,
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ৩৫
“আম্মাআআআ!! তোমার স্বামিকে সামলাও!!”
সে এতো জোড়ে চিৎকার করল, যে উপস্তিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। আমজাদ মীর একরাশ বিরক্ত নিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। মনে মনে ভাবলেন, কি বেয়াদব ছেলে জন্ম দিয়েছি আমি। খালি বাপকে সন্দেহ করে!
