বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৩
রানী আমিনা
আনাবিয়া চিরকুটটা খুলে সামনে মেলে ধরলো, সেখানে পরিচিত হস্তাক্ষরে গোল গোল করে লেখা,
“শেহজাদী, আপনার প্রতি আমার অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আপনি শেহাজাদা ইলহানের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে যে ধারণা করেছিলেন তা একেবারেই সঠিক।
আপনার একান্ত অনুগত,
গুলবাহার।”
আনাবিয়া হাসলো সামান্য, আলো আঁধারির ভেতর এর হাসি বিদ্রুপাত্মক ঠেকলো যেন। কাগজখানা মুঠির ভেতর ভরে নিতে নিতে প্রশ্ন করলো,
“ওদিকের খবর বলো বার্ডি।”
“শেহজাদী, সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷”
আনাবিয়া বার্ডি নামক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সন্তোষের হাসি হাসলো। পরক্ষণেই বার্ডির মলিন চেহারা খেয়াল করে বলল,
“তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাসায় ফিরে যাও, কিছুদিন ওড়াউড়ি ছেড়ে বিশ্রাম করো। পরবর্তীতে কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার ফুরসত পাবেনা৷”
বার্ডি কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে মৃদু হাসলো, বলল,
“আমার সকল পরিশ্রম আপনার জন্যই শেহজাদী। আপনি খুশি হচ্ছেন এটাই আমার বিশ্রাম, এর বাইরে অন্য কোনো বিশ্রামের আমার প্রয়োজন হবে না৷ অনুমতি দিলে আমি এখন ফিরবো।”
আনাবিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো। বার্ডি উড়ে যেতে নিলো তৎক্ষনাৎ, তখনি আনাবিয়া আবার ওকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“দাঁড়াও, খাওয়া হয়েছে তোমার?”
বার্ডি শুকনো মুখে দৃষ্টি নত করে মাথা নাড়ালো দুদিকে। আনাবিয়া দরজা থেকে সরে ভেতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভেতরে এসো, খেয়ে যাবে৷”
বার্ডি অপ্রস্তুত হলো, শেহজাদীর কামরায় ঢুকে খাবার খাওয়ার মতোন দুঃসাহস করতে হঠাৎ সাহস হলোনা। কিন্তু পরক্ষণেই মাতৃস্নেহ পাওয়ার তীব্র লোভ উঁকি দিলো ওর বুকের ভেতর।
শেহজাদীর এক ঝাঁক বাচ্চা আছে, তারা ব্যাতিত অন্য কাউকে কখনো শেহজাদীর আশেপাশে ঘেঁষতেও দেখেনি সে। দূর থেকে সর্বদা শেহজাদীর সাথে ওই উচ্ছৃঙ্খল ছেলেমেয়ে গুলোর খুনসুটি, হাসি খেলা দেখে গেছে। খুব হিংসা হতো ওর, ওরা শেহজাদীকে কত্ত কাছে পায়, কত্ত মজা করে! আর সে!
বছর পাঁচ পূর্বে রেড জোনের ভেতর প্রথম বার এই ঝলমলে শুভ্রা রমনীকে দেখে সে ভুলে গেছিলো ডানা ভাঙার যন্ত্রণা। সেদিন কত যত্ন করেই না ওই কোমল হাত জোড়া দিয়ে বার্ডিকে তুলে নিয়েছিলো সে, ডানা জোড়া কত যত্নেই না সারিয়ে তুলেছিলো!
ওই একটা মাস শেহজাদীর অবচেতন মনের যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ অদ্ভুত ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছিলো বার্ডি। এমন মাতৃস্নেহ সেই প্রথমবার ভোগ করার পরম সৌভাগ্য লাভ করেছিলো সে। কিন্তু এই ভালোবাসা ওর কপালে বেশিদিন থাকেনি, তার মাস খানেক পরেই শেহজাদী হারিয়ে যায় ওই লাইফট্রি নামক দানবীর বুকের ভেতর।
বার্ডি আনাবিয়ার অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা। আনাবিয়া আবারও ইশারা দিলো তাকে ভেতরে প্রবেশের জন্য। বার্ডি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনুগত্যের সাথে পা বাড়ালো।
সফেদ মার্বেল পাথরের কামরা, স্ফটিকের ঝলমলে ঝাড়বাতি, কামরার কোণায় কোণায় আভিজাত্যে পরিপূর্ণ একেকটি আসবাব। তারই মাঝে স্বর্ণ নকশা খচিত একটি কুচকুচে কালো পাথরের বিশাল সিংসাহন, রক্তাক্ত….!
রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ে ক্রমেই লালিমায় ঢেকে দিচ্ছে শুভ্র মেঝে, থকথকে তরলে ঢেকে যাচ্ছে যেন সমস্তই!
হঠাৎই গ্লিচ দেখা দিলো এই সিংহাসনের ওপর, কাঁপা-কাঁপি করে এলোমেলো হয়ে যেত যেতে হঠাৎই দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো একটি বিরাট নদী, বয়ে চলেছে উচ্ছৃঙ্খল ভঙ্গিতে! ঢেউ গুলো একের পর এক আছড়ে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে, ছুটে চলেছে কোনো অজানা সমুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ার তীব্র আকর্ষণে!
হঠাৎই বিশাল নদীটির বুকের ভেতর শব্দ হলো পানির ছলকে যাওয়ার, যেন খুব উঁচু হতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো কাউকে। চমকে তাকালো সে শব্দের উৎসের দিকে, চোখে পড়লো একটি মেয়েলি অবয়ব, শেকলে বাঁধা, আষ্টেপৃষ্টে!
শেকলের অগ্রভাগে আটকানো ভারী পাথরের ভীষণ ভারে নদী তলে বিদ্যুৎ গতিতে হারিয়ে যেতে চলেছে অবয়বটি!
ভ্রু কুচকে আরো ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করতেই ঝলমলে শুভ্র মেয়েটির ছোট্ট, মোলায়েম মুখখানা ভেসে উঠলো সেখানে, চোখে মুখে তার ভীষণ অসহায়ত্ব!
হীরকখন্ডের ন্যায় ঝিকিমিকি করতে থাকা বড়বড় চোখ জোড়া দিয়ে সে তাকিয়ে আছে এদিকেই, বাঁচার তীব্র আকুতি তাতে স্পষ্টতর হয়ে ধরা দিয়েছে! পানির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে মেয়েটি মরিয়া হয়ে পাথরে বাধা হাতটি বাড়িয়ে দিতে চাইলো ওর দিকে। গহীনে হারিয়ে যাওয়া আটকাতে ছটফটিয়ে উঠে ব্যাকুল, অসহায় গলায় ডেকে উঠলো,
“মীরিহ্…!
পরমুহূর্তেই হারিয়ে গেলো সে খরস্রোতা নদীর সবুজাভ পানির গহীনে! মীরের বুকের ভেতর হঠাৎই যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন, মনে হলো যেন ওর শরীরের অর্ধাংশ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে ওই সর্বগ্রাসী নদীর অতল!
মীরের হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ হলো তৎক্ষনাৎ! চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে উঠলো, স্বর্ণাভ চোখে খেলে গেলো তাণ্ডব। হৃদয় প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই প্রতিক্রিয়া দেখালো শরীর! ওর শক্তিশালী পায়ের তীব্র চাপে যেন কেঁপে উঠলো ধাতব ব্রিজ! পরক্ষণেই বিদ্যুৎ বেগে শুন্যে উঠে গেলো তার সুদীর্ঘ অবয়ব, আর তার পরমুহূর্তেই ঝড়ো বেগে ছুটে নদীর বিশাল স্রোতের ভেতর বজ্রের মতোন আছড়ে পড়লো ওর বিশাল শরীর!
মস্তিষ্কের নির্দেশহীন, চেতনা বিহীন মীরের শরীর যেন বিদ্যুৎ বেগে নিজেই নিজেকে কমান্ড দিলো। কোনো আদেশ ছাড়াই তারা পালন করে গেলো নিজেদের চিরকালীন কর্তব্য। নিজের শরীরের ওপর এই অচেনা কর্তৃত্ব উপলব্ধি করে এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো মীর! পরক্ষণেই এই অনিয়ন্ত্রিত স্রোতের নিকট নিজেকে সমর্পণ করে দিলো নির্বিকার, নিঃশব্দে!
মস্তিষ্ক আর শরীরের একাত্মতায় যেন কোনো ঘুমন্ত, সুপ্ত স্মৃতির সমুদ্র হঠাৎ তাণ্ডব শুরু করলো মীরের মন, মগজের প্রতিটি কোণায় কোণায়। অস্পষ্ট হয়ে পুরোনো দিন গুলো সজোরে ছুটে এলো ঝাঁকে ঝাঁকে, বিদ্যুৎ রেখার মতোন ভেসে যেতে লাগলো চোখের ওপর দিয়ে!
কেঁপে উঠলো মীর! ভেতর থেকে কেউ তাগাদা দিলো মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে, স্বর্ণাভ চোখ জোড়া দিয়ে প্রাণপণে খুঁজে চলল সে তাকে! জলের নিচে সবকিছু অস্পষ্ট, বিকৃত, দুঃস্বপ্নে ঢেকে থাকা বাস্তবতার মতোন! তবুও সে খুঁজে ফিরলো তাকে উন্মনা, উদগ্রীব, ব্যাকুল চিত্তে!
তখনি ওর চোখ গেলো নদীর তলের দিকে। এক ঝাঁক ঝিকিমিকি করতে থাকা সফেদ চুলের বহর পানির প্রবাহের সাথে সাথে দুলে চলেছে, তারই ফাঁকফোঁকড় দিয়ে উঁকি দিয়ে চলেছে একটি মোলায়েম শুভ্র মুখমণ্ডল! চোখ জোড়া খোলা, নিঃসাড়, টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া অল্প নড়ছে, যেন তখনো ডেকে চলেছে,
“মীরি…!”
আচমকা ক্ষিপ্র বেগে মেয়েটির দিকে ছুটে গেলো মীর, তার বাহুদ্বয় ক্ষুধার্ত শিকারি বাঘের ন্যায় হাতড়ে চলল মেয়েটিকে কাছে টানার এক অনিয়ন্ত্রিত, তীব্র বাসনায়। নাগাল পাওয়া মাত্রই নিজের কঠোর থাবা জোড়া দিয়ে ঝটিতি আঁকড়ে ধরলো সে মেয়েটির কোমর, এক ঝটকায় টেনে নিয়ে আছড়ে ফেললো তাকে বুকের ওপর!
কিন্তু মেয়েটিকে বুকের সাথে মেশানো মাত্রই হঠাৎ মীরের শরীর জুড়ে ছটিয়ে পড়লো এক তীব্র যন্ত্রণা! পরমুহূর্তেই নদীর সবুজাভ, অস্পষ্ট পানির ভেতর হঠাৎ ছড়িয়ে পড়লো চোখ ধাধানো এক আলোর বহর!
আলোর সঙ্গে সঙ্গে জলের তলা থেকে যেন উঠে এলো কোনো অজানা শক্তি, তৎক্ষণাৎ সেই শক্তি যেন ওর বুক থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইলো মেয়েটিকে!
ভীষণ জোর টান পড়লো মেয়েটির শরীরে বাধা পাথর গুলোয়, অসহ্য যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো মেয়েটি! মীর প্রাণপণে ধরে রাখতে চাইলো ওকে, কিন্তু কারো ভীষণ টানে হঠাৎ ওর বাহুদ্বয় ছিন্ন করে, বক্ষভেদ করে কেউ টেনে নিয়ে গেলো মেয়েটিকে, চোখ ধাধানো আলোয় পরিপূর্ণ পানির অতল গহ্বরে মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো সফেদ শরীরের অধিকারিনী!
মুহুর্তেই আচমকা ঘুম ভাঙলো মীরের, তীব্র বেগে শ্বাস টেনে নিয়ে হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো সে পানি থেকে জমিনে উঠে আসা মাছটির মতোন!
তখনি একটি গ্লাভসে আবৃত হাত ত্রাণকর্তা হয়ে এসে বিশ্রাম নিলো ওর বুকের ওপর। মীরের শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয়ে এলো তৎক্ষনাৎ, ফুসফুস ভরে এলো স্বস্তিতে। শান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস টেনে নিয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো এই প্রশান্তিকর হাতের মালিককে।
হুডি ট্রাউজারে মোড়া সেই মেয়েটি, মুখখানা ঢাকা মাস্কের আড়ালে। চোখ জোড়া লাইট ব্লু, তাকিয়ে আছে তারা মীরেরই দিকে, যেন চোখে তাকিয়েই স্বস্তি দিয়ে চলেছে ওকে, শীতল করে চলেছে ওর অশান্ত বক্ষপিঞ্জর।
মেয়েটিকে দেখতে দেখতে হঠাৎই বুকের ভেতর কোনো কিছুতে ধাক্কা দিলো যেন! এই চোখ জোড়া ঠিক ওর স্বপ্নের মেয়েটির চোখ জোড়ার মতোন, অমনই মায়ায় ভরা, অমনই সম্মোহনী! শুধু রঙেরই ভিন্নতা, এছাড়া আর সমস্তই যেন একই ছাঁচে গড়া।
মীরের দৃষ্টি বিঁধে রইলো আনাবিয়ার মুখাবয়বে। আনাবিয়া চোখ নামিয়ে নিলো দ্রুতই, ছোট্ট করে বলল,
“মর্নিং।”
পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে লেগে গেলো কাজে। মীর বিছানায় উঠে বসে চোখ বোলালো চারদিকে। মেয়েটি ওর বিছানার বিপরীতে থাকা বইয়ের আলমিরাতে বই সাজিয়ে দিচ্ছে৷ প্রায় শেষ, আর অল্প ক’খানা বাকি।
মীর বসে বসে ভীষণ মনোযোগী দৃষ্টিতে ওর কাজ দেখলো কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎই গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,
“ম….নিং”
চিরপরিচিত গমগমে কন্ঠস্বর শুনে আনাবিয়া চমকে তাকালো পেছনে! হাতের বইটা শব্দ করে পড়ে গেলো মাটিতে, স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইলো সে মীরের মুখপানে!
মীর মেঝেতে পড়ে যাওয়া বইটার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলল,
“ম….নিং”
আনাবিয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। ওকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে মীর হকচকিয়ে গেলো, হঠাৎ কি হলো ঠাহর করতে পারলোনা। আনাবিয়া মীরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে চেয়ে আগ্রহী কন্ঠে বলল,
“আবার বলুন!”
মীর ওর দিকে ভ্রু কুচকে সন্দেহের চোখে দেখলো কিছুক্ষণ, তারপর সময় নিয়ে বলল,
“ম-নিং”
আনাবিয়ার খুশি উপচে পড়লো যেন, উচ্ছ্বসিত হয়ে শব্দ করে হাসলো সে। মীরকে দিয়ে ওই একই শব্দ বলাতে লাগলো বার বার! মীর যতবার বলল ততবারই ওর চোখে মুখে উপচে পড়লো উচ্ছাস। মীরের অনুধাবনে এলোনা এই সামান্য শব্দে মেয়েটির এত খুশি হওয়ার কারণ!
আনাবিয়া এগিয়ে গেলো মীরের আরও কাছে। বিছানার ওপর উঠে দুইপা ভাজ করে মীরের মুখোমুখি বসলো সে, প্রফুল্লচিত্তে বলল,
“বলুন, ‘আমি নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান’।”
“আ-আমি ন্-নামীর আ-আসওয়াদ দ্-দেমিয়ান…!
আনাবিয়া হঠাৎ প্রচন্ড খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে উঠলো উচ্চস্বরে। ওর এই প্রবল উচ্ছাস যেন ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে! রেড জোন জুড়ে হঠাৎ বয়ে গেলো এক রহস্যময় প্রশান্তিকর বাতাস, মনমাতানো মিষ্টি সুগন্ধিতে ভরে উঠলো চারপাশ, বাতাস এসে আলতো স্পর্শ দিয়ে গেলো মীরের লম্বা চুলে। মূহুর্তেই যেন বদলে গেলো প্রকৃতি, প্রফুল্ল হয়ে উঠলো চারপাশ!
মীর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, স্মৃতির পাতা হাতড়ে মনে পড়লো এই একই উচ্ছাস সে আগেও কোথাও দেখেছে, কোথাও শুনেছে! এই একই ভঙ্গিমা, একই চিৎকার, একই অভিব্যাক্তি, একই প্রকাশভঙ্গী!
মুহূর্তে সে চোখ বুলিয়ে নিলো আনাবিয়ার হাসির রেখাগুলোয়, ঠোঁটের কোণে তারও ফুটে উঠলো এক চিলতে খুশি। মনে চাইলো মেয়েটির মুখের ওপর এই অনাবশ্যক দস্যুর ন্যায় মাস্কটা একটানে খুলে ফেলে দিতে, ছুয়ে দিতে মাস্কের তলায় লুকিয়ে রাখা ওই উচ্ছসিত অবয়ব।
অবিলম্বে দৃঢ় হাতজোড়া মুঠো করে ফেললো সে, যেন ছুয়ে দিতে চাওয়ার তীব্র বাসনা আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা!
ঠিক তখনি কামরার দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো কোকো, ওর পেছন পেছন ফাতমা, লিও আর লিন্ডা। কোকো ঢুকেই আনাবিয়ার দিকে এগোতে এগোতে প্রচন্ড উদ্বিগ্ন, দ্রুত কন্ঠে শুধোলো,
“আম্মা, আপনি ঠিক আছেন? আপনার কোথাও লেগেছে? আপনি কি খুব ব্যাথা পেয়েছেন? কোথায় লেগেছে দেখি!”
আনাবিয়াকে এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলো করে কোকো চকিতে তাকালো বিছানার দিকে। তাকানো মাত্রই মীরের ধ্বংসাত্মক শকুনি দৃষ্টি ওরই দিকে নিবদ্ধ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো সে। ওর পেছন পেছন বাকিরাও স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে।
কোকো আর এগোলোনা, যেভাবে ভেতরে ঢুকেছিলো সেভাবেই পেছন দিকে হেটে সবগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই লিওর পিঠে জোরসে একটা থাবড়া কষিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো কোনো এক দিকে। আচমকা থাবড়া খাওয়ায় লিও যারপরনাই অবাক হলো, থাবড়া খাওয়া জায়গায় হাত দিয়ে ওকে কেন মারা হলো বুঝতে না পেরে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো কোকোর যাওয়ার পথে। লিন্ডা লিওর থাবড়া খাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সহমর্মিতার গলায় বলল,
“তুমি কিছু মনে নিও না, শেহজাদী এখন তাঁর সব সময় হিজ ম্যাজেস্টি কে দিচ্ছেন বলে কোকো ভাইজান খুব দুঃখে আছেন। সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে৷”
এমন সময় ফ্যালকন আর কাঞ্জি এসে দাঁড়ালো ওদের পেছনে। কিছুক্ষণ আগেও সবাই একসাথে বসে হাসিঠাট্টায় মেতে ছিলো। হঠাৎ শেহজাদীর চিৎকার শুনে কোকো পড়ি কি মরি করে ছুটে গিয়েছে, ওর পিছে পিছে এরা কজনও। কিন্তু কোকোকে বেরিয়ে আসতে দেখে, আর এসেই তার এই ধুমধাড়াক্কা মাইর দিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার যাত্রার কারণ জানতে ফ্যালকন পরিস্থিতি বুঝে ঠোঁট বাকিয়ে বলে উঠলো,
“কোকো ভাইজান শেহজাদীর অভাবে সিরিয়াস টাইপের লোনলি ফ্যিল করছে, তার কোথাও একটা সেটিং করিয়ে দেওয়া দরকার।”
“ভাতের হোটেলের মালকিনের সাথে ধরে সেটিং করিয়ে দেওয়া যাক। ঝগড়াটে দুটো সারাদিন চুলোচুলি করবে। চুমাচুমি তো করার সম্ভাবনা নাই, চুমাচুমির থেকে চুলোচুলি করতেই কোকো ভাইজান বেশি পছন্দ করবে। শ্লার জন্মই হয়েছে ভায়োলেন্স করার জন্য৷”
বলল কাঞ্জি। ফ্যালকন ওর পিঠে একটা থাবড়া দিয়ে বলল,
“এই দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হলো কাঞ্জি ভাই। তুমি কাঁধে তুলে নাও।”
“কিন্তু আমি তো লায়রা কে কাঁধে তুলতে চাই।”
বলে ফিচেল হাসলো কাঞ্জি। লিও ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,
“পেডো নাকি রে তুই শালা! বাচ্চা মেয়ে ও একটা, সেদিন জন্মেছে মনে হয়!”
“তুই চুপ করতো ভাই, তুই তোর দিকে তাকা। ঠিক বয়সে কোনো সিংহীর সাথে ইয়া করলে তোর এতদিনে লিন্ডার মতো এক কুড়ি কাচ্চা বাচ্চা থাকতো।”
ক্যাটকেটিয়ে বলল কাঞ্জি। লিন্ডা ফুসে উঠলো, আঙুল তুলে বলল,
“কাঞ্জি ভাইয়া, আমার সোয়ামী কে নিয়ে উল্টাপাল্টা বললে কিন্তু তোমার নামে মামলা হয়ে যাবে শ খানেক বলে দিলাম।”
“তুই আমারে মামলার ভয় দেখাস! সেদিন কোলে নিয়ে ঘুরেছি তোকে, এই আমার পিঠে এখনো তোর খামচির দাগ আছে, লাফিয়ে শার্ট ধরে ঝুলে পড়েছিলি। তোর আর তোর এই বুড়া সুগার ড্যাডির বাচ্চাকাচ্চা কেমন হবে এই টেনশনে আমি রাতে তিনবার স্ট্রোক করি। আর তুই কিনা আমাকে বলিস মামলা দিবি? এই দিন দেখার আগে আমি মরে গেলাম না কেন?”
ফ্যালকন এতক্ষণ নির্বিকার চিত্তে এদের ড্রামা দেখছিলো। হঠাৎ বলে উঠলো,
“ভাই তোদের এই ওভার অ্যাকটিং বন্ধ কর প্লিজ। কোকো ভাইজান বনবাসে যাওয়ার আগে ভাতের হোটেলের আজীবন সদস্য পদ গ্রহণের একটা বন্দবস্ত করতে হবে, চল!”
এরপর সবগুলোকে নিয়ে সে এগোলো কোকোকে খুঁজতে।
মীরের সামনে একটা মোটা মলাটের বই খোলা, কোণায় ইংরেজি বর্ণমালায় ঝকঝকে অক্ষরে লেখা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। আনাবিয়া বসে মীরের মুখোমুখি, মনোযোগী চোখে মীরের মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করতে ব্যাস্ত সে৷
মীর প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে বইয়ের কাগুজে ভাজে, এই হলুদাভ পৃষ্ঠা ভর্তি করে লেখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁকিবুঁকি গুলো কিভাবে যেন ওর মস্তিষ্ক বুঝে নিচ্ছে, এই উদ্ভট আঁকাবাঁকা লেখা গুলো সমস্তই ও কিভাবে কিভাবে জানি বুঝতে পারছে!
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?
কিভাবে এই কালো রঙে আঁকা ক্ষুদ্রাকৃতির নকশা গুলো থেকে সে অর্থ উদ্ধার করছে সেটা তার মস্তিষ্ক কিছুতেই ঠাহর করতে সক্ষম হচ্ছে না!
আনাবিয়া কৌতহলভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর মুখপানে, বোঝার চেষ্টা করে চলেছে মীরের মনে এই মুহুর্তে ঠিক কি চলছে।
কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আনাবিয়া মোলায়েম কন্ঠে শুধোলো,
“কিছু বুঝতে পারছেন?”
মীর হতে কোনো উত্তর এলোনা, তার প্রচন্ড আগ্রহী চোখ জোড়া বইয়ের প্রতিটি লাইনে মনোযোগ দিতে ব্যাস্ত। আনাবিয়া হাত বাড়িয়ে সন্তর্পণে সরিয়ে নিতে গেলো বইটি। কিন্তু মীর ক্ষিপ্র বেগে সেটাকে ছিনিয়ে নিলো আনাবিয়ার হাত থেকে, অতঃপর এই কালিমায় লেখা তথ্যবহুল উদ্ভট আঁকিবুঁকির রহস্য উদঘাটনে ডুবে গেলো মুহুর্তেই!
মধ্যরাত।
মীরের কামরা হতে আলো আসছে মৃদু। চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ঝুঁকে বইয়ে মুখ গুজে আছে সে। টেবিল ল্যাম্পের হলুদাভ আলো এসে পড়ছে তার শ্যামরঙা কঠিন মুখাবয়বে।
রাতের খাবার পড়ে আছে সাইড টেবিলের ওপর, ঢাকা দিয়ে রাখা। এতক্ষণে বোধ হয় ঠান্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। তার সমস্ত মনোযোগ টেবিলের ওপর খুলে রাখা মেরুণ রঙা মলাটের বইটির ওপর, যার কোণায় ছোট্ট করে লেখা, ‘দ্যা দেমিয়ান হিস্ট্রি’।
এই বইটা গতকালই জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছে সে। রেড জোন নামক এই জঙ্গলটির প্রতি তীব্র আকর্ষণ থেকে রোজকার মতোই মধ্যরাতে সে বেরিয়ে গেছিলো উন্মোচন করতে এই গহীন জঙ্গলের অপার রহস্য! উন্মোচন করতে, মাসের নির্দিষ্ট দিনে কোন মায়াবিনীর সম্মোহনী কন্ঠ নিঃসৃত সুরের মূর্ছনায় ঘুমিয়ে পড়ে সমস্ত রেড জোনের প্রাণীকুল।
অনুসন্ধানের এক ফাঁকেই এই বইটা ঘাঁসপাতার ফাঁকে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়েছিলো সযত্নে। নিজের নামের সাথে মিল পেয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলো ভীষন। সেদিনই মহলে ফিরে পড়তে পড়তে বইয়ের ভাজে আবিষ্কার করে একটি ছোট্ট চিরকুট, যাতে গোটাগোটা, স্পষ্ট, সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা-
‘স্যিক দ্যা স্যোল বিনিথ ইয়্যোর নেইম’
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩২
বইয়ের ভাজ থেকে আজও সেটি বের করে দেখলো মীর। লেখা গুলোর যেন এক মারাত্মক আকর্ষণী শক্তি আছে, এই ছোট্ট একটি বাক্য যে এত শক্তিশালী হবে, এভাবে ওকে টেনে নিবে সেটা মীর কখনোই ভাবেনি!
এমন সময়ে দূরের কোনো অঞ্চল হতে ভেসে এলো একটি ঘন্টাধ্বনি। ঘড়ি দেখলো মীর, রাতের একটা।
লেখা গুলোকে আরও কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বইয়ের ভাজে রেখে দিয়ে বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর গায়ের ওপর একটি সাদা রঙা পাতলা শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
