বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৫

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৫
রানী আমিনা

“ভাই, লায়রা কে কোনো ভাবে আমাদের মহলে শিফট করার ব্যাবস্থা করা যায় না? ওকে চোখের সামনে বড় হতে দেখতাম!”
“শোন কাঞ্জি, তুই যদি আর একবারও লায়রা লায়রা করেছিস তবে তোকেও কোকো ভাইজানের কাছে পাঠিয়ে দিবো। বর্ডারের ওই লাইট হাউজে কোকো ভাইজানের সাথে দুদিন থাকলে সোজা হয়ে যাবি তুই। ফ্যালকন থেকেছে, ওয় জানে কোকো ভাইজানের থাবড়ার কত উপকারী শক্তি আছে৷ সব রকমের ভূত ঝেড়ে ফেলার মহৌষধ!”
ওকামির হুমকি শুনে কাঞ্জি চুপ করে গেলো। মরে গেলেও বর্ডারের লাইট হাউজে সে যেতে চায়না৷ ও জায়গা কোকো ভাইজানের মতো মানুষের জন্যই ঠিক আছে। সমুদ্রের যে বিশাল বিশাল ঢেউ বারে বারে আছড়ে পড়ে লাইট হাউজের গায়ে তাতে কখনো কখনো মনে হয় লাইট হাউজটা ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে লোনা পানির তলায়৷
ব্রায়ান সহ ওরা তিনজনে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে একটি বেতের তৈরি বেঞ্চে। ওদের একটু সামনেই মাটির ওপর পাথর দিয়ে ঘিরে একটা গোল জায়গা করে বনফায়ারের স্থান তৈরি করা। সেখানে পড়ে আছে খানিকটা পুরোনো ছাঁই।

বনফায়ারের স্থান থেকে কিছু দূরে চারদিক থেকে ঘিরে সারি দিয়ে রাখা মোটা মোটা গাছের গুড়ির বেঞ্চ, সেখানে বসে খোশগল্পে মেতেছে শার্লট, ফাতমা আর রেক্সা। কিছুক্ষণ পর পর তাদেরই উচ্চস্বরে হাসাহাসির শব্দে সচকিত হয়ে উঠছে চারপাশ৷
ওদের থেকে কিছু দূরের এক কোণে দুইটা পুরনো আমগাছের মাঝখানে ঝুলে আছে একটা দড়ি দিয়ে তৈরি হ্যামক। সেখানে মাথার তলায় হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লিও, ওর বুকের ওপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তন্দ্রাচ্ছন্ন লিন্ডা। হ্যামকটা দুলছে মৃদু ভঙ্গিতে।
আশেপাশে থাকা গাছগুলোর ডালপালায় জড়িয়ে আছে সোনা রঙা মরিচ বাতি। সেগুলোর মৃদু আলোতে স্বপ্নালোকের মতোন দেখাচ্ছে সম্পুর্ন স্থানটা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েগুলোর উচ্ছ্বসিত কলরবের সাথে যোগ দিয়েছে ঝিঝিপোকার একটানা ঝাঝানো ডাক, জঙ্গলের গভীরে থাকা শেয়ালের হুক্কাহুয়া শব্দ, হুতোম প্যাঁচার গা ছমছমে হুম হুম ডাক আর জঙ্গল হতে ভেসে আসা নানা অদ্ভুত শব্দ।
মীর মহলে ফেরার পর থেকে কেউ ভুলেও মহলে আড্ডাবাজি করেনা। কিন্তু আড্ডাবাজি করতে না পারলে আবার ওদের দমবন্ধ লাগে। কোকো লাইট হাউজের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করার পূর্বে ওদের জন্য এই এরিয়াটার ঝোঁপঝাড়, আগাছা সম্পুর্ন পরিষ্কার করে বেশ নজরকাড়া স্থানে পরিণত করে রেখে গিয়েছে। সময় পেলে এখানেই এসেই সব গুলো গা এলিয়ে বসে বসে অলস সময় পার করে।

ওদের খুনসুটির মাঝেই আচমকা স্তব্ধ হয়ে এলো চারপাশ। ঝিঝিপোকার শব্দ, শেয়ালের ধ্বনি, হুতোম প্যাঁচার আলসেমি পূর্ণ ডাক- সমস্তই থেমে গেলো হঠাৎ। চারপাশে এমন আকস্মিক নিরবতা নামার কারণে থেমে গেলো মেয়েগুলোর হাসাহাসি। ওরা বিস্ময় নিয়ে একে অপরের সাথে চোখাচোখি করলো।
ওকামি কাঞ্জিও থামিয়ে দিলো ঝগড়া, মেয়েগুলোর দিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করলো তাদের হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ার কারণ। লিও চারদিকে তাকিয়ে দেখলো একবার, কোনো বিপদের আভাস পাওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা কোথাও।
ঠিক তখনই হ্যামক হতে কিছু দূরের আঁধারের ভেতর থেকে কেউ গমগমে স্বরে বলে উঠলো,
“লিও, রাইট?”

মীরের কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই চমকে লাফিয়ে উঠলো লিও৷ তন্দ্রা ছুটে গেলো লিন্ডার, আতঙ্কিত হয়ে আঁকড়ে ধরলো সে লিওকে। লিওর দৃষ্টি ত্রস্ত, ছায়ার ভেতর দিকবিদিক তাকিয়ে সে খুঁজে চলল মীরকে।
তখনি জঙ্গলের ভেতর থেকে ওর হ্যামকের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখলো একটি সুউচ্চ অবয়বকে। দু’পাশের ঘন কুয়াশা সরিয়ে যেন সে নিজেই অন্ধকার ঠেলে পথ করে নিচ্ছে। স্বর্ণাভ, অগ্নিশিখার ন্যায় দীপ্ত চোখ জোড়া ধূসরতার ভেতরেও হয়ে আছে স্পষ্ট!
ব্যতিব্যস্ত হয়ে লিও দ্রুত গতিতে নেমে গেলো হ্যামক থেকে, লিন্ডাও নেমে পড়লো তৎক্ষনাৎ। বেঞ্চে বসা ছেলে গুলো উঠে দাঁড়ালো তড়িতে, মেয়েগুলো আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
ভারী পা ফেলে এগিয়ে এসে মীর থামলো লিওর সামনে। চোখে নেই কোনো ক্রোধ, শুধু অনন্তর শান্ত দৃষ্টি- অথচ ভয়ঙ্কর! দাঁড়িয়ে রইলো সে স্থীর হয়ে, শকুনি চোখ দুটো ধীরে ধীরে ঘুরে চললো যত্রতত্র দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের দিকে।

টু শব্দটি করলোনা, তবুও ওর তীক্ষ্ণ চোখের নিঃশব্দ, কড়া নির্দেশ পড়ে ফেলতে বেগ পেতে হলোনা কাউকে।
একেক করে পেছাতে শুরু করলো সকলে৷ কাঞ্জি কোনো রকমে একবার চোখ তুলে সম্মুখের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ওকামি আর ব্রায়ানকে টেনে নিয়ে মিলিয়ে গেলো ছায়ার ভেতর। লিন্ডা গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো ফাতমার গা ঘেঁষে।
ফাতমা কাঁপা হাতে সবগুলোকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলো কোথাও, তারপর ঝোপ ঝাঁড়ের ভেতর মিলিয়ে গেলো নিঃশব্দে।
চারপাশ ফাঁকা হতেই মীর এগিয়ে এলো আরও দু কদম। লিও শুকনো ঢোক গিলে দম ধরে পড়ে রইলো। পরক্ষণেই গমগমে কন্ঠের প্রশ্নে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো সে,

“তোমাদের মেয়ে কোথায়?”
-আমাদের মেয়ে? ভাবলো লিও। ওদের মেয়ে কে?
তৎক্ষনাৎ খেয়াল এলো শেহজাদী ওদেরকে হিজ ম্যাজেস্টির উপস্থিতিতে ‘শেহজাদী’ সম্বোধন করতে নিষেধ করেছিলেন। কোকো ভাইজানের মতোন তাই ওরা সকলেই শেহজাদীকে আম্মা বলে ডাকে।
তবে কি হিজ ম্যাজেস্টি ভেবেছেন শেহজাদী ওদের ভাতিজি?
“কোথায় থাকে তোমাদের মেয়ে? তোমাদের সঙ্গে কেন নয়? ঠিকানা বলো।”
পরক্ষণেই মীরের করা প্রশ্নে শুকনো ঢোক গিললো লিও। শেহজাদী সাফ সাফ মানা করে দিয়েছেন যেন হিজ ম্যাজেস্টি কোনো ভাবেই তার নাগাল না পান, কোনো ভাবেই যেন তাঁর সম্পর্কে কোনো তথ্য জানতে না পারেন। এখন?

কি করবে সে? কি উত্তর দিবে?
লিও নত হয়ে চুপ করে রইলো। সময় গড়ালো কিয়ৎক্ষণ, কিন্তু সম্মুখে দন্ডায়মান দীর্ঘকায় ব্যাক্তিটির ক্রোধিত নিঃশ্বাসের ওজন বেড়েই চলল।
ভড়কালো লিও, ত্রস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আম-আমি জানিনা! ক্ষ-ক্ষম-ক্ষমা করবেন!”
“তুমি জানোনা?”

চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করলো মীর। শব্দ দুটি যেন ছুরির ফপ্লার মতোন ভেদ করলো লিওকে। ভয়ে হিম হয়ে এলো লিও! ভীতসন্ত্রস্ত চোখে সে দেখতে পেলো হিজ ম্যাজেস্টির হাত জোড়া ক্রমে ক্রমে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠছে। ওই হাতের একটা থাপ্পড় পড়লে ওর ঘাড়টাই উলটে যাবে! কি করবে? বলে দিবে? ভেঙে দিবে শেহজাদিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি?
মীর কিয়ৎক্ষণ শীতল চোখে পর্যবেক্ষণ করলো লিওর কাঁপতে থাকা দেহাবয়ব। তারপর ধীর, গম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করলো,

“এই সপ্তাহের ভেতর মহল ছেড়ে দিবে। তোমাদের কাউকে যেন এই মহলের ত্রিসীমানায় না দেখি।”
বলেই মীর ভারী পা ফেলে এগোলো মহলের দিকে। লিও দম ছাড়লো ধীর গতিতে! যেন এতটুকু শব্দ না হয়, জাগিয়ে না তোলে তাঁর ক্রোধকে! আজকের মতো প্রাণে বাঁচা গেছে। কিন্তু মহল ছেড়ে কোথায় যাবে ওরা? অন্যদের কি বলবে?
ঠিক তখনি মীর থামলো আবার, পেছনে না ফিরেই পূর্বের মতোন হিমশীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
“আর হ্যাঁ, তোমাদের মেয়ে যদি এ সম্পর্কে একটা শব্দও জানে তবে সবগুলোর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবো। মাইন্ড ইট।”
তারপর হাটতে শুরু করলো আবার, তার দীর্ঘ দেহ মিলিয়ে গেলো কুয়াশার ভেতর, যেন অন্ধকার ওকে গিলে নিলো নিরব ত্রাসের মতোন!

“শেহজাদী, ফ্যালকন কল করেছিলো।”
“কি বলছে?”
“বলছে কোকো ভাইজানের মুড নাকি ভীষণ খারাপ। আলফাদ আর ফ্যালকনে আস্ত রাখছে না, মারা ধরার উপরে রাখছে। তাই ও বলছিলো আমাদেরকেও লাইট হাউজে গিয়ে কিছুদিন ঘুরে আসতে৷”
লিওর কথা শুনে বই থেকে মুখ ওঠালো আনাবিয়া। বিছানার ওপর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বই পড়ছিলো সে, কোমর পর্যন্ত চাদর টানা৷ সামনেই নীল রঙা সোফার ওপর বসা লিও আর কাঞ্জি।
“কে কে যাবি?”

“আমি, লুনা, কাঞ্জি আর ওকামি যেতে চাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম সাথে রেক্সাকেও নিবো।”
রেক্সার কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো আনাবিয়া। ওকে হাসতে দেখে লিও ঘাড় চুলকে অপ্রস্তুত হেসে বলল,
“ফ্যালকন বিশেষ ভাবে রেক্সাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছে। কিন্তু শার্লট ফাতমা রা বায়না ধরেছে ওদেরকেও নিতে হবে৷ ওদের নিলে ব্রায়ানকে কি করবো?”
“সবাই চলে গেলে মীরের দেখাশোনা কে করবে? কাঞ্জি এখানেই থাকুক, ব্রায়ান শার্লট দের সাথে। তুই আর ওকামি লিন্ডা রেক্সাকে নিয়ে ঘুরে আয়।”
বলে আবার বইয়ে মুখ গুজলো আনাবিয়া৷ লিও কাঞ্জি চোখাচোখি করলো। কি করবে বুঝতে পারলোনা৷ ওদেরকে ইশারায় কথা বলতে দেখে আনাবিয়া শুধোলো,
“আর কিছু বলার আছে?”
সঙ্গে সঙ্গে দুজনে টানটান হয়ে বসে দুদিকে সজোরে মাথা নাড়ালো। তারপর বিদায় নিয়ে নেমে এলো ট্রি হাউজ থেকে। নিচে নেমেই লিও কাঞ্জিকে ঝাঁকি দিয়ে চাপা, অসহায় সুরে জিজ্ঞেস করলো,

“এবার কি হবে?”
কাঞ্জি সতর্ক চোখে ট্রি হাউজের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“ওদিকে চল, এদিকে কথা বললে শেহজাদী সব বুঝতে পেরে যাবেন।”
লিওকে টেনে নিয়ে কাঞ্জি চলে গেলো জঙ্গলের ভেতর৷ নিরিবিলি স্থানে গিয়ে বলল,
“তোরা ক’জন লাইট হাউজের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দে৷ আমরা কজন এই দিকেই থাকবো। রাত কাটাবো অ্যানিম্যাল টাউনে আর দিন কাটাবো জঙ্গলে। তাহলে শেহজাদীও সন্দেহ করবেন না, আবার হিজ ম্যাজেস্টিও ক্ষেপে যাবেন না।”
“কিন্তু এইভাবে যাযাবরের মতোন ঘুরবি তোরা? দিনে খাবি কি?”

“সে চিন্তা আমার, তোরা কালকেই বেরিয়ে যাবি। আজ রাতে গিয়ে ব্যাগপত্র রেডি করবি। আমি এখন অ্যানিম্যাল টাউনে গিয়ে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করে আসবো। আর হিজ ম্যাজেস্টির খাবারের ব্যাবস্থা তো শেহজাদীই করেন, তখন না হয় ফাতমা বা শার্লট কাউকে পাঠিয়ে দিবো। আর আমরা এদিক ওদিক থাকবো। গুড প্লান।”
“কিন্তু ওদের কাউকে দেখে যদি হিজ ম্যাজেস্টি রিয়্যাক্ট করেন তখন কি হবে?”
“করবেননা, হিজ ম্যাজেস্টি চান না শেহজাদী কিছু জানুক, সুতরাং শেহজাদী বর্তমান থাকাকালীন কেউ একজন থাকলে তিনি কিছুই বলবেন না। আর শেহজাদী মহল থেকে বেরোনোর আগেই ওদেরকে বেরিয়ে যেতে বলবো তাহলে আর কোনো সমস্যাই থাকবে না।”

লিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর কাঞ্জির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
“শেহজাদী যদি জানতে পারেন তবে আমাদের কি হবে?”
“আমরা যেদিকেই যাবো সেদিকেই বিপদ৷ সিনিয়র বিপদ এবং জুনিয়র বিপদ। সিনিয়র বিপদ ভয়ানক, তাই সিনিয়র বিপদ থেকে বাঁচা আগে জরুরি। চল এখন।”

দুপুরে গোসল শেষে বেরিয়ে এসে বিছানার পাশে একটা গিটার পড়ে থাকতে কপালে ভাজ পড়লো মীরের। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলো সেটা।
কালচে-মেহগনি কাঠের মসৃণ, চকচকে দেহের ওপর হাত বুলালো মীর। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো গিটারটিকে। রোজগোল্ড প্লেটেড হার্ডওয়্যার, অ্যাবোনি উডের ফিঙ্গারবোর্ডের ওপর সাদা মুক্তার ইনলে দিয়ে তৈরি পাখির পালকের মতোন সুক্ষ্ম ফ্রেট মার্কার।
হেডস্টকে জাঁকজমকপূর্ণ ব্র্যান্ডের এমব্লেম। এক কোণে ক্ষীণ স্বর্ণের লাইনিং দ্বারা খোদাই করা একটি নাম- ‘আসওয়াদ’।

উৎসুক চোখে গিটারটিকে বাজানোর ভঙ্গিতে ধরলো মীর। আলো আঁধারিতে আচ্ছন্ন কিছু ধুলো জমা স্মৃতির গুচ্ছ ধরা দিলো মানস্পটে। সেই অনুযায়ী গিটারে হাত দুটো স্থাপন করলো সে, আঙুল বুলালো সরু তারে। তৎক্ষনাৎ ঝনঝন করে উঠলো এক অসঙ্গত, আনাড়ি শব্দ।
কিন্তু দমে গেলোনা মীর। আবছা স্মৃতি গুলো স্মরণ করার চেষ্টা করতে করতে বার বার চেনা সুর গুলো উঠানোর প্রয়াসে ঝালাপালা করে ফেললো হলরুমে থাকা লিও কাঞ্জি দের কান। সকলে মিলে দ্রুত হাতে ব্যাগ গোছাচ্ছিলো। দুপুরের আগেই বেরিয়ে যাবে।

কাঞ্জি দুহাতে কান চেপে ধরে ভ্রু কুচকে অসহায় ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“শেহজাদী সকাল সকাল কি দিয়ে গেলো, এবার আমাদের কানের পর্দা খুলে যাওয়ার পালা!”
“আমার তো পর্দার সাথে সাথে কানের দেয়ালও খসে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।”
কান চেপে ধরা অবস্থায় বলল ওকামি। লিও নির্বিকার চিত্তে ব্যাগ গোছাতে ব্যাস্ত। অন্তত পনেরো দিনের নিচে এমুখো হবে না সে৷ প্রয়োজন পড়লে লিন্ডাকে নিয়ে ওদিক থেকে ভেগে যাবে৷
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই গিটারের শব্দ সহনীয় পর্যায়ে চলে এলো, আরও কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর ঝাঝালো শব্দ পরিণত হলো মিষ্টি সুরেলা শব্দে৷ কাঞ্জি কানের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বলল,

“বাহ্‌, কুয়্যিক লার্নার!”
“এ কারণেই উনি একজন বাদশাহ, আর তুই একটা কম বুদ্ধিসম্পন্ন বাঘ। তোকে অমন একটা গিটার দিলে দশ বছরেও শিখতে পারবি কিনা সন্দেহ।”
হাতে একটা টি শার্ট নিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বলল লিও। কাঞ্জি নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,
“অফমান করছিস? না হয় করেছিলাম ফেল, পড়াশোনায় তো ওরম কতজন ফেল করে, তাই কি? বই পড়ার চেয়ে গিটার বাজানো অবশ্যই সহজ। ওই কাগজে লেখা ছাতার মাথা পড়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট। তোরা এত ব্রিলিয়ান্ট তা কি করেছিস জীবনে? সেই তো জঙ্গলে আমার সাথে এক ঘরে ঘুমোস।”
“এক ঘরে ঘুমোলেই তো আর সিংহ বাঘ হয়ে যাবেনা। আর তোর ওই গোবর ভর্তি মাথাও আমার মাথার মতো হবে না। তাই চুপ থাক, বকিস না।”

“আমার মাথায় গোবর হলে তোর মাথায় গু, তাও কুত্তার গু।”
“কি করে বুঝলি ওইডা কুত্তার গু? চেটে দেখছিস?”
কাঞ্জি লাফিয়ে উঠলো, হাতা গুটিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ওকামি ঝাড়ি মেরে বলে উঠলো,
“আরেহ্‌, তোরা দুইডা কি আর মানুষ হবিনা?”
“মানুষ কিভাবে হবো শালা? আমি বাঘ!”
“আর আমি সিংহ!”
বলে দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে ব্যাগ গোছাতে রইলো। ওকামি ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলো কামরা ছেড়ে।

চেয়ারের নরম গদিতে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ইলহান। আনাবিয়া সিংহাসনর চারপাশে লতাপাতা গজিয়ে দেওয়ায় সেখানে বসার আর সুযোগ হয়নি ওর।
পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইযান। চুপ করে ইলহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে৷ ভেবে চলেছে রাজ পরিবারের পুরুষ গুলো এত সুদর্শন কিভাবে হয়? দাসী গুলো তো আর এমনি এমনি পাগল বনে যায় না! কি এক যাদুকরী চাহনি এঁরা ফেলেন, সৃষ্টিকর্তাই জানেন!
কিয়ৎক্ষণ নিরবে অতিবাহিত হওয়ার পর ইলহান চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই শুধোলো,
“খবর বলো ইযান।”

“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদীর সাথের ছেলে গুলোর কয়েকটি কে সমুদ্রের বর্ডারের লাইট হাউজের ওদিকে দেখা গিয়েছে। বেশ অনেকেই আছে সেখানে। শেহজাদী হয়তো এখন একা একাই আছেন রেড জোনে৷”
“যত দিন আসওয়াদ বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত আনাবিয়া কখনো একা হবে না ইযান। ওকে তুমি চেনোনা। ও জঙ্গলে বর্তমান আছে মানেই আনাবিয়া সম্পুর্ন সিকিউরড।”
“কিন্তু আমরা তো হসপিটালে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম শেহজাদার স্মৃতি লোপ হয়েছে। তাহলে উনি থেকেওবা কি লাভ হবে? উনি তো আর শেহজাদীকে চিনবেন না।”
ইলহান হাসলো, বলল,

“ওর সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কোনো মন্তব্য করা বোকামি, ইযান। ওকে তুমি যেমনটা দেখবে তার আংশিক ব্যাতিত পুরোপুরি সত্য কখনোই হবে না। ওর ওই ঠান্ডা চেহারার আড়ালে এক বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পরিমাণ সত্য লুকিয়ে থাকলেও তুমি সামান্য আঁচ টুকু পর্যন্ত পাবে না। ওর চোখ পড়তে পারা যায় না ইযান, তারা সর্বদা একই বার্তা দেয়- ডেস্ট্রয়। এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।”
ইযান চুপ করে রইলো, কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ইলহান আবার বলল,
“আর রইলো আনাবিয়া!

মীর নিজের শ্বাস ত্যাগ করবে তবুও আনাবিয়াকে নয়৷ নিজেকে সে আনাবিয়ার একমাত্র অধিকারী ভাবে; তার এই অধিকার বোধের ভেতর এ পৃথিবীর অন্য কোনো ব্যাক্তির প্রবেশ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।
সে চাইলে আনাবিয়াকে ভাঙবে, কাটবে, তছনছ করবে কিন্তু অন্য কারো ছায়ার স্পর্শও সহ্য করবে না। তাই মীর বর্তমান থাকতে নশ্বর কোনো কিছু আনাবিয়ার ক্ষতি করবে এমনটা অসম্ভব, নিশ্চিন্ত থাকো।”
ইযান শুনলো চুপচাপ। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
“রামাদিসামা থেকে খবর এসেছে ইয়োর ম্যাজেস্টি। সৈন্যদেরকে রেড জোনে আক্রমণ করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। তবে সামান্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷”
ইলহান চোখ মেলে তাকালো এবার। নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি সমস্যা?”

“কিছু সৈন্যরা রেড জোনে আক্রমণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা বলতে চাইছে শেহজাদী যেখানে থাকেন সেখানে তারা কোনোভাবেই আক্রমণ করতে পারবে না। তাছাড়া সেখানে নানা রকম ভয়ঙ্কর প্রাণীতে ভর্তি, সেখানে গেলে তারা কোনোভাবেই পেরে উঠবে না।
ক্রমে ক্রমে বিরোধী দের দল ভারী হচ্ছে ইয়োর ম্যাজেস্টি। তারা কেউই চাচ্ছে না রেড জোনে আক্রমণ করতে৷ এইভাবে যদি চলতে থাকে এবং শেহজাদা এখনো বেঁচে আছেন এই সংবাদ যদি পঞ্চদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে তবে আমাদের হাতে আর কোনো উপায় থাকবে না ইয়োর ম্যাজেস্টি।”

ইলহান ফোস করে শ্বাস ছাড়লো, কিয়ৎক্ষণ ভাবলো চুপচাপ। তারপর হঠাৎ বলল,
“যে সমস্ত সৈন্যরা যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানাবে এদের পরিবারের সবাইকে জিম্মি করবে৷ এরপরও রাজি না হলে পরিবার সহ আসমানে পাঠিয়ে দিবে। এমন অবাধ্য সৈন্য আর প্রজা কোনোটাই আমার চাইনা৷ এখন তুমি যেতে পারো, আমি বিশ্রাম নেবো কিছুক্ষণ।”
ইযান ঢোক গিললো একটা। তারপর আনুগত্য জানিয়ে বেরিয়ে গেলো কামরার বাইরে৷
বাহার আনাবিয়ার কামরাতেই ছিলো, ইযান রয়্যাল ফ্লোরের বারান্দা ছাড়তেই কামরা ছেড়ে বেরিয়ে ছুটলো সে টপ ফ্লোরের দিকে।

চারদিকে সমুদ্রের ভয়াল গর্জন। নোনাজলের গন্ধে ভিজে থাকা ঠান্ডা হাওয়ার মাঝখানে, ঢেউয়ের ভীষণ গর্জনকে উপেক্ষা করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে একটি লাইটহাউজ। ধবল রঙা, প্রায় শতফুট উচ্চতার স্থাপনাটির গায়ে সামুদ্রিক লবণের সাদা দাগ। কোথাও কোথাও ঝড়-জলের ছাপ, নতুন-পুরাতন ক্ষত।
চূড়ার কাঁচের কৌটার ভেতর রাখা মহাশক্তিশালী আলোক বস্তুটি সদা ঘূর্ণায়মান, ধীরে ধীরে ঘুরে গিয়ে সমুদ্রপথে আলোকরেখা ছুঁড়ে দিচ্ছে বারবার, যেন গলা ছেঁড়ে নাবিকদের উদ্দ্যেশ্যে বলে চলেছে,
“ফিরে এসো, পথ হারাইয়োনা।”

লাইট হাউজের চুড়ার ওপর ডানা ভাজ করে বসে আছে ফ্যালকন। লাইট হাউজের মাঝবরাবর থাকা একটি চওড়া জানালা খুলে সেখানে বাইরের দিকে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বিরস মুখে বসে আছে কোকো। নিচে, ওদের ছোট্ট কামরায় বেঘোরে ঘুমোচ্ছে আলফাদ।
লিও লিন্ডারা এসেছে ঘন্টাখানেক হলো৷ এসেই সবগুলো জঙ্গলে ঘুরতে ঢুকে গেছে, এখনো ফেরার নাম নেই। কোকো বলে দিয়েছে নিজেদের খাবারের ব্যাবস্থা নিজেরা করে নিতে, সে কারো দায়িত্ব নিতে পারবে না৷
কিছুক্ষণ বাদেই জঙ্গলের রাস্তা হতে খলবলিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো লিন্ডা আর রেক্সা। ওদের পেছন পেছন লিও আর ওকামি। কোকো আড়চোখে একবার দেখে নিলো রেক্সাকে তারপর আবার মনোযোগ দিলো সমুদ্রের দিকে।
লিও ওকে দেখে দুষ্টু হেসে ওকামি কে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো লাইট হাউজের পাদদেশে, তারপর উঁচুতে বসে থাকা কোকোর উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

“রাফানজেল রাফানজেল, লেট ডাউন ইয়োর হেয়ার।”
“বা**ল ফালাচ্ছি, আয় ধর।”
নির্বিকার গলায় বলল কোকো। লিও আর ওকামি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। রেক্সা লিন্ডার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় শুধোলো,
“এসব কেমন ধারা কথা বার্তা?”
লিন্ডা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছিলো, বলল,
“এখান থেকে এখনি চলো নইলে এরপর ওরা যা সব বলা শুরু করবে তাতে আগামী চব্বিশ ঘন্টার জন্য তোমার কান অপবিত্র হয়ে যাবে৷”
ওদের কথার মাঝেই ওকামি জোর গলায় শুধোলো,
“কত লম্বা হয়েছে ভাই?”
“তোকে দুইবার মুড়িয়ে দেওয়া যাবে।”
ওকামি পেটে হাত চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়লো। আর লিন্ডা কানে হাত চেপে রাখা রেক্সাকে নিয়ে দ্রুতই এলাকা ছাড়লো।

পরদিন সকাল।
মীর গত রাতটা বাইরে ছিলো। ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। কামরায় ঢুকতেই চোখে পড়লো টেবিলের ওপর রাখা একটা মোটা মলাটের ডায়েরি। মলাটের গাঢ় নীলের ওপর সোনালী হরফে জ্বলজ্বল করছে, – “দেমিয়ান রুলস”।
পাতা উল্টাতেই নিজের হস্তাক্ষর চোখে বাধলো তার। প্রথম পাতাতে লম্বাটে ঝাড়াকাটা অক্ষরে লেখা,- “নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান, ফোর্টি নাইন্থ কিং অব প্যালেন ল্যান্ডো”।
দরজা ভেজিয়ে দিলো মীর, তারপর ডায়েরিটা নিয়ে বসলো। পাতার পর পাতা জুড়ে তারই লেখা। খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লো সে সমস্তটা। রাজ্যের আইনের খসড়া, বাতিলযোগ্য বিধান, সংসোধন যোগ্য রুলস- কোথায় কি পরিবর্তন আনয়ন করলে, কোনটা বাদ দিলে, কোনটা জারি করলে সব কিছু সুষ্ঠু ভাবে পরিচালিত হবে সমস্ত দিয়ে একটা জ্যান্ত সংবিধান যেন সে নিজেই তৈরি করে তুলেছে!
সবটা পড়ে কিছু স্থানে তার চোখ আটকালো। কিছু বাদ দিলো, কিছু পরিবর্তন করলো, কিছু সংযোজন করলো, কিছু কাটাকুটি করে আবার লিখলো নতুন করে।

কাট ছাট শেষে ঘড়ি দেখলো সে। দুপুর হতে বেশি দেরি নেই, কিচেন থেকে টুকটাক শব্দ ভেসে আসছে, খাবারের সুস্বাদু ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে মহল জুড়ে।
আর কিছুক্ষণ পরেই হুডি পরিহিতা রমণীটি আসবে, ঠিক মীর যখন গোসলে ঢুকবে তখন চুপিসারে কামরায় ঢুকে খাবার রেখে পালিয়ে যাবে আবার৷
মীর ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। মীরের সামনে না পড়বে না, এ চেষ্টা সে রোজ করে এবং রোজই ব্যর্থ হয়। এখন মহল সুনসান, শান্ত, স্তব্ধ, বিরক্তিহীন। এই নিস্তব্ধতাই ওর কাজের জন্য উপযুক্ত!

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৪

ড্রয়ার খুলে মীর বের করলো একটা পকেট নাইফ। বা হাতে ধরে ডান হাতের তালুতে একটা টানে চালিয়ে দিলো ধারালো ফলাটা, তৎক্ষনাৎ চামড়া ছিড়ে আলগা হয়ে এলো মাংস, কলকলিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলো সেখান থেকে। মীর তাকিয়ে রইলো সেদিকে এক দৃষ্টিতে, অনুভূতি হীন, নির্জীব চিত্তে।
খুঁজে খুঁজে একটা নোংরা কাপড়ের টুকরো জোগাড় করে পেঁচিয়ে নিলো হাত। তারপর উঠে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। মেঝেতে পড়ে রইলো কয়েক ফোটা মেরুণ রঙা তরল।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here