বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৭

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৭
রানী আমিনা

রেড জোন ভেদ করে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে এগোচ্ছে আনাবিয়া। কোকোর সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে সে, কিন্তু প্রতিবারই আউট অব রিচ। দুঃশ্চিন্তা আর অকারণ বিরক্তিতে ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ওর। ব্রায়ানের প্রতি মীরের এই হঠাৎ আক্রোশের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না আনাবিয়া। নাকি সবটাই শুধু ওকে মহল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার ফাঁদ?

ব্যাস্ত পায়ে মহলের নিকট পৌছাতেই এক সুতীব্র নিরবতা গ্রাস করলো আনাবিয়াকে। কোথাও কোনো টু শব্দটি নেই। ধীর পায়ে মহলের প্রধান সিড়ির দিকে এগোতে এগোতে দ্বিধান্বিত চোখে দেখলো সে চারদিকে। কোথাও কেউ নেই! সুনসান!
আনাবিয়া মহলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ। সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠবে কিনা সে দ্বিধায় স্থীর হয়ে রইলো। কোকোকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করলো আরেকবার, কিন্তু আবারও এলো একই উত্তর, আউট অব রিচ!
কিছু সময় পেরোতেই হঠাৎই সমস্ত শরীরে কেঁপে উঠলো আনাবিয়ার, বেড়ে গেলো হৃৎস্পন্দনের গতি। পরক্ষনেই নিজের ঠিক পেছনে ও শুনলো মীরের গমগমে কন্ঠস্বর,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“হ্যালো মিস….. পুচকেহ্‌!”
চমকে উঠে পেছন ফিরতেই কপালে বাড়ি খেলো মীরের বুকে, চকিতে তড়িঘড়ি করে পিছিয়ে গেলো দু কদম! তাকালো চোখ তুলে।
ধীর স্থীর, রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মীর। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার সাহায্যে ঘুরিয়ে চলেছে একটি সেলফোন। সোজা ভঙ্গিমা, দৃঢ়; প্রশস্ত বক্ষ ঠিক পাহাড়ের মতোন অনড়! পরনের ফুল স্লিভ ব্লাক টি শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখা কনুই পর্যন্ত। তাতে প্রকট হয়ে আছে হাতের দৃঢ় শিরা উপশিরার সুবিন্যস্ত সমাহার!
চুল এলোমেলো, তবুও সেই বিশৃঙ্খলায় ছাপানো এক অদ্ভুত, মনোহর মহিমা! স্বর্ণাভ, তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া গভীর, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায়! যেন হৃদয়ের অন্তস্তল ভেদ করে ঢুকে যাবে আরও গভীরে, আত্মসাৎ করে ফেলবে সমস্ত গোপনতর তথ্য!

আনাবিয়া মুহুর্তের জন্য হতচকিত হয়ে স্থীর দাঁড়িয়ে রইলো, দৃষ্টি ছুটে পড়লো মীরের হাতের সেলফোনটার ওপর। আঁতকে উঠে শঙ্কিত গলায় শুধোলো,
“কোকো… কোকোর ফোন আপনার কাছে কেন? কোকো কোথায়?”
আনাবিয়ার প্রতিটা অভিব্যাক্তি নিবিড়, শিকারী চোখে পর্যবেক্ষণরত মীর তার পেশিবহুল হাত খানা উঁচিয়ে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিলো নিজের কামরার দিকে।
আনাবিয়া ভড়কালো প্রচন্ড, উর্ধশ্বাসে সিড়ি বেয়ে উঠে ছুটে গেলো মীরের কামরায়। ওর পেছন পেছন ধীর গতিতে সিড়ি টপকে এগোলো মীর।
হন্তদন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আনাবিয়ার চোখে পড়লো মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কোকোর দিকে, নিঃসাড়, জ্ঞানহীন!

প্রমাদ গুনলো আনাবিয়া, দৌড়ে কোকোর নিকট পৌঁছে হঠাৎ হাটু গেড়ে বসে পড়লো মেঝেতে। ভয়ে বিস্ময়ে, কম্পমান কন্ঠে প্রায় অস্ফুটে সে শুধোলো,
“কোকো…. কোকো কি হয়েছে তোর?”
কোকো এতটুকু সাড়াশব্দ দিলোনা।
বুক কেঁপে উঠলো আনাবিয়ার! দ্রুত দু হাতে হ্যাচকা টেনে কোকোকে উলটে সোজা করে শুইয়ে দিলো সে। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি গেলো কোকোর ঠোঁটের কোণা বয়ে ঝরতে থাকা সাদা রঙা ফ্যানার দিকে!

সেই মুহুর্তে আবারও নিজের ঠিক পেছন থেকে ভেসে এলো মীরের পদশব্দ। আনাবিয়া উঠে দাড়ালো ঝটিতি। মীর কামরায় ঢুকতেই তীব্র আক্রোশে ছুটে গিয়ে দুহাতে ধাক্কা দিলো মীরের বুক বরাবর, কেঁদে উঠে উগ্র গলায় শুধোলো,
“কি করেছেন আপনি আমার কোকোর সাথে? ও কেন কোনো সাড়া শব্দ দিচ্ছে না?”
আনাবিয়ার ধাক্কা মীরকে এক চুল পরিমাণ টলাতে সক্ষম হলোনা, উপরন্তু তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো মীরের দৃষ্টি, মস্তিষ্কের ভেতর ঠোকর খেলো এক জোড়া শব্দ, -আমার কোকো!
ক্রোধে তৎক্ষনাৎ শক্ত হয়ে এলো ওর চোয়ালদ্বয়! পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা কাঁচের ছোট্ট ভায়াল তুলে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর মধ্যে নিয়ে ধরলো আনাবিয়ার সম্মুখে। চোখে অদ্ভুত শীতল গভীরতা নিয়ে ধীর, গমগমে স্বরে বলল,

“অ্যান্টিভেনম। ইয়্যু হ্যাভ অনলি থার্টি মিনিটস।
আমি যা কিছু জিজ্ঞেস করবো তার সঠিক উত্তর দিবে। নইলে ‘তোমার কোকো’ ত্রিশ মিনিটের ভেতর এই ধরনী ছেড়ে উড়াল দিবে আসমানে।”
বাইরে ধ্বনিত হতে রইলো বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, মীর ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকালো একবার। ফিসফিসে বৃষ্টি, ক্রমশ গতি বাড়ছে তার!
আনাবিয়া চোখ মুছলো, শক্ত গলায় বলল,
“আ’ম নট স্যেইং অ্যা ওয়ার্ড আনটিল আ’ হ্যাভ দ্যা অ্যান্টিভেনম!”
“দ্যাটস নট হ্যাপেনিং, মিস…. পুচকে।”
“আপনি অ্যান্টিভেনম দিবেন, কোকো সম্পুর্ন সুস্থ হবে, তারপর আমি কথা বলবো, তার পূর্বে নয়।”
“হুউউউমমম, খুব দরদ!

কি হয় সে তোমার? এত দরদ কিসের?”
“সেটা আপনার না জানলেও চলবে, অ্যান্টিভেনম দিন।”
মীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে শেষোক্ত কথাটা বলল আনাবিয়া।
“নোপ।”
বলে সশব্দে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো মীর৷ ঘরটা তৎক্ষনাৎ ডুবে গেলো আধো অন্ধকারে।
আনাবিয়া ঢোক গিললো! মীর এগিয়ে এসে নিজের শক্ত, সাড়াশির ন্যায় আঙুল গুলো দিয়ে খপ করে ধরে ফেললো আনাবিয়ার হাতের কবজি। পরক্ষণেই টেনে নিয়ে এক ঝটকায় আছড়ে ফেললো পাশের সোফার ওপর।
ঝোড়ো বেগে পাশ থেকে টেনে নিলো একটা চেয়ার, চোখে হিমশীতল ঝলক নিয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়লো আনাবিয়ার ঠিক মুখোমুখি, তুলে। বলল,

“লেটস স্টার্ট।”
“আপনি আমাকে চেয়েছিলেন এবং পেয়েও গেছেন। তবুও কেন ওকে আঁটকে রেখেছেন? কেন ওকে ছেড়ে দিচ্ছেন না? ”
তীব্র আক্রোশে, ধরা গলায় বলল আনাবিয়া। মীর চেয়ার সুদ্ধ এগিয়ে এসে বসলো আনাবিয়ার একদম কাছে, হাটুর ফাঁকে হাটু গলিয়ে দিলো। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে, চোখে দেখা দিলো অদ্ভুত কোমলতা অথচ তাতে হিংস্রতার সামান্য কমতি নেই!
হাত বাড়িয়ে মোলায়েম স্পর্শে সে ফেলে দিলো আনাবিয়ার হুডির হুড। লালচে-কালো চুলগুলো উন্মোচিত হলো ধীরে ধীরে। মীরের তর্জনীর দস্যিপনা এলোমেলো ভাবে হাত খোপা করে রাখা চুলগুলোকে ছড়িয়ে দিলো আরও! আনাবিয়ার পিঠ জুড়ে ঝর্ণার ন্যায় ঝুপঝুপিয়ে নেমে এলো তারা, মুখের সম্মুখে এসে ভিড় করলো কয়েকটি রেশম কোমল গুচ্ছ।

হাত বাড়ালো মীর, মুখের ওপর এসে পড়া চুল গুলোকে আলতো স্পর্শে গুজে দিলো আনাবিয়ার কানের পেছনে। কেঁপে উঠলো আনাবিয়া। চোখ খিচে নিলো মুহুর্তেই।
মীর হাসলো মৃদু, ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে নিলো আনাবিয়ার চুল ঘেষে। দীর্ঘ চুলের শেষ প্রান্তে গিয়ে আঙুলে জড়িয়ে নিলো এক গুচ্ছ চুল।
আনাবিয়া ঢোক গিললো, ফুপিয়ে উঠলো সামান্য, বাধো বাধো স্বরে বলল,
“অ্যান্টিভেনম টা দিয়ে দিন, ছেড়ে দিন ওকে!”
“দিবো… কিন্তু বিনিময় চাই।”
“কী চাই?”
মীর ঝুঁকে এলো ওর দিকে, মৃদুস্বরে বলল,
“তোমাকে।”

আনাবিয়া অস্বস্তিতে পিছিয়ে সিটিয়ে গেলো সোফার সাথে। তখনো চোখ খিচে বন্ধ করা তার। মীর গমগমে গলায় বলে উঠলো,
“আমার দিকে তাকাও।”
আনাবিয়া শ্বাস টেনে নিলো, অতঃপর চোখ মেললো ধীর গতিতে। সম্মুখে, নিজের ঠিক সামনেই মীরের স্বর্নাভ চোখ, শ্যাম রঙা মুখ খানা দেখে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো ওর। আতঙ্কে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলো তৎক্ষনাৎ। কিন্তু মীরের গমগমে আদেশ এসে বাধা দিলো তাতে,
“একদম চোখ সরাবে না, এখন তুমি শুধু আমার দিকে তাকাবে৷”

আনাবিয়া মূর্তির মতোন বসে রইলো মীরের দিকে তাকিয়ে। মীর সন্তুষ্টির হাসি হাসলো, শান্ত সুরে বলল,
“এবার বলো, মিস…. কে তুমি? কি তোমার পরিচয়? কেন এভাবে সর্বক্ষণ এড়িয়ে চলো আমাকে? আমাদের দুজনের ভেতর ঠিক কোন ধরণের সম্পর্ক এবং তাকে তুমি কি নামে সম্বোধন করো?”
ভীষণ ভীতি সুক্ষ্ম কাঁপুনি ধরিয়ে দিলো আনাবিয়ার শরীরে, গলা শুকিয়ে আসতে চাইলো বার বার!
মীর তাগাদা দিয়ে বলল,
“দ্রুত উত্তর দাও পুচকে, ছ’মিনিট ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে। বেশি দেরি করলে ‘তোমার কোকো’ আর এ পৃথিবীর আলো দেখবে না৷”
“আ-আমাদের ভেতর কোনো সম্পর্ক নেই, আপনি আমার কেউ নন, আমিও আপনার কেউ নই। আ-আমরা কেউ কাউকে চিনিনা।”

এক নিঃশ্বাসে বলল আনাবিয়া কথা গুলো। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে আসলো ওর, হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাতে শুরু করলো হঠাৎ, সেটা যেন সম্মুখে বসা মীরও টের পেলো স্পষ্ট! সে ঝুঁকে এলো সামান্য, বলল,
“তবে আমার দেওয়া আংটি কেন তোমার আঙুলে শোভা পাচ্ছে নূরিয়া তাজদিন?
আমি তোমাকে যতটা চিনেছি, তুমি র‍্যান্ডম কোনো ব্যাক্তির দেওয়া কোনো কিছুই কখনো ব্যাবহার করবে না। স্যো….. অ্যাম আ’ স্পেইশাল টু ইয়্যু?
নিজের বহু বছরের পুরোনো, ফেলে আসা নাম শুনে চমকালো আনাবিয়া। মীর এত বছর পূর্বের কথা কিভাবে জানলো? তবে কি সে আনাবিয়াকে নিয়ে রিসার্চে নেমেছিলো?
আনাবিয়া অনামিকাতে পরানো আংটিটার দিকে একবার তাকিয়ে দম ছাড়লো জোরে! মীর আরও কি কি জেনেছে সে সম্পর্কে সে সম্পুর্ন অজ্ঞাত।

ভয়ে, অস্বস্তিতে গরম লাগতে শুর করলো ওর। শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে! মাথা ধরতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। এতটা চাপ ও এর আগে কখনো অনুভব করেছে কিনা মনে পড়ে না ওর, কান দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হতে শুরু করেছে তার!
বাইরে হালকা বৃষ্টির শব্দ। মীর সোজা হয়ে বসে আনাবিয়ার মুখোমুখি, তার চোখ গাঁথা আনাবিয়ার চোখে।
আনাবিয়াকে কিছুক্ষণ পরখ করে নিয়ে আচমকা শীতল হেসে সে শুধোলো,
“তুমি কি আমাকে ভয় পাও, নূর?”
আনাবিয়া দম আটকে আসা স্বরে উত্তর দিলো,

“হ্যাঁ।”
মীর মাথাটা কাত করলো সামান্য, মায়াভরা, কৌতুহলী কন্ঠে শুধোলো,
“ভয়…..? নাকি ঘৃণা?
আনাবিয়া উত্তর করলো না কোনো, চোখ সরিয়ে নিলো আলগোছে। মীর শব্দ করে হেসে উঠলো, পরক্ষণেই থেমে গেলো আবার। চোখ জোড়া হয়ে উঠলো আরও গভীর। আদেশের সুরে সে বলল,
“আমার দিকে তাকাতে বলেছি, নূর।”
আনাবিয়া তাকালো আবারও। মীর কিঞ্চিৎ ঝুঁকে এসে শুধোলো,
“কি এমন করেছিলাম আমি, যে কারণে আমার স্ত্রী আমাকে এত ভয় পায়? বা বলা যায় ঘৃণা করে?”
আনাবিয়া চমকে তাকালো মীরের দিকে। বিস্ময়ে আলগা হয়ে এলো ওর ঠোঁট জোড়া। মুখখানা মাস্কে ঢাকা থাকায় মীরের দৃষ্টিগোচর হলোনা তা, তবুও সে স্পষ্ট টের পেলো তার সম্মুখে বসা তারই স্ত্রীর মনের অবস্থা। চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে সে ভ্রু তুলে ঠান্ডা স্বরে শুধোলো,

“কি হয় কোকো তোমার? কি সম্পর্ক তোমার ওর সাথে? সে কি তোমার নিকট আমার থেকেও দামি, নূর?”
আনাবিয়ার চোখ জোড়া ভিজে উঠলো হঠাৎ কোনো অজানা কারণে। ভেজা ঢোক গিলে সে উত্তর করলো,
“হ্যাঁ।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মীর। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁট শক্ত করে বলে উঠলো,
“আমি যদি তাকে ছেড়ে দিই তবে তুমি কি এক মুহূর্তের জন্যও আমার দিকে ভিন্ন চোখে তাকাবে, নূর? সমস্ত ভীতি, ঘৃণা বাদ দিয়ে?”

“আপনি আমাকে চিনেন না, আমাকে আপনার মনেও পড়েনি! আমার চেহারাটা অব্দি আপনার স্বরণে নেই এবং আমার জন্য আপনার মনে কোনো অনুভূতি থাকাও অসম্ভব। তবে কেন আমাকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে চাইছেন? আমি আপনার কেউ নই, বলেছি তো!”
কান্না জড়ানো ক্রোধিত স্বরে বলে উঠলো আনাবিয়া।
“আমার স্মরণে এলেও তুমি আমার স্ত্রী, না এলেও তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে দেখলেও তুমি আমার স্ত্রী, না দেখলেও তুমি আমার স্ত্রী। আমার মনে পড়েনি, বা আমি দেখিনি এই কারণে কি তোমার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে, নূর?”

মোলায়েম কণ্ঠে বলল মীর। আনাবিয়া চুপ করে রইলো, উত্তর দিতে পারলোনা কোনো। ব্যাথিত, দ্বিধান্বিত দুই হৃদয়ের অদৃশ্য ছটফটানিতে ঘরের বাতাস যেন জমে গেলো হঠাৎ, আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠলো ক্রমশ।
আনাবিয়ার দম আটকে আসতে চাইলো, হাঁসফাঁস করতে শুরু করলো ও হঠাৎ!
মীর ঝুঁকে এলো আবার, মৃদুস্বরে বলল,
“আমি শুধু জানতে চাই, তোমার ঘৃণার সাথে সাথে আমি কি তোমার প্রয়োজনও, নূর?”
আনাবিয়া চুপ রইলো, কিন্তু চুপ রইলোনা ওর নয়নদ্বয়। বারংবার ভিজে উঠতে চাইলো তারা, তার সাথে সাথে উত্থান পতন হতে রইলো বাইরের বৃষ্টির বেগ।
মীরের চোখে চরম কৌতূহল, ঠোঁটে অদ্ভুত শান্ত হাসি। আনাবিয়ার নিরবতাকে ভেদ করে সে জিজ্ঞেস করলো,

“আমি কি খুব খারাপ, নূর?
“…হ্যাঁ।”
“কোনো খারাপ স্বামী কি তার স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য কাউকে এতটা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে? ইয়েস অর নো।”
“না।”
তৎক্ষনাৎ শক্ত গলায় উত্তর করলো আনাবিয়া। মীর ঢোক গিলে বলল,
“তবে মানছো, আমি ভালো?”
“ন্‌-না…..! মানে হ্যাঁ পারেন!!”
“তবে তুমি স্বীকার করছো আমি তোমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য সব করতে পারি?”
আনাবিয়া আহত বাঘিনীর ন্যায় আশাহত হয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে। ওর হতাশ, হিংস্র চাহনি হাসালো মীরকে। সে গাঢ় চোখে চেয়ে শুধলো,

“বলো নূর, তুমি কোন উত্তর বেছে নেবে তোমার স্বামীর জন্য? ইয়েস… অর নো? হুইচ ওয়ান?”
আনাবিয়া অন্যদিকে চোখ ফেরালো। মীর ঠোঁট টিপে হাসলো তাতে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে অতঃপর বলল,
“আচ্ছা, আমি যদি বলি তোমার এই প্রিয় মানুষটিকে ছেড়ে দিবো, বিনিময়ে তুমি একবার আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে, স্ত্রীরা যেমন স্বামীর দিকে হাসে, প্রেম মিশ্রিত হাসি।
তুমি কি হাসবে?”
আনাবিয়ার চোখ জ্বলে উঠলো, কন্ঠে কাঠিন্যতা মিশিয়ে সে উত্তর দিলো,

“না।”
মীর ফিচেল হাসলো, বলল,
“তবে তোমার কাছে কোকোর জীবন তেমন দামী নয়, তাই তো?”
আনাবিয়া চমকে তাকালো মীরের দিকে, তেজস্বী গলায় বলল,
“আপনি আমাকে কথার জালে ফাসাতে চাইছেন!”
“জ্বি, কারণ আপনি আমাকে ঘৃণা করলেও আমি আপনার প্রতিটি অনুভূতিতে জড়িয়ে আছি, মিসেস।”
আনাবিয়ার ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে, চোখে এসে ভর করেছে আতঙ্ক।
মীর এই মুহুর্তে বসে আছে সোজা হয়ে, ওর শকুনি দৃষ্টি ঘুরে ফিরে চলেছে আনাবিয়ার মুখমন্ডলে। চোখ জোড়ায় বিরাজমান অদ্ভুত স্থীরতা!

গলা খাকারি দিয়ে সে ছুড়ে দিলো আরও কতক বাক্য,
“আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর দাও, নূর। যদি কোকোর জীবন আর আমার জীবন একত্রে তোমার সামনে দাঁড় করানো হয় তবে তুমি কার দিকে হাত বাড়াবে?”
আনাবিয়া জ্বলন্ত চোখে তাকালো মীরের দিকে, ক্ষ্যাপাটে স্বরে শুধোলো,
“আপনি কি তাকে নিজের অপোনেন্ট মনে করছেন?”
“অন্য কোনো পুরুষের সাথে আমার স্ত্রীর এত ক্লোজ রিলেশন থাকুক এটা আমি কখনোই চাইনা নূর! তাই সে যে-ই হোক না কেন, এবং তার সাথে তোমার যে সম্পর্কই হোক না কেন। নট ইভেন মা’ সান।”
“অ্যান্টিভেনমটা দিয়ে দিন, নইলে মরে যাবে ও!”
অস্থির, তেজস্বী গলায় অনুনয়ের সুরে বলল আনাবিয়া।

মীর নিশ্চুপে দেখে চলল আনাবিয়ার চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন, ওর কণ্ঠস্বরের ওঠানামা। তারপর হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলের ওপর থেকে একটি ছোট্ট বোতল হাতে নিলো। বোতলের ছিপি খুলেই ঢকঢক করে গিলে ফেললো ভেতরের তরলটুকু। খালি বোতলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে এক টানে ঠোঁট মুছে অ্যান্টিভেনমের ভাইলটা রাখলো আনাবিয়ার সম্মুখে। বলল,
“সেইম পয়জন। মাইন ইজ টেন টাইম স্ট্রংগার দ্যান হিম। অ্যান্টিভেনম…. ইটস দ্যা সেইম ফ’ বোথ। এখন বলো, কাকে বাঁচাবে তুমি? ম্যি..? অর হিম?”
আনাবিয়ার মুখখানা রক্তশূণ্য হয়ে গেলো মুহুর্তেই, বড় বড় অবিশ্বাস্য চোখ মেলে সে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে।
মীর ঝুঁকে এলো আবার, হাত বাড়িয়ে ধীর গতিতে নামিয়ে দিলো আনাবিয়ার মোলায়েম মুখখানা আবৃত করে রাখা মাস্ক টা। আনাবিয়া বাধা দিলোনা, বাধা দেওয়ার শক্তি, সাহস কোনোটাই পেলোনা। স্থীর, স্তব্ধ চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে।

মীর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার শুভ্র মুখপানে। বিষের প্রভাবে মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠলো তার, চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো।
আনাবিয়ার মুখখানা দেখে মনকাড়া হাসলো সে, হাত বাড়িয়ে নিজের তর্জনী আর মধ্যমার উল্টো পিঠ বুলিয়ে নিয়ে এলো আনাবিয়ার কোমল চোয়ালের ওপর দিয়ে। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমার বউ এমন আগুন সুন্দরী জানলে আমি কখনোই বিষ খেতাম না, নূর৷ ‘নূর’…. তোমার নামটা কে রেখেছিলো নূর ? তোমার নামের সাথে তোমার চেহারার ভীষণ রকম মিল।”
কথা আটকে আসতে চাইলো মীরের, ঠোঁটের কোণে দেখা দিলো রক্তের আভাস, কেশে উঠলো মীর! কয়েক ফোটা রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে!

আনাবিয়ার চোখ থেকে টপটপ করে পড়তে রইলো পানি, বাইরে বেগ বাড়লো বৃষ্টির।
আনাবিয়া এবার ভেঙে পড়লো কান্নায়! তড়িতে সোফা থেকে উঠে আছড়ে পড়লো মীরের বুকের ওপর। বিধ্বংসী আর্তনাদ করে তীব্র আক্রোশে বলে উঠলো,
“কেন এমন করলে মীর? আমাকে পরীক্ষা করার কি আর কোনো উপায় ছিলো না তোমার কাছে?”
মীর গা কাঁপিয়ে হাসলো নিঃশব্দে, অসাড় হয়ে আসা দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো আনাবিয়াকে, বলল,
“তোমার ঘৃণা, তোমার কান্না, তোমার ক্রোধ, অভিমান, ভালোবাসা, এমনকি নীরবতাও একান্তই আমার নূর। আমি চাইনা সেখানে কেউ কখনো ভাগ বসাক। এটলিস্ট, আমার প্রাণ থাকতে নয়৷
তুমি স্বাধীনতা চাইলে আজ, এই মুহুর্তে আমাকে মেরে ফেলতে পারো নূর, দ্যা চয়েজ ইজ ইয়োর্স। আমি জানিনা আমি কি খারাপ করেছিলাম তোমার সাথে, বাট আ’ সয়্যার আমি ওই ভুল আর কখনো রিপিট করবো না, বিলিভ মি!”

মীরের বুকে মুখ গুজে পড়ে আর্তনাদ করতে থাকা আনাবিয়া ফুপিয়ে উঠে এক হাতে মীরের গলা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“চুপ করো!”
পরক্ষণেই মীরের ওপর থেকে উঠে চোখ মুছে নিলো সে, উঠে দাঁড়িয়ে তড়িতে অ্যান্টিভেনমের ভাইলের ছিপি খুললো। কোকোর দিকে তাকালো একবার, চোখ জোড়া ভরে এলো আবারও, বুক ছাপিয়ে কান্নার ঝড় এসে আছড়ে পড়তে লাগলো বারংবার।
চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকে মুখখানা শক্ত করে বোতলের তরলটুকু নিমিষেই খাইয়ে দিলো মীরকে।

পরক্ষণেই চেপে রাখা কান্না জোয়ারের ন্যায় ভেঙেচুরে এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো ওকে, চিৎকার করে কেঁদে উঠে মাটিতে বসে পড়লো আনাবিয়া। ওর তীব্র, অসহায় আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো সমস্ত রেড জোন।
মীর চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে নিভে যাওয়া চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, ওর মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,
“নূরিয়া তাজদিন, তুমি তোমার এই খারাপ স্বামীকে ভীষণ রকম ভালোবাসো।”
আনাবিয়া শুনলোনা কিছু, ওর অসহায় দৃষ্টি পড়ে রইলো মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কোকোর দিকে।
কি করবে, কিভাবে কোকোকে বাঁচাবে, কোন ধরণের বিষ কোনো কিছুই ঠাহর করতে মস্তিষ্ক সায় দিলোনা! অসাড় হয়ে গেলো যেন ওর চিন্তাচেতনা, বোধ বুদ্ধি!
মীর ফিচেল এসে বলে উঠলো,

“কেঁদোনা নূর, ওকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। ও মরবে না, দুদিন পর উঠে পড়বে।”
মীরের কথা শোনা মাত্রই কান্না থেমে গেলো আনাবিয়ার। স্তব্ধ, আক্রমণাত্মক চোখে ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মীরের দিকে। মীর বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা রক্তের দাগ গুলো মুছে ফেলতে ফেলতে বলল,
“আমি আগেই জানতাম তুমি আমাকে রেখে কোকোকে অ্যান্টিভেনম দিবে না। তাই বিষটা শুধু আমিই গ্রহণ করেছি নূর। যদি আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তুমি কোকোকে অ্যান্টিভেনম দিতে তবে বেয়াদবটা নির্ঘাত মরতো। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার জোরে ওর জান বেঁচেছে।”
আনাবিয়া দাঁতে দাঁত চাপলো, এত আয়োজন শুধুই ওকে দিয়ে স্বীকার করানোর, যে সে মীরেরই স্ত্রী! কিন্তু এই ফাঁদে ও আর পড়তে চায় না। কোনো ভাবেই না!
তখনি আচমকা বাইরে দরজার ওপর শোনা গেলো কারো আছড়ে পড়ার শব্দ। পরমুহূর্তেই ভেসে এলো ফক্সি আর লায়রার কন্ঠস্বর! দুজনে আশেপাশেই খেলছিলো, আনাবিয়ার কান্নার আওয়াজ পেয়ে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে ছুটে ছুটতে চলে এসেছে এখানেই৷

দরজায় মাথা লাগিয়ে গুতিয়ে ডেকে চলেছে ফক্সি, লায়রা সম্মুখের দু পায়ের থাবা দিয়ে বারংবার আঘাত করতে করতে আর্তনাদ করে চলেছে সমানে!
অ্যান্টিভেনম কাজ করতে শুরু করেছে সবে। কিন্তু বাহিরে শেয়ালের ধ্বনি শোনা মাত্রই সোজা হয়ে বসলো মীর। শেয়াল সম্পর্কিত পূর্বের সপ্নালু স্মৃতি গুলো হঠাৎই হামলে পড়লো ওর স্মৃতিপটে। মনে পড়লো সেই ঝিলমিলে মেয়েটিকে, যার সাথে রোজরাতে সাক্ষাৎ হতো তার!

অবিলম্বে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মীর। মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ! কিন্তু টললো না মীর, থামলো না সে। দ্রুত পায়ে মেঝেতে বসে থাকা আনাবিয়াকে পেরিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঝটিতি দরজা খুললো সে।
নিচে তাকিয়ে ফক্সি কে দেখা মাত্রই চিনে ফেললো মীর। মুহুর্তেই মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ বেগে হামলে পড়লো ওর পাথর বন্দী জীবনের অস্পষ্ট স্মৃতি, প্রচন্ড পরিচিত কারো আর্তচিৎকার শুনে শেকল ভেঙে ছুটে চলে যাওয়া…. তারপর…… সাগর পাড়ের ঝিলমিলে মেয়েটি; সফেদ চুল, হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখের অধিকারিনী…..

ঝিলমিলে মেয়ে! তাহলে সে সবই সত্যি? সমস্তই সত্যি? দৃশ্য গুলো তবে ওর স্বপ্ন ছিলো না? অবিলম্বে ওর মস্তিষ্ক আনাবিয়ার নূর নামক চেহারার সাথে ঝিলমিলে মেয়ের এক বিস্তর মিল করে ফেললো।
মুহুর্তেই চোখের সম্মুখে জলোচ্ছাসের ন্যায় হানা দিলো হাজার হাজার স্মৃতি! প্রবল চাপ পড়লো মীরের মস্তিষ্কে! হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করতে রইলো ভীষণ জোরে, তীব্র যন্ত্রণায় আঁধার নেমে আসতে চাইলো চোখের সম্মুখে!
তড়িতে দু হাতে দুদিকের দরজার কাঠামো আকড়ে ধরলো সে! জ্ঞানলোপ হওয়ার পূর্বে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে এক পলক দেখতে চাইলো আনাবিয়ার মুখখানা।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৬

সেই মুহুর্তেই এক বিকট শব্দ হলো কামরার পেছনের দেয়ালে। নিভে যেতে চাওয়া চোখে মীর দেখলো দেয়ালের মাঝ বরাবর ভেঙে দূর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে তার নূর…. তার আনাবিয়া….. তারই শিনজো…..!”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here