বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৯
রানী আমিনা
শীতের গাঢ় রাত।
আকাশে থোকা থোকা সাদাটে মেঘের আভাস, ঝাঁকে ঝাঁকে তারকারাজি ফুটে আছে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু দেখা নেই চাঁদের।
প্রাসাদের করিডোর নিস্তব্ধ। রয়্যাল ফ্লোরের রাজকীয় কক্ষে একা বসে আছে ইলহান, সামনে ছড়ানো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। সেগুলোর দিকে তার পূর্ণ মনোযোগ।
হঠাৎ টেবিলে থাকা স্বচ্ছ যন্ত্রের ওপর ভেসে উঠলো ইযানের আলোকচিত্র, সাথে একটি ছোট্ট বার্তা— ইয়োর ম্যাজেস্টি, ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিন, ইটস আর্জেন্ট।
ইলহান বিরক্ত হলো, ছেলেটা মধ্যরাতের আগে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পায় না। যত রকমের জরুরি সংবাদ তার রাত বাড়লেই পেতে হয়।
বিরক্তিতে ভ্রু জোড়া কুচকে নিয়ে সে স্বচ্ছ পর্দার ওপর আঙুল ছোয়াতেই খুলে গেলো দরজা। তৎক্ষনাৎ ভেতরে প্রবেশ করলো ইযান। মুখমন্ডলে তার উত্তেজনা ছাপানো।
“তোমাকে কতবার বলেছি ইযান, রাতে আমাকে বিরক্ত করবে না?”
কড়া গলায় বলল ইলহান।
ইযান মাথা নত করে কণ্ঠ নামিয়ে বললো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, ক্ষমা করবেন। জরুরি না হলে আমি আপনাকে কখনোই বিরক্ত করতাম না৷”
“বলো, কি হয়েছে?”
“আজ আপনার কামরায় যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তার মূল বিষয়বস্তু গোপনে বাইরে পাঁচার করা হচ্ছিলো। অপরাধিনীকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। দৃঢ় সন্দেহ রয়েছে যে এর পূর্বেও সে বহুবার আমাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার তথ্য বাইরে সরবরাহ করেছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইলহানের মুখের ওপর থেকে বিরক্তি সরে গিয়ে ভর করলো বিস্ময়, পরক্ষণেই সে বিস্ময় ক্রোধে রুপান্তরিত হয়ে ওর কপালে ফেললো ভাজ, চোয়াল হয়ে এলো শক্ত। গমগমে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কে সে? কার এত বড় স্পর্ধা হয়েছে আমার প্রাসাদে থেকে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার? আর কি কি করেছে সে? কোন কোন ইনফর্মেশন বাইরে পাঠিয়েছে? কার নিকট পাঠিয়েছে?
“গুল বাহার, ইয়োর ম্যাজেস্টি। সন্ধ্যায় সে প্রাসাদের ছাদে গিয়েছিলো গোপনে। সেখানে খাসবাদী অরোরা উপস্থিত ছিলো। সেখানেই বাহারের অসাবধানে তার চিরকুটটি অরোরার কাছে পৌছ্ব যায়, অরোরা সেটা এক দাসীর মাধ্যমে আমার নিকট পৌছে দিলে দেখি আজকের সভার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হুবহু লেখা তাতে।”
বাহারের নাম শুনে ইলহান শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো টেবিলের দিকে, চোখে ফুটে উঠলো অসন্তোষ। ইযান হাতের মুঠিতে ভাজ করে রাখা চিরকুটটা রাখলো টেবিলের ওপর। ইলহান সেটা তুলে নিয়ে ভ্রু কুচকে দেখলো কিছুক্ষণ।
ইযান আবার বলতে শুরু করলো,
“গুলবাহারকে তখনি বন্দি করা হয়েছে, ইয়োর ম্যাজেস্টি। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছি কিন্তু সে মুখ খুলতে চাইছে না। আপনি অনুমতি দিলে তাকে বেজমেন্টে নিয়ে বন্দি করবো, ইয়োর ম্যাজেস্টি। সব কথা তখন আপনিই মুখ থেকে বেরিয়ে যাবে।”
শেষোক্ত বাক্যটা কঠিন স্বরে বলল ইযান। ইলহান বসে রইলো কিছুক্ষণ স্থীর, নিরব হয়ে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীর এলিয়ে দিলো চেয়ারে। ক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর করাল, শান্ত গলায় বলল,
“খোঁজ নাও সে কার হয়ে কাজ করছে। যতক্ষণ না সমস্ত সত্য উগরে দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে যাবে৷”
ইলহান এবার মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো।
ইযান দাঁড়িয়ে রইলো প্রস্থানের অনুমতির অপেক্ষায়। ক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর ইলহান বন্ধ চোখেই জিজ্ঞেস করলো,
“ওদিকের আপডেট বলো।”
“শেহজাদী দু সপ্তাহ পূর্বে শিরো মিদোরি ছেড়ে বেরিয়েছিলেন। শেষ বার তাঁকে সমুদ্রে তাঁর প্রাইভেট ইয়টে দেখা গেছিলো, এখনো তিনি শিরো মিদোরিতে ফিরে আসেননি। আর… শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের কোনো আপডেট এখনো জানা যায়নি।এতদিনেও কেউ তাকে বাইরে বের হতে দেখেনি, তাই তার বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু শেহজাদী শিরো মিদোরি ছাড়ার পূর্বের দিনে ফ্যালকন নামক ছেলেটার সাথে কুরো আহমারের ফেমাস শেফ মুরসালিনকে শিরো মিদোরিতে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এছাড়া জংলী গুলোর অন্য কাউকে দেখা যায়নি।”
“ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পারো।”
বলে ক্লান্ত দেহখানা চেয়ারে আরেকটু এলিয়ে দিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো ইলহান৷ ইযান আনুগত্য জানিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু ইলহানের কথায় থামলো আবার,
“অরোরা কে বলে পাঠাবে এই অবস্থায় ছাদে বেশি ঘোরাঘুরি না করতে, সাবধানে থাকতে। আমার অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি হোক আমি চাইনা৷”
“আপনার যেমন আদেশ, ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
বলে ইযান বেরিয়ে গেলো বাইরে৷
পাথরের ছোট্ট কুঠুরি, সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে মাথায় বেধে যায় ছাদ। স্যাঁতসেঁতে পাথুরে দেয়ালে ঝুলছে মাকড়সার জাল, সিলিং গলিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে নোংরা পানি। চারদিকে আঁধারে ঠাসা, আলো বলতে শুধুই ধাতব দরজার নিচ গলিয়ে আসা মশালের আগুনের ক্ষীণ রশ্মি। স্যাতস্যাতে মেঝেতে ঘুরে চলেছে কীট, নিঃস্তব্ধতা চিরে ভেসে আসছে তাদের সহস্রপদচারণার খসখসে শব্দ।
তার ওপরেই পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে বাহার, মুখে গুজে দেওয়া কাপড়। চোখের কার্নিশ বেয়ে অনর্গল গড়িয়ে পড়ছে লোনা জল। পোকামাকড় বারেবার উঠে আসতে চাইছে ওর শরীরের ওপর৷
এমন সময় দূরে কোথাও গমগমে শব্দ হলো লোহার দরজা খোলার। ধীরে ধীরে নিকটে এলো কয়েক জোড়া পদশব্দ। বাহার ছটফটিয়ে উঠলো মুক্তি পাওয়ার আশায়!
পায়ের শব্দ গুলো এসে থামলো ধাতব দরজার সামনে, পরক্ষণেই ঘরঘর শব্দ করে বাদিকে সরে গেলো লৌহকপাট। আলো এসে হামলে পড়লো বাহারের সিক্ত চোখে, চোখ খিচে নিলো সে।
ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো ইযান, হাতে জ্বলন্ত মশাল। পেছনে এলো জনাকয়েক রক্ষী, হাতে তাদের কুচকুচে কালো রঙা চাবুক। চাবুকের দিকে দৃষ্টি যাওয়া মাত্রই মুখে আতঙ্ক জমে উঠলো বাহারের। বাধা হাত জোড়া নিয়েই পা দিয়ে মেঝে ঠেলে ঠেলে গুটিয়ে গেলো সে ছোট্ট কুঠুরির এক কোণায়! শিখার লাল আলোর প্রভাবে পালিয়ে গেলো সেখানের নোংরা কীট গুলো।
ইযান ভারী পায়ে এসে দাঁড়ালো বাহারের সামনে। মশালের আগুন চোখে ঝিলিক তুলে দিলো বাহারের। পকেট থেকে মোচড়ানো চিরকুটটা বের করে মেঝেতে ছুড়ে ফেললো, কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ভালোয় ভালোয় বলে ফ্যাল কাকে পাঠাতি এসব চিরকুট?”
বাহার কাঁপলো সামান্য, আগুনের ক্ষীণ আলোকে সেটা দৃষ্টিগোচর হলোনা কারো। ঠোঁট জোড়া আটকে রইলো শক্তকরে, যেন মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে গেলেই ঠোঁট জোড়া তাতে বাঁধা দেয়।
মশালটা আরও এগিয়ে নিয়ে এলো ইযান, ধরলো বাহারের মুখের কাছে। তাপে কপালে ঘাম জমে টপটপ করে ঝরতে শুরু করলো তার! মশালটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো ওর চোয়ালের আরও নিকট, আরেকটু এগোলেই আগুনের লেলিহান শিখা ছুয়ে দিবে নরম চোয়াল, ঝলসে দিবে সুন্দর মুখখানাকে।
আতঙ্কিত হয়ে গেলো বাহার, দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণায় চোখ জোড়া পানিতে টইটম্বুর হয়ে এলো তার।
“বল, নামটা বল শুধু! নাম বললেই তোকে ছেড়ে দিবো, আর কিচ্ছু বলবোনা।”
গমগমে গলায় বলল ইযান। বাহার দাঁতে দাঁত আঁটকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো মশালের দিকে।
ইযান এবার দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“কথা বলতে দেরি করলেই এই মশাল তোর মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেবো বে**শ্যা মা**গী! কার হয়ে কাজ করছিস তুই?”
জোরে শ্বাস নিতে নিতে, চোয়াল ছুয়ে দিতে চাওয়া মশালের দিকে সিক্ত চোখে একবার তাকালো বাহার। ইতোমধ্যে ফোসকা পড়তে শুরু করেছে চোয়ালে। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো সে, তবুও মুখ থেকে একটা শব্দ বের করলো না।
হঠাৎ মশালটা অদূরে ছুড়ে ফেলে দিলো ইযান, পরক্ষণেই বাহারের লাল চুলের মুঠি ধরে সজোরে আছাড় মারলো পাথরের দেয়ালের ওপর, কপাল ফেটে গলগলিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলো তৎক্ষনাৎ!
ইযান দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“আমাদের খেয়ে, আমাদের পরে আমাদেরই পেছনে ছুরি চালানোর সাহস তোকে কে দিয়েছে নাম বল তার!”
পরমুহূর্তেই আবারও সজোরে আছাড় দিলো দেয়ালের ওপর। রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হতে শুরু করলো বাহারের কপাল বেয়ে। হারিয়ে ফেললো শরীরের সমস্ত শক্তি, অসাড় হয়ে এলো শরীর, নেতিয়ে পড়া চোখ জোড়া দিয়ে তাকিয়ে রইলো ইযানের দিকে৷
সোজা হয়ে দাঁড়ালো ইযান, ইশারা করতেই দুজন প্রহরী এগিয়ে এলো সামনে। পরক্ষণেই বাহারের অসাড় শরীরের ওপর সজোরে পড়লো চাবুক! যন্ত্রণায় দুর্বল হয়ে আসা গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো তীব্র গোঙানির শব্দ।
প্রহরীরা আঘাত করলো আবারও। প্রতি আঘাতে গলা থেকে বের হতে চাওয়া গোঙানি যেন আঁটকে যেতে রইলো আরও, বের হওয়ার মতোন জোরটুকু পেলোনা। ক্রমে ক্ষতবিক্ষত হতে শুরু করলো বাহারের পিঠ, বুক, পেট। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে মেঝেতে জড়ো হলো ক্রমে, নিথর হতে শুরু করলো দেহ।
এক সময় এসে ইযানের আদেশে থেমে গেলো চাবুকের আঘাত। হাটু মুড়ে বসে উঁচু করে ধরলো সে বাহারের রক্তমাখা চিবুক। নিভে যেতে চাওয়া আখিজোড়ায় তাকিয়ে বলল,
“দেখা যাক, তোর লয়ালটির পুরুত্ব কতটুকু, গুলবাহার! তবে মনে রাখিস, তুই বিশ্বাসঘাতক না হতে চাইলেও তোর এই শরীর একসময় বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠবে, তখন তারা বলতে শুরু করবে এক এক করে।”
ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো ইযান, তারপর বাহারকে ওভাবেই ফেলে রেখে বেরিয়ে গেলো সে প্রহরীদের নিয়ে। লোহার দরজায় আঁটকে দিলো তালা।
আঁধার নামতেই যেন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠলো কুঠুরির ভেতরটা, ফিরে এলো এতক্ষণ লুকিয়ে থাকা কীট গুলো, মহাসমারোহে তারা দখল করে নিলো বাহারের ক্ষতস্থান গুলো।
রাতের বুক ফুঁড়ে নেমে আসা কুয়াশায় মোড়ানো কুরো আহমারের নির্জন রাস্তাগুলো। সুউচ্চ স্ট্রিট লাইটের মৃদু হলুদাভ আলো ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে।
চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু থেকে থেকে ভেসে আসছে রাস্তার কুকুরদের শীতার্ত চিৎকার। ফাঁকা রাস্তায় এখন জনাকয়েক লোক, অধিকাংশই তরুণ। হাত ধরাধরি করে, দুষ্টু মিষ্টি গল্পে মেতে, জোড়ায় জোড়ায় নির্জন রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে ঘরে ফিরছে তারা।
হঠাৎই, রাতের সেই দৃঢ় নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে এলো একজোড়া শক্ত, ভারী বুটের ধ্বনি। ধীর কদমে কেউ এগিয়ে আসছে এই মহাসড়ক বেয়ে৷
ক্ষণ পরেই আলো-আঁধারির ফাঁক গলিয়ে, মহাসড়কের হলুদাভ আলোয় ভেসে উঠলো এক সুদীর্ঘ, পুরুষালি অবয়ব।
ধুসর বর্ণের টার্টল নেক সোয়েটারের ওপর চড়ানো গাঢ় কালো উলের কোটটি নেমে গেছে হাঁটু অব্দি, শীতল বাতাসে রাজসিক ভঙ্গিতে উড়ে চলেছে কোটের শেষাংশ।
হুডেড কোটটির উপরাংশ ঢেকে রেখেছে তার স্বর্ণাভ দৃষ্টি। বুকের ধাতব বোতামগুলো স্বল্প আলোকে চকচক করে উঠছে।
চকচকে কালো লেদার বুটের প্রতিটি দৃঢ়, ভারী, শাব্দিক পদক্ষেপ কাঁপিয়ে চলেছে কংক্রিটের পথ। হাতের গাঢ় কালো চামড়ার গ্লাভসের ওপর দিয়ে কবজিতে বাধানো একটি মেটাল ব্লাক রিস্ট ওয়াচ, তার ধাতব রুপোলী কাঁটা গুলো ঝিকমিক করছে মৃদু আলোকে।
লং কোটের ভেতর লুকোনো তার প্রশস্ত কাঁধ, গ্রীক মূর্তির মতোন খাড়া, পুরুষালি দেহের সাথে তাল মিলিয়ে রাজসিক হাঁটার ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে এক অনির্বচনীয় দম্ভ।
রাস্তা ধরে হেটে চলা গুটিকয়েক লোকজন হঠাৎ যেন থমকে গেলো কারো অদৃশ্য প্রতাপে। নিজেদের কর্মে নিজেরাই বিস্মিত হয়ে অবাক চোখে তাকালো একে অপরের দিকে। ক্ষণ পরেই সুদীর্ঘ অবয়বটির বুটের শব্দে কৌতুহলী, ভীত দৃষ্টিতে তাকালো মহাসড়কের মধ্যখানে।
মুহুর্তেই দৃষ্টি সীমায় ধরা দিলো সেই দাপুটে, রাজসিক শরীরের অবিচল পদক্ষেপের মালিক। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, হাত জোড়া ডার্ক শেডের প্যান্টের পকেটের ভেতর দিয়ে হেটে চলেছে সে।
থমকানো জনসমাগমের বিস্ময়াভিভূত চাহনির ভেতর দিয়ে, নিশুতির অন্ধকার ভেদ করে সেই সুদীর্ঘ অবয়ব এগিয়ে গেলো ডাস্কমায়ার জঙ্গলের পথে।
জঙ্গলের ভেতর থেকে ক্ষণ পর পর ভেসে আসছে শেয়াল আর নেকড়ের চিৎকার। ডাস্কমায়ার জঙ্গলে শিকারি বলতে এই দুইটা প্রাণীই। আর আছে সরীসৃপ। সকল ধরনের বিষধর সরীসৃপে ঠাসা এই ডাস্কমায়ার জঙ্গল।
জঙ্গল পেরোলেই সমুদ্র, সেখানে সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল আর লেদারব্যাক সি টার্টলদের রোদ পোহানোর জায়গা। সেদিকে সাধারণ মানুষের পদচারণা নেই বললেই চলে। ভুলবসত কেউ চলে গেলে অক্ষত হয়ে আর ফিরে আসেনা, যদিনা ভাগ্য তার আজন্ম সহায় হয়।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গেছে চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা। রাস্তা ধরে কিছদূর এগোতেই ঘন হয়ে উঠলো জঙ্গল, ক্ষনপর দেখা গেলো একটি বিরাট সাইনবোর্ড যাতে বড় বড় লাল কালীতে লেখা— ডেঞ্জার
তারই নীচে ছোট ছোট কালো রঙা অক্ষরে লেখা — নো এন্ট্রি।
সাইনবোর্ড পেরিয়ে রাস্তা বয়ে হেটে চলল স্বর্ণাভ দৃষ্টির অধিকারী ব্যাক্তিটি। জন সমাগম ফেলে এসেছে অনেক দূরে, পিছে পড়ে আছে হিমে আবৃত হয়ে যাওয়া কুরো আহমারের ছোট ছোট বাসা বাড়ি গুলো।
ঠান্ডা বাড়ছে ক্রমশ, মধ্যরাতের শীতের প্রকোপ কাঁপিয়ে তোলার উপক্রম শরীর। জানুয়ারি শুরু হলেই তুষার পড়তে শুরু করবে এদিকে, কুরো আহমার ঢেকে যাবে কয়েক ফুট উঁচু তুষারের চাদরে।
কিন্তু ভলক্যানো সদৃশ চোখের মালিকের কোনো হেলদোল হচ্ছেনা তাতে। নির্বিকার চিত্তে, নিজের স্বকীয় গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে সে হেটে চলেছে ছুরির ফলার ন্যায় তীব্র শীতল বাতাসের ভেতর দিয়ে।
কিছুদূর এগোতেই ফিকে হয়ে এলো জঙ্গল, তার কিছু মুহুর্ত পরেই দৃষ্টিগোচর হলো এক বিশাল মহলের চূড়া। ধীরে ধীরে প্রকট হলো অদ্ভুত নীরবতায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজসিক প্রাসাদটি।
বিশাল প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু দুটি স্তম্ভ, তাতে খোদাই করা সোনালী নকশা জ্বলজ্বল করছে চাঁদের আলোয়। তারই সম্মুখে পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন বিশালদেহী দ্বাররক্ষী।
রাজসিক ব্যাক্তিটির পায়ের শব্দ কাছে আসতেই সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো দুজনে, হাতের অস্ত্র গুলো শক্ত মুঠিতে ধরে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইলো অন্ধকারের পানে। নিষিদ্ধ জেনেই এই রাস্তায় ভ্রমণের মূল্য চুকিয়ে দেবে উৎসুক পথচারীকে।
আঁধারের ভেতর দৃষ্টিগোচর হলো আবছা অবয়বটি, রক্ষী দুজন প্রস্তুতি নিলো সীমানায় আসার পূর্বেই ব্যাক্তিটির খুলি উটিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সেই মুহুর্তেই ধেয়ে আসা বাতাসে ফেলে দিয়ে গেলো তার মুখাবয়ব আবৃত করে রাখা হুডখানা, পরক্ষণেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে দৃষ্টিগোচর হলো তার আগ্নেয়গিরির ন্যায় শকুনি চোখ জোড়া।
রক্ষী দুজনের সতর্ক চোখে মুহুর্তেই এসে ভর করলো ভয়, আনুগত্য, শ্রদ্ধা। তড়িতে মাথা নুইয়ে আনুগত্য জানিয়ে প্রবেশদ্বারের বিশাল শেকল টেনে ধরলো দুজনে, বিকট শব্দে মাটি কাঁপিয়ে ধীরে ধীরে খুলে গেলো ধাতব দরজা। মুহুর্তেই জেগে উঠলো সমস্ত প্রাসাদ!
ঘন কুয়াশা ভেদ করে এভিয়ে এসে, ধীর, ভারী পা ফেলে প্রবেশদ্বার পেরোলো সে, অবিলম্বে মহলের রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরে উঠলো ঘোষণা,
—অ্যালার্ট.. অ্যালার্ট, দ্যা কিং নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান ইজ হিয়ার।
মুহূর্তেই তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো অন্দরমহলে। দাস-দাসীরা উষ্ণ বিছানা ছেড়ে, হুড়োহুড়ি করে ছুটে প্রস্তুতি শুরু করলো বাদশাহকে স্বাগত জানানোর। মধ্যরাতে আবার ব্যাস্ত হলো চুলা গুলো। প্রস্তুতি চলল বাদশাহর জন্য সবচেয়ে সেরা খাবারটি তৈরির। প্রত্যেকের মুখে এসে ভর করলো একই অভিব্যক্তি, ভয় আর ভক্তির মিশেল।
কোথাও যেন এতটুকু অসঙ্গতি না হয় তার জন্য চতুর্দিকে কড়া নজর রাখতে শুরু করলো মহলের প্রধান দাসী, তার কড়া আদেশের সুরে তটস্থ হয়ে উঠলো সকলে।
দাস গুলো মহলে ওঠার সিঁড়ির দুপাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো যথা নিয়মে। সিঁড়ি ভেঙে উঠে প্রতাপে পূর্ণ পদক্ষেপে মহলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো দীর্ঘাবয়বটি। নতুন দাস-দাসী গুলো আতঙ্কে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, লুকোনোর চেষ্টা করলো কেউ কেউ ওই শকুনি দৃষ্টির আঁচড় হতে, কেউ আঁটকে ধরে রইলো শ্বাস!
অবশেষে মীর পৌঁছাল মহলের অন্তঃপুরে, তার আর আনাবিয়ার ব্যক্তিগত কামরার বিশাল দরজার সামনে। এইদিকে শুধুমাত্র দাসীদের প্রধান ব্যাতিত অন্যকারো বিনা অনুমতিতে প্রবেশ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। রোজ দাসী প্রধান নিজ দায়িত্বে অধস্তন দাসীদেরকে দিয়ে কামরাটিকে ঝকঝকা তকতকা করে রাখেন। হিজ ম্যাজেস্টি এবং হার ম্যাজেস্টি পূর্ব সংবাদ ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ হানা দেন এই মহলে, দাসী প্রধানের তাই আগাম সতর্কতা।
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো মীর। অন্ধকার কামরা, কিন্তু তার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠলো বৈদ্যুতিক বাতিগুলো, সাদাটে স্বর্ণালি আলোয় আলোকিত হয়ে এলো সুসজ্জিত কক্ষটি।
চারদিকে নজর বুলিয়ে দেখলো মীর। যেমনটা শেষবার দেখেছিলো তেমনটাই আছে আজও। এগিয়ে এলো বিছানার নিকট, শয্যার বিপরীতে রাখা বিরাট শার্সিতে ফুটে উঠলো তার পুরু পোশাকে মোড়া গাম্ভীর্যপূর্ণ রাজসিক চেহারা।
একে একে সমস্ত পোশাক খুলে শাওয়ার নিতে ঢুকলো সে ওয়াশরুমে। তার অনুপস্থিতির সুযোগে দুরুদুরু বুক নিয়ে কামরার টেবিলে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার গুছিয়ে রেখে গেলো জনাকয়েক দাসী। সঙ্গে নিয়ে গেলো খুলে রাখা পোশাক, আলমিরা থেকে নতুন পোশাক বের করে সুসজ্জিত ভাবে রেখে গেলো বিছানার পাশে।
দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে পানির গ্লাসটা হাত থেকে নামিয়ে টেবিলে রাখলো মীর। ক্ষণ পূর্বেই খাওয়া শেষ হয়েছে তার, বর্তমানে ঘরময় পায়চারি করতে করতে খাবার গুলো দ্রুত হজমের চেষ্টায় সক্রিয় সে। শব্দ পেয়ে আগন্তুকের উদ্দ্যেশ্যে আদেশপূর্ণ স্বরে বলে উঠলো,
“এসো..”
দরজা ঠেলে ভেতরে এলো একজন দাস, নত মুখে শুধোলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, এলিনা কালবি জানতে চাইছেন আপনার কিছু প্রয়োজন কিনা।”
মীর তাকালো তার দিকে, দাসটির পেছনে দরজার ওপাশে চোখে পড়লো জমকালো মেয়েলি পোশাকের নিম্নাংশ, পোশাকের মালকিনের শুভ্র পা জোড়া ভেতরে প্রবেশের উত্তেজনায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
চোখ সরিয়ে নিলো মীর, গমগমে স্বরে বলল,
“না, কিছু প্রয়োজন নেই, আমার বাহিরের পোশাক গুলো তৈরি রাখতে বলো, আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই বের হবো।”
উঠে এলো মীর বিছানায়, স্বচ্ছ যন্ত্রে রাত আড়াইটার এলার্ম সেট করে শুয়ে পড়লো উপুড় হয়ে।
বাহিরের জমকালো পোশাকের মালকিনের উত্তজনায় কেঁপে ওঠা পা জোড়া থমকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর হতাশ ভঙ্গিতে ছোট ছোট ধীর পদক্ষেল ফেলে ফিরে গেলো আবার পূর্বের স্থানে৷
নিস্তব্ধ রাত্রীতে যখন মহলের সকলেই ঘুমে আচ্ছন্ন তখন জেগে রইলো একটিমাত্র প্রাণী। আনাবিয়ার বিলাসবহুল ক্লজেটের দরজা ঠেলে ঢুকলো সে ভেতরে। বাতাসে এখনো ভাসছে মৃদু সুগন্ধী, ঝাড়বাতির স্বর্নাভ আলোক কণা এসে হুটোপুটি করে চলেছে মেঝেতে।
ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোলো মীর, চাহনিতে লেগে রইলো এক রহস্যময় শূন্যতা। দৃষ্টি ঘুরে ফিরে চলল আনাবিয়ার প্রতিটা পোশাক, প্রতিটা প্রসাধনী, প্রতিটা গহনায়।
এগোতে এগোতে মুহূর্তের জন্য হঠাৎ সে থেমে গেলো একটা সুন্দর, ফ্লাপি স্যাফায়ার গাউনের সম্মুখে। আলগোছে হ্যাঙারে ঝুলে আছে সেটি, আলো পড়ে ঝিকিমিকি করছে ক্রিস্টাল কণা গুলো। এখনো তাকে তোলা হয়নি আলমিরাতে।
এগিয়ে গেলো মীর, ইস্পাত-দৃঢ় হাত বাড়ালো নরম, কোমল পোশাকের দিকে। আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে দেখলো ক্রিস্টালের সুক্ষ কারুকাজ। নামিয়ে নিয়ে এসে বুকের কাছে ধরলো সেটা, পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে ব্যাকুল চিত্তে মুখ গুঁজে দিলো কাপড়ের বুকে! গভীর শ্বাসে টেনে বুক ভর্তি করে নিলো পরিচিত সুবাসে!
যে ঘ্রাণ একসময়ে শুধু তার চারপাশেই সাপের মতোন কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুরতো, এখন সেই ঘ্রাণই প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীর একমাত্র স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে তার সামনে! এ ছাড়া আর কিছুই নেই, আর কোনো কিছুই প্রেয়সীর অভাব পূরণ করতে সক্ষম নয়।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৮
গাউনটিকে দুহাতে বুকে চেপে ধরলো মীর, পোশাকের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে চেপে ধরলো প্রাণপণে, যেন রক্ত মাংসে গড়া প্রেয়সীকে বুকের ভাজে পিষে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা!
নিরবে কেটে গেলো কিছুক্ষণ, হঠাৎ ক্লজেটের ভেতর দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঝটিতি চোখ মেললো মীর।
