বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪০

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪০
রানী আমিনা

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মীর, তাকালো সরাসরি ক্লজেটের অন্য কোণা অবস্থিত ছোট দরজাটার দিকে। বাহিরের নীলচে আলোয় দৃষ্টিগোচর হলো একটি বিশালাকৃতির নেকড়ে, ছায়ার মতোন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। মীর তার দিকে তাকানো মাত্রই নিজের হিউম্যান ফর্মে ফিরলো সে, পরিণত হলো একটি টগবগে যুবকে। পরক্ষণেই মাথা নুইয়ে আনুগত্যের সুরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, অনুমতি না নিয়ে ভেতরে প্রবেশের জন্য ক্ষমা করবেন। আপনি যার খোঁজ করছিলেন তাকে ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের অপজিটে থাকা বুক ক্যাফেতে দেখা গেছে। এখনো সে সেখানেই আছে। আপনার কি আদেশ?”
“রক্ষীদের কাউকে বলো কামরা প্রস্তুত করে দিতে, সেখানে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ভোরে উঠে শিরো মিদোরিতে ফিরে যাবে৷”

আনাবিয়ার স্যাফায়ার ড্রেসটা হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখলো মীর। পাশে পড়ে থাকা রাতের পোশাক গুলো হাতে তুলে নিতেই আড়চোখে তাকালো নেকড়েটা। মেয়েলি পোশাক এমন নিপুণ ভাঁজ করতে দেখে মুহুর্তের জন্য বিস্মিত হলো সে। পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার, দৃষ্টি নত করে নিলো সে। পোশাক গুলো আলমিরাতে রেখে পেছনে না তাকিয়েই মীর গমগমে স্বরে শুধোলো,
“খুব মজা পাচ্ছো, অ্যাশটন?”
প্রশ্ন টা শোনা মাত্রই অ্যাশটনের হাসি উড়ে গেলো, পাংশু মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে আলমিরাতে নিজের দীর্ঘ দেহ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো মীর, অ্যাশটনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এসবের মর্ম তুমি এখন বুঝবে না অ্যাশটন, তোমার তো বউ পালায়নি! কখনো পালালে দেখবে তুমিও এভাবে বউয়ের পোশাক গোছাচ্ছো।”
অ্যাশটনের হাসি পেলো আবারও। গলা খাকারি দিয়ে হাসিটা আটকে ফেলে সে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমার বউ নেই।”
“এক্স্যাক্টলি। এখন গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসো আমার পোশাক প্রস্তুত হয়েছে কিনা, হয়ে গেলে নিয়ে এসো।”
বলে মীর এগোলো কামরার উদ্দ্যেশ্যে। অ্যাশটন আহত চোখে তাকিয়ে এগোলো মীরের পোশাকের খোঁজে।

শীত জেঁকে বসেছে, চারদিকে তীব্র শীতল বাতাস বইসে শো শো করে। ফাঁকা রাস্তা বেয়ে একটি বেবি পিংকের বিলাসবহুল, রাজকীয় গাড়ী ছুটে চলেছে ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের দিকে। কাঁচ গুলো উঠানো, ভেতরের উষ্ণ পরিবেশে বসে রাস্তার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে মীর।
গাড়িটা সেদিনই কিনেছিলো, যেদিন প্রথমবার খবর পেয়েছিলো আনাবিয়া ওর সন্তানের মা হতে চলেছে। আনন্দে সেদিন হৃদয় আচ্ছন্ন হয়েছিলো ওর৷ মিষ্টি সংবাদের বিনিময়ে উপহার হিসেবে রাজমহলে রেখে গেছিলো গাড়িটিকে, আনাবিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় সেই উপহার আজও অনাহূত, আনাবিয়া পর্যন্ত তা আর কখনোই পৌঁছেনি।
যদিও এই অদ্ভুত মেয়েলি রঙের গাড়িটিতে উঠে মীরের পৌরুষে অনর্গল গুতো লাগছে কিন্তু এখন আর কোনো উপায় নেই৷ গুতো গুলোকে হজম করে দ্রুত বেগে মহাসড়ক ছেড়ে সে এগোলো শহরের ব্যস্ত অংশের দিকে।

রাতের এখন শেষ প্রহর। বুক ক্যাফের ভেতরে এখনো বাতি জ্বলছে কোথাও কোথাও। টেবিলের ওপর হাত ঠেকিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ পাশে রেখে বই আর নোটবুকে মনোযোগ সকলের। কারো কারো ডেস্কের ওপর মেলে রাখা ল্যাপটপ, চোখে ঘুম। ক্ষনে ক্ষনে বইয়ের পাতা ওল্টানোর আর কলমের খসখসানির শব্দ ভেসে আসছে নীরবতার ভেতর দিয়ে।
এক কোণের একটি টেবিলে বসে আছে একজন মধ্যবয়সী সুপুরুষ। চোখের সামনে খুলে রাখা মোটা মলাটের একটা বই, পূর্ণ মনোযোগ তার বইয়ের ওপর।

পড়তে পড়তে কফির মগে চুমুক দিতেই কপাল কুচকে ফেললো সে, কিছু দূরের ক্যাফেটেরিয়াতে বসে ঝিমোতে থাকা ছেলেটাকে ডাক দিয়ে এক কাপ গরম কফি দিতে বলে আবারও বইয়ে মনোযোগ দিলো সে।
সেই মুহুর্তেই ক্যাফের দরজা ঠেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকলো কালো রঙা লং কোটে মোড়া এক রাজসিক অবয়ব। মুখখানা আবৃত একটি উলের তৈরি নেক গেইটারে। চোখ জোড়া ঢাকা পড়ে আছে কালো হুডের আড়ালে।
মাত্রই কফি অর্ডার করা লোকটি আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মতোন চমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ! আগন্তুক মেঝের দিক থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে তাকালো লোকটির পানে, অবিলম্বে দৃষ্টিগোচর হলো আগন্তুকের স্বর্ণাভ চক্ষুদ্বয়।
লোকটির চোখ কপালে উঠে গেলো মুহুর্তেই! ভয়ে, বিস্ময়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নিরবতার ভেতর হঠাৎ শব্দ হওয়ায় সকলেই বিরক্তি নিয়ে তাকালো লোকটির পানে, সাথে সাথে তাদের চোখ গেলো কালো পোশাকে আবৃত আগন্তুকের দিকে। আগন্তুক চোখ নামিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।
মধ্যবয়সী লোকটি বিস্মিত চোখে চেয়ে ঠোঁট আলগা করে উচ্চারণ করতে গেলো,

“ইয়োর ম-”
কিন্তু তার সম্বোধনের আগেই হুডিতে ঢাকা দীর্ঘ অবয়বটি তার দৃঢ় হাত উঠিয়ে নেক গেইটারের ওপর দিয়ে তর্জনী চেপে ধরলো ঠোঁটের ওপর। তার আদেশপূর্ণ ইশারার তীব্রতায় লোকটা হকচকিয়ে চুপ হয়ে গেলো সাথে সাথেই। হঠাৎ উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করলো তার, নিজেই শুনতে শুরু করলো নিজের হৃদ স্পন্দন। তীব্র শীতের মাঝেও কপালে দেখা দিলো বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা।
সেই মুহুর্তেই ক্যাফের মালিক ওপর তলা হতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো নিচে। এসেই ঘুম জড়ানো গলায় তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

“বুক ক্যাফে আজ এখনি বন্ধ হয়ে যাবে, পাঁচ মিনিটের ভেতর সবাই সবার জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাফে খালি করে দিন।”
স্টুডেন্ট যারা ছিলো বেশিরভাগেরই সামনে ফাইনাল এক্সাম। তাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই শহরে বেশ অনেকগুলো বুক ক্যাফে করা হয়েছে, সেগুলো সারা রাতই খোলা থাকে। আজ হঠাৎ তিনটে বাজতে না বাজতেই বেরিয়ে যেতে বলায় তারা একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু মাত্রই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকা সুদীর্ঘ ব্যাক্তিটির এই নিরব উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করলো তারা, নিজেদের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো তৎক্ষণাৎ।
সকলে বেরিয়ে যেতেই ক্যাফের মালিক মীরের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে মাথা নত করে আনুগত্য জানিয়ে আবারও উঠে গেলো সিঁড়ি বেয়ে৷

মধ্যবয়সী লোকটি নিজের বিস্ময় কাটিয়ে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো, মীর ধীর গতির লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বসলো অন্য একটি চেয়ারে, লোকটিকে আঙুলের ইশারায় বসতে বলল নিজের বিপরীতে। লোকটি তৎক্ষনাৎ আরেকটি চেয়ার টেনে এনে বসে পড়লো মীরের মুখোমুখি। মীর মাথার ওপর থেকে হুড সরিয়ে দিলো, দৃষ্টি গোচর হলো ওর ঘাড় বাবরি ঝাকড়া, গাঁঢ় ছাই রঙা চুল। টেনে নামিয়ে দিলো নেক গেইটার টা।
“এখানে কি করছো তুমি, নাহিয়ান? তোমার তো ওয়ারদিচায় থাকার কথা।”
বলল মীর। নাহিয়ান নামক লোকটি এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে ছিলো মীরের মুখপানে। চোখের সামনে এতদিনের মৃত মানুষটিকে জীবিত দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার, অলৌকিক জগতের ভয়ও কাজ করছে ভেতরে ভেতরে!
মীরের প্রশ্নে ভয় কাটিয়ে নত চোখে ইতস্তত করে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, ওয়ারদিচার কন্ট্রোলার পদ থেকে শেহজাদা ইলহান আমাকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে আমি নিজের বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু নতুন কন্ট্রোলার সেবাস্টিন সম্প্রতি আমার বাসা দখল করে নিয়েছে। ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে আমি এখন এখানেই থাকছি, ফারিশের একটা ফার্ম হাউজ ও আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে, ইয়োর ম্যাজেস্টি।”

ফারিশের নাম শোনা মাত্রই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মীরের। জিজ্ঞেস করলো,
“ফারিশ এখন কি করছে?”
“সে এখন ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টে টিচার হিসেবে আছে, সাথে একটা ফাইভ স্টার হোটেলের য়্যোনার। এই তো বাদিকেই ফারিশা লিউক্স নামের যে তেরোতলা হোটেলটা চকচক করছে ওটা ওর। নওয়াস ভাইজান মারা যাবার পর আগের বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, সেটা সেল করে দিয়ে শহরের পশ্চিমের দিকে চলে গিয়েছে পরিবার সহ।”
“সে কি সম্প্রতি শিরো মিদোরিতে গিয়েছিলো?”
“ইয়েস ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী লাইফ ট্রি থেকে ফিরে এসেছেন শুনে সে গিয়েছিলো। বাচ্চা মেয়ে দুটোকে নিয়ে তারপর থেকে মাঝে মাঝেই যেতো শুনেছি।”

মীরের দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠলো ক্রমশ। ক্রোধটা এখনের মতো সংবরণ করে জিজ্ঞেস করলো,
“নওয়াস জাবিন কবে মারা গেছে? দাফন কোথায় করা হয়েছে?”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, নওয়াস আর জায়ান ভাইজান কবে মারা গেছেন বা তাদেরকে কোথায় দাফন করা হয়েছে কেউ জানেনা। ক্ষমতায় যাবার পর শেহজাদা ইলহান তাদের দুজনকেই কন্ট্রোলার পদ থেকে সরিয়ে সৈন্য দিয়ে এক প্রকার টেনে হিচড়ে শিরো মিদোরিতে নিয়ে যান, তারপর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ফারিশ আর জাভেদেরা অনেক চেষ্টা করেছে তাদের খোঁজ পাওয়ার, কিন্তু কোনোভাবেই তাদেরকে পাওয়া যায়নি। এরপর একদিন খবর এসেছিলো শেহজাদা ইলহান কারাগার থেকে অনেক বেওয়ারিশ লাশ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছেন, নাবিকদের যারা দেখেছিলো তাদের কেউ কেউ বলেছিলো ওই লাশের ভিড়ে নওয়াস আর জায়ান ভাইজানের ডেডবডিও ছিলো। তারপর থেকে ওরা দুজনেই আশা ছেড়ে দিয়েছে।”

মীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা, নিরব কামরার ভেতর ওর দীর্ঘশ্বাসকে জঙ্গলের শুকনো পাতা যুক্ত গাছের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া হঠাৎ বাতাসের শব্দের মতোই শোনালো। নাহিয়ানের সাথে এরপর মীরের কথা হলো ভোরের আলোতে পূব আকাশে লালিমা লেপন হওয়া পর্যন্ত। তারপর দুজনেই বেরিয়ে পড়লো নিজেদের গন্তব্যে।

রেড জোনের ভেতর অ্যানিম্যাল টাউন হতে কয়েক ক্রোশ দূরে জোভির বাসা। মসভেইল হতে খুব বেশি দূর নয়। মীর বাচ্চাগুলোকে মহল থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকে সকলে মিলে জোভির বাসায় উঠেছে। লিও লিন্ডারা এতদিন সমুদ্র পাড়ের লাইট হাউজে ছিলো, ওরা এসেছে আজ কয়েকদিন। সকলে মিলে জোভির বাড়িটিকে এখন মাথায় তুলে রেখেছে। এতগুলো চাচ্চু আর ফুপ্পিদের মাঝে জোভির ছেলেটা মহানন্দে বড় হচ্ছে, সাথে দুষ্টুও হচ্ছে সমান তালে।

কোকো ছেলেটির নীল চোখ দেখে তাকে ব্লু বলে ডাকতো, এখন চাচ্চুর দেওয়া নামই তার অফিসিয়াল নাম হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে ব্লু চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে কোকোর কাঁধের ওপর। কোকোরা সকলে মিলে রোবটের মতোন বসে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছে। টানটান উত্তেজনা চলছে খেলায়, এক সেকেন্ডের জন্য চোখ সরালেই ক্লাইম্যাক্স মিস হয়ে যাবে৷ মেয়ে গুলো মিলে পাশের ঘরে বসে লিন্ডার প্রেমকাহিনী শুনতে ব্যাস্ত। শুধু রেক্সা নেই সেখানে। সে এই ভোর সকালে গেছে জঙ্গলে ঘুরতে।
বিরোধী দলের প্লেয়ার যখন এক লাথিতে ফুটবলটিকে গোলপোস্টের ভেতরে দিতে যাবে সেই মুহুর্তেই কোকোর কান খাড়া হলো কারো খিলখিলে হাসির ক্ষীণ আওয়াজে। তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে, ওদিকে গোল হলো কিনা সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করলোনা।
তাকাতেই তার চোখে পড়লো দূরে রেক্সা কারো সাথে সানন্দে গল্প করতে করতে এদিকেই আসছে। সেই ‘কারো’ টা একটা ছেলে, হৃষ্টপুষ্ট ছেলে।
কোকোর মেজাজ বিগড়ে গেল তৎক্ষনাৎ৷ দাঁত কিড়মিড় করে সে পাশে থাকা ফ্যালকনকে গুতো মেরে জিজ্ঞেস করলো,

“ওই ছেলেটা কে রে?”
“ওইটা কিমালেবের প্লেয়ার, ওর নাম জোনাস, পিঠে লেখা আছে দেখো না?”
টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা ফ্যালকন উত্তর দিলো। কোকো ওর পিঠে একটা বোম ফেলে গজগজ করতে করতে বলল,
“হাঁসের বাচ্চা, ওই প্লেয়ারকে আমি চিনিনা? আমি ভাতের হোটেলের সাথের ছেলেটার কথা জিজ্ঞেস করছি।”
কোকোর হাতির মতো হাতের থাবড়া খেয়ে ফ্যালকন টানা হয়ে গেলো। চোখ কুচকে জঙ্গলের দিকে তাকালো সে। ছেলেটাকে দেখেই বলল,
“তোমাদের গ্রুপের লোক আর তুমি চিনোনা? ওইটা ওইযে জর্জ নামের যে হাতির মতো কুমিরটা আছে ওর বড় ছেলে মার্লো।”

কোকো কিছুক্ষণ কুমিরিয়ান চোখে মার্লো ছেলেটাকে দেখলো। দাঁত কেলিয়ে বাঁচছে না! মেয়ে দেখলেই এদের চ্যাগাইয়া পড়তে মন চায়।
কোকো দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ভাতের হোটেলের সাথে ওর কিসের এত কথা? এত হাসাহাসির কি আছে এখানে? আর এই ভাতের হোটেলটাকে আমি সস্তা বলি ঠিকই বলি। বেয়াদব মাইয়া!”
“তুমি এত ক্ষেপছো কেন?”
“ক্ষেপবোনা? ও আমাদের সাথে থাকে মানে ও আমাদের গ্রুপের। আমাদের গ্রুপের মেয়েরা কেউ বাইরের কারো সাথে কথা বলে না, ও কেন বলবে? আর তাছাড়া আমি তোদের সিনিয়র, আম্মা না থাকলে তোদের সবার দায়িত্ব আমার ওপর৷ তাই ভালো মন্দ কোথায় কি হচ্ছে সেগুলো আমাকেই দেখতে হবে৷”
নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল কোকো। ফ্যালকন এতক্ষণ কৌতুকপূর্ণ চোখে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিলো। বলল,
“দায়িত্ব একটু বেশি বেশি পালন করছো দেখি আজকাল! কি ব্যাপ্পারররররর?”
ভ্রু নাচালো ফ্যালকন দুবার। কোকো ওর দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালো পরক্ষণেই। তারপর সোজা এগোলো রেক্সাদের দিকে।

ফ্যালকন ওকে এভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে দেখে পাশের লিওকে গুতিয়ে গুতিয়ে বলল,
“এরে এরে, রোমিও ক্ষেপে গেছেরে। উঠ, ভাবীকে উদ্ধার করতে ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে৷ তাত্তারি।”
ফ্যালকনের কথায় সবগুলো উঁকি মেরে দেখলো বাইরে, তারপর ফুটবলের পিন্ডি চটকিয়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো হলরুম থেকে।
রেক্সা মার্লো ছেলেটিকে বিদায় জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো, হঠাৎ সেখানে লম্বা লম্বা পা ফেলে উদয় হলো কোকো। রেক্সার পাশে দাঁড়িয়ে বাকা চোখে তাকালো মার্লোর দিকে।
রেক্সা ওকে আচমকা সামনে দেখে চমকালো। মার্লো ছেলেটা ভড়কে গেলো হঠাৎ। রেড জোনে কোকো নামক ছেলেটার সুখ্যাতি জানতে কারো বাকি নেই। চোখের সামনে এই টেরোরিস্টকে দেখে মার্লো কোনদিকে পালাবে বুঝতে পারলো না, ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা পায়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
কোকো ঠান্ডা স্বরে বলল,

“মার্লো, সমুদ্র পাড় ছেড়ে এদিকে কি তোমার? অবেলায় এসব দিকে আসবে না, শেষে আর বাড়িতে ফিরলে না পারলে তোমার বুড়ো বাপকে কে সামলাবে বলো? এখনি এই রেড জোন ছেড়ে গেটাউট হয়ে যাও। এদিকে যেন তোমাকে আর না দেখি। শুধু তুমি নয়, কাউকেই যেন না দেখি।”
শেষোক্ত বাক্যদুটো রেক্সার মাথার ওপর তাকিয়ে বলল কোকো। মার্লো যা বোঝার বুঝে গেলো, বুজে আসা গলায় নিজেকে রক্ষা করতে কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে নিবে তখনি কোকোর পেছনে এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো বাকি বাচ্চারা। এই শীতেও সবার উদোম শরীর, পরণে শুধু ট্রাউজার৷
জোভির হাতে একটা হকিস্টিক, কাঞ্জির কাধে একটা কুড়াল। নেওয়ার মতো কিছু পাচ্ছিলোনা, বাইরে কুড়ালটাকে দেখে তুলে নিয়ে এসেছে। সবার হাতেই কিছু না কিছু, শুধু ফ্যালকনের হাতে একটা চামচ, তাড়াহুড়োয় এটা তুলে নিয়েই চলে এসেছে সে। সেটাকে দ্রুত পেছনে লুকিয়ে রাখলো, নইলে কোকো দেখলে মারবে নির্ঘাত৷
মার্লো হকিস্টিক দেখার পর যেটুকু শক্ত ছিলো কুড়াল দেখে তার হাওয়া বেরিয়ে গেলো সম্পুর্ন। সে একটা শুকনো ঢোক গিলে কোনো রকমে বলল,

“ক্ষ-ক্ষমা করবেন কোকো ভাইজান, এমন ভুল আর হবে না। আমি এখনি চলে যাচ্ছি, আর কোনোদিন এদিকে আসবোনা, কাউকে আসতেও দিবোনা৷”
আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালোনা মার্লো। উল্টোদিকে ফিরে কয়েক কদম হেটে গিয়েই ছুটে গাছগাছালির ভেতর হারিয়ে গেলো।
কোকো এবার ফিরলো রেক্সার দিকে। ও রেক্সার দিকে ফেরা মাত্রই সবগুলো বিদ্যুৎ গতিতে পেছন ফিরে সোজা এগোলো বাড়ির দিকে৷
রেক্সা এতক্ষণ হতভম্বের মতোন দাঁড়িয়ে সবার কর্মকাণ্ড দেখছিলো। কোকোকে এভাবে তাকাতে দেখে সে দমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কি?”
“এমনিতেই সবাই জানে তুমি সস্তা ভাতের হোটেল, এখন এমন কিছু কোরোনা যাতে সস্তার আগে এবার মাইনাস ডিগ্রি বসা শুরু করে।”
“সস্তার আগে মাইনাস বসা শুরু করলে কি আমি দামী হয়ে যাবো?”
নিষ্পাপ মুখে জিজ্ঞেস করলো রেক্সা৷ কোকো কিছুক্ষণ ওর দিকে কুমিরিয়ান চোখে তাকিয়ে থেকে ধমক দিয়ে বলল,
“ভেতরে যাও!”
ধমক খেয়ে লাফিয়ে উঠে রেক্সা ছুটে চলে গেলো বাড়ির ভেতরে৷

দ্রুত পায়ে হেটে চলেছে কোকো। মেজাজ ওর বিগড়ে আছে। মনে চাইছে রেক্সার কানের বারান্দায় একটা থাপ্পড় দিতে, দাঁত কেলিয়ে গল্প করা বের করে দিতে।
কিন্তু মেয়ে লোকের গায়ে হাত ওঠানো কাপুরুষতা। আপাতত মর্নিং ওয়াক করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টায় আছে সে।
সামনেই অর্কিড বাগান।

সেখানে চিরশয্যায় শায়িত ওদের শেহজাদা, হিজ ম্যাজেস্টি আর ওর আম্মার নিখাঁদ ভালোবাসার ফসল, এক মুঠো নিষ্পাপ মাংসপিণ্ড! বাচ্চাটা জন্মালে আজ কত বড় হয়ে যেতো! এতদিনে নিশ্চয় কবুতরের মতো বকম বকম করার মতো বয়স হয়ে যেতো তার?
শেহজাদীর মতোন দুষ্টুমিতে ভরা হতো? নাকি হিজ ম্যাজেস্টির মতোন গম্ভীর, দৃঢ় দর্শন হতো? যদি গম্ভীর দর্শন হতো তবে নিশ্চয় ওর সামনে এসে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ভীষণ গুরুতর ভাব নিয়ে বলত,

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৯

“কোকো ভাইয়া, আমি আদেশ করছি এখুনি আমাকে আম্মাজানের কাছে নিয়ে চলো, নইলে তোমার গর্দান নিবো!”
অসম্ভাব্য জীবন কল্পনার এই মিষ্টি মুহুর্ত ভেবে হাসলো কোকো। এগিয়ে গেলো অর্কিড বাগানের দিকে। শেহজাদার কবরটা একটু দেখে আসবে।
কিছুদূর এগোতেই কোকোর চোখে পড়লো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কেউ, চুপচাপ, নত মুখ, দৃঢ় হাত খানা বুলিয়ে চলেছে কবরের ওপর ফুটে থাকা তাজা লাল গোলাপটিতে…..

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here