Death or Alive part 11
priyanka hawlader
এক সুন্দর, অথচ অদ্ভুত বিষণ্ণ বিকেল
আকাশের গায়ে লেগে থাকা রোদ্দুরটা আজ একটু বেশি কোমল, একটু বেশি সোনালি। মধুপুরের বাতাসে হালকা কদমফুলের ঘ্রাণ মিশে আছে। রাস্তায় সন্ধ্যার আলো নেমে আসার আগে একরকম সোনালি নীরবতা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ঠিক এমন এক মন কেমন করা বিকেলে ক্যালিয়ন এসে দাঁড়িয়েছে অর্ষার বাড়ির সামনে।
তাঁর চোখে চিন্তার ছায়া, ঠোঁটে অনিশ্চয়তার রেখা। হাতের ফোনটা বারবার কানে তুলছেন, আবার নামিয়ে নিচ্ছেন।
বারংবার চেষ্টা করেও ওপাশ থেকে একটিই বার্তা ভেসে আসছে— “The number you are trying to call is currently switched off.”
ক্যালিয়নের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো গভীর হয়। এতদিন পর, এভাবে হঠাৎ করে অর্ষার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া— এটা কিছুতেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না তাঁর কাছে।
চোখটা একবার অর্ষার বন্ধ জানালার দিকে চলে যায়। সবকিছু যেন থমকে আছে— না কোনো শব্দ, না কোনো সাড়া। সবকিছু নিঃস্তব্ধ।
তিনি তখনই নিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ড্যানিয়েলকে ফোন করে বলেন,
ড্যানিয়েল, আমি চিন্তায় পড়ে গেছি। অর্ষার ফোন বন্ধ। তুমি এক্ষুনি খোঁজ লাগাও, সে কোথায় আছে।”
ড্যানিয়েল দেরি না করে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর দ্রুত ফিরে এসে ক্যালিয়নের সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার মুখ গম্ভীর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লর্ড ক্যালিয়ন,” ড্যানিয়েল ধীরে বলে, “খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, আজ সকালে অর্ষা ম্যাডাম তাঁর বাবা-মাকে শুধুমাত্র একটি মেসেজ করে যান। সেখানে লেখা ছিল— তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ক্যাম্পে যাচ্ছেন এবং যোগাযোগ হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে।
ক্যালিয়নের চোখ এক লহমায় আরও কঠিন হয়।
তুমি কি জেনেছো, কোন ক্যাম্প? কোথায়?”
জি স্যার, ক্যাম্পটি নাকি বহু দূরের এক গ্রামাঞ্চলে। এমন এক জায়গায় যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না। শুনেছি এটা নাকি বহু আগেই ঠিক করা ছিল। তাঁর ডাক্তারি প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে তিনি এক বছরের জন্য ঐ ক্যাম্পে যাবেন— এমনটাই পরিকল্পনা ছিল।
এক বছরের জন্য?
এই কথাটা ক্যালিয়নের হৃদয়ে যেন ছুরি চালিয়ে দেয়।
সে কি তবে তাকে না জানিয়েই চলে গেলো? এভাবে?
আকাশটা হঠাৎ যেন আরও বেশি ফাঁকা লাগে ক্যালিয়নের কাছে। সেই সোনালি বিকেলটা যেন হঠাৎ ম্লান হয়ে যায় তাঁর চোখে।
তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। বাতাসে এখন আর কদমফুলের গন্ধ নেই, বরং এক বিষণ্ণ নির্জনতা মিশে গেছে। ক্যালিয়নের চোখে এবার আর আগুন নেই, আছে এক অজানা ভয়, এক চুপ চাপ প্রতিজ্ঞা—
“আমি তোমায় খুঁজে পাবো, অর্ষা। তুমি কোথায় লুকিয়ে থাকো না কেন— আমি আসবো। আর এবার… তোমার ফেরা আমার নিয়ন্ত্রণেই হবে।
তার চোখের সামনে তখনো অর্ষার হাসিমুখটা ভাসছে। সেই মুখ, যে মুখ একদিন তার হৃদয়ের অন্ধকারে আলো জ্বেলে দিয়েছিল—তাকে আবার একবার ফিরে পাওয়ার আশায় সে ভেসে গিয়েছিল সময়ের স্রোতে। কিন্তু ফিরে এসে কী পেল? এক ফোঁটা অপেক্ষাও করেনি অর্ষা। কি এত তাড়া ছিল তার? কী এমন ঘটেছিল যে সে আরেকটা দিন, মাত্র দুটো দিনও অপেক্ষা করতে পারল না?
চোখের কোণে জ্বালা অনুভব করে সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
“আমার জন্য কি দুটো দিন অপেক্ষা করলে খুব বেশি দেরি হয়ে যেত? কেন অপেক্ষা করলে না তুমি? দুটো দিন… মাত্র দুটো দিন!”
তার গলা ভারি হয়ে আসে। ক্ষোভে, কষ্টে, অথচ কণ্ঠে যে ব্যথা ঝরে পড়ে, তা যেন আকাশেও প্রতিধ্বনি তোলে। বাতাস থমকে দাঁড়ায়।
তারপর ধীরে ধীরে সে ড্যানিয়েলের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়, চোখদুটো আগুনে লাল হয়ে আছে। গলায় যেন বাঘের গর্জন—
“তৈরি হও, ড্যানিয়েল। আমরা যাচ্ছি। সে এখন যেখানেই থাকুক—জলবনে, পর্বতে, ক্যাম্পে কিংবা অন্য কারও পাশে—আমি তাকে খুঁজে বের করব। আমি তাকে আবার নিজের করে নেব। যেভাবেই হোক… তাকে আমি নিয়ে যাবই। আমার দুনিয়ায়, আমার ছায়ায়, আমার একচ্ছত্র শাসনে।”
তার কণ্ঠে সেই অন্ধকার ভালোবাসার গম্ভীর প্রতিধ্বনি, যার কোনো যুক্তি নেই, শুধু তীব্র মালিকানা আছে। অর্ষা তার হয়েছে—এটা সে বিশ্বাস করে না, সে জানে। আর সেই জানার দাবিতে, এক অদৃশ্য পণ করে সে পা বাড়ায় আগুনের পথে।
এখন শুধু শুরু—যুদ্ধের, ভালোবাসার, আর অধিকার প্রতিষ্ঠার।
নিশ্ছিদ্র নীরবতা ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিল। চারপাশে যেন একটা মৃত গম্ভীরতা ভর করে আছে, যেখানে সময় থেমে গেছে। অর্ষা বসে ছিল এক কোণে, আলোহীন সেই অচেনা ঘরের ধুসর দেওয়ালের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে। চোখজোড়া ক্লান্ত, তবু তীব্র জিজ্ঞাসায় ভরা। হঠাৎ করেই সে শব্দ শুনতে পেল—ধীরে ধীরে খোলা দরজার শব্দ।
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল এক মহিলা, বয়স বোঝা যায় না, তবে তার চলনে ছিল রাজকীয় প্রশান্তি। তার হাতে ধরা এক রূপার তৈরি খাবারের ট্রে, যার উপর নানা রকম সুস্বাদু রাজভোজের আয়োজন। মিষ্টির সুবাস আর মাংসের ঝাল গন্ধ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত মোহ তৈরি করছিল বাতাসে। কিন্তু অর্ষার চোখ সেই খাবারের উপর ছিল না। তার দৃষ্টি ছিল খোলা দরজার দিকে।
এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে সে ছুটে উঠে দাঁড়াল। যেন মুক্তির একমাত্র পথ এই দরজা। বুকের ভিতর ভীষণ রকমের একটা তাড়না—“এখন না হলে আর কখনো নয়!” সে দৌড় দিল, প্রাণপণে ছুটে গেল দরজার দিকে। এক পা, দু’পা, তিন… দরজা থেকে মাত্র হাত তিনেক দূরে—
হঠাৎ এক বিকট ঝটকা! যেন পুরো শরীরে হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ একসাথে খেলে গেল।
“আআহ!” — তীব্র আর্তচিৎকারে সে ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে। পুরো শরীর জমে আসে, বুকের ভেতর হিম শীতল এক আতঙ্ক বয়ে যায়।
সে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকলেও অবচেতনভাবে হাত দিয়ে দরজার চারপাশটা খোঁজে। কোথাও তো কোনও তার নেই! কোথাও তো কোনও বৈদ্যুতিক যন্ত্রও নেই! তাহলে এভাবে ঝটকা খেলো কী করে?
ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখে—দরজাটা এখনও খোলা, তবে অদৃশ্য কোনও শক্তি যেন সেই সীমারেখায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। বাইরে বের হওয়ার চেষ্টাকে যেন শাস্তি হিসেবে ফিরিয়ে দিয়েছে।
সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। মুখে বিস্ময়, চোখে ভয়, আর হৃদয়ে জমে ওঠা এক নতুন প্রশ্ন—
এই বাড়িটা কি কেবল তার বন্দিত্ব নয়, বরং এক ভয়ংকর রহস্যে ঘেরা এক জীবন্ত খাঁচা?
অর্ষা পড়ে যাওয়া দেখে সে মহিলা খাবারটা টেবিলের উপর রেখে এরপর অর্ষার সামনে যায়। কিন্তু রহস্যময়ী এক মহিলা। মুখে একরাশ ক্লান্তি আর চোখে ছিল গভীর কোনো ব্যথার ছাপ।
মহিলাটি তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,
— “মা, তুমি চাইলেও বাদশার অনুমতি ছাড়া এই জায়গা থেকে এক পা-ও নড়তে পারবে না। তোমার সব কিছু এখন ওর হাতে।
অর্ষা হতবাক। ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল,
কে… কে এই বাদশা? আপনি বলছেন ওর অনুমতি ছাড়া আমি এখান থেকে বেরোতে পারবো না? কেন? আমাকে এখানে কেন আটকে রাখা হয়েছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
তার চোখ দুটো ছলছল করছিল, কণ্ঠে অসহায়তা।
অর্ষার হাত ধরে মহিলা ধীরে ধীরে তাকে খাটে বসালেন। চারপাশের অদ্ভুত দেয়াল, ঘরের ছাদে ঝুলতে থাকা লাল কাপড়, আর সেই অদ্ভুত ঘ্রাণ… সবই যেন অন্য এক জগতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অর্ষা আবার বলল,
— “আপনিই বা কে? আপনি কেন এখানে আছেন? আর এই বাড়িটা এমন অদ্ভুত কেন? এটা তো কোনো সাধারণ বাড়ি নয়! চারদিকে শুধু অন্ধকার, আর একটা পাগল লোক আমার সামনে এসে কি সব ‘কালো জাদু’ বলছিল! ও কি পাগল? দেখে তো মনে হয় না পাগল এত হ্যান্ডসাম লোক আবার পাগল হয় কিভাবে? নাকি সত্যিই এখানে কিছু ভয়ঙ্কর ঘটছে?
মহিলার মুখে তখন এক অদ্ভুত বিষণ্নতা ফুটে উঠল। তিনি যেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। অর্ষা এবার প্রায় কেঁদে ফেলে বলল,
— “দয়া করে আপনি আমাকে সবটা খুলে বলুন। আমি জানতেই চাই— কে এই বাদশা? কেন আমাকে আনা হয়েছে এখানে? আর সত্যিই যদি কিছু ভয়ঙ্কর সত্য থাকে, আমি তার মুখোমুখি হতে চাই!”
মহিলা ধীরে ধীরে মাথা নিচু করলেন। ঠোঁটে ফিসফিসে স্বর…
— “সব বলবো মা… সবই বলবো। কিন্তু আগে তুমি খাবারটা খেয়ে নাও তারপর তোমায় আমি সবটা খুলে বলবো।
অর্ষার বুকটা কেঁপে উঠল। সে ভাবে যদি খাবার খাওয়ার পর সব সত্যি সে বলে তাই জলদি করেছি খাবারটা খেয়ে নিতে থাকে। এমনি সারাদিন সে কিছু খায়নি আর শরীরও খুব ক্লান্ত খুদা আর সহ্য হচ্ছে না।
ঘরটা আবার অন্ধকার হয়ে গেল। দেয়ালে একটিমাত্র প্রদীপ নিভু নিভু আলো জ্বালিয়ে টিম টিম করছে।
অর্ষা ধীরে ধীরে শেষ করে খাবারের শেষ গ্রাসটুকু। তার শরীরের ক্লান্তি তখনো পুরোপুরি কাটেনি, কিন্তু ক্ষুধার তাড়না কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এবার সে চোখ তুলে তাকায় সেই রহস্যময় মহিলাটির দিকে, যার আচরণ আর পোশাকে যেন কোথাও অদ্ভুত এক শীতলতা মিশে আছে। তার মুখে এক গভীর রহস্যের ছায়া, চোখ দুটোও যেন অনেক কিছু দেখে ফেলা ক্লান্ত প্রহরীর মতো।
মহিলাটি চুপচাপ বসে ছিল এতক্ষণ, এবার হঠাৎই ঠোঁটের কোণে এক চাপা হাসি নিয়ে বলতে শুরু করল—
“তুমি যা দেখছো, যেখানে আছো—এই দুটোই মানুষের জগতের বাইরের কিছু।”
অর্ষা থমকে যায়। কপালে ভাঁজ পড়ে। সে যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কথাগুলো কতটা সিরিয়াস, কতটা কল্পনার মতো।
মহিলা আবারও বলে উঠলো, কণ্ঠস্বরটা এবার আরও গভীর—
“এটা জ্বীনের রাজ্য। এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। আশেপাশে যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছো, যে বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছো—সবই জিনদের নিয়ন্ত্রণে। আর তুমি এখন যে জায়গায় আছো, সেটা আরব আর ইরানের মধ্যবর্তী কোহে কাফ পাহাড়ের ওপর। এটা এমন এক স্থান, যেখানে কোনো মানুষ চাইলেও প্রবেশ করতে পারে না। আর যদি ভাগ্যক্রমে কেউ ঢুকেও পড়ে, তাহলে সে জীবিত পৃথিবীতে আর ফিরে যেতে পারে না।”
অর্ষার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
মহিলা থেমে যায় না, বরং ধীরে ধীরে কথাগুলো আরো ঘনীভূত হয়—
“এই পাহাড় বহু শতাব্দী ধরে মানুষের চোখের আড়ালে। বহু অভিযাত্রী, বহু গবেষক চেয়েছিল এটা খুঁজে পেতে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেছিল এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সত্যি বলতে কী—এই জায়গা শুধু তাদের চোখে ধরা পড়ে, যাদেরকে জিনেরা অ নিজেরা বেছে নেয়।
অর্ষা শ্বাস নিতে ভুলে যায় যেন। নিজের শরীরটাকে হালকা হালকা ভারী মনে হয়, মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে।
“আর তোমাকে যে এখানে তুলে এনেছে,” মহিলা এবার গলা নামিয়ে বলে, “সে এই রাজ্যের একমাত্র শাসক। জীনদের বাদশা—ওয়াজফান কায়স্থ।
এই নামটা শুনে অর্ষার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তার মনটা কেমন যেন আলোড়িত হয়ে ওঠে। ওয়াজফান! সেই যে… সেই রাতে, অন্ধকার মাঠে দেখা সেই লাল মনি চোখের মানুষটা? সেই কি তবে জিন?
তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে বিশ্বাস করতে পারে না সে এসব শুনছে, কিংবা এখন যেখানে বসে আছে তা সত্যিই কোনো অলৌকিক জগত।
একটা জিন!—অর্ষা নিজের মনেই বলে ওঠে নিঃশব্দে।
সে অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের দোলাচলে দুলতে থাকে। যেন তার চারপাশের বাস্তবতা ভেঙে পড়েছে, আর তার নিচে চাপা পড়ছে তার চেনা পৃথিবীটা। একটানা শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, সে যেন একটা অলীক স্বপ্নের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, যার বাস্তবতা খুব বেশি ভয়ংকর, আর পালানোর পথ নেই।
তার মনের ভিতরে হাজারো প্রশ্ন, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বের হয় না।
অর্ষার বুকটা যেন ধক ধক করতে থাকে। একটা অজানা ভয়, একটা অদ্ভুত অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে সাহস করে জিজ্ঞেস করে—
আপনি নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছেন, তাই না? এসব গপ্পো বানানো… মানুষ এখানে আসতে না পারলে আপনি কীভাবে এলেন? আর আমি কেন এখানে আটকে?”
তার গলা কাঁপছে, চোখে অশ্রু জমে আছে।
— “আর… ঐ লোকটা যদি সত্যিই জিনের বাদশা হয়, তাহলে সে কেন আমায় বন্দি করে রেখেছে এখানে? আমি তো কোনো অপরাধ করিনি!”
মহিলার মুখটা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখের কোণে জমে ওঠে এক পশলা পুরনো কষ্টের রেখা। তারপর ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন—
আমি জানি না… আমি সত্যিই জানি না কেন তোর মতো একটা মানুষি মেয়েকে এখানে আনা হয়েছে। কিন্তু তুই তো জানিস না মা, এই জায়গাটা বাইরের জগৎ থেকে কত আলাদা, কত অন্ধকার…”
তার কণ্ঠে যেন ক্লান্তি আর শূন্যতা একসাথে।
অনেক বছর আগে… তখন আমাদের রাজ্যের বাদশা ছিল ওয়াজফানের বাবা। খুব বিচক্ষণ, মমতাময় একজন শাসক ছিলেন তিনি। একদিন মানুষের জগতে গিয়েছিলেন কোনো এক বিশেষ কাজে। আর সেই সময়েই আমার জীবনের সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়।”
অর্ষা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মহিলার দিকে।
আমি তখন একজন সাধারণ গৃহিণী ছিলাম, মা… আমার স্বামী ছিল, সন্তান ছিল… কিন্তু হঠাৎ আমার স্বামী মৃত্যু হয়ে যায় তারপর আমার নিজের পরিবার আমায় বের করে দেয়। আমার ছেলে-মেয়েরা আমায় অস্বীকার করে… আমি হয়ে যাই একাকী, পরিত্যক্ত।আমি নাকি তাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম। কেউ কথা বলতো না আমার সঙ্গে, কেউ খোঁজ নিতো না। তখনই তিনি, মানে বাদশা, দয়া করে আমাকে তার সঙ্গে এই রাজ্যে নিয়ে আসেন।
এখানে এসে আমি পেলাম একটুখানি আশ্রয়, আর একটা দায়িত্ব— রান্নাঘরের দায়িত্ব। এই অন্ধকার রাজ্যের প্রতিটি জিনের খাদ্য আমার হাতে তৈরি হয়… যেন রান্নার ধোঁয়ার মধ্যে আমি নিজের কষ্টগুলো গলিয়ে দিতে পারি।”
অর্ষা নিঃশব্দে শুনতে থাকে। চোখ বড় বড় করে।
“কিন্তু…” — মহিলা থেমে যায় কিছুক্ষণ, তারপর আবার বলে ওঠে —
“তাঁর ছেলে, মানে ওয়াজফান… সে কখনো আমায় গ্রহণ করেনি। সে মানুষদের ঘৃণা করে, মা। ভয়ঙ্করভাবে ঘৃণা করে। সে তো নিজেই বলেছে, মানুষ হলো বিশ্বাসঘাতক, স্বার্থপর, হিংস্র। তার মতে মানুষ ভালোবাসে না, শুধু ব্যবহার করে। তাই সে কখনোই চায়নি আমি এখানে থাকি, কারণ আমি তো একজন মানুষই।
অর্ষার মনে পড়ে ওয়াজফানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আগুনের মতো রাগ। সে গিলে ফেলে নিজের গলার কাঁটা।
তাহলে সে আমায় এখানে এনেছে কেন? অর্ষার প্রশ্নটা যেন শূন্যে ঝুলে থাকে।
মহিলা মাথা নাড়ে।
সেটা আমি জানি না। ওয়াজফান কারও কথা শোনে না, এমনকি তার বাবারও নয়। তবুও তখন তার বাবা বলেছিল— ‘একটা ছায়া থাকুক প্রাসাদে, রান্নাঘরে যেন মানুষের হাতের স্পর্শ থেকে যায়।’ আর সে কথা রেখেই আমি এখানে রইলাম। কিন্তু তোর ব্যাপারে কিছুই আমি জানি না, মা। এতদিনে তো জেনে গেছি— এই রাজ্যে কিছুই এমনি এমনি ঘটে না…”
তার কণ্ঠটা যেন ভার হয়ে আসে।
অর্ষার চোখ ছলছল করে উঠে।
তাহলে আমি কীভাবে ফিরবো? আমি কী কখনো ফিরে যেতে পারবো?
মহিলা তার হাত ধরে।
সব প্রশ্নের উত্তর এখুনি পাবি না, মা। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস— তোর মধ্যে কিছু আছে… যা এই অন্ধকার রাজ্যকেও আলো দেখাতে পারে। কিন্তু সেই আলো জ্বালাতে হলে তোর ভয়কে জয় করতে হবে।
তার চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি।
আর ওয়াজফান… সে তো এক রহস্য নিজেই। হয়তো সে তোর জন্যই অপেক্ষা করছিল। না হলে এই নিষ্ঠুর বাদশা এত বছর পর একজন মানুষকে হঠাৎ করে এনে বন্দি করবে কেন?”
অর্ষার ঠোঁট কাঁপে। হাজারো প্রশ্নের ভারে সে যেন দমবন্ধ হয়ে আসে।
আমি জানি না… আমি কেবল মুক্তি চাই… তার কণ্ঠ ম্লান হয়ে আসে।
তুই যদি মুক্তি চাস, তাহলে প্রথমে জানতে হবে তোর এখানে আসার আসল কারণ। আর সেটা খুঁজে পেতে হলে… তোকেই যেতে হবে ওয়াজফানের কাছে।
এরপর মহিলাটা চলে যায় নিজের কাজে আর অর্ষা ভাবতে থাকে এ কেমন চক্র সে কি কখনো বের হতে পারবে না সে তো ক্যালিয়নকে বলেছিল অপেক্ষা করবে। ক্যালিয়ন ফিরে এসে তাকে না পায় তাহলে কি হবে হঠাৎ তার নিজের ফোনের কথা মনে পড়ে এরপর সে খুঁজতে থাকে নিজের মোবাইল কিন্তু কোথাও পায়না।
একটি গভীর রাত, নিঃসঙ্গ জঙ্গলের অরণ্যপ্রান্তে…
মধুপুর গড়—বাংলার বুকের মধ্যে যেন এক অব্যক্ত রহস্য বয়ে চলা জনমানবহীন বনাঞ্চল। গাঢ় সবুজ পাতায় মোড়া সেই নিঃস্তব্ধ জঙ্গল, রাতের কালো চাদরে মোড়া হয়ে যেন আরও গা ছমছমে হয়ে উঠেছে। পাখিদের কিচিরমিচির নেই, বাতাস নেই, শুধুই গাঢ় নীরবতা। দূরে কোথাও একটা পেঁচা ডেকে ওঠে, আর জঙ্গলের গহীনে মাঝে মাঝে ভেসে আসে হিংস্র কোনো প্রাণীর রুদ্ধশ্বাস গর্জন।
সেই গর্জনের উৎস—এক অদ্ভুত প্রাণী, যার রূপ মানুষরূপী হলেও চোখের দৃষ্টিতে আছে বন্য নেকড়ের ভয়ংকর তেজ। সে ক্যালিয়ন।
সে দাঁড়িয়ে আছে মধুপুর গড়ের নিঃসঙ্গ এক প্রান্তে, যেখানে চাঁদের আলো পর্যন্ত ধরা দেয় না ঠিকঠাক। ক্যালিয়নের চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে জ্বলছে—সোনালি আগুনের মতো, রাগে ও আকুলতায়। রাতের বাতাসে তার নিশ্বাস যেন বিস্ফোরিত আগুনের মতো বেরিয়ে আসছে।
সে গর্জে উঠল। গলা ফাটানো সেই গর্জন ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গলের প্রতিটি কোণায়।
অর্ষা কোথায়! কোথায় ও গেল?”
তার কণ্ঠে কেবল রাগ নয়, ছিল ব্যথা, ছিল উদ্বেগ।
সে বারবার পায়চারি করছে, দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ, দাঁত কষে গজগজ করে বলছে,
ওর ভার্সিটি ক্যাম্প ছিল যেদিকে, আমি সেখানে গেছি। রাস্তাঘাট, টিলা, নদীপাড়—সব খুঁজি। এমনকি যেখানে ও কখনো কখনো চুপচাপ চলে যায়—সেই পুরনো বটগাছটার নিচেও গেছি। কিছু নেই। কোথাও নেই অর্ষা।
একটা কড়কড়ে শুকনো পাতায় পা পড়ে গেল তার, শব্দ হল, কিন্তু ক্যালিয়নের রাগ আর আতঙ্কে সে তা শুনেও কিছুমাত্র ভাবল না।
যে ক্যাম্পে ওর যাওয়ার কথা ছিল সেখানেও যায়নি ও তো মিথ্যে বলে কোথাও যায় না। এতটা সাহস ওর নেই। তাহলে কোথায় গেল ও? কেউ কি…”
তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তে।
সে এক ঝটকায় গাছের কাণ্ডে ঘুষি মারল—রক্ত পড়ে গেল পাথুরে গাছের গায়ে। কিন্তু সেই ব্যথাও যেন তাকে নরম করল না। বরং সেই রক্ত দেখে সে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
আমি তোমাকে খুঁজে বের করব, অর্ষা। তুমি পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। আর যদি কেউ তোমাকে কিডন্যাপ করে থাকে… তবে তার পুরো পৃথিবী জ্বালিয়ে দেব আমি।
তাঁর গর্জনে রাতের নিস্তব্ধতা থরথর করে কেঁপে উঠল।
চাঁদ ঢেকে গেল কালো মেঘে, হাওয়া শুরু হল হালকা করে। গাছের ডালপালা শব্দ করে নড়ল। পেছনে কোথাও এক পশুর হুংকার শোনা গেল। কিন্তু ক্যালিয়নের চোখ শুধু একটি মুখ কল্পনা করে অর্ষা।
তার চোখের শিরা ফুলে উঠেছে। আর গর্জন করে সে বলল,
এই অন্ধকারকে ছিঁড়ে আমি তোমাকে খুঁজে বের করব, অর্ষা। এই জঙ্গল, এই পৃথিবী, কেউও তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না!
আর সেই চিৎকার ভেদ করে রাত যেন আরও গভীর হয়ে গেল।
ক্যালিয়নের চোখে তখন আগুন জ্বলছে। তার সোনালি চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। গায়ের প্রতিটি পেশিতে টান, যেন রাগে সে নিজের আদিম নেকড়ে রূপেই ফিরে যেতে চলেছে। গর্জে উঠলো সে—
“ড্যানিয়েল! এই জঙ্গলের যত পশুপাখি আছে, সবার কাছে খবর পাঠাও! আমি জানতে চাই, অর্ষা কোথায়! এখনই, ঠিক এখনই! তাকে খুঁজে না পেলে এই জঙ্গল আর থাকবে না… আমি সবকিছু আগুনে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবো!”
ড্যানিয়েল হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেও, বুঝে যায়— এবার আর দেরি করলে চলবে না। ক্যালিয়নের ভেতরের অন্ধকার রূপ জেগে উঠছে। সে নিজের যাদুশক্তি ব্যবহার করে আকাশে হাত তোলে, মন্ত্রোচ্চারণে চারদিক থরথর করে কাঁপতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই জঙ্গলের গাছপালা কাঁপতে কাঁপতে একের পর এক পশুপাখি জড়ো হতে শুরু করে ক্যালিয়নের সামনে হরিণ, সিংহ, ভালুক, গুহাবাসী পাখি, পাহাড়ি ঈগলসব যেন জঙ্গলের নীরব সাক্ষী হয়ে হাজির।
ক্যালিয়নের তীব্র গলা কাঁপিয়ে বলে ওঠে,
“তোমাদের মধ্যে কেউ জানো অর্ষা কোথায় আছে? কেউ কি তাকে কোথাও দেখেছো? কিছু তো বলো! একটুও যদি জানো, চুপ করে থেকো না!”
সে এক এক করে পশুদের দিকে তাকিয়ে, চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে থাকে। কিন্তু সবাই হতভম্ব, হতাশ… কেউ কিছু জানে না। না, তারা অর্ষাকে কোথাও দেখেনি।
তখন ক্যালিয়ন আবার ফুঁসে ওঠে। এবার পাখিদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“তোমরা তো আকাশ চষে বেড়াও, কোথাও কি সে তোমাদের চোখে পড়েনি? অর্ষা… অথবা তার ছায়া?”
পাখিরাও একে একে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ তারা জানে অর্ষা কোথায়। তারা এবার বলতে শুরু করে,
অর্ষা কে জ্বীনের বাদশা ওয়াজফান কায়স্থ তার দুনিয়া নিয়ে গিয়েছে। রাতে অর্ষার ঘুমের মধ্যেই সে তাকে চুরি করে নিয়ে যায়।
শব্দগুলো যেন বিষাক্ত তীর হয়ে এসে বিদ্ধ করে ক্যালিয়নের হৃদয়ে। তার চোখ মুহূর্তেই রক্তবর্ণ ধারণ করে। দেহের চারপাশে জ্বলতে থাকে ঘন নীল অগ্নিশিখা। মাটির বুক কেঁপে ওঠে, বাতাসের গতি হঠাৎই থমকে যায়।পুরো জঙ্গল নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। কোথাও যেন নিঃশব্দে হাহাকার বাজে।
ক্যালিয়নের চোখ লালচে হতে থাকে। তার হাত দুটো মুঠো করা, দাঁত কিড়মিড় করছে। নিজের ভেতরে দাউ দাউ আগুনের মতো ক্রোধ জমে উঠছে। সে নিজে নিজে মনে মনে ভাবে, অর্ষাকে ওয়াকফান কেনো ওর রাজ্যে নিয়ে যেতে পরে।
কিন্তু ঠিক পর মুহূর্তেই আবার তার ঠোঁটের কোণে হালকা একটা কৌতূহল ফুটে ওঠে, কিন্তু রাগ চাপা পড়ে না। সে গর্জন করে বলে—
“যেখানেই থাকো তুমি, অর্ষা, আমি আসছি… এই দুনিয়ার সমস্ত নিয়ম ভেঙে আমি তোমাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনব।
সেই মুহূর্তে ক্যালিয়নের চোখের সামনে একটা পুরনো স্মৃতি ঝলসে ওঠে— অর্ষার হাসিমুখ, তার গলার সেই কোমল ডাকে ভরা “ক্যালিয়ন…”।
তার ভিতরের নেকড়ে চিৎকার করে ওঠে,
— “ওয়াজফান!”
একটি বাজ পরার মতো বিস্ফোরিত হয় তার অন্তর। যেন কেউ তার বুক চিরে ভালোবাসার হৃদয়খণ্ড টেনে নিয়েছে। পশু-পাখিরা একে একে সরে যায়, ক্যালিয়নের রাগ আর যন্ত্রণার তাপে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তারা।
নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে গর্জে ওঠে,
Death or Alive part 10
— “ওয়াজফান… তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস! অর্ষা আমার… আমার হৃদয়ের গভীরে বাস করে সে। তুই কী ভেবেছিস? আমি চুপ করে থাকব? রেডি থাক… আমি আসছি! তোর অন্ধকার রাজ্য আমি ছারখার করে দেব।
তার শরীর জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুনে। দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, ঠোঁটে জেদি এক উচ্চারণ,
আমার রেড ওয়াইন … আমি আসছি।
আকাশ কালো হয়ে আসে। পাহাড়ের গায়ে গর্জন তোলে বিজলি। দূরে কোথাও একা দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতাগুলোও যেন এই ঘোষণা শুনে কেঁপে ওঠে।
