Death or Alive part 12
priyanka hawlader
সকালটা যেন হঠাৎই নিজের চেহারা পাল্টে ফেলেছিল।
সূর্য উঠে ছিল ঠিকই, তবে তার আলোতে কোনো উষ্ণতা ছিল না। চারদিক কুয়াশার মতো ধোঁয়ায় ভরা, অথচ আগুন জ্বলছিল না কোথাও। আকাশের রং ছিল নীল নয়, রক্তজবার মতো লালচে—যেন কেউ রাতভর রঙ তুলিতে প্রতিশোধের প্রতিকৃতি এঁকে রেখেছে। বাতাসে গন্ধ ছিল আগুন, ধাতব রক্ত আর মৃত্যুর। যেন প্রাকৃতিক জগৎ জানিয়ে দিচ্ছিল, আজ কিছু ভয়ংকর ঘটতে চলেছে।
রাজপ্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল ক্যালিয়ন। তার নীল চোখে আগুনের হলকা, চোয়ালে ছিল জেদ, আর কণ্ঠে ছিল এক ভয়ংকর নীরবতা—যে নীরবতা ঝড়ের আগের প্রশান্তির চেয়েও বেশি ভয়ংকর।
তার কাঁধে ধাতব বর্ম, হাতে এক ভয়াল তলোয়ার যার ধার এত তীক্ষ্ণ যে বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণেই সুর তোলে। পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল অসংখ্য যোদ্ধা, পশু ও জিন সেনারা। তাদের চোখেও ছিল একই আগুন—প্রতিশোধ আর বিজয়ের শপথ।
হঠাৎ ক্যালিয়ন আকাশমুখী হয়ে গর্জে উঠল—
ওয়াজফান কায়স্থ! তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস! অর্ষা আমার ছিল, আছে, থাকবে! তুই তাকে ছুঁয়েছিস—এখন প্রস্তুত হ, কারণ আজ আকাশ ফাটবে, মাটি কাঁপবে, আর তোর পারস্যের আকাশে জ্বলে উঠবে আমার রক্তজ্বালা।”
তার গলা এমন গম্ভীর ছিল, যেন আকাশ কেঁপে উঠলো। পাখিরা ভয় পেয়ে উড়ে গেল দূরে, পাহাড়ের গায়ে ঢেউ খেলল শব্দের প্রতিধ্বনিতে। পুরো রাজ্য স্তব্ধ হয়ে গেল।
এরপর তার চোখ দু’টো সরু হয়ে এলো—এবার আর সময় নেই।
সে সবাইকে লক্ষ্য করে বলল—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—”রেডি হও সবাই! আজ কোনো দয়া নেই, কোনো মাফ নেই। অর্ষা আমাদের হৃদয়ের রানী, তাকে যারা ছিনিয়ে নিয়েছে, তাদের উপর নেমে আসবে আমাদের ন্যায়বিচার। এখনই যুদ্ধ হবে, এখনই আমরা আক্রমণ করব পারস্যের অন্ধকার রাজ্য! আর ফিরব অর্ষাকে সঙ্গে নিয়ে।”
সেই মুহূর্তে যুদ্ধডঙ্কার শব্দ বেজে উঠল। যুদ্ধের সাজসজ্জায় প্রস্তুত হল সবাই। আকাশে গর্জন তুলল বিশাল ডানাওয়ালা ড্রাগনসেনারা, মাটিতে ঝনঝন করে উঠল অস্ত্রের আওয়াজ, আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল শুধু একটাই শব্দ—”অর্ষা… অর্ষা… অর্ষা…”
ক্যালিয়ন এখনো গম্ভীর মুখে দাঁড়ানো—তার চোখে সেই দৃষ্টি যা রাজ্য উল্টে দিতে পারে, আর তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকা প্রতিশ্রুতি—প্রেমের, প্রতিশোধের, এবং বিজয়ের।
তার কণ্ঠে ছিল সেই তীব্র প্রতিজ্ঞার সুর—
ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনতে আমি গোটা দুনিয়াও পুড়িয়ে দিতে পারি।
হঠাৎ সেই উত্তেজনার মধ্যে থেকে ড্যানিয়েল সামনে এসে দাঁড়াল।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে ক্যালিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো—
“লর্ড… এখনকার ওয়াজফান আর আগের মতো নেই। সে এখন জিনদের বাদশা। তার শরীর এখন তাপ-শক্তিতে তৈরি, আগুনে গড়া এক ভয়ঙ্কর রূপ। আমরা যদি পুরো বাহিনী নিয়েও যাই, তবুও সে একাই আমাদের ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
তার রাজ্যে ঢুকে সরাসরি হামলা করা মানেই আত্মহননের সমান। এ সিদ্ধান্ত বোকামি। আমাদের আগে ভাবতে হবে কৌশল—
ড্যানিয়েলের কণ্ঠেও ভয় ছিল না, ছিল বাস্তবতা। কিন্তু ক্যালিয়নের হৃদয় এই মুহূর্তে কোনো যুক্তি মানছিল না।
তার চোখের তারা কাঁপলো, আর এক মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল।
সে ধীরে ধীরে এক পা সামনে বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো—
মরে গেলেও সব মরে যাবে… কিন্তু আমি… আমি আমার ভালোবাসাকে কারো কাছে রেখে আসতে পারি না। ওর হৃদয়ে আমি ছিলাম, আজও আছি।
ওরা যদি আগুনে পুড়িয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে, আমি বরফে জমিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনব।
আমি কাওকে ভয় পাই না… ওরা যা করেছে… আমি তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু করবো। এখন কেউ আমায় থামাতে পারবে না।
তার হুংকারে যেন আকাশ ভারি হয়ে উঠলো—
আর সেই বজ্রঘন প্রতিজ্ঞার মধ্যেই ধীরে ধীরে পর্দা নামতে লাগল এক যুদ্ধের আগুন ঝরা নতুন দিনের সামনে…
তবে ড্যানিয়েল এক বিষণ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বলে ওঠে,
আমরা মরে যাব, ঠিক আছে। কিন্তু যদি সে অর্ষা ম্যামের কোন ক্ষতি করে ফেলে? যদি সে বুঝে যায় যে ওর জন্যই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম? যদি সেই ক্ষোভে সে অর্ষাকেই মেরে ফেলে? তখন আমরা চাইলেও কিছু করতে পারব না, লর্ড।
তার কণ্ঠে অসহায়তা ছিল, চোখে একরাশ অজানা শঙ্কা। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ।
ক্যালিয়নের চোখদুটি রক্তাভ রঙে জ্বলে উঠলেও এবার যেন শান্ত হয় তার মন। সে বুঝে গেল, ড্যানিয়েল অকারণ ভয় দেখাচ্ছে না। ওয়াজফান, সেই অশান্ত আগুন, সেই হিংস্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ জিন—তাকে ভরসা করা যায় না। সে যে কোন মুহূর্তেই অপ্রত্যাশিত, নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ক্যালিয়ন ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর চাপা রাগে গর্জে ওঠে—
তাহলে কি করব, ড্যানিয়েল? এভাবে বসে থাকব? আর আমার রেড ওয়াইন— আমার ভালোবাসা— তাকে রেখে আসব সেই নরকের রাজ্যে, সেই রক্তপিপাসু জিনের কাছে?”
তার চোখের কোণা ভিজে ওঠে ক্রোধ আর যন্ত্রণার ছায়ায়।
ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, মাথা নত করে সম্মানের সাথে বলে,
“লর্ড, আমাদের এখনই হামলা করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমি শুনেছি, দুই মাস পর ওয়াজফান এক বিধ্বংসী যুদ্ধে অংশ নিতে যাবে— এমন এক যুদ্ধে যা কোহকাফ ছাড়িয়ে বহু দূর… সেই সময় তার রাজ্যে থাকবে না তার ছায়াটুকুও।”
একটু থেমে সে আরো গম্ভীর হয়ে বলে,
— “আর ঠিক সেই মুহূর্তটাই হবে আমাদের সুযোগ। আমরা তখনই হামলা চালাব— ধ্বংস করে দেব তার অন্ধকার প্রাসাদ, এবং আপনাদের রেড ওয়াইনকে ফিরিয়ে আনব… আপনার ভালোবাসাকে মুক্ত করব সেই জিনের নখদর্পণ থেকে।
এরপর ক্যালিয়ন বলে ওঠে যদি সে আর স্যার কোন ক্ষতি করে।
আমার মনে হয় না সে কোন ক্ষতি করবে ক্ষতি করা হলে বাংলাদেশেই করে দিয়ে চলে আসতো. ওয়াফান কোন কিছুর জন্য পরোয়া করার লোক না সে ক্ষতি করবে না তাই নিয়ে এসেছে —ড্যানিয়েল বলে।
ক্যালিয়নের চোখে ফিরে আসে এক স্ফুলিঙ্গ—প্রেম আর প্রতিশোধের অগ্নিশিখা। সে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়, যেন এখনই শপথ নিচ্ছে
“অর্ষা শুধু আমার… মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হলেও আমি ওকে ফিরে আনব।”
চাঁদের আলোয় তখন এক নীরব যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা লেখা হয়ে যায় দুই হৃদয়ে—
একটি ভালোবাসা,
একটি অপেক্ষা,
আর এক নৃশংস জিনের বিরুদ্ধে
অদৃশ্য প্রতিশোধের অঙ্গীকার।
অর্ষা রুমের এক কোণে বসে আছে নিঃশব্দে। চারপাশে গভীর নীরবতা, শুধু দূর কোথাও যেন কোনও এক অজানা প্রাণীর করুণ ডাকে রহস্য ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। আলোর মতো কিছুই নেই, ঘরের কোণাগুলো যেন গিলে নিচ্ছে তাকে, ঠিক যেমন করে কেউ তার পরিচিত জগতকে গিলে ফেলেছিল এই অচেনা দুনিয়ায় টেনে নিয়ে এসে।
তার চোখদুটি স্থির হয়ে আছে সামনের এক বিন্দুতে, কিন্তু মন উড়ে বেড়াচ্ছে ছিন্নভিন্ন চিন্তার পাখায়। তার মনে একটাই ভাবনা ঐ মহিলা এসেছিল, তার বলা প্রতিটি কথা যেন একেকটা বিষাক্ত কাঁটার মতো গেঁথে বসেছে অর্ষার মনে।
কথাগুলো তার মাথায় বাজছে বারবার। অস্বস্তিকর ভয়, এক অদ্ভুত ঘোর আর অসমাপ্ত প্রশ্নের ভিড়ে সে নিঃস্ব, নিঃসহায় বোধ করছে। এই দুনিয়াটা কি সত্যিই বাস্তব? নাকি কোনও দুঃস্বপ্ন? মানুষ সত্যিই কি পারে জিনদের জগতে আসতে? এগুলো কি কল্পনা? নাকি নিষ্ঠুর বাস্তব?
সে নিজেকে প্রশ্ন করে, ‘আমি কি এখনো জীবিত? নাকি হারিয়ে গেছি সেই দুনিয়ার সীমারেখা পেরিয়ে?’
তার শরীরটা ভার হয়ে আসে, মাথা নীচু করে চোখ বন্ধ করে সে ভাবতে থাকে—
“এই জিনের দুনিয়া থেকে আমি কি আদৌ ফিরে যেতে পারব?
যদি পারি, তাহলে কিভাবে?
আর যদি না পারি… তাহলে কি আমাকে সারাজীবন এখানেই কাটাতে হবে?
এই অন্ধকার, রহস্য আর অদৃশ্য আতঙ্কে ভরা দুনিয়ায়?”
তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে একটাই প্রশ্ন তীব্র হয়ে ধাক্কা দিচ্ছে—
“জিনের বাদশা কেন আমায় এনেছে? কেন আমি?”
বাতাসটা হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা শীতল স্রোত বইয়ে যায় তার শরীর জুড়ে। অর্ষা চমকে ওঠে, কিন্তু চোখ মেলে না।
সে জানে—এই দুনিয়ার চোখের দেখা সব সময় বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এই জগতে, চোখের সামনে যা আসে তা অনেক সময়ই বাস্তব নয়।
আর যেটা অদৃশ্য, সেটাই হতে পারে সবচেয়ে সত্য।
রুমের বাতাসে হালকা ফিসফিসে একটা শব্দ কানে আসে—
“সব প্রশ্নের উত্তর একদিন পাবে… তবে সময় হলে…”
অর্ষার হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই মহিলার চোখ—তীব্র দৃষ্টির ভেতর যেন লুকিয়ে ছিল শত বছরের ক্লান্তি আর গভীর কোনও অভিশাপ।
এরপর সে ধীরে ধীরে বিছানার পাশে হেলে পড়ে। শরীর নিস্তেজ, কিন্তু মন ততটাই চঞ্চল।
এই বন্দিদশা, এই অজানা আতঙ্কের মাঝেও অর্ষা এখন একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে—
সে লড়বে। মুক্তির পথ সে খুঁজবেই।
এই অন্ধকার জগতের মাঝেও সে খুঁজে বের করবে আলো।
জিনের বাদশা হোক কিংবা অন্য কেউ—
কারও দাস হয়ে সে থাকবে না।
তার ঠোঁটে এক ফালি নিঃশব্দ দৃঢ়তা খেলে যায়। চোখের কোণায় জমে থাকা অশ্রু মোছে না, বরং সেগুলোকেই নিজের শক্তি করে রাখে
ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎ করেই ঘরের দরজার সামনে কেমন যেন এক আলো ছড়িয়ে পড়ে। দরজাটি হালকা শব্দে খুলে গেল। অর্ষা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল—একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
এ কি সত্যিই মানুষ? নাকি… কোনো অলৌকিক সত্তা?
মেয়েটিকে দেখে প্রথমেই অর্ষার মনে হলো—এই তো সেই রূপকথার পরিরা, যাদের গল্প সে ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে শুনত। গোল্ডেন রঙের ঝলমলে চুলগুলো যেন সূর্যের আলো নিজের মাঝে ধারণ করে রেখেছে। তার গায়ের রং এতটাই ফর্সা, যেন তুলোর মতো মসৃণ, নিখুঁত। নাক, ঠোঁট, চোখ—সব কিছু এতটাই নিঁখুত, যেন কোনো শিল্পী বহু যত্নে তুলিতে আঁকছেন পরিপূর্ণ এক স্বর্গীয় প্রতিকৃতি।
তার পরনে ছিল এক অদ্ভুত নীলাভ পোশাক, যা মাটি ছুঁয়ে নেমে এসেছে নিঃশব্দে, এবং তার চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায়—এ চোখ যেন কিছু লুকিয়ে রাখে, হয়তো কোনও অতীত, হয়তো কোনও ভবিষ্যতের চিহ্ন।
অর্ষা যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল।
এই মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে আছে আলো, রহস্য, আর মুগ্ধতা।
এরপর সে ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানায়,
কে… আপনি?” অর্ষার ঠোঁট থেকে অস্পষ্ট শব্দ ফোটে।
মেয়েটি হালকা হেসে এগিয়ে আসে ঘরের ভেতর। তার হাসিটাও যেন শব্দহীন কোনো সুর, মনের ভিতর আলো জ্বেলে দেয়ার মতো।
“ভয় পেয়ো না,” মেয়েটি বলে, কণ্ঠটা যেন ঝর্ণার মতো নরম, শান্ত।
তবে তার চোখে ছিল গভীর কিছু—অতল, অচেনা কিছু বার্তা, যেন সে অনেক কিছু জানে, অনেক কিছু দেখেছে।
অর্ষার মনে হতে থাকে—এ মেয়ে মানুষ নয়। মানুষ হলে এমন সৌন্দর্য নিয়ে জন্মানো সম্ভব না। আর চারপাশে যখন কেউ নেই, এই শূন্য প্রাসাদে হঠাৎ এমন একজনের আগমন—তা তো স্বাভাবিক নয়।
তবে ভয় নয়, অর্ষার মন বলছে মেয়েটি কোনো হুমকি নয়। বরং যেন সুরক্ষা, আশ্বাস কিংবা ভবিষ্যতের কোনো আলোকরেখা হয়ে এসেছে তার সামনে।
এমন সময় মেয়েটি অর্ষার পাশে এসে বসে বলে,
“তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, তাই না? শিগগিরই সব উত্তর পাবে। এখন শুধু বিশ্বাস রেখো।”
অর্ষা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার চোখে।
তাঁর মনে হতে থাকে—এই মেয়েটিই হয়তো তার জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেবে।
এই রহস্যময়, অসম্ভব সুন্দর পরিই হয়তো তাকে নিয়ে যাবে অজানা কোনো গন্তব্যে।
তুমি অর্ষা, তাই না?” মেয়েটির কণ্ঠে যেন সুরের ঢেউ।
—“আমি ইসাবেলা… তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
অর্ষা অবাক চোখে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। ইসাবেলা চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলে চলল,
—“জানি, আমার এখানে আসার কথা ছিল না। এই প্রাসাদে, বিশেষ করে এই ঘরে, তোমার সাথে দেখা করতে আমাদের কারোই অনুমতি নেই। ওয়াজফান দা খুব রাগ করবে জেনে গেলে। কিন্তু… আমি থাকতে পারিনি অর্ষা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে আটকাতে, কিন্তু পারিনি। তোমার গল্প শুনেছি অনেক… শুনেছি, কীভাবে মানব দুনিয়া থেকে তোমাকে এখানে আনা হয়েছে।
এখন ভাবছো তো তোমার গল্প কার কাছে শুনেছি আর তোমার নাম কিভাবে জানি। ওই যে তখন তোমাকে যে খাবার দিতে এসেছিল রান্নার মাসি আমাদের তার থেকেই তোমার ব্যাপারে জেনেছি তাইতো ছুটে চলে এলাম।
আমি এই রাজ্যের একমাত্র প্রিন্সেস, প্রিন্সেস ইসাবেলা।
আর তোমাকে এখানে যে নিয়ে এসেছে সে হচ্ছে আমার বড় দা এই রাজ্যের বাদশা।
উনার কথা ছাড়া এই রাজ্যে একটা পাতাও নড়ে না কিন্তু আমি এসেছি চুপি চুপি লুকিয়ে আমার মানুষের দুনিয়ায় যাওয়ার অনেক শখ ছিল কিন্তু ওয়াজফান দা কখনো যেতে দেয়নি। আর তাইতো তোমার কথা শোনা মাত্রই ছুটে চলে এলাম।
এবার অর্ষা বলে, আপনার দা কেন আমায় এখানে নিয়ে এসেছে। আমাকে আমার দুনিয়া ফিরতে দিন প্লিজ।
ইসাবেলা বলে এটাতো শুধু ওয়াজফান দা ভালো জানে কেন তোমাকে এখানে এনেছে আর উনি ছাড়া কারো সাহস নেই তোমাকে এই ঘর থেকে বের হতে দেওয়ার পর্যন্ত তোমার দুনিয়া তো অনেক দূর।
এরপর,
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ইসাবেলা আবার বলে ওঠে,
এই জগতটা যেমন জাদুতে ভরা, তেমনই কঠিন নিয়মে ঘেরা। কিন্তু আমি চাই না তুমি নিজেকে একা ভাবো। আমি চাই, তুমি জানো… এখানে এমন কেউ একজন আছে, যে তোমার কথা ভাবে, তোমার পাশে থাকতে চায়।
অর্ষা তখনো চুপ। তার হৃদয়ে ততক্ষণে ঢেউ খেলে গেছে। এই অচেনা জগতে, যেখানে সবকিছুই ভয় আর রহস্যে মোড়ানো, সেখানে এই একটুখানি মায়া, একটুখানি মানবিকতা যেন তার হাড়ে-মজ্জায় আলতো করে ছুঁয়ে গেল।
ইসাবেলা এবার ধীরে ধীরে অর্ষার হাতের ওপর হাত রাখে। তার চোখে এক অপূর্ব মমতা, আর ঠোঁটে এক দৃঢ় প্রত্যয়,
তুমি ভেবো না, তুমি একা। আমি তোমার পাশে আছি আজ থেকে আমাকে নিজের বন্ধু ভাববে এমনিও এই রাজ্যে আমার কোন বন্ধু নেই যারা আছে সব দাস-দাসী আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।
এবার অর্ষাএকটু মুচকি হাসে। এত ভয়ঙ্কর জিনিসের মধ্যে তার সঙ্গে কিছুটা তো ভালো হলো।
আর মনে মনে ভাবে এর দ্বারাই আমি নিজের পালানোর পথ খুঁজে পাবো হয়তো।
এরপর ইসাবেলা তার হাতে থাকা পোশাকটা অর্ষা দিকে এগিয়ে দেয় যেটা সে আসার সময় নিজের সঙ্গেই নিয়ে এসেছিল কারণ মাসি তাকে বলেছিল অর্ষা কাল থেকে একটাই জামা পড়ে আছে।
ইসাবেলা বলে এটা তুমি পড়ে নাও ওয়াশরুমে গিয়ে স্নান করে এসে। এক জামাতে কতদিন বা থাকবে।
এরপর বলে আমি এবার যাই তবে আবার আসব… হয়তো লুকিয়ে, হয়তো নিষেধ ভেঙে… কিন্তু আমি আসব।”
একটা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসের মতো মুহূর্ত কাটে।
এরপর ইসাবেলা চলে যায়।
আর অর্ষা উঠে ওয়াশরুমে যায়, তার এখন বিরক্ত লাগছে এই একই ড্রেসে থাকতে। একটু গোসল করা উচিত।
ইসাবেলা যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর, নীরব ধীরপায়ে ওয়াজফান অর্ষার কক্ষে প্রবেশ করে। দরজার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে এক অপার্থিব আলো, যেন চাঁদের কোমল ছায়া মেঝেতে পা রাখছে। চোখ তুলে তাকাতেই তার দৃষ্টিতে আটকে যায় এক দৃশ্য, যে দৃশ্য কোনো মানব চোখে আগে দেখা হয়নি—অর্থাৎ, অর্ষা।
সে বসে আছে জানালার ধারে, সেই সাদা-রুপালি বড় গাউনটি পরে, যার আঁচলে যেন তারা ঝরে পড়েছে। তার চুলগুলি খোলা, রাতের আকাশের মতো গাঢ়, আর বাতাসে হালকা দুলছে এক অচেনা ছন্দে। জানালা দিয়ে পড়ে আসা চাঁদের আলো তার গায়ের ওপরে নরম পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, যেন স্বর্গের আলো এসে তাকে স্পর্শ করছে।
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে যায় স্তব্ধ হয়ে। চোখের পলক পড়া ভুলে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। তার মনে পড়ে, সে জীবনে অনেক পরী দেখেছে—রূপকথার, আগুনের, পানির, বরফের। তাদের রূপে ছিল জাদু, গঠন ছিল অনিন্দ্য। কিন্তু আজকের এই মুহূর্তে—এই এক নারীর রূপে—তার দেখা সব পরীকে যেন ছোট মনে হয়।
“এত সুন্দর কেউ হতে পারে?”—মনে মনে ফিসফিস করে ওঠে ওয়াজফান।
সে অনুভব করে, এই দৃশ্য তার হৃদয়ে আজীবন জ্বলন্ত দাগ কেটে থাকবে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি যেন রূপকথার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমন সৌন্দর্য বর্ণনার অতীত, ভাষার বাইরে। এই পৃথিবীতে, পরীর থেকেও সুন্দর কিছু থাকতে পারে।এটা না দেখলে বিশ্বাস হতো না কখনও।
অর্ষা তখন জানালার দিকে তাকিয়ে, দূর আকাশে হারিয়ে গেছে। সে জানে না, পেছনে দাঁড়িয়ে কেউ নিঃশব্দে তার রূপে হারিয়ে গেছে—কোনো এক জিন, যে ধীরে ধীরে পরীর প্রেমে বন্দি হয়ে যাচ্ছে।
তাও নিজের অজান্তেই।
ঠিক তখনই ওয়াজফান কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ভেতরের অন্ধকারে ডুবে যায়। তার চোখে এখন আর বিস্ময়ের জ্যোতি নেই, বরং সেখানে খেলে যাচ্ছে গভীর অবিশ্বাস আর সন্দেহের ছায়া। নিজের মনে জ্বলে ওঠে সে —
“এই সৌন্দর্য… এই কোমলতা… সবই কি নিছক এক অভিনয়? এক বিভ্রম মাত্র? এই মানব কন্যা… সে কি সত্যিই এতটা সাধারণ? না কি তার পেছনে লুকিয়ে আছে অশরীরী কোন কৌশল? কালো জাদু?”
ওয়াজফান অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে হালকা শয়তানি হাসি দিয়ে নিজের মনে ফিসফিস করে ওঠে,
“এই ধরনের নাটক তো অনেক পরীরাই করেছে। অনেকেই চেয়েছিল এই ‘বাদশার’ কাছে আসতে… অনেকেই চেয়েছিল আমায় জয় করতে। কেউ পারেনি। আর এই দুর্বল মানব কন্যা…! সে ভাবে সে পারবে?
তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে গভীর ঘৃণার ছায়া। চোখে তখন হিংস্র এক শীতলতা।
তুমি জানো না আমি কে, মেয়ে। তুমি জানো না আমি কী করতে পারি। তোমার কোমল চোখ, শান্ত মুখাবয়ব – এগুলো দিয়ে তুমি কারো দয়া জাগাতে পারো। কিন্তু আমি? আমি তো হৃদয়হীন… আমি সেই শয়তান, যাকে প্রেম স্পর্শ করে না।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সে অর্ষার দিকে। অর্ষা তখনো চাঁদের দিকে তাকিয়ে, কল্পনার মধ্যে হারিয়ে। হঠাৎ তার পাশে দাঁড়িয়ে ওয়াজফান গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে—
“তোমাকে এখানে আনা হয়েছে চন্দ্রবিলাস করার জন্য নয়। এই প্রাসাদে আজ থেকে তুমি কেবল এক দাসী। এই বিশাল প্রাসাদের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি করিডোর, প্রতিটি কোণ… সবই হবে তোমার কাজের ক্ষেত্র। রক্তে ঘাম মিশিয়ে তুমি পরিষ্কার করবে, রন্ধন করবে, শোধন করবে। আমি তো বলেছিলাম— প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করব। আজ থেকে সেই নরক শুরু হলো, লিটল মনস্টার।
তার কণ্ঠে কোনও দয়া নেই, কেবল নির্দয় শীতলতা।
“নরক কী জিনিস, সেটা তুমি এখনো জানো না। এখন থেকে ধাপে ধাপে তোমাকে আমি সেটাই শেখাব। ধ্বংস, শাস্তি, অপমান, কষ্ট – একেকটা করে আসবে। তোমার চোখের জল হবে আমার বিজয়ের প্রমাণ। তুমি ভেবেছিলে নিজেকে বাঁচাতে পারবে? না, লিটল মনস্টার । তুমি আমার খাঁচায় বন্দী এক পাখি, যার ডানাও কাটা— শুধু সময়ের অপেক্ষা, কখন তোমার কণ্ঠ থেমে যাবে।”
অর্ষা এতক্ষণ ধরে জানালার বাইরের অজানা অন্ধকারে চোখ রেখে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছিল। মনে হচ্ছিল, ওই কালো আকাশ, নিঃসঙ্গ গাছগুলো যেন তার নিজের মনের প্রতিবিম্ব। কিন্তু ওয়াজফানের কথাগুলো তার কানে যেই ঢুকলো, সঙ্গে সঙ্গে সে যেন এক গভীর ঘোর থেকে জেগে উঠলো।
ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ দুটো রক্তমুখর, জ্বালামুখর সেই আগুনের মতো। তার চেহারায় ঝড়ের পূর্বাভাস। রাগে-দুঃখে-অপমানে গলা কাঁপছে, কিন্তু সেই কম্পনের মধ্যেও তার কণ্ঠস্বর ছিল স্থির, দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী।
আমি পারবো না, তাই তো? আপনি কী ভেবেছেন? আমাকে এখানে আটকে রেখে আপনি খেলছেন নিজের ইচ্ছেমতো? আমাকে একটা খেলনার মতো মনে করছেন, যাকে ইচ্ছে হলে সাজিয়ে রাখবেন, আবার ইচ্ছে হলে ভেঙে ফেলবেন? আপনি ভুল করছেন,
তার বুক ওঠানামা করছিল উত্তেজনায়, কিন্তু তবুও সে চেষ্টা করছিল নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
আমি দুর্বল নই। আমি ভয় পাই না, সে আমার সামনে যেই আসুক হোক সে কোন জিনের বাদশা। আপনি কী ভেবেছেন? আমি আপনার চোখের ভাষা পড়তে পারি না? আপনি আমার উপর আধিপত্য দেখাতে চান, আমাকে নিজের মতো করে গড়ে নিতে চান? কিন্তু দুঃখিত, আমি সেই ধাতের নই।”
তার কণ্ঠস্বর নরম ছিল, কিন্তু শব্দগুলো ছিল তীক্ষ্ণ ছুরির মতো। কারণ গত রাতের ঘটনা তার মনে এখনো জ্বলন্ত দাগ হয়ে আছে—যখন ওয়াজফান তার গলা চেপে ধরেছিল, নিঃশ্বাস নিতে দিয়েও যেন না। সে ভুলেনি সেই ভয়, কিন্তু সেই ভয়ই আজ তাকে আরও শক্ত করেছে।
আপনার এই অন্ধকার জগতের নিয়ম আমাকে মানতে হবে কেন? আমার কোনো দোষ নেই, কিছুই জানি না আমি আপনার রাজ্য নিয়ে, আপনার অস্তিত্ব নিয়েও না! তবুও আপনি আমাকে এখানে এনে বন্দি করেছেন, মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছেন, কেন? আমাকে ফিরিয়ে দিন আমার পৃথিবীতে! আমার মা আছেন, আমার আপনজনেরা আছেন, তাদের কাছে ফিরে যেতে দিন। আমি বন্দিনী হয়ে বাঁচতে চাই না, আমি মানুষ, পুতুল নই।
এক মুহূর্ত থেমে সে নিঃশ্বাস নিল। গলার স্বর চিৎকারে উঠল না, কারণ সে জানে—একটুও বেশি বললেই হয়তো আবার সেই রুদ্র রূপে ফেটে পড়বে ওয়াজফান। তবুও সাহস করে, চোখে চোখ রেখে বলল—
আপনার কাছে কৃতজ্ঞ নই, ভীতও নই। আমি শুধু নিজের জীবনের অধিকার চাই, কিছু নয়। এই অধিকার কেড়ে নেওয়া অন্যায়, আর সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি চুপ করে থাকব না।”
তার কণ্ঠে ছিল প্রতিবাদ, চোখে ছিল আগুন, আর চিবুকের রেখায় ছিল আত্মসম্মান বাঁচিয়ে রাখার দৃঢ়তা।
ওয়াজফান নিজের অগ্নিদৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁটে একরকম ঠান্ডা, নিষ্ঠুর হাসি খেলে যায়। মনে মনে সে ভাবে—
“আমার সামনে কথা বলার সাহস! আজ পর্যন্ত কেউ এতটা স্পর্ধা দেখায়নি। রাজ্য কাঁপে আমার নাম শুনে, আর এই মানব কন্যা…! সে আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছে? এই কাঁচের মতো কোমল শরীরে এতটা সাহস কোথা থেকে আসে?”
তার কণ্ঠের গর্জন না থাকলেও ভেতরের আগুন হুহু করে জ্বলে ওঠে।
“তবে ভালোই হলো,” সে মনে মনে বলে, “দুর্বল হলে তো আর খেলনা হয়ে উঠত না। কিন্তু এ! এ তো এক গোপন আগুন, যাকে ছুঁয়ে দেখা যায় না, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। খেলনাটা যত দৃঢ় হবে, তাকে ভাঙার আনন্দ তত গভীর হবে। আর আমি? আমি তাকে ভাঙব—প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে। ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, এমনভাবে… যেন সে নিজেও বুঝতে না পারে কখন ভেঙে গেছে।”
ওয়াজফান চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে আসে, কিন্তু তবু মুখে কোনো শব্দ নেই—শুধু চিন্তার রাজ্যে সে রক্তমাখা পরিকল্পনা আঁকতে থাকে।
“এই সাহস… এই চোখের দৃঢ়তা… আমি তা একদিন মাটির সাথে মিশিয়ে দেব। একদিন, যখন সে দাঁড়িয়ে থাকবে আমার সামনে, ভেঙে পড়া আত্মা নিয়ে, আমি তার চোখে চোখ রেখে বলবো—
‘এখন দেখাও সাহস, মেয়ে! দেখাও সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি!’”
তার ঠোঁটে তখন আরেকবার সেই বিষাক্ত হাসি খেলে যায়।
“ভালোই হলো,” সে ভাবতে থাকে, “এই খেলনাটা অনেকদিন খেলা যাবে। রাজ্য, যুদ্ধ, সভা—সব এখন বিরক্তিকর। প্রাণহীন একঘেয়েমি। কিন্তু এখন! এখন আমার দিন শুরু হলো। আজ থেকে প্রতিটি প্রহরে, প্রতিটি অন্ধকার রাতে, আমি একটাই খেলা খেলবো—তাকে ভাঙা, তাকে পিষে ফেলা। তার হাসি, তার নির্ভীকতা, তার আত্মবিশ্বাস। সব আমি মুছে ফেলব, এমনভাবে যেন নিজেকে দেখলে সে ঘৃণা করে, কান্না আসে। আমি তাকে এমনভাবে নিজের অধীনে নিয়ে আসব, যেন সে ভুলেও আর শ্বাস নিতে না চায় আমার অনুমতি ছাড়া।
তার চোখে তখন আর রক্ত নয়, বরং শিকারীর নিষ্ঠুর আনন্দ খেলে যায়।
এরপর ওয়াজফান গম্ভীর স্বরে, চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি নিয়ে অর্ষার দিকে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে একটি হিংস্র হাসি খেলে যায়। ধীরে ধীরে সে বলে,
এই কি এখনও আমাকে ভয় পাস না লিটল মনস্টার ? তবে এবার চল, তোর এই ভুলভ্রান্ত ধারণাটাই ভেঙে দিই। এবার দেখা হোক আমার আসল রূপের সঙ্গে!
এই কথার পর মুহূর্তেই ওয়াজফানের চোখদুটো রক্তবর্ণে জ্বলে ওঠে। এক নিমিষে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যেন প্রকৃতিও থমকে গেছে তার রূপান্তরের সাক্ষী হতে।
এক ঝলকে যেন সময় স্থির হয়ে পড়ে। এরপরই সেই অচেনা অন্ধকার থেকে জন্ম নেয় এক ভয়াল দৃশ্য…
ওয়াজফানের শরীর ক্রমশ বিকট আকার ধারণ করতে থাকে—সে ক্রমশ বিশাল এক দৈত্যে রূপ নেয়। তার গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের রেখা, যেন সে আগুনেরই সন্তান। মাথার দু’পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে দুইটি দানবীয় সিং, তীক্ষ্ণ, বাঁকানো আর বিভীষিকাময়। তার সমস্ত চেহারায় ছড়িয়ে পড়ে বিভৎসতা, বিকৃতির এক করুণ কাহিনি যেন তার গাত্রে লেখা।
তার মুখটি এতটাই বিকৃত, এতটাই ভয়ংকর যে সাধারণ কোনো মানুষের চোখে তা ধরা পড়লে হৃদয় থেমে যেতে পারে। তার দাঁতগুলো ধারালো নখের মতো, চোখদুটি যেন লাল জ্বলন্ত আগুনের গোলা, যার দিকে তাকালেই শরীরের ভেতর কেঁপে ওঠে হিমশীতল এক শিহরণ।
অর্ষা এইসব দৃশ্য নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করতে পারে না। এক মুহূর্ত আগেও যে মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়েছিল, এখন সে যেন নরকের অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা এক অভিশপ্ত জিন। তার চেতনা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসে, হৃদপিণ্ডের স্পন্দন যেন থেমে যেতে চায়।
আর সেই আতঙ্ক, সেই ভয়, সেই অবর্ণনীয় বিভীষিকা — অর্ষাকে গ্রাস করে নেয় পুরোপুরি। এক চিৎকারও তার কণ্ঠ থেকে বের হয় না। শরীরটা কেঁপে উঠে থেমে যায়, চোখজোড়া বিস্ফারিত, নিঃশ্বাস ভারী, তারপর…
সে ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অজ্ঞান।
চারপাশে নিস্তব্ধতা নামে, শুধু জ্বলন্ত আগুনের মত ওয়াজফানের দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে এক অভিশপ্ত তাপ।
অন্ধকারের বুক চিরে রাত্রি আরও ঘন হয়ে আসে।
অর্ষার নিথর দেহটি শূন্য দৃষ্টিতে পড়ে ছিল রাজপ্রাসাদের পাথুরে মেঝেতে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, যেন সময় থেমে আছে তার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দেহের পাশে। ঠিক তখনই সেই ভয়াল রূপ, সেই দানবীয় জিন, ওয়াজ ফান—তার ভীষণ জিনের অবয়ব থেকে ধীরে ধীরে নিজের মানুষ-রূপে ফিরে আসে।
একটা ব্যঙ্গাত্মক, ঠাণ্ডা হেসে সে বলে ওঠে—
“হা-হা… দুর্বল মানবী! এই শক্তি নিয়ে এসেছো আমার সাথে যুদ্ধ করতে? প্রথম ধাপেই তো হেরে গেলে! বাকি ধাপগুলো কিভাবে পেরোবে বলো তো?”
তার কণ্ঠে করুণার লেশ নেই, বরং রুক্ষতা আর তাচ্ছিল্য ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে দেয়ালে দেয়ালে।
সে পাশের টেবিল থেকে একটা রূপালী পাত্র তুলে নেয়—ভিতরে ঠান্ডা জল। মুহূর্তের মধ্যে পুরোটা জল অর্ষার মুখে ছুড়ে মারে সে, যেন তার এই অজ্ঞানতা সহ্য হচ্ছে না আর।
শীতল জলের ধারায় চমকে ওঠে অর্ষা, জ্ঞান ফিরে আসতেই হঠাৎ কাশতে কাশতে উঠে বসে। বুকজুড়ে ভেজা কাপড়, শ্বাস কেঁপে ওঠে, চোখে এখনও অস্পষ্টতা। তার দৃষ্টিতে যেন ভয়, অপমান আর বিষন্নতার একসাথে মিশ্র প্রতিফলন।
ওয়াজ ফান এবার ধীরে ধীরে তার সামনে এসে এক হাঁটু গেড়ে বসে। চোখ দুটো তার চোখে স্থির করে বলে ওঠে—
“কোথায় গেল সেই সাহসিকতা, একটু আগেই তো বলছিলে রাজার মতো কথা? শেষমেশ তুমি তো দুর্বলই রইলে… দুর্বল কন্যা, মানব হয়েই যদি জিনের সাথে পাঙ্গা নিতে চাও, তার পরিণাম তো বুঝতেই পারো। আজকের মতো ছেড়ে দিলাম—এটাই তোমার সৌভাগ্য।”
তার কণ্ঠে এক ধরণের হুঁশিয়ারির ঝাঁঝ, যা মনে করিয়ে দেয়—ওয়াজ ফান ক্ষমাশীল নয়, আজ শুধু সময়ের খেলা তাকে শান্ত রেখেছে।
তারপর সে ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বলে—
“এরপর যদি আমার মুখের উপর কথা বলো, তাহলে ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করবে তোমার জন্য। আর শুনে রাখো—আগামীকাল সকাল থেকে যেন তোমার হাতেই রাজপ্রাসাদের সব কাজ শুরু হতে দেখি। কোনো দ্বিধা, কোনো অজুহাত নয়।”
এই কথাগুলোর পর ওয়াজ ফান উঠে দাঁড়ায়। তার দীর্ঘ কদমে ধীরে ধীরে অর্ষার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে ভেজা, অপমানিত, কাঁপতে থাকা এক দুর্বল মানবী—যার সামনে এখন শুধুই ভয়, অধিকারহীনতা আর অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ।
ওয়াজ ফান চলে যাওয়ার পর, কক্ষের নিস্তব্ধতা যেন হঠাৎ করেই ভারী হয়ে ওঠে। চারপাশে অন্ধকার আর পাথরের ঠাণ্ডা দেয়ালগুলো যেন ওর নিঃশ্বাস পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে। সে নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করে একটু পরম মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে ফিসফিস করে নিজেকেই বলে উঠল—
“হয়তো আজ প্রথমবার এমন কিছু দেখলাম যা সাধারণ মানুষের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। হ্যাঁ, ওয়াজ ফান… তুমি আমাকে চমকে দিয়েছ, আতঙ্কিতও করেছ। কিন্তু তাই বলে তুমি ভেবো না আমি তোমার ভয়ে পিছু হটব। আমি সেই মেয়ে নই যে ভয়কে নিজের শিকল বানিয়ে বসে থাকবে। আমি পালাব, যেভাবেই হোক—আমি আমার পৃথিবীতে ফিরব। আর সেই পথের প্রথম ধাপই হলো এই ভয়ঙ্কর কক্ষটা ছেড়ে বের হওয়া।”
তার দৃষ্টিতে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি। একটা আগুন, একটা সিদ্ধান্তের অনল। অর্ষা দাঁড়িয়ে পড়ে, মুখ তুলে দেয়ালের দিকে তাকায়, যেন সেখানেই তার ভবিষ্যতের মানচিত্র আঁকা। সে আবার বলে উঠল—
“যদি এই প্রাসাদের কাজ করাই হয় আমার মুক্তির চাবিকাঠি, তবে তাই হোক। তোমার কথামতো কাজ করব, তুমি যেমন বলেছো—এই প্রাসাদের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াব। কারণ তবেই তো আমি খুঁজে পেতে পারি মুক্তির পথ। তবেই তো আমি জানতে পারব এই অন্ধকারের ভিতর কোন আলোটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
তার চোখে তখন অদম্য আত্মবিশ্বাস। আর সেই আত্মবিশ্বাসের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নীরব কৌশল। সে নিজেকে বোঝাতে থাকে—
“তোমার বোনকে আমি বন্ধু বানিয়েছি—এটাই হবে আমার প্রথম অস্ত্র। ওকে পাশে পেলে হয়তো আরও কিছু জানব, প্রাসাদের ভিতরের খবর, গোপন পথ কিংবা কিছু ভুল যেটা হতে পারে আমার সুযোগ। আমি ধৈর্য ধরব, মুখে ভয় দেখাব না, চোখে লুকাব না আমার সংকল্প। কিন্তু মনে মনে আমি প্রস্তুত হচ্ছি—প্রতি মুহূর্তে নিজের পরিকল্পনা গড়ে তুলছি।
অর্ষা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর নিজের বুকে হাত রাখে, চোখ বন্ধ করে দৃঢ় স্বরে বলে ওঠে
সেই দিন আসবেই, যেদিন এই দানবীয় প্রাসাদের দেয়াল কাঁপবে আমার পদচারণায়। আমি দেখাব, কীভাবে এক মেয়ে—যাকে সবাই দুর্বল ভাবে—নিজের সাহস, আত্মবিশ্বাস আর মনোবলে পাল্টে দিতে পারে নিয়তির লিখন। তুমি চেয়েছিলে আমাকে বন্দি করে রাখতে, কিন্তু ভুলে গেছো… বন্দি করে রাখলে মনকে নয়, কেবল দেহকে। আর আমার মন… সে তো আজ থেকে মুক্তির গান গাইছে।
এক বিশাল মেঘে ঢাকা পাহাড়, যার চারপাশে নেমে আসে কুয়াশার চাদর আর সাদা বরফের নরম ঝরনা। চারদিক শুধু সাদা—তুষারের রাজত্ব যেন। সেই রহস্যময় পর্বতের নাম এলবুর্জ। উঁচু উঁচু ঢিলায় ঘেরা পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে এক গোপন রাজ্য, যার নাম—মেসোপটেমিয়া।
এ রাজ্য মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। এটাকে বলা হয় পরীদের রাজ্য। কেউ জানে না, কেউ খুঁজে পায় না, কিন্তু সে রাজ্য সত্যিই আছে। সেই গোপন রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এক অপূর্ব রাজপ্রাসাদ—সাদা-সোনালি মার্বেলে তৈরি, যার ছাদ ছুঁয়ে যায় মেঘেদের কণ্ঠা।
সেই প্রাসাদের এক অপূর্ব সৌন্দর্য মাখা ঘরে, নরম চন্দনের সুগন্ধে ভরপুর একটি বিশাল কক্ষে, রেশমি নীল পর্দার পাশে, সুস্বর্ণ কাঠের তৈরি বিশাল রত্নখচিত পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে এক রাজকন্যা—প্রিন্সেস এলিনা।
তার রূপ যেন জ্যোৎস্নার চেয়েও ধবধবে। এলিনার লম্বা, রূপালি চুল ছড়িয়ে আছে বিছানায়, যেন চাঁদের ঝর্ণাধারা। চোখদুটো বন্ধ, কিন্তু চোখ খুললেই বোঝা যায় সেই চোখ দুটি গভীর, ঝিলিক দেয়া হেমন্ত বিকেলের আকাশের মতো। তার ঠোঁট গোলাপি, নিখুঁত খচিত দুটি পাপড়ির মতো। তার সৌন্দর্য দেখে চাঁদও হিংসায় ছায়ায় ঢাকে নিজেকে।
হঠাৎই নরম পায়ের শব্দ—“টপ টপ”—তার কক্ষে প্রবেশ করে এক প্রবীণ দাসী, নাম মালালা। তার মুখে উদ্বেগের ছাপ।
মালালা নিচু গলায় বলে ওঠে,
প্রিন্সেস এলিনা! জেগে উঠুন, জরুরি সংবাদ আছে।
এলিনা ধীরে ধীরে চোখ মেলে, মাথা উঁচু করে বলে,
কি হয়েছে মালালা? তুমি তো কখনো এমন উদ্বিগ্ন দেখাইনি।
মালালা দ্রুত বলে,
পারস্য রাজ্যে একটি মানব কন্যা এসেছে। বাদশা নিজ হাতে তাকে প্রাসাদে এনেছেন।
এলিনার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। অবিশ্বাসে তার ঠোঁট ফাঁক হয়ে যায়।
— “কি বলছো তুমি! এটা অসম্ভব! ওয়াজফান… সে তো কখনো কোনো মানবকেই সহ্য করতে পারে না। সে নিজে একজন মানব কন্যা নিয়ে এসেছে!”
মালালা শান্ত গলায় বলে,
— “আমি মিথ্যা বলছি না, প্রিন্সেস। শুধু আমাদের রাজ্য নয়, চারপাশের প্রতিটি পরী ও জিনদের রাজ্যেও এই খবর ছড়িয়ে গেছে।
এলিনা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার রূপালি চুল ঢেউ খেলিয়ে পড়ছে কোমরের নিচে পর্যন্ত, আর চোখে ফুটে উঠছে এক হালকা বিরক্তি, এক হালকা ঠান্ডা উচ্চাভিলাষ।
— “আহ, মালালা! এত চিন্তিত হচ্ছো কেন? আনলে এনেছে, তাই বলে পৃথিবী তো থেমে যায়নি! হয়তো কোনো দরকারেই এনেছে। বাদশা ওয়াজফান হঠাৎ কী মনে করে এনেছে সেটা ভাবা এখন সময়ের অপচয়।”
মালালা একটু সংকোচে বলে,
“তবে রাজকন্যা, এটা তো অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা…”
এলিনা হালকা হাসে, সেই হাসি ঠোঁটের কোণ ছুঁয়েই থেমে যায়—ঠান্ডা, রাণীসুলভ।
“তুমি জানো মালালা, আমি এসব বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। এখনো যদি ওর প্রতি মনে একটু-আধটু টান থেকেও থাকে, সেটাও হয়তো অভ্যেস। তবে জানো তো, জ্যাইম অনেকদিন পর ফিরেছে। সে যেন রাজ্যেই থাকে না, সারাক্ষণ পাহাড় পেরিয়ে ঘোরে বেড়ায়। ছোটবেলার বন্ধুত্বের সব স্মৃতি ভুলে গেছে!”
মালালা হালকা কৌতূহল নিয়ে বলে,
— “আপনি কি তবে আজই যাবেন ওর সঙ্গে দেখা করতে?”
এলিনা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে জানালার দিকে পা বাড়ায়। জানালার পর্দা সরিয়ে মেঘে মোড়া বরফঢাকা উপত্যকা দেখেন—যেন নিজেরই রাজ্যকে মাপছেন। তারপর বলেন,
— “না, আজ নয়। তবে ভাবছি কিছুদিনের মধ্যে পারস্যে ঘুরে আসবো। একটু রাজ্যের বাইরে সময় কাটাতে মন চাচ্ছে। তখন না হয় সেই মানব কন্যাকেও দেখে আসবো।”
তার ঠোঁটে আবারও এক রহস্যময় হাসি খেলে যায়।
— “ভালোই হয়েছে আসলে। এই একঘেয়ে জিন-পরীদের মাঝে এক মানব কন্যার আগমন—বদল আসবে রাজ্যের বাতাসে।”
Death or Alive part 11
মালালা কিছুটা বিস্ময়ে রাজকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এলিনার দৃষ্টিতে এক ধরনের গভীরতা, এক অব্যক্ত অভিপ্রায়। সে কি কৌতূহলী? না ঈর্ষান্বিত? না কি কিছু ভিন্ন পরিকল্পনা তার মনে জন্ম নিচ্ছে?
রাজপ্রাসাদের উঁচু মিনারে তখন ঘন্টার শব্দ বেজে ওঠে—এক নতুন সকাল, এক নতুন আগমন আর এক রহস্যময় গল্পের শুরু।
