Death or Alive part 15
priyanka hawlader
ওয়াজফান অর্ষার খুব কাছে এসে দাঁড়াতেই মুহূর্তেই ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি সরাসরি আটকে যায় তার চোখে, তীব্র কিছু একটা যেন উপচে পড়ছে সেই দৃষ্টিতে। হঠাৎ করেই, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, ওয়াজফান তার চুলের মুঠি ধরে টেনে আনে নিজের কাছে—আর পরক্ষণেই তার ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় অর্ষার ঠোঁটে।
এইভাবে, হঠাৎ… এই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে অর্ষা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন সময় থেমে গেছে। এক মিনিটের জন্য পুরো পৃথিবী নিস্তব্ধ, তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ ভয়ের শিহরণ আর অপার বিস্ময়।
কিন্তু ওয়াজফান থামে না।
সে যেন পাগলের মতো অর্ষার ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে—আবেগ, উন্মাদনা আর নিজের অস্থিরতা ঢেলে দিচ্ছে এই স্পর্শে।
কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে অর্ষার ধ্যান ফিরে আসে। তার শরীর কেঁপে ওঠে, সে আতঙ্কে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, হাত দিয়ে ওয়াজফানকে ধাক্কা দিতে শুরু করে।
ছাড়ো… ওয়াজফান… প্লিজ…” — অস্পষ্ট কণ্ঠে ফিসফিস করে ওঠে অর্ষা।
কিন্তু তার প্রতিরোধ যত বাড়তে থাকে, ওয়াজফানের আঁকড়ে ধরা তত গভীর হয়ে যায়। যেন সে এক কণাও ছাড়তে নারাজ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখনই অর্ষা বুঝে যায়—সে যত বেশি নড়বে, ততই ওয়াজফান তাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে।
অবশেষে সে ধীরে ধীরে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, কাঁপতে থাকা দেহ নিয়ে, আতঙ্ক আর অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে আসা এক অনুভবে।
ওয়াজফান সেই নিস্তব্ধতাকে টের পায়।
ধীরে ধীরে সে তার ঠোঁট সরিয়ে নেয়, চোখে দপদপ করে জ্বলা এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। একটিবারের জন্যও কিছু না বলে, সে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে অর্ষাকে ছেড়ে দেয়।
অর্ষা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে, চোখের কোণে জমে ওঠে অদেখা অশ্রু।
ঘরে তখন শুধু নিঃশ্বাসের আওয়াজ।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে অর্ষার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখদুটো তার ঠিকঠাকভাবে ছিন্নভিন্ন করার মতো তীব্র। সে নিচু গলায়, ঠান্ডা অথচ হিংস্র এক কণ্ঠে ফিসফিস করে ওঠে—
— “বলেছিলাম না… আমার মুখের ওপর কথা বলবি না। আমার সামনে কেউ আওয়াজ তুলে কথা বললে, সেটা আমার একদম সহ্য হয় না।”
তার প্রতিটি শব্দ যেন বিষের মতো গায়ে বিদ্ধ হচ্ছিল অর্ষার।
ওয়াজফান এক ধাপ আর এগিয়ে আসে, এবার মুখটা একদম কাছে এনে বলে—
— “তোর ওপর অনেক শাস্তি দিয়েছি… কিন্তু আজ থেকে এসব শাস্তি নিতে নিতে তুই অভ্যস্ত হবি। মাথায় গেঁথে রাখ—
তুই শুধু আমার… আমার দাসী… বুঝলি?
তোর শরীরের প্রতিটা অংশ…
তোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত… সব আমার।
এখন থেকে তোর দেহ দাসত্ব করবে—আমার আদেশেই বাঁচবি তুই।
কথাগুলো ছুরি দিয়ে কাটা মতো ঠান্ডা ও তীক্ষ্ণ।
অর্ষা কিছু বলার চেষ্টা করেও মুখ খোলার সাহস পায় না। ঠোঁট কাঁপে, চোখের কোণে অশ্রুর রেখা জমে ওঠে… কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
তার মন আর শরীর এখনো জর্জরিত কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ংকর মুহূর্তের স্মৃতিতে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, মাথা নিচু, নিঃশ্বাস ভারী, আর বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ।
ওয়াজফান একবার তাকায় তার দিকে। অর্ষার সেই নিঃশব্দতা যেন তাকে তৃপ্তি দেয়।
সে আরও একবার শীতলভাবে বলে ওঠে—
— “এরপর থেকে ভুল করার আগে ভেবে করবি।
কারণ এখন থেকে… তোকে এরকম শাস্তি পেতেই হবে।”
এই কথা বলে, ওয়াজফান ঘুরে দাঁড়ায়। দরজার দিকে এগিয়ে যায় দৃপ্ত পায়ে। দরজা খুলে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কিছু একটা অনুভব করছে। তারপর কোনো শব্দ না করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
পেছনে শুধু অর্ষা—স্তব্ধ, কাঁপতে থাকা একা একটা নিঃশব্দ দেহ।
গভীর রাত। চারদিক নিস্তব্ধ।
অর্ষার ঘরের জানালা খোলা, হালকা বাতাস পর্দাকে ধীরে ধীরে দুলিয়ে দিচ্ছে। ম্লান চাঁদের আলো ঘরের একপাশে ঝুলে পড়েছে, আর অর্ষা বিছানায় নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে আছে—ক্লান্ত, ভেতরটা এখনও জড়িয়ে আছে দিনভর ঘটে যাওয়া বিষাদের ভারে।
হঠাৎ…
অর্ষার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। ঘুমের মধ্যে যেন সে কিছু অনুভব করে।
একটা অস্বস্তি… এক ধরনের ভারি নিঃশ্বাসের মতো…
মনে হচ্ছে কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুব কাছ থেকে। এমনভাবে, যেন চোখ গলে গিয়ে মন পড়ে নিতে চায় তার।
সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে।
ঘরের অন্ধকার চেনা, কিন্তু আজ যেন কিছুটা ভিন্ন।
তার মনে হলো, বিছানার এক পাশে, খুব কাছে কোথাও… কিছু একটা বসে আছে।
কিন্তু… চোখে কিছুই পড়ছে না।
সে একটু উঠে বসে, চারপাশে তাকায়—দরজা বন্ধ, জানালা খোলা। বাতাস বইছে, কিন্তু তাতে এমন অনুভব হওয়ার কথা না।
তবুও সেই অনুভূতি যায় না।
মনে হয়, কোনো দৃষ্টি এখনও ঘিরে আছে তাকে। একান্ত নীরব, অথচ কাঁপন ধরানো দৃষ্টি।
এক মুহূর্তের জন্য অর্ষার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
সে ধীরে ধীরে বিছানার চাদর টেনে নেয় গলা পর্যন্ত। ঠোঁট শুকিয়ে যায়। কিন্তু নিজের মনকে বুঝিয়ে, চোখ বুজে আবার শুয়ে পড়ে।
— “ভুল হচ্ছে… কিছু না… আমি ভাবছি…” — নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করে সে।
কিন্তু ঘুমানোর আগে মনে হয়, কোনো অদেখা ছায়া যেন হালকা হাসছে। নিঃশব্দে। ঠান্ডা সেই হাসি অর্ষার মনটাকে চেপে ধরে এক অজানা আতঙ্কে।
কিন্তু সে আর চোখ খোলে না। নিঃশব্দ ঘরে, নিঃশ্বাস ভারি হতে থাকে…
রাত গভীর। চারপাশে নিস্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধে আছে।
ওয়াজফান বসে আছে নিজের ঘরের কোণায় রাখা রকিং চেয়ারে। হালকা দুলছে সে… একবার সামনে, একবার পেছনে। মাথা পেছনে ঠেকানো, চোখ বন্ধ, ঠোঁটে হালকা এক অদ্ভুত হাসি।
তার ঠোঁট এখনো যেন জ্বলছে। কিছুক্ষণ আগের সেই চুমু… যেন এখনও স্পর্শ ছেড়ে যায়নি।
সে মনেই মনে ফিসফিস করে—
“এটা কেমন অনুভব ছিল… যেন লাড্ডু খাচ্ছি। না… জিনেদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার… মিষ্টি, তবে আমার প্রিয় খাবার সেই লাড্ডু।”
ওয়াজফান হাসে একরাশ মোহ নিয়ে।
“লাড্ডু তো আগেও অনেক খেয়েছি… কিন্তু এইটা… এইটা ছিল যেন অমৃতের স্বাদ… আগুনের মতো জ্বালানো আর বরফের মতো ঠান্ডা।”
তার চোখজোড়া ধীরে ধীরে খুলে যায়। এক অদ্ভুত দীপ্তি জমে আছে তাতে।
“ইচ্ছা করছে আবার খেতে। আবার ছুঁতে, আবার কাঁপাতে, আবার তোর ঠোঁটগুলো ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু এখন আমার কাছে কোনো অজুহাত নেই… এত সহজে কি আবার পারা যায়?”
ওয়াজফান উঠে দাঁড়ায় না। শুধু দুলতে থাকে। একবার পেছনে, একবার সামনে।
“আমি আজ বুঝে গেছি… আসলে আমার তোকে নিয়ে কী দরকার। আমি কী চাই। এই আকর্ষণ, এই টান—সবই ততক্ষণ থাকবে, যতক্ষণ না তোকে পুরোপুরি পেয়ে যাচ্ছি।”
তার গলার স্বর ধীরে ধীরে নিচু হয়ে যায়। যেন নিজের কাছেই স্বীকার করছে এক অন্ধকার প্রতিজ্ঞা।
“আর একবার… আর একবার যদি তোর দেহটা আমার হয়ে যায়—পুরোটাই… তাহলে এই পাগলামিটা শেষ হয়ে যাবে।”
“তখন আমি তোকে তোর দুনিয়ায় ফেরত দিয়ে আসব।”
একটু থেমে সে আবার ফিসফিস করে—
“কারণ আমি জানি… আমি কাউকে ভালোবাসি না। আমি কেবল জয় করতে ভালোবাসি। ভোগ করতে। এরপর ফেলে দিতে। তুইও তার ব্যতিক্রম না।”
রকিং চেয়ার থেমে যায়।
ওয়াজফান চুপচাপ বসে থাকে। চোখ বন্ধ করে ঠোঁটে সেই পুরনো চুমুর স্বাদ ফিরিয়ে আনতে চায় বারবার। যেন নিজের মনেই আবার চুমু খাচ্ছে অর্ষাকে।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
নিরবতা এতটাই তীব্র যে, মনে হয় তার এই বিকৃত চিন্তাগুলোই দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা মারছে।
পরদিন সকাল — রাজপ্রাসাদের বাতাসে হঠাৎই নেমে এলো এক অদৃশ্য আঁধার।
সূর্যের আলো এসে পৌঁছালেও রাজপ্রাসাদের দেয়ালে যেন তার উষ্ণতা পৌঁছাতে পারছিল না।
সব কিছু ঠান্ডা, স্তব্ধ… আর তার মাঝেই ভেসে উঠল এক ঘোষণা, যেন বজ্রপাতের মতো।
বিরাট হলঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাদশাহ ওয়াজফান, তার কণ্ঠে ছিল রাজসিক দৃঢ়তা আর চোখে ছিল সেই বিকৃত আত্মতৃপ্তির ঝিলিক।
চোখ না মেলেই সে জানিয়ে দিল—
আজ থেকে অর্ষা শুধু আমার…
আমার পার্সোনাল দাসী।
সে কারও নয়, রাজপ্রাসাদের নয়, শুধুমাত্র ওয়াজফান বাদশাহর।
তার শরীর, তার হাত, তার চোখ—সব আমার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
প্রাসাদের কোনো সাধারণ দাসীর কাজ সে করবে না।
সে শুধু আমার আদেশ মেনে চলবে, আমার পার্সোনাল সব কাজ সে করবে।
আমার ছায়াতলে দাসীর মত বেঁচে থাকবে।
চারপাশের দাস-দাসীরা, অভিজাত মন্ত্রী আর প্রাসাদের পাহারাদাররা যেন এক মুহূর্তের জন্য শূন্য হয়ে গেল।
কেউ সাহস করল না কথা বলার।
কেউ চোখ তুলেও তাকাল না বাদশার চোখে।
সবাই শুধু চুপ…
কেননা তারা জানে—ওয়াজফান কোনো সাধারণ শাসক নয়।
তার রক্তে আগুন, তার ইচ্ছায় মৃত্যুর ছায়া।
কিন্তু… সেই নীরবতা ভাঙল এক অন্য দৃষ্টিতে।
সবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাইম।
তার চোখে আতঙ্ক, কিন্তু তাতে মিশে আছে এক কঠিন সংকল্প।
সে নিজের মনে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল—
দা, তুই যে খেলায় নেমেছিস…
সেটা আগুনের খেলা।
যে আগুনে শুধু তুই পুড়বি না…
তুই যে জীবনটা ভাঙতে চলেছিস,
সে জীবন আমার হৃদয়ের একান্ত প্রিয়…
আমি তোকে সেই জীবনটাকে ধ্বংস করতে দেব না।
যেভাবেই হোক, আমি কিছু একটা করব…
করতেই হবে।”
তার চোখে এখন আর ভয় নেই, কেবল এক যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি।
অদৃশ্যভাবে যেন সময়ের একটা মোচড় শুরু হলো, যেটা জ্যাইম আর ওয়াজফানের মধ্যে এক নীরব যুদ্ধের শুরু।
অন্যদিকে… অর্ষার কক্ষে—
মেঝেতে বসে ছিল সে, নিঃশব্দে।
আকাশের দিকে তাকানো জানালার ফাঁকে এক দাসী ঢুকল নিঃশব্দে, মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে গেল—
রানি… মানে… অর্ষা… আপনি এখন বাদশাহর একান্ত দাসী…
এই কথা এখন পুরো প্রাসাদ জানে।
কেউ আপনাকে ছুঁতেও পারবে না… আপনি শুধু তার… শুধু তার…”
কথা শেষ না করেই দাসী সরে যায়।
অর্ষার মুখ সাদা হয়ে যায়। ঠোঁট কেঁপে উঠে।
সে যেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না, কিছু অনুভবও করছে না।
তার কানে এখনো বাজছে রাতের সেই দৃশ্য…
ওয়াজফানের চোখ, তার স্পর্শ…
আর সেই ভয়াবহ চুমু—যেটা কোনো ভালোবাসার ছিল না, ছিল দখলের, ছিল দাসত্বের ঘোষণার মতো।
তার হাত দুটো ঠান্ডা। মুখ ঘামছে।
সে ফিসফিস করে নিজের মনেই বলে—
আমি তার সামনে যেতে চাই না…
না… আমি পারব না… আমি…”
কিন্তু এই প্রাসাদে কোনো ‘না’ চলে না।
এই প্রাসাদে ভালোবাসা নয়, চলে কেবল ‘আজ্ঞা’।
আর তার উপর এখন লেগে গেছে সেই রাজমোহর—দাসত্বের শিকল।
অর্ষা জানে, সে পালাতে পারবে না।
কিন্তু সে এটাও জানে—এই খাঁচা একদিন ফেটে যাবে, হয়তো ভেতর থেকে, হয়তো বাইরে থেকে।
আর তখন… হয়তো কোনো কেউ ঝড় হয়ে আসবে…
অথবা অর্ষা নিজেই হবে ঝড়ের জন্মদাত্রী।
দুপুরের রোদ তখন রাজপ্রাসাদের মার্বেল ফ্লোরে সোনালি আভা ছড়াচ্ছে।
ঘরের কোণে বসে আছে অর্ষা, নিঃশব্দে। চোখদুটি অন্যমনস্ক, যেন অনন্ত শূন্যতার মাঝে হারিয়ে আছে। সে নিজেকে ধরে রাখতে চাইছে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে যেন নিঃশব্দে জ্বলছে।
এই নিঃস্তব্ধতা ভাঙে এক দাসীর নরম পায়ের শব্দে।
দাসী নিচু গলায়, মাথা নিচু করে বলে উঠল—
মাফ করবেন রানি… মানে অর্ষা… বাদশাহ আপনাকে ডাকিয়েছেন।
গোসলের সময় হয়েছে। তার সবকিছু এখন থেকে আপনাকেই দেখতে হবে।
আপনি তার পার্সোনাল দাসী… তাই…”
শব্দগুলো শেষ হতেই অর্ষার বুক ধক করে ওঠে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যায়।
সেই পরিচয়ের ভার—”পার্সোনাল দাসী”—তার রক্তে যেন বিষ ঢেলে দেয়।
সে ধীরে ধীরে দাসীর দিকে তাকায়, চোখে লালচে জ্বালা আর অদ্ভুত এক শক্তির আভাস। এক মুহূর্ত যেন সে কাঁপছিল, পরক্ষণেই তার ঠোঁট কেঁপে উঠে, কিন্তু গলাটা দৃঢ়।
যাও… গিয়ে বলো তোমার সেই বাদশাকে—
আমি তার কাজ করব না।
আমি তার সামনে যেতে চাই না।
সে যে শাস্তি দিতে পারে, দিক…
কিন্তু আমি আমার আত্মাকে আর ছোট হতে দেব না।”
তার কণ্ঠে কোনো কান্না নেই, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন ঠাণ্ডা আগুনে পোড়া।
দাসী থমকে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায় অর্ষার দিকে।
কি বলবে বুঝতে পারে না। যে রাজপ্রাসাদে বাদশাহর হুকুমই শেষ কথা—সেখানে এই মেয়েটা এত সাহস কোথা থেকে পেল?
কিন্তু অর্ষার চোখে এমন কিছু ছিল যা সেই দাসী নিজের মধ্যেও খুঁজে পায় না—অভিমান, ঘৃণা… আর অদম্য আত্মসম্মান।
দাসী কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে সরে যায়। নিঃশব্দে রাজপ্রাসাদের করিডোর পেরিয়ে যায়, যেন তার পায়ে শেকল পড়ে আছে।
সে জানে, এখন তাকে সেই কথাগুলো পৌঁছে দিতে হবে—বাদশাহর কাছে।
আর তারপর… কি হবে, সেটা কেউ জানে না।
অর্ষা একা বসে থাকে। বাইরে রোদের ঝলকানি, ভেতরে আত্মার অন্ধকার।
দাসী থমথমে গলায় , অর্ষার বলা কথাগুলো ওয়াজ ফান এর কাছে পৌঁছে দেয়।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে তার গ্লাস নামিয়ে দাসীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। ঠোঁটের কোণে হালকা এক বাঁকা হাসি খেলে যায়, যেন তার ভিতরের আগুন দপদপ করে জ্বলছে।
“ঠিক আছে। তুমি যাও। আমি দেখছি—ব্যাপারটা।”
তার স্বরটা এতটাই ঠান্ডা, তবুও তাতে যেন ভয় ছড়িয়ে পড়ে। দাসী আর কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে চলে যায়।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে করিডোর পেরিয়ে যায় অর্ষার কক্ষের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু থামে, তারপর ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে দেয়। ভিতরে অর্ষা এক কোণে বসে আছে, চোখে একধরনের আত্মবিশ্বাস আর সাহস নিয়ে।
ওয়াজফান কোনো শব্দ না করে ঘরে ঢুকে পড়ে। অর্ষা চমকে তাকায়, কিন্তু উঠে দাঁড়ায় না।
সে এক ঝটকায় অর্ষার হাত টেনে তুলে দাঁড় করায়। তারপর তার দুই হাত শক্ত করে ধরে কোমরে জড়িয়ে নেয়। পুরো শরীরটা নিজের দিকে এমনভাবে টেনে আনে, যেন একটুও দূরত্ব সহ্য করতে পারছে না।
ফিসফিস করে বলে ওঠে,
“আমার আদেশ অমান্য করার সাহস দেখিয়েছো? কী শাস্তি দেওয়া উচিত বলো তো? যেটা আমি চাই, সেটাই তো পাবে… তাই না?”
তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁট এগিয়ে যায় অর্ষার ঠোঁটের দিকে।
অর্ষার মাথায় কাল রাতের কথা স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে— এবার তার মুখে ফুটে ওঠে ভয়, আতঙ্ক, আর সেই অপ্রতিরোধ্য ছায়া।
সে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে।
সে কাপা গলায় বলে ওঠে,
“না… না… আমি করব, সব করব! আপনি যা বলবেন তাই করব, দয়া করে… দয়া করে থামুন!”
কিন্তু ওয়াজফান থামে না।
সে তার ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় অর্ষার ঠোঁটে—এইবার আরও গভীর, আরও আগ্রাসীভাবে। ঠোঁটের মধ্যে ক্রোধ, মালিকানা, আর এক অন্ধ আবেগ মিশে যায়। অর্ষা যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়।
তারপর কিছুক্ষণ পর ঠোঁট আলগা করে ওয়াজফান খুব কাছ থেকে ফিসফিস করে বলে,
“এই শাস্তিটা শুধু আমাকে এখানে আনানোর জন্য। যদি দাসীর কথা মেনে ভালোভাবে চলে আসতে, তাহলে আমি আসতামও না। কিছু করতামও না।”
তার কণ্ঠে কোনো অনুশোচনা নেই—আছে শুধু মালিকানার দাবি, একরোখা কর্তৃত্ব।
“এখন চলো। আমার রুমে।”
বলেই কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করে, তার হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যায় নিজের কক্ষে।
দরজা বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় তাকে ঠেলে দাঁড় করায় আলমারির সামনে।
তার কণ্ঠে কোনো কোমলতা নেই—আছে শুধু নিঃশব্দ নির্দেশের তীব্রতা।
“আমার গোসলের পোশাক বের করে দাও। আর গোসলখানাটা ঠিকঠাক সাজিয়ে দিয়ে এসো—গরম পানি, তোয়ালে, সব যেন থাকে।”
অর্ষা কিছু না বলে নিচু মাথায় আলমারির দরজা খুলে গুছিয়ে গুছিয়ে একজোড়া পোশাক বের করে। তারপর দ্রুত গোসলখানার দিকে যায়। তোয়ালে ঝুলিয়ে দেয়, গরম পানির ট্যাপ চালু করে দেয়, সাবান-শ্যাম্পু সব ঠিকঠাক জায়গায় রেখে আবার ফিরে আসে।
সে যখন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যেতে চায়, তখন পেছন থেকে ওয়াজফানের তীব্র কণ্ঠ শুনে তার পা আটকে যায়।
“আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি? তাহলে যাচ্ছ কেন?”
অর্ষা থমকে দাঁড়ায়। তার হাতটা তখনও দরজার হ্যান্ডলে।
“এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি গোসল শেষ করলে যেতে বলব, তখন যাবে।”
ওয়াজফান ধীরে ধীরে তার রাজকীয় জামাটা খুলতে শুরু করে। ভারী জরি-করা কুর্তা খুলে বুকের উপরিভাগ নগ্ন করে ফেলতেই অর্ষা চমকে ওঠে।
সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় করে বলে ওঠে,
“আপনি কী করছেন! ছি… ছি! আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, দেখতে পাচ্ছেন না?”
ওয়াজফান মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়, ঠোঁটে চিরচেনা সেই হালকা ঠাণ্ডা হাসি।
“তো কী হয়েছে? দেখছো তো, চোখ বন্ধ করে নাও। আমি তো বলিনি তুমি দেখো… আমি শুধু বলেছি, তুমি এখানে থাকবে।”
তার ঠাণ্ডা দম্ভ যেন কানে কাঁটা হয়ে বাজে অর্ষার কাছে।
ওয়াজফান আর কোনো কথা না বলে পোশাকটা খুলে একপাশে রাখে, তারপর নিঃশব্দে চলে যায় বাথরুমের দিকে।
অর্ষা তখন অসহায়ভাবে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করে, ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে ওঠে বিড়বিড় করে—
“আগে ভেবেছিলাম লোকটা হৃদয়হীন… এখন বুঝছি—নির্লজ্জ, বেহায়া, উগ্র। একদম ভয়ঙ্কর!”
তার হাত দুটো কাঁপছে একটু একটু করে। ভিতরে ভিতরে একধরনের অদ্ভুত ঝড় চলছে তার মধ্যে—ভয়, রাগ, অপমান আর এক টুকরো অজানা অনুভব, যার নাম সে জানে না।
পেছনের দিকে গোসলের পানির শব্দ, আর অর্ষার মনে ক্রমাগত বাড়তে থাকা টেনশন যেন এক নিঃশ্বাসে আটকে থাকে ঘরের বাতাসে।
কিছুক্ষণ পর বাথরুমের দরজাটা খোলে।
ভিজে ভিজে চুলগুলো একটু এলোমেলো, চোখে অদ্ভুত এক ঘোলাটে গভীরতা। ফর্সা সুঠাম শরীরে এখনো পানির ফোঁটা ঝরে পড়ছে। বুকের ওপর থেকে পানির রেখাগুলো যেন তার শক্ত শরীরের বাঁক ধরে নিচে গড়িয়ে যাচ্ছে।
ওয়াজফান ধীর পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে আসে।
অর্ষার চোখ পড়তেই থেমে যায়। সে অপলক তাকিয়ে থাকে।
“জিন হয়েও এত সুন্দর!”
সে নিজেকে সামলাতে পারে না—মনে মনে বিড়বিড় করে ওঠে,
“ভূতের মতো ভয়ংকর হয়ে থাকবি, কিন্তু এতটা… এতটা সুন্দর? এটা কীভাবে সম্ভব?”
তার দৃষ্টি যেন আটকে যায় সেই ভেজা বুক, ভিজে চুল আর চোখের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
হঠাৎ সেই দৃষ্টি ছিন্ন করে ওয়াজফানের কণ্ঠ শুনতে পায়—ঠাণ্ডা কিন্তু তাতে মিশে থাকা নিখাদ উপহাস।
“কিছুক্ষণ আগেও কে যেন মুখে মুখে কথা বলছিল—আর এখন নিজেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে!”
অর্ষা যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ খেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। নিজের মুখেই নিজেকে গালি দেয়,
“উফ্, কি করছিস তুই অর্ষা! এই রাক্ষসটার দিকে কি এভাবে তাকাতে আছে তোর?”
সে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে আসে।
আমি… আমি কাউকে দেখছিলাম না! আপনি তো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই দেখা হয়ে গেছে… মানে… না, মানে আমি কারো দিকে তাকাইনি!”
ওয়াজফান এর কণ্ঠে খুশির শয়তানি ভর করে।
ওয়াজফান হালকা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে,
“তাহলে এই চোখ দুটো এত বড় বড় করে উঠল কেন, বলো তো? যা হোক… আমার পোশাকটা আমাকে পরিয়ে দাও।”
অর্ষা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় তার দিকে। মুখ খুলে কিছু বলতে গিয়েও শব্দ আটকে যায় গলায়। সে জানে, কিছু না করলে ওয়াজফান তার সীমা অতিক্রম করতে দ্বিধা করবে না। আবার সেই ঠোঁট… সেই শাস্তি।
নিঃশব্দে, লজ্জা চেপে সে ধীরে ধীরে ওয়াজফানের পোশাক হাতে তুলে নেয়। একপা করে এগিয়ে এসে তার হাত গলিয়ে পরিয়ে দিতে থাকে।
ওয়াজফান একটুও নড়ছে না। যেন সে উপভোগ করছে অর্ষার হাতের ছোঁয়া, তার লজ্জা, তার স্পর্শের কাঁপুনি।
পোশাকটা পুরো পরিয়ে দেওয়ার পর, অর্ষা তাড়াতাড়ি পেছনে সরে আসে। তার হৃদস্পন্দন এত জোরে, যেন কেউ পাশে দাঁড়িয়ে শুনলেই বুঝে ফেলবে সে কতটা অস্বস্তিতে আছে।
“হয়ে গেছে… আমি যাচ্ছি!” — এতটুকুই বলে সে দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
পেছনে দাঁড়িয়ে ওয়াজফান ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নেয়।
সে বিড়বিড় করে বলে,
“এভাবেই ধীরে ধীরে তোমার সব ছিনিয়ে নেব তোমাকে টাইম দিচ্ছি গুছিয়ে নাও নিজেকে কারণ এরপর আমার অধিকার চলবে শুধু তোমার দেহের প্রতিটা খাঁচায় খাঁচায়।
সময় এক অদ্ভুত জিনিস—কখনও নিঃশব্দে বয়ে যায় ঝর্ণার মত, আবার কখনও তার ভারে মানুষ ধীরে ধীরে দমে যায়।
অর্ষার জীবনে এই কয়টা দিন ঠিক সেরকমই কেটেছে—নিঃশব্দ, ধূসর, আর অজানা এক অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
সে জানালার ধারে বসে থাকে অনেকক্ষণ ধরে, যেন তার মনটা কাচের ফ্রেম পেরিয়ে অনেক দূরে কোথাও পাড়ি জমিয়েছে। জানালার ওপাশে কিছু পাখি ডাকছে, আকাশের মাঝে আলোর রেখা পড়েছে, কিন্তু তার মনে আলো পড়েনি বহুদিন।
হাতে বই, কিন্তু পাতাগুলো আর পড়ে না। চোখ চলে যায় শূন্যে। মনে পড়ে যায় সেই রাতগুলোর কথা, সেই ঠোঁটের ছোঁয়া, যা শাস্তির আকারে তার উপর নেমে আসে।
আগে অন্তত ওয়াজফানের রাগে সে নিজেকে প্রতিরোধ করত। মাথা উঁচু করে বলত,
“তোমার কাছে মাথা নত করবো না!”
তখন আঘাত আসত… হাতের শক্তিতে, কথার কাঁটায়। কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে লড়াই করার সাহস ছিল।
এখন?
ওয়াজফানের শাস্তি পাল্টে গেছে।
সে এখন আর চিৎকার করে না, আঘাত করে না।
তবে তার ঠোঁট, তার চোখ, তার ঘন নিঃশ্বাস—এসব দিয়েই সে দখল করে অর্ষাকে। প্রতিবার তার ঠোঁট নামিয়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে যে দৃষ্টি ফেলে, তা আগুন নয়—বরং বিষের মত। ধীরে ধীরে গলে যায় মনের প্রতিরোধ।
অর্ষা এখন আর তেমন করে বাধা দেয় না।
তাকে রক্ষা করার কেউ নেই।
এই রাক্ষসটা জিন—শুধু দেহে না, মস্তিষ্কেও।
একটা অতিপ্রাকৃত শক্তি, যা শুধু তাকে নয়, তার আশেপাশের মানুষগুলোকেও পরিবর্তন করে দিতে পারে ।
তার বুকের ভিতর কেবল একটা ভয়—
“যদি সে সত্যিই একদিন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন আমাকে কে বাঁচাবে?”
জ্যাইম…
হ্যাঁ, সেই যে তার ছায়ার মত ছিল…
কিন্তু আজকাল সে আর কথা বলে না আগের মতো।
সেদিনের সেই ভুলের পর অর্ষা অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে। চোখে জল এনে বলেছে,
“ভুল হয়ে গেছে, বিশ্বাস করো…”
জ্যাইম শুধু হাসে একপাশে তাকিয়ে, আর বলে—
“ঠিক আছে, মাফ করে দিয়েছি।”
কিন্তু সেই হাসিতে ছিল না আগের কোমলতা, ছিল না আত্মার সখ্য।
এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে ওদের মাঝে।
অর্ষার মনে হয়, সে একা। নিঃসঙ্গ। পরিত্যক্ত।
সন্ধ্যার আলো নিভে আসে ঘরে। কাচের জানালায় তার মুখ পড়ে ছায়া হয়ে। সে চেয়ে থাকে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে—এক অচেনা মেয়ে, যার চোখে এখন জল নয়, বরং চাপা রাগ, একরাশ ক্লান্তি আর কিছুটা হাল ছেড়ে দেয়া ভাব।
হঠাৎ তার মনে হয়,
“না, আমি যদি এখানেই পড়ে থাকি, তবে একদিন আমিই নিজেকে হারিয়ে ফেলব।”
পালাতে হবে।
কিন্তু কীভাবে?
ওয়াজফান তার গতিবিধির ছায়াও টের পায়। এই ঘরে, এই প্রাসাদে, এমনকি বাইরে ওই জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই। দাসদাসী—সবাই যেন ওয়াজফানের হয়ে নজর রাখে।
তবু তার মন বলে,
“যত অন্ধকার গভীর হোক, এক ফোঁটা আলো ঢুকবেই কোনোদিন।”
সে শীতল মেঝেতে বসে থাকে, পেছনে জানালার কাঁচে রাতের প্রথম তারা। ঠোঁট থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে ছোট্ট একটি নাম—
“জ্যাইম…”
সে জানে, যদি কেউ তাকে ফেরাতে পারে তার ছায়া থেকে আলোয়, তবে সেটা সে-ই।
তবে সেই আলো এখন দূর, অনেক দূর…
তবুও অপেক্ষা করে সে। কারণ অর্ষা এখনো পুরোপুরি ভাঙেনি।
শুধু একটু…
শুধু একটু ফাটল ধরেছে তার সাহসের প্রাচীরে।
এখন দেখার বিষয়—সে নিজেকে জোড়া দিতে পারবে, না ধসে পড়বে এই অদৃশ্য শেকলের নিচে।
এরপর হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগে—
“ওই দানবটা আমার সাথে এমন কেন করে? সে কি আমাকে ভালোবাসে? নাকি কেবলমাত্র ভোগ করতে চায়?”
মাথা নিচু করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকের ভেতর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস, দেহ কাঁপছে দোটানায়।
“ভোগ করতে চাইলে তো এতদিনে… জোর করেই পারত… আমার শরীরটাকে ছিঁড়ে ছুঁড়ে শেষ করে ফেলত। কিন্তু না—সে কখনো কিস ছাড়া কিছুতেই জোর করেনি।
অর্ষার ভ্রু কুঁচকে আসে।
“তবে কি সে ভালোবাসে?”
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে সে আবার বিরক্ত হয় নিজের উপর—
“না না! হৃদয় তো তার নেই! তার ভেতরে কি আদৌ ভালোবাসা বলে কিছু আছে? সে তো মানুষ সহ্য করতে পারে না—ঠাণ্ডা রক্তের জিন দানব যেন! তাহলে আমাকে ভালোবাসবে কেন?”
তবুও আবার ভাবনায় টেনে আনে এক প্রশ্ন—
তবে কেন সে আমায় আটকে রেখেছে এই অন্ধকার প্রাসাদে? আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে কেন?
একটা গভীর শ্বাস ফেলে অর্ষা, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়াটাও যেন তার সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
যদি আমি শুধু ভোগ্য বস্তু হতাম, তাহলে এতটা গুরুত্ব দিত না। আমি না চাইলে সে কখনো ছুঁয়েছে কি? না শুধু ঠোঁট ছোঁয়া ছাড়া কোথাও টাচ করেনি বাজেভাবে। তার চোখের ভাষা পড়া যায় না, কিন্তু মাঝে মাঝে সেগুলো এমন কিছু বলে… যা আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
অর্ষা জানে—ভয় আর মোহ একসঙ্গে কাজ করছে তার ওপর। সে জানে, এই টানাটানির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের আত্মপরিচয়।
সে জানে না, এই দানবটা কি তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়? নাকি এক ভয়াল প্রেম যার মোহ কাটিয়ে বাঁচা অসম্ভব?
তার ভাবনার মাঝে হঠাৎ কোলাহল ভেসে আসে বাইরে থেকে,
“ভাবি রানী এসেছেন! ভাবি রানী এসেছে!”
“চলো, সবাই চল স্বাগতম করতে!”
বাইরে থেকে দাস-দাসীদের হাঁকডাক, খুশির ছায়া ঘিরে ফেলে মহলটাকে।
‘ভাবি রানী’—এই শব্দদুটো যেন বিদ্যুতের মতো কেঁপে দিয়ে যায় অর্ষাকে।
তার বুক ধক করে ওঠে।
ভাবি রানী… মানে তো… ওয়াজফানের বউ?
Death or Alive part 14
না না, এটা তো অসম্ভব!
অর্ষার মন এলোমেলো হয়ে যায় মুহূর্তেই।
এক ঝড় বইতে থাকে তার ভিতরে—
“সে কি আমাকে আটকে রেখে, অন্য কাউকে বিয়ে করল? তবে আমি কে? কেন আমায় বন্দি করে রেখেছে এভাবে? আমি কি তবে কেবল একটি খেলনা? এক বন্দিনী? আর আমি ভাবলাম সে আমায় ভালোবাসে।
