Death or Alive part 17

Death or Alive part 17
priyanka hawlader

কোহে কাফের সকাল।
এক রহস্যময় সকাল—আলো আছে, তবুও নেই।
সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার কিরণ যেন পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ফিরে গেছে।
সমগ্র অঞ্চল যেন এক ফর্সা কুয়াশার চাদরে ঢাকা।
সবকিছু ঝকঝক করছে হিমস্নাত কণায়, অথচ রৌদ্রের উষ্ণতা নেই কোথাও।
আকাশের ধূসরতায় পাখিরা আজও চুপ।
গাছে পাতাগুলো কাঁপছে হাওয়ায়, যেন তারা জানে—এই দিন অন্য রকম।
আর সেই নিঃস্তব্ধ পাহাড়ঘেরা রাজ্যে—
রাজসভায় দাঁড়িয়ে আছেন ওয়াজফান।
গভীর চোখ, দৃঢ় মুখ, কালো রক্তজবা চরণে গাঁথা মুকুট পরা সেই পুরুষ,
যার কণ্ঠ একবার উঠলেই আকাশ থমকে দাঁড়ায়।
রাজ্যজুড়ে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়—

“প্রস্তুত হও! এখনই আমরা যুদ্ধের জন্য রওনা হব।
ওই রাজ্য… যারা আমাদের অপমান করেছে,
যারা আমাদের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে—
তাদের আমরা ছারখার করে দেব।
সবাইকে মেরে, ধ্বংস করে, জ্বালিয়ে…
তবেই ফিরব আমরা।”
তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ যেন বজ্র হয়ে আছড়ে পড়ে মেঝেতে।
যোদ্ধারা মাথা নিচু করে সম্মতি জানায়।
তাদের চোখে আগুন, শরীর জেগে উঠেছে রক্তস্নাত যুদ্ধের তৃষ্ণায়।
কোনো দ্বিধা নেই।
সেই মুহূর্তে দু’জন ঘোড়সওয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়
আয়রাক—যে রক্তের মতোই নিষ্ঠুর, আর
জ্যাইম—যার তলোয়ার কথা বলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তারা দাঁড়িয়ে পড়ে ওয়াজফানের ডান-বাঁ পাশে।
তাদের চোখে ভয় নয়, বরং এক অদ্ভুত উত্তেজনা।
এ যেন শুধু রাজাধিরাজের আদেশ মানা নয়,
বরং এক অন্ধ বিশ্বাস—বিনাশেই মুক্তি।
ওয়াজফান সবার দিকে তাকিয়ে বলে—
“আজকে শুধু যুদ্ধ নয়—আজ এক ইতিহাস রচিত হবে।”
তার চোখে এক অদ্ভুত আগুন।
যেন আজকের যুদ্ধ শুধু বিজয়ের জন্য নয়,
কারো প্রতি ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর অভ্যন্তরের অশান্তির মুক্তি।
ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে দূরে।

সামনের ফটকে পত পত করে উড়ছে রাজ্যের নিশান—কালো পটভূমিতে আগুনরঙা চিহ্ন।
যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। রাজপ্রাসাদের প্রতিটি অলিন্দে এক রকম চাঞ্চল্য—যেন বাতাসেও গন্ধ লেগে আছে রক্তের। ঠিক সেই সময়, যখন সমস্ত সৈনিকরা নিজেদের অস্ত্র ও সাজপোশাকে সজ্জিত, ওয়াজফান চুপিচুপি চলে আসে রাজপ্রাসাদের একান্ত নিঃশব্দ কক্ষে—অর্ষার ঘরে।

পুরো রাত সে আসেনি আর একবারো। কিন্তু এখন চলে যাবে বহুদূর, সেই অনন্ত যুদ্ধভূমির দিকে। ফিরবে কি আদৌ? জানে না। তাই প্রাসাদের রক্ষীদের বলে দিয়েছে—এই মানবকন্যা যেন এক মুহূর্তের জন্যও কারও চোখের আড়ালে না যায়। যেন সে সুরক্ষিত থাকে। তবে আদৌ কি তা নিরাপত্তা? নাকি কোনো গোপন বন্দিত্ব?
কক্ষে প্রবেশ করেই তার চোখে পড়ে, অর্ষা বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটি হাত বুকের কাছে, এক ভাঁজে ঠোঁট, কপালে এলোমেলো কিছু চুল। এমন শান্ত আর নিরীহ মুখ, যেন কেউ কোনোদিন কষ্ট ছুঁয়ে দেখেনি।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, শব্দহীন পায়ে। বিছানার পাশে এসে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে তার মুখের দিকে। মুখটা ঠিক যেমন ছিল প্রথম দেখা সেই রাতে—ভয়, অবাক আর সাহস মেশানো চোখদুটি এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে।

তারপর সে ধীরে অর্ষার কপালের কাছে ঝুঁকে পড়ে। একটুকরো নিঃশব্দ চুমু—কোনো ইচ্ছের নয়, যেন এক অদ্ভুত তৃষ্ণার নিবেদন।
চোখে এক বিষণ্ণ দীপ্তি নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।
শেষবারের মতো অর্ষার দিকে ফিরে তাকায়।
ওয়াজফান মনে মনে বলে — এই দুনিয়াকে জয় করে ফিরব। তোর জন্যই ফিরব।
তারপর, ওয়াজফান নীরবে কক্ষ ত্যাগ করে—কোহে কাফের দিগন্তের ওপারে অপেক্ষমাণ যুদ্ধের দিকে।

মৃদু বাতাসে জানালার পাশে রাখা পর্দা দুলছিল ধীরে ধীরে। সেই হাওয়ার ছোঁয়ায় অর্ষার ঘুম আস্তে আস্তে ভাঙে। ঘুম জড়ানো চোখে ছাদে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পড়ে থাকে সে। মনটা আজ যেন একটু হালকা, একটু উদাস।
ঠিক তখনই কাঠের দরজায় ধীরে ধীরে শব্দ হয়, এবং এক দাসী নিচু স্বরে বলে ওঠে,
— “ম্যাম, আপনি জেগে উঠেছেন?”
অর্ষা আস্তে উঠে বসে, দৃষ্টি স্থির করে দাসীর দিকে তাকায়।
দাসী নিচু হয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বলে,
— “আজ থেকে আপনাকে আর কোনো কাজ করতে হবে না, ম্যাম। আপনি তো এখন বাদশাহ হুজুরের নিযুক্ত দাসী… আর তিনি তো আজ প্রাসাদে নেই। রাজ্যরক্ষার জন্য গেছেন যুদ্ধে। তাই আপনার ওপর আর কোনো দায়িত্ব নেই আজ।

অর্ষার হৃদয়ে যেন এক অনাবিল প্রশান্তি নেমে আসে। চোখে মৃদু হাসির রেখা খেলে যায়।
সে মনে মনে ভাবে, “যাক… অবশেষে একটু নিঃশ্বাস ফেলার মতো সময় পেলাম। যুদ্ধ, রাজনীতি, হুকুম — এসবের মাঝে আমার নিজের মনের কথা বলারও সময় ছিল না। আজ অন্তত নিজের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে পারবো।”
সে ধীরে ধীরে চুলগুলো এক পাশে সরিয়ে বলে,

— “তুমি একটা কথা বল দাসী… ইসাবেলা কোথায়? আমি ওর সাথে একটু কথা বলবো বলে ভাবছিলাম।”
দাসী একটু ইতস্তত করে বলে ওঠে,
— “প্রিন্সেস ইসাবেলা আজ প্রাসাদে নেই । তিনি সকালে তাঁর পিতার সঙ্গে বাইরে গেছেন। কোথায় গেছেন তা বলা হয়নি। আজ প্রাসাদ অনেকটাই খালি। শুধু আমরা দাস-দাসী আর কিছু প্রহরী রয়েছি।”
অর্ষার চোখে একটুখানি শূন্যতা ভেসে ওঠে।
সে নিচু স্বরে বলে,
— “আচ্ছা, ঠিক আছে… তুমি যাও।”
দাসী বিনীতভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রস্থান করে।
অর্ষা জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। দূরের আকাশটা নীলচে সোনালী রঙে রাঙানো। পাখিরা দূরে উড়ে যাচ্ছে দল বেঁধে, যেমন ভাবে সে একদিন উড়ে যেতে চেয়েছিল নিজের মুক্তির খোঁজে।
আজকের এই নিঃসঙ্গ সকাল যেন অর্ষার অন্তরের কল্পলোকের সাথে সুর মিলিয়ে যাচ্ছে। কারও হুকুম নেই, কারও নজরদারি নেই—একটা নিঃশব্দ স্বাধীনতা।
তবু সেই স্বাধীনতাও কেমন যেন একলা, কেমন যেন শূন্য।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ষা। হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে, সে নিঃশব্দে বাইরের তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল, হৃদয়ের অতল থেকে কোনো অজানা চিন্তা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, দূর থেকে একধরনের হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ কানে আসে। প্রাসাদের দিক থেকে আসা সেই আওয়াজ যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
অর্ষা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এরপর নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে আসে প্রাসাদের করিডোরে। তার পায়ের নরম চলাফেরাতেও অনুভব করা যাচ্ছিল, বাতাসের মাঝে যেন এক অশুভ স্নিগ্ধতা ভর করেছে।
সামনের খোলা চত্বরে এসে দাঁড়াতেই তার চোখ আটকে যায় এক ভয়াবহ দৃশ্যের উপর। রাজপ্রাসাদের বাহিরে কিছু অজ্ঞাত লোক প্রহরীদের সঙ্গে রীতিমতো ধস্তাধস্তি করছে। তরবারির ঝলকানি, ধাতবের ঠোকাঠুকি আর প্রচণ্ড চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

অর্ষা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
কিন্তু ঠিক তখনই… তার সামনে এসে দাঁড়ায় এক অচেনা-চেনা ছায়াময় মুখ।
তার দৃষ্টি ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে সেই চেনা চোখে, সেই গভীর অথচ স্থির দৃষ্টিতে, যে চোখ একদিন তাকে অন্য এক রহস্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
সেই চোখ আজও তেমনই আগুনে, তেমনই অভ্রান্ত।
“ক্যালিয়ন!” – অর্ষার ঠোঁট ফিসফিস করে উঠে।
তার বুক ধক ধক করতে থাকে। কীভাবে? কিভাবে সম্ভব? এই রাজ্যের সমস্ত পথ যে এখন বন্ধ। প্রহরার পর প্রহরা। তবুও… ক্যালিয়ন এসেছে। এই বিপদের ভেতর, এই ভয়াবহ মুহূর্তে ঠিক তার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে।
সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। পেছনে যুদ্ধের গর্জন, সামনে সেই চিরচেনা আগুন-চোখের পুরুষ।
তার অস্তিত্ব কাঁপে, হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা সব ভয়, ও প্রশ্ন যেন একসাথে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
অর্ষা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্যালিয়নের চোখে। ক্যালিয়নও চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যেন হাজার কথার ভাষাহীন উচ্চারণ।
দূরে তখনও লড়াই চলছে।
কিন্তু ঠিক এই দু’জনের মাঝে—সময় যেন থেমে গেছে।
কিছুক্ষণ আগে,

ক্যালিয়নের চোখ ছিল নির্ভীক, সিদ্ধান্তে অটল। রাজসিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে সে বলছিল,
— “ড্যানিয়েল, আজ সেই দিন… আজ কোহে কাফ পাহাড় পেরিয়ে পারস্য রাজ্যে প্রবেশ করব। রাজ্য এখন প্রায় খালি, ওয়াজফান যুদ্ধে গেছেন। এই সুযোগ আর পাব না। সময় এসেছে তাদের গর্ব ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার। তৈরি হও।
ড্যানিয়েল মাথা নোয়ায় সম্মানের সঙ্গে। মুহূর্তেই ঘোড়ার পিঠে ঝাঁপিয়ে ওঠে তারা। ক্যালিয়নের চোখে তখন বিজয়ের আগুন, কিন্তু সেই আগুনের নিচে যেন জমাট বাঁধা আরেক অনুভূতির ছায়া—একজনের মুখ, হৃদয় থেকে কখনও মুছে ফেলতে পারেনা যাকে।
প্রবেশ ঘটে পারস্যের অন্তঃপুরে।

যেখানে নীরবতা ছিল শাসকের অনুপস্থিতির, সেখানে আচমকা শুরু হয় ঝড়।
প্রহরীরা বাধা দিতে আসে—তাদের চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে শঙ্কা। কিন্তু ক্যালিয়ন থেমে থাকে না।
নিজের দুই হাতে ছুরি চালিয়ে একের পর এক প্রহরীকে নিস্তব্ধ করে দিতে থাকে সে।
চারদিকে রক্তের ছিটেফোঁটা, চিৎকার, ধ্বংসের শব্দ।
কিন্তু হঠাৎই সময় থেমে যায় তার জন্য।
এক নারী দাঁড়িয়ে আছে স্থিরভাবে।
অর্ষা।
চোখে অবিশ্বাস, কপালে ভাঁজ, ঠোঁটে জিজ্ঞাসা—সে তাকিয়ে আছে, ক্যালিয়নের দিকে।
ক্যালিয়নের বুক ধকধক করতে থাকে।
যেন পুরোনো ক্ষতগুলো হঠাৎ খোলা আকাশে তীব্র আলোয় ফেটে গেছে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, চোখ তার অর্ষার চোখে নিবদ্ধ। যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ নিঃশব্দ হয়ে গেছে কেবল এই দু’জনের মাঝে।

অর্ষা ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে…
কিন্তু ক্যালিয়ন এক ধাক্কায় সামনে আসে, তার আঙুল ছুঁয়ে যায় অর্ষার ঠোঁটে।
চুপ,” চোখের ভাষায় বলে ওঠে সে,
এখন কিছু বলো না… শুধু থাকো আমার কাছে।
সঙ্গে সঙ্গে সে জড়িয়ে ধরে অর্ষাকে, এমন এক শক্ত ভালোবাসায়, যেন শতাব্দীর অপেক্ষা এক মুহূর্তে ফেটে বেরিয়ে এসেছে।
ক্যালিয়নের বুকের মধ্যে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরা যেন এক রকমের দাবি—অত্যন্ত দৃঢ়, একরোখা, এবং অস্বস্তিকর।
সে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যেন অর্ষাকে নিজের শরীরের ভেতর মিশিয়ে ফেলবে।
অর্ষা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্বস্তি দানা বাঁধছে।

এই ছোঁয়াটা—যা একসময় হয়তো তার ভালো লাগত—আজ বড় অচেনা, বড় অজানা ঠেকছে।
হৃদয়ের গভীর থেকে যেন একটা নীরব প্রতিবাদ উঠে আসছে, কিন্তু সে তার কারণ বুঝে উঠতে পারছে না।
একটা সময় সে নিজে তাকে পছন্দ করেছিল তবে আজ তার ছোয়া কেমন যেন ভিতর থেকে অস্বস্তি ফিল করছে।
একসময় ধীরে ধীরে, একদম হালকা ভঙ্গিতে অর্ষা তার হাত দিয়ে ক্যালিয়নকে ঠেলে সামান্য দূরে সরে আসে।
চোখে একরাশ দ্বিধা, ঠোঁটে শব্দহীনতা।
তারপর এক ফাঁকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
তুমি এখানে এলে কীভাবে? এখানে তো সাধারণ কোনো মানুষ ঢুকতেই পারে না… আর তুমি তো পুরো একটা দল নিয়ে এসেছো। এই রাজপ্রাসাদে কীভাবে এলে?”

ক্যালিয়নের চোখে ক্ষণিকের বিস্ময়, তারপর গভীর একটা প্রশ্রয়।
সে অর্ষার দিকে এগিয়ে আসে, তার হাত ধরে আবারও বলল:
সব বলব তোমায়, অর্ষা। কিন্তু এখন সময় নেই। আগে চল।
আমাদের ফিরে যেতে হবে… আমি এসেছি তোমায় নিয়ে যেতে।
আমাদের নিজের দুনিয়ায়।
অর্ষার চোখে এক ঝলক বিস্ময় জ্বলে ওঠে।
‘নিজেদের দুনিয়া’—মানে কি সে তাকে মা–বাবার কাছে নিয়ে যাবে?
এই আশাটুকুই বুকের মধ্যে চেপে ধরে সে ধীরে ধীরে ক্যালিয়নের হাত ধরে নেয়।
দুই হাতে বাঁধা এক অজানা যাত্রার শুরু হয়।
পেছনে পড়ে থাকে রাজপ্রাসাদের অলিন্দ, অদ্ভুত রহস্যের দেয়াল,

অর্ষা ক্যালিয়নের শক্ত হাত ধরে রাজপ্রাসাদের প্রশস্ত করিডোর পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল। চারপাশে দাস-দাসীরা অবনত দৃষ্টিতে সরে যাচ্ছিল তাদের পথ থেকে। কেউ আটকানোর সাহস দেখাচ্ছে না কারণ প্রহরীরা অনেকেই মরে পড়ে আছে অনেকে আহত হয়ে পড়ে আছে। অর্ষার মুখে নিরবতা, চোখ দুটো অদ্ভুত রকমের স্থির। হঠাৎই সে থেমে দাঁড়ায়।

পিছন ফিরে তাকায়—অবাক নয়নে, নিঃশব্দে। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে শেষবারের মতো আঁকতে চাইছে সেই অচেনা, অথচ অজান্তেই হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া আবরণবিহীন রাজপ্রাসাদকে। চোখের সামনে অন্ধকার পাথরের তৈরি সেই উচ্চ মিনার, রূপালি রেলিংঘেরা বারান্দাগুলো, গোলাকার ছাদগুলো সব এক অদ্ভুত ব্যথা হয়ে জমা হচ্ছে বুকের বাঁ পাশে।
কেন যেন যেতে ইচ্ছে করছে না তার। বুকের গভীরে অজানা এক হাহাকার! এমন তো কথা ছিল না। নিজেই তো বহুবার ভেবেছে, কল্পনায় এঁকেছে মুক্তির সেই শুভক্ষণটিকে—যখন সে এই অন্তরাল ছেড়ে মুক্ত বাতাসে পা রাখবে। তবে আজ কেন এত দ্বিধা? আজ তো তার মুক্তির দিন। আজ তো সে স্বাধীন হচ্ছে।

তবুও… কেন মনে হচ্ছে যেন নিজেরই কোনো অচেনা টুকরো ফেলে যাচ্ছিল এখানে? কেন মনে হচ্ছে যেন এই প্রাসাদের কোনো এক করিডোরে, কোনো নিঃসঙ্গ ছায়ায় তার কোনো এক জন্মের অতীত আটকে রয়ে গেছে?
হঠাৎ চোখে ধরা পড়ে এক নিস্তব্ধ বারান্দা—সেখানে কেউ নেই, কিন্তু সেই শূন্যতাতেও যেন কারও উপস্থিতি স্পষ্ট। হাওয়ার ঝাপটায় পর্দা একবার উড়ে ওঠে, যেন কেউ তাকে বিদায় জানাতে চায়… না কি আটকে রাখতে চায়?
ঠিক তখনই ক্যালিয়নের কণ্ঠ ভেসে আসে, “কি হলো, দাঁড়িয়ে গেলে কেন? চলো।”
অর্ষা ধীরে মাথা নাড়ে, একবার নিজের অজানা যন্ত্রণাকে গিলে ফেলে, তারপরে ক্যালিয়নের সঙ্গে এগিয়ে যায়—কিন্তু পেছনে পড়ে থাকে এক অচেনা ব্যথা, এক অসম্পূর্ণ অনুভব, এক অদৃশ্য ছায়া।
সেই মুহূর্তে হয়তো সে নিজেও জানে না—এই যাত্রা শেষ নয়। এ তো কেবল শুরু।

নিঃশব্দে ভেসে আসা হাওয়ার মতো ক্যালিয়ন এসে দাঁড়ায় নিজের রাজপ্রাসাদের সামনে। তার ডান হাতের মৃদু টানেই অর্ষা যেন স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে। চোখ তুলে তাকায় সামনের সেই অট্টালিকার দিকে—যেটি ঘিরে আছে অন্ধকার বনের গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। কিন্তু এই নীরবতা ছিল না শান্তিময়; বরং অদৃশ্য কিছু ছায়া যেন দেয়ালের গায়ে গায়ে হাঁটছে, জানালার কাচের ওপাশে কার যেন চাহনি ঘোরাফেরা করছে।
অর্ষা বিস্ময়ে শ্বাস রুদ্ধ করে তাকিয়ে থাকে চারদিকে—এই প্রাসাদ তো… ঠিক যেন তার সেই জিনদের রাজ্যর মতই শুধু একটু অন্যরকম ! ছায়াময়, প্রাচীন, আর অতল রহস্যে ঘেরা। ঠোঁট ফাঁক করে সে বলে ওঠে,
“এটা কোথায়? ক্যালিয়ন, আমরা তো আমার দেশে ফেরার কথা বলেছিলাম। বাবা-মার কাছে যাবো বলেছিলাম! তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?”
তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, চোখে ভয়ের ছায়া।
ক্যালিয়ন তার চোখের গভীরে চেয়ে থেকে ধীরে বলে,

“চলো, আমার সঙ্গে। আমি সব বলবো তোমাকে, অর্ষা। কিন্তু তার আগে আমাকে তোমার বিশ্বাস দরকার।
অর্ষা দ্বিধায় পড়ে যায়, তবুও নীরবে তার পেছনে হাঁটে। বিশাল সোনালী দরজা খুলে এক সুনসান ঘরে ঢোকে তারা। ঘরটি অলোকসন্ধির মতো নীরব, অথচ জ্বলছিল শত শত ছোট আগুনের বাতি, যেন জ্যোৎস্না পায়ের নিচে বিছানো। হঠাৎ ক্যালিয়নের কণ্ঠ আবার শোনা যায়।
“অর্ষা, এবার তুমি আমাকে আমার সত্য রূপে দেখো। তুমি যে সত্যের মুখোমুখি হতে চাও, তার শুরু এখান থেকেই।”
এই বলেই ক্যালিয়ন চোখ বন্ধ করে, নিঃশ্বাস ফেলতেই যেন তার চারপাশের বাতাস বদলে যেতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যেই অর্ষার চোখের সামনে দাঁড়ানো মানবরূপী ক্যালিয়ন আর নেই—তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল, সোনালি-কালো লোমে মোড়া নেকড়ে! চোখ দুটো তার জ্বলছে নীল আগুনে, দাঁতের কোণায় ঝলকে উঠছে কাঁচি-ধরা ক্ষিপ্রতা।

অর্ষা বিস্ময়ে পেছনে সরে আসে, পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল তার! তার হৃদপিণ্ড এত জোরে ধুকপুক করতে থাকে, যেন এখনি ছিঁড়ে পড়বে বুকে।
“তুমি… তুমি একজন নেকড়ে? না… এটা তো… তুমি… কিভাবে?”
কথাগুলো তার কণ্ঠেই আটকে যায়।
সে যার দিকে বিশ্বাসের হাত বাড়িয়েছিল, যার চোখে ভালোবাসা দেখেছিল বলে তার সাথে বন্ধুত্ব করেছিল —সে একজন রূপান্তরিত নেকড়ে!
ভয়, অভিমান, আর বিশ্বাসভঙ্গের এক অজানা ঝড় বইতে থাকে অর্ষার মনে। নীরব দাঁড়িয়ে থাকা সেই নেকড়েটি—ক্যালিয়ন, যেন তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু অর্ষার মনে তখন শুধুই এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—
আমি আবার কোন জালে আটকে গেলাম না তো।

নীরবতা যেন জমাট বাঁধা রাতের মতো ঘন হয়ে নেমে এসেছিল চারপাশে। ক্যালিয়নের চোখের দীপ্তি ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে লাগল, তার তীব্র নেকড়ের রূপটা এক সময় যেন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গিয়ে ফিরে এল তার মানব অবয়বে। চুলগুলো এলোমেলো, মুখে এক অদ্ভুত বেদনার ছাপ, চোখে গভীর এক আকুলতা।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল অর্ষার দিকে। তার পা পড়ে যেন পাথরের উপর নয়, সময়ের অতল অতীতের এক স্মৃতিতে। অর্ষা তখনও হতভম্ব, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সেই অপরূপ রহস্যময় পুরুষটির দিকে, যার এক পলক আগে গর্জে উঠেছিল নেকড়ের রূপে।

ক্যালিয়ন থেমে দাঁড়ায় অর্ষার কাছাকাছি। তার কণ্ঠে গভীরতা, মৃদুতা আর এক অনির্বচনীয় আবেগ—
“তুমি ভয় পেও না, অর্ষা,” সে বলল, স্বরের প্রতিটি শব্দ যেন ঝরে পড়ছিল নিঃশব্দ রাতে। “হ্যাঁ, আমি মানুষ নই—সম্পূর্ণ না—তবে আমার ভালোবাসায় কোনো ভাঁটা নেই। আমি তোমায় ভালোবাসি, খুব… খুব বেশি ভালোবাসি।”
তার কণ্ঠ ভিজে ওঠে স্মৃতির জলে।

“তুমি জানো না, কিন্তু এই ভালোবাসা আজকের নয়। সেই দিন থেকে, যেদিন তুমি ক্লাস নাইনে পড়তে… তখন তুমি এতটাই ছোট ছিলে, নিষ্পাপ, সাহসী, আর আলোর মতো নির্মল। সেদিন আমি ছিলাম এক ক্ষুধার্ত, আহত নেকড়ে—আর তুমি… তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে। তখন থেকেই আমার হৃদয় তোমার হয়ে গেছে, অর্ষা। তোমার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ভয়ের মুহূর্ত, আমি ছায়ার মতো আগলে রেখেছি—দূর থেকে। আমি চেয়েছি তোমার জীবনে কখনোই কোনো আঁধার না আসে।”
ক্যালিয়নের চোখে এক মুহূর্তের জন্য কষ্ট ফুটে ওঠে।

“তবে আমি জানতাম, একদিন না একদিন তোমার সামনে আসতেই হবে। তাই আমি মানুষ রূপে এসেছিলাম তোমার কাছে, মধুপুরে। তোমাকে অপেক্ষার কথা বলেছিলাম… মনে আছে? আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তোমায় সব সত্য বলে দেব। কিন্তু তার আগেই… ওয়াজফান এসে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।”
তার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, চোখ নামিয়ে নেয় মাটির দিকে। তারপর আবার চোখ তুলে চেয়ে থাকে অর্ষার চোখে—সেই চোখে যার মাঝে সে খুঁজতে থাকে ।

এরপর আবার বলে তবে একটা কথাই সত্য… আমি তোমায় অসম্ভব ভালোবাসি। সেই প্রথম দিন থেকে আজ অবধি, এবং যতদিন আমি আছি… তুমি শুধু আমার। কেবল আমার।”
এই বলে ক্যালিয়ন ধীরে এগিয়ে আসে, তার দৃষ্টিতে ভয় নেই, বরং আবেগে ভরা এক অনুরোধ। সে আলতো করে অর্ষার হাতটি ধরল—নরম, থরথর করে কাঁপছে অর্ষার আঙুলগুলো। কিন্তু তার হাতের স্পর্শে ছিল একরাশ উষ্ণতা, একরাশ প্রতিজ্ঞা, আর অফুরন্ত ভালোবাসার স্পন্দন।
ঘরজুড়ে তখন নীরবতা জমাট বাধা নিস্তব্ধতার মতো। এক অজানা ঘূর্ণি যেন ঘরের প্রতিটি দেয়াল ছুঁয়ে গুমরে উঠছে। অর্ষা ধীরে ধীরে নিজের হাতটা ক্যালিয়নের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল—নরম, কিন্তু দৃঢ় এক প্রতিজ্ঞায়।
তার চোখে কোনো ঘৃণা ছিল না, কিন্তু ছিল নিঃসঙ্গতা মেশানো নির্লিপ্ততা। তার কণ্ঠে ছিল শান্ত, অথচ মর্মভেদী এক সত্যের ঘন উচ্চারণ।
সে ক্যালিয়ন,” কে বলে , “তোমায় আমি ভালোবাসি না।”

একটি বাক্য—কিন্তু যেন হাজারটা তলোয়ার একসাথে এসে ক্যালিয়নের বুক চিরে ফেলল। তার চোখের দৃষ্টি মুহূর্তেই নিভে গেলো, ভ্রু জুড়ে ধাক্কা খাওয়ার ছাপ। ঠোঁট কাঁপছে, গলা শুকিয়ে গেছে, তবুও সে জোর করে বলে উঠল:
“তুমি… তুমি মিথ্যে বলছো, অর্ষা। আমি জানি, তুমি ভালোবাসো আমাকে। আমার রূপ দেখে ভয় পেয়েছো, তাই হয়তো দূরে ঠেলছো। কিন্তু আমি তো মধুপুর গ্রামে দেখেছি… তোমার চোখে আমি নিজেকে দেখেছিলাম—একটা নরম কোমল ভালোবাসা, যা লুকিয়ে রাখলেও চোখ বলে দেয়।”
অর্ষা এবার গভীরভাবে তার দিকে তাকাল। কোনো রাগ ছিল না তার চোখে, ছিল কেবল আত্মপ্রত্যয়ের নির্মম স্পষ্টতা।

“না, ক্যালিয়ন… সেটা ভালোবাসা ছিল না,” সে বলল মৃদু কণ্ঠে, “সেটা ছিল একধরনের ভালোলাগা। হ্যাঁ, তোমার যত্ন, তোমার নিরাপত্তা আমায় স্পর্শ করেছিল। আমি ভেবেছিলাম সেই অনুভূতিটাই হয়তো ভালোবাসা। কিন্তু আজ… এত দিন পর বুঝতে পারলাম—ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক না।
তার চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু কণ্ঠে ছিল অচঞ্চল এক স্থিরতা।
“এই দুই মাস তোমার থেকে দূরে ছিলাম… প্রথম কয়েকটা দিন হ্যাঁ, তোমার কথা মনে পড়ত। কিন্তু তারপর? আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম এক অজানা জগতে। কষ্টে ছিলাম, নিঃসঙ্গতায় ভাঙছিলাম। কিন্তু… তাও তোমার কথা মনে পড়েনি। একবারও না। যদি ভালোবাসতাম—তাহলে তোমার মুখ ভেসে উঠত আমার অন্ধকার রাতের আকাশে, না?”
তার প্রতিটি শব্দ যেন আঘাত হচ্ছিল ক্যালিয়নের হৃদয়ের গভীরে। ক্যালিয়ন নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল, ঠোঁটে কোনো উত্তর নেই, কণ্ঠে কোনো সান্ত্বনা নেই—শুধু চোখ দুটি হয়ে উঠেছিল নিঃসীম শূন্যতায় ডুবে থাকা কোনো বিষণ্ন নেকড়ের মতো।
অর্ষা নিচু গলায় শেষবার বলল—

“আমি বুঝে গিয়েছি, ক্যালিয়ন… আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। আর সত্যিটা বলা তোমার প্রাপ্য ছিল।”
দেয়ালের পাশে থাকা বাতিটি নিভে গেল হঠাৎ, যেন সেই মুহূর্তের নিঃশব্দ আর্তনাদে কেঁপে উঠে হারিয়ে গেল আলোটুকুও। ক্যালিয়নের বুকের ভিতর যেন কিছু একটা চিরদিনের জন্য ক্ষত করে গেল।
এরপর অর্ষা বলে ওঠে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো আমার দুনিয়া আমার মা-বাবার কাছে আমি সেখানেই ফিরে যেতে চাই।
রাত তখন নীরবতার আঁচলে ঢাকা। রাজপ্রাসাদের প্রাচীন দেয়াল যেন নিঃশব্দে শোনে দু’টি হৃদয়ের টানাপোড়েন—একটি ভালোবাসায় আবদ্ধ, আরেকটি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ক্লান্ত।

অর্ষার মুখে স্পষ্ট প্রত্যাখ্যানের শব্দ শুনে হঠাৎই ক্যালিয়নের চোখ লাল হয়ে ওঠে। তার ভিতরে যেন বন্য কিছু জেগে ওঠে, যার ওপর আর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এক চিৎকারে সে গর্জে উঠে বলে,
“না! কখনোই না! তুমি ভালোবাসো বা না বাসো, তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি আমার, অর্ষা! আজ থেকে তুমি কেবল আমার। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেব না। যতক্ষণ না তুমি আমাকে ভালোবাসো—আমি তোমাকে আটকে রাখব, আগলে রাখব। আমি জানি, একদিন তোমার হৃদয় বদলাবে, আমার দিকে ফিরবে, আমাকে চাইবে… আমি তোমায় ভালোবাসি, আর সে ভালোবাসা দিয়ে তোমার মনে আবার আলো জ্বালাবো। তারপর, আমি তোমাকে বিয়ে করব। এই দুনিয়ায় কেউ তোমাকে আমার থেকে দূরে করতে পারবে না।”

বলে সে এক ধাক্কায় অর্ষার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায় এক অন্ধকার ঘরে। অর্ষা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ক্যালিয়নের মুখে তখন এক নির্মম, অবিচল দৃঢ়তা। ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে ক্যালিয়ন বলে,
“এই ঘরেই থাকবে তুমি। যতদিন না আবার তোমার হৃদয় আমার হয়ে ওঠে, ততদিন এভাবেই থাকবে। যেদিন ভালোবাসবে, সেদিন মুক্তি পাবে। তার আগে নয়।”
তারপর ধপ করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। শব্দটা যেন পাহাড় ভেঙে পড়ার মতো গর্জে ওঠে।
অর্ষা দরজার কাছে ছুটে গিয়ে বারবার ধাক্কা দেয়, চিৎকার করে বলে—

“তুমি ভুল করছো, ক্যালিয়ন! ভালোবাসা কখনো জোর করে হয় না। এটা অনুভব, জোরে আসা যায় না। তুমি আমার মনের কেউ না… তুমি আমার হৃদয়ে নেই! তুমি শুধু আমার ভালো বন্ধু ছিলে, থাকবে। কিন্তু তার বেশি কিছু না। আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না… পারবো না! আমাকে যেতে দাও… প্লিজ, ক্যালিয়ন… আমাকে মুক্তি দাও!”
তার কণ্ঠে তখন কান্নার দমক, গলার স্বর কাঁপছে, চোখ ঝাপসা। কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যালিয়ন একটিও শব্দ করে না। ভেতরের আর্তনাদ, আহ্বান, কান্না—সব শোনে সে… তবুও প্রতিক্রিয়াহীন। যেন এক সমুদ্র যন্ত্রণার নিচে সে নিঃশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।

চোখ দুটো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে তার। ভালোবাসার নামে যা সে করতে যাচ্ছে, তা যে ভালোবাসা নয়—একটা অন্যায়, সে বুঝেও তা থামাতে পারছে না।
চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু জমে ওঠে—কিন্তু সে ফিরেও তাকায় না। শুধু পেছনে ফেলে যায় নিজের সমস্ত যন্ত্রণায় বন্দি একটি মেয়েকে, আর নিজের ভেতরের ভাঙা একটা হৃদয়কে।
শুধু ফিসফিস করে একটাই কথা বলে দুনিয়া উল্টে গেলেও তুমি আমার……তুমি আমার… রেড ওয়াইন।
অর্ষা নিঃশব্দে রুমের মেঝেতে বসে পড়ে। তার চোখে জল, তবে সে কান্না করছে না—এই জল যেন আত্মার ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। ঘরের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে যেন তার হৃদয়ের শব্দই সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে।
মনে শুধু একটাই প্রশ্ন—”কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তার জীবন?”
এক অন্ধকার রাজ্য থেকে বেরিয়ে, কী করে সে আরেক অন্ধকারে এসে পড়লো? আগের যন্ত্রণাময় জীবনটা যেন হঠাৎ অনেক পরিচিত আর সহনীয় মনে হচ্ছে।

“কমপক্ষে সেখানে বন্ধুরা ছিল, ইসাবেলা যে বোনের মত খেয়াল রাখত। জ্যাইম যে আড়াল থেকে বন্ধু হয়ে উঠেছিল। দম বন্ধ হলেও, জানতাম কে শত্রু, কে আপন।
এখানে? এই সোনালী কারাগারে? নিঃশ্বাসই যেন ব্যথা দেয়।”
সে ধীরে মাথা তুলে চারদিকে তাকায়—চমৎকার সাজানো রাজকক্ষ, মহামূল্যবান আসবাব, মেঝেতে মখমলি গালিচা—কিন্তু এসবের মাঝেও তার গা সাড়া দেয় না। এ যেন এক পাখির সোনার খাঁচা, যেখানে ডানা আছে, আকাশ নেই।
তার কণ্ঠ ফিসফিস করে ওঠে—
“আমি তো ক্যালিয়নকে কোনোদিনও ভালোবাসিনি। বন্ধু ভেবেছিলাম, সেই বন্ধুত্বে একটা মায়া ছিল, সুরক্ষা ছিল… সেটা শুধু একটা ভালো লাগা ছিল সে ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি আমি ভুল ভেবেছিলাম কিন্তু সময়ের সাথে আমার ভুল ধারণা কেটে যায়।

কিন্তু ভালোবাসা? না, সেটা কখনোই জন্মায়নি। আর জন্মাবেও না।”
হঠাৎই অর্ষা কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখ দুটো অদ্ভুত এক উত্তেজনায় জ্বলছে।
মনে মনে বলে ওঠে—
“সে কি আসবে? ও… ও কি ফিরবে আমাকে নিতে? নিশ্চয়ই আসবে। আমি জানি ও আসবে… আমাকে এই খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে যাবে… ও তো জানে আমি কোথায়…”
এক মুহূর্ত, একটা নিঃশ্বাস…
আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন সেই বিশ্বাসটা নিজেই নিজেকে ধাক্কা মারে।
তার ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে ওঠে, মুখটা কালো মেঘের মতো গম্ভীর।
“না! না! ও কেন আসবে?”

“তুই আবার তার কথা ভাবছিস কেন অর্ষা? এক হৃদয়হীন ব্যক্তির কথা যার মধ্যে কোন হৃদয় নেই।
“তুই ভুলে গেছিস, সে তো তোকে ভালোবাসতো না—সে শুধু তোকে ভোগ করতে চেয়েছিল! খেয়াল ছিল, অধিকার ছিল, ভালোবাসা ছিল না।”
“সে তো তোকে কখনোই নিজের করে রাখেনি, কেবল নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছে…
তাহলে এখন কেন আসবে তোকে বাঁচাতে?

Death or Alive part 16

সে তো বিয়ে করছে অন্য একটা নারীকে তুই তার জীবনের কোথাও ছিলি না না আছিস।
এই কথাগুলো উচ্চারণ করতে না করতেই যেন মনের ভেতর কিছু একটা ভেঙে পড়ে।
অর্ষা হঠাৎ হাঁপাতে শুরু করে, বুকের ভেতরটা টান টান হয়ে আসে। এই গুমোট নিঃশ্বাসে সে টিকে থাকতে পারছে না।
সে ধীরে ধীরে আবার মেঝেতে বসে পড়ে, এবার ঝুঁকে পড়ে নিজের হাঁটুর ওপর। ঠোঁট দুটি নীরবে কাঁপে।

Death or Alive part 18

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here