Death or Alive part 18

Death or Alive part 18
priyanka hawlader

পারস্য রাজ্যের রাজপ্রাসাদ — যেখানে চলছে তাণ্ডবের আগুন
চারদিকে আতঙ্কের বাতাস। রাজপ্রাসাদের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে দাসদাসীদের নিথর দেহ। আসবাবপত্র, ভাঙা সিংহাসন, ছিন্নবিচ্ছিন্ন পর্দা—সবকিছু যেন অচেনা এক ঝড়ের শিকার হয়েছে। এই তাণ্ডবের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে একমাত্র পুরুষ—বাদশাহ ওয়াজফান!
তার চোখে লাল আগুন। নিশ্বাস যেন আগুনের ঢেউ। চারদিকে গর্জন করে উঠছে জ্বালাময়ী হাওয়ার মতো তার কণ্ঠস্বর—

“F*cking useless!”
“তোরা এতগুলো দিন একটাও কাজের কাজ করলি না! তোরা তোদের নাকের নিচে দিয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে চলে গেল আর তোরা বাঁচাতে পারলি না! সে তো এখন তোদের চোখের সামনে থেকেও নেই!”
সে ক্ষিপ্ত হয়ে পেছনের বড় পিলারটা এক ঘুষিতে ভেঙে ফেলে। ছাদ কেঁপে ওঠে! তারপর একে একে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হতভম্ব দাসিদের দিকে তাকিয়ে বলে—
“তোদের দরকার নেই আমার রাজ্যে… মর!”
তারপর সে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। ভয়ে দাসদাসীরা দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে, কেউ কান্না করে, কেউ সাহায্য চায়—কিন্তু তাদের কণ্ঠ থেমে যায় ধাতব তরবারির শব্দে, আর গলা চিরে বেরিয়ে আসা রক্তে।
একটা একটা করে সবার জীবন নিঃশেষ করে দেয় নিজ হাতে। রাজপ্রাসাদ যেন পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
কিছুক্ষণ আগে…

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অর্ষা চলে যাওয়ার পর থেকেই দাসদাসীদের মধ্যে ছিল এক গভীর অস্থিরতা। কেউ কিছু বলছিল না, কিন্তু কারও চোখে লুকানো ছিল না ভয়।
তারই মাঝে এক সাদা পোশাক পরা জিন—যে দীর্ঘদিন ধরে ছিল ওয়াজফানের চেয়ারের নিচে ছায়া হয়ে—চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে ছুটে চলে যায়… উদ্দেশ্য একটাই, খবরটা ওয়াজফান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেদিন বাদশাহ রাজ্য সীমার বাইরে ছিল, যুদ্ধে ব্যস্ত—এবং জিনটাকে যেতে যেতে রাত হয়ে যায়।
রাত গভীর হলে জিনটা পৌঁছে যায়। কাঁপা কণ্ঠে বলেই ফেলে—
“আমার প্রভু… মানব কন্যা… অর্ষা… সে—সে এখান থেকে চলে গেছে। কেউ তাকে নিয়ে গেছে, আর আমরা কিছুই করতে পারিনি…”

এই কথাটা শোনার পর একটা মুহূর্তও থামে না ওয়াজফান। তার চোখে জ্বলতে থাকে ভয়ংকর আগুন। হাত মুঠো করে সে ছিঁড়ে ফেলে তার যুদ্ধের খাকি চাদর।
তারপর যুদ্ধের সেনাপতি আয়রাক আর জ্যাইমকে ডাকে—
“সেনা ভাগ করে দাও। অর্ধেক থাকবে রাজ্য সীমায়, অর্ধেক যাবে আমার সঙ্গে—প্রাসাদে!
কথাটা শুনে জ্যাইম জিজ্ঞেস করে কেন দা কোন সমস্যা হয়েছে, ওয়াজফান বলে যা হয়েছে আমি দেখে নেব তোরা এই দিকটা দেখে নে।

সঙ্গে সঙ্গে সে রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা দেয় তার উন্মত্ত রাগ নিয়ে। উড়াল দিয়ে টর্নেডোর মতো ছুটে চলে আসে। আর প্রাসাদে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই… এই ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয়।
এখন রাজপ্রাসাদ কেবল রক্ত আর ধ্বংসস্তূপের স্মারক। কেউ আর জানে না, এই আগুন কতদূর ছড়াবে। শুধু ওয়াজফানের চোখে স্পষ্ট—একটাই লক্ষ্য:
লিটল মনস্টার .. তুই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিস .. এখন এটা শাস্তি তুই ভয়ংকর ভাবে পাবি … —এই দুনিয়া আমি ধ্বংস করে দেব!
এরপর,
ওয়াজফান ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠল, যেন তার কণ্ঠে বজ্রপাতের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো প্রাসাদের চারদিক জুড়ে।

— “তৈরি হও সবাই! এইবার আমি নিজে যাচ্ছি সেই রাজ্যে! আর যে-ই হোক, সামনে যদি কেউ বাধা দিতে আসে, তাকে ধ্বংস করে তবে ফিরিয়ে আনবো অর্ষা কে। এইবার আর কাউকে ছাড়বো না, কারো কান্না শুনবো না!”
তার চোখদুটোতে লেলিহান আগুন। ঠোঁট আঁচড়ে ধরা প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা। রক্ত-রাঙা সন্ধ্যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল সে—একজন জ্বলে-পুড়ে ওঠা বাদশা, যার হৃদয় ধ্বংস আর প্রেমের তীব্র দ্বন্দ্বে টালমাটাল।
এই আদেশে চারদিক কেঁপে উঠলো। সৈন্যরা নড়েচড়ে উঠলো যেন বজ্রের আগুন তাদের হাড়ে হাড়ে লেগেছে। তবুও সাহস করে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি ধীর কণ্ঠে বলে উঠল—
— “বাদশাহ, আমাদের সেনাবাহিনী এখনও সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। অর্ধেক সৈন্য আপনি আগের যুদ্ধে রেখে এসেছেন। আমি অন্য রাজ্য থেকে অতিরিক্ত সেনা ডাকিয়েছি। তারা পৌঁছুতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগবে। আমাদের সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

ওয়াজফানের চোখ লাল হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। তার নীলচে পোশাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো তার রক্তিম ক্রোধ। এক ঝটকায় সামনে রাখা তামার প্রদীপ ছুঁড়ে ফেলে বলল—
— “তাহলে সেই এক ঘণ্টার মধ্যেই সব প্রস্তুতি শেষ চাই! অস্ত্র-ঘোড়া-রথ—সব! যেন মুহূর্তেই যুদ্ধ শুরু করা যায়। আমার চোখের সামনে কোনো অলসতা দেখতে চাই না! নইলে যারা আজ অলস, কাল তারা জীবিত থাকবে না—এই আমার ওয়াজফানি শপথ!”
তার কণ্ঠ যেন ধ্বনিত হলো হাজার সৈন্যের মনের ভিতরে। বাতাস থমকে গেল। সৈন্যদের চোখে পড়ল আতঙ্ক আর আনুগত্যের ছায়া। কারো সাহস হলো না তার দিকে সোজা তাকিয়ে থাকার।
ওয়াজফান এরপর দৃষ্টিপাত করলো প্রাসাদের প্রাচীরে—যেখানে দূরে অদৃশ্য এক রাজ্যর দিকে তাকিয়ে আছে সে। যেন চোখ দিয়েই সে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে সব দেওয়াল, সব মানুষ, আর সেই রাজ্যের সব প্রহরী,
এই পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না লিটল মনস্টার । এই এক ঘণ্টা আমার ধৈর্যের শেষ সময়—তারপর আগুন ঝরবে…”

এই বলেই তিনি দীর্ঘ পদক্ষেপে চলে গেলেন নিজের কক্ষে। দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে রাতের আকাশে একে একে জ্বলে উঠতে থাকল যুদ্ধের সংকেতবাহী মশাল—তীব্র আগুনের মত জ্বলন্ত, যেমন জ্বলছে ওয়াজফানের প্রতিশোধ।
এই যুদ্ধ আর কেবল এক রাজ্য জয়ের জন্য নয়—এটি ছিল এক প্রেম, এক প্রতিজ্ঞা, এক ধ্বংসাত্মক আবেগের বিস্ফোরণ—যার কেন্দ্রে ছিল একটি মেয়ের নাম—অর্ষা।
ওয়াজফানের কক্ষে—অস্থির পায়ের শব্দ, ভারী নিঃশ্বাস আর পাষাণ হৃদয়ের মাঝে চলা এক বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। তার দৃষ্টিতে আগুনের হলকা, বুকের গভীরে আগ্নেয়গিরির মত ফেটে পড়া এক যন্ত্রণা।

হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছায় সেই কক্ষটিতে—অর্ষার কক্ষ।
দরজার কাছে এসে থমকে যায়। কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন ভেতরে ঢোকার আগে সে নিজেকেই তৈরি করছে—কিন্তু সেই প্রস্তুতি তার আবেগের স্রোতের সামনে নেহাতই দুর্বল।
ধীরে ধীরে কক্ষের দরজা ঠেলে ঢোকে সে। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় চারদিকে।
কিন্তু…

শূন্য।
না অর্ষা, না তার সেই কোমল গন্ধ, না তার নিঃশ্বাসের ছায়া।
কক্ষের নিস্তব্ধতা যেন কানের ভেতরে ছুঁড়ে দিচ্ছে করাতের শব্দ।
ওয়াজফান মুহূর্তেই ছুটে যায় বিছানার দিকে।
হাত দিয়ে, মুখ ঘষে—সেই পরিচিত ঘ্রাণটুকু খুঁজে ফেরে,
যেটা একদিন তাকে উন্মাদ করেছিল।
কিন্তু আজ…
শূন্যতা।
শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে হঠাৎ। মাথার মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করে।
সে বসে পড়ে বিছানার ওপর, দু’হাত মুঠো করে, চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে—
“আমি ভেবেছিলাম এটা শুধু আকর্ষণ… হয়তো একরকম মোহ। যদি মোহ হতো, হয়তো যেতে দিতাম। কিন্তু না… এই যন্ত্রণা বলছে—তুই আকর্ষণ না… তুই আমার নেশা। একবার নয়, বারবার নিতে ইচ্ছা করে। বারবার তোকে ছুঁতে চাই, শুনতে চাই তোর কণ্ঠস্বর।”

সে গভীরভাবে নিশ্বাস টেনে নেয়, যেন বাতাসেও অর্ষার অস্তিত্ব খুঁজছে। কিন্তু কোনো কিছুই তার তৃষ্ণা মেটায় না। তার চোখের পাথরের মতো কঠিন রঙ এবার বদলে যেতে থাকে—লালচে রাগ থেকে সোনালি এক উন্মত্ত আলোয়।
তুই কি জাদু করেছিস লিটল মনস্টার ? কী ছড়িয়ে দিয়েছিস আমার রক্তে? তুই ছাড়া আর কেউকে দেখি না, তুই ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। এই নেশা… কোনো ওঝা কাটাতে পারবে না। আর আমি এই নেশা থেকে মুক্তি চাই না।
তার ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কণ্ঠ দৃঢ়—

—“তুই আমার ছিলি না, তবু তুই আমার হয়ে গেছিস। এখন থেকে, তুই—পুরোটাই আমার। শরীর, মন, আত্মা… সব আমার। আমি তোর প্রেম চাওনি, তোর মালিকানা চেয়েছি। এখন থেকে তুই আমার দুনিয়া, আর সেই দুনিয়া আমি নিজের হাতেই গড়ে নেব।”
প্রাসাদের বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে ওয়াজফানের এই একতরফা ঘোষণা শুনে।
তার চোখের সোনালি রঙে জ্বলে ওঠে দখলের আগুন,
ভালবাসার নামে গড়ে ওঠা এক বিভীষিকাময় চক্রবূহ্য।
আর তার কেন্দ্রে বন্দিনী—অর্ষা।
তারপর হঠাৎ যেন বজ্রপাতের মতো এক চিন্তা মাথায় খেলে গেল—
ক্যালিওন তো আমার শত্রু! তাহলে সে কেন অর্ষাকে নিতে এল? আর অর্ষা… কেন তার সঙ্গে নির্দ্বিধায় চলে গেল?
এই প্রশ্নগুলো বুকে বাজতে থাকল বজ্রের মত, আর মুহূর্তেই যেন জিন বাদশার ভিতরটা গর্জে উঠল এক অগ্নিময় তাণ্ডব।

সে আর দেরি করল না—তার চোখদুটো বন্ধ করে গভীর ধ্যানের ভেতর প্রবেশ করল। দু’হাত আকাশের দিকে তুলে শক্তিশালী মন্ত্র পাঠ করে খুলে ফেলল অতীতের দরজা। এক বিশাল স্বচ্ছ কাঁচের পিঠে ফুটে উঠল অর্ষার জীবনের অদেখা অধ্যায়গুলো।
প্রথমে দেখা গেল অর্ষার নির্জন বিকেলগুলো—চোখে অদ্ভুত উদাসী চাহনি নিয়ে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে অজানা এক জগতের উপত্যকায়। তারপর হঠাৎ একদিন সে দেখা পেল ক্যালিওনের—ভয়ংকর নেকড়ে রূপ ত্যাগ করে মানুষের অবয়বে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রহস্যময় যুবকের। জিন বাদশা স্পষ্ট দেখতে পেল—অর্ষার চোখে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে এক কৌতূহল, এক বিশ্বাস, এক আলতো মুগ্ধতা। আর ক্যালিওন? সে তো অনেক আগে থেকেই ভালোবেসে বসেছিল অর্ষাকে।

দৃশ্যগুলো যেন হুল ফোটালো তার বুকের ভেতর। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি চাহনি, প্রতিটি হাঁটা—সব যেন তার হৃদয়ের ওপর ঘা মেরে বলল, “তুই হেরে গেছিস!”
তার শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছিলো রাগে। পরক্ষণেই তার চোখদুটো আগুনে লাল হয়ে উঠল। সোনালী রঙের সেই ধরা মণি—যেটা তার ক্ষমতার প্রতীক, সেটাতেই জ্বলে উঠল লেলিহান শিখা। সেই আগুনের প্রতিফলন পড়ল রাজপ্রাসাদের দেয়ালে, মেঝেতে,
সে দাঁড়াল হঠাৎ।
তার এক হাঁকডাকেই ধ্বসে পড়ল কক্ষের একাংশ। মেঝেতে ফাটল ধরল, ছাদের মণি-মুক্তা ঝনঝন করে পড়ে ভাঙতে লাগল। চারদিকে শুধু ধ্বংস আর উন্মত্ততা।
“আমার লিটল মনস্টার ! আমার—শুধু আমার! অন্য কেউ যদি তার দিকে তাকানোর সাহসও করে, আমি তার চামড়া ছিঁড়ে নেব!”

তার কণ্ঠস্বর ছিল গর্জনের মতো, যেন বিশাল পর্বতের ভিতর থেকে বোমা ফাটার শব্দ আসছে।
এরপর সে এক ঝড়ের বেগে সেই ঘরের সব কিছু ভাঙতে লাগল। দেয়ালের ঝুলন্ত প্রাচীন তরবারি, সাজানো রত্নখচিত পাত্র, খোদাই করা মূর্তি—কোন কিছুই রেহাই পেল না। একের পর এক ধ্বংসের সুর তুলল সে, যেন এই ধ্বংসই তার ভালোবাসার প্রতিশোধ।
তার দৃষ্টিতে এখন শুধুই প্রতিশোধ, শুধুই ঘৃণা, আর অগ্নিশিখার মতো এক দগ্ধ নেশা।
“তুই আমার, তুই আমারই আছিস, আর চিরকাল আমারই থাকবি!”
তার গলার স্বর যেন আকাশ কাঁপিয়ে বলছিল।

আর তখনই, তার সামনে ভেসে উঠল একটি নতুন দৃশ্য—অর্ষা আর ক্যালিওন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, সূর্যাস্তের আলোয় একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহনিতে ছিল না কোনো ভয়, ছিল শুধুই এক নিঃশব্দ অনুভব। সেই দৃশ্যটাই যেন শেষ খোঁচাটা দিল তাকে।
তার দেহ থেকে আগুনের শিখা উঠে গেল আকাশের দিকে। পুরো প্রাসাদ কেঁপে উঠল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল তার শ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা অশুভ জাদুশক্তি।
অন্যদিকে,

ক্যারিয়ন ধীরে ধীরে দরজার কপাট ঠেলে প্রবেশ করে অর্ষার কক্ষে। রাতের নিস্তব্ধতা যেন ভার হয়ে নেমে এসেছে সারা কক্ষে। জানালার পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে, চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে বিছানার ধবধবে চাদরে। সেই আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক প্রশান্ত, গভীর নিদ্রায় ডুবে থাকা মুখ—অর্ষা।
সে যেখানে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেখানেই রয়েছে অর্ষা। যেন স্বপ্নের দেশ থেকে ফেরেনি সে। ক্যারিয়নের চোখে তীব্র এক আলো জ্বলে ওঠে—তা কি কোনো গভীর, গোপন আবেগ? সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্ষার মুখের দিকে—একটি নিষ্পাপ, কোমল মুখ, যার প্রতিটি রেখা যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। সেই মুখে কোনো রাগ নেই, কোনো অভিমান নেই, আছে কেবল শান্তির ছায়া, যেন সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ ঢেউ।

ক্যারিয়ন সামনে এগিয়ে আসে। তার দীর্ঘ ছায়া পড়ে অর্ষার শরীরজুড়ে। সে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশে, তারপর আলতো হাতে এক জাদুকরি মুদ্রা আঁকে বাতাসে। মুহূর্তেই অর্ষার নিদ্রা গভীরতর হয়। এখন আর কোনো শব্দ, আলো বা স্পর্শ তাকে জাগাতে পারবে না। সে চলে গেছে ঘুমের এমন এক স্তরে, যেখানে স্বপ্নও শব্দহীন।
তারপর ক্যারিয়ন ধীরে ধীরে বিছানার পাশে বসে পড়ে। নিঃশব্দে, নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয় করে তার। যেন এই ঘুম ভাঙানো পাপ। কয়েক মুহূর্ত সে এভাবেই বসে থাকে, চোখ দুটি নিবদ্ধ অর্ষার মুখের প্রতিটি রেখায়।
হঠাৎ তার ভেতরের এক অজানা আকর্ষণ, এক অব্যক্ত টান, তাকে তাড়িত করে তোলে। সে ধীরে ধীরে পাশে শুয়ে পড়ে, সাবধানে যেন বাতাসেও না লাগে তার ভার। তারপর তার মাথাটি আলতো করে নিয়ে যায় অর্ষার গলার কাছে।

সেই গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয় সে—যেন খুঁজে পেতে চায় শতাব্দী ধরে খুঁজে ফিরেছে এমন কোনো ঘ্রাণ, কোনো পরিচয়। অর্ষার শরীর থেকে নিঃসৃত সুবাসে সে চোখ বন্ধ করে ডুবে যায় এক অচিন জগতে। সে শ্বাস নেয় গভীরভাবে, যেন সেই সুবাসে আছে তার হারিয়ে যাওয়া জন্মস্মৃতি, কোনো অতল প্রেম, অথবা কোনো আদিম পাপের মুক্তি।
তার ঠোঁট অর্ষার ত্বকের ছোঁয়া এড়িয়ে শুধু স্পর্শ নেয় বাতাসের মতো—নরম, নীরব, নিঃশব্দে।
আর এই নিঃশব্দ ভালোবাসার, একতরফা আকর্ষণের, এক অদ্ভুত আবেশের মধ্যেই রাত গভীর হয়। ঘরের কোণে থাকা প্রদীপের শিখা টিম টিম করে জ্বলে আর বাইরের আকাশে তারা একে একে মিলিয়ে যায়।

এইদিকে ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে হঠাৎই ওয়াজফানের মনে পড়ে— অর্ষা এখন ক্যালিয়নের কাছে!
একটা যন্ত্রণার স্রোত বয়ে যায় বুকের মধ্যে। এক মুহূর্তেই তার রাগের শিখা ছুটে যায় মাথায়।
“না!” — নিজেকে স্থির রাখতে পারে না সে।
সে দুই হাত ছড়িয়ে যাদুমন্ত্র আওড়ায়। এক ভয়ানক আগুনের বল গঠিত হয় তার সম্মুখে। বলটার ভিতরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক দৃশ্য—
অর্ষা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। আর তার গলায় মুখ গুঁজে, চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ক্যালিয়ন!
দৃশ্যটা যেন ছুরি হয়ে গেঁথে যায় ওয়াজফানের চোখে।
তার মুখ বিকৃত হয়ে যায় ক্রোধে। রক্তাভ চোখে আগুনের ঝলক।
সে চিৎকার করে বলে ওঠে —

You touched her?! You dared to touch what’s MINE?! My shadow doesn’t even dare to reach her, and YOU… YOU put your filthy lips on her!”
তার কণ্ঠ যেন প্রলয়ের হুঙ্কার!
“I’M COMING! I’M COMING TO RIP YOUR SOUL FROM YOUR BODY!”

তার কণ্ঠ রাজপ্রাসাদের দেয়াল কাঁপিয়ে তোলে।
পরক্ষণেই সে ছুটে যায় রাজসভায়। প্রবল শক্তি নিয়ে বিশাল দরজা খুলে ঢুকে পড়ে রাজাদের সম্মেলনকক্ষে।
“তোমরা যুদ্ধ চাও? নাকি তোমাদের শেষ মুহূর্তে আত্মসমর্পণ? সৈন্য পাঠাও— অথবা নিজেরা এসে মুখোমুখি হও! আজ আমি একাই শেষ করব ওদের।
তার চারপাশে আগুনের বৃত্ত গড়ে ওঠে। সৈন্যদের কেউ কেউ ভয়ে পেছিয়ে যায়, কেউ দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে।
ওয়াজফান এক ঝটকায় আকাশে উড়াল দেয়। তার পেছনে আগুনের ডানায় সজ্জিত বিশাল বাহিনী, মুখে মুখে একই সুর—
“প্রলয় আসছে…”
এ সৈন্যরা ও পিছে পিছে যায়।

নিঃশব্দ রাতটা এক অদ্ভুত ভারে ঢেকে ছিল। চারদিকে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সমস্ত প্রাণ—কেবল জেগে ছিল এক রহস্যময় নীরবতা। সেই নিঃস্তব্ধতার মাঝেও অর্ষার নিঃশ্বাস ছিল ধীর, শান্ত, যেন কোন ক্লান্ত মেঘ মাটিতে নেমে এসেছে বিশ্রামের খোঁজে।

কিন্তু গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ তার নিঃশ্বাসে এক টুকরো কাঁপুনি খেলে গেল। চোখ বন্ধ থাকলেও অর্ষার অবচেতনে টের পেল কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে তার গলার পাশে।
ক্যালিওন নিঃশব্দে তার ঘাড়ের পাশে মুখ রেখে ছিল, ঠিক যেন এক সিংহ তার স্নেহের স্পর্শে পাহারা দিচ্ছে নিজের মনের রানীকে। কিন্তু অর্ষা একটু নড়েচড়ে উঠতেই কালিওনের তীক্ষ্ণ অনুভূতি বলে দিল—তার ঘুম আর গভীর নেই।
এক মুহূর্তের জন্যও সে দেরি করলো না। ধীরপায়ে, নিঃশব্দে, অন্ধকার ছুঁয়ে সে সরে নিল মুখ। তারপর ছায়ার মত অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ঘর থেকে। দরজা খুললো না, শব্দ হলো না—তবু জানালার পাশে বাতাসের এক কাঁপুনিতে যেন বলে গেল, “আমি আছি, ঠিক তোমার পাশে।

কিন্তু সেই নিরবতা স্থায়ী হলো না বেশি সময়।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎই বাইরে শুরু হলো অস্বাভাবিক শব্দ।
চিৎকার, ধাক্কাধাক্কি, ধাতব কিছুর সংঘর্ষের শব্দ, যেন দূর থেকে ধেয়ে আসছে ঝড়। এক ঝাঁক বুনো অশ্ব আর তলোয়ারের ঝনঝনানিতে আকাশের শান্তি ছিন্নভিন্ন।
অর্ষা তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে উঠলো। ভেতরে আতঙ্কের ঢেউ খেলে গেল।
সে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল।
“কে… কে আছে বাইরে? কি হচ্ছে?” — কণ্ঠে আতঙ্ক, কণ্ঠে দুঃশ্চিন্তা।
কিন্তু দরজা সেই আগের মতোই নিস্তরঙ্গ। শক্ত, নিষ্ঠুর, তার একটুও নাড়িয়ে দেয় না সেই দ্বার। যেন তার সামনে এক অদৃশ্য প্রাচীর।

সে আরও কয়েকবার ধাক্কা দিলো, হাতের চোটে ব্যথা পেল, কিন্তু দরজাটা যেন নীরব অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তার সামনে।
বাইরে তখনও গোলমাল চলছে—এখন যেন শব্দ আরও বেশি। কারো ধাক্কাধাক্কি, কারো চিৎকার, কেউ যেন বলছে “পেছাও! ওকে আটকাও!” — কারো কণ্ঠস্বর রক্তের মতো গরম, আগুনের মতো কাঁপা।
অর্ষা ততক্ষণে ভয় আর কৌতূহলের মাঝে হিমশীতল হয়ে গেছে। এক পা এক পা করে ফিরে এল বিছানায়, আর ঘরের কোণে বসে পড়লো চুপচাপ।
তার চোখ বড় বড়, বুকের ভেতর ঢাক বাজছে, আর চারপাশে এক অজানা আশঙ্কার ধোঁয়া যেন ঘনিয়ে আসছে।

অন্ধকারের শ্বাসপ্রশ্বাসে প্রাসাদ কাঁপছে…
রাত্রির নিস্তব্ধতা যেন থমকে গিয়েছিল। ক্যালানিয়নের রাজ্যের আকাশ জুড়ে ঘন কালো মেঘ জমেছে। মেঘের গর্জনে মিশে আছে মানুষের চিৎকার, মৃত্যুর আর্তনাদ। প্রাসাদের সুউচ্চ মিনার থেকে দেখা যাচ্ছে—এক ছায়ামূর্তি আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের বুকে। সে যেন এক দানব, যার চোখে দয়া নেই, হৃদয়ে ভালোবাসা নেই—শুধু প্রতিশোধের আগুন।
ওয়াজফান!

তার পদচারণায় কাঁপছে প্রাসাদের মাটি। হাতে নখরসম খঞ্জর, আর পিছনে একদল দানবাকৃতির সৈন্য—যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য, ধ্বংস! যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রাখছে মৃতের স্তূপে। আর ওয়াজফান? সে যেন রক্তের গন্ধে আরও পাগল হয়ে উঠছে।
“আমার লিটল মনস্টার কে সরিয়েছো? আজ পুরো রাজ্যই তার বিনিময়ে পুড়বে!”—চেঁচিয়ে উঠল সে, কণ্ঠে অগ্নি।
তলোয়ার নয়, তার শরীরই যেন অস্ত্র। এক প্রবল আঘাতে সে একটি পাহারাদারকে মাটিতে গুঁড়িয়ে দিল। একে একে ছুটে এল বাকি রক্ষীর দল, কিন্তু কেউই তার সামনে দাঁড়াতে পারল না। কারো মাথা ছিন্ন, কারো বুক বিদীর্ণ—ওয়াজফানের হাতে মৃত্যু যেন শিল্প হয়ে উঠেছে।
মৃত্যুর মহাযজ্ঞে এক মুহূর্তের থেমে যাওয়া—
ড্যানিয়েল এগিয়ে আসে আক্রমন করার জন্য

কিন্তু ওয়াজফানের চোখে কোনো মানবিকতা নেই। সে যেন পশু—না, তার থেকেও ভয়ানক কিছু। এক ঝাঁপে সে ড্যানিয়েলের গলা চেপে ধরে তুলে ফেলে আছাড় মারে প্রাসাদের পাথরের মেঝেতে। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে মেঝে।
ড্যানিয়েল যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে, কিন্তু ওয়াজফান যে শক্তিতে আছাড় দিয়েছে, তা যেন মৃত্যুর কাছের ঠিকানা লিখে দিয়েছে। সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে যায়—শ্বাস চলছে, কিন্তু শক্তি নেই।
এই সব কিছুর সময় ক্যালিয়ন ছিল নিজের কক্ষে। রাজ্যের পরিস্থিতির খবর তখনো পৌঁছেনি তার কাছে। প্রাসাদের দাসেরা ভয়ে কাঁপছে, কেউ কেউ লুকিয়ে পড়ছে স্তম্ভের পেছনে, কেউবা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ।
তবুও একজন দাসী, বুক কাঁপতে কাঁপতে ছুটে যায় ক্যালিয়নের কক্ষে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে—
লর্ড ক্যালিয়ন … রাজ্য… রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! ওয়াজফান… সে… সে অর্ষার খোঁজে সবকিছু ছারখার করে দিচ্ছে! ড্যানিয়েল…”

আর দাসী বাক্য শেষ করার আগেই ক্যালিয়নের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে।
ওইদিকে…
ওয়াজফান তখন পৌঁছে গেছে সেই দরজার সামনে—যেখানে অর্ষা বন্দী।
তার দৃষ্টি লালচে আগুনে জ্বলছে। এক মুহূর্ত দাড়িয়ে যেন দুঃস্বপ্নের মতো হাসল সে।
“তুই তো আমার দুনিয়া ? আজ তোকেই আমি সেই দুনিয়ার রাজা বানাব… আমার পৃথিবীর রানী!
তারপর হঠাৎই সে এক শক্তিশালী লাথি মারে দরজার মাঝ বরাবর—
এক প্রচণ্ড শব্দে দরজাটা গুঁড়িয়ে পড়ে। ধুলো আর কচূর্ণ উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিতরে থাকা অর্ষা হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। চোখে জ্বলজ্বলে আতঙ্ক, ঠোঁট কাঁপছে, হৃদস্পন্দন যেন থেমে এসেছে।
আর দরজার ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে সে—ওয়াজফান।

তার মুখে তৃপ্তির ছায়া, আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে এক শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা।
বিছানায় বসে থাকা অর্ষা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ কিন্তু পরক্ষণেই যেন কোন যুক্তি কাজ করল না তার মস্তিষ্কে, কোনো লজ্জা বা দ্বিধা নয়—শুধু এক প্রবল অনুভূতির টানে সে ছুটে আসে।
বুকভরা অস্থিরতা নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই দানব-সদৃশ পুরুষটির বুকে।
তার কাঁধে মুখ গুঁজে ফেলে হঠাৎ যেন আষাঢ়ে শান্তি খুঁজে পায় সে।
ওয়াজফানের বিস্ময় মিলেমিশে যায় এক অপরিসীম তৃপ্তির আনন্দে। অর্ষার দেহ তার বুকে, হৃদয়ের ঠিক ওপরে—যেখানে ধ্বংস আর রক্তের ইতিহাস লেখা ছিল, সেখানেই যেন কেউ প্রথমবারের মতো শীতল হাত রাখে।
অর্ষা জানে না কেন, জানে না কী এক মোহে সে এমন করল।

কেন তার মন বলছে—এই রক্তমাখা বুকই তার আশ্রয়, এই দানবকেই সে বিশ্বাস করতে চায়।
যেন এই বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকলে, দুনিয়ার কোনো অন্ধকার তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
এ যেন এক তীব্র মায়া, যেখানে অর্ষা তার সমস্ত ভয়কে ভুলে শান্তির নীড় খুঁজে পাচ্ছে।
কিন্তু সেই মুহূর্তের কোমলতায় বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে বাস্তব।
পেছন থেকে ক্যালিয়ন ছুটে এসে এক প্রবল আক্রোশে ওয়াজফানকে লাথি মারে।
এক ঝটকায় অর্ষা ছিটকে পড়ে একপাশে, আর দানব ও যোদ্ধা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় যুদ্ধের জন্য।
শুরু হয় তীব্র সংঘর্ষ।

আকাশ যেন কেঁপে ওঠে তাদের আঘাতে আঘাতে।
ওয়াজফানের চোখে খেলা করে হিংস্রতা, ক্যালিয়নের মুখে দৃঢ় সংকল্প।
কিন্তু সময়ের সাথে বোঝা যায়, শক্তিতে, দেহে, দৃষ্টিতে—ওয়াজফান এক তাণ্ডব।
ক্যালিয়ন আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার তীব্রতা সামলাতে হিমশিম খায়।
প্রতিটি ঘুষি, প্রতিটি লাথি যেন আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে চারপাশে।
বাতাস থমকে যায়, দেওয়াল থরথর করে কাঁপে।
অর্ষা এক কোণে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চেয়ে থাকে—কখনও ক্যালিয়নের মুখে, কখনও সেই ভয়ংকর অথচ আশ্রয়দাতা ওয়াজফানের চোখে।

তার চোখে ভাসতে থাকে প্রশ্ন—এই যুদ্ধ কিসের?
ভালোবাসা না প্রতিহিংসা?
কে আসলে তার আপন?
আর কে সেই যাকে সত্যিই বলা যায়, “আমার”?
একজন তো আমার বন্ধু কিন্তু আরেকজন সে কি হয় আমার এই প্রশ্নের তার মনে হচ্ছে।
রাজপ্রাসাদের ভেতরে তখন যেন সময় থমকে গেছে। চারপাশে রক্তের গন্ধ, দেয়াল জুড়ে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন, আর তার মাঝখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই পুরুষ—একজন আগুনের মতো রাগে জ্বলন্ত, আরেকজন রক্তাক্ত, কিন্তু চোখে এখনো প্রতিজ্ঞার দীপ্তি।

ওয়াজফানের তীব্র আঘাতে ক্যালিয়ন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। তারপর, নিজের যাদু শক্তি প্রয়োগ করে ক্যালিয়নের দুই হাত অদৃশ্য দড়িতে বাঁধে সে।
ক্যালিয়ন এখন হাঁটু গেড়ে বসে আছে, দেহে রক্তের ছাপ, কিন্তু চোখে এখনো লজ্জাহীন সাহস।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে—তার হাতে এক ধারালো, কালো রুপার তৈরি ছুরি। চোখে সোনালি আগুনের ঝলক।
সে এক দানব, যে এখন শুধুই প্রতিশোধ চায়।
ঠিক তখনই—
“না!” এক কান্না ভেজা চিৎকারে থেমে যায় ওয়াজফানের পা।

অর্ষা দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়, দুই হাত ছড়িয়ে দেয় ক্যালিয়নের দিকে।
“প্লিজ… এমন করবেন না,” কাঁপা গলায় বলে সে। “ওকে মারবেন না, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি…”
ওয়াজফানের চোখে এক মুহূর্তের বিস্ময় খেলে যায়। কিন্তু তারপরে সেই বিস্ময় রূপ নেয় উন্মত্ত রাগে।
“সরে যা!” সে গর্জে ওঠে। “আজ আমি ওকে শেষ করেই ছাড়বো!”
সে আবার তেড়ে যেতে চাইলে অর্ষা নিজেকে ছুড়ে দেয় তার সামনে, এবার তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
“না! আমি যেতে দেব না! আপনি যদি ওকে মারেন, তবে আমাকেও মারতে হবে!” তার কণ্ঠে তীব্র কাতরতা।
ওয়াজফান ছুরিটি ঝাঁকিয়ে ফেলে দেয় মাটিতে।
তার রাগ যেন এখন মুখ দিয়ে আগুন হয়ে বেরোতে চাইছে।
সে হাত বাড়িয়ে অর্ষার চুলের মুঠি ধরে মুখটা টেনে আনে নিজের খুব কাছে। আরেক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে তার চোয়াল।

“তুই… তুই ওকে বাঁচাতে চাইছিস কেন?”
তার চোখের ভিতর যেন আগ্নেয়গিরির মতো লাভা ফুটে উঠছে।
“বল! তুই কি ওকে ভালোবাসিস? বল!!”
অর্ষা কাঁপতে কাঁপতে মাথা দুদিকে নাড়ে। চোখে জল টলমল করছে।
“না…” ফিসফিস করে সে। “আমি তাকে ভালোবাসি না…”
ওয়াজফানের চোখে তখনও বিশ্বাস নেই।
সে এবার অর্ষার গলা চেপে ধরে।
“তাহলে… কেন? সত্যি বল! না হলে আমি এবার নিজের হাতেই শেষ করব ওকে!”
অর্ষা শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছে, তবু টুটে যাওয়া কণ্ঠে বলে ওঠে—
“আমি ওকে ভালোবাসি না… তবে ও আমার বন্ধু ছিল। আমাকে এক সময় বাঁচিয়েছিল… ও আমার ভালো বন্ধু। শুধু বন্ধু। প্লিজ… ওকে মারবেন না…”
ওয়াজফান স্থির হয়ে যায়।

তার দৃষ্টিতে এখন এক বিষণ্ন আগুন—যেটা পোড়াচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই নিভছে না।
তার শক্ত করে ধরা হাত ঢিলে হয়ে আসে…
আর পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়ে এক বোবা নীরবতা নেমে আসে।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে অর্ষার চোখে চোখ রাখে।
তার সোনালি চোখ জ্বলছে রুদ্ধশ্বাস আগুনে।
এক মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ঠিক আছে… আমি ওকে মারব না।”
অর্ষার চোখে খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসার আগেই সে ঠান্ডা গলায় বলে,
“তবে… একটা শর্ত আছে।”

তার ঠোঁটে এক বাঁকা, অন্ধকার হাসি খেলে যায়।
“Kiss me.”
অর্ষার বুক ধক ধক করে ওঠে।
তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়—
“কি…?”
ওয়াজফান সামনে এগিয়ে আসে,
“হ্যাঁ। এখনই। চুমু খাও আমাকে। তাহলে ও বেঁচে যাবে।”
অর্ষার সমস্ত শরীর জমে যায়।
পেছনে ক্যালিয়নের উপস্থিতি তাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে।
সে জানে, ক্যালিয়ন বাধা পড়ে আছে, তবে তাকিয়ে আছে এই দৃশ্যের দিকে—এটা অর্ষা ঠিকই টের পাচ্ছে।
সে একটু ঘুরে ক্যালিয়নের দিকে তাকাতে চায়,
কিন্তু ঠিক তখনই—

ওয়াজফান তার চুলের মুঠি ধরে টেনে নেয় মুখের কাছে, চোখ রাগে জ্বলে উঠেছে।
“একদম তাকাবি না ওর দিকে।
তুই যদি ওর দিকে তাকাস, তাহলে তোর চোখ… আর ওর জীবন—দু’টোই শেষ হবে।”
অর্ষার নিঃশ্বাস আটকে আসে।
মনে হচ্ছে, সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে কোনো অজানা অন্ধকারে।
ওয়াজফান আবার গর্জে ওঠে—
“কর। যা বলেছি—তা কর। না হলে আমার ধৈর্য আর থাকবে না।”
অর্ষা ধীরে ধীরে ওয়াজফানের দিকে এগিয়ে যায়।
তার ভেতরটা কাঁপছে—লজ্জা, ভয় আর অপমান মিশে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা।
সে ওয়াজফানের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ তুলতে চায়, কিন্তু ওয়াজফান এতটাই লম্বা যে ঠোঁটে ঠোঁট মেলানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।

তবু অর্ষা পায়ের পাতার ওপর ভর করে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করে।
কিন্তু তবুও—ছোঁয়া যায় না।
ওয়াজফান যেন অপেক্ষায় ছিল এই দৃশ্যের জন্য।
সে আলতো করে তার কোমরে হাত রেখে তাকে নিজের কোলে তুলে আনে।
অর্ষা তার গলা জড়িয়ে ধরে—ভয় আর অসহায়তায় তার হাত কাঁপছে।
ওয়াজফান তার মুখ কাছে আনে, চোখে এক জয়ী অন্ধকার দীপ্তি—
আর তারপর—
তার ঠোঁট ছুঁয়ে যায় অর্ষার ঠোঁটে।
একটা হালকা, কিন্তু দাবিময় চুম্বন।

ওয়াজফানের ঠোঁট অর্ষার ঠোঁটে ছুঁতেই যেন এক উন্মত্ত ঝড় বয়ে যায়। অর্ষা সরে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু পারল না। ওয়াজফানের শক্ত হাত তার পেছন ঘিরে ধরে রাখল, যেন তাকে এই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে একমাত্র নিজের করে নিতে চায়।
সে বারবার, পাগলের মতো, উন্মাদের মতো চুম্বন করে চলল অর্ষার ঠোঁটজোড়া। সেই চুমুতে ছিল দাবানলের তাপ, একরাশ অধিকারবোধ, আর অন্ধ আবেগ।
অর্ষা চোখ বন্ধ করে ফেলল, শরীরটা অবশ হয়ে আছে, সে শুধু অনুভব করছে বুকের কাছে পোশাকে খামচে ধরা নিজের হাত, আর ওয়াজফানের তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া।
আর তখনই—
দূর থেকে ভেসে এলো ক্যালিয়নের গলা।

“LET HER GO! SHE’S MY RED WINE!” — ক্যালিয়নের কণ্ঠে ছিল বিষাদ আর হাহাকার।
তার চোখ বিস্ফারিত, দৃষ্টি অগ্নিময়, বুকের ভেতরটা যেন কেউ ছুরি দিয়ে কেটে দিচ্ছে।
“F*cking monster! Don’t you dare touch her! She’s mine, dammit!”
কিন্তু ওয়াজফান শুনছে না। বরং আরও ধীরে ধীরে অর্ষাকে নিয়ে বিছানায় নামিয়ে ফেলে—একটা ধ্বংসাত্মক আবেগে পরিপূর্ণভাবে।
তবুও সে থামে না। তার ঠোঁট একবার কপালে, একবার গালে, আবার ঠোঁটে চুমু খেয়ে চলে যায়—প্যাশনেটলি, যেন প্রতিটি চুম্বনে সে অর্ষাকে গিলে ফেলতে চায়।
অর্ষা চোখ বন্ধ করেই আছে—তার বুকের কাপড় আঁকড়ে ধরে—তবুও সে যেন নিঃশব্দে লড়ছে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে।

এদিকে ক্যালিয়ন দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে, যেন যে কোনো মুহূর্তে নিজেকে ছাড়িয়ে ঝাপিয়ে পড়বে।
তার চোখ লাল, নিঃশ্বাস অস্থির। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে—
“Leave her now! Before I rip your heart out, Wazfan!”
ওয়াজফান তখন চোখ তুলে তাকায় ক্যালিয়ন এর দিক।
তার চোখে বিদ্রুপ—যেন বলছে, “তোর কিছু করার নেই। সে এখন আমার।”
কিন্তু তার ঠোঁট থামে না। বরং সেই চোখ রেখেই আরও গভীর, আরও তীব্র এক চুম্বনে ডুবে যায় অর্ষার ঠোঁটে।
ওয়াজফান যেন থামতেই চায় না। চুম্বনের খপ্পরে পড়ে অর্ষার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের ভেতর হাহাকার, ফুসফুসে বাতাস নেই, শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। সে যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। ঠিক তখনই, ওয়াজফান তার ঠোঁট সরায়।

অর্ষা হাঁপাতে থাকে… জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে… যেন একেকটা শ্বাসে বেঁচে থাকার যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে সে।
কিন্তু মুক্তি মিলল না…
ওয়াজফান হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে তার গলায় দাঁত বসিয়ে দেয়—ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে কিছুক্ষণ আগে ক্যালিয়ন নিজের কপাল ঠেকিয়ে রেখেছিল।
“আর কেউ নয়, এখন থেকে এই চিহ্ন শুধু আমার!” – ওয়াজফানের গলায় এক ঠাণ্ডা, অথচ মালিকানার গর্জন।
অর্ষা মৃদু চিৎকার করে উঠে। সেই চিৎকারে যেন ক্যালিয়নের হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
ওয়াজফান উঠে দাঁড়ায়। তারপর কোনো দ্বিধা ছাড়াই অর্ষাকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
আর পেছনে…

Death or Alive part 17

ক্যালিয়ন বসে থাকে নত মাথায়।
এক ব্যর্থ, হৃদয় ভাঙা প্রেমিক।
তার চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় তার ভালোবাসা—কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।
ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে সে। কণ্ঠ আটকে আছে, চোখে জল নেই… শুধু এক নিঃশব্দ কান্না, এক নীরব চিৎকার।
তার সমস্ত আলো যেন নিভে গেছে আজ।

Death or Alive part 19

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here