Death or Alive part 24
priyanka hawlader
ঘরের ভেতর আলো নেভানো।
শুধু আয়নাঘরের কোণায় থাকা সেই একটিমাত্র আয়না—যেটা আজ রাতে অনেক কিছু দেখে ফেলেছে।
মেঝেতে দুটো শরীর নগ্ন …
একটা শরীর নিথর, আরেকটা শরীর তাতে জড়িয়ে আছে ঘুমিয়ে… শান্ত, গভীর নিদ্রায়।
ওয়াজফান অর্ষার বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে।
তার নিঃশ্বাস এখন ভারী নয়, শান্ত।
সেই পুরুষটি, যে কিছু ঘন্টা আগেও ছিল উন্মত্ত… এখন যেন শিশুর মতো শান্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু অর্ষা…?
সে নিঃশব্দ, নিথর।
তার চোখ বন্ধ, ঠোঁট ফাঁকা, শরীর নিস্তেজ।
আসলে রাতের একটা মুহূর্তে…
যখন ওয়াজফান নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল তার ভালোবাসায়, তার উন্মাদ আবেগে—
তখন অর্ষা ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে শুরু করেছিল।
সে আর সইতে পারছিল না…
না ভালোবাসার ছোঁয়া, না ক্লান্তির ভার।
একসময় নিঃশব্দেই নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে…
অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু ওয়াজফান সেটা বুঝতেই পারেনি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে মগ্ন ছিল, নিমজ্জিত ছিল তার স্ত্রীর প্রতিটি প্রতিক্রিয়ায়, তার গন্ধে, তার ত্বকে—
ততটাই তীব্রভাবে, যেভাবে এক পিপাসার্ত পথিক জলের খোঁজে বালু চুষে নেয়।
১২ ঘণ্টা…
এমনকি সময়ও যেন থেমে গিয়েছিল তাদের চারপাশে।
আর যখন ওয়াজফান থামলো…
তখন ভোর গড়িয়ে দুপুর। এরপর সে সেভাবে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
এরপর তার ধীরে ধীরে চোখ খোলে।ঘুম ভেঙে সে লক্ষ করলো…
অর্ষা নিস্পন্দ।
তার কপালে হাত রাখতেই এক ঝটকায় উঠলো বাস্তবতা।
লিটল মনস্টার …!
তার গলায় চাপা ভয়।
তীব্র আবেগে ভরা কণ্ঠে সে অর্ষার নাম ধরে ডেকে উঠলো,
চোখের কোণ দিয়ে সেই পুরুষেরও এই প্রথম ভয় ধরা পড়লো—
যার নাম ওয়াজফান।
যে নিজেকে ঈশ্বর মনে করে… অথচ এই মুহূর্তে অসহায়।
১২ ঘন্টা…
একটানা, এক নিঃশ্বাসে, এক উন্মাদনায়—
ওয়াজফান যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল অর্ষার ভেতর।
সে বুঝতেই পারেনি কখন সময় গলে গেছে…
আর কখন তার লিটল মনস্টার নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে একেবারে।
আলো নিভে থাকা আয়নার ঘরে যখন ওয়াজফানের নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে,
তখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো
ঠাণ্ডা… নিথর… নিস্পন্দ দেহের উপর।
আর উঠে এটা দেখতে পায় সে,
সে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়লো অর্ষার ওপর।
চোখের পাতা তুলতে চাইল, সাড়া নেই।
ঠোঁটে ডাক এলো—ধীরে, জোরে… তারপর প্রায় কাছাকাছি কণ্ঠে—
“লিটল মনস্টার… কি হয়েছে তোমার? উঠো…”
তার কণ্ঠে সেই বুনো পুরুষটার কোনো অস্তিত্ব নেই আর।
শুধু ভয় আছে, অপরাধবোধ আছে,
আর আছে তার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক।
সে অর্ষার বুকের কাছে কান রাখে…
হৃদস্পন্দন ধীরে… কিন্তু আছে।
সে হাফ ছেড়ে বাঁচে, কিন্তু স্বস্তি আসে না।
এক মুহূর্ত দেরি না করে,
নিজের পাজামা পড়ে এরপর নিজের লম্বা পোশাক দিয়ে অর্ষার শরীর পুরোটা ডেকে নেয়।
ওয়াজফান অর্ষাকে কোলে তুলে নেয়।
ভালোবাসায় নয়, অধিকারবোধে নয়—
এই প্রথম, শুধুমাত্র তীব্র ভয়ের ঘামে ভেজা এক পুরুষের তাড়নায়।
সে ধীরে ধীরে হাঁটে করিডোর পেরিয়ে নিজের রুমে।
মাথায় অর্ষার চুল পড়ছে, শরীরটা হালকা অথচ ভারী…
প্রতিটা পা ফেলতে ফেলতে সে মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার দেয়—
“আমি কি ওকে ভেঙে ফেলেছি…?”
“আমি কি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছি…?”
রুমে ঢুকেই সে বিছানায় অর্ষাকে শুইয়ে দেয়।
তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে রাখে কয়েক সেকেন্ড…
এরপর ধীরে ধীরে বলে,
“প্লিজ… চোখ খোলো, লিটল মনস্টার…
আর কখনো তোমাকে এইভাবে কষ্ট দেবো না আমি… কসম…”
ওয়াজফান এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলো না।
অর্ষার নিথর শরীরটা আবার কোলে তুলে নিয়ে সোজা নিয়ে গেলো রাজপ্রাসাদের স্নানঘরে।
গরম জল ছাড়লো, নিজের হাতে ধীরে ধীরে গায়ে জল ঢালতে শুরু করলো।
তার একটুও তাড়া নেই।
সে যেন ধুয়ে ফেলতে চাইছে সব ব্যথা, সব ক্লান্তি, সব অশ্রু—যা হয়তো অর্ষা মুখে বলেনি, কিন্তু শরীর বলে দিয়েছে।
তারপর খুব যত্নে, নিজের হাতে পরিয়ে দিলো একটা বড় ঢিলেঢালা টি-শার্ট, আর একটা সাদা প্লাজো।
সবশেষে একটা পাতলা কোমল কম্বল জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো অর্ষাকে।
তবুও চোখ মেলে না অর্ষা।
তবুও ঠোঁটে নেই কোনো সাড়া।
ওয়াজফান মাথার কাছে বসে পড়ে, এক হাত দিয়ে অর্ষার চুল সরিয়ে কপালে চুমু খায়।
তার চোখ এখন আর আগুনে জ্বলছে না,
বরং দুটো নদীর মতো…
যেখানে কিছু শব্দ আটকে আছে, যেগুলো সে বলতে জানে না।
অবশেষে সে উঠে দাঁড়ায়।
একটা জিনি-বাহিত জাদুর ঘূর্ণিতে খবর পাঠিয়ে দেয় রাজ বৈদ্ধকে।
“অর্ষা ঠিক নেই… ওকে দরকার তোমার। এখনই।”
তারপর ধীরে পেছনে তাকিয়ে দেখে…
ঘুমন্ত অর্ষা—
আর তার নিজের ভেতরের একরাশ নীরব অস্থিরতা।
রাজপ্রাসাদের দরজা খুলতেই ঢুকলেন রাজ বৈদ্ধ—
সাদা দাড়ি, গম্ভীর মুখ, হাতে প্রাচীন কাঠের বাক্স।
ওয়াজফান কোনো কথা না বলে তাকে সরাসরি অর্ষার কাছে নিয়ে গেলো।
বিছানায় অর্ষা এখনো নিথর, কপালে হালকা ঘাম, ঠোঁট ফ্যাকাসে।
রাজ বৈদ্ধ তার হাত ধরে চোখ বন্ধ করলেন,
ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিয়ে যেন শরীরের ভিতরের স্রোত পড়তে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি ওয়াজফানের দিকে তাকালেন—
দৃষ্টি ছিল সরল, কিন্তু তাতে তিরস্কারের এক হালকা রেশও ছিল।
“বাদশা, তেমন ভয় নেই। তবে…”
তার কণ্ঠে এক ধরনের সতর্কতা।
“উনি মানুষ-কন্যা। মানুষের শরীর এত দীর্ঘ সময়ের… মিলন সহ্য করার জন্য তৈরি নয়।
আপনি জিন—আপনার হ্মম… শক্তি, সহনশক্তি—মানুষের তুলনায় বহু গুণ বেশি।
আপনি যেটা টানা করেছেন… সেটা রানীর জন্য প্রায় মারাত্মক ছিল।”
ওয়াজফান নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে।
চোখে অনুশোচনা, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই।
রাজ বৈদ্ধ তার দিকে আরও এক পা এগিয়ে এসে হালকা হাসলেন,
“বাকিটা আপনি বুঝদার… বুঝেই গেছেন, আমি কি বলতে চাইছি।”
এরপর তিনি অর্ষার কপালে হাত রেখে একটি ছোট শিশি খুললেন।
তার ভেতরে ছিল গাঢ় নীল রঙের ওষুধ—
যা অতি বিরল ভেষজ থেকে তৈরি।
তিনি তা ধীরে ধীরে অর্ষার ঠোঁটে ঢেলে দিলেন।
“আমি রানী সাহেবাকে ঔষধ দিয়ে দিয়েছি।
তবে জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে—এক দিন।”
এ কথা বলে রাজ বৈদ্ধ বাক্স বন্ধ করলেন,
একবার ওয়াজফানের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ঘরে এখন শুধু নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ…
ওয়াজফান একা দাঁড়িয়ে,
তার বুকের ভেতরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে—
যা ক্ষমার প্রার্থনার মতো, কিন্তু সে এখনো মুখে আনেনি।
রাজ বৈদ্ধ চলে যাওয়ার পর ঘরে আবার নীরবতা নেমে এলো।
শুধু অর্ষার ধীর নিঃশ্বাসের শব্দ আর মশারির ভেতরে বাতাসের হালকা দোলা।
ওয়াজফান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো—
তার ভেতরে যেন যুদ্ধ চলছে।
তার চোখ একবার অর্ষার মুখে, একবার নিজের হাতে।
শেষমেশ ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এসে বসল।
সে ঝুঁকে পড়লো অর্ষার ঠোঁটের দিকে,
খুব নরম, নিঃশব্দ এক চুমু দিল—
যেন ক্ষমা চাইছে,
যেন বলতে চাইছে “আমি আছি…”
এরপর ধীরে কম্বলের ভিতরে ঢুকে পড়লো,
অর্ষার পাশে শুয়ে তার গা ঘেঁষে।
নিজের হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো ঠিক যেভাবে
ঝড় শেষে কেউ নিজের হারিয়ে যাওয়া জিনিসকে আঁকড়ে ধরে রাখে।
একসময় হাত বাড়িয়ে আলতো করে অর্ষার টি-শার্টের ভেতরে ঢুকে গেলো,
শুধু বুকের ওপর মাথা রাখলো।
সেই বুকের ধীর স্পন্দন শুনে তার চোখ ধীরে ভিজে উঠলো—
এখনো বেঁচে আছে, এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তি।
নিম্ন স্বরে, প্রায় ফিসফিস করে বললো—
“সরি… লাড্ডু।
এরপর থেকে খেয়াল রাখবো… সবটা।”
তার কণ্ঠে আর সেই বাদশার অহংকার নেই,
শুধু আছে এক প্রেমিকের ভয় আর প্রতিশ্রুতি।
জ্যাইম নিজের প্রাসাদের এক অন্ধকার কক্ষে একা বসে আছে। চারপাশে শুধু নীরবতা, আর সেই নীরবতার গভীরে ডুবে আছে তার মন। যেন এই অন্ধকার ঘরটাই গিলে নিচ্ছে তার সব রাগ, দুঃখ আর অভিমান।
কিছুক্ষণ আগের এলিনার সাথে কথা বলার মুহূর্তগুলো বারবার ভেসে উঠছে তার চোখে।
সে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছিল এলিনাকে সামলে রাখতে, যাতে সে নিজের অতীতের ভারে ভেঙে না পড়ে। কিন্তু হঠাৎই এলিনা বিরক্ত হয়ে, কণ্ঠে অস্থিরতার ঝড় বইয়ে, চিৎকার করে বলে ওঠে—
— “জ্যাইম, তুই চলে যা এখান থেকে! প্লিজ, আমাকে একটু একা থাকতে দে। আমি একা থাকতে চাই… প্লিজ।”
কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে বিঁধলো জ্যাইমের বুকে। তবুও সে নিজেকে সামলে মৃদু কণ্ঠে বলল—
— “আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই যেহেতু আমাকে যেতে বলছিস, আমি যাচ্ছি। কিছুক্ষণ একা থাক, কিন্তু আবার কোনো পাগলামি করে বসিস না। তাহলে কিন্তু তোকে খুব বকব। ঠিকমতো খেয়ে নিস, নিজের খেয়াল রাখিস… এভাবে নিজেকে ভেঙে পড়তে দিস না।”
এ কথা বলে সে ধীরে ধীরে রাজ্য ছেড়ে চলে গেল নিজের রাজ্যে।
পিছনে এলিনা দরজা বন্ধ করে নিজেকে এক নিঃসঙ্গ কারাগারে আবদ্ধ করল।
রাজ্যে ফিরে এসে জ্যাইমও নিজেকে এক অন্ধকার ঘরে বন্দি করে দিল।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে—চোখে অশ্রুর বন্যা। মাথা যেন ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরছে, বুকের ভেতর কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। কখনো দু’হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে, কখনো ঠান্ডা দেয়ালে নিজের মাথা আঘাত করছে সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু গলায় শব্দ আটকে যাচ্ছে—শুধু বুকের ভারে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
হঠাৎ সে নিজের হাত শক্ত করে কামড়ে ধরল—এতটাই জোরে যে চামড়া ছিঁড়ে মাংস উঠে এলো, আর গাঢ় রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
ভালোবাসার এই বিষাক্ত ছোবল ধীরে ধীরে নীল বিষে বিষাক্ত করে দিচ্ছে তার দেহ ও মনকে।
সে জানে না, কতক্ষণ আর এই যন্ত্রণা সইতে পারবে…
একদিন পর—
সকালের আলো পর্দা ভেদ করে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছে।
অর্ষার চোখের পাতা কেঁপে উঠলো, তারপর ধীরে খুলে গেল।
প্রথমেই চোখে পড়লো—
পাশেই বসে আছেন ওয়াজফান, হেলান দিয়ে, চোখ বন্ধ।
ঘুম যেন তাকে স্পর্শ করলেও পুরোপুরি গ্রাস করেনি।
তার মুখের ক্লান্ত রেখাগুলো স্পষ্ট বলছে—
সে হয়তো টানা একদিন জেগেই থেকেছে,
অর্ষার শ্বাস-প্রশ্বাস গুনেছে, আর নিঃশব্দে প্রার্থনা করেছে।
অর্ষার ঠোঁটে হালকা মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
নরম স্বরে বললো—
“এভাবে ঘুমাচ্ছেন কেন? সোজা হয়ে শুয়ে ঘুমান… ঘাড়ে ব্যথা করবে।”
ওয়াজফানের চোখ হঠাৎ খুলে গেলো—
যেন কারও প্রিয়তম ডাক তাকে ঘুমের গভীর অন্ধকার থেকে টেনে তুলেছে।
সে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো, অবিশ্বাস আর স্বস্তির মিশেলে।
তারপর আর নিজেকে সামলাতে পারলো না—
ঝুঁকে পড়লো, অর্ষাকে জড়িয়ে ধরলো,
তার ঠোঁট, কপাল, গাল—পুরো মুখ জুড়ে চুমুতে ভরিয়ে দিলো।
“তুমি… কখন উঠলে? আমাকে জাগাওনি কেন?”
তার কণ্ঠে রাগ নেই, আছে অস্থির ভালোবাসা।
“পুরো একদিন ধরে তুমি জ্ঞান হারিয়ে ছিলে… হুঁ?”
অর্ষা শুধু তাকিয়ে রইলো তার দিকে,
চোখে এক অদ্ভুত নীরবতা—
যেখানে অভিমান, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা একসাথে কথা বলছে।
বিকেলের আকাশটা যেন সোনালি আঁচে রাঙানো। জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলো ঘরে ঢুকে পড়ছে, মেঝেতে ছড়িয়ে দিচ্ছে উষ্ণ সোনালি রঙের ছায়া। হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে, আর দূরে কোথাও পাখির ডাকে নীরবতা ভাঙছে।
ইসাবেলা বিছানার কোণে বসে, হাতের আঙুলে চুলের গোছা পাকিয়ে, মিষ্টি হেসে অর্ষার দিকে তাকাল।
—ভাবি, জানো… আমি তোমাদের দুনিয়া সম্পর্কে অনেকের কাছ থেকে শুনেছি।”
অর্ষা একটু অবাক হয়ে হাসল,
— “কি শুনেছো আমাদের দুনিয়া সম্পর্কে?”
ইসাবেলা জানালার বাইরে একবার তাকিয়ে যেন কল্পনার ভেতর হারিয়ে গেল, তারপর ধীরে বলল—
— “শুনেছি, সেখানকার দেশীয় কালচার… ঐতিহ্য… আর সেই মনোহর পরিবেশ, সত্যিই মনকে মুগ্ধ করে তোলার মতো। আমি কখনো যাইনি, না নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু যতটুকু শুনেছি, তাতেই বুঝতে পারি যে দুনিয়াটা কতটা সুন্দর।”
এক মুহূর্ত থেমে, ইসাবেলা চোখ মেলে অর্ষার দিকে তাকাল—
— “আর দেখো, তোমার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে আমি এখন বুঝে গিয়েছি, সেখানকার মানুষের মনও কতটা আন্তরিক।”
অর্ষা নীরবে হাসল, জানালার বাইরের সোনালি আলো যেন তাদের কথায় মিশে, ঘরটিকে আরও উষ্ণ করে তুলল।
অর্ষা ধীরে বলল—
— “হুম, তা ঠিক বলেছো। সত্যি… এখন আমারও আমার দেশের কথা মনে পড়ছে।”
ইসাবেলা উজ্জ্বল চোখে ঝুঁকে এলো, যেন গোপন কিছু বলতে যাচ্ছে—
— “যানো ভাবি, আমার না… তোমাদের দুনিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। কিন্তু দা ভাই আমাকে কিছুতেই অনুমতি দেয় না। আচ্ছা, দা ভাই তো তোমার সব কথা শোনে, তাই না? তুমি বললেই তো সে রাজি হয়ে যাবে। প্লিজ ভাবি, তুমি না একটু দা ভাইকে বোঝাও, যেন সে আমাকে তোমাদের দুনিয়ায় যেতে দেয়।
অর্ষা মাথা নেড়ে হেসে ফেলল—
— “না বাবা, আমি ওই গোমড়া মুখটাকে কিছু বলতে পারব না। তার রাগ তো তুমি জানোই—কিছু বলার আগেই আগুনের মতো জ্বলে ওঠে।”
ইসাবেলা ঠোঁট ফুলিয়ে মিষ্টি অভিমানী ভঙ্গিতে বলল—
— “প্লিজ প্লিজ প্লিজ ভাবি, আর না করো না… আমি জানি, দা ভাই তোমার কথাই শুনবে। সে তো তোমার সাথে রাগ দেখায় না।”
অর্ষা ভ্রু তুলে হালকা হেসে উত্তর দিল—
— “কে রাগ দেখায় না? ভালোবাসার সময় ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু যখন রেগে যায়… তখন তার হাতের শক্ত মার থেকে আমিও রেহাই পাই না।”
ইসাবেলা একটু চুপ করে অর্ষার মুখের দিকে তাকাল, যেন কিছু বুঝতে চাইছে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে মন খারাপের ভঙ্গিতে বসে রইল। জানালার বাইরের রোদ তখন ফিকে হয়ে আসছে, আর ঘরের ভেতরটা হঠাৎ যেন নীরব হয়ে গেল।
অর্ষা এবার ইসাবেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলে,
কি হয়েছে, আমার বান্ধবী? মন খারাপ? আমার সাথে রাগ করেছো নাকি?”
ইসাবেলা কিছু বলল না, চুপ করে বসে থাকল।
অর্ষা মুচকি হেসে কণ্ঠে দুষ্টুমি মিশিয়ে বলল—
— “হুমম… আমি তো ভাবছিলাম, তোমার বিষয় নিয়ে তোমার দা ভাইয়ের সাথে কথা বলব, যাতে সে তোমাকে আমাদের দুনিয়ায় যেতে দেয়। কিন্তু এখন তো দেখছি তুমি আমার সাথে রাগ করে বসে আছো… তাহলে আর তোমার দা ভাইয়ের সাথে কথা বলাটা হবে না।”
ইসাবেলা হঠাৎ মুখ তুলে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল—
— “ভাবি, তুমি সত্যি ভাবছিলে দা ভাইয়ের সাথে আমার জন্য কথা বলবে?”
অর্ষা কোমল কণ্ঠে বলল—
— “হুম, সত্যি। আমার বান্ধবী আমার কাছে একটা আবদার করেছে, আর আমি সেটা রাখব না—এটা কি কখনো হয়?”
শুনে ইসাবেলা খুশিতে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরল।
অর্ষা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল—
— “হুম, এত খুশি হয়ে লাভ নেই। আগে তোমার দা ভাই মানুক, তারপর খুশি হও। আমি চেষ্টা করব ঠিকই, কিন্তু সে মানবে কিনা… সেটা আলাদা ব্যাপার।”
ইসাবেলা তাড়াতাড়ি বলল—
— “তুমি আগে চেষ্টা তো করো ভাবি, তুমি চেষ্টা করলে না মেনে যাবে কোথায়!”
অর্ষা মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বলল—
— “ওকে… তাহলে চেষ্টা করে দেখি।”
ইসাবেলা উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বলল—
— “Thank you, ভাবি!”
দু’জনের হাসিমাখা মুখে বিকেলের সোনালি আলো গড়িয়ে পড়ছিল। এমনই হাসি-আড্ডা, খুনসুটি আর উষ্ণতায় বিকেলটা কেটে গেল।
রাতের নীরবতা ভেদ করে মৃদু প্রদীপের আলোয় রাজকক্ষ আলোকিত।
ওয়াজফান মাথা নিচু করে বসে আছে—
টেবিল ভর্তি রাজসভার কাগজপত্র, সিলমোহর, আর জরুরি চিঠি।
তার ভ্রু কুঁচকে আছে, চোখ এক মুহূর্তের জন্যও উঠছে না কাগজ থেকে।
দেখেই বোঝা যায়—এটা রাজ্যের কোনো জরুরি বিষয়,
যা বাদশাহের মন পুরোপুরি গ্রাস করে রেখেছে।
তার ঠিক কয়েক কদম দূরে,
অর্ষা ধীরে ধীরে পায়চারি করছে।
তার চোখে একরাশ দ্বিধা—
মনে অনেক কথা, কিন্তু কিভাবে বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না।
কখনও তার পা থামে,
কখনও আবার সামনে-পেছনে ঘুরে বেড়ায়।
কিন্তু ওয়াজফানের দৃষ্টি একবারও ওঠে না তার দিকে—
সে যেন রাজ্যের সিংহাসনের ভারে ডুবে গেছে পুরোপুরি।
অর্ষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে,
তার বুকের ভেতরে জমে ওঠে এক দীর্ঘশ্বাস…
এরপর,
ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে অর্ষা গিয়ে ওয়াজফানের পাশে বসল।
ওয়াজফান এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকাল,
অর্ষা তাকে একটি ছোট্ট হাসি দিল—
যেন চোখের ভাষায় বলছে “আমি আছি”।
ওয়াজফানও মুচকি হাসল, তবে সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে আবার কাগজের জগতে ডুবে গেল।
অর্ষা গভীর নিঃশ্বাস নিল—
দ্বিধা আর সাহসের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য লড়াই চলছে।
ধীরে ধীরে তার আঙুল এগিয়ে এলো,
ওয়াজফানের মাঝের পোশাকের এক কোণা আলতো করে টেনে ধরল।
একটু চাপ দিল, যেন নিঃশব্দে বলছে “শুনো আমাকে…”।
ওয়াজফান থেমে গেল।
ধীরে মুখ তুলে অর্ষার দিকে তাকাল—
সেই দৃষ্টি যেন সরাসরি তার মনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল।
একটা হালকা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।
“বল… কী বলতে চাও?
কি ভেবেছো আমি বুঝিনি, হুম?
এতক্ষণ ধরে শুধু কিছু বলার জন্য এভাবে পায়চারি করছো।
বলো… কী চাই?”
তার কণ্ঠে ছিল রাজকীয় দৃঢ়তা,
কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত নরমতা—
যেন উত্তর শোনার আগেই সব জানে।
অর্ষা একটু থমকে থেকে ধীরে ধীরে বলল—
“আপনি না… আমায় বলেছিলেন, বিয়ের পর নিয়ে যাবেন মা–বাবার সাথে দেখা করাতে…”
ওয়াজফান অর্ষা চোখে চোখ রাখলো,
তার ঠোঁটে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল এক প্রশস্ত হাসি।
সে হাত বাড়িয়ে অর্ষার গাল আলতো করে টেনে নিল,
যেন তার এই ছোট্ট অভিমানটাকে মিষ্টি খেলায় রূপ দিল।
“হুম… কথা দিয়েছি, তাই নিয়ে যাবই।
তবে এখন আমার আর রাজ্যের কিছু জরুরি কাজ আছে।
ওগুলো শেষ করতে কিছুদিন লাগবে, বেবি।
সব ঠিক হলে… তখন নিয়ে যাব।”
বলে সে অর্ষার কপালে এক উষ্ণ চুমু খেল,
যেন প্রতিশ্রুতিটা সীলমোহর দিয়ে দিলো।
কথা গুলো বলে,
ওয়াজফান আবার দৃষ্টি ফেরাল রাজকীয় কাগজপত্রে—
কলমের খসখস শব্দে ঘরের নীরবতা ভেঙে গেল,
আর অর্ষা চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার দিকে কিছুক্ষন…
মনে অদ্ভুত এক অপেক্ষার অনুভূতি জমে উঠল।
ওয়াজফান তখনও নিজের কাজে ডুবে।
অর্ষা ধীরে হাত বাড়িয়ে তার জামার এক কোণা ধরে টান দিল,আবার
নিম্ন স্বরে বলল—
“শুনুন না… আমার কথা বলা তো এখনও শেষ হয়নি।”
ওয়াজফান মাথা তুলে তাকাল।
“হুম… বলো, এবার কী বলার আছে তোমার?”
অর্ষা ভেতরে ভেতরে কাঁপছে—
সরাসরি বলার সাহস যেন গলায় আটকে গেছে।
হঠাৎ, না ভেবেই, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল—
“I love you…”
ওয়াজফান মৃদু হাসল।
তার চোখে যেন বোঝার ঝিলিক—
“কি মতলব তোমার, শুনি? হুমম… এরকম মিষ্টি মিষ্টি কথার ফাঁকে আমাকে ফাঁসিয়ে যা বলার, সরাসরি বলে ফেলো।”
অর্ষা একটু ইতস্তত করে—
“হুম… বলছি, কিন্তু তার আগে আপনি বলুন, কথাটা শুনে রাগবেন না, আর আমাকে বকবেনও না?”
ওয়াজফান ঠোঁট বাঁকিয়ে—
“যদি কথাটা আমাকে রাগানোর মতো হয়, তাহলে রাগবই। আর তোমার বকা খাওয়ার মতো হলে বকা তো খাবেই।”
অর্ষা এবার ভয়ে ভয়ে আসল কথাটা বলল—
“আমি শুনেছি, ইসাবেলার নাকি মানব–দুনিয়ায় ঘুরতে যাওয়ার অনেক শখ। ও কখনো যায়নি সেখানে। কিন্তু আপনি ওকে যেতে দেন না। প্লিজ… এবার অন্তত ওকে যেতে দিন। ওয়াজফান… আপনি ‘না’ বলবেন না।”
ওয়াজফানের চোখ মুহূর্তেই কঠিন হয়ে উঠল।
কর্কশ স্বরে বলল—
“সেটা কোনো দিনও সম্ভব নয়, লিটল মনস্টার।
আমি জেনে–বুঝে আমার বোনকে বিপদের মুখে দিতে পারব না।
আর হ্যাঁ—আমি তোকে বলিনি এ প্রাসাদের কারো বিষয়ে এত ভাবতে।
তুই শুধু আমাকে নিয়েই ভাববি, তাহলেই চলবে।”
অর্ষা তবু থামল না—
“আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন, ওয়াজফান, প্লিজ…
ও আর ছোট বাচ্চা নয় যে সবসময় আপনিই আগলে রাখবেন।
ও যথেষ্ট বড় হয়েছে, নিজের ভালো–মন্দ বোঝে।
আমার মনে হয়, এবার ওকে একটু ফ্রিডম দেওয়া উচিত।
অন্তত একবার একা যাক, নিজের জীবনের মজাটা উপভোগ করুক।
এ সময়টা চলে গেলে তো আর পারবে না…”
ওয়াজফান তাকিয়ে রইল—চোখে রাগ, মনে অদ্ভুত এক দ্বিধা।
ওয়াজফানের ভ্রু কুঁচকে গেল, রাগ যেন ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে।
বিরক্তির সুরে বলে উঠল—
**“আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না, লিটল মনস্টার।
আমার বোন নিয়ে আমি কী করব, কী করব না—সেটা আমি খুব ভালো জানি।
তুমি সেটা আমাকে বুঝতে দাও।
তোমাকে কখনো ওর ব্যাপারে এত ভাবতে বলিনি।
আর হ্যাঁ—আমি কিছুতেই আমার বোনকে ওই মানব–দুনিয়ায় যেতে দেব না।
আমি মানুষদের একটুও বিশ্বাস করি না।
ওদের খুব ভালো করেই চিনি—নিজেদের স্বার্থে তারা যে কারো সঙ্গে যা খুশি করতে পারে।
সবটা জেনে–শুনেও আমি এমন জায়গায় আমার বোনকে ছেড়ে দিতে পারব না।”**
অর্ষা নরম স্বরে বলল—
Death or Alive part 23 (2)
“আমি বুঝছি আপনার দিকটা… কিন্তু আপনিও তো আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, প্লিজ…”
ওয়াজফানের গলা এবার কঠিন হয়ে উঠল—
“লিটল মনস্টার, আমি আর এই বিষয়ে একটা কথাও বলতে চাই না।
আমার মতামত স্পষ্ট—এবিষয়ে আমাকে আর মাথা খেও না।”
কথা শেষ করেই রাগে–মেগে নিজের সব কাজের কাগজপত্র হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ওয়াজফান।
পেছনে রইল অর্ষার নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।
 
