Death or Alive part 25
priyanka hawlader
রাত দীর্ঘ হয়ে উঠল।
ওয়াজফান ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে।
অর্ষা বিছানার উপরে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে শুয়ে আছে।
ওয়াজফান নিস্তব্ধে ঘরে ঢুকে, কোনো শব্দ না করে অর্ষার পাশে শোয়, তারপর আলতো হাতে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে।
অর্ষা সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজফানের হাতটা ছিটকে ফেলে দিয়ে উঠে বসে।
অর্ষার এমন ব্যবহারে ওয়াজফান অনেকটাই রেগে যায়।
সে হালকা বিরক্ত স্বরে বলে—
— “ওহহো লিটল মনস্টার, এভাবে দূরে সরলে কেনো? কাছে আসো বলছি এখুনি।
অর্ষা কিছু বলে না, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে শুধু।
ওয়াজফান আবারও অর্ষার কাছে গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কাঁধে থুতনি রাখে।
অর্ষা এবারও তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ওয়াজফান এতটাই শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল যে তার শক্তির কাছে সে পেরে ওঠে না।
তাই কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে বলে—
— “ছাড়ুন আমায়। কে যেনো বলেছিলেন, আমি যেনো তার মাথা না খাই, আমার কথায় সে বিরক্ত বোধ করছিলো। আমি যেনো তাকে আর বিরক্ত না করি— সে তো সেটাই চাইছিলো, তাই না? এখন তো আমি তাকে বিরক্ত করছি না, তাহলে সে নিজেই এখন কেনো এই বিরক্তিকর মানুষটার কাছে এসেছে? সে কি নিজের বলা কথাগুলো ভুলে গিয়েছে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওয়াজফান কিছুই বলে না।
সে জানে, কিছু বললে অর্ষা আরও বেশি রিয়্যাক্ট করবে।
তাই চুপচাপ অর্ষার ঘাড়ে মুখ গুঁজে আলতোভাবে তার ঠোঁট ছোঁয়ায় কাঁধে।
তারপর দীর্ঘ একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলে।
অর্ষা ওয়াজফানের এমন আচরণে আরও বেশি রেগে যায়।
সে রাগে ওয়াজফানকে এক ধাক্কায় নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
ওয়াজফানের চোখে তখন ঝড়ের কালো ছায়া।
তার ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ রাগ জমে আছে, কণ্ঠ নেমে এসেছে গা ছমছমে গম্ভীরতায়।
— “আমাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস কে দিলো তোমাকে, লিটল মনস্টার? দিন দিন সাহস যেন বেড়েই চলেছে তোমার। আমি কিছু বলি না বলে ভেবো না, তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে আর আমি চুপচাপ সহ্য করবো। আমার শক্ত হাতে মার খাওনি অনেকদিন তাই বলে কি ঘাড়ের রগগুলো এমন তিরতির করে উঠেছে? আবার দুটো পড়লে ঠিক সোজা হয়ে যাবে।”
অর্ষা মুখ তুলে তাকায়। চোখে তীব্র অভিমান, ঠোঁটে তীক্ষ্ণ উত্তর।
— “নিজে ভুল করেছেন, আর এখন রাগ দেখাচ্ছেন আমায়? ভুলে যাবেন না, রাগ শুধু আপনার একার নয়—আমারও আছে। আমিও রাগ করতে পারি। আর এই যে মারের ভয় দেখাচ্ছেন, সেটা আমার জন্য নয়, কারণ আমি আপনাকে ভয় পাই না।”
ওয়াজফানের কণ্ঠ তখন আরও গভীর, কিন্তু ঠাণ্ডা।
— “লিটল মনস্টার… আমার রাগটাকে কন্ট্রোলে রাখতে দাও। নয়তো একবার সেটা ছুটে গেলে কি হতে পারে, তুমি জানো। তখন তোমার জন্য আমাকে সামলানো কষ্টকর হয়ে যাবে।”
অর্ষার ঠোঁট বাঁকা হাসিতে টান খায়, কিন্তু তাতে কোনো কোমলতা নেই।
— “তাহলে চলে যান এখান থেকে। রাগও কমে যাবে। বিকেলে যেভাবে আমার কথা না শুনে আমাকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি এখন এখান থেকে চলে যান। কেন এসেছেন এখানে?”
ওয়াজফান এবার কিছুটা এগিয়ে আসে, চোখে হুকুমের দীপ্তি।
— “আমার ঘর, আমার বউ—আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি। তুমি কে, আমায় এখান থেকে বের করে দেওয়ার? আর তোমার সাহস হলো কি করে, আমার নিঃশ্বাসকে আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর?”
অর্ষার চোখে তখন তীব্র অভিমান। কণ্ঠে হিমশীতল ব্যঙ্গ মিশে যায়।
— “ও আচ্ছা… এখন আপনার মনে পড়ছে যে আমি আপনার বউ? কেন দুপুরে যখন বলেছিলেন যে আপনার বোনের বিষয়ে আমি যেন মাথা না ঘামাই… তখন? তখন তো আমি আপনার বোনের ব্যাপারে ভাবার মতো কেও ছিলাম না, তাই না? আপনার সেই বড় বড় কথাগুলো কি এখন ভুলে গিয়েছেন? নাকি শুধু রাত হলেই মনে পড়ে যায় যে আপনার একটা বউ আছে? না হলে তখন ঐ রকম কথা বলার সময় কি আপনার মনে ছিল যে সেই কথাগুলো আপনি আপনার বউকেই বলছেন?”
ওয়াজফান ঠোঁট চেপে ধরে, চোখে বিরক্তির ছায়া। কণ্ঠে একরাশ গম্ভীরতা আর তীক্ষ্ণতা।
— “এই জন্যই মেয়েমানুষদের আমি পছন্দ করি না… কিন্তু শালার মনটা সেই এক মেয়ের কাছেই গিয়ে আটকালো। সব সময় এক লাইন বেশি বুঝতে হবে তোমার! আমি তো ওইভাবে মিন করে কিছু বলিনি। এখন এসব অজুহাত না দেখিয়ে আমার কাছে আসো। শান্তি খুঁজে নিতে দাও আমাকে তোমার মাঝে।”
অর্ষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁটে ব্যঙ্গের ছাপ।
— “কেন? এখন আমার মাঝে শান্তি খুঁজতে হবে আপনাকে? বিকেলে যেখানে গিয়েছিলেন শান্তি খুঁজতে, এখন সেখানে যান না! এখানে কেন এসেছেন?”
বাতাসে যেন এক অদৃশ্য ঠাণ্ডা ছুরি ঝুলে থাকে।
ওয়াজফানের কণ্ঠ এবার ভারী হয়ে ওঠে, চোখে জ্বলে ওঠে সতর্কতার আগুন।
— ওহো এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে, লিটল মনস্টার । আমি এক কথা বারবার বলতে পছন্দ করি না। তাই আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগে নিজের এই পাগলামো বন্ধ করো।
অর্ষা শান্ত, কিন্তু দৃঢ় স্বরে উত্তর দেয়, যেন নিজের জায়গায় অটল।
— “ঠিক আছে, আমি এসব পাগলামো বন্ধ করব… তবে একটা শর্তে—আপনি আমার বিকেলে বলা কথাগুলো মেনে নিন।”
ওয়াজফান ঠোঁটে বিরক্তির হাসি টেনে মাথা নাড়ে।
— “ওহো, লিটল মনস্টার… আবারও সেই একই পেচাল।”
অর্ষা নরম কণ্ঠে বলে,
— “আপনার বোন তো আমারও বন্ধু, তাই না? আমি কি নিজে না জেনে-শুনে ওকে কোনো খারাপ জায়গায় পাঠাবো? আমি তো ওকে পাঠাবো আমার বাবা-মার কাছেই। মানব দুনিয়ায় গিয়ে ও পুরোপুরি মানুষের মতোই থাকবে, তাই না? কেউ জানবেই না যে ও একজন পরী। আর হ্যাঁ, ও সেখানে পুরো নিরাপদে থাকবে—আমার বাবা-মার কাছে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।”
বলতে বলতে অর্ষা ওয়াজফানকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
— “প্লিজ… অন্তত এবার না করবেন না। প্লিজ, মেনে নিন।”
ওয়াজফান কিছুক্ষণ গভীর নীরবতায় ডুবে থাকে। তারপর হঠাৎই অর্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “হুম… জান ম্যাম, আজ না হয় আপনার ইচ্ছাতেই চললাম। মেনে নিলাম আপনার কথা। তবে হ্যাঁ, আমারও একটা শর্ত আছে—মানব দুনিয়ায় ইসাবেলা যাবে আমার বেছে দেওয়া একজন দাসীকে সঙ্গে নিয়ে।”
অর্ষার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে।
— “সে তো আপনার ইচ্ছা। আপনি ওকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন, আমি তাতেই খুশি।”
ওয়াজফান মুচকি হেসে বলে,
— “শুধু নিজের খুশি হলে হবে না… এতক্ষণ যে আমাকে রাগিয়েছো, এখন আগে আমাকে খুশি করো।”
অর্ষা আলতো করে তার গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। কিন্তু ওয়াজফানের তাতে মন ভরে না। মুহূর্তেই সে অর্ষার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নেয়, তারপর মন ভরে চুম্বন করে।
তারপর, তৃপ্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, ওয়াজফান অর্ষাকে বুকের ভেতর ঢুকে চোখ বন্ধ করে বলে, এখন শান্তিতে ঘুমাতে চাই । এরপর ঘুমিয়ে যায় দুজন। দু’জনের নিশ্বাস মিলেমিশে যায় এক ছন্দে… আর ধীরে ধীরে রাত ডুবে যায় নিস্তব্ধতায়।
সূর্যের প্রথম কিরণ গাঢ় অন্ধকার ভেঙে নতুন দিনের আবির্ভাব ঘটাচ্ছিল। হালকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল, পাতা ও ফুলেদের মধ্যে যেন নতুন সুরের সুর বাজাচ্ছিল। আকাশটা ঝকঝকে নীল, আর চারপাশে যেন জীবনের নতুন আশা ফুটে উঠছিল।
ইসাবেলা তার ছোট্ট ঘরে বসে বসে খুশির মিশ্রিত ভাবনায় ভাসছিল। সাম্প্রতিক সময়ের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটলো—তার দা ভাই অবশেষে তাকে মানব দুনিয়ায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।
তার মনটা যেন সোনালি রঙে রাঙানো, মুখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বল হাসি। সে নিজের হাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, চোখে ঝলমল করছিল নতুন অভিজ্ঞতার আগ্রহ আর উত্তেজনা।
যাওয়ার পূর্বে ইসাবেলা অর্ষা কে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানায়। আর ওয়াজফান এর তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর অর্ষা ও ওয়াজফান তাকে বিদায় জানাল। তাদের চোখে লুকানো ছিল মিশ্র অনুভূতি—একদিকে ভালোবাসার উষ্ণতা, অন্যদিকে বিচ্ছেদের মৃদু বিষাদ।
একজন আনুগত্যপূর্ণ দাসী হাত ধরে, ইসাবেলা ধীরে ধীরে তার গন্তব্যের পথে পা বাড়াল। পেছনে ফেলে আসছিল সেই ঘর-বাড়ি, যেখান থেকে শুরু হবে তার এক নতুন জীবন।
তারা যখন বেরিয়ে পড়ল, তখন সূর্যের মৃদু কিরণ যেন আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ছিল তার উপর।
নতুন দুনিয়ার অজানা পথে এগিয়ে যেতে যেতে ইসাবেলার মনে ভাসছিল নতুন স্বপ্ন আর প্রত্যাশা।
দুই দিন পেরিয়ে গেছে, আর জ্যাইম নিজের মাঝে গুটিয়ে বসেছে এক নিঃশব্দ কোণে—তার প্রাসাদের একাকী ঘরে, যেখানে চার দেয়ালই যেন তার বেদনার সাক্ষী। ঘরটি ভরপুর অন্ধকারে, আর সেই অন্ধকারে মিশে আছে তার মনের ছায়া—রাগ, দুঃখ, অভিমান আর নিঃসঙ্গতার এক বিরূপ মিশেল।
তার হাতের ঘড়ির পর্দা বারবার আলো জ্বালাল, একাধিকবার এসেছে কল—তবু সে চুপচাপ ফিরিয়ে দিয়েছে সবাইকে। দরজার ওপারে থেকে ভেসে আসছে এক নম্র কণ্ঠস্বর, জ্যাইম এর আবেগঘন অনুরোধ—
— “প্লিজ, আমাকে আমার মত একা থাকতে দে, দা।”
ওয়াজফান, যিনি হাজারো চেষ্টা করে তাকে বের করার চেষ্টা করেছিল, তার একাকীত্বের প্রাচীর ভেঙে আবার আলোর পথে টেনে নিয়ে আসার ইচ্ছা রেখেছিল—আজ সে হার মানল জ্যাইমের অনুরোধের কাছে। সে বুঝল, কখনো কখনো মন খারাপের আড়ালে থাকা বেদনা নিজে থেকেই ছিঁড়তে হয়, আর কাউকে জোর করা যায় না।
নীরবতা আর নিঃসঙ্গতার মাঝে ওয়াজফান চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল, আর জ্যাইম হৃদয়ে ব্যথা নিয়েও সম্মান জানিয়ে তার ব্যক্তিগত একাকীত্বের প্রতি।
ঘরটি আবার নিস্তব্ধ, শুধু বাতাসের শব্দ আর ঘড়ির টিকটিকির মাঝে গাঢ় এক বিষাদের ঘ্রাণ।
ইসাবেলা পৌঁছানোর আগেই অর্ষা গোপনে এক বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে তার বাবা-মায়ের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল।
এখন, নীরব দুপুরে উঠোনে বসে বাবা-মা সেই চিঠি খুলে পড়ছেন। কাগজে অর্ষার পরিচিত হাতের লেখা—মৃদু কম্পন যেন প্রতিটি অক্ষরে ছাপ রেখে গেছে।
চিঠিতে লেখা ছিল:
আসসালামু আলাইকুম, বাবা-মা,
তোমরা তো জানোই, আমি একটা ক্যাম্পে আছি। এখানে নেটওয়ার্কের অভাবে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে তোমরা আমাকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করো না—আমি এখানে ভালো আছি, নিজের কাজ মন দিয়ে করছি। কাজ শেষ হলে ইনশাআল্লাহ খুব শিগগিরই বাসায় ফিরে আসবো।
আচ্ছা, অনেক কথাই বলে ফেললাম—এবার আসল কথায় আসি, যেই কারণে এই চিঠি তোমাদের পাঠালাম। আমার এক বান্ধবী কিছু কাজের জন্য আমাদের গ্রামে আসছে। তাছাড়া, তার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল গ্রামটা ঘুরে দেখার—তাই একসাথে দুটো ইচ্ছে পূর্ণ হবে। আমি ওকে তোমাদের কাছে পাঠাচ্ছি। যতদিন তার মন চাইবে, সে তোমাদের সঙ্গে থাকবে, তারপর কাজ শেষ হলে ফিরে যাবে। ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়, থাকার ও আপ্যায়নের কোনো ঘাটতি না থাকে—এই বিষয়ে খেয়াল রাখবে।
আর হ্যাঁ, তার সঙ্গে তার একজন দাসীও আসবে—তোমরা তাদের দুজনকেই নিজের মতো আগলে রেখো।
সবশেষে, তোমরা নিজেদের খেয়াল রেখো। সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করো। আর আমাকে নিয়ে একটুও চিন্তা করো না।
তোমাদের মেয়ে,
অর্ষা
চিঠি পড়ে বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকালেন।
দীর্ঘ পথের ক্লান্তি নিয়ে, ধূলিধূসর বিকেলের আলোয় অবশেষে ইসাবেলা দাসীকে সাথে করে পৌঁছাল অর্ষার বাবা-মায়ের দরজায়।
দরজায় দাঁড়িয়েই সে মিষ্টি হাসি দিল, যেন সফরের সমস্ত ক্লান্তি গোপন করে রেখেছে সেই হাসির আড়ালে।
অর্ষার বাবা-মা ইসাবেলাকে দেখে আনন্দিত। এমন ভদ্র ও কোমল স্বভাবের মেয়েকে পেয়ে তাদের চোখে যেন আলাদা এক স্নেহ ঝিলিক দিয়ে উঠল।
তারা আন্তরিকভাবে তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন, বসালেন, আর অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে আপ্যায়নের উষ্ণতায় ভরিয়ে দিলেন—গরম ভাত, ধোঁয়া ওঠা ডাল, গ্রামের বিশেষ কিছু পদ, আর সাথে ছিল মায়ের হাতের নিখাদ যত্ন।
দুপুরের খাবার শেষ হলে বাড়ির আঙিনায় নেমে এল একরাশ শান্তি।
ইসাবেলা তখন নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়ল।
তার সঙ্গে আসা দাসীও অনেকক্ষণ ধরেই নীরব, যেন সফরের ক্লান্তি শরীর থেকে ছেঁকে নিয়ে তাকে গভীর ঘুমে টেনে নিয়েছে।
বাড়ি তখন নিশ্চুপ—শুধু জানালার বাইরে বাতাসে দোল খাচ্ছে গাছের পাতা, আর আকাশে রোদ ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে।
ইসাবেলার মন আজ যেন একদম স্থির থাকতে চাইছে না।
এই অচেনা গ্রামে এসে কি তবে শুধু চার দেয়ালের মধ্যে বসে সময় কাটানোর জন্যই তার আগমন?
না, এমন নয়। তার চোখে কৌতূহলের দীপ্তি—চারপাশে কত অজানা দৃশ্য, কত অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য, কত গল্প লুকিয়ে আছে এই গ্রামের পথঘাটে।
ভাবনার সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিল সে—এক মুহূর্তও আর ঘরে বসে সময় নষ্ট নয়।
দ্রুত উঠে অর্ষার মায়ের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে জানাল,
— “আমি একটু গ্রামটা ঘুরে দেখি, ফিরতে দেরি করব না।”
অর্ষা তাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিল—
যেখানেই যাও, সন্ধ্যার আগেই অবশ্যই বাসায় ফিরে আসবে।
এই কথাটা ইসাবেলা মনে গেঁথে রেখেছে।
তাই বেরোনোর আগে আবারও অর্ষার মাকে বলে গেল,
— “চিন্তা করবেন না খালা, আমি সূর্য ডোবার আগেই ফিরে আসব।”
বাড়ির উঠোন পেরিয়ে, ধূলোমাখা পথ ধরে ইসাবেলা তখন এগিয়ে গেল অচেনা গ্রামটির দিকে—চোখে বিস্ময়, মনে প্রত্যাশা, আর পায়ে ছিল অভিযাত্রীর তাড়া।
ঘুরতে ঘুরতে ইসাবেলা একসময় পৌঁছে গেল জঙ্গলের গভীরে।
আজ তার মন যেন এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে ভরে আছে—চারপাশের খোলা আকাশ, সবুজে ঢাকা গাছপালা, আর পাখিদের মধুর কলতান তাকে যেন নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছে।
কখনো সে চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে অনুভব করছে প্রকৃতির ছোঁয়া,
কখনো গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে যেন নীরবে কথা বলছে তাদের সাথে।
আবার কখনো মিষ্টি হাওয়ায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর কখনো রঙিন ফুলের পাপড়িতে নাক ঘষে নিচ্ছে তাদের সুগন্ধ।
সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল… কিন্তু হঠাৎই তার মনে হল—
দুই জোড়া চোখ বহুক্ষণ ধরে তাকে লক্ষ্য করছে।
সে চমকে চারপাশে তাকাল, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেল না।
নিজেকে বোঝালো—“হয়তো ভুল দেখছি”—তারপর আবারও নিজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেল।
তবুও সেই অদৃশ্য দৃষ্টি যেন আরও গভীর হয়ে তাকে অনুসরণ করছিল।
ঠিক তখনই, জঙ্গলের সরু পথ ঘুরে সামনে এসে দাঁড়াল এক বিশাল নেকড়ে।
তার তীক্ষ্ণ নীল দৃষ্টি ছেদ করে ঢুকে গেল ইসাবেলার চোখে।
নেকড়েটা ধীরে ধীরে, প্রায় শিকারির মতো ভঙ্গিতে, এগিয়ে আসছে তার দিকে।
ইসাবেলার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
ভয়ে সে চোখ শক্ত করে বন্ধ করল,
আর দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিল—
যেন অন্ধকারের ভেতরে ঢুকে গেলেই বিপদ মিলিয়ে যাবে।
নিজের ভেতরে অজানা এক সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে চোখ মেলল ইসাবেলা।
কিন্তু পরের মুহূর্তেই সে বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল—
সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন যুবক।
তার চোখে নীলকান্তমণির মতো দীপ্তি, ছোট করে কাটা চুল, আর ফর্সা আভায় ঢাকা চেহারা।
দেখেই বোঝা যায়—সে এদেশের নয়, অন্য কোনো অচেনা জগতের বাসিন্দা।
ইসাবেলা অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল—
কোথাও আর সেই নেকড়েটির দেখা নেই।
সে এক নিঃশ্বাসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
—“কে… কে আপনি? আর এখানকার নেকড়েটা কোথায় গেল?”
যুবকটি মৃদু হাসল, চোখে এক অদ্ভুত রহস্যের আভা নিয়ে বলল,
—“আমি-ই সেই নেকড়েটা।”
শোনার পরও ইসাবেলার মুখে বিস্ময়ের ছাপ তেমন ফুটল না।
কারণ, সে জানত—নেকড়েরা মানুষের রূপ নিতে পারে।
তবুও, এই গহীন জঙ্গলে এমন একজনকে দেখে তার বুকের ভেতর ভয়ের ছায়া নেমে এল।
যুবকটি যেন তার ভাবনা পড়ে ফেলল,
—“আমি জানি, আপনিও কোনো মানুষ নন… আপনি একজন পরী।
আপনার চলাফেরা, আপনার আচরণ—সবই বলে দিচ্ছে সেটা।
আমার মতো নেকড়ের পক্ষে আপনাকে চিনতে ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
ইসাবেলা কোনো জবাব দিল না, শুধু নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
যুবকটি আবার বলল,
—“আপনি এখানে ঘুরতে এসেছেন, তাই না?
চলুন, আমি আপনাকে পুরো গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাই।”
ইসাবেলা তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল,
—“না, আজ নয়। এমতেও সন্ধ্যা নেমে এসেছে, আর আমাকে অবশ্যই বাড়ি ফিরতে হবে।
তাহলে আমি চলি।”
সে আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে পা বাড়াল বাড়ির পথে…
হঠাৎই পেছন থেকে ছেলেটির কণ্ঠ ভেসে এলো, একটু উচ্চস্বরে—
—“আমার সাথে যেতে না চাওয়ার কারণ কী? ভয়? নাকি অবিশ্বাস?”
ইসাবেলা থেমে পেছনে ঘুরল, ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
—“কোনোটাই না। আপনাকে আমি ভয় পেতে যাব কেন?
আর অবিশ্বাস… অবিশ্বাস তো হবেই, যাকে আমি চিনি না তাকে বিশ্বাস করব কেন?”
ছেলেটি হালকা হেসে বলল,
—“এই রূপটা আপনার সাথে মানাচ্ছে না।
আপনি আবার ফিরে যান সেই চঞ্চল রূপে, যেভাবে কিছুক্ষণ আগে ছিলেন।
আপনার সেই হাসিখুশি, চঞ্চল, মিষ্টি মেয়েটিকে আমি দেখতে চাই।”
ইসাবেলা ভুরু কুঁচকে কিছুটা বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করল,
—“তাহলে কি আপনি এতক্ষণ যাবৎ আমাকে ফলো করছিলেন?”
ছেলেটি যেন প্রশ্নটিকে পাশ কাটাতে চাইলো, দ্রুত বলল,
—“চলুন, আপনাকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাই।
এই জঙ্গলের ভেতরে, খুব দূরে নয়। বিশ্বাস করে যেতে পারেন।”
ইসাবেলার গলায় এবার দৃঢ়তা,
—“আপনি কেন আমার কথার উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছেন?
আমি যা জিজ্ঞেস করেছি, সেটার উত্তর দিন।”
ছেলেটি এবার খানিক বিভ্রান্ত হলো, তারপর ধীরে ধীরে বলল,
—“আমি কেন আপনাকে ফলো করতে যাব? আমার কি খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই?
আমি তো শুধু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিজের পথে ফিরছিলাম।
তখনই আপনার এসব পাগলামি চোখে পড়ে গেল। এর বেশি কিছু নয়।”
ইসাবেলা কিছু না বলে শুধু একবার গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল,
ছেলেটি ইসাবেলার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসিতে বলল,
—“তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সাথে যাবেন কি না। সময় কিন্তু ফুরিয়ে আসছে—সন্ধ্যার আগে আপনাকে আবার বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।
চিন্তা নেই, আমার সাথে গেলে আমি ঠিক সময়ে আপনাকে পৌঁছে দেব।
আর বন্ধুত্ব করবেন আমার সাথে? তাতে আপনার বিশ্বাস অর্জনের সুযোগ পাব।”
ইসাবেলা কিছুক্ষণ দ্বিধায় পড়ে গেল। তার চোখে মিশ্র অনুভূতি—অবিশ্বাস, কৌতূহল আর খানিকটা কৌতুক।
সে মৃদু হাসল, তারপর বলল,
—“এখনই তো আমাদের পরিচয় হলো, আর আপনি এত তাড়াতাড়ি আমাকে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যেতে চাইছেন… আপনার মতলবটা কী, হুম?
আর হ্যা, জীন আর নেকড়েদের মধ্যে তো শত্রুতার সম্পর্ক। তারা কী করে বন্ধু হতে পারে?”
ছেলেটি ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি টেনে বলল,
—“তো কি হয়েছে? জীন আর নেকড়ের মধ্যে শত্রুতা থাকতে পারে, কিন্তু নেকড়ে আর পরীর মধ্যে তো নয়!
তাই নেকড়ে আর পরী বন্ধু হতে পারে, এটাই স্বাভাবিক।
বলুন তো, আপনি কি বন্ধু হবেন আমার?
আর আমার কোনো গোপন উদ্দেশ্য নেই।
শুধু ভাবলাম, ভিন্ন দেশের এক পরী এখানে ঘুরতে এসেছে—তাকে গ্রামটা একটু ঘুরিয়ে দেখানো আমার কর্তব্য। এর বেশি কিছুই নয়।
আপনি যেতে চাইলে চলুন, না হলে… আচ্ছা থাক, আমি যাই।”
ইসাবেলা হেসে বাধা দিল,
—“আচ্ছা, চলুন। আজ না হয় এই জঙ্গলের গভীর পথটুকু পার করে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসুন।
আর হ্যাঁ, আমরা তো ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ হতে পারি, তাই না?
তো আজ থেকে আমরা বন্ধু… ঠিক আছে?”
ছেলেটার চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল।
—“ঠিক আছে, তাহলে তাই হোক।”
Death or Alive part 24
ইসাবেলা নিজের মতো হেঁটে চলল, ছেলেটিও পা মিলিয়ে তার পিছনে।
দু’জন গল্প করতে করতে হাঁটল,
পথ শেষ হলে ছেলেটি ইসাবেলাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের গন্তব্যের পথে রওনা হল।
সন্ধ্যার আকাশে তখন নরম সোনালি আলো, আর দু’জনের অদৃশ্য বন্ধুত্বের সেতু প্রথমবারের মতো বোনা হয়ে গেছে…
 
