Death or Alive part 31

Death or Alive part 31
priyanka hawlader

বিকেলের আকাশে সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সোনালি আলো মেখে চারদিক যেন নরম রঙে রাঙানো, বাতাসে হালকা শীতলতা। তবু প্রকৃতির এই শান্ত সৌন্দর্য যেন একটুও ছুঁতে পারছে না ইসাবেলার হৃদয়কে।
সে বসে আছে নিজের কক্ষের জানালার ধারে। চোখের সামনে দূরের আকাশ জ্বলজ্বল করছে, অথচ তার চোখে যেন কেবল একরাশ কুয়াশা। মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। অনেকদিন হয়ে গেল নিজের পরিবারকে দেখা হয়নি—না তার বাবা, না প্রিয় ভাইয়েরা, কেউকেই না। রাজ্যের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি স্মৃতি তাকে আজ প্রচণ্ডভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।

“আমার রাজ্যে এখন কেমন আছেগো সবাই? কী চলছে সেখানে?”—নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্ন করে ইসাবেলা। তার বুকের ভেতরে একরাশ উদ্বেগ জমতে থাকে।
কিন্তু তারপরই হঠাৎ এক কঠিন সত্যি তাকে বিদ্ধ করে যায়—সে আর কখনোই ফিরে যেতে পারবে না। হাজার ইচ্ছে থাকলেও নিজের জন্মভূমির মাটিতে পা রাখতে পারবে না, প্রিয় বাবা কিংবা ভাইদের বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠতে পারবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই অপার দূরত্ব, এই বেদনাদায়ক অচেনা নিয়ম যেন তাকে শেকলে বেঁধে রেখেছে। ইসাবেলার মনে হতে লাগল—
“তাহলে কি আমি ভুল করেছি? এই রাজ্য বেছে নেওয়া… নিজের ভাইকে ছেড়ে আসা… সবকিছুই কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল? আমি কি নিজের অজান্তেই এমন এক পথ বেছে নিয়েছি, যেটার জন্য সারাজীবন আমাকে পস্তাতে হবে?”
ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে—কোথায় যেন একটা বড় অন্যায় করে ফেলেছে সে নিজের সাথেই।
জানালার ওপাশে সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগে শেষ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগন্ত জুড়ে। কিন্তু সেই আলোও আজ তার মন ভরাতে পারল না। মনে হলো, যত রঙই ছড়িয়ে পড়ুক আকাশে, ইসাবেলার মনের অন্ধকার আর আলো খুঁজে পাবে না।
সে নিঃশব্দে বসে রইল, চারপাশে বিকেলের শান্ত সৌন্দর্য, অথচ ভেতরে কেবলই বেদনাভরা দীর্ঘশ্বাস।
হঠাৎই ইসাবেলার মনের গভীরে এক নতুন চিন্তার ঢেউ উঠল। কিছুক্ষণ আগেও যে শূন্যতা আর আফসোস তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, হঠাৎ যেন তা মিলিয়ে যেতে লাগল। সে নিজের মনে নিজেকেই ধরা-ছোঁয়ার মতো স্পষ্টভাবে বলল—

“না… আমি কোনো ভুল করিনি।”
হ্যাঁ, সে ভুল করেনি। কারণ তার জীবনে যে মানুষটি আছে, সেই ভালোবাসাই তাকে সম্পূর্ণ করেছে। সেই মানুষটি শুধু তার পাশে নেই, বরং প্রতিটি মুহূর্তে তার ভরসা, তার হাসি, তার স্বপ্নের সঙ্গী হয়ে থেকেছে।
চোখের সামনে ভেসে উঠল ড্যানিয়েলের হাসিমাখা মুখশ্রী। সেই হাসিতে যেন সবটুকু অন্ধকারকে ভেঙে দেওয়ার জাদু আছে। সেদিন ওয়াজফান রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই যেন ড্যানিয়েল আরো বেশি যত্ন নিয়ে ইসাবেলাকে আগলে রেখেছে। কখনোই সে ইসাবেলাকে একা বোধ করতে দেয়নি। যত ব্যস্ত সময়ই হোক, হাজারো দায়িত্বই থাকুক না কেন, ড্যানিয়েল সবসময়ই তার জন্য কিছু মুহূর্ত আলাদা করে রাখে।

ইসাবেলার সামান্যতম ব্যথাও ড্যানিয়েলের কাছে সহ্য করা যায় না। তার চোখে ইসাবেলা যেন এক টুকরো স্বচ্ছ কাচের মতো, একফোঁটা আঁচড়ও যে সহ্যসাধ্য নয়। সে যেন সবসময় পাহারাদারের মতো সতর্ক থাকে—ইসাবেলার মুখে কোনো দুঃখের ছায়া পড়বে না, কোনো দুঃখের আঁচ তাকে স্পর্শ করবে না।
ড্যানিয়েলের যত্ন আর ভালোবাসা এতটাই নিখুঁত যে, ইসাবেলার কাছে মনে হয় সে যেন এক কোমল ফুল—যার গায়ে কখনোই ধুলোর দাগ পড়তে দেওয়া হয় না। তার প্রতিটি ছোট ছোট চাওয়া, প্রতিটি সরল ইচ্ছাকে ড্যানিয়েল এমন গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণ করে যে ইসাবেলা অবাক হয়ে যায়।

আর যদি কখনো রাজ্যের কারো সাহস হয় ইসাবেলাকে তুচ্ছ করে কথা বলার, তাকে আঘাত দেওয়ার—তখনই যেন ড্যানিয়েল এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। সে নিজের ভালোবাসার জন্য সবার সঙ্গে লড়ে যেতে দ্বিধা করে না। তার কাছে ইসাবেলার সম্মানই প্রথম, তার হাসিই সবচেয়ে মূল্যবান।
এসব স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই ইসাবেলার মন যেন একটু একটু করে হালকা হতে লাগল। বুকের ভার যেন সরে গেল, মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। আর সেই প্রশান্তির সঙ্গে জড়িয়ে এল মিষ্টি হাসির ঝিলিক—
একটা খাঁটি, স্বচ্ছ, হৃদয়ভরা হাসি।

সে বুঝল—ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, ভালোবাসা মানে এমন একজন মানুষকে পাওয়া, যে প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে আগলে রাখে, যত্ন করে, আর তোমার ছোট্ট একটি দুঃখকেও নিজের হৃদয়ে বহন করে নেয়।
কিন্তু পরক্ষণেই ইসাবেলার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। তার বুকটা হঠাৎই শূন্য হয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল—হ্যাঁ, তাদের বিয়ে তো হয়েছে, কিন্তু আজ অবধি ড্যানিয়েল তাকে একবারও চুম্বন পর্যন্ত করেনি।
ড্যানিয়েল যেন সবসময় তাকে আগলে রাখতে চায়, তার যত্ন করে, তাকে একটুও আঘাত করতে দেয় না—কিন্তু তার বাইরে যেন কিছুতেই যেতে চায় না। যতবারই ইসাবেলা তার কাছাকাছি আসতে চেয়েছে, তার মায়াময় স্পর্শের মধ্যে ডুবে যেতে চেয়েছে, ড্যানিয়েল ঠিক তখনই কোনো না কোনো বাহানা বানিয়ে তাকে এড়িয়ে গেছে।
এই কথাটা মনে পড়তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল গত রাতের ঘটনা।

সেদিন ইসাবেলার মনটা ছিল বেশ ফুরফুরে। তাই সে রাতের বেলায় সুন্দর করে সেজে উঠেছিল। চুলে ছাড়া, মুখে হালকা রঙ, আর সাজে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ। সে অপেক্ষা করছিল ড্যানিয়েলের জন্য—আজ তাকে সাজগোজ দেখাবে, তার চোখে নিজের সৌন্দর্য খুঁজবে।
অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান হলো। ড্যানিয়েল রুমে ঢুকলো। প্রথমেই সে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো, তারপর এসে টেবিলে বসে কাজে মন দিতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই ইসাবেলা তার সামনে এসে দাঁড়ালো, আর মিষ্টি ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো—

— “আমাকে আজ এরকম সাজে কেমন লাগছে বলো তো?”
ড্যানিয়েল থমকে দাঁড়ালো। সে মন ভরে ইসাবেলাকে দেখল, পুরোটা দৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে দেখে নিল। তারপর এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল—
— “তুমি তো সবসময়ই আমার কাছে অসাধারণ লাগো। তবে আজ… আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে। খুব সুন্দর… যেন আমার বউ বউ মনে হচ্ছে।”
ড্যানিয়েলের এরকম কথায় ইসাবেলার গাল লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। তার ঠোঁটে ফুটল এক মায়াবী হাসি। আর সেই হাসির ঝলক যেন ড্যানিয়েলের ভেতরে এক অদ্ভুত নেশা জাগিয়ে তুলল।
সে হঠাৎই উঠে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে ইসাবেলার দুই বাহু শক্ত করে ধরে টেনে নিল নিজের বুকে। ইসাবেলা প্রথমে কিছুটা লজ্জা পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল—ড্যানিয়েল এবার তাকে আরও কাছে টানতে চাইছে। সেও সম্মতি জানিয়ে ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রাখল। মুহূর্তটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিল…
কিন্তু হঠাৎই যেন ড্যানিয়েলের মনে এক ঝড় বয়ে গেল। সে এক মুহূর্তেই ইসাবেলাকে ছেড়ে দিল এবং অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল—

— “আমাকে লর্ড ক্যালিয়ন ডেকেছিল… আমি তো একেবারেই ভুলে গেছি। আমাকে এখনই যেতে হবে।”
কথাটা বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
ইসাবেলা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ বলল—এ অজুহাত ভুয়া। সে জানে, এরকম কিছুই নয়। ড্যানিয়েল বহুবার এরকম বাহানা দিয়ে তাকে এড়িয়ে গেছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, তবুও বুকের ভেতরটা হঠাৎই খালি হয়ে গেল। ভালো মনের জায়গায় হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল হতাশার কালো ছায়া।
কল্পনা থেকে ফিরে এসে ইসাবেলার বুকটা যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল—
“আচ্ছা… ড্যানিয়েল কি আর আমাকে ভালোবাসে না? আমি কি আর আগের মতো সুন্দর নেই, যে সে বারবার আমাকে প্রত্যাখ্যান করছে? নাকি তার মনে অন্য কোনো মেয়ে আছে, যার জন্য সে এরকম করছে? আমি কি শুধু তার দায়িত্ব হয়েই রয়ে গেছি? তার ভালোবাসা কি তবে অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে?”
এই প্রশ্নগুলো যেন তীরের মতো এসে বিঁধতে লাগল তার হৃদয়ে। তার বুক কেঁপে উঠল—

“আমি তো তার ভালোবাসার টানে নিজের ভাইকে ছেড়ে এই রাজ্যে চলে এসেছি। নিজের পরিবারকে ত্যাগ করেছি। আর সেই অনুতাপেই কি আজ সে আমাকে এতটা আগলে রাখছে। তাহলে আমি কি শুধু তার মাথার উপর একটা বোঝার ঝিলিক হয়ে দাঁড়ালাম যেটা তাকে সারা জীবন বোধহয় না চাইতেও বয়ে যেতে হবে। তবে আমি কী করলাম? আমি কি তবে ভুল করলাম তাকে ভালোবেসে?”
ভাবতে ভাবতে তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা। যেন প্রতিটি ফোঁটা অশ্রু তার ভেতরের যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে বইতে লাগল।
ইসাবেলা হতভম্ব। জানে না এখন কী করবে। জানে না কোন পথে গেলে শান্তি পাবে।
শুধু বোঝে—এই অনিশ্চয়তা, এই দোদুল্যমান ভালোবাসা তাকে ধীরে ধীরে অস্থির করে তুলছে, ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছে তাকে।

মধুপুরগড়ের ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাশাপাশি হাত ধরে এগিয়ে চলেছে ওয়াজফান আর অর্ষা। সেদিনের মতো আজকের আকাশটা অদ্ভুত শান্ত—চারদিক জুড়ে পাখির কলতান, বাতাসে লুকানো হালকা শীতলতা, আর মাটির গন্ধে যেনো নতুন কোনো প্রতিশ্রুতির মতো মায়া মাখা।
অর্ষার মুখভর্তি হাসি আজ। কতদিন পর অবশেষে সে তার মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে চলেছে! বুকের ভেতর খুশি যেন একরাশ রঙিন প্রজাপতির মতো লাফাচ্ছে। আর সেই খুশিই যেন তার চোখের সামনে টেনে আনে এক মুহূর্ত—
কাল বিকেলে মনখারাপ করা অর্ষা একা বসেছিল বাগানের কোণে। মাথা নিচু, ঠোঁট ফুলে আছে। তখনই কাজ সেরে ওয়াজফান এসে তার পাশে বসল। তার গলা ভরা স্নেহে—
“কি হয়েছে আমার লাড্ডুর? এত উদাস হয়ে বসে আছো কেন?”
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল—

“অনেকদিন হলো মা–বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। খুব ইচ্ছে করছে তাদের কাছে যেতে।”
ওয়াজফানের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল।
“ঠিক আছে। তাহলে আজই তোমাকে নিয়ে যাব। চোল এখনি যাবো আমরা।
অর্ষার চোখে আলো ফুটে উঠে । অনেকদিন যাবদ অর্ষা তার বাবা-মা এর সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ওয়াজফান এর কাজের ব্যস্ততার কারণে সে নিয়ে যেতে পারছিল না তবে আজ অর্ষার মন খারাপ দেখে যেন তার সব কাজ ফেলে শুধু অর্ষাকে খুশি করতে নিয়ে যাচ্ছে তাকে তার দুনিয়ায়
তবে আজ অর্ষা যখন সত্যিই পথে বেরিয়েছে, তার ভেতরে হালকা এক ভয়ও গড়ে উঠেছে।
পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ ওয়াজফান থেমে তাকাল, কারণ অর্ষা আর এগোচ্ছে না।
“কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন, লিটল মনস্টার ? চলো।”
অর্ষা একটু ইতস্তত করে বলল—

“একটা অনুরোধ রাখবেন? প্লিজ না করবেন না।”
“কি অনুরোধ?” ওয়াজফানের চোখ কৌতূহলী।
অর্ষার কণ্ঠ কাঁপল—
“আমার বাবা–মা হয়তো আমাদের বিয়ের কথা শুনে রাগ করবেন। আমাকে নানা কথা বলবেন। আপনি দয়া করে তাদের সামনে রাগ করবেন না, আর কোনো উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না। আর তাদেরকে উল্টোপাল্টা একটা কিছু বলবেন না। প্লিজ, আমি চাই না তারা ভাবুক আমি এমন কাউকে বিয়ে করেছি যে বড়দের সম্মান করতে জানে না।”
ওয়াজফানের ঠোঁটে একরাশ ব্যঙ্গের ছাপ ফুটে উঠল। সে এবার কপাল কুচকে বলল,
“তাহলে তোমার কাছে মনে হয় আমি বড়দের সম্মান করি না, তাই তো? ঠিক আছে, দেখা যাক। আমি কি করি আর কি করি না, সেটা বুঝে যাবে। চলো আগে।”

এই উত্তর শুনে অর্ষার বুক কেঁপে উঠল। ভয় মিশ্রিত অজানা শঙ্কা তার পদক্ষেপকে ভারী করে তুলল। তবু একেকটা নিঃশ্বাসে প্রার্থনা করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে।
কিছুক্ষণ পর তারা এসে দাঁড়াল বাড়ির বিশাল মূল ফটকের সামনে। অর্ষার বুকের ভেতর তখন ঢিপঢিপ শব্দে কাঁপছে। জানে না—ভেতরে ঢুকলে তাদের অপেক্ষায় কি আছে।
বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই ডাক শুনে ছুটে বেরিয়ে এল অর্ষার বাবা–মা আর ছোট ভাই। মুহূর্তেই তাদের চোখে আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল, যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। মা প্রথমেই অর্ষাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের মধ্যে, বাবা–ভাইও কাছে এগিয়ে এসে গলিয়ে নিল তাকে আপন স্নেহে। তারপর তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসলো।
মায়ের কণ্ঠ ভেসে এলো—

“কেমন আছিস মা? ওখানে কেমন কেটেছে তোর দিন?”
অর্ষা ভেজা চোখে মুচকি হেসে বলল—
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি মা। তোমরা কেমন আছো?”
কিন্তু মায়ের জবাব আসার আগেই সবার দৃষ্টি একসাথে ঘুরে গেল ওয়াজফানের দিকে। হঠাৎ যেন সময় থমকে দাঁড়াল। অবাক চোখে বাবা জিজ্ঞেস করলেন—
“তোর সঙ্গে থাকা এই ছেলেটা কে? তোর বন্ধু?”
অর্ষা মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল, তারপর দৃঢ় গলায় বলল—
“না বাবা, উনি আমার বন্ধু নন… উনি আমার স্বামী।”
কথাটা শুনে যেন সারা ঘরে ঝড় বয়ে গেল। অবিশ্বাসে সবার মুখ হাঁ হয়ে রইল। অর্ষা সাহস সঞ্চয় করে আবার বলল

“হ্যাঁ মা, উনি আমার স্বামী। আমরা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। ক্যাম্পে কাজ করতে গিয়েই আমাদের দেখা হয়েছিল, সেখান থেকেই সব শুরু।”
অর্ষার বাবা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন—
“আমাদের কিছু না জানিয়ে, আমাদের ছাড়াই বিয়ে করে ফেলেছিস? তাহলে এখন এখানে কেন এসেছিস? আমাদের নিমন্ত্রণ দিতে তোর বিয়ের?”
অর্ষা কাঁপা গলায় বলল—
“না বাবা, ওরকম কিছু নয়। আমি জানি, আমি তোমাদের ছাড়া বিয়ে করেছি। কিন্তু মা–বাবার দোয়া ছাড়া একটা বিয়ে কখনোই পূর্ণতা পায় না। তোমাদের আশীর্বাদ ছাড়া আমি নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে করি। তাই এসেছি তোমাদের কাছে—তোমাদের সম্মতি চাইতে।

বাবার চোখে জল চিকচিক করলেও কণ্ঠস্বর কঠিন—
“হায় হায়! আমি তোকে কোনোদিন কিছুর জন্য না করিনি। যদি বলতিস, তুই একটা ছেলেকে ভালোবাসিস, আমি কি তোকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতাম না? নিশ্চয়ই দিতাম। নিজের হাতে মেয়ের বিয়ে দেওয়া ছিল আমার স্বপ্ন। কিন্তু তুই আমার সেই স্বপ্নটাকেই পায়ে ঠেলে দিলি। এখন বিয়ে করে ফেলেছিস, সবকিছু তো হয়েই গেছে। তো এখন আর আমাদের আশীর্বাদের কি দরকার?”

মা–ও এগিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়ালেন। কণ্ঠ গম্ভীর, চোখে অভিমান—
“হ্যাঁ, তোর আমাদের এখন লাগবে না আর। তুই নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছিস। তাহলে এখন ওকেই আঁকড়ে জীবন কাটা। আমরা শুধু চাই, তুই সুখে থাকিস। তবে আমাদের দরজায় আর ভরসা নিয়ে দাঁড়াবি না। যেহেতু ভালোবেসে তুই বিয়ে করে নিয়েছিস তাহলে এখন যে মানুষটাকে বিয়ে করেছিস তার হাত ধরে তার সাথে ফিরে যা তার বাসায় কারণ আমরা কোন এরকম মেয়েকে আর আমাদের মেয়ের পরিচয় দিতে চাইনা আজ থেকে আমাদের মেয়ে আর নেই তাই দয়া করে এখান থেকে চলে যা।
অর্ষা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন।
“না আমরা, আর কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার যা বলার ছিল, বলে দিয়েছি। এখন এখান থেকে যেতে পারিস।”

অর্ষা যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের ভেতর অভিমানের জল উথলে উঠছে, তবুও কিছু বলতে পারল না। চুপচাপ মনমরা হয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল, আর তার বুকের ভেতরটা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছিল।
ওয়াজফান এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব চুপচাপ দেখছিল তবে এবার,
এক অচেনা শান্ত হাসি মুখে টেনে আনল। এই হাসি আগে কখনো কেউ দেখেনি, এমনকি অর্ষাও না। তার ভেতরের দানবীয় রাগ, ঝড়ের মতো উগ্রতা—সব যেন এক মুহূর্তে কোথায় হারিয়ে গেছে। তার চোখে আজ এক অনন্য স্নিগ্ধতা, আচরণে এক অদ্ভুত সুশান্ত ভঙ্গি।
সে ধীরে ধীরে অর্ষার মা–বাবার সামনে এগিয়ে এল। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন তার অহংকারের প্রাচীর ভেঙে পড়ছে। দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে সে নরম কণ্ঠে বলল,

“আঙ্কেল, আন্টি… আমাদের উপর রাগ করবেন না। আমরা তো আসলে বাচ্চা মানুষ। নিজেদের অজান্তেই ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু তাই বলে কি আপনাদের উচিত আমাদের এমন কঠোর শাস্তি দেওয়া?
একবার ভেবে দেখুন তো—আমরা যদি শান্তভাবে বসে কথা বলি, তবে কি নিজেদের ভেতরের ভুল বোঝাবুঝি মেটানো সম্ভব নয়? চেষ্টা করেই দেখুন না… হয়তো আপনারা বুঝবেন, এখানে আসলে কোনো অপরাধ নেই—শুধু আছে একে অপরকে ভালবাসা।”

তার কথা বলার ভঙ্গি এতটাই নম্র, এতটাই বিনয়ী যে, মুহূর্তের জন্য অর্ষার বাবা–মা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ ছেলে যে রাগে আগুন হয়ে উঠতে পারে এ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাও নেই।
অর্ষার মা–বাবা সরাসরি কিছু না বলে একে অপরের চোখে চোখ রাখলেন। তাদের মুখে রাগের রেখা এখনো স্পষ্ট, কিন্তু অন্য একজন যুবকের মুখের উপর সোজাসুজি কিছু বলা মানে যেন অপমানজনক হয়ে যাবে। অজান্তেই দুজনের চোখের দৃষ্টি নিচু হয়ে এল, তারপর মাথা নেড়ে নীরবে সম্মতি জানালেন।
এই মুহূর্তে যেন বাতাসে জমে থাকা উত্তেজনা একটু হলেও নরম হয়ে গেল।
ওয়াজফান ভেতরের প্রশান্তি নিয়ে নরম গলায় বলল,
“তাহলে আসুন, বসে একটু শান্তভাবে কথা বলি।”
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে সযত্ন ভদ্রতায় পথ দেখিয়ে এগিয়ে দিল। অর্ষা একপাশে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা দেখছিল, তার হৃদয় তখনও কাঁপছে বিস্ময়ে তবে সে তার স্বামীর এরকম শান্ত সুলভ ও হাসি মাখা আচরণ পুরাই অবাক।

তার বাবা–মা এক অদ্ভুত দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেলেন, তবুও তাদের পদক্ষেপ থেমে থাকল না। তারা আরেকবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
তারপর সবাই একসাথে বসলো বসার রুমে শান্ত পরিবেশে। ঘরের ভেতরে বাতাস ভারী হয়ে আছে, যেন প্রত্যেকে নিজস্ব রাগ আর ভালোবাসার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ষার চোখ বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওয়াজফানকে—এমন ভদ্র, শান্ত আর বিনয়ী রূপ সে আজ প্রথমবার দেখছে। মনে হচ্ছিল, এ কি সত্যিই সেই ওয়াজফান? সেই দানবীয় উগ্র মানুষটা, যে কখনোই কারো অনুরোধের পরোয়া করে না?
আজ সে বদলে গেছে—কি শুধু আসক্তি তার লিটল মনস্টার এর জন্য।

নরম আলোয় চারদিকে যেন এক অদ্ভুত ভারী নীরবতা জমে আছে। অর্ষার বাবা-মা সামনের সোফায় বসে আছেন, চোখে রাগের ঝলকানি এখনো দপদপ করছে। অর্ষা একপাশে চুপচাপ বসে আছে, বুকের ভেতর দুশ্চিন্তার ঢেউ যেন ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে। আর সেই মুহূর্তে ওয়াজফান—যে মানুষটিকে সবাই বরাবরই বদমেজাজি, ঝড়ের মতো তীব্র স্বভাবের বলে জানত—সে আজ আশ্চর্য শান্ত, সুশান্ত এক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।
তার চোখদুটো গভীর, কণ্ঠস্বর যেন স্রোতের মতো শান্ত, বিনয়ের ছোঁয়া মিশে আছে প্রতিটি শব্দে। অর্ষার মা-বাবার সামনে এসে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার সাথে সে বলল—

“আঙ্কেল, আন্টি… আপনাদের মেয়েকে দোষারোপ করবেন না। ও কোনো ভুল করেনি। ভুল যদি থেকে থাকে, তবে সেটা আমার। আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, আপনাদের সম্মতি নেওয়া হয়নি—এই তাড়াহুড়োটা আমারই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ও তো নিষ্পাপ, তাই না?
আপনাদের মেয়ের স্বপ্ন, আপনাদের ইচ্ছে—সব আমি ভেঙেছি। আপনাদের অমতে ওর হাত ধরেছি। দোষ যদি হয়, তবে আমার; শাস্তি পেতেও আমি প্রস্তুত। কিন্তু কেন আমার দোষে ওকে শাস্তি দেবেন? কেন ওকে তাড়িয়ে দেবেন?
আপনাদের কাছে যদি এই বিয়েটা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়, তবে আমাকে তাড়িয়ে দিন। আমি নিজে এখান থেকে চলে যাব। কিন্তু অর্ষা… ও তো আপনাদের প্রাণ। মা–বাবার বুক থেকে কেউ কি তাদের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে? আমি চাই না আমার কারণে মেয়েটা তার আপনজন থেকে বঞ্চিত হোক।

আপনারা হয়তো এখন রাগ করে বলছেন—ওকে এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, পরে আপনারাই কষ্ট পাবেন। আর অর্ষা ও আপনাদের খুব ভালোবাসি ও আপনাদের ছাড়া বাঁচতে পারবে না। তাই যদি কাউকে কষ্ট দিতেই হয়, আমাকেই দিন। আমি সেই কষ্ট হাসিমুখে মেনে নেব। কিন্তু দয়া করে—আপনারা ওকে কষ্ট দিয়েন না কারণ ওর কষ্ট আমার সহ্যের বাইরে আমি সইতে পারবো না ওর চোখের পানি। আপনারা আপনার মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। ওকে মেনে নিন, প্লিজ।
কথাগুলো শেষ হতেই ঘরের ভেতর নেমে এলো এক স্তব্ধ নীরবতা। যেন বাতাসও থেমে গেছে শোনার জন্য। অর্ষার মা-বাবা একে অপরের চোখে চোখ রাখলেন। তাদের ভেতরের রাগ তখনো নিভে যায়নি, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে কোথাও যেন এক মৃদু আলো জ্বলে উঠল—এই ছেলেটা খারাপ নয়। এ মানুষটা সত্যিই ভালো, আর তাদের মেয়েকে নিঃশর্তে ভালোবাসে।
তবুও, অভিমানের জালে তারা নিজেদের আটকে রাখলেন। কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। অর্ষার বাবা সংক্ষেপে শুধু বললেন—

“তোমরা এখানে থাকতে পারো। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
এরপর এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় দুজন নিজেদের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।
ওয়াজফানের ঠোঁটে দেখা গেল বাঁকা হাসি সে জানতো এমনটাই হবে এতক্ষণ তো সে শুধুই একটা নাটক করে গেল কারণ তার লিটল মনস্টার ফিরে গিয়ে কাঁদবে এটা তার সহ্য হবে না আবার সে তার লিটল মনস্টারকে ছাড়া থাকতেও পারবেনা তাই ছোট্ট একটা নাটক সাজিয়ে সবটা ঠিক করে দিল।
অর্ষা স্তব্ধ হয়ে রইল। এতক্ষণ ধরে সে ওয়াজফানকে দেখছিল এক নতুন আলোয়। এ মানুষটা কি সত্যিই সেই ওয়াজফান, যার রাগে আগুন ফেটে পড়ে, যে কখনো কাউকে পাত্তা দেয় না? আজ সে মাথা নত করেছে, শান্ত হয়ে কথা বলছে, নিজের ভুল স্বীকার করছে—সবকিছুই শুধু তার জন্য এটা তার এত স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে সে যেন নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না সবটা।
অর্ষার বুক ভরে উঠল অদ্ভুত সুখে। চোখের কোণে অশ্রু জমে উঠলেও মনে হলো, এ অশ্রু যন্ত্রণার নয়—এ অশ্রু আনন্দের, স্বস্তির।

সে ভেতরে ভেতরে ভাবতে লাগল—
“আজ আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। এই বদমেজাজি মানুষটার ভালোবাসা যে কতটা গভীর, তা আমি এখন বুঝতে পারছি। আমার মা–বাবার কাছে তার এভাবে বিনয় দেখানো, ধৈর্য দেখানো… এটা যে কত বড় উপহার, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।”
তার হৃদয় ধপধপ করতে লাগল খুশিতে। কারণ আজ সে শুধু ভালোবাসার মানুষটাকে নয়, এক নতুন মানুষকে দেখল—যে তার জন্য বদলাতে পারে, নরম হতে পারে, পৃথিবীর সামনে মাথা নত করতে পারে।
অর্ষা অবাক হয়ে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে
হঠাৎই ওয়াজফান এগিয়ে এসে তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো—
— “কি হলো? এরকমভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
অর্ষা হকচকিয়ে উঠে, তোতলানো কণ্ঠে বলল—
— “এটা কি সত্যিই আপনি ছিলেন? আপনাকে তো আবার ভূতে ধরেনি তো! থুরি… আপনি তো নিজেই ভূত… আরে না না, আমি কী যে বলছি!”
বলে সে গিয়ে ওয়াজফানের কপালে হাত রাখলো, চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

— “ঠিক আছেন তো? আপনি আবার অসুস্থ হয়ে যাননি তো? এরকম অদ্ভুত কথা কেন বলছেন? …এই ব্যাটা, সত্যি করে বলেন তো—আপনি আবার এখানে আশার আগে নেশা করে আসেননি তো?”
ওয়াজফান চোখ ছোট করে বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল—
— “শোনো, ঢং করো না এত! আমি … শুধু সব করেছি এজন্য যে, পরে না হয় আবার তুমি আমার সামনে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে বসতে। তোমার সেই কান্নার শব্দে আমার কানে যে ঝালাপালা হয়ে যায়, তাই।”
অর্ষা ঠোঁট ফুলিয়ে প্রতিবাদ করল—
— “ওই! আমি আবার কবে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদলাম? মোটেও আমি এভাবে কাঁদি না।”
ওয়াজফান অর্ষার কাণের কাছে ঝুঁকে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল—
— “মনে করিয়ে দেব কবে কেঁদেছিলে?
ওয়াজফান এর এমন কথায় অর্ষা লজ্জা পেয়ে যায় বুঝে যায় ওয়াজফান কিসের ইঙ্গিত করছে।
সে চোখ নামিয়ে নেয়,

ঠিক তখনই তাদের এই ছোট্ট মুহূর্ত ভেঙে দিয়ে চলে এলো অর্ষার ছোট ভাই ফারাজ। সে এতক্ষণ কিছুটা অভিমান করে দূরে ছিল, তবে এখন আবার এসেছে, মনে হয় দিদির সাথে কিছু বলার আছে।
ফারাজ মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল—
— দিদি! তুই এখনো দুলাভাইকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? যা, দুলাভাইকে নিয়ে রুমে যা।”
অর্ষা খানিকটা লজ্জা মাখা ভঙ্গিতে ওয়াজফানের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। ঠিক তখনই পেছন থেকে ফারাজ আবার মজার ছলে বলে উঠল—
— “বাই দ্য ওয়ে, দুলাভাই কিন্তু ভীষণ হ্যান্ডসাম! আর শুন, কেউ তাকে পছন্দ করুক বা না করুক, আমি কিন্তু তাকে খুব পছন্দ করেছি।”
ফারাজের দুষ্টু মন্তব্য শুনে অর্ষার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক মৃদু, স্নিগ্ধ হাসি। এরপর ধীরে ধীরে ওয়াজফানের হাত ধরে সে রুমের ভেতরে চলে এলো।

রুমে প্রবেশ করেই ওয়াজফান চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখতে লাগল। আসবাবপত্রগুলো সাধারণ, সাজসজ্জায়ও কোনো আভিজাত্যের ছোঁয়া নেই, তবে প্রতিটি জিনিসেই ঘরোয়া উষ্ণতার গন্ধ মিশে আছে। ওয়াজফানের চোখে হয়তো প্রথমবারের মতো এমন সাদামাটা, অথচ শান্ত পরিবেশ ফুটে উঠল।
অর্ষা কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বলল—
— “এটা খুব ছোট রুম… জানি আপনার বাড়ি কত বিশাল, কত বিলাসবহুল। তাই এখানে থাকতে হয়তো আপনার কষ্ট হবে। তবে যদি একটু চেষ্টা করেন, কয়েকটা দিন মানিয়ে নিন।”
ওয়াজফান মুচকি হেসে অর্ষার হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। তার চোখেমুখে ছিল অদ্ভুত দৃঢ়তা আর গভীরতা—
— “এখানে থাকতে আমার কখনোই কষ্ট হবে না। কারণ যেখানে তুমি আছো, সেখানেই আমি অনায়াসে থাকতে পারব।”
অর্ষার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। সে ঠিক বুঝল না, ওয়াজফানের কণ্ঠের দৃঢ়তাটা কি আদেশের মতো, নাকি সীমাহীন ভালোবাসার মতো।
ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার বাইরে থেকে ভেসে এলো অর্ষার ছোট ভাইয়ের কণ্ঠ—

— “দিদি! মা তোমাদের খেতে ডাকছে। দুলাভাইকেও নিয়ে আয়।”
অর্ষা এক ঝটকায় সরে এসে ওয়াজফানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় বলল—
— “চলুন, খেতে চলুন।”
কিন্তু ওয়াজফান মুখ গম্ভীর করে, কঠোর ভঙ্গিতে জবাব দিল—
— “না, আমি যাব না। তুমি জানো না, আমি তোমার হাতের রান্না ছাড়া কিছু খেতে পারি না। তুমি যাও, রান্না করো, তারপর আমি খাব।”
অর্ষা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে চাপা হাসি খেলে গেল।
— “এটা কিরকম পাগলামো, ওয়াজফান? আচ্ছা, আমি যদি কখনো না থাকি, তখন আপনি কী করবেন?”
এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াজফানের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। চোখে ঝলসে উঠল কঠিন এক শীতলতা। তার কণ্ঠ যেন ধমকের মতো কেঁপে উঠল—

— “তুমি থাকবে না মানে? পাগল হয়ে গেছো নাকি? তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিলে তো যাবে—কখনোই ভুলেও ভেবোনা তুমি আমার থেকে ছাড় পাবে ।”
অর্ষা স্তব্ধ হয়ে গেল। ওয়াজফানের সেই দৃঢ় অথচ ভয়ঙ্কর উচ্চারণে যেন মুহূর্তেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল। তবুও তার অন্তরের গভীরে এক অদ্ভুত নিরাপত্তার পরশ বইতে লাগল—যেন এই মানুষটা সত্যিই তাকে কখনো হারাতে চাইবে না।
ওয়াজফান অদ্ভুত কঠিন অথচ ব্যথাভরা কণ্ঠে আবার বলল—

— “আর যদি কখনো এরকম পরিস্থিতি এসে পড়ে, তুমি আমার কাছে না-ও থাকো… তবে সেই দিন থেকে আমার জন্য সব শেষ হয়ে যাবে। আমি আর কোনোদিন রান্না করা খাবার খেয়ে বাঁচবো না।
আমি আমার নারী ছাড়া অন্য কোন নারীর হাতের রান্না কখনোই মুখে তুলবো না মরে গেলেও না –এটা তুমি জেনে রাখো।

কথাগুলো শুনে অর্ষার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। তার মনে হলো ওয়াজফানের এই কথার আড়ালে হয়তো এক অদৃশ্য শপথ লুকিয়ে আছে—যেন সে সত্যিই তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।
কিন্তু সে আর কিছুই বলল না। চোখে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত নীরবতা। ঠোঁট সামান্য কাঁপলেও কোনো উত্তর দিল না অর্ষা। শুধু ধীরে ধীরে সরে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
ওয়াজফান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার পিছু হটার দৃশ্যের দিকে। অর্ষার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তার হৃদয়ের ভেতর কেঁপে উঠছিল। মুহূর্তটায় ওয়াজফানের চোখে ঝলসে উঠল এমন এক অনুভূতি—ভালোবাসা, ভয় আর অধিকারবোধের মিশ্র ছায়া—যেন সে ঠিক করে নিয়েছে, অর্ষা তার জীবন থেকে কখনোই হারিয়ে যাবে না।

রান্নাঘরে ঢুকে অর্ষা নিঃশব্দে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। হাত দুটো কাঁপছিল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করল। বুকের গভীরে অদ্ভুত এক উষ্ণতা জেগে উঠছিল—ওয়াজফানের ওই কথাগুলো হয়তো ভয়ঙ্কর ছিল, তবে তার ভেতরে ছিল এক অকৃত্রিম, অচঞ্চল ভালোবাসার ছায়া।
রান্নাঘরের কোণে অর্ষা কুঁচকানো চুলের খোঁপা হাতে ধরে, ধীরে ধীরে পাত্রটি নাড়ছিল। তার মা রান্নাঘরের দরজার পাশে এসে দাঁড়ালেন, অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তো সব রান্না করে রেখেছি, তুই আবার কেন রান্না করছিস?”
অর্ষার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর মৃদু কাঁদতে কাঁদতে তার মায়ের দিকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে কাঁদল, তারপর ফিসফিস করে বলল,

“আমায় মাফ করে দাও মা… আমি আর কখনো ভুল করব না।”
মেয়ের কান্না দেখে মায়ের বুক ভরে গেল। সে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরেই বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে, আর কান্না করা লাগবে না। বল, এখন কি রান্না বাকি? আমি করে দিচ্ছি। তুই তো এমনিও রান্না পারিস না।”
কিন্তু অর্ষা মাথা না হেলিয়ে বলল,
“না মা, তোমার জামাই শুধু আমার হাতের রান্না খেতে পছন্দ করেন। অন্য কারো হাতের রান্না মুখেও তুলবেন না। তাই আমাকে করতে হবে। আমি যদি অখাদ্য রান্না করি, তাও তিনি খেয়ে নেবেন, কিন্তু অন্য কারো হাতের রান্না তিনি খায় না।”

অর্ষার কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মায়ের বুকটা ভরে গেল। হাহাকার আর কষ্টের মাঝেও এক শান্তি ঝিলমিল করতে লাগল—কারণ তার মেয়ে নিজের সুখের জন্য কখনোই ভুল পথ বেছে নেবে না। সে যে সত্যিকারের ভালোবাসা, নিজের প্রিয় মানুষকে সম্মান আর যত্ন দিয়ে রাখবে, তা দেখে মায়ের হৃদয় শান্ত হলো।
আর ওয়াজফান—হ্যাঁ, সেই মানুষটি যে তার মেয়েকে শুধু নিজের চোখের মতো রাখতে চাইবে, যে তার সুখ-দুঃখের প্রতিটি মুহূর্তে পাশে থাকবে—তার প্রতিশ্রুতিটাই মায়ের বিশ্বাসে দাগ কাটল। মায়ের মনে এক গভীর নিশ্চয়তা জেগে উঠল, যে ওয়াজফানই তার মেয়েকে রক্ষা করবে, তার জীবনকে নিরাপদ রাখবে।
চুপচাপ, কিছু না বলে, তিনি ধীরে ধীরে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মায়ের এই মৃদু স্পর্শে অর্ষার চোখে অজান্তেই উজ্জ্বলতা ভেসে এল। আর তারপর, নীরবতার মাঝে, মায়ের হৃদয় শান্ত হয়ে ফিরে গেল—মেয়ের জন্য নিরাপত্তার সেই অমোঘ বিশ্বাস নিয়ে।

তাই আর কিছু না বলে তিনি চলে যান রান্না ঘর থেকে।
অর্ষা রান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখল। ওয়াজফান ও অর্ষা একসাথে বসলো খেতে। অর্ষার বাবার মুখে রাগের ছাপ এখনো স্পষ্ট হলেও, নতুন জামাইয়ের আপ্যায়নে কিন্তু একটুও কমতি রাখলেন না। যত্ন করে একে একে পাতে খাবার তুলে দিলেন—ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, তরকারি—সব যেন অদ্ভুত নিখুঁত আন্তরিকতায় পরিবেশন করা হলো।
ওয়াজফান প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল, কিন্তু পরে অর্ষার মায়ের এমন যত্নে তার ভেতরের অস্বস্তি ধীরে ধীরে গলে গেল। অর্ষা খেয়াল করল, ওয়াজফান খাওয়ার সময় একবারও মুখ ঘুরিয়ে নেয়নি, বরং প্রতিটি পদকে যেন ভীষণ মনোযোগ দিয়ে স্বাদ নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, খাবারের ভেতরে যেন সে পাচ্ছে ঘরের উষ্ণতা, পরিবারের স্পর্শ।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে অর্ষা ধীরে ধীরে বলল,
— “চলুন, আপনাকে আমাদের গ্রামটা একবার ঘুরে দেখাই।”
ওয়াজফান হালকা হেসে সম্মতি দিল।

তারপর দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে গ্রামময় বেরিয়ে পড়ল। চারপাশে সোনালি রোদে ঝলমল করছিল বিকেলের আলো। মাঠের ভেতর শস্যের ঢেউ খেলছিল, কাক আর দোয়েল উড়ে বেড়াচ্ছিল আকাশে। দূরে বয়ে যাওয়া খালের ধারে শিউলি ফুলের সুবাস ভেসে আসছিল বাতাসে।
অর্ষা ধীর কণ্ঠে বলতে লাগল গ্রামের ছোটবেলার স্মৃতির টুকরো—কোথায় সে খেলত, কোথায় লুকাতো, কোন গাছের ডালে ঝুলে দোল খেত। ওয়াজফান নিরব কিন্তু গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তার চোখে মুগ্ধতা, যেন এ গ্রামের প্রতিটি মাটি, প্রতিটি বাতাসকে সে নতুন করে অনুভব করছে—অর্ষার চোখের ভেতর দিয়েই।
হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছাল গ্রামের এক পুরোনো বটগাছের নিচে। বাতাসে ওদের ওড়না আর শার্টের কোণা উড়ছিল। অর্ষা গাছের গুঁড়িতে হাত রেখে দাঁড়াল। ওয়াজফান পাশে এসে ধীরে তার হাতটা নিজের হাতে নিল। চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরে দিগন্তে অস্ত যেতে থাকা সূর্য।
মুহূর্তটা যেন অদ্ভুত শান্ত আর অনন্ত হয়ে উঠল।

অন্ধকার ঘর। চারদিকের দেয়ালে যেন শোকের নিঃশব্দ ছায়া নেমে এসেছে।
জ্যাইম এক কোণে একাকী বসে আছে।
তার হাতে শক্ত করে ধরা সেই পুরনো চিঠিখাতা—এলিনার শেষ লেখা।
এটাই এখন তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।
চোখের কোণে শুকনো অশ্রু, তবু ভেতরে যেন স্রোতের মতো কান্না।
এলিনার মৃত্যুর পর থেকে জীবন তার কাছে নিছক শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তার বাম হাত ক্ষতবিক্ষত—ছুরি চালিয়ে নিজেকেই করেছে ছিন্নভিন্ন।
হাতে তাজা ক্ষত, শুকনো রক্ত, পুরনো কাটা দাগ—সব মিলিয়ে এক যন্ত্রণার ইতিহাস।
প্রতিটি আঘাত যেন ছিল ভেতরের আগুনকে নিভিয়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা।

হঠাৎ সে আবার ছুরিটা ক্ষতের ওপর চালায়—
ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ঝরে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে।
জ্যাইম নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে ওঠে—
“ভালোবাসা যদি শুধু কষ্ট দেওয়ার নাম হয়, তবে আমি আজীবন এই কষ্টেরই বন্দি।
সে তো চলে গেছে… আমাকে একা ফেলে রেখে।
তবুও কেন তার নাম আজও বুকের ভেতর বাজে বজ্রপাতের মতো?
কেন ভালোবাসা এত নির্মম?
একজন কে ভালোবেসে আমি আমার সব দিলাম, তবুও কিছুই পেলাম না।
কি অপরাধ ছিল আমার? ভালোবেসেছিলাম—এই কি আমার শাস্তি?
আজ আমার হাতে যে রক্ত ঝরছে, এ রক্ত শুধু আমার নয়…
এ রক্ত আমার ভাঙা স্বপ্নের, না-পাওয়া ভালোবাসার,

আর সেই চিরন্তন অপেক্ষার, যার শেষ নেই।”
চোখে এক ঝলক অশ্রু নেমে আসে।
ছুরিটা শক্ত করে ধরতে ধরতে সে আবার বিড়বিড় করে—
“ভালোবাসা কি তবে মৃত্যুরই আরেক নাম?
যদি তাই হয়… তবে আমি ধীরে ধীরে মরছি প্রতিদিন।”
চারদিক নিস্তব্ধ।
শুধু ঘরের অন্ধকারে রক্তের গন্ধ আর কষ্টের প্রতিধ্বনি ভাসছে।
আর জ্যাইম বসে আছে নিজের ছায়ার সঙ্গী হয়ে—
অভিশপ্ত এক ভালোবাসার বন্দি।

সন্ধ্যা নামছে।
আকাশের রঙ ধীরে ধীরে বেগুনি অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।
পাখিদের ডাক স্তিমিত, বাতাসে কেবল নীরবতার দীর্ঘশ্বাস।
নিকারো রাজ্যের উঁচু প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ক্যালিয়ন।
চোখ তার দূরে—তবুও যেন কিছুই দেখছে না।
হাওয়ায় তার চাদর দুলছে, কিন্তু তার বুকের ভেতরটা জমাট বরফের মতো ঠাণ্ডা।
সে হঠাৎই নিজের ভেতরের সেই অদৃশ্য কষ্টটাকে শব্দে রূপ দিতে চায়।
ফিসফিস করে বলে ওঠে—

“ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়…
তাহলে আমি আজীবন অপরাধী।
অর্ষা, তুমি কি জানো?
ভালোবাসা মানুষকে যেমন বাঁচায়,
তেমনি কখনো কখনো তাকে নিঃশব্দে হত্যা করে।”
তার গলায় কান্নার চাপা কম্পন।
কিন্তু চোখে একফোঁটা জলও নেই।
সে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে—
“তুমি আমাকে বাঁচাতে পারতে, অর্ষা।
কিন্তু তুমি করোনি…
তোমার কারণেই আমি প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি।
এই বুকের যন্ত্রণা—এই নিঃশব্দ মৃত্যু—কতটা কষ্টের,
তা আমি ছাড়া কেউ জানবে না।”

ক্যালিয়ন দাঁড়িয়ে থাকে নিস্তব্ধতায়,
তার চারপাশে শুধু বাতাসের হাহাকার।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে গভীর শ্বাস টেনে,
মুখে আনলো একরাশ কঠিন দৃঢ়তা।
“ড্যানিয়েল আর ইসাবেলা…
হ্যাঁ, আমি তাদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছি।
কারণ আমি চাই না ড্যানিয়েল আমার মতো কষ্ট পাক।
আমি চাই না ড্যানিয়েল সেই যন্ত্রণা ভোগ করুক,
যা আমি আজও বহন করছি।
ভালোবাসা যদি ত্যাগের নাম হয়—
তাহলে এই ত্যাগই হবে আমার শেষ ভালোবাসার প্রমাণ।”
অন্ধকারে তার দৃষ্টি হারিয়ে যায়।
আকাশে তারারা জ্বলজ্বল করে,

কিন্তু ক্যালিয়নের চোখে কেবল নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এক দগদগে শূন্যতা।
হঠাৎই ক্যালিয়নের মনের ভেতর গুঞ্জন তোলে একরাশ অজানা ভাবনা।
কেউ জানে না সে মুহূর্তে তার মাথার ভেতর কেমন অস্থিরতা চলছে।
তার ঠোঁট নীরব, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে যেন ভয়ংকর ঝড়ের ছায়া।
মনে হচ্ছে, সেই ভাবনাগুলো তাকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর দূরত্বে কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
যেন তার চারপাশের প্রাসাদ, রাজত্ব, আকাশ কিংবা বাতাস—
কিছুই আর নেই, সবকিছু মিলিয়ে গেছে অদৃশ্য অন্ধকারে।
ক্যালিয়নের বুক ধকধক করছে।
তার নিজেরই মনে হচ্ছে, এই অজানা চিন্তাগুলো তাকে সাত দিনের জন্য নয়,
বরং সাত জন্মের মতো দীর্ঘশ্বাসে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
মাথার ভেতরে এক অস্থির স্রোত,
যেন কিছু হারানোর ভয় আর কিছু পাওয়ার অক্ষমতা—
দু’টোই মিলে তাকে ঘিরে ফেলেছে।
বাহির থেকে তাকে দেখলে মনে হয়—
সে দাঁড়িয়ে আছে নির্লিপ্ত, শান্ত;
কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন অদৃশ্য আগুনে পুড়ে যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে।

রাতের খাবার শেষ করে ওয়াজফান অর্ষাকে নিয়ে ধীরে ধীরে রুমে ফিরে আসে। রুমে ঢুকেই সে দরজাটা ভারী শব্দ করে বন্ধ করে দেয়। ঘরে হঠাৎ যেন নীরবতার সঙ্গে অদ্ভুত এক চাপা উত্তেজনা নেমে আসে।
ওয়াজফান ধীর পদক্ষেপে অর্ষার দিকে এগোতে থাকে। তার চোখ দু’টোতে জ্বলজ্বল করছে এক গভীর নেশা, এক অজানা আবেগের স্রোত। অর্ষা তার চোখে সেই দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে—আজ সে আবার কি চায়। ভয় আর লজ্জায় তার বুকের ভেতর হঠাৎই কেঁপে ওঠে।
সে ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকে, এক পা… এক পা করে। কিন্তু হঠাৎই তার পা বিছানার ধারে আটকে যায়। ভারসাম্য হারিয়ে সে নরম বিছানায় পড়ে যায়।
ওয়াজফান তখনও থেমে নেই। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে, চোখে সেই তীব্র নেশার ছাপ নিয়ে, সে এগিয়ে আসে অর্ষার দিকে।

অর্ষা বিছানায় শুয়েও নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, হাত দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে পেছাতে চায়। কিন্তু ওয়াজফান এক হাঁটু গেড়ে বিছানায় ঝুঁকে পড়ে। তার দৃষ্টি অদ্ভুত গম্ভীর, যেন পৃথিবীর সবকিছু থেকে শুধু এই মুহূর্তটা তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সে হাত বাড়িয়ে অর্ষার কোমল পা ধরে টেনে আনে নিজের কাছে।
অর্ষার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে, বুকের ভেতর তীব্র ধুকপুকানি, চোখে এক অদ্ভুত ভয় আর একইসাথে এক অচেনা আকাঙ্ক্ষার ছায়া।

ওয়াজফান ধীর-ধীর অর্ষার শরীরের উপর নিজের পুরো ওজন ঝুঁকিয়ে দেয়। তার চোখে এক অদ্ভুত উষ্ণতা, আর মুখ অর্ষার গলার পাশে ডুবিয়ে, নরম ভেসে আসা নিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে ফিসফিস করে—
“আজ আবার তোমায় অসুস্থ করতে চাই, বউ। আমি ছুঁলে… তুমি এক সপ্তাহ অসুস্থ থাকো, আর আমি সেই সময়টুকু নিজেকে খুব কষ্টে কন্ট্রোল করে রাখি । তোমাকে রোজ চাই, খুব করে কাছে চাই, কিন্তু তোমার ক্ষতি আমি চাই না। তবে আজ… আজ একটু তোমাকে অসুস্থ করতে চাই, জান।”
অর্ষার হৃদয় মুহূর্তে ধুকপুক করতে থাকে। ভয় আর লাজ, অদ্ভুত আকর্ষণ আর উত্তেজনার এক অস্পষ্ট মিশ্রণ তার বুকের মধ্যে ঘুরপাক খায়। ওয়াজফানের নরম স্পর্শে যেন সারা শরীর জোড়া হয়ে ওঠে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে তার উপস্থিতি অদৃশ্যভাবে ছুঁয়ে যায়।

Death or Alive part 30

ওয়াজফান তার গলার নরম স্পর্শে অর্ষার প্রতিক্রিয়া অনুভব করে, ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে রাখে, যেন তার ইচ্ছার তীব্রতা ক্ষতি না করে। তার চোখে হাসি, আর ভেতরে এক অদ্ভুত তৃষ্ণা—অর্ষাকে কাছে পেতে চাওয়ার
অর্ষা খানিকটা লজ্জা ও ভয় অনুভব করে, কিন্তু তার হৃদয়ও অজান্তেই কাছে টানে ওয়াজফানের প্রতি। এই মুহূর্তের ঘনিষ্ঠতা, নীরব উত্তেজনা, আর ফিসফিস করা শব্দগুলো যেন পুরো ঘরটাকে এক অদ্ভুত আবেশে ভরে দিয়েছে।
ওয়াজফান অর্ষার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
Now,i will eat you whole, baby

Death or Alive part 32

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here