Death or Alive part 32
priyanka hawlader
পারস্য রাজ্যের আজকের আবহাওয়া কিছুটা উদ্ভ্রান্ত, চারদিকে যেন গভীর এক নিশ্বাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। শান্তি নেই কারো মনে। হঠাৎই সেই নীরবতাকে ছিঁড়ে দেয় ওয়াজফানের এক গভীর কন্ঠের হুংকার।
ওয়াজফান রাগে চোখ লাল করে উঠলো। তার কণ্ঠ যেন বজ্রের মতো গর্জে উঠলো—
“তোমাদের ওর ছবি স্পর্শ করার অনুমতি কে দিয়েছে! আমি বলেছি না—এই রাজ্যে যেন আমার লিটল মনস্টারের জিনিসে সামান্য দাগও না লাগে। সেটা ওর শরীরের হোক বা ওর ছবিতে। আর আমার বারণ সত্ত্বেও এত বড় ভুল কি করে করলে! তোমাদের কি ওর ছবি স্পর্শ করতে বলেছিলাম।
“বল।”
সেই রাগ, সেই হুমকি যেন প্রাসাদের বাতাসকেও কেটে ফেলল। সবাই ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সামনে কেউ কিছু বলার সাহসই পাচ্ছে না। রূপটা পুরো স্তব্ধ, স্থির, যেন সময় থমকে গেছে। শুধু শুধু তাকিয়ে থাকে সবাই—ওয়াজফানের হুকার, তার রাগ, সব মিলিয়ে যেন বাতাসে আগুন জ্বালিয়ে তুলেছে।
আরও ভয়ানক দৃশ্য—তার পা’র কাছে পড়ে আছে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় একটি জিন করমচারির লাশ। যার কারণে ভুল করে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে অর্ষার একটা ছবি মাটিতে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। সেই দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ওর রাগ যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে, যেন সবকিছু একবারেই আগুনের মধ্যে ঝলসিয়ে যাবে।
প্রাসাদের প্রতিটি জীন এখন নীরব, স্থির এবং আতঙ্কিত। কেউ তাকায় না, কেউ হুঁশিয়ারী করে না—কারণ সবাই জানে, ওয়াজফানের রাগের পরিধি তাদের ধারণার বাইরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওয়াজ ফান এরপর আবারও বজ্রগম্ভীর হুংকারে বলে ওঠে—
“এরপর থেকে আমার লিটল মনস্টার-এর ছবিতে হাত তো দূরের কথা, ছায়াও যেন না পড়ে। ওর কোনো জিনিসে তোমাদের স্পর্শ করা চিরতরে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছি আমি! আর আমার এই নিষেধ অমান্য করার দুঃসাহস যদি কেউ দেখায়, তবে আজ শুধু এক দেহ পড়ে আছে তোমাদের চোখের সামনে—কিন্তু দ্বিতীয়বার এমন ভুল করলে পুরো প্রাসাদটাই রক্তস্রোতে ভেসে যাবে! তাই সতর্ক করে দিচ্ছি—ভুল করেও আর কখনো এরকম দুঃসাহস দেখাবে না। নয়তো আমি কতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারি, সেটা তোমাদের কল্পনার বাইরে।”
তার কণ্ঠের হুংকারে দেয়াল পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। গার্ডদের মুখ শুকিয়ে যায়, ভয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত সরে পড়ে সবাই।
তবে ওয়াজফান থামে না। চোখ রক্তবর্ণ, মুখে হিংস্রতা ভর করে আবার গর্জে ওঠে আয়রাক কে হুকুম করে —
“এ লাশটা ফেলে দাও। আমার প্রাসাদে এই পচা গন্ধ চাই না।”
মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অর্ষার ভাঙাচোরা ছবির টুকরোগুলো যেন অগ্নিশিখার মতো চোখে বিঁধে যায় ওয়াজফানের। সে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ে, ছবির ভগ্নাংশ গুছিয়ে তুলে নেয়। এরপর চলে যেতে থাকে নিজের রুমের দিকে।
প্রাসাদের বাতাস নিঃশব্দে জমাট বাঁধে। রাত যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে, আর ওয়াজফানের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদৃশ্য শপথের কঠিন প্রাচীর।
আর পেছনে থাকা আয়রাক চোখ রাখে ওয়াজফান এর যাওয়ার দিকে। সে মনে মনে ভাবতে থাকে—এই কয়েক মাসে বাদশাহ কতটা ভয়ংক হয়ে উঠেছে। সে এখন আগের থেকেও দ্বিগুণ হিংস হয়ে গিয়েছে। আগে তো কেউ কিছু করলে সবাইকে শুধু বকাবকি করতো।
কিন্তু এখন এই রাজপ্রাসাদে কেউ একটুও পান থেকে চুন খসলে ও, ওয়াজফানের হিংস্রতা যেন অবধারিত রূপ নেয়। সে যেন এক অদৃশ্য আগুনের মতো, যে আগুনের স্পর্শেই কেউ নিরাপদ নয়। ছোটখাট কোনো ভুলও যেন শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তরিত হয়।
তার এই হিংস রূপ প্রাসাদের সকলকে সতর্ক করে রেখেছে। সবাই অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা করছে, যেন কোনো ভুল না ঘটে এবং ওয়াজফান রেগে না যায়।
আয়রাক ফিসফিস করে মনে মনে বলে,
“তবে কি এতটা হিংস্রতা, এতটা বদলানো—শুধু রাণী অর্ষা মারা যাওয়ার পর থেকে।
তার কথার সাথে যেন মিশে যায় রাজপ্রাসাদের অশান্ত বয়ে যাওয়া হাওয়া।
আজ প্রায় দুই মাস কেটে গেছে, কিন্তু এই দুই মাসে জ্যাইম সেই অন্ধকার কক্ষ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বের হয়নি। যেন এই অন্ধকার একাকীত্বই তার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। দিনের আলো বা মানুষের ছায়া তার কাছে এখন একেবারেই অচেনা। খাবারের সময় হলে শুধু একজন দাসী অতি নিরবভাবে ঘরের সামনে খাবারের থালা রেখে যায়; আর জ্যাইম—সে আর কারো সাথে দেখা করতে চায় না, কারো চোখের দিকে তাকাতে সাহস পায় না।
এই কয়দিনে তার শরীরেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। মুখে গজিয়েছে বড় বড় দাড়ি, মাথার চুলগুলো যেন ঘাড় দিয়ে নিচে মৃদু ছুঁই ছুঁই হয়ে পড়েছে। তার আচরণও যেন বদলে গেছে—কেউ কাছে এলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়, কারো সঙ্গে কথা বলে না। ঘন্টার পর ঘন্টা সে আঁকড়ে ধরে থাকে দেওয়ালের দিকে, যেন তার চোখে প্রতিটি ফাঁক তার প্রিয় মানুষটার উপস্থিতি আঁকড়ে ধরতে চায়।
এ যেন সে পুরো পাগলের মতো হয়ে গেছে। কখনো নিজেকে আঘাত করে, তারপর সেই আঘাতে যেন অজান্তেই হেসে ওঠে; হুট করেই চিৎকার করে, অঝোরে কাঁদতে থাকে। তার বেদনার প্রতিটি ছন্দে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন অন্ধকার এক নতুন রূপ ধারন করে। এই অন্ধকার ও একাকীত্বই এখন তার পৃথিবী, তার বন্ধু, তার সহচর, এবং তার একমাত্র সান্ত্বনা।
অন্ধকার রুমে বসে আছে জ্যাইম তাকিয়ে আছে সুন্নে দেয়ালের দিকে, তার হাতে আঁকড়ে ধরা এলিনার দেওয়া সেই চিঠিটি যেটা তার শেষ সম্বল। সারা শরীর ভরে ফুটে আছে ক্ষতবিক্ষত ক্ষতস্থানগুলো—স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দাঁত দিয়ে সজরে কামড়ানোর দাগ, কি দিয়ে আঘাত করার দাগ, বেল্ট দিয়ে আঘাত করার দাগ—সব কিছু জানাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে তার শরীরে।
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমি আজও বেঁচে আছি এলিনা, শুধু তোমার রেখে যাওয়া এই শেষ চিঠিটা কারনে। তোমার বলা কথাগুলোর কারণে প্রতিনিয়ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার অভ্রান্ত চেষ্টা করছি, কিন্তু জানিনা কতদিন এই চেষ্টা আমি করে যেতে পারবো। তবে আমি আমার মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও বলবো—যেন আমার মৃত্যুর পরে তোমার রেখে যাওয়ায় শেষ চিঠি আমার কবরে স্থাপিত করে দেওয়া হোক।
তোমাকে হারানোর পরে আমি বুঝেছি—মৃত্যু কাউকে মারে না, মৃত্যু শুধু বেঁচে থাকা মানুষকে প্রতিনিয়ত মারে।
হঠাৎই জ্যাইমের মুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত, অশান্ত হাসি—এক পাগলের মতো উন্মত্ত হাসি। সে তার ভাঙা কণ্ঠে বলে, “তুমি এসেছ, এলিনা… আমি জানতাম, তুমি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে আমার কাছে। তুমি বোধহয় আমাকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছ, তাই না? তাই তুমি আমার কষ্ট কমানোর জন্য আমার কাছে ফিরে এসেছ, আবার তাই না…”
কথাগুলো বলতে বলতে সে থমকে দাঁড়ায়। মনে হয়, তার সামনে সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এলিনা—তার হারানো, তার সবচেয়ে প্রিয় এলিনা—ঠিক তার সামনে। জ্যাইম অন্ধকারে তাকিয়ে সে মিথ্যে ছায়া নয়, যেন সত্যিই এলিনার আবছা রূপ দেখতে পাচ্ছে।
এক মুহূর্তে তার হৃৎপিণ্ডে যেন ভাসছে আনন্দ আর যন্ত্রণা একসাথে। সে এগিয়ে যায়, তার হাত বেয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়, তাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু হঠাৎই সব যেন ভেঙে যায়—মাটিতে ধুপ করে বসে পড়ে, সমস্ত আশা চূর্ণবিচূর্ণ। সে বুঝতে পারে, এলিনা ফিরে আসেনি। তার চোখে অশ্রু জড়ো হয়, এবং হৃদয় থেকে বেরোয় হাহাকার—এই ফিরে আসা, এই জড়িয়ে ধরা, সবই কেবল তার কল্পনারই খেলা।
এখনও প্রতিনিয়ত, সে তার কল্পনা জগতের মধ্যে এলিনাকে ফিরে আসা দেখতে পায়। চোখ বন্ধ করলে সে দেখতে পায় তার হাসি, শুনতে পায় তার স্বর। হাত বাড়ালে মনে হয় সে সেখানে—কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসে বাস্তবের কঠোর সত্য। জ্যাইম জানে, সত্যিকার এলিনা কখনও ফিরে আসবে না। তবু সে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে এই ভয়ানক এক অন্ধকার জগতে, যেখানে কল্পনা এবং স্মৃতি এক হয়ে গিয়েছে, আর প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে শুধু অনুভব করে, হারানো ভালোবাসার ঘাতক যন্ত্রণা।
জ্যাইমের চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে, প্রতিটি ফোঁটা যেন তার ভিতরের যন্ত্রণার সাক্ষী। এক হাত দিয়ে সে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে, আর অন্য হাত দিয়ে দেওয়ালে জোরে জোরে আঘাত করছে, যেন আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বের হচ্ছে তার অন্তরের সব যন্ত্রণা।
ভাঙা, কণ্ঠে তিনি ফিসফিস করে বলে উঠল,
“লোকে বলে… সময় সব ক্ষত সারিয়ে দেয়… কিন্তু সময় তো শুধু তোমার স্মৃতিকে আরও গভীর করে দেয়। প্রতিটি নিশ্বাস যেন বলছে—আমি তোমাকে হারিয়েছি, এলিনা। আর সেই হারানোই আমাকে পাগল করে তুলেছে।
প্লিজ… এলিনা, ফিরে আসো না আমার কাছে? আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এরপর আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না, আকাশের ওপারে চলে যেতে দেবো। শুধু… প্লিজ, একবার… ফিরে আয়… আমার কাছে।”
তার কণ্ঠ যেন আকাশের গহ্বরে ভেসে যাচ্ছে, আর অশ্রুর সঙ্গে প্রতিটি শব্দ মিলিয়ে তৈরি করছে এক নিঃশব্দের, হৃদয়বিদারক সংগীত—হারানো ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস, বেঁচে থাকার ক্লান্তি এবং ফিরিয়ে নেওয়া অনিশ্চিত আশা।
জ্যাইম চোখ দিয়ে অতবরত অশ্রু ঝরতে রাখতে রাখতে, হুংকার দেওয়া কণ্ঠে সুন্নের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে ওঠে—
“I love you, এলিনা!”
কান্নার ভেজা চোখে সে যেন শব্দগুলো পড়াচ্ছে, হৃদয়ের প্রতিটি টানাপোড়েন ছুঁয়ে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের হাতটি গুটিয়ে নেয়, কিন্তু ছুরি ধরে সে সেই ক্ষতস্থলে আবার আঘাত করতে থাকে, যেন লিখছে—কতটা সে তার সাথে আছে, কতটা তার ব্যথা ভাগাভাগি করছে। বুকের ধাক্কা আর চোখের জলই প্রকাশ করছে সেই অন্তরের অশান্তি।
তার কণ্ঠ আবার কেঁপে ওঠে, কষ্টের প্রতিচ্ছবি হয়ে:
“যদি কষ্টের কোনো শব্দ থাকতো, তবে আমি প্রতিটা মুহূর্ত চিৎকার করে বলতাম। তুমি শুধু আমার হয়ে থাকো, এলিনা। কিন্তু আজ দেখো, তুমি তো আমার হলেই না, অথচ আমি রয়ে গেলাম পাগল হয়ে।”
তারপর সে এক আঘাতেই স্থির হয়ে যায়, ছুরি দিয়ে নিজের ক্ষতস্থলে শতবার আঘাত করতে থাকে। যেন সেই পুনরাবৃত্তি ক্ষত থেকে ভেতরের যন্ত্রণার ঢেউগুলোকে কিছুটা হলেও শিথিল করছে। চোখ দিয়ে জল ধারা অব্যাহত—অশ্রু আর যন্ত্রণার এক অমোঘ স্রোত।
ঘর জুড়ে যেন বিরাজ করছে নিস্তব্ধতার এক ভয়ংকর আচ্ছন্নতা। বাতাসও যেন তার চিৎকার, আর্তনাদ এবং অসহনীয় যন্ত্রণায় কাঁপছে। আকাশ পর্যন্ত যেন জ্যাইমের কান্নায় কাঁপছে—শুধু সেই হারানো ভালোবাসার জন্য, শুধুই এলিনার জন্য।
বিকেলের রোদ মৃদু সোনালি আলোয় রাজপ্রাসাদের বারান্দা ভরে উঠেছে। সেই আলোয় নিঃশব্দে বসে আছে ইসাবেলা। তার চোখে এক অজানা শূন্যতা, মনকে গ্রাস করে আছে একাকার ভাবনা। দুই মাস হয়ে গেল, ড্যানিয়েল এই রাজ্যে নেই। কাজের কারণে চলে গেছে অন্য রাজ্যে, কিন্তু তার এই অনুপস্থিতি যেন ইসাবেলার মনে এক অসহায় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। একাকীত্বের দীর্ঘ সময়গুলো তার চিন্তাগুলোকে বন্দিনী করে রেখেছে, মুক্তি দিচ্ছে না এক মুহূর্তও।
সে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে—
“আমার সাথে আসলে কী ঘটছে? কিছুই বুঝতে পারছি না। ড্যানিয়েল কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে? নাকি ওর সবটুকু যত্ন, সবটুকু আগলানো কেবল দায়িত্বশীলতার কারণে? যদি সত্যিই ভালোবাসা না থাকে, তবে কেন সে আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল?কেন আমাকে এই রাজপ্রাসাদে এনে নিজের জীবনের অংশ করেছিল?”
কিন্তু আবারই তার মনের ভেতর দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে।
“আচ্ছা, ভালোবাসা যদি সত্যিই না থাকে, তবে কেমন সেই দায়িত্ব, যা এতটা গভীর, এতটা নিবিড়? একজন মানুষ কি শুধু দায়িত্ববোধের কারণে অন্য কাউকে এত আগলে রাখতে পারে? সবসময় পাশে থাকতে চাইবে? অথচ আমার কাছে আসে না, আমার অন্তরের কাছে পৌঁছাতে চায় না।”
ইসাবেলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। মনে হয়, ভালোবাসার সঠিক ভাষা বোঝা কতটা কঠিন! ড্যানিয়েলের অনুভূতি তাকে প্রতিনিয়ত কাছে টানে আবার দূরে ঠেলে দেয়। সে চায় ইসাবেলাকে আগলে রাখতে, কিন্তু তার হৃদয়ের দুয়ার খুলে দেয় না। আর এই অচেনা দ্বন্দ্বই ইসাবেলার প্রতিটি বিকেলকে করে তোলে অস্থির, নিঃসঙ্গ ও চিন্তার গোলকধাঁধায় আবদ্ধ।
হঠাৎই ইসাবেলার মনে পড়ে যায়, সে দেখেছিল একদিন ড্যানিয়েল কে অন্য এক রাজ্যের মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো তারা দুজন দুজনকে অনেক আগে থেকেই চিনে।
কথাটি মনে পড়তেই ইসাবেলার মনে হয়, ড্যানিয়েল কি তবে তাকে নয়, সেই মেয়েটাকেই ভালোবাসে? আর সে—শুধু তার দায়িত্বশীলতা। তাই-ই কি তাকে এতটা আগলে রাখে?
পরক্ষণেই ইসাবেলার মনে পড়ে যায়, আজ ড্যানিয়েল সব কাজ শেষ করে অবশেষে রাজ্যে ফিরতে চলেছে। তার মনে এক অজানা দৃঢ়তা জন্ম নেয়—আজ সে মনের সব ভার জিজ্ঞেস করবে ড্যানিয়েলকে। সে আর এই দোটানার মধ্যে থাকতে চায় না।
এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ পেছন থেকে এক জোড়া হাত জোরে জড়িয়ে নেয় তাকে। ইসাবেলা বিস্ময়ে পেছনে ঘুরে তাকায়—দেখে ড্যানিয়েল তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আছে। ড্যানিয়েলের মুখে মৃদু হাসি, আর ইসাবেলার মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
ড্যানিয়েল মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
— “পিন্সেস ইসাবেলা, তা আমাকে ছাড়া আপনার দিন কেমন কাটলো এতদিন?”
ইসাবেলার সংক্ষিপ্ত উত্তর,
— “হুম, ভালো।”
ড্যানিয়েল আবারও হাসে, কণ্ঠে রসিকতা মেশানো সুর,
— “আমাকে ছাড়া তুমি ভালো ছিলে এতদিন? একটুও মিস করোনি আমাকে?”
ইসাবেলা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তবে উত্তর আসে আবারও সংক্ষিপ্ত,
— “হুম, করেছি।”
হুট করেই ইসাবেলার মনে দৃঢ় হয়—আর দেরি নয়! এখনই সে জিজ্ঞেস করবে ড্যানিয়েলকে, আর তার কাছ থেকে সব প্রশ্নের উত্তর আদায় করেই ছাড়বে। কেনো সে এরকম করছে, আদৌ তাকে ভালোবাসে কিনা—এসব প্রশ্নের উত্তর সে আজই চাইবে।
এমন ভাবনায় ভরতেই ইসাবেলা বলে ওঠে,
— “আপনাকে কিছু বলার আছে…”
ঠিক তখনই হঠাৎ দরজায় এসে ডাক দেয় এক নেকড়ে। মুহূর্তেই ড্যানিয়েলের মনে পড়ে যায় তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে। তাই হয়তোবা ডাকতে এসেছে, ইসাবেলাকে ছেড়ে দিয়ে সে দ্রুত বলে ওঠে,
— “আমার একটা কাজ আছে, তাই আমাকে এখনই যেতে হবে। আমি পরে এসে তোমার কথা শুনব।”
কথাগুলো বলেই ড্যানিয়েল চলে যায়। আর ইসাবেলা উদাস চোখে দাঁড়িয়ে থাকে—হৃদয়ে জমে ওঠা কথা অনুচ্চারিত থেকে যায়, আর মন ভরে ওঠে এক অজানা কষ্টে।
একটি ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে ড্যানিয়াল। তার সাথে আছে এক নেকড়ে ছেলে। হঠাৎ ড্যানিয়েল গর্জে ওঠে, কণ্ঠে বজ্রধ্বনি,
— *“তোমার সাহস কী করে হলো আবার ইসাবেলার দিকে চোখ তুলে তাকানোর? আমি তো বলেছিলাম, ওর দিকে কেউ কুদৃষ্টি দিতে পারবে না! কেউ যদি চেষ্টা করে, আমি সেই হাত কেটে দেবো। এরপর যদি আমার কানে আসে—ইসাবেলা সম্পর্কে একটি তুচ্ছ শব্দও কেউ বলেছে, কিংবা তার নামে খারাপ মন্তব্য করেছে—তবে আমি এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করব, যা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
ভুলে যেও না, আমি এই রাজ্যে না থাকলেও রাজ্যের প্রতিটি খবর ঠিকই রাখি। আর হ্যাঁ, লর্ড ক্যারিও কিছু মাস ধরে রাজ্যে নেই বলে যদি তোমরা নিজেদের রাজা ভাবতে শুরু করো—তবে সেটা তোমাদের ভুল। সে রাজ্যের সব দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে গিয়েছে। তাই আমি নিজের ইচ্ছেমতো যাকে যা করতে পারি। প্রয়োজন হলে কাউকে হত্যা করতেও আমি দ্বিধা করব না। তাই আমার হুকুম অমান্য করার সাহস যেন আর কখনো না দেখাও।”*
ড্যানিয়েলের বজ্রকণ্ঠে কাঁপতে থাকে রুমের বাতাস।
ঠিক সেই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ইসাবেলা। তার কানে ভেসে আসে ড্যানিয়েলের বলা কথাগুলো। বিস্ময়ে থেমে যায় সে, নিঃশব্দে রুমের দেয়ালে কান ঠেকিয়ে আরও স্পষ্টভাবে শোনার চেষ্টা করে। দ্যানিয়েলের প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে অদ্ভুত আলোড়ন তোলে—ভয়, বিস্ময় আর অজানা এক আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ইসাবেলা।
নেকড়ে ছেলেটি ঠোঁটে এক বাঁকা হাসি টেনে দ্যানিয়েলকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
— *“তুমি নিজেই তো ইসাবেলাকে তুলে এনেছো, তাই না? লর্ড ক্যালিয়ন-এর কথায়! সে তো চেয়েছিল ওয়াজফানের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে। আর তাই সে-ই তো তোমাকে বলেছিল—জীনের বাদশার বোনের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে, ইসাবেলাকে সেই জালের ভেতর ফাঁসিয়ে বিয়ে করে এনে তুলে দিতে। তুমি-ও তো ঠিক তার সব কথামতোই করেছ।
সত্যিই ভালোবাসা কোথায়? তুমি তো শুধু লর্ড ক্যালিয়নের আদেশ মেনে চলেছো। তাই এখন যদি অন্য কেউ ইসাবেলার দিকে তাকায়, কিংবা তাকে পেতে চায়—তাতে তো তোমার কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। কারণ তুমি ওকে ভালোবাসো না।”*
কথাগুলো যেন বজ্রাঘাতের মতো এসে আঘাত করে ইসাবেলার হৃদয়ে। রুমের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না—এতটা ভালোবাসা, এতটা যত্ন, এত স্মৃতি—সবই কি তবে অভিনয় ছিলো?
তার বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চোখ ভিজে ওঠে নীরব অশ্রুতে। কণ্ঠে কোনো শব্দ আসে না—শুধু ভেতরে এক অন্তহীন শূন্যতা জমে ওঠে। ধীরে ধীরে, ভাঙা মন নিয়ে সে সেখান থেকে সরে যায়, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে ভেঙে যাচ্ছে তার ভরসার প্রাসাদ।
ড্যানিয়েল রাগে চোখ লাল করে এক ঝটকায় নেকড়ে ছেলেটির কলার চেপে ধরে, গর্জনমিশ্রিত হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে—
— “তোকে কে বলেছে আমি ইসাবেলাকে ভালোবাসি না? হ্যাঁ, ওকে তুলে আনতে গিয়েছিলাম লর্ড ক্যালিয়নের কথায়—কিন্তু ওকে তুলে আনার পর আমি ওকে আমার স্ত্রী হিসেবে মর্যাদা দিয়েছি। আর হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবাসি! ও এখন আমার বউ, আমার জীবনসঙ্গিনী। তাই ভুল করেও যদি আমার স্ত্রীর সম্পর্কে আর একটি শব্দও বলতে শুনি, তবে আমি তোকে শাস্তি দিতে দ্বিধা করবো না– নিজের হাতে তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব!”
রাগে কাঁপতে কাঁপতে ছেলেটার কলার ছেড়ে দেয় ড্যানিয়েল। তারপর চোখে দহনভরা আগুন নিয়ে আবারও হুঁশিয়ারি দেয়,
— “আমার দেওয়া ওয়ার্নিংটা যেনো মাথায় রাখিস। দ্বিতীয়বার এরকম করলে আমি আর সতর্ক করবো না—তোকে সরাসরি মাটির নিচে পুঁতে দেব।”
কথাটা বলে ড্যানিয়েল ঝড়ের মতো রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রুমের ভেতরে বাতাস জমাট বেঁধে থাকে—নেকড়ে ছেলেটির মুখে ভয়ের ছাপ আর ড্যানিয়েলের গর্জন যেন এখনও দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়।
রাতটা আজ অদ্ভুত শান্ত অথচ ভেতরে ভেতরে অশান্ত। আকাশে কালো মেঘের ভাঁজ, চারদিকে বয়ে যাচ্ছে একরাশ অশান্ত বাতাস। সেই বাতাস যেনো কারও কান্না, কারও দুঃখের প্রতিধ্বনি বয়ে আনে। অথচ এই অস্থিরতার মাঝেই, এক কোণে সুশান্ত দেহে অথচ অশান্ত মনে বসে আছে বাদশাহ ওয়াজফান।
তার চোখে জ্বলছে দহন, দৃষ্টিতে আছে আগুনের তেজ। কিন্তু সেই আগুনের শিখা বাইরের কারও দিকে ছুটে যাচ্ছে না—পুড়িয়ে খাচ্ছে তার অন্তরকে। অর্ষার চলে যাওয়ার পর থেকে এই দুই মাস ধরে যেনো তার জীবনটাই থেমে গেছে। সিংহাসনের জাঁকজমক, রাজ্যের বিপুল সম্পদ, এমনকি অগণিত খাবারের পাহাড়—কিছুই তাকে স্পর্শ করে না।
দুই মাস! পুরো দুই মাস ধরে তার ঠোঁটে একটুকরো আহার পর্যন্ত ওঠেনি। না ফল, না মাংস, না রাজপ্রাসাদের সেরা ভোজ—কিছুই তার কাছে খাবার নয়। কারণ খাবার মানেই তার কাছে অর্ষার হাতের রান্না। সে ছাড়া অন্য কিছু স্পর্শ করার সাহস পায়নি, ইচ্ছে জাগেনি।
মানুষের শরীর সহ্য করতে পারে সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ না খাওয়া, আবার জল ছাড়া মাত্র চার-পাঁচ দিন। অথচ একজন জিনের ক্ষমতা ভিন্ন। তারা সহ্য করতে পারে আরও দীর্ঘ সময়ের অভুক্তি। একজন জীন খাবার ও পানি খাওয়া ছাড়া সর্বোচ্চ ১ বছর বেচে থাকতে পারে। আর তাই অর্ষাহীন জীবনে ওয়াজফান কাটিয়ে দিয়েছে দুই মাস—না খাবার, না পানি। কেবল তপ্ত নিশ্বাস আর দহনমাখা চোখে জ্বলন্ত শূন্যতা।
অর্ষা যেনো তার জীবন থেকে সরে যাওয়া কোনো মানুষ নয়, বরং তার অস্তিত্ব ছিনিয়ে নেওয়া। তাই আজও এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার রাতে, অশান্ত বাতাসের তাণ্ডবের মাঝখানে, নিজের ভেতরের ঝড় নিয়ে সিংহাসনের ওপর একা বসে আছে ওয়াজফান।
তার কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো এক গর্জন ভেসে আসে। নিঃশব্দ রাত কেঁপে ওঠে সেই স্বরে। ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে ওয়াজফান হাত বাড়িয়ে দেয় অর্ষার ছবির দিকে। ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে, যেন ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের সবটুকু যন্ত্রণা ঢেলে দিয়ে ফিসফিস করে বলে—
“আমার পৃথিবীটা শেষ হয়ে গেছে, যেদিন তুমি চোখ বুজে ঘুমিয়ে গেলে চিরতরে। আমি আজও বেঁচে আছি, লিটল মনস্টার, শুধু তোমার নামের পাশে ‘ছিল’ শব্দটা বসাতে ভয় পাই বলেই। তুমি কেন এভাবে নির্মমভাবে আমাকে ফেলে চলে গেলে? এই ভুবনহীন নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল তুমি ছিলে। আর সেই তুমি যখন আমায় ছেড়ে চিরতরে চলে গেলে, তখন আমিও নিঃশেষ হয়ে গেলাম।
আমি আছি, বেঁচে আছি—কিন্তু কেবল নিঃশ্বাস নেওয়া ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার আর কোনো কাজ নেই। তুমি কেন আমায় ফেলে চলে গেলে? কেন এভাবে দুঃখের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে তুমি নিজে মুক্তি নিলে?”
সে থেমে যায় এক মুহূর্ত। বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে না বলা কতকথা। এরপর আবার জলন্ত গলায় বলে—
“আমার বিশ্বাস, তুমি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। এই বিশ্বাসটুকুই আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি আমি। নইলে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভস্ম করে দিচ্ছি, কেবল তোমার অপেক্ষায়…”
ওয়াজফান ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে শোয়। নীরবতা ঘরটি আবৃত করে রেখেছে, শুধু দূর থেকে বাতাসের ফিসফিস কানে আসে। হঠাৎই তার চোখ পড়ে নিজের হাতে। অজান্তেই সে মুখ খুলে ফিসফিস করে, “তোমার হাতের স্পর্শ এখনো আমার আঙুলে লেগে আছে, কিন্তু তুমি নেই… এই শূন্যতা কোনোদিনও ভরবে না, লিটল মনস্টার।”
সে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু মনে ভেসে ওঠে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি স্পর্শ। ধীর গলায় একটি শেষ বাক্য ফিসফিস করে—
“আজও আমি ঘুমোতে গেলে, তোমার কণ্ঠস্বর কানে বাজে, অথচ জানি… তুমি আর কখনো ফিরবে না। কিন্তু তবুও মনকে বুঝতে পারি না; প্রতিনিয়ত মনে হয় যেনো এইতো তুমি ফিরে আসবে আমার কাছে। আর আমি জানি, আমার মনে হওয়া ভুলনা—তুমি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে, আমার কাছে আসতে যে তোমাকে হবেই, দেখো নিও, তুমি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে আমার কাছে।”
Death or Alive part 31
দুই মাস ধরে ঘুম অচেনা হয়ে গেছে ওর চোখের পলকগুলোর জন্য। তবুও, কেবল একটু আরামের জন্য সে পলকগুলোকে ধীর করে বন্ধ রাখে। নিঃশ্বাসে ভরা রাত, নিস্তব্ধ ঘর, আর একান্ত বিষাদ—সবই মিশে এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে ওয়াজফানের অন্তর্লীন একাকিত্বকে আরও গভীর করে তোলে।
 
