Death or Alive part 33

Death or Alive part 33
priyanka hawlader

এক রূপকথার মতো জঙ্গল। চারপাশে যেন কুয়াশায় ঢাকা সবুজ পর্দা। গাছগুলো লম্বা, শ্যাওলা আর অর্কিডে ভরা; ঝরে পড়া পাতার ভেজা গন্ধ মিশে আছে বাতাসে। উপরে ঘন ছাউনি, মাঝে মাঝে সূর্যের আলো পাতার ফাঁক গলে এসে নরম সোনালি রশ্মি ফেলে।
প্রজাপতির ঝাঁক, রঙিন হামিংবার্ড আর পাখিদের ডাক মিলেমিশে জঙ্গলের এক অনন্য সুর তৈরি করে। দূরে কোথাও একটানা পানির শব্দ—একটা ছোট্ট জলপ্রপাত গড়িয়ে পড়ছে শ্যাওলা ঢাকা পাথরের ওপর দিয়ে। মাটিতে ভেজা মস, আর চারদিকে বুনো ফুলের নরম রঙ যেন জঙ্গলের বুকেই বসানো এক স্বপ্নলোক।এই জঙ্গল টির নাম হল, Mindo nambillo cloud forest.

জঙ্গলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে এক সুন্দর কটেজ,
কটেজটা কাঠ দিয়ে তৈরি, ছাদে লালচে-বাদামি টালি।
বারান্দাটা বাঁশ দিয়ে ঘেরা, যেখানে ঝোলানো আছে দুইটা দোলনা চেয়ার, আর পাশে কাঠের ছোট টেবিলে রাখা তাজা বুনো ফুলভরা কাচের ফুলদানী।
জানালায় সাদা হালকা পর্দা, বাতাসে দুলে দুলে বাইরে তাকানো যায়।
কটেজের চারপাশে ছোট বাগান, যেখানে বুনো অর্কিড, কলা গাছ আর রঙিন প্রজাপতির খেলা।
একপাশে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামলেই একটা ছোটো নদীর ধারে পৌঁছে যাওয়া যায়।
কটেজের ভেতরে ঢুকলেই কাঠের ফ্লোর আর উষ্ণ আলোর নরম পরিবেশ।
লিভিং রুমে বড় একটা ফায়ারপ্লেস, পাশে বইয়ের তাকে রাখা জঙ্গলের ইতিহাস আর গল্পের বই।
সোফাগুলো হালকা বাদামি কাপড়ে মোড়া, টেবিলের উপর রাখা কাঠের তৈরি লণ্ঠন, যেটায় মোমবাতি জ্বললে ভেতরে নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দেয়ালে টাঙানো আছে স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা পাখি আর ঝর্ণার ছবি।
শোবার ঘরে কাঠের বড় বিছানা, সাদা-ক্রিম রঙের চাদর আর মশারি ঝুলানো, যেন জঙ্গলের মাঝে থেকেও নিরাপদ আর আরামদায়ক ঘুম।
ভেতরে সব সাজসজ্জায় একধরনের গ্রামীণ অথচ স্বপ্নময় আবহ—যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকার এক শান্ত ঠিকানা।
কটেজের ভেতরে নীরবতা, শুধু বাইরে থেকে ভেসে আসছে বনের পাখিদের কোলাহল আর দূরের ঝর্ণার মৃদু গুঞ্জন। কাঠের জানালা ভেদ করে সকালের সোনালি আলো ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে ঘরে।
কাঠের তৈরি সেই ছোট্ট ঘরের ভেতর, নরম সাদা চাদরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে এক মেয়ে। তার নিঃশ্বাসের তাল যেন বনের স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে। হঠাৎই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলের গলা ভেসে আসে—

—“উঠ রেড ওয়াইন… আর কতক্ষণ ঘুমাবে? দেখো, কত বেলা হয়ে গেছে… এবার উঠে যাও।”
মেয়েটি নড়েচড়ে উঠে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় তার দিকে। অর্ধেক ঘুমন্ত চোখে জেগে ওঠার হাসি মিশে আছে। ঠোঁটে লেগে থাকে মৃদু আলোর মতো একটি হাসি।
সে নরম স্বরে বলে—
—“গুড মর্নিং, মাই লাভ।”
ছেলেটা হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে আসে। চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, ঠোঁটে কোমলতা।
—“গুড মর্নিং, মাই রেড ওয়াইন।”

মেয়েটা ধীরে উঠে বসে, আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে। এই আলিঙ্গনে জঙ্গলের সব কোলাহল থেমে যায় যেন। কয়েক মুহূর্ত পর তার দৃষ্টি যায় টেবিলের দিকে। সেখানে রাখা আছে কাঠের ট্রেতে সাজানো নাস্তা—তাজা ফল, মধু মাখা পাউরুটি আর গরম কফির কাপ।
চোখ বড় হয়ে যায় তার। অবাক হয়ে বলে ওঠে—
—“ক্যালিয়ন… আজও তুমি আমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়ে এনেছো? এই রোজ রোজ তুমি কেন খাবার বানাবে? আমাকে কেন বানাতে দাও না বলো তো?”
ক্যালিয়ন একটু থেমে মৃদু হাসল। তারপর তার কণ্ঠে দৃঢ়তা, অথচ ভালোবাসার কোমলতা মিশে শোনা গেল—
—“কারণ তুমি আমার অনেক সাধনার পরে পাওয়া আমার ভালোবাসা। আমি তোমাকে আমার রানী করে রাখতে চাই। তোমাকে এখানে খাবার বানানোর জন্য আনি নি, তুমি এখানে আমার রানী হয়ে আমার রাজ্যে আমার সাথে দিন কাটাচ্ছো—এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। তুমি শুধু হুকুম করো, আমি তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করে দেব… আমার রেড ওয়াইন।”
মেয়েটার ঠোঁটে হাসি ফুটল, তবে সেই হাসির আড়ালে চোখে লেগে থাকল একরাশ বিস্ময়। সে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল—

—“তুমি আমায় এত ভালো কেন বাসো? এত ভালোবাসার কি কারণ আছে?”
ক্যালিয়ন গভীর দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকাল। যেন তার ভিতরের সবটুকু অনুভূতি সেই দৃষ্টির ভেতর ডুবে আছে। ধীরে ধীরে বলল—
—“কেন ভালোবাসি তা জানি না। তবে এটুকু জানি, তুমি আমার বহু সাধনার পরে পাওয়া ভালোবাসা। তুমি জানো না তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কতটা কষ্ট করেছি। আমি তোমাকে আর কখনো হারাতে চাই না। তুমি আমার কাছে অমূল্য… এতটাই অমূল্য যে তোমার সামান্য কষ্টও আমি সহ্য করতে পারি না। তাই রান্নাবান্নার কথা একেবারেই ভুলো। তোমার হাতে আঁচড় লাগুক, কিংবা চুলার পাশে সামান্যও কষ্ট হোক—সেটা আমি মানতে পারব না।”
তার এই গভীর কথাগুলো শুনে মেয়েটির চোখ ভিজে উঠল। জল জমে চিকচিক করতে লাগল। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না—আলতো করে ক্যালিয়নের বুকের কাছে মাথা রাখল, তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
মৃদু কণ্ঠে বলল—
—“আমি অনেক ভাগ্যবতী… যে তোমার মতো একজন স্বামী পেয়েছি। যে আমাকে এতটা ভালোবাসে, এতটা আগলে রাখে।”
সেই মুহূর্তে কটেজের ভেতর যেন সময় থেমে গেল। জানালার বাইরে পাখিদের গান, দূরের ঝর্ণার শব্দ, আর ভেতরে দুজনের হৃদয়ের মিলন—সব মিলিয়ে যেন জঙ্গলের বুকের মাঝে সৃষ্টি হলো এক অনন্ত ভালোবাসার কবিতা।

নিজের কক্ষে, বারান্দার কিনারে দাঁড়িয়ে আছে ইসাবেলা। দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ দৃষ্টি বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চোখের পানি পড়ার কারণে। তার বুকের ভেতর যেন এক অদৃশ্য শূন্যতা, এক অসহ্য যন্ত্রণা জমে আছে।
মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় ড্যানিয়েলের বলা কথাগুলো। হৃদয়টা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ড্যানিয়েল কি সত্যিই তাকে ভালোবাসে না? শুধু প্রতিশোধ নেবার জন্যই কি তার জীবনে এসেছিল? তার ভাইয়ের ওপর প্রতিশোধ নেবার অন্ধ ইচ্ছের কাছে ইসাবেলার ভালোবাসা—শুধু কি এক মিথ্যে নাটক?
ভাবতেই ইসাবেলার কলিজা ফেটে যেতে থাকে। বুকের গভীরে জমে ওঠা ভালোবাসা, বিশ্বাস আর স্বপ্ন মুহূর্তেই ধুলোয় মিশে যায়। নীরবে অশ্রু ঝরে তার চোখ থেকে—যেন প্রতিটি ফোঁটা কান্না দগ্ধ করছে তার আত্মাকে।

সেই তখন এসেছে ডেকে নিয়ে গেল একটা প্রহরী তারপর একবারও ইসাবেলার সঙ্গে বসে কথা বলার সুযোগ হয়নি ড্যানিয়েলের। কাজের চাপ যেন পাহাড়সম ভর করে আছে তার কাঁধে। ক্যালিয়ন রাজ্যে নেই, তাই পুরো দায়িত্ব এখন ড্যানিয়েলের উপর। রাজ্যের প্রতিটি বোঝা যেন একাই বয়ে বেড়াচ্ছে সে।
কাজের ব্যস্ততায় ইসাবেলাকে আর আগের মতো সময় দেওয়া হয় না, সেভাবে খেয়াল রাখতেও পারছে না।
ধীরে ধীরে রুমে ঢুকে ড্যানিয়েল দেখতে পায়—বারান্দার কিনারে দাঁড়িয়ে আছে ইসাবেলা। নিঃশব্দ, একাকী। তার ক্লান্ত চোখে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট। ড্যানিয়েল নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে বলে ওঠে—

— “সরি, জান… আমি জানি আগের মতো তোমাকে সময় দিতে পারি না। কাজের চাপ অনেক বেশি। কিন্তু কথা দিচ্ছি, এরপর থেকে শুধু তোমাকেই সময় দেবো।”
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ইসাবেলা ড্যানিয়েলকে ধাক্কা মেরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিল।
এমন আচরণে ড্যানিয়েল স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো ভেবেছিল—ইসাবেলা কেবল রাগ করেছে। তাই আবারও এগিয়ে গিয়ে তাকে কাছে টানার চেষ্টা করতেই—
হঠাৎ ইসাবেলা হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে,
— “দূরে থাকুন আমার থেকে! আমাকে ছুবেন না… আপনি এক জঘন্য পুরুষ! আপনার ছোঁয়া এখন আমি ঘৃণা করি।”
অভিভূত হয়ে ড্যানিয়েল স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলতে চাইলে ইসাবেলা হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। চোখ ভরে অশ্রু আর কণ্ঠ ভেঙে যায় যন্ত্রণায়—

— “কিসের জন্য এনেছিলেন আমাকে এখানে? আপনার ভোগের সামগ্রী বানাতে? লর্ড ক্যালিয়নের কথায় আপনি আমাকে তুলে এনেছিলেন! আপনি আমায় কখনোই ভালোবাসেননি। কেন করলেন আমার সাথে এমন নির্মম নাটক? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছিলাম? আমার ভাই বা আপনাদের কী ক্ষতি করেছিল, যার প্রতিশোধ নিতে আপনি আমার জীবন নিয়ে খেললেন?”
ইসাবেলার বুক কাঁপতে থাকে, গলায় তীব্র বেদনার ঝড়—
— “আর এই কারণেই তো বিয়ের পরও আপনি একবারের জন্যও আমায় স্পর্শ করেননি!”
ড্যানিয়েল নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে—তার চোখে বিস্ময়, মনে এক অদ্ভুত তোলপাড়। আর ইসাবেলার চোখ ভিজে থাকে বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণায়।

ড্যানিয়েল স্তব্ধ হয়ে ভাবতে থাকে—ইসাবেলা সত্যিটা কীভাবে জেনে গেল!
এতদিন সে ইচ্ছে করেও তার কাছে যায়নি। কারণ বুকের ভেতর লুকানো ছিল এক গভীর অনুশোচনা। সে ভেবেছিল, একদিন নিজেই সব সত্যিটা বলে দেবে ইসাবেলাকে, তারপর তাকে নতুন করে জড়িয়ে ধরবে।
কিন্তু ভয় ছিল—যদি ইসাবেলা ভুল বোঝে, যদি সবকিছু ভেঙে তাকে ছেড়ে চলে যায়? তাই মুখ খুলতে পারেনি কখনো।
কিন্তু আজ—ইসাবেলা যখন সব জেনে ফেলেছে, তখন আর নীরব থেকে লাভ নেই। ড্যানিয়েল এগিয়ে আসে তাকে বোঝাতে।
কিন্তু ইসাবেলা তীব্র হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে—

— “আর এক পা আমার কাছে আসবেন না! আমি আপনাকে ঘৃণা করি, ড্যানিয়েল! হ্যাঁ, সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি আপনাকেই। আমি আপনার কাছ থেকে ডিভোর্স চাই… মুক্তি চাই। আমাকে যেতে দিন আপনার এই অভিশপ্ত জীবন থেকে।”
‘ডিভোর্স’ শব্দটা যেন বজ্রাঘাত হয়ে আছড়ে পড়ে ড্যানিয়েলের হৃদয়ে।
রাগে তার শরীর থরথর কাঁপতে থাকে। হঠাৎই সে পাশের দেয়ালে এক ঘুষি মারে। শক্ত দেয়াল ফেটে যায় তার আঘাতে। পাশে থাকা চেয়ারটা তুলে মাটিতে আছড়ে ভেঙে ফেলে মুহূর্তেই।
রক্তাভ চোখে ড্যানিয়েল এগিয়ে গিয়ে ইসাবেলার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে। কণ্ঠে বজ্রধ্বনির মতো গর্জন—

— “তোর সাহস হলো কিভাবে আমার কাছে ডিভোর্স চাইবার? তুই চাস বা না চাস, তোকে আমার কাছেই থাকতে হবে। ঘৃণা কর, ভালোবাস যা খুশি কর… কিন্তু আমি তোকে কখনোই আমার কাছ থেকে দূরে যেতে দেব না। তুই আমার বউ। এটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখিস। ভুলেও ভাবিস না, তুই আমার থেকে আলাদা হতে পারবি।”
তার কণ্ঠ আরও গভীর হয়, ভয়ংকর শীতলতা মিশে—

— “প্রয়োজন হলে তোর কলিজা বের করে মেপে দেখবো কতটুকু সাহস হয়েছে আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা বলিস! কিন্তু জেনে রাখ—আমি বেঁচে থাকতে তুই কখনোই আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবি না।”
কথাটা বলে এক ঝটকা দিয়ে ইসাবেলাকে ছেড়ে দেয়।
দরজা ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায় ড্যানিয়েল।
আর ইসাবেলা ভেঙে পড়ে মেঝেতে। বুকের ভেতর জমে ওঠা যন্ত্রণা আর অশ্রুধারায় দম বন্ধ হয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার ভেতরের সবটুকু শক্তি।

পারস্য রাজ্যে নেমে এসেছে আরও এক গভীর শোকের ছায়া। রাজপ্রাসাদের আঙিনায় বাতাসও আজ যেন শোকভারী, নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু দীর্ঘশ্বাসের স্রোত ভেসে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে কোমায় থাকা ইশবাব। বহুদিন ধরে সে নিথর হয়ে শুয়ে ছিল—অসংখ্য চেষ্টা করেছে রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বৈদ্যরা, প্রতিদিন তার প্রাণে নতুন আশার আলো ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করেছে তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সমস্ত জ্ঞান ও দক্ষতা পরাজিত হলো নির্মম ভাগ্যের কাছে।
ইশবাব চলে গেল না ফেরার দেশে।

পুরো রাজ্যজুড়ে নেমে এলো এক অশ্রুময় নীরবতা। প্রতিটি মুখে শোকের রেখা, প্রতিটি হৃদয়ে ব্যথার ভার। কিন্তু ওয়াজফানের কাছে এই শোক যেন আরও ভয়ঙ্কর, আরও নিঃশব্দ ঝড়। তার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে যেন সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই—কঠোর দৃষ্টিতে, আগুনে জ্বলা চোখে সে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কে জানে, তার ভেতরে কী ঝড় বইছে, কী দগ্ধ হচ্ছে!
চারদিকে শোকের রীতি চলছে। সবাই ব্যস্ত ইশবাবের বিদায়ের শেষ কাজ নিয়ে।
জিনদের মৃত্যু মানুষদের মৃত্যুর মতো নয়—তাদের কবর দেওয়া হয় না। বরং মরার পর তাদের শরীর সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে রাখা হয় এক নির্দিষ্ট স্থানে। কারণ তারা মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে আলো-ছায়ার মিশেলে ছাই হয়ে মিলিয়ে যায় আকাশের বিশালতায়।
আজও তাই করা হলো। ইশবাবকে শেষ সম্মান দিয়ে রাখা হলো, যেন এক পবিত্র আত্মার অন্তিম যাত্রার জন্য সাজানো হলো মহৎ বিদায়পথ।

সবাই জানে, কয়েক ঘণ্টা পর তার অস্তিত্ব শুধু স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে, দেহ মিলিয়ে যাবে অনন্ত আকাশে।
ইশবাবের শেষ কার্য সমাপ্ত করে ওয়াজফান নিঃশব্দে ফিরে এলো নিজের প্রাসাদের নির্জন কক্ষে। দরজাটা ভেতর থেকে ধীরে টেনে বন্ধ করল সে। চারদিকে স্তব্ধতা, যেন শোকের ছায়া তাকে পিছু নিয়ে এসেছে।
নিজের পুরোনো দুলতে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসলো সে। চেয়ারটা আস্তে আস্তে দুলছে, অথচ তার মুখে নেই কোনো অভিব্যক্তি। এমন মুখ, যা দেখে বোঝার উপায় নেই তার অন্তরে কতটা ঝড়, কতটা দগ্ধ আগুন লুকিয়ে আছে। তার চোখদুটি—লাল, জ্বলন্ত, ভয়ংকর—যেন এখনো আগুনের শিখা ছড়াচ্ছে চারপাশে।
কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর, ধীরে ধীরে নিজের জামার সাইড থেকে একটুকরো ওড়না বের করল সে। সেই ওড়নাটা হাতে পেঁচিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিল, যেন খুঁজে পেতে চাইল এক হারানো ঘ্রাণ। কিন্তু কোথায়! সেই ঘ্রাণ তো শুধু তার লিটল মনস্টারের শরীরেই ছিল। এই শুকনো কাপড়ে তা নেই, নেই তার অস্তিত্বের স্পর্শ।
চোখ মেলে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে, দুলতে দুলতে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল—

“দেখো লাড্ডু, তুমিও চলে গেলে… আর ধীরে ধীরে সব কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। একে একে সবাই হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছুতেই তা নিয়ে ভাবি না। আমার তো পরোয়া শুধু তোমাকে নিয়ে ছিল। আমি তো মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য তোমাকে রেখে গিয়েছিলাম… অথচ তুমি সারা জীবনের জন্য আমার থেকে দূরে চলে গেলে। কেন করলে এটা? তুমি তো বলেছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে কেন দূরে গেলে?
জানো তো, সবাই বলে তুমি নাকি এই পৃথিবীতেই নেই। কিন্তু আমি জানি তুমি আছো। তাই তো এখনো আমার নিঃশ্বাস চলছে। তুমি যদি সত্যিই না থাকতে, তবে আমার নিঃশ্বাসটা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম—আমার নিঃশ্বাসটা তোমার সঙ্গেই থাকবে। হ্যাঁ, এখন দূরত্ব আছে, কিন্তু জানি তুমি আছো এই পৃথিবীর কোথাও। আর আমি তোমাকে ঠিকই খুঁজে বের করব। একদিন না একদিন, আবার তোমাকে ফিরিয়ে আনব নিজের কাছে।”

তারপর কিছুটা নীরব থেকে ভাঙা স্বরে ফিসফিস করে—
“আমি জানি, আমার ভুল হয়েছিল… তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যও আমার কাছ থেকে দূরে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি। হয়তো তবেই তুমি আজও আমার কাছেই থাকতে। কিন্তু আর একবার তোমাকে আমি খুঁজে পাই, তবে আর কখনো তোমাকে নিজের থেকে দূরে যেতে দেব না। প্রমিস করছি, আমার জান… আমার লিটল মনস্টার।”
ওয়াজফান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই ওড়নার দিকে। তার চোখে যেন একসাথে ভালোবাসা, ক্ষত আর ভয়ংকর হিংস্রতা ঘুরপাক খাচ্ছে।
ওড়নার সাদা কাপড়ে অদৃশ্য আগুনের প্রতিচ্ছবি, আর তার দৃষ্টির ভয়ংকর লাল আভা যেন পুরো কক্ষটাকেই কাঁপিয়ে তুলছে।
ওয়াজফান ওড়নাটাকে দেখতে থাকতেই তার মনে ভেসে ওঠে সেই দিনের সেই পুরনো অতীত…

অতীত…
সেদিন সারা রাত সে অর্ষাকে ছাড়েনি। তাদের মিলনের মুহূর্তে, যেন অর্ষা বেশি চিৎকার করতে না পারে, তার মুখে ওড়না দিয়ে রেখেছিল। কারণ এটি তার বাবার বাড়ি, কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিল—
“চিৎকার করো না, জান… এখানে কিন্তু মানুষ আছে, সবাই এসে পড়বে।”
ওড়নাটা তখনই তার মুখে সঠিকভাবে বসিয়ে দেয়। তারপর সারা রাত জুড়ে চলল তার আদর। আধাঘণ্টা পর পর অর্ষাকে জিরোতে দিল, এরপর আবার কাছে টেনে নিল। রাতের শেষে, যখন ভোর হলো, অর্ষা জ্ঞান হারানোর উপক্রমে থাকল। ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়াজফানের লাল বলটা আরও উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে লাগল।
এটি তখনই জ্বলার কথা যখন কোনো বিপদের আশঙ্কা থাকত। ওয়াজফান তার জিন জাতিকে নির্দেশ দিয়েছিল—কোনও বিপদ ছাড়া কেউ যেন তাকে ডাকে না। আর এ বার পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায়, তাকে বাধ্য হয়ে অর্ষাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে গিয়ে বলটা হাতে তুলে নেয়,
ঠিক তখনই ওপাশ থেকে আয়রাক বলল—

“বাদশাহ, রাজপ্রাসাদে অনেক বড় বিপদ হয়েছে। আপনি পারলে এক্ষুনি আসুন, কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও আসুন, অনুরোধ করছি।”
ওয়াজফান আর কোনো উপায় না পেয়ে বলল—
“আমি একটু পর আসছি।”
এরপর সে অর্ষার কাছে ফিরে গেল। দেখল ক্লান্ত শরীরটি বিছানায় নিথর হয়ে আছে, কিন্তু জ্ঞান এখনো আছে।
ওয়াজফান চাদরটি ধীরে ধীরে অর্ষার শরীরের চারপাশে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে লাগল। সেখানে সে অর্ষাকে সুন্দরভাবে গোসল করিয়ে দিল, নিজেই যত্নসহকারে তার প্রতিটি হাতের ছোঁয়া দিয়ে সবকিছু ঠিক করল। গোসল শেষে রুমে ফিরে এসে জামা পরিয়ে দিল। কিন্তু অর্ষা কিছুই বলল না; তার শরীরে আর শক্তি নেই, কথাটুকু বলার সামর্থ্যও অনুপস্থিত।

ওয়াজফান তাকে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও ওয়াশরুমে গেল। একবারেই গোসল করে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে ফিরে এলো। এরপর এসে অর্ষার সামনে বসল, মুখটি ঝুঁকে দিয়ে তার গলায় মুখ ডুবিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নিল। বিড়বিড় করে বলল—
“আমার লিটল লাড্ডু, আমি কিছুক্ষণের জন্য প্রাসাদে ফিরে যাচ্ছি। অনেক ইম্পরট্যান্ট। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছি না, এখন তুমি অসুস্থ, তবে আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। আমার জানের কাছে ততক্ষণ শুধু নিজের খেয়াল রাখবে।”
তারপর অর্ষার কপালে ছোট্ট করে চুমু দিল। অর্ষার চোখের দিকে তাকাতেই বোঝা গেল, সে যাওয়ার সম্মতি দিচ্ছে। ওয়াজফান কপালে আরেকটি ছোট চুমু দিয়ে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে হঠাৎ ফিরে তাকাল; মনে হলো তার বুকে কিছুটা চিনচিন ব্যথা বসেছে, যেন এটিই শেষ দেখা। কেমন করে এমন হলো, কেন হলো—এটি তার জানা নেই।

বর্তমান,,,
ওয়াজফান ওড়নাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বিড়বিড় করতে লাগল—
“আমি তো আমার কথা ঠিকই রেখেছিলাম, ফিরে… তো গিয়েছিলাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তোমার কাছে। কিন্তু… তোমাকে আর ফিরে পেলাম না। তুমি হারিয়ে গেলে, চিরতরে হারিয়ে গেলে… আমার কাছ থেকে। কেন হারিয়ে গেলে? আমার লিটল মনস্টার, তুমি নয়? তুমি আমার কথা রাখলে না কেন?
আমি তো বলে এসেছিলাম, নিজের খেয়াল রেখো। তাহলে কেন কয়েকটা ঘন্টা নিজের খেয়াল রাখতে পারলে না? কেন এভাবে লুকিয়ে আছো? আর কোথায় লুকিয়ে আছো? আমি তোমাকে খুঁজে বের করবো, যেখানেই তুমি থাকো না, কেন যে কোনো পরিস্থিতিতেই আমি আসব… ঠিকই তোমার কাছে।”

রান্নাঘরের ভেতরে ক্যালিয়ন আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে, ধীরে ধীরে কিছু একটা তৈরি করছে। চুলার তাপে বাতাসে ভেসে আসে গরম খাবারের সুগন্ধ। হঠাৎই তার পেছন থেকে এক জাদুকরী অনুভূতি—দুটো ছোট্ট হাত আস্তে আস্তে তার কোমরকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।
ক্যালিয়নের মুখে অপ্রকাশিত হাসি ফুটে উঠল। সে মুচকি হেসে ঘুরে দাঁড়াল, তারপর হাতগুলোকে ধরে সামনে টেনে নিয়ে কোমরে পেঁচিয়ে ধরল। এরপর হাতের মালিক কে ক্যাবিনেটের উপরে তুলে বসাল। চোখে আলো, ঠোঁটে হালকা হাসি, সে বলল

—কি হয়েছে, আমার রেড ওয়াইন? তুমি রান্নাঘরে কি করছো? তোমার কি কিছু দরকার?
মেয়েটি শুধু মাথা নাড়ল, মুখে বলল—
—“আমি তো তোমাকে দেখতে এসেছি। তুমি একা একা রান্না করছ, তাই এলাম তোমাকে সাহায্য করতে।”
ক্যালিয়ন ধীরে তার গালটা টেনে নিয়ে বলল—
—“কোন দরকার নেই আমাকে সাহায্য করার। আমি একাই করতে পারি। আমি তো আগেই বলেছি—আগুনের সামনে আসবে না। আগুনের তাপ তোমার গায়ে লাগলে সেটা আমি সহ্য করতে পারব না।”
মেয়েটি এবার সাহস জুগিয়ে ক্যালিয়নের জামার কলার ধরল, ঠোঁটের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এল। ঠিক তখনই ক্যালিয়ন নিজেকে সামলাতে পারল না, দ্রুত একটু সরে গেল।
মেয়েটির চোখে কিছুটা মন খারাপ ফুটে উঠল। সে আক্ষেপের স্বরে বলল—

—“আমরা তো স্বামী-স্ত্রী… কিন্তু তুমি কেন আমাকে ছুতে দাও না? যতবার আমি তোমার কাছে যেতে চাই, তুমি দূরে সরে যাও।”
ক্যালিয়ন এক মুহূর্ত থেমে তার দিকে তাকাল, তারপর শক্ত করে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল।
—“তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি চাই তুমি পুরোপুরি সুস্থ হও। তোমার কি ক্ষতি হয়েছে, আমি জানি। আমি চাই আমার রেড ওয়াইন পুরোপুরি সুস্থ হোক। তারপর আমি আবার তোমাকে নতুন করে বিয়ে করব, নিজের মতো আদরে ভরিয়ে নেব।”
মেয়েটি তার কথাগুলো শুনে কিছুটা লজ্জা পেল। ঠোঁট থেকে একটা ধ্যাত উচ্চারণ করে ক্যালিয়নের বুকে হাত দিয়ে আলতো করে মেরে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
ক্যালিয়ন পিছন থেকে মুচকি হাসল, তার যাওয়া দেখে। কিন্তু সেই হাসির সঙ্গে সঙ্গে চোখে ভেসে উঠল গভীর ভাবনা—মনের মধ্যে চলতে লাগল এই রহস্যময়, কোমল, আর গভীর ভালোবাসার খেলা।

ড্যানিয়েল তখন যে চলে গিয়েছিল। রাগে ফুঁসতে থাকা সত্ত্বেও আর একবারও রুমে আসেনি। কারণ সে জানত, রাগের মাথায় আবার সামনে এলে হয়তো ইসাবেলাকে আঘাত করবে—আর সেটা সে চায় না।
নিজেকে সামলাতে, ভেতরের আগুনকে শান্ত করতে সে সময় নিয়েছিল।
অনেকক্ষণ পর অবশেষে ধীরে ধীরে আবার রুমে প্রবেশ করে।
চোখে পড়ে—বিছানায় নিশ্চুপ শুয়ে আছে ইসাবেলা।
ড্যানিয়েল নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়েই দেখতে পায়, ঘুমিয়েও তার চোখ-মুখ লালচে—স্পষ্ট বোঝা যায় কতটা কেঁদেছে সে।

তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।
ধীরে ধীরে বসে পড়ে তার পাশে।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে দেয়, তারপর সযত্নে ইসাবেলাকে তুলে আনে নিজের কোলে।
বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে ওঠে—
“আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করো… কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই নই, ইসাবেলা।”
ইসাবেলা ঘুমের ঘোরেই নিঃশব্দে নিশ্বাস নিচ্ছে, আর ড্যানিয়েল নিঃশব্দে তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে
যেন তাকে হারানোর ভয়টা এখনই প্রাণহরণী হয়ে উঠেছে।
হঠাৎই ইসাবেলার ঘুম ভেঙে যায়।
চোখ খুলে সে বিস্ময়ে টের পায়—ড্যানিয়েল তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
মুহূর্তেই তার রাগে ফুঁসে ওঠে, সে সরে যেতে চায়।
কিন্তু ড্যানিয়েল আরও শক্ত করে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখে, যেন প্রাণভরে হারিয়ে ফেলতে না চাওয়া কোনো ধন।
মৃদু, কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে—

“এখানেই থাকো না কেন? কেন এমন চড়ুই পাখির মতো বারবার উড়াল দিতে চাইছো?
হ্যাঁ, আমি জানি আমি ভুল করেছি… প্রথমে লর্ড ক্যালিয়নের কথায় তোমাকে ভালোবেসেছিলাম—অন্তত ভান করেছিলাম।
কিন্তু ইসাবেলা… যখন সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম, তখন বুঝলাম, আমি আর এই অভিনয় চালাতে পারবো না।
সেই মুহূর্তেই ক্যালিয়নকে বলে দিয়েছিলাম—আমি নাটক করতে পারব না।
কারণ তুমি আর কেবল একটা নাম নও, তুমি আমার ইসাবেলা।
আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি… এত ভালোবাসি যে তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতেই পারি না।
প্লিজ, জান…

আমাকে ক্ষমা করে দাও।
আমি আর কখনো তোমার সাথে এরকম করব না।
প্লিজ, আমার ছোট্ট বাচ্চা, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
ড্যানিয়েলের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, বুকের ভেতর ধরা ইসাবেলার কাঁধে তার অশ্রু পড়ে যায়।
তবুও ইসাবেলা ধীরে ধীরে ড্যানিয়েলের আঁকড়ে ধরা হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
তারপর এক পা দূরে গিয়ে বসে পড়ে। চোখে ক্ষোভ আর কণ্ঠে বিষণ্নতার কাঁপন।
সে বলে ওঠে—
“আপনি হয়তো এখন আমায় ভালোবাসেন… কিন্তু আজীবন আমার এই আফসোসটা থেকে যাবে—
শুরুতে কেন আমায় ভালোবাসতে পারলেন না? কেন আমার সাথে অভিনয় করলেন?
আমি তো আপনাকে আমার সবটুকু দিয়ে প্রথম দিন থেকেই ভালোবেসেছি।
কিন্তু আপনি? আপনি তো শুরু করেছেন এক অভিনয় দিয়ে,
আপনার নকল মুখোশ দিয়ে।

আর সেই মুখোশধারী কাউকে আমি আর কখনো ভালোবাসতে পারব না।
আমার হৃদয়ে আর কখনো আপনাকে জায়গা দিতে পারব না।
আমি আপনার কাছে আর থাকতে চাই না।
হ্যাঁ, আপনি হয়তো জোর করে আমাকে আটকে রাখবেন,
কিন্তু বিশ্বাস করুন—একদিন না একদিন আমি ঠিকই আপনার কাছ থেকে দূরে চলে যাবো।”
কথাগুলো বলেই ইসাবেলা চুপ করে বসে থাকে, আর ড্যানিয়েলের বুকের ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে যায়।
ড্যানিয়েল আবারও রেগে ওঠে। চোখ দুটোতে আগুনের ঝলক, বুক ভরা দম যেন ফেটে যাচ্ছে।
তবে এবার আর ইসাবেলাকে আঘাত করে না—

শুধু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে—
“তুমি চাও বা না চাও, তোমাকে আমি জোর করেই এখানেই রাখবো।
পালানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।
কারণ তোমাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই।
নিজের জীবনের বিনিময়েও তোমাকে আমি আমার করে রাখবো।
তুমি আমারই থাকবে… আমার হয়েই, সারা জীবনের জন্য।”
কথাগুলো বলে ড্যানিয়েল ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
পিছনে রয়ে যায় নিঃশব্দ অশ্রু আর ইসাবেলার বুকফাটা হাহাকার।

অর্ষা মরে যাওয়ার পর থেকে ওয়াজফান যেন সমগ্র দুনিয়াকেই তার খোঁজে নিয়োজিত করে রেখেছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে একজন করে জ্বীনকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে, যাতে তারা অর্ষার সামান্যতম কোনো খোঁজ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়। তার মনে এখনো এক অসম্ভব বিশ্বাস—অর্ষা মরে নি সে কোথাও না কোথাও আছে।
ওয়াজফানে আদেশে আয়রাক—প্রতি সপ্তাহেই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। অর্ষার বিশ্ববিদ্যালয়, তার বন্ধুদের আসর, এমনকি যেখানে যেখানে সে পা রেখেছিল, প্রতিটি জায়গায় খোঁজ নেয় আয়রাক। যেন মৃত প্রিয়জনকে খুঁজে ফেরে মরিয়া এক বাদশার দূত।
আজও সেই দিন এসেছে। ওয়াজফান নিজের কণ্ঠকে স্থির রেখে আয়রাককে ডেকে বলল—
“তোমার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই দেরি না করে এখনই রওনা হও বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।”
আয়রাক বিনম্র মাথা নত করে সম্মতি জানাল এবং বেরিয়ে পড়ল তার যাত্রাপথে। হৃদয়ের গভীরে সে ফিসফিসিয়ে বলল—

“যদিও আমরা সবাই জানি রানি মারা গিয়েছেন, তবুও বাদশাহ তার মৃত্যুকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। আর তাই এই অন্তহীন খোঁজ, এই অবিরাম পাঠানো… যেন প্রতি সপ্তাহে আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে তিনি নিজেকে বোঝান, অর্ষা এখনো কোথাও বেঁচে আছেন। তার মনকে শান্ত করার জন্যেই এই নিরন্তর খোঁজ।”
রাজপ্রাসাদের বাতাসে যেন অদৃশ্য কষ্টের ছায়া ভাসতে লাগল। একদিকে বাস্তবতা, অন্যদিকে অবিশ্বাসের শেকল—ওয়াজফান এখন সেই শেকলে বন্দী।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছাল আয়রাক। প্রাসাদ থেকে বেরোনোর আগে থেকেই তার মনে ছিল—প্রথমেই অর্ষার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে, সেখান থেকেই খবর নেয়া শুরু করতে হবে।
কিন্তু সেখানে গিয়েই তার চোখে পড়ল এক পরিচিত দৃশ্য। দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা। সে হাসছে, বন্ধুদের সঙ্গে চঞ্চলতায় ভরা এক মুহূর্ত উপভোগ করছে। সেই হাসি যেন বাতাসে ঝংকার তোলে, আর আয়রাক স্থির দাঁড়িয়ে থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার মনে কোথাও যেন অদ্ভুত এক শীতলতা নেমে আসে—যেন এই হাসিটাই তার ক্লান্ত যাত্রার সমস্ত কষ্ট মুছে দিল।

প্রথমবার নয়, প্রতি সপ্তাহেই সে বাংলাদেশে আসে। ইয়ানার সঙ্গে তার কথা হয়, তবে তখন এই চঞ্চল মেয়েটি যেন হঠাৎই শান্ত, নীরব হয়ে যায়। অথচ আজ… আজ সে নিজের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাসে ভরে আছে। আয়রাক অনুভব করল—ইয়ানা আসলে এই চঞ্চল, এই প্রাণবন্ত রূপেই তার পছন্দের ।
কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে আসাটা তার কাছে ছিল কেবল বাদশাহর হুকুম পালন করার এক নিরস দায়িত্ব। কিন্তু এখন—এখানে আসার মধ্যে যেন অন্য এক আনন্দ মিশে গেছে। নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেও তার মনে থাকে শুধু অপেক্ষা, কবে আবার সে বাংলাদেশে আসবে, কবে আবার ইয়ানাকে দেখবে।
কিন্তু কেন? কেন এই অনুভূতি? আজও সে নিজেকে প্রশ্ন করে, উত্তর খুঁজে পায় না। শুধু জানে—যখনই ইয়ানার সামনে আসে, অস্থির মনটা এক আশ্চর্য শান্তিতে ভরে যায়।

আয়রাক তাই আজও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইয়ানার সেই চঞ্চল হাসির দিকে।
হঠাৎই যেন ইয়ানার চঞ্চলতা থেমে গেল। মুহূর্তেই তার চোখ এসে পড়ল আয়রাকের উপর। সে থমকে দাঁড়াল। ভেতরে ভেতরে মনে মনে বলতে শুরু করল—
“আয়রাক… এই জীন লোকটা! এর কি প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসতে হয়? একই জায়গায়, একই উদ্দেশ্যে! এর কি আর কোনো কাজ নেই? কাউকে বলতেও পারি না যে সে মানুষ নয়—সে একজন জীন। যদি বলে দিই আর সে পরে রেগে যায়, তখন যদি ক্রোধে আমার জানটাই নিয়ে নেয়? ভয়েই তাই কাউকে কিছু বলতে পারি না, শুধু মনে মনে বলি—এই বেটা ভংয়কর…”

তার ভাবনার ভেতরেই হঠাৎ আয়রাক এগিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে। স্থির অথচ গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—
“হ্যাই, কেমন আছেন আপনি?”
ইয়ানা হঠাৎই কিছুটা ভয় পেয়ে, আবার কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিল—
“হুম… ভালো আছি।”
আয়রাক আবারও শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ল—
“আচ্ছা, এই সপ্তাহে কি অর্ষার সাথে আপনার কোনো প্রকার যোগাযোগ হয়েছে?”
ইয়ানা মাথা নিচু করে ছোট্ট করে বলল—
“না।”
ইয়ানা কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল—

“যানিনা অর্ষার কি হয়েছে… আমি ওর সাথে প্রতিদিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করি, কিন্তু কোনো খোঁজই পাই না।”
(আসলে অর্ষার ভার্সিটির কেউই জানত না যে অর্ষা মারা গেছে।)
আয়রাক কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ইয়ানার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন গভীর কোথাও খুঁজে দেখতে চাইছে সত্যিই সে কিছু জানে কি না। এরপর একরকম নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলল—
“ঠিক আছে… তবে আমি আসছি।”
এরপর আয়রাক পা বাড়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
ইয়ানা পেছন থেকে বলে ওঠে,

আমার মনে হয় কি আপনি শুধু শুধুই প্রতি সপ্তাহে এই ভার্সিটিতে অর্ষার খোঁজে আসেন এখানে ওর কোন খোঁজ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না তো আর যদি খোঁজ পাওয়া যায় তবে আমি আপনাকে জানাবো। আপনি বরং এখন এই ভার্সিটিতে খোঁজা বাদ দিয়ে অর্ষা কে না হয় অন্য কোথাও খুঁজে দেখেন।
আয়রাক পেছন ঘুরেই ইয়ানার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,

Death or Alive part 32

আপনার কি মনে হয় আমি কি শুধু অর্ষার খোঁজ নেওয়া কাজটা কি শুধু এই ভার্সিটি অবধি বরাদ্দ রেখেছি।
কথাটা বলেই সে ধীরে পা বাড়িয়ে সরে গেল ভিড় থেকে। আর পেছনে দাঁড়িয়ে রইল ইয়ানা, এরকম অদ্ভুত কথার মানে যেন সে পুরোপুরি বুঝতে পারল না। তার বুকের ভেতরে তখনও ধুকপুক শব্দ বাজছিল অস্বস্তি আর ভয়ের।

Death or Alive part 34

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here