Death or Alive part 37
priyanka hawlader
ওয়াজফান তার বাহুতে নিথর অর্ষাকে নিয়ে রাজ্যে ফিরে আসে। তার চোখে তীব্র উদ্বেগের ছায়া, বুকের ভেতর অস্থির ঢেউ। সোনালি আলোয় ঝলমল করা রাজপ্রাসাদের কক্ষে যখন সে অর্ষাকে বিছানায় শোয়ায়, তখনো তার চোখ খুলে না। নিস্তব্ধ নিঃশ্বাসে কেবল মৃদু কম্পন, যেন দূর আকাশ থেকে ভেসে আসা ভাঙা সুর।
রাজ বৈদ্যকে দ্রুত ডাকা হলো।
অভিজ্ঞ সেই চিকিৎসক দীর্ঘক্ষণ অর্ষার পাশে বসে তার চোখ, কপাল, ঠোঁট, আর শ্বাস-প্রশ্বাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। মাঝে মাঝে হাত রেখে দেখলেন তার নাড়ি, কপালে ভাঁজ আরও ঘন হলো।
ওয়াজফান ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে ছিল। অবশেষে রাজ বৈদ্য উঠে দাঁড়াতেই সে উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিল—
— “বলুন! আমার লিটল মনস্টারের কী হয়েছে? সে সুস্থ হয়ে যাবে তো?
রাজ বৈদ্য কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। মনে হলো যেন তিনি শব্দ খুঁজছেন, যেসব শব্দে পুরো সত্য প্রকাশ করা যায়। অবশেষে গম্ভীর গলায় তিনি বললেন—
— “বাদশাহ… মহারানীর স্মৃতি থেকে অনেকটা অংশ মুছে দেওয়া হয়েছে। আর এই কাজটি করেছে নেকড়ে-রাজা ক্যালিয়ন।”
ওয়াজফানের বুক যেন ছিন্ন হয়ে গেল এই কথায়। রাজ বৈদ্য ধীরে ধীরে আরও বলতে লাগলেন—
— “সেদিন… যখন মহারানী পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান, তখন ক্যালিয়ন তাকে উদ্ধার করে সুস্থ করেছিল এটা তো এখন আমরা সবাই জানি । কিন্তু আঘাতের কারণে রানী কিছু সময়ের জন্য নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেই সুযোগেই ক্যালিয়ন এমন কোন জাদুর অপব্যবহার করেছে যার কারনে আপনার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতিই রানীর মাথায় বিকৃত করে দিয়েছে। আপনার অস্তিত্বকে তার মনে থেকে মুছে ফেলে সেখানে নিজের প্রতিচ্ছবি বসিয়েছে।”
ওয়াজফান স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। রাজ বৈদ্যের কণ্ঠে শোকার্ত ভার—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “এখন মহারানী যতবারই অতীতের সেই স্মৃতিগুলো মনে করতে যান, ততবারই তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্যালিয়নের মুখ। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে ক্যালিয়নকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। তবে—”
রাজ বৈদ্য থেমে গিয়ে গভীর দৃষ্টিতে ওয়াজফানের দিকে তাকালেন,
— “তবু মহারানীর অন্তরের গভীরে কোথাও আপনার ছায়া রয়ে গেছে। তিনি অচেতন মনে, মনের কোনো গোপন কোণে আপনাকেই নিজের বলে অনুভব করেন। তাই মাঝেমধ্যে আপনাকে চিনতে পারেন, আবার অচেনার মতো দূরে সরেও যায়।”
ওয়াজফানের বুক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। চোখে আগুনের মতো জ্বালা, অথচ ভেতরে ঢেউয়ের মতো ব্যথা। নিথর অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে সে ফিসফিস করে বলল—
— “আমার লিটল মনস্টার… তুই আমায় চিনিস না আজ… তবু তোর ভেতরে আমি আছি। আমি ফিরিয়ে আনব তোর প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি অনুভূতি… কোনো জাদু, কোনো বিশ্বাসঘাতকতাই আমাদের আলাদা রাখতে পারবে না।”
অন্ধকার কক্ষে নিস্তব্ধতা আরও গভীর হলো। বাইরে ঝড়ের শব্দ যেন ওয়াজফানের হৃদয়ের তোলপাড় প্রতিধ্বনি করছে।
এরপর ওয়াজফান কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। ঠান্ডা শীতল কণ্ঠে অবশেষে প্রশ্ন করল—
— “তবে এখন এর সমাধান কী? কিছুই কি করার নেই?”
রাজ বৈদ্য গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত দ্বিধা আর ভারী বেদনার ছাপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বললেন—
— “বাদশাহ, এ রোগের কোনো সরল সমাধান নেই। আপনি চাইলে নিজের জাদুশক্তি প্রয়োগ করে মহারানীর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু তাতে রয়েছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। মহারানীর মাথায় ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই ক্যালিয়নের জাদু তার স্মৃতির ভেতরে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। এখন যদি আবার জাদুশক্তি দিয়ে নতুন করে চাপ প্রয়োগ করা হয়… তবে মহারানীর প্রাণসংশয় হবে। তিনি আর বাঁচবেন না।”
ওয়াজফান নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। রাজ বৈদ্য থেমে গিয়ে আবার বললেন—
— “এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই কাটাতে হবে। হয়তো মহারানীর মনের কোনো অচেতন কোণে আপনি রয়ে গেছেন বলেই মাঝে মাঝে আপনাকে চিনতে পারবেন, আপনার কাছে আসতে চাইবেন। আবার কোনো কোনো সময়, যখন তার মনে ক্যালিয়নের প্রভাব তীব্র হয়ে উঠবে, তখন তিনি আপনাকে ক্যালিয়ন ভেবে আপনার কাছেই থাকতে চাইবেন… অথবা উল্টোটা ঘটতে পারে। যখন তার ক্যালিয়ন এর কথা খুব বেশি মনে পরবে তখন সে হয়তো আপনাকে ক্যালিয়ন হিসেবে মানতে না পেরে সত্যিকারের ক্যালিয়নের কাছে ছুটে যেতে পারেন।
তিনি এক মুহূর্ত থেমে গম্ভীর স্বরে যোগ করলেন—
— “দিনগুলো এভাবেই চলতে থাকবে। হয়তো কোনোদিন অলৌকিকভাবে তার স্মৃতি ফিরে আসবে… কিন্তু সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তার মনে আপনার প্রতি যে টান, যে ভালোবাসা আছে, সেটাই একমাত্র ভরসা। কখনো তিনি আপনাকে কাছে টেনে নেবেন, আবার কখনো হঠাৎ দূরে ঠেলে দেবেন। এ রোগের কোনো ওষুধ নেই, কোনো চিকিৎসাও নেই। এখন শুধু সময় আর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র ইচ্ছাই একমাত্র নির্ভরতা। তিনি চাইলে মহারানী সুস্থ হবেন, নয়তো এভাবেই থেকে যাবেন সারা জীবন।
বাক্যগুলো ওয়াজফানের বুকের ভেতর যেন শীতল ধারালো খঞ্জরের মতো বিঁধল। সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। জিজ্ঞেস করার মতো কিছু অবশিষ্টও ছিল না। রাজ বৈদ্য তার দায়িত্ব শেষ করেছেন—সমস্ত সত্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
গভীর নীরবতায় ঢেকে গেল ঘর। রাজ বৈদ্য সম্মান জানিয়ে মাথা নত করলেন, ধীরপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পেছনে রইল ওয়াজফান—অচেতন অর্ষার পাশে, স্থির দাঁড়িয়ে, দৃষ্টিতে অসীম শূন্যতা।
ওয়াজফান ধীর পায়ে এগিয়ে এলো অর্ষার শয্যার কাছে। যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপে শোনা যাচ্ছে হৃদয়ের স্পন্দন। চারদিক নিস্তব্ধ—দেয়ালের ঝোলানো প্রদীপগুলো নরম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, সেই আলো এসে পড়েছে অর্ষার ফ্যাকাশে মুখে। নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে শুধু শোনা যাচ্ছে তার শান্ত, ধীর শ্বাসের শব্দ।
ওয়াজফান বিছানার পাশে বসে পড়ল। দুই চোখ স্থির হয়ে রইল অর্ষার শান্ত মুখশ্রীর দিকে। কতবার সে এই মুখের দিকে তাকিয়েছে, তবু আজকের দৃশ্য আলাদা। অচেতন ঘুমের মধ্যে অর্ষার ঠোঁটে এক হালকা নিস্তব্ধতা, চোখের পাতায় লুকানো অজানা দ্বন্দ্ব।
ওয়াজফানের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। মনে পড়ল তাদের কাটানো মুহূর্তগুলো—হাসির ঝংকার, অভিমান, আর ভালোবাসার অগণিত ছায়া। অথচ আজ তার লিটল মনস্টার তাকে চিনতে পারছে না! তার সমস্ত স্মৃতি, সমস্ত ভালোবাসা কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে।
তবু আজ ওয়াজফানের চোখে নেই আগের সেই দাউদাউ আগুন। নেই সেই তীব্র ক্রোধ, যা তার চারপাশকে ছাই করে দিতে পারে। বরং আজ তার চোখে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত কোমলতা, এক অপরিসীম নরম আলো। মনে হচ্ছিল, যেন জিনের বাদশাহের দৃষ্টি থেকেও সমস্ত কঠোরতা গলে গিয়ে রয়ে গেছে কেবল এক গভীর মমতা।
তার চোখের সেই নরমতা শুধু অর্ষার জন্য।
শুধু তার লিটল মনস্টারের জন্য।
ওয়াজফান আলতো করে হাত বাড়িয়ে অর্ষার কপালের কাছে রাখতে চাইল, কিন্তু মাঝপথে থেমে গেল। ভেতরে ভয় জাগল—যদি সে স্পর্শে অর্ষা আবার ব্যথা পায়? যদি ঘুম ভেঙে গিয়ে তাকে অচেনা মনে করে ভয় পায়?
হাতটা ফিরিয়ে নিল ওয়াজফান।
কিন্তু চোখ ফিরল না এক মুহূর্তের জন্যও।
সে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল—একই সাথে ভাঙা, আবার দৃঢ়। তার বুকের গভীরে প্রতিজ্ঞা জন্ম নিল, “যেভাবেই হোক, আমি ফিরিয়ে আনব তোর প্রতিটি স্মৃতি। তুই আমায় চিনতে না পারলেও… আমি তোর পাশে থাকব। তুই যত দূরে চলে যাস,আমি তোকে ঘিরেই থাকব।”
কথাগুলো বলে ওয়াজফান যেন নিজের ভেতরে এক নিঃশব্দ ঝড়ের মধ্যে ডুবে গেল। বুকের ভেতর জমে থাকা অপরাধবোধ তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছিল। কিছুক্ষণ স্থির থেকে সে সাহস করে ধীরে ধীরে ভাঙা হাতদুটো অর্ষার মাথার কাছে এনে আলতো করে বুলিয়ে দিল। সেই স্পর্শে যেন তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল, অথচ মুখের চোয়াল হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠল।
চোখের কোণে আগুন, ঠোঁটে চাপা অভিমান—সে নিজেকেই অভিশাপ দিতে লাগল।
— “সব দোষ তোরই… স্টুপিড জিন বাদশা ওয়াজফান! তোর কী দরকার ছিল লিটল মনস্টারকে সেখানে ফেলে রেখে রাজ্যে চলে আসার? যদি সেদিন তুই না আসতিস… তবে তো এতো সবকিছু বদলাত না। এ অন্ধকার নামত না।”
তার বুক থেকে কর্কশ হাহাকার বেরোল।
— “সব দোষ তোরই! তোর জন্যই আজ আমার লিটল মনস্টার আমায় চিনতে পারছে না। এত বড় ভুল কী করে করলি তুই? যদি তুই সেই ভুলটা না করতি… তবে তোর লাড্ডু আজো তোর কাছেই থাকত। আমার বুকের ভেতর, আমার ছায়ায় নিরাপদ থাকত।”
প্রতিটি শব্দে কাঁপছিল ওয়াজফানের আত্মা।
— “শুধু তোর একটা ভুলের কারণে আজ তোকে এমন শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। তোর লিটল মনস্টার তোর হাত ছেড়ে অন্য কাউকে আপন ভাবছে… অন্য কারও কাছে যেতে চায়। এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে?”
হঠাৎ সে দাঁত চেপে ফিসফিস করে উঠল—
— “সব দোষ তোরই… shameless জিন বাদশা ওয়াজফান কায়স্থ! আমি নিজের এই ভুলের জন্য নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করব না… কোনোদিনও না।”
অর্ষার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর একসাথে জন্ম নিল অপরাধবোধ, ক্রোধ এর অসীম ঢেউ।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইসাবেলা। দূরের আকাশটা সাদা ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে ভিজে উঠছে, অথচ তার অন্তরে যেন এক অদৃশ্য অন্ধকারের ভার জমে আছে।
সে মনে মনে হিসাব মেলাতে থাকে—
কি থেকে কি হয়ে গেল তার জীবন!
একটা সময় ছিল, যখন ড্যানিয়েল তার কাছে মানে ছিল শান্তি, নিরাপত্তা, ভালোবাসা। সেই মানুষটার হাসিতে, স্পর্শে, প্রতিশ্রুতিতে সে খুঁজে পেয়েছিল নিজের পৃথিবী।
কিন্তু আজ!
আজ ড্যানিয়েল যেন আর সেই ড্যানিয়েল নেই। তার চোখে শুধু দখলদারিত্ব, তার স্পর্শে শুধু জোর আর পাগলামী।
ইসাবেলা বুক চেপে ধরে শ্বাস টানল।
সে পারছে না সব ভুলে যেতে। আবার পারছে না সব মেনে নিতেও।
ড্যানিয়েলকে সে ভালোবেসেছিল—
কিন্তু আজকের এই রূপ, এই উন্মাদ আসক্তি, এই ইউরোপীয় শাসকসুলভ ভালোবাসা…
না, এটা সে কখনো চায়নি।
তার চোখ ভিজে উঠল। বুকের ভেতর অস্বচ্ছ, অব্যাখ্যাত এক যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে লাগল।
— “ভালোবাসা কি তবে এমনই হয়? ভালোবাসা কি শুধু দখল…? নাকি আমারই ভুল ছিল…”
সে নিজের প্রতিচ্ছবি ভাঙা কাঁচের মতো ছড়িয়ে থাকতে দেখল মনে।
বারান্দার ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে, নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব আর যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল,
নিজের ভাবনার গভীরে হারিয়ে ছিল সে । হঠাৎ অনুভব করল, তার পেছন থেকে শক্ত এক আলিঙ্গন জড়িয়ে ধরেছে তাকে। শরীর কেঁপে উঠল মুহূর্তেই—সে বুঝে গেল এ স্পর্শ কার।
চমকে উঠে, রাগে ফেটে পড়ে সে ড্যানিয়েলের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে চিৎকার করে উঠল—
— “কতবার বলেছি আমাকে ছোঁবেন না! আপনার ছোঁয়া আমার ঘৃণা লাগে! কেন তবু বারবার আমাকে ছুঁয়ে দেন?”
ড্যানিয়েলের চোখ লাল হয়ে উঠল রাগে। দাঁত চেপে সে গর্জে উঠল—
— “তোকে কতবার বলেছি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করবি না! আমি তোর উপরে অধিকার রাখি… তুই পুরোটাই আমার!”
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেই ঝড়ো রাগ ভেঙে পড়ল এক অদ্ভুত দুর্বলতায়।
ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে ইসাবেলার পায়ের কাছে বসে পড়ল। নিজের মুখটা গুঁজে দিল তার কোমল পেটের কাছে।
তার কণ্ঠে ভাঙা সুর—
— “কেন এমন করছিস, জান? আমার বাচ্চা… আমি মানছি আমি ভুল করেছিলাম। আমি তো ক্ষমা চাইছি তোর কাছে, আবারো চাই। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি… আমাকে মাফ করে দে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।”
তার কণ্ঠে কান্নার আর্দ্রতা জমে উঠল।
— “আমার এই হৃদয়টা প্রতিদিন যন্ত্রণায় ছটফট করে তোর জন্য। তোকে এভাবে ব্যবহার করাটা আমার নিজের কাছেও অসহনীয় লাগে। আমি তো তোকে মাথায় করে রাখতে চাই… আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায় না? প্লিজ, জান… একটু ভালোবেসে থাক আমার সঙ্গে।”
ড্যানিয়েলের গলা যেন ভেঙে এল শেষ কথাগুলোয়। তার শক্ত অথচ ভঙ্গুর হাত ইসাবেলার কোমরের চারপাশে আঁকড়ে ধরল আরও জোরে, যেন ছেড়ে দিলে সে সত্যিই সব হারিয়ে ফেলবে।
ড্যানিয়েলের ভাঙা কণ্ঠের কথা শুনে ইসাবেলার চোখে হঠাৎ করেই জল ভরে ওঠে। তার বুকের ভেতর জমে থাকা কঠোরতা কিছুটা নরম হতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে সে হাত বাড়িয়ে দেয় ড্যানিয়েলের মাথার দিকে—স্পর্শ করতে চায়। কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে হাত থেমে যায় মাঝপথে।
মনে পড়ে যায় অতীতের সমস্ত যন্ত্রণা, ড্যানিয়েলের জোর করে নেওয়া রাতটা, তাকে ভালো না বেসে তার সঙ্গে নাটক করার মুহূর্তগুলো। সেই কষ্টের মুহূর্ত। চোখ বুজে শ্বাস চেপে ধরে সে আবার শক্ত হয়ে যায়।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ফিসফিস করে, প্রায় অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে—
— “ছাড়ুন… আমাকে।”
শব্দগুলো যেন ভেঙে পড়ে বাতাসে।
ড্যানিয়েল মাথা নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখ বেয়ে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এবার সে আর কোনো কথা বলে না।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। একবারও ইসাবেলার চোখের দিকে তাকায় না। ধীরে ধীরে ভারী পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রুমের ভেতর শুধু রয়ে যায় ইসাবেলার ভারী নিঃশ্বাস আর এক অদৃশ্য শূন্যতা, যা দুজনের মধ্যকার দূরত্বকে আরও গভীর করে তোলে।
রাত তখন গভীর। প্রাসাদের চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। দূরের প্রহরীদের টিমটিমে মশাল ছাড়া আর কোথাও কোনো আলো নেই। আকাশের বুক ভরা কালো মেঘ, মাঝেমধ্যে হালকা বাতাস এসে জানালার ফাঁক গলে ঢুকে যায়—সবকিছু যেন নিঃশ্বাস আটকে আছে।
অর্ষা এখনো ঘুমিয়ে আছে। রাজবৈদ্য তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গিয়েছিলেন, তাই কোনো শব্দ, কোনো আলোড়নেই তার চোখ খোলেনি। শান্ত, নিরুপদ্রব ঘুমের মধ্যে সে যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে ডুবে আছে।
তার পাশেই বসে আছে ওয়াজফান। একটুও নড়ছে না। যেন পাথরের মতো স্থির হয়ে শুধু তাকিয়ে আছে তার লিটল মনস্টারের মুখের দিকে। কতদিন পর আবার এভাবে সে অর্ষাকে কাছে পেয়েছে—তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সেই থেকে সে এক মুহূর্তও বিছানার ধারে থেকে সরে যায়নি।
তার চোখ বারবার ঘুরে ফিরছে অর্ষার শান্ত মুখশ্রীর দিকে। নিঃশ্বাসে ওঠানামা করা বুক, ঠোঁটের হালকা কম্পন, আর কপালের কোণে নিঃশব্দ প্রশান্তি—সবই যেন ওয়াজফানের কাছে এক অলৌকিক দৃশ্য।
সে মনে মনে ফিসফিস করে বলল—
“লিটল মনস্টার… কতদিন পর তোকে এভাবে দেখছি। কতদিন তোকে ছুঁতে পারিনি, তোকে অনুভব করতে পারিনি। আজ তুই আমার কাছে… আমার একদম কাছে।”
ওয়াজফান ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিল। তার ভেতরে জমে থাকা সমস্ত কষ্ট, সমস্ত ক্লান্তি যেন মুছে যাচ্ছে অর্ষার শরীরের পরিচিত ঘ্রাণে। এতদিনের নির্ঘুম রাত, অস্থির অপেক্ষা, যন্ত্রণায় কেটে যাওয়া সময়—সবকিছু মিলেমিশে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিল তার ভেতরে।
আলতো করে সে অর্ষার গায়ের কাছাকাছি ঝুঁকল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর ধীরে ধীরে তার মাথা
ঢুকিয়ে নিল অর্ষার জামার ভিতরে এরপর বুকের ওপর রাখল। উষ্ণতার সঙ্গে ভেসে এলো সেই চিরচেনা সুগন্ধ—যা একসময়ে তার পৃথিবী হয়ে উঠেছিল।
ওয়াজফান চোখ বন্ধ করল। সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল, অথচ ভেতরে শান্তির জোয়ার বইছিল।
আজ বহুদিন পর সে সত্যিকারের ক্লান্ত, অথচ সুখী।
সে ভাবল—
“আজ আমি আমার লাড্ডুকে পেয়েছি… আমার বুকের কাছে, আমার নিশ্বাসের ভেতর। আজ আমি ঘুমাবো… দীর্ঘ, শান্ত এক ঘুম।”
অর্ষার নিস্তব্ধ শরীরের ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে ধীরে ধীরে ওয়াজফানের চোখের পাতা নেমে এলো।
বুকের ভেতর অচেনা প্রশান্তি নিয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
ভোরের আলো তখন ধীরে ধীরে জানালার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করছে। সারা রাত অচেতন নিদ্রায় ঢাকা থাকা প্রাসাদ এবার জেগে উঠছে প্রহরীদের হাঁকডাক আর পাখিদের কণ্ঠে।
ওয়াজফান তখনও অর্ষার পাশেই। তার বুকের ওপর মাথা রেখে রাতভর ঘুমিয়েছিল সে। দীর্ঘদিনের নির্ঘুম ক্লান্তি যেন কিছুটা লাঘব হয়েছিল, কিন্তু মনের অস্থিরতা এক মুহূর্তের জন্যও ঘুচেনি।
হঠাৎই অর্ষার দেহে হালকা নড়াচড়া অনুভব করল ওয়াজফান। সেই মুহূর্তেই তার ঘুম ভেঙে গেল। বুকের ভেতর দম আটকে এল যেন। চোখ মেলে দেখল—অর্ষা অচেতন দেহে একটু সরে উঠেছে।
এক নিঃশ্বাসে রক্ত যেন জমাট বেঁধে গেল ওয়াজফানের শরীরে। ধীরে ধীরে সে উঠে বসল, অর্ষার বুক থেকে মাথা সরিয়ে নিল। দু’চোখ স্থির হয়ে গেল অর্ষার মুখে।
তার ঠোঁট কেঁপে উঠল নিঃশব্দে—
“এবার… সে জেগে উঠবে?”
এক অদ্ভুত ভয়ের ছায়া ছড়িয়ে পড়ল ওয়াজফানের চেহারায়। এত বড় শক্তিশালী জিন বাদশাহ হয়েও আজ সে যেন এক অসহায় শিশুর মতো কাঁপছে।
মনের গভীরে প্রতিটি ভাবনা একে একে আঘাত হানতে লাগল—
“সে কি আমাকে চিনবে?
না কি আগের মতোই ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলবে—
‘আমি তোমাকে চিনি না… দূরে যাও!’
সে কি আমার বুকের ভেতর ফিরে আসবে?
না কি আবার পাগলামি করে ক্যালিয়নের নাম ধরে ডেকে উঠবে?
আবারও কি তার ঠোঁট থেকে শুনব সেই অভিশপ্ত নাম—ক্যালিয়ন… ক্যালিয়ন?”
ওয়াজফানের পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়াল। নিঃশ্বাস আটকে রইল তার বুকের ভেতর। অর্ষার চোখের পাতা কেঁপে উঠছে—এটাই হয়তো সেই মুহূর্ত, যেটি তার সমস্ত ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
সেই ক্ষণে, প্রাসাদের দেয়াল, আকাশ, বাতাস—সবকিছু যেন নীরব হয়ে গেল।
ওয়াজফানের মনে হলো, এই একটি মুহূর্তেই তার জীবন ভেঙে পড়তে পারে… অথবা নতুন করে গড়ে উঠতে পারে।
ধীরে ধীরে অর্ষার চোখের পাতা কাঁপতে কাঁপতে খুলে গেল। নিস্তেজ দৃষ্টিতে ও প্রথমে ছাদের দিকে তাকালো, তারপর ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঘুরে এল ওয়াজফানের মুখে। ক্ষীণ এক মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। পরক্ষণেই দুর্বল দু’হাত বাড়িয়ে ওয়াজফানের গলায় জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল—
— “কি হয়েছে? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার কি রূপ এত বেড়ে গেছে নাকি…?”
ওয়াজফান তখনও ভয়ে কাঁপছিল। এতক্ষণ ধরে সে শুধু ভাবছিল— অর্ষা আর তাকে চিনবে তো? নাকি দূরে ঠেলে দেবে? কিন্তু এই মৃদু বাক্যগুলো তার বুকের গভীরে শান্তির ঢেউ বয়ে আনল। যেন তার লিটল মনস্টার আবার তাকে চিনে ফেলেছে, তাকে আর হারাবে না।
কিন্তু সেই শান্তি স্থায়ী হলো না। মুহূর্তের ভেতরেই অর্ষার কণ্ঠস্বর আবার কেঁপে উঠলো, এবার অন্য সুরে—
— “কি হয়েছে ক্যালিওন? কথা বলছেন না কেন আমার সাথে? চুপচাপ কি শুধু তাকিয়ে থাকবেন…?”
ওয়াজফানের বুক হঠাৎ করে ভারী হয়ে গেল। তার সমস্ত আশা, সমস্ত স্বস্তি যেন ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে। অর্ষা… তাকে নয়, ক্যালিওনকে খুঁজছে।
ওয়াজফানের ভেতরটা যেন মুহূর্তেই এক অচেনা ঝড়ে ভেঙে পড়ল। অর্ষার বলা প্রতিটি শব্দ তার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধছিল। মনে হচ্ছিল বুকের হাড়গুলো একে একে ভেঙে যাচ্ছে, পাঁজরগুলো চূর্ণ হয়ে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তার যে অর্ষা—যাকে সে ছায়ার মতো নিজের আঙুলের ডগায় ধরে রেখেছিল, যার চারপাশে একটা দেয়াল টেনে রেখেছিল যাতে অন্য কোনো পুরুষের ছায়াও না পড়ে—সেই অর্ষাই আজ তাকে চিনতে পারছে না। তার চোখে ওয়াজফান নয়, অন্য পুরুষ। আর তার ঠোঁটে উচ্চারিত হচ্ছে সেই অভিশপ্ত নাম—ক্যালিয়ন।
এ যন্ত্রণা কোনো তলোয়ারের আঘাতের চেয়েও গভীর। এ কষ্ট কোনো মৃত্যুর শাস্তির চেয়েও ভয়ংকর। কারণ, যাকে সে নিজের সমস্ত পৃথিবীর কেন্দ্র ভেবেছিল, যার জন্য বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেয়েছিল, সেই আজ তাকে অস্বীকার করছে।
ওয়াজফান তো এমন একজন, যে তুচ্ছ বিষয়েও রাগে পৃথিবী পুড়িয়ে দিতে পারে। সামান্য ভুল, সামান্য অবাধ্যতা—সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারে। অথচ আজ! আজ অর্ষার মুখ থেকে অন্য পুরুষের নাম শুনেও সে শান্ত, ভীষণ শান্ত। কারণ সে জানে, এটা অর্ষার ইচ্ছা নয়। এটা তার অসুস্থতা, তার মন-জুড়ে ক্যালিয়নের অশুভ ছায়ার অভিশাপ।
ভেতরে ভেতরে তার রাগ, তার ঝড়, তার অগ্নি—সবকিছু গিলে নিচ্ছে সে নিজেই। নিজের বুক ছিঁড়ে যাওয়া যন্ত্রণা চেপে রেখে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে অর্ষার চুলে আঙুল বুলিয়ে দেয়। ঠোঁটে একফোঁটা কাঁপা হাসি ফুটে ওঠে, অথচ চোখে জমে থাকে দমিয়ে রাখা কষ্ট ।
সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল—
“না, আমি হাল ছাড়ব না। আমার লিটল মনস্টারকে আমি আবারও ফিরে পাব। তাকে সুস্থ করব। সে আবার আমাকে চিনবে, আমাকে ডাকবে… শুধু আমায়… শুধু তার কায়াস্থ সাহেব কে।”
তার বুক ভরা ঝড়, তার সমস্ত পাগলামি আর দমিয়ে রাখা হাহাকারকে চাপা দিয়ে সে ধৈর্যের এক প্রতিমূর্তি হয়ে বসে রইল অর্ষার পাশে। কারণ তার কাছে এখন সবচেয়ে জরুরি—নিজের পাঁজর টাকে সুস্থ করা, তাকে আবার নিজের করে পাওয়া।
এভাবেই কেটে গেল কিছুদিন,,,
দিনগুলো যেন থেমে গিয়েছিল। প্রতিটি ভোর ওয়াজফানের কাছে হয়ে উঠেছিল একেকটা দুঃস্বপ্নের শুরু, আর প্রতিটি রাত ছিল যন্ত্রণার একেকটা সমাপ্তি। সময় তার কাছে যেন আর সময় নয়, যেন অনন্ত কষ্টের শৃঙ্খল।
কখনো অর্ষা হঠাৎ তাকে চিনে নিয়েছে, বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠে সেই পুরনো ডাক—কায়াস্থ সাহেব । সেই মুহূর্তে মনে হয়েছে তার সমস্ত পৃথিবী আবার রঙে ভরে গেছে, তার লিটল মনস্টার ফিরে এসেছে। কিন্তু আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্ষা যেন কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া মন নিয়ে অন্য নাম ডাকে—ক্যালিয়ন! তার চোখে জ্বলজ্বলে বিশ্বাস, যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে-ই তার স্বামী।
আরও কঠিন ছিল সেই মুহূর্তগুলো, যখন অর্ষা কান্নাকাটি করত। বারবার ওয়াজফানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলত—আমায় ক্যালিয়নের কাছে নিয়ে চল, আমি তাকে ছাড়া বাঁচব না!
ওয়াজফানের বুকের ভেতর তখন ছিঁড়ে যাওয়া যন্ত্রণা রক্তের মতো ঝরতে থাকত। যেন তার হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছে।
তবুও সে কিছু বলেনি।
কিছু ভাঙেনি।
কিছু ধ্বংস করেনি।
যে ওয়াজফান সামান্য কারণে পৃথিবী জ্বালিয়ে দিতে পারত, সে আজ নিজেকে আগুন থেকে সরিয়ে রেখে এক অদ্ভুত শান্তির আবরণে ঢেকে ফেলেছে। কারণ সে জানে, অর্ষা এটা করছে না নিজের ইচ্ছায়। এটা তার অসুস্থতা, তার স্মৃতির ওপর ক্যালিয়নের নির্মম জাদুর ছায়া।
তাই নিজের ভেতরের সমস্ত ঝড়, সমস্ত রাগ, সমস্ত দমবন্ধ করা যন্ত্রণা চাপা দিয়ে ওয়াজফান শুধু তাকিয়ে থেকেছে অর্ষার দিকে। কখনো ভোরের আলোয়, কখনো রাতের অন্ধকারে।
সে নিজেকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দিয়েছে—
“সব সহ্য করবি, ওয়াজফান। শুধু তোর লিটল মনস্টার আবার তোর কাছে ফিরে আসবে বলেই সহ্য করবি।”
বুকের গভীরে জমে থাকা কষ্ট, ছিন্নভিন্ন হৃদয়ের আর্তনাদ—সব চাপা দিয়ে সে সহ্য করে গেছে।
কারণ তার কাছে পৃথিবীর একমাত্র সত্য ছিল—
অর্ষা।
তার ছোট্ট লাড্ডু।
অন্যদিকে…
ইসাবেলা আর ড্যানিয়েলের মধ্যে এখন আর কোনো স্বাভাবিক কথা হয় না। ড্যানিয়েলও আর আগের মতো তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে না। যেন নীরবতাকেই মেনে নিয়েছে দুজনের মধ্যে।
তবুও, নিজের মতো করে ইসাবেলাকে থাকতে দেয় সে।
কিন্তু যতটুকু পারে, যত্নে আগলে রাখে—কোনো খামতি রাখে না সেই দিক থেকে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, যেন এক অনড় প্রহরী সবসময় তার ছায়ার মতো ঘিরে আছে ইসাবেলাকে।
কিন্তু রাত নামলেই…
ইসাবেলার অসহায়তার সীমা ভেঙে যায়। যতই চেষ্টায় ড্যানিয়েলকে ঠেকাতে, ঠেলে দূরে সরাতে—তবুও সে পারে না। ড্যানিয়েলের জেদের কাছে তার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।
রাতের অন্ধকারে জোর করে তাকে নিজের করে নেয় ড্যানিয়েল।
ইসাবেলার চোখ ভিজে যায় ঘৃণা আর অসহায়তায়, অথচ ড্যানিয়েলের চোখে তখন ভেসে ওঠে শুধুই উন্মত্ত ভালোবাসা আর একধরনের দখলদারিত্ব।
এভাবে চলতে চলতে সময় কেটে যায়—
কিন্তু তাদের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উন্নতি হয় না।
ভালোবাসার বদলে জমে থাকে দূরত্ব, আর দূরত্বের ভেতরে বোনা হয় অভিমান আর যন্ত্রণা।
সকালের প্রথম আলোয়ও যেন আনন্দ নেই আজ।
পুরো পারস্য রাজ্য জুড়ে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। চারদিক থেকে ভেসে আসছে হাহাকার আর কান্নার শব্দ, যা বাতাসকে আরও ভারী করে তুলছে।
রাজপ্রাসাদের দেয়ালগুলো যেন প্রতিটি কান্নার সুরকে প্রতিধ্বনি করে আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে, আর তাতে পরিবেশ হয়ে উঠছে আরও নিস্তব্ধ ও বিষণ্ণ।
অন্ধকার রাজ্যে আজ শোক যেন এক অদ্ভুত অন্ধকারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে—
যেখানে সামান্য আলো থাকলেও কেবলই মনে হয় চারদিকে আঁধার।
জ্যাইমের মৃতদেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে মাটির বুকে।
চারপাশে যেন অদৃশ্যভাবে বসে আছে রাজ্যের জিনেরা—
তাদের কান্না, হাহাকার, আর্তনাদে পুরো পরিবেশ ভরে উঠেছে।
মনে হচ্ছে তারা সবাই মিলে তার আত্মাকে ঘিরে শোক পালন করছে।
তার মৃত্যুর খবরেই চারপাশ যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
এই মৃত্যুসংবাদ বাতাসকেও করেছে ভারী,
যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে কেবল বেদনার দীর্ঘশ্বাস।
মানুষের বুকফাটা কান্না, অস্থির হাহাকার
চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে পরিবেশকে আরও শোকে আচ্ছন্ন করেছে।
আর এই মৃত্যুর খবর যখন পৌঁছালো ওয়াজফানের কানে,
তখন তার বুকের ভেতরটা যেন তীব্র ঢেউয়ে ভেঙে পড়লো।
এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট না করে ছুটে এলো সে জ্যাইমের মৃতদেহের সামনে।
দেখলো—শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে আছে জ্যাইম।
মুখে এমন প্রশান্তির ছাপ, যেন মৃত্যু নয়, কোনো অদ্ভুত শান্তির নিদ্রা।
কিন্তু সেই শান্তি ওয়াজফানের অন্তরকে অস্থির করে তুললো আরও।
ভাইয়ের এমন শান্ত মুখ দেখে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো
তাদের একসাথে কাটানো দুষ্টু-মিষ্টি মুহূর্তগুলো।
মনে পড়লো—
কীভাবে ছোট্ট জ্যাইম তার চারপাশে দৌড়াতো,
হাসি-ঠাট্টায় ভরিয়ে রাখতো প্রতিটি প্রহর।
কখনো আবার এতটাই সতর্ক হয়ে উঠতো যে
ওয়াজফানকে সামলে রাখা যেন তার একমাত্র দায়িত্ব।
একটা দুষ্টু মায়াবী ছায়ার মতো সে সবসময় ভাইয়ের সঙ্গেই থাকতো।
ওয়াজফানের বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো স্মৃতির ভারে—
এটাই তো তার সবচেয়ে আপনজন ছিল,
যাকে ছাড়া এক মুহূর্তও সে ভাবতে পারতো না।
তার ছোট্ট পাগল ভাই,
যার হাসি ছিল পুরো রাজ্যের প্রাণ।
তবু আজ কেন? কেন হঠাৎ করে সব ছেড়ে চলে গেল সে?
কেন এমন নিষ্ঠুর পথ বেছে নিল,
যেখানে থেকে ফেরা অসম্ভব?
ওয়াজফানের মনে পড়লো,
ছোট বেলায় যখন জ্যাইমের আঙুলে সামান্য কেটে যেত,
তখন পুরো রাজ্যকে শাস্তি পেতে হতো তার কারণে।
যখন সে ব্যথায় কেঁদে উঠতো,
তখন সূর্য পর্যন্ত যেন আলো দিতে ভয় পেত।
কিন্তু আজ? আজ তো সে নিজেই নিজের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
তাহলে এর শাস্তি কাকে দেবে ওয়াজফান?
কাকে সে অভিযুক্ত করবে?
ভাগ্যকে? নাকি নির্মম পৃথিবীকে?
কোনো উত্তর নেই, শুধু বুকফাটা এক অতভূত প্রতিধ্বনি—
যা ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রাসাদের প্রতিটি দেয়াল।
নিঃশব্দ ভোরের অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে,
আর ওয়াজফান দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়ের নিথর দেহের সামনে,
ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে ।
এরপর,,
ওয়াজফান ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে—
জ্যাইমের নিথর দেহের সামনে।
তার বুকের ভেতরটা যেন হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে গেল,
যেন কোনো গভীর গহ্বরে একা পড়ে গেছে সে।
চোখ দুটি স্থির, নিস্তব্ধ, শূন্যতায় ভরা।
তবে চোখে একফোঁটা অশ্রর ছিটে ফোটে ও নেই।
কারণ সে জিনের বাদশা কান্না কাকে বলে সে কখনো শিখে নি সে কাঁদতে জানে না তার চোখে কখনো পানি আসেনি তাই হয়তো ভাইয়ের নিথর দেহের সামনেও তার চোখে এক ফোটাও পানি নেই তবে ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো ভাইয়ের শান্ত মুখ।
এই শান্ত নিদ্রা জ্যাইমের জীবনের শেষ ঘুম।
কোনো ঝড় নেই, কোনো শব্দ নেই, শুধু অদ্ভুত প্রশান্তি।
ওয়াজফান নির্বাক তাকিয়ে রইলো—
এই চেনা মুখের দিকে,
যে মুখ আজ থেকে আর কোনোদিনও তার সামনে জীবন্ত হয়ে ধরা দেবে না।
আজকের পর এটাই শেষ দেখা…
শেষ ছোঁয়া…
শেষ স্মৃতি।
নিজেকে সামলে নিতে নিতে ওয়াজফান ধীরে ধীরে
ভাইয়ের নিথর দেহকে কোলে তুলে নিলো।
যেন বুকের ভেতরে জমে থাকা প্রতিটি স্মৃতি আর ভালোবাসা
একসাথে মিশে গেছে সেই দেহের ভারে।
তারপর রাজ্যের প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী,
পবিত্র রিচ্যুয়ালের জায়গায় নিয়ে গিয়ে
সতর্কতার সাথে শুইয়ে দিলো ভাইকে।
চারদিকের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ অনুভূত হলো—
জ্যাইমের আত্মা যেন ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে আকাশের ওপারে।
মাটির বুকে নিথর দেহ পড়ে রইলো,
কিন্তু আকাশের অদৃশ্য দরজায় ডানা মেললো তার আত্মা।
সবকিছু শেষ করে, ভারী পায়ে ফিরে এলো ওয়াজফান জ্যাইম এর কক্ষে।
পা যেন প্রতিটি পদক্ষেপে জমে যাচ্ছে—
প্রতিটি ধাপে মৃত্যু আর শূন্যতার ছায়া।
চোখে ভেসে উঠছে শুধু একটিই ছবি—
তার ছোট ভাইয়ের শান্ত মুখ।
অন্যদিকে,
রাজপ্রাসাদের এক কোণে অর্ষা
নিঃশব্দে বসে আছে নিজের কক্ষে।
চারদিকের অচেনা পরিবেশ, অচেনা মানুষ,
অচেনা রাজ্য তাকে ঘিরে রেখেছে।
সে যেন ভেসে আছে এক অচেনা, আলাদা জগতে—
যেখানে কারও সাথে কোনো বন্ধন নেই,
শুধু নিঃসঙ্গতা আর ভয়ের ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
রাজ্য কাঁদছে এক মৃত্যুতে,
কিন্তু অর্ষা নিজের নিঃস্থবতার সাথে বসে থাকে।
এসব কিছুই যেন সে বুঝতে পারছে না।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করল।
চোখে ভেসে উঠল চারপাশ—রুমে ছড়িয়ে আছে সবকিছু।
যেনো জ্যাইম এর স্মৃতি প্রতিটি কোণায় ঘুরছে।
কিন্তু আজ আর নেই সেই জ্যাইম,
যার জন্য স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে ছিল।
আজ কেবল আছে জ্যাইম এর শেষ বিদ্যমানতা।
ওয়াজফান চারপাশটা তাকিয়ে দেখল।
চোখে পড়ল বিছানার উপর রাখা একটি কাগজ।
সিধির ভাঁজে রাখা সেই কাগজটি তুলে নিল সে।
মনে হলো—এটা তার ভাই রেখে যাওয়া শেষ চিঠি।
ধীরে ধীরে চিঠিটি খুলল, নিঃশব্দে পড়তে শুরু করল।
প্রিয় দা,
আমি জানি তুই যখন এই চিঠি পড়ছিস, তখন হয়ত আমি আর এই দুনিয়ায় নেই। আমি চলে যাচ্ছি নিষ্ঠুর এই জগত থেকে, শুধু রেখে যাচ্ছি নিজের স্মৃতি হিসেবে একখানা চিঠি। জানিস দা, আমি সত্যি মন থেকে ভালোবেসেছি এলিনাকে, কিন্তু দেখ নিয়তির নির্মম পরিহাস—আমি তাকে পেলাম না। আর ঠিক আমার মতোই, ও তোকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল। ভাগ্যের খেলা, ওকে জিততে দিল না; বরং হাড় হিসেবে উপহার করলো মৃত্যুর কাছে। তবে এই মৃত্যুর জন্য তুই কখনোই দায়ী নও, আমার কাছে তুই কোনো অপরাধী না।
যাক, ভাগ্য অন্তত একটি ভালোবাসার কাছে হাড় মানতেই হলো। তুই তোর ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েছিস, আমি তাতেই খুশি। থাক না হয়, থাকুক না দু’একটা ভালোবাসার অপূর্ণতা। আমি খুশি তুই অর্ষা কে পেয়েছিস, আর অর্ষা ও ভালো মানুষ, ও তোকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে। তবে আফসোস থেকে গেল আমার জীবনে—এরকম নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষটাকে আমি নিজের করে পেতে পারিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কাছে হার মানতে হলো আমাকে।
জানিস দা, আমি এতদিন বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছি, এলিনার রেখে যাওয়া চিঠিটা ছিল আমার শেষ আশ্রয়। তবে এই ভুবনহীন দুনিয়ায় আমি আর পারলাম না, নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। শেষমেশ আমাকে হার মানতে হলো নিয়তির নির্মম পরিহাসের কাছে। আমি এখন আর থাকতে পারছি না, আমার এলিনাকে ছাড়া। তাই আমি চিরতরে চলে যাচ্ছি আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছে।
চলে যাচ্ছি, তবে তোর জন্য আমার স্মৃতি হিসেবে রেখে যাচ্ছি এই চিঠিটাকে। ভালো থাকিস, তুই নিজের ভালোবাসার মানুষটির সাথে। আর আমি চলে গেলাম, আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছে। আর কোনদিনও দেখা হবে না আমাদের।
Death or Alive part 36
ইতি,
তোর সব থেকে আদরের,
তোর প্রিয় ছোট ভাই।
জ্যাইম.
ওয়াজফান যেন চিঠিটা পড়ে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বুকের ভেতর জমে ওঠে হাহাকার। হাত জোড়া করে কাপতে শুরু করে।
