Death or Alive part 41
priyanka hawlader
এক গভীর সন্ধ্যা। ওয়াজফান বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে হালকা শীতলতা, আর আকাশের গভীর নীলচে ছায়ার মধ্যে যেন সময়ও থমকে আছে। এক মাস কেটে গেছে—একটি দীর্ঘ মাস, যখন সে ভেবেছিল অর্ষার জ্ঞান কিছু মুহূর্তের মধ্যেই ফিরে আসবে। কিন্তু আজ, এক মাস পরেও তার চোখ বন্ধই রইল, নিঃশব্দতা ঘর জুড়ে ছেয়ে আছে।
সব রকম চিকিৎসক, বৈদ্য—সকলেই পরীক্ষা করে গেছেন। প্রত্যেকের মুখে একটাই বার্তা—অর্ষার ইন্টার্নাল ইনজুরি গভীর, তার শারীর ও মানসিক ভাবে দুটোই অতিরিক্ত চাপের শিকার। এই কারণেই তার জ্ঞান ফিরছে না।
তবুও, প্রত্যেকেই বলেছে, যে কোনো মুহূর্তেই সে চোখ খুলতে পারে।
ওয়াজফান নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দোষারোপের এক অদ্ভুত অগ্নিতে পুড়ে যাচ্ছিল। রাতের পর রাত জেগে সে অর্শার পাশে বসেছিল, হাত ধরে শূন্যে তাকিয়ে আছে। কতবার আহাজারি করেছিল, কতবার কণ্ঠে নামিয়ে ডাক দিয়েছিল—“লিটল মনস্টার , উঠো, বলো।” কিন্তু অর্ষার নিঃশ্বাস ছাড়া কিছুই ফিরে আসে নি।
এই নিস্তব্ধতার মধ্যে ওয়াজফানের মন যেন তার অনুশোচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন একটি চুম্বক হয়ে তাকে টানছে—প্রিয় মানুষটির জন্য, তার প্রিয় লিটল মনস্টার জন্য, যে এতদিনের স্থিরতা ভেঙে দিয়ে তাকে পরীক্ষা করে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এগুলো ভাবছে—প্রতিটি চিন্তা যেন তার হৃদয়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছিল, তার লিটল মনস্টার তাকে শাস্তি দিচ্ছে। সেই দিন, যখন সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, তখনকার অসাবধানতার দাম কি আজও পরছে? এক মাস ধরে এই নিস্তব্ধ শাস্তি চলেছে।
এই ছোট্ট মনস্টারটা এত জেদি কেন? শুরু থেকেই, প্রথম দিন থেকেই সে সাহস দেখিয়ে আসছে।সে জিনের বাদশা এই পৃথিবীতে কারো তার মুখের উপর কথা বলার সাহস পর্যন্ত নেই—কিন্তু এই ছোট্ট মনস্টার তার সামনে দাঁড়িয়ে, অবহেলা করে, কখনো চড় মারে, কখনো জেদ দেখায়।
ওয়াজফান বুঝতে পারছে—এই ছোট্ট মনস্টার তার দুর্বলতা টের পেয়েছে, আর তাই তার সঙ্গে খেলে যাচ্ছে। এই ছোট্ট মাস্টার যদি অন্য কেউ হত, হয়তো এতদিনে সে কবরের নিচে চলে যেত।
কিন্তু সব কথা ভাঙতে পারছে না। বুকে যেন একটি গভীর যন্ত্রণা জ্বলে—অদ্ভুত, ভারাক্রান্ত। সে ভাবছে, কখন তার লিটল মনস্টার চোখ খুলবে, কখন তাকে ডাকবে, কায়াস্থ সাহেব বলে।
প্রতিটি মুহূর্ত যেন দীর্ঘ নিরবতা, প্রতিটি নিঃশ্বাসে অশ্রু মিশে আছে, আর ওয়াজফানের হৃদয় এই দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্যে আরও গভীর হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে,
ইসাবেলা আর ড্যানিয়েলের সম্পর্ক আগের মতো আর নেই। ধীরেসুস্থে, নিঃশব্দে, তারা দুজনেই বদলে গেছে। ইসাবেলা এখন আর আগের মতো রেগে ওঠে না—মনের কোনো কোণে তার প্রতি বিরক্তি নেই। বদলে সেখানে একটি নরম আবেগ জন্মেছে, যেখানে ভালোবাসা নিঃসঙ্গভাবে জমে উঠেছে।
ড্যানিয়েলও তার নিজের দিকে নজর রেখেছে—সতর্ক, যত্নশীল, কিন্তু কখনও বেশি চাপ দেওয়া ছাড়া। তার কেয়ারনেস, তার চোখের মৃদু উষ্ণতা, এবং শব্দহীন যত্ন—সবকিছু ইসাবেলাকে বোঝাচ্ছে, সে কতটা ভালোবাসে।ইসাবেলা ভেবেছিল ড্যানিয়েল তাকে ভোগ করতেই বিয়ে করেছে কিন্তু বেবি পেটে আসার পর থেকে ড্যানিয়েল একবারো তাকে জোর করেনি।
সত্যিই ড্যানিয়েল তাকে ভালোবাসে ড্যানিয়াল সত্যিই একটা বেবি চেয়েছিল তাকে কাছে রাখার জন্য আর তাই সে এসব করেছে।
তবে ইসাবেলা যে রাগ না এটা মুখে প্রকাশ করে না। সে এখনো বলে, সে ড্যানিয়ালের কাছে থাকতে চায় না। তবে মন জানে—ভালোবাসার এই আবহ তার ভেতর জেগে উঠেছে। একরাশ আবেগ জমেছে, যা তার বোকা বা অসাধারণ সাহসী মনকে চেপে ধরেছে।
একটু শাস্তি দিতে চাই—হয়তো ড্যানিয়েলের পক্ষে এটি যেন একটি সতর্কতা। তাই সে কিছু বলে না, কেবল মৃদু হাসি বা নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়ায় নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখে।
আয়রাখ ও ইয়ানার জীবন যেন এক শান্ত নদীর মতো, ধীরে ধীরে ভালোবাসার স্রোতে ভাসছে। বিয়ের পর থেকে তাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা তাদের জীবনকে পূর্ণতার আলোকচ্ছটায় মেলে ধরেছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি চুম্বনে তারা খুঁজে পায় এক অপরিসীম স্বস্তি, এক গভীর মিলন, যা শুধুই তাদেরই—সময়ের ধকলের বাইরে, পৃথিবীর হাওয়া থেকেও দূরে। ভালোবাসা তাদের জীবনকে এমন এক অমর ছায়ায় মুড়ে রেখেছে, যা কখনো ক্ষয় পায় না।
তারা এখন হানিমুনে অন্য দেশে ঘুরছে। পারস্য রাজ্য থেকে অনেক দূরে।
তবে এত কিছুর মাঝেও যেন ইয়ানাক মন খারাপ সে বিয়ের পর গিয়েছিল তার মা বাবার কাছে তবে তার মা বাবা তাদের মানবে না বলে ফিরিয়ে দিয়েছে, আর তাই তার মন ভালো করার জন্য আয়রাক তাকে ঘুরতে নিয়ে এসেছি প্রতিমুহূর্তে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে।
ওয়াজফান বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে কিছু জরুরি কাগজপত্র আর সামগ্রী নিয়ে মনোযোগ দিচ্ছিল, যেন নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। হঠাৎই ভেতর থেকে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল—কিছু একটা মাটিতে পড়ে গেছে।
তার বুক হঠাৎ ধক করে উঠল। এই কক্ষে তার অনুমতি ছাড়া কারো প্রবেশের সাহস নেই। শুধু এক জনই পারে—তার লিটল মনস্টার।
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মনে হলো, বুকে জমে থাকা আশার স্ফুলিঙ্গ হঠাৎ আগুন হয়ে জ্বলে উঠল।
“জ্ঞান ফিরে এসেছে!”—মনে মনে চিৎকার করে উঠল সে।
এক মুহূর্ত দেরি না করে হাতে থাকা জিনিসগুলো ফেলে দিয়ে ছুটে গেল কক্ষে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল—
বিছানায় অর্ষা।
তার শরীর হালকা নড়ছে, নিঃশ্বাসে পরিবর্তন এসেছে। ধীরে ধীরে চোখের পাতাগুলো কাঁপছে, যেন শত নিদ্রার পর প্রথমবার আলো দেখতে চাইছে।
তার হাত পাশের টেবিলে রাখা গ্লাসে লেগে গেছে, আর সেই গ্লাসটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গিয়েছে।
ওয়াজফান খুশিতে দৌড়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসে পড়ল। অর্শার নিঃশ্বাসের প্রতিটি আন্দোলন যেন তাকে নতুন জীবন উপহার দিল।
অর্ষা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়, পাশে বসে থাকতে দেখে ওয়াজফানকে। তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক মুচকি হাসি, তবে পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে—যাই হয়ে যাক, এই লোকটা খুব খারাপ, সে তাকে কত কষ্ট দিয়েছে! তাই অর্ষা মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ঘুরে থাকে।
ওয়াজফান সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায় তার লিটল মনস্টার তাকে চিনেছে, তবে গাল ফুলিয়েছে কেন তাও বোঝা যায়। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তার লাড্ডুকে টেনে কোলে নেয়। নরম সুরে, অনুতপ্ত কণ্ঠে বলে—
“আমার লাড্ডু, দেখো… আমি সত্যিই সরি। আমি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি, তাই তোমাকে একটু বেশি কষ্ট দিয়েছিলাম। আমি সরি তো… তুমি তো আমাকে এক মাস শাস্তি দিলে, এক মাস শাস্তি দেওয়ার পরও কি মুখ ফুলিয়ে থাকবে?”
‘এক মাস?’—অর্ষার চোখ বড় হয়ে ওঠে। বিস্ময়ে বলে,
“আমি এক মাস অজ্ঞান ছিলাম!”
এরপর ওয়াজফানের বুকে ঘুষি মারতে মারতে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় অর্ষা। রাগে, কষ্টে, কণ্ঠ কেঁপে ওঠে তার—
“শয়তান! দানব! জানোয়ার! আপনি এতটা হিংস্র কেন? ছাড়ুন আমাকে, আমাকে ছুঁবেন না!”
এমন কান্ড দেখে ওয়াজফান শুধু মুচকি হাসে। ধীরে ধীরে আবার তাকে টেনে নিজের কাছে আনে, শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে। কপালে আলতো চুমু খেয়ে গভীর সুরে বলে—
“আর কখনো এমন করবো না… তুই আমার কাছে ভালো থাক, এটুকুই আমার একমাত্র চাওয়া।”
ইসাবেলা বসে আছে নিজের কক্ষের এক কোণে। তার মনটা যেন আজ কিছুটা খারাপ। চার দেয়ালের এই ঘরটা, যেখানে এতদিন ধরে সে বন্দি হয়ে আছে, এখন আর তাকে আগের মতো টানে না। ধীরে ধীরে তার ভেতরে জমে উঠেছে এক অদ্ভুত অস্থিরতা।
বন্ধ কক্ষে থাকতে থাকতে সে যেন অনেকটু বোর হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে—আর সহ্য হচ্ছে না। ইসাবেলার মন চাচ্ছে, একবার বাইরে গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে, আকাশের দিকে তাকাতে, বাতাসে ভেসে থাকা দুনিয়ার রঙ ছুঁয়ে দেখতে। একটু হলেও ঘুরে দেখতে চাই সে বাহিরের দুনিয়াটাকে।
কিন্তু ভালো করেই জানে—ড্যানিয়েল তাকে এত সহজে বাইরে যেতে দেবে না। তার নিয়ন্ত্রণ, তার শাসন—সবকিছু যেন তাকে বেঁধে রেখেছে অদৃশ্য শিকলে। তবুও, ইসাবেলার ভেতরে একটা ছোট্ট আশা জেগে ওঠে।
“যদি বলি… যদি একবার অনুরোধ করি, হয়তো আজ ড্যানিয়েল আমাকে যেতে দেবে।”
নিজের মনে এই ভেবে সে খানিকটা সাহস জোগাড় করে। হোক না নিষেধ, হোক না ঝগড়া—চেষ্টা তো করতেই পারে।
কিছুক্ষণ পর,
ড্যানিয়েল রুমে প্রবেশ করে। সোজা দরজা খুলেই চোখ পড়ে—কোণায় গুটিয়ে বসে আছে ইসাবেলা; দেখলেই বোঝা যায় মনটা খারাপ। ড্যানিয়েল নিশ্চুপেই তার পাশে এসে বসে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে আমার পরীটা? কেন এমন উদাস হয়ে বসে আছো? মন খারাপ দেখাচ্ছে—বল তো, কী হয়েছে?”
ইসাবেলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, তারপর ইতস্তত কণ্ঠে বলল,
“আমার আর এই বন্দী রাজপ্রাসাদে থাকতে ভালো লাগছে না। বন্দি করে—খাঁচার পাখির মতো বেঁচে থাকতে আমি আর পারছি না। চলুন না, একটু বাইরে—দুনিয়াটা ঘুরে দেখি। অন্তত কিছু সময়ের জন্যই হোক, আমি একটু বাইরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। প্লিজ, নিয়ে চলুন না—আমাকে, অন্তত একটু সময়ের জন্য। প্লিজ, ড্যানিয়েল।”
ইসাবেলার কথা শুনার সাথে সাথেই ড্যানিয়েলের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। স্পষ্ট, কড়া কণ্ঠে সে উত্তর দেয়,
“না—কখনই না। তুমি জানো না, এই সময় বাইরে যাওয়া তোমার জন্য নিরাপদ নয়। আমি তোমার ক্ষতি হতে পড়ে, এমন কিছু কখনোই হতে দেওয়া হবে না।”
ড্যানিয়েলের উত্তর শুনে ইসাবেলা সাহস নিয়ে এবার বলে ওঠে,
“কি এমন হয়েছে আমার যে আমি কি একটুখানি বাইরে যেতে পারব না? বাইরে গেলে এমন কী ক্ষতি হবে? যাব, ঘুরে আসব, এটাই তো। কেন এমন করছেন আপনি? কিছু সময়ের জন্য গেলে কি এমন ভয়ংকর কিছু হয়ে যাবে? প্লিজ, নিয়ে চলুন না আমাকে…”
ড্যানিয়েল এবার কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“না, ইসাবেলা! আমি বলেছি তুমি বাইরে যেতে পারবে না মানে—তুমি বাইরে যেতে পারবে না। শুধু শুধু জেদ করছো কেন? আর হ্যাঁ—তোমার ভালো-মন্দ তুমি কীভাবে বুঝবে? তোমার কাছে তো কেবল কিছু সময়ের সুখটাই দরকার। কিন্তু এর আড়ালে কত বড় ক্ষতি লুকিয়ে থাকতে পারে, কত কষ্ট আসতে পারে—তা তোমার কল্পনার বাইরে। তাই তোমার ভালো-মন্দের দিকটা আমাকে বুঝতে দাও। আমি ঠিক তোমার ভালোটাই বুঝব।”
ড্যানিয়েল-এর উত্তর শুনে ইসাবেলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। একটু সাহস জোগায়—তার কণ্ঠে স্ফুরণ আসে, মাথা উঁচু করে সাহসী স্বরে বলে,
“আপনি এত রাগান্বিত কেন? আমি তো স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে বললাম। এটা কি এত রাগের কারণ? আমি বুঝতে পারছি না। আর হ্যাঁ, বলুন—বাহিরে এমন কি ক্ষতি আছে যে আপনি আমাকে নিয়ে যেতে দেন না? শুধু লেজলেজি অজুহাত দেখালেই হবে? যদি আপনার মনে না থাকে যে আপনি আমাকে বাহিরে নিতে চান, সরাসরি বলুন—আপনি আমাকে নিয়ে যেতে চান না। বাহিরে গেলেই আমার খারাপ হবে, এই বাহানায় আটকানো ঠিক হয়নি। যদি সত্যিই আপনি আমাকে নিয়ে যেতে চান না, তাহলে একেই বলে দিন—আমি কেবল অজুহাত দেখিয়ে আটকে রাখা চাই না। যদি আপনি অনুমতি না দেন, তবু আমি কোনো দাসীর সঙ্গে চলে যাব। এমন ধরণের অজুহাত দেখিয়ে আমাকে আটকে রাখার আর মানে নেই।”
ইসাবেলার কথা শুনে ড্যানিয়েলের রাগ আরও বেড়ে যায়। কণ্ঠে তীব্রতা মিশিয়ে সে বলল,
“আমি কোনো অজুহাত দেখাচ্ছি না। আমি বলেছি—তোমার এই সময় বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। সেটা মেনে নাও। আর হ্যাঁ, যদি তোমাকে বাইরে নিয়ে যেতে হত, আমি নিজেই নিয়ে যেতাম। কখনও কোনো দাসীর সঙ্গে পাঠাতাম না। যেখানে আমি তোমাকে নিজের সাথেই বাহিরে নিয়ে যাওয়ার রিস্ক নিতে চাই না। সেখানে তুমি কিভাবে ভেবে নিলে যা আমি তোমাকে কোন দাসীর ভরসায় ছেড়ে দেব।
তুমি কোথাও যেতে পারবে না—এখান থেকে। এটাই আমার শেষ কথা। প্লিজ, আমাকে আর রাগান্বিত করো না। নয়তো আমি নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারব না । তবে হ্যাঁ আমি তোমাকে তো কোনো আহত করতে পড়াবো না কারণ তুমি আমার হার্টবিট, আর যদি আমি নিজের হার্টবিট কে আহত করি, তাহলে আমি নিজেও বাঁচতে পারবো না? তাই আমি এমন কোনো কিছু করব যাতে তুমি কখনো এই রুমে থেকে বের হতে না পারো।
ড্যানিয়েলের কথা শুনে ইসাবেলা চুপ হওয়ার বদলে আরও রেগে যায়।
“আপনি এমন করছেন কেন? আমি তো বুঝতে পারছি না। শুধু বলছেন—‘তোমার ক্ষতি আছে, ক্ষতি হবে।’ বাহিরে কি ক্ষতি আছে আমার বলুন ? এখন তো আর বলতে পারছেন না।
তাহলে কি ভেবে নেব? এই সব কথাই তো অজুহাত। আসলে আপনি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন না। আমার বাইরে যাওয়াটা হয়তো আপনার কোনো কালো রহস্যের সঙ্গে জড়িত, যা আমি যদি জানতে পারি…। আর হয়তো আপনার এখন আর আমাকে ভালো লাগে না, তাই আপনি বাহিরে নিয়ে নিজের নতুন সংসার শুরু করেছেন—এই কারণেই বোধ হয় আপনি আমাকে বাইরে যেতে দিতে চান না। আমি সত্যিটা জানতে পারব বাইরে গেলে? হয়তো যেনে জাবো বাইরে আপনার পতিতা নারী আর রক্ষিতা আছে।হয়তো তাদের সঙ্গে করা সব ফষ্টিনষ্টির কথা আমি জেনে যাব।
ড্যানিয়েল অনেকটা কষ্ট পায় এমন কথায়। তবে সে ইসাবেলা কে সেটা বুঝতে না দিয়ে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে,
“এতটা অবিশ্বাস! আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না। বাইরে যেতে চাও তো ঠিক আছে, চলো— এখনই তোমাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছি। আর আজ আমি তোমার কাছে প্রমাণ করিয়ে দেব যে আমার জীবনের শেষ প্রান্তে শুধুমাত্র তোমার নাম লেখা—ইসাবেলা। কিন্তু তুমি সামান্য বিষয় নিয়েই আমাকে অবিশ্বাস করছো। চল, তবে প্রমাণ দেই। কি হলো, চলো।”
কথাগুলো এতটাই হৃদয়স্পর্শী ছিল যে ইসাবেলার মনটা কিছুটা নরম হয়ে যায়। সে এভাবে বলতে চায়নি তবে রাগের মাথায় ভুলভাল বলে ফেলেছে।
এরপর ড্যানিয়েল তার হাত শক্ত করে ধরে, ধীরে ধীরে তাকে বাহিরে নিয়ে যায়।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর, ওরা দুজন এসে দাঁড়ায় এক নিরিবিলি জঙ্গলের মধ্যে। জঙ্গলটা পারস্য রাজ্য থেকে বেশি দূরে নয়। দুজন কিছুক্ষণ হাত ধরে ঘুরে ঘুরে পথ চলতে থাকে।
হঠাৎ দূরের অন্ধকার থেকে দেখা যায়—অন্য রাজ্যের একদল জিন এগিয়ে আসছে। তারা পারস্য রাজ্যের শত্রু। এরা আশিক জ্বীনের দল। সেই আশিক জিনটিকে, যার জন্য ওয়াজফান তার লিটল মাস্টারকে হারিয়েছিল, পরে ওয়াজফান জিনটিকে নিজের কাছে বন্দি করেছিল। এবং এখন, অর্ষাকে পাওয়ার পর, ওই জ্বীনটিকে ভয়ংকর মৃত্যুর দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল তার রাজ্যে।
এবার সেই রাজ্যের জিনেরা প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে এসেছে—ওয়াজফানের কাছে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে, তারা প্রথমে ইসাবেলাকে দেখে। তারা চেনতে পায়, এ তো ওয়াজফানের বোন। তাদের মুখে হঠাৎ একবারের জন্য হাসি ফুটে ওঠে। ‘এবার আমাদের কষ্টের প্রতিশোধ নিতে সুযোগ এসেছে,’ তারা মনে করে।
রাজ্যের পথে যাওয়ার মাঝেই শিকারি পেয়েছে—এবার আমাদের শিকার করা সহজ হয়ে গেছে। তারা ভেবে নেয়, তাদের প্রতিশোধ না হয়, ইসাবেলার মৃত্যু দিয়ে নেওয়া হবে। বোনের মৃত্যুতে তো ওয়াজফানও ভেঙে পড়বে। এই ভাবেই তারা নিজের প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্তে দৃঢ় হয়।
আর এই পরিকল্পনাই তারা এবার এগিয়ে আসে ইসাবেলার দিকে। তবে তাদের জানা ছিল না—ইসাবেলার সামনে প্রতিরক্ষা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ভারী দেওয়াল, যার নাম ড্যানিয়েল।
শত্রু দলের লোকেরা পিছন থেকে এগিয়ে এসে ইসাবেলার পিঠে আঘাত করার চেষ্টা করে। ঠিক সেই মুহূর্তে ড্যানিয়েল তার সামনে এসে দাঁড়ায়, আর তরোয়াল তার পেটে ঢুকে যায়। ড্যানিয়েলকে দেখে জিন দলের লোকেরা অবাক হয়, সাথে কিছুটা ভয়ও পায়। রক্ত পড়তে শুরু করে তার শরীর থেকে, তবুও সে কঠোর হয়ে দাঁড়ায়—পাথরের মতো, যেন ইসাবেলাকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রক্ষা করবে।
সঙ্গে সঙ্গে আবারও ইসাবেলার ওপর হামলা শুরু হয়। ড্যানিয়েল সেই সব আঘাত নিজের উপর নিয়ে নেয়। এরপর শুরু হয় জিনেদের ও ড্যানিয়েলের মধ্যকার মারাত্মক যুদ্ধ। জিনেরা বারবার ছুরি, চাপাতি, তরোয়াল, ব্যবহার করে আঘাত করার চেষ্টা করে, কিন্তু ড্যানিয়েল পাথরের দেওয়াল হয়ে সব আঘাত নিজের শরীরে ধরে রাখে—একটাও আঘাত ইসাবেলার গায়ে পৌঁছতে দেয় না।
তরোয়ালের ক্ষতবিক্ষত আঘাতে যেন ড্যানিয়েলের শরীর ছিড়ে যাচ্ছিল, তবুও সে রুখে দাঁড়ায়। নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়েই সে জিনেদের এক এক করে মাটিতে লুটিয়ে দেয়। হাজারো আঘাতের পরও ড্যানিয়েল ইসাবেলাকে রক্ষা করতে অবিচল থাকে। এক হাতে সকল এর সাথে লড়ে যায় সে। তবুও সে ইসাবেলার গায়ে বিন্দু পরিমান আচরও লাগতে দেয় না । আর এতক্ষণে ড্যানিয়েলের আক্রমণে প্রায় সমস্ত জিন মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে, তারা আধ-মরা, তবুও ড্যানিয়েল তাদেরও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দমন করে, নিজের শক্তিশালী তরোয়াল এর আঘাত দিয়ে।
এতোক্ষনের তরলের ক্ষতবিক্ষত আঘাতের পরে ড্যানিয়েলের শরীরে অঝরের রক্ত বের হতে থাকে, যেন রক্তের স্রোত থামছেই না। তার শরীর আর টিকে থাকতে পারল না, মাটির বুকে লুটিয়ে পড়ল। এতক্ষণ যাবৎ ইসাবেলা দাঁড়িয়ে সব দেখছিল—ড্যানিয়েলকে বাঁচানোর জন্য আর্তনাদ করছিল। কিন্তু যখন ড্যানিয়েলের লুটিয়ে পড়া শরীর তার চোখের সামনে, ইসাবেলা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না; ছুটে গিয়ে মাটির বুকে থেকে ড্যানিয়েলের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরে পড়ছে ইসাবেলার।
ড্যানিয়েল নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে কষ্ট করে একবার ইসাবেলার দিকে তাকায়। শেষ নিঃশ্বাস বের হবার আগেই কাসতে কাসতে তার মুখ থেকে বের হয় কিছু অদ্ভুত সুরে শব্দ—
“তুমি কেন ভালোবাসলে না আমাকে, ইসাবেলা? আমি কি এতটাই নিকৃষ্ট ছিলাম যে আমার কপালে তোমার ভালোবাসা টুকুও ঠাই হলো না? একটু কি ভালোবাসা যেত না আমাকে? আমি কি তোমার কাছ থেকে একটুখানি বিশ্বাসেরও যোগ্য ছিলাম না? কেন এত অবিশ্বাস ছিল তোমার আমার প্রতি?”
ইসাবেলা পাগলের মতো কান্না করছে, ঠোঁট দুটো কাঁপছে, অঝোরে কেঁদে কেঁদে ড্যানিয়েলের দিকে হাত বাড়াচ্ছে । কিন্তু হাত এতটাই কাঁপছে যে স্পর্শ করতে পারছে না।
ইসাবেলা কিছু বলতেই যাওয়ার আগেই ড্যানিয়েল নিজের একটি আঙ্গুল তার মুখের সামনে নিয়ে চেপে ধরে বলল,
“এতদিন তো অনেক বলেছো, আমি তো চলেই যাবো। আমার জীবনের শেষ সময়টুকু, না হয়, একটু আমাকে বলার সুযোগ দাও।”
কথাটা শুনে ইসাবেলা চুপ হয়ে যায়, তবে পাগলের মতো অঝোরে কান্না চালিয়ে যাচ্ছে। সে সমানে দুই দিকে মাথা ঝুলাচ্ছে, যেনো সে ড্যালিয়েল এর বলা কথাগুলোর উত্তর না বুঝাচ্ছে। তার পুরো শরীর কাঁপছে, যেন কি করবে বুঝতে পারছে না—কেবল কাঁদতেই আছে।
ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করে,
“তুমি তো চেয়েছিলে আমি যেন তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাই। নেও, আজ তোমার ইচ্ছেটাকে পূরণ করে দিল আল্লাহ। কথায় আছে, মানুষ যা মন থেকে ইচ্ছে করে চায়, আল্লাহ তার সেই ইচ্ছা ঠিকই পূরণ করেন। তাই দেখ, আল্লাহ আজ তোমার ইচ্ছেটা কেও পূরণ করে দিল—দূরে সরিয়ে দিল তোমাকে আমার কাছ থেকে।
বেঁচে থাকতে তো আর পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারত না। আর তাই আজ, আমার মৃত্যুই আমাদের আলাদা করে দূরে ফেলছে—আমি তোমার কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাচ্ছি, যেখানে তুমি হাজার চাইলেও আসতে পারবে না। আর আমি চাইবো না নিজের কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে।
যদিও তুমি কখনো আমাকে ভালোবাসনি, তবুও বলছি অন্তত আমার শেষ চাওয়া হিসেবে আমাদের ভালোবাসার স্মৃতি ধরে রাখো। আমাদের সন্তানটাকে নিজের কাছে আগলে রেখো, সারাজীবন ভালোবাসা দিয়ে। ওকে আমার কমতিটা কখনো বুঝতে দিও না আর ওকে বলো ওর বাবা কোনো বিশ্বাসঘাতক ছিল না। সে তো ছিল আজীবন এক নারীতেই আসক্ত পুরুষ, আর সেই নারীর কোলেই আজ নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।”
কথাটা শেষ করেই ড্যানিয়েল এর মুখ থেকে কাশতে কাশতে রক্ত বের হয়ে আসে আর এটা দেখে ইসাবেলা অনেকটা ভয় পেয়ে যায় সে কাঁদতে থাকে ড্যানিয়েল মাথায় হাত রেখে । আর ড্যানিয়েল শেষবারের মতো আবারো হাত বাড়িয়ে ইসাবেলার চেহারাকে ছুঁতে চায়, কিন্তু তার আগেই সৃষ্টিকর্তা তাকে কোন সুযোগ না দিয়ে তার পুরো প্রাণ কেড়ে নেয়। ড্যানিয়েলের চোখ বন্ধ হয়ে যায়, শূন্যে তোলা হাতটি ধুপ করে মাটিতে পড়ে যায়…..
ক্যালিয়ন এখনো সেই পুরোনো কটেজেই পড়ে আছে, যেখানে অর্ষার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আজও তাকে শ্বাস নিতে শেখায়। শোবার ঘরের নরম বিছানা, বাগানের ফুলেরা, সবকিছুই তাকে মনে করিয়ে দেয় তার রেড ওয়াইনের হাসি, তার ছুটোছুটি, তার প্রাণচাঞ্চল্য। মনে হয় যেন এখনো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে, হাসছে, খুনসুটি করছে।
কিন্তু সবকিছুই কেবল এক মরীচিকা, কেবল কল্পনার ধোঁয়া। বাস্তবে তার রেড ওয়াইন আর তার কাছে নেই—সে তো এখন অনেক দূরে, ওয়াজফানের সান্নিধ্যে। এই কথাটিই ক্যালিয়নের বুকের ভেতর প্রতিক্ষণ তীব্র শিহরণ তোলে, তাকে ভেঙে চূর্ণ করে। কারণ তার হৃদয়ের ধন, তার রেড ওয়াইন, আজ অন্য কারো কাছে।
ক্যালিয়ন অন্ধকারে বসে আছে, হাতে ধরা ওয়াইনের গ্লাস। ওয়াইনের দিকে তাকাতেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার নিজের রেড ওয়াইনের মিষ্টি চেহারা। সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অদ্ভুত কিছু কথা—
“এই পাঁজরে আজও তোমার নাম লেখা… তবে তুমি কেন এই পাঁজরের হারের সৃষ্টি হলে না? ভালো তো বেসেছিলাম তোমায়… তবে তোমাকে পাওয়ার মত সৌভাগ্য কেন হলো না আমার? সৃষ্টিকর্তা, তোমায় সৃষ্টি তো করেছিল—তবে অন্য কারো করে কেন? যদি তার তোমাকে অন্য কারোর করারই ছিল, তবে সে কেন এই হৃদয় তোমার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিল? এই নির্মম ভাগ্য কেন হল আমার, যাতে তোমার নাম লিখা নেই? এই জীবনের কোন মানেই নেই, যে জীবনে তুমি নেই।
কেন তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে, রেড ওয়াইন? এই ভাগ্য কি তোমাকে পেতে পারত না? কেন আমার ভালোবাসার পরিণতটা এত নির্মম হলো? জীবনে কি এতোটুকু সুখও ঠাঁই হতে পারতো না আমার ভাগ্য? ও খোদা, তুমি কেন এতটা নিষ্ঠুর? তোমার নিষ্ঠুরতা এতটাই যে, যেটা একজন পুরুষের জীবন কেরে নেওয়ার মতো… তোমার কি একটুও মায়া হলো না আমার এই বেঁচে থেকেও মৃত্য আর্তনাদ দেখে? কেন তুমি আমার কাছ থেকে আমার রেড ওয়াইন কে নিয়ে গেলে? আর যদি তুমি আমার না হওয়ারই ছিলে, তবে কেন এই মন তোমার হয়ে রয়ে গেল আজীবন?”
Death or Alive part 40
হঠাৎ তার হাতে থাকা গ্লাস ভেঙে যায়। কাঁচের টুকরোগুলো ছিটকে পড়ে, আর তার হাত থেকে অঝোরে রক্ত পড়তে শুরু করে। সে রক্তের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ ছুড়ে দেয়, কণ্ঠে কাঁপন:
“বিধাতা, কেন এতটা নিষ্ঠুর হলো? বিধাতা, কি পারত না তোমাকে আমার নামে লিখতে?”
 
