Death or Alive part 5

Death or Alive part 5
priyanka hawlader

সন্ধ্যা নেমেছে মধুপুরগড়ে।
আকাশে একফালি চাঁদ লাজুকভাবে জ্বলছে,
কুয়াশার আস্তরে নিজেকে লুকাতে চাইছে যেন।
আলগা হাওয়ায় শালগাছের পাতারা মৃদু কাঁপছে,
আর সেই শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দ জঙ্গলের গভীরতায়।
অর্ষা বারান্দার বাঁশের চেয়ারে বসে আছে।
তার হাতে ধরা এক কাপ গরম লেবু চা,
আর চোখ দুটি স্থির—দিগন্তের গা ছমছমে রূপে।
তবে মনটা… দূরে কোথাও ভেসে যাচ্ছে।
চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ক্যালিয়নের মুখ।
তার কথা বলার ভঙ্গি।
তার হাসি।

আর সেই দৃষ্টিটা… যেন অর্ষার হৃদয় ভেদ করে ভিতর পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
এই ক’দিনে আমরা কত জায়গা ঘুরেছি একসাথে…
জঙ্গল, নদীর ধার, ছোট টিলা, আর সেই ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তটা…
এক চিলতে হাসি খেলে যায় অর্ষার ঠোঁটে।
সে আমাকে খুব কেয়ার করে…
অনেক বেশি। এমনভাবে, যেন আমি খুব আপন কেউ।”
সে আবার চায়ে চুমুক দেয়।
তার চোখে এখনো সেই দৃশ্য ভাসছে—
সেই দিন শীতে ক্যালিয়নের নিজের কোট খুলে পরিয়ে দেওয়া,
তার হাতে হাত রেখে পথ দেখানো,
আর অচেনা পথের মাঝেও তার পাশে থাকা।
আমি তো তাকে বন্ধু ভেবেছিলাম।
কিন্তু সত্যি কি তাই?
তাকে বন্ধুর মতোই দেখি আমি?”
অর্ষা মনে মনে দ্বন্দ্বে পড়ে যায়।
সে জানে—সে কোনো সাধারণ মেয়ে না।
সে শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছেলেদের চোখ দেখলেই বুঝতে পারে—তারা কী চায়।
আর ক্যালিয়নের চোখে সে কি দেখেনি?
সেই চোখ দুটো…
যেন শুধু আমাকেই খুঁজছে।
আমার মুখে তাকিয়ে থাকে অদ্ভুত এক গভীরতা নিয়ে,
যা কোনো কথায় বোঝানো যায় না।
তবু আজ ক্যালিয়ন আসেনি।
শুধু ফোনে বলেছে—
আজ একটু কাজ আছে, কাল সকালে দেখা হবে।”
অর্ষা ভাবে—
তার তো আসার কথা না…
তবু আমি বসে আছি…
তার জন্যই তো?”
তাঁর নিজের মনেই প্রশ্ন,
এটা কি বন্ধুত্বের বাইরে কিছু?

তাকে ছাড়া আজ দিনটাকেই যেন ফাঁকা মনে হচ্ছে…
বাতাস হঠাৎ একটু জোরে বইতে শুরু করে।
চায়ের কাপে তরঙ্গ ওঠে।
দূর থেকে ভেসে আসে এক অচেনা পাখির ডাক।
জঙ্গলের ছায়া যেন ধীরে ধীরে ঘন হয়ে আসছে।
অর্ষা মনে মনে একটু কাঁপে,
তবে সেটা ঠান্ডায় না,
একটা অনুভূতিতে—যার নাম এখনো সে ঠিক দিতে পারছে না।
সন্ধ্যার পর চাঁদের আলো এখন ঘন কুয়াশার ভিতর হারিয়ে গেছে।
তার ভাবনারা মাঝেই হঠাৎ
ঠিক সেই মুহূর্তে—
তার ফোনটা বেজে ওঠে ।
অর্ষা চমকে যায়।

স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়তেই সে চমকে ওঠে—
“Kälion calling…”
মুহূর্তের ভেতর তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠে কিছু না বলা অনুভূতি।
সে উৎসাহে ফোনটা রিসিভ করে নিয়ে বলে—
হ্যাঁ বলুন… আপনার কিছু দরকার ছিল? আপনি এখন কী করছেন?”
ওপাশ থেকে মৃদু হেসে ক্যালিয়নের কণ্ঠ ভেসে আসে—
“আহ্ এত প্রশ্ন একসাথে করলে আমি কোনটা আগে উত্তর দেব বলো তো?”
এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে—
তোমার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে… নিশ্চয়ই তুমি কিছুক্ষণ আগেও আমার কথাই ভাবছিলে।
না হলে আমি কল দিতেই এত তাড়াতাড়ি ফোন ধরে এমন প্রশ্ন করো কেন?”
অর্ষা হঠাৎই থমকে যায়।
গলা শুকিয়ে আসে।

হৃদপিণ্ড যেন খানিকটা দ্রুত ছুটতে শুরু করেছে।
না না… মোটেও না… মানে… আমি তো এমনি বসেছিলাম।
আপনি কল দিলেন তাই কথা বলছি, আর কি।”
কথাগুলো যেন অস্বস্তিতে গোঁ গোঁ করে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে।
ওপাশে ক্যালিয়নের মুচকি হাসি আরেকটু গভীর হয়।
সে মনেই বলে ফেলে—
তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি।
আমি সবটাই দেখছি, অর্ষা।
তুমি আমায় না দেখলেও… আমি তোমায় দেখছি।
তোমার ভাবনাগুলো—আমার দিকেই ঘুরে ঘুরে আসে।
অর্ষার শ্বাস যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়।
হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে ফোনটা।
তার মনে হাজার প্রশ্ন, কিন্তু ঠোঁট নীরব।
তখনই ক্যালিয়নের কণ্ঠ আরেকবার ভেসে আসে—এবার নরম, আমন্ত্রণমূলক স্বরে…
বাইরে এসো…

আজ তো আমাদের দেখা হয়নি।
চলো, একটু হাঁটি… জঙ্গলের ধারে, চাঁদের নিচে—তোমার সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাই।
একটা গভীর নিস্তব্ধতা নামল চারপাশে।
অর্ষা চোখ বন্ধ করে, শ্বাস নিয়ে…
নিজেকে প্রশ্ন করে—কি বলবে সে এবার?
না কি—কিছু বলাই উচিত নয়, শুধু… চলে যাওয়া উচিত ক্যালিয়নের পাশে।
ফোনের ওপাশে ক্যালিয়নের কণ্ঠ এখনো ভেসে আসছে…
“চলো, একটু হাঁটি। আজ তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি…”
অর্ষার গলা শুকিয়ে গেছে যেন।
হঠাৎ সে একটু কেঁপে উঠে বলে ফেলে—
না মানে… এখন তো সন্ধ্যা।
মা যদি যেতে না দেয়…”
কথাটা শেষ করতে করতে সে নিজেও টের পায়—
এটা একটা অজুহাত।
একটা ছোট্ট মিথ্যে।

কারণ বাস্তবে তার মা এরকম ব্যাপারে বাধা দেন না।
আসলে… এই মুহূর্তে ক্যালিয়নের সামনে যাওয়ার কথা ভাবতেই তার বুকের ভেতর কেমন করে উঠছে।
লজ্জা। উষ্ণতা। ভয়… কিংবা ভালো লাগা?
সে নিজেই জানে না।
তবে ক্যালিয়ন জানে।
ক্যালিয়ন তো এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেই,
ঠিক বাড়ির গেইটের কাছে—
তাকিয়ে আছে অর্ষার জানালার দিকে।
তাই মুচকি হেসে ফোনে বলে—
তুমি কি আমাকে এড়াতে চাইছো অর্ষা?”
অর্ষা চমকে যায়।
তাকে তো দেখা যাচ্ছিল না বাইরে থেকে!
তবে সে বুঝে যায়—এই লোকটা…
আলাদা।
খুব আলাদা।

এক মুহূর্ত থেমে, নিজের বুকের ওপর হাত রাখে সে।
এই ধুকপুকানিটা… ক্যালিয়নের জন্যই তো।
তাই ধীরে, একরাশ সাহস জড়িয়ে নিয়ে বলে—
না… আসছি।”
ফোনটা রেখে দেয়।
তারপর দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
মাকে বলে—
আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হতে পারে।
তার মা, যিনি তাকে ছোটবেলা থেকেই জানেন, ভাবেন এটা হয়তো মীরার বাড়ি যাবে।
তাই হাসি দিয়ে বলে—
যা মা, সাবধানে ফিরিস।”

কিন্তু ঠিক দরজার কাছেই পড়ে তার বাবার মুখোমুখি।
বাবা একটু কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে—
এই রাতে কোথায় যাচ্ছিস মা?”
অর্ষা এক মুহূর্ত থেমে, চোখ নামিয়ে বলে—
মীরার বাসায়।
ওর একটু সমস্যা হয়েছে, ডেকেছে।
আমি একটু গিয়ে দেখি। ফিরবো রাতেই।”
তার বাবা চোখ সরু করে কিছুক্ষণের জন্য তাকে দেখে,
তবে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হাঁটা দেন।
অর্ষা বুকের ভেতর শ্বাস আটকে বাইরে বেরিয়ে আসে…
আর বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে ক্যালিয়ন।
সাদা শার্ট, ডেনিম জিন্স, গলায় একটা পাতলা স্কার্ফ।
আর সেই চোখ…
যেন রাতের আকাশে দুটো নীল তারা।
অর্ষা ক্যালিয়নের দিকে ধীরে এগিয়ে যায়।
তার মুখে হালকা হাসি।
এই প্রথমবার…

সে স্বেচ্ছায় ক্যালিয়নের দিকে এক পা বাড়ালো।
চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে গা ছমছমে জঙ্গলের পাতায় পাতায়।
আকাশে মেঘ নেই, চারপাশে নীরবতা… যেন রাতটিও ভালোবাসার জাদুতে কুয়াশা হয়ে ঝুলে আছে।
অর্ষা ধীরে হাঁটছে ক্যালিয়নের পাশে।
চাঁদের সাদা আলোয় তার মুখটা ঝলমল করছে,
চোখে হালকা উজ্জ্বলতা, ঠোঁটে এক অচেনা লাজুকতা।
ক্যালিয়ন তাকিয়ে আছে ঠিক সেই মুখের দিকেই।
তার চোখে যেন এক আগুন জ্বলছে,
যে আগুন শুধু ভালোবাসা নয়,
ভেতরে লুকিয়ে থাকা অভিমন্যু জীবনের প্রাচীন কোনো প্রতিজ্ঞা।
হঠাৎ—

অর্ষার পা কিছুর সাথে ঠেকে যায়।
সে পড়ে যেতে লাগলে এক মুহূর্ত দেরি না করে
ক্যালিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরে ফেলে।
অর্ষা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে,
তার বুকের ঠিক ওপরেই রয়েছে ক্যালিয়নের উষ্ণ হাতে রক্ষা—
আর ক্যালিয়নের মুখ তার মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।
এই অন্ধকারে আমার হাত ধরে হাঁটো,
নরম কণ্ঠে বলে ক্যালিয়ন।
না হলে আবার পড়ে যাবে।
অর্ষার মুখ লাল হয়ে ওঠে।
তবু, না বলে সে ক্যালিয়নের হাতটা ধরে ফেলে।
দুজন একসাথে হাঁটতে শুরু করে…
অর্ষা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে—এই গাছটা নাম এটা…? এই পাখির ডাকটা কত সুন্দর ? আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
কিন্তু ক্যালিয়ন শুধু হেসে যায়।

তাকে দেখে মনে হয় সে অন্য কিছু শুনছে না,
শুধু অর্ষার কণ্ঠ শুনতে আর তার মুখ দেখতে এসেছে এই জঙ্গলে।
একসময়, নীরবতার মাঝে
ক্যালিয়ন হঠাৎ নিচু গলায় বলে ওঠে—
Ti Amo…
অর্ষা থেমে যায়।
চোখ বড় বড় করে বলে—
কি বললেন?
ক্যালিয়ন আবার বলে, এবার আরও ধীরে…
আরও গভীর চোখে তাকিয়ে…
Ti Amo… red wine.
তার কণ্ঠে অদ্ভুত এক আবেগ।
চোখে নেশা।
মুখে কিছু না বলা প্রতিজ্ঞার ছায়া।
অর্ষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে—

এইটা কোন ভাষা? মানে কি? আর আপনি আমার কি নামে ডাকলেন এটা।
ক্যালিয়ন মুচকি হেসে বলে— red wine,
আজ থেকে আমি তোমায় এই নামেই ডাকবো,
অর্ষা অবাক হয়ে বলে এটা আবার কেমন নাম? আর এই নামে কেন ডাকবেন আমার কি নাম নেই।
তুমি দেখতে red wine এর মতো নেশালো তাই আমি এই নামেই তোমাকে ডাকবো।
এবার অর্ষা একটু লজ্জা পায় তাই কথা ঘোরানোর জন্য বলে আর যেই ওয়ার্ড টা বললেন সেটা কোন ভাষা।
সেটা ইটালিয়ান ভাষা।
তুমি বুঝবে না… বাসায় গিয়ে Google করে নিও। ক্যালিয়ন হালকা হাসি দিয়ে বলে।
অর্ষা মুচকি হেসে আবার রাগারাগির সুরে বলে—
“না, আপনি এখনই বলবেন। আমি এক্সাইটেড হয়ে যাচ্ছি এটা জানার জন্য।”
ঠিক তখনই—
আকাশ থেকে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়।
মাথার ওপর থেকে ঝরে পড়ছে বরফ-ঠান্ডা পানির ধারা।
অর্ষা হতচকিত হয়ে ওঠে।
“বৃষ্টি?! এই তো একেবারে হঠাৎ!”

দুজন দৌড়ে যায় সামনে থাকা বিশাল এক গাছের নিচে।
গাছের পাতা ঘন, বৃষ্টির অনেকটা ঠেকায়।
তবু অর্ষার কাঁধ ভিজতে থাকে।
ক্যালিয়ন তখন তার গলার স্কার্ফ খুলে
নরম করে অর্ষার মাথায় ধরে দেয়—
“এইটা রাখো… ঠান্ডা লাগবে না।”
অর্ষা তার চোখে তাকায় কিছুক্ষণ।
চুপচাপ।
তাকে এমনভাবে কেউ আগলে রাখেনি আগে।
আর ক্যালিয়ন?
সে যেন জানে—এই চাঁদ, এই বৃষ্টি, এই রাত—
অর্ষাকে নিজের দিকে টানার মুহূর্ত এটা।
চারদিকটা ঝিরঝিরে বৃষ্টির শব্দে ভরে গেছে।
গাছের পাতায় ঠকঠক শব্দ, মাটিতে গড়িয়ে পড়া জল…
আর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো মানুষ—যাদের মাঝে যেন সময় থেমে গেছে। (যদিও একজন মানুষ আর অন্যজন নেকড়ে তবে এখন মানুষের রুপে)

অর্ষা কাঁপছে।
ঠান্ডায় নয়, এক অজানা উত্তেজনায়।
তার কাঁধে এখনো ক্যালিয়নের স্কার্ফ।
কাঁধের ওপর পানির ছাঁট পড়লেও শরীরটা উষ্ণ—
কারণ তার একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটা, ক্যালিয়ন।
ক্যালিয়ন তাকিয়ে আছে গভীরভাবে।
তার চোখের মাঝে আলোর চেয়েও জ্বলন্ত এক নেশা।
হঠাৎ সে নরম গলায় বলে,
তুমি জানো, আমি এই বৃষ্টির চেয়েও বেশি তোমায় চাই।”
অর্ষা কিছু বলতে চায়… পারে না।
তার গলা যেন আটকে যায়।
হাতদুটো নিজের শরীরের কাছে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
ক্যালিয়নের এক পা এগিয়ে আসে,
তারপর ধীরে ধীরে সে অর্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
তার চোখ ঠিকঠাক আটকে থাকে অর্ষার চোখে।
অর্ষার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।
তার শরীরটা কাঁপছে আরও জোরে—

এইবার আর ঠান্ডায় নয়, এক অজানা আতঙ্কে ও আকর্ষণে।
ক্যালিয়ন তার ঠোঁট এগিয়ে আনে অর্ষার ঠোঁটের দিকে—
দুজনের ঠোঁটের মাঝখানে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব।
কিছু সময় পর এই দূরত্ব হয়তো থাকবে না।
অর্ষা চোখ বন্ধ করে ফেলে।
সে জানে না কেন করছে এটা,
তবে করে।
এই মুহূর্তে বৃষ্টি থেমে যায়,
চারপাশে কেবল তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ।
ঠিক তখনই—
এক চমকদার বিজলির ঝলক
আকাশ ছিঁড়ে পড়ে চারদিক আলো করে তোলে।
হঠাৎ অর্ষা যেন বাস্তবে ফিরে আসে।
তাকে মনে পড়ে যায়—

এই মানুষটা আমার জীবনে হঠাৎ এসেছে। আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানি না! আর তাকে পছন্দ করি কিনা সেটাও জানিনা।
সে চোখ খুলে হঠাৎ ক্যালিয়নকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।
ক্যালিয়নের চোখে বিস্ময়,
অর্ষার চোখে কাঁপুনি।
না… না… আমি… আমি পারবো না…”
বলেই সে পেছন ঘুরে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে চলে যায় বাড়ির দিকে।
ক্যালিয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তার চোখে এবার অদ্ভুত শূন্যতা।
একটু… একটু সময় আর ছিল… red wine ।
আরেকটু দেরি হলে… এই ঠোঁট দুটো আর আলাদা থাকতো না।”
ক্যালিয়নের ভেজা চুল কপালের ওপরে লেপ্টে গেছে।
তবুও সে হাসে।
একটা ধীর বিষণ্ন হাসি…
আর ঠোঁটের কোণে ফিসফিস করে বলে—

Ti Amo, red wine … আমি তোমায় চাই… আর সেটা কোনো মানবিকভাবে নয়।
বৃষ্টির ফোঁটা এখনো ঝরছে…
আর তার ভেজা কুয়াশার ভেতর দিয়ে অর্ষার দৌড়ের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে।
পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যালিয়ন।
নড়ছে না। কিছু একটা ভেবে তার হাসিমাখা মুখটা হঠাৎ কালো আঁধারে ছেয়ে যায়,
শুধু দাঁড়িয়ে—ভেজা চুল, ঠোঁট অর্ধেক খোলা,
আর তার দুই হাত—একটা ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠছে।
তার চোখের ভেতর যে আগুন আগে ছিল শুধু আকর্ষণের,
এখন সেটি পোড়াচ্ছে… জ্বলছে… গিলে খেতে চায়।
তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে নরম কিন্তু ভয়ানক কণ্ঠস্বর,
তুমি আবার পালালে…

তুমি এখনো কি আমার থেকে ভয় পাও?
না কি আমার প্রতি তোমার আসক্তি তুমি নিজেই মানতে পারছো না?”
তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে।
তুমি কি এখনো বুঝতে পারোনি, অর্ষা?
আমি তোমাকে শুধু পছন্দ করি না…
তোমায় নিজের রক্তের অংশ মনে করি।
তুমি আমার Red Wine…
আমার আসক্তি, আমার নেশা, আমার তৃষ্ণা…
তোমাকে নিয়ে যাবই—তোমার চাওয়া না চাওয়ার কোনো মানে নেই।”
তার চোখে এখন আগুন আর রক্তের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
নীল নয়, আগুনে রঙে ছাপ পড়েছে।
এই পৃথিবী তোমায় রক্ষা করতে পারবে না red wine …
তুমি শুধু আমার।
আর আমি তোমায়—তোমার সম্মতি ছাড়াই ছিনিয়ে নেবো,
কারণ এটা ভালোবাসা না,
এটা অধিকার… এটা মালিকানা।তুমি ভালোবাসো কিংবা না বাসো আমি তোমায় নিয়ে যাবই।
তার পেছনে তখনই একটা বিশাল কালো নেকড়ের ছায়া যেন গাছের মাঝে জ্বলে ওঠে।

রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে গুমোট পরিবেশ। অন্ধকারে জ্বলছে কিছু চিরন্তন আগুনের টর্চ, যেন বাতাসটাকেও গিলে নিচ্ছে।
সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজফান। চোখ দুটো লালচে আভায় দীপ্ত। তার সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়রাক—তার নির্ভরযোগ্য পার্সোনাল রক্ষী।
আয়রাক নিচু গলায় বলে—
“বাদশাহ… আমি দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি…”
“দুই দিন হয়ে গেছে… প্রিন্স জ্যাইমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
এক মুহূর্ত, নিঃশব্দ। বাতাস থমকে যায়।
তারপর—হঠাৎ গর্জে ওঠে এক বিকট আওয়াজ!
ওয়াজফান বজ্রের মতো চিৎকার করে ওঠে—
“দুই দিন…? দুই দিন হয়ে গেছে! আর তুই আজ এসে খবর দিচ্ছিস?”
পর মুহূর্তে সে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আয়রাকের গলা চেপে ধরে। এক হাতেই তাকে টেনে তুলে ফেলে মাটির কিছু ইঞ্চি ওপরে। আয়রাকের শ্বাস রুদ্ধ হতে থাকে।

“তুই তো ছায়া! ছায়া হয়ে যার ওপর নজর রাখবি, তার খবর দুই দিন ধরে জানিস না?
তোর সাহস হয় কী করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস!
ওয়াজফান এক ঝটকায় আয়রাককে ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাজ দরবারের পাথরের মেঝেতে। একটা ধাক্কায় আয়রাকের ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ে।
তারপর সিংহাসনের পাশের গোপন খাঁজ থেকে টেনে বের করে তলোয়ার—
বিশেষ এক অস্ত্র—জিন জাতির আত্মার বিভাজক, যেটা এক কোপে যেকোনো জিনকে মেরে ফেলতে পারে। শুধুমাত্র বাদশাহ নিজে এতে পুরোপুরি মারা যায় না, তবে ক্ষত এত গভীর হয় যে দিনগুলো পর্যন্ত তার প্রাণ কাঁপে।
ওয়াজফান গর্জে ওঠে—
“আজ তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না!”
তলোয়াল উঁচু করে ছুটে যায় আয়রাকের দিকে। কিন্তু তার আগে…
আয়রাক কাতর গলায় বলে উঠে—

“বাদশা! আমি আজই খবর পেয়েছি! আজকেই! আমি দেরি করিনি…!”
“আমি যাকে প্রিন্স জ্যাইমের ছায়া বানিয়ে পাঠিয়েছিলাম—সে মাত্রই খবর দিয়েছে। আজ, এই মুহূর্তে!”
ওয়াজফানের হাত থেমে যায়। তলোয়াল স্থির, কিন্তু চোখ জ্বলছে আগুনে।
“সে কোথায়?” – ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে ওয়াজফান।
“জানি না, প্রভু। তার শেষ অবস্থান ছিল ঢাকা শহরে, বাংলাদেশে। তবে গত দুইদিনে সে ফোন বা জাদুমাধ্যমে কোনও যোগাযোগ করেনি কারো সাথে । আর তার ছায়া, ‘নিফাল’, মাত্র এক ঘণ্টা আগে আমাকে জানিয়েছে সে তাকে দেখতে পায়নি।
দুইদিন তাকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু কোথাও পায়নি তাই সে ফিরে এসে আমাকে জানায়।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে তলোয়াল নিচে নামায়। আয়রাকের গা থেকে ঘাম চুঁইয়ে পড়ে, চোখে দৃষ্টি স্থির—সে জানে, একটু আগে তার জীবন কিছু ইঞ্চির ব্যবধানে ছিল।
ওয়াজফান ধীরে বলে—
“যদি আমার ভাইর গায়ে আঁচও লাগে… তাহলে ওই ছায়াকে তো আমি এখন এমনিও মারবো, পরে তোকেও পুড়িয়ে ছাই করে দেব।
প্রাসাদের ভেতরে এক গাঢ় অন্ধকার রাজকক্ষ। বাতাস থমকে গেছে যেন। আগুনের শিখাগুলোও নিঃশব্দ, ধ্বংসের অপেক্ষায়।

ওয়াজফান দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পাথরের সিংহাসনের সামনে, হাতে ধরা সেই ভয়ঙ্কর তরোয়াল—“রুহ্-আল-জাহান্নাম”, যে তরোয়ালের এক কোপেই শেষ হয়ে যায় জিন আত্মা।
তার চোখে তখন আগুনের লাল ছায়া।
ওয়াজফান গর্জে ওঠে —
সেই ছায়াকে এক্ষুনি আমার সামনে আনো! আমি নিজ হাতে তাকে মৃত্যু দেবো… তবে তার আগে, সে যা জানে—সবকিছু আমার সামনে বলবে।
আয়রাক দ্রুত নতজানু হয়ে সরে যায়। কিছুক্ষণ পর, রাজ দরজার ছায়া ফুঁড়ে এক ছায়া-আকৃতি এসে দাঁড়ায়। মাথা নিচু, শরীর কাঁপছে। সে নিফাল—প্রিন্স জ্যাইমের পাহারাদার ছায়া, ছায়ার মতো ছায়া, যাকে নজর রাখার দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল।
ওয়াজফান এগিয়ে এসে দাঁড়ায় তার এক হাত দূরে। গলার নিচের রক্তচাপা রাগ গম্ভীর গর্জনের মতো কানে বাজে—
কোথায় ছিল জ্যাইম?
বাংলাদেশে কোন ভার্সিটিতে ভর্তি ছিল?
তারপর কী হয়েছে?
সে কাদের সঙ্গে মিশেছে? কার কাছে গিয়েছে? এক এক করে সব বল—একটু সময়ও পাস না।
নিফাল হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপা কণ্ঠে বলতে শুরু করে—
বাদশা… প্রিন্স জ্যাইম বাংলাদেশের ঢাকায় এক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল… নাম ছিল ‘ইস্টার্ন স্কাই ইউনিভার্সিটি’।

( ছদ্মনাম গল্পে এমন অনেক ছদ্মনাম আছে কেউ এগুলো খুঁজতে যাবেন না এর কোন সত্যতা নেই)
“প্রথম কদিন একা ছিল, কিন্তু এরপর এক মেয়ের সঙ্গে তার বেশ দেখা-সাক্ষাৎ হতে থাকে… নাম ইয়ানা। মেয়েটি ভার্সিটিতেই পড়ে। মডার্ন, কৌতূহলী, সাহসী…”
সর্বশেষ, আমি যেদিন তাকে দেখি, সে ওই ইয়ানার সাথেই ছিল… ক্যাম্পাসের পিছনের পার্কে কথা বলছিলো। এরপর…
এরপর… সে যেন হাওয়া হয়ে যায়। আমি অনেক খুঁজেছি, বাদশা। পুরো ঢাকা শহর, ছায়ার মত চষে বেরিয়েছি, কিন্তু কোথাও নেই। একটিও চিহ্ন… নেই…
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে শুনছে। তার চোখের মণি যেন জমাট লাল আগুনে পরিণত হয়েছে। তার ঠোঁটে এক ধরণের হিংস্র নীরবতা।
হঠাৎ—
এক মুহূর্তে সে তার তরোয়াল উঁচু করে বলে ওঠে—
“তুই ব্যর্থ। তুই বিশ্বাসঘাতক, ছায়ার নামের কলঙ্ক!”
নিফাল ফ্যালফ্যাল করে চায়—“না! বাদশা! আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছি! আমি—”
চেষ্টা ব্যর্থ হলে, ছায়া আর থাকে না—সে কেবল ছায়ার ভাঙা প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।”
এরপর,

এক ঝলক আলো, এক চিৎকার… এক কোপে নিফাল ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে। রক্ত না, কিন্তু কালো ধোঁয়ার মতো ধ্বংস হয়ে যায় তার শরীর। রাজ কক্ষে আবার নিস্তব্ধতা নামে।
ওয়াজফান তলোয়ার মাটিতে ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্বাস ভারী। চোখ বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বলে—
জ্যাইম… তুমি কী করছো…
“তুমি যদি নিজের মন দিয়ে ফেলো… তবে তুমি আর নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। এবার… আমাকে আসতে হবে।”
ছায়ার মৃত লাশটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ছাই হয়ে মানুষের লাশ দাফন করা লাগে কিন্তু জিনদের মরার পর তারা ছাই হয়ে উড়ে যায়।
রাজপ্রাসাদের শূন্য সিংহাসনকক্ষ, নিস্তব্ধ। মাত্র কিছুক্ষণ আগে একটা আত্মা ধ্বংস হয়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী এখনও বাতাসে ঘুরছে।
ওয়াজফান ঘুরে দাঁড়ায়। চোখে পুঞ্জিভূত রাগ আর অদৃশ্য এক যন্ত্রণার রেখা।
তার গলা চাপা, কিন্তু তীক্ষ্ণ,
“আয়রাক… প্রস্তুত হও। এখনই আমরা যাবো… মানবের দুনিয়ায়।”
আয়রাক মাথা নিচু করে সম্মতি জানায়, কিন্তু চোখে ছায়া স্পষ্ট। সে জানে—যেখানে ওয়াজফান পা রাখে, সেখানে আলো নিভে যায়।

ওয়াজফান নিজের ঘরে ঢোকে। দরজা বন্ধ হয় এমন শব্দে, যেন পাথরচাপা দেওয়া হয়েছে ভাগ্যকে।
এরপর একটা পোশাক পরে,
পুরো পোশাকটি গভীর কালো রঙের। এটি অন্ধকার ও মৃত্যু-সদৃশ এক ছাপ সৃষ্টি করে।
এটি একটি ঢিলেঢালা হুডি চাদর বা কালো রোব (cloak), যেটি মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো দেহ ঢেকে রেখেছে।
মাথায় হুড তোলা, ফলে মুখ অন্ধকারে ঢাকা — মুখের কোনো অংশ দৃশ্যমান নয়।
মুখে পরে একটি বিশেষ মুখোশ—যেটা চোখের নিচ থেকে শুরু করে গলা পর্যন্ত ঢাকা।
এই মুখোশটি কালো ধাতব, তার গায়ে রহস্যময় গঠন… যেন প্রাচীন কোনও অভিশাপ লেখা।
এখন শুধু ওয়াজফানের চোখ দেখা যাচ্ছে—

যেখানে আগে ছিল অগ্নি লাল আভা, এখন সেই আগুন দহনের বদলে দেখা যাচ্ছে এক জ্বলন্ত সোনালি আলো।
সেই চোখে শক্তি, রাজত্ব আর প্রতিশোধ জ্বলছে।
কিন্তু সেই সোনালি রঙটা মাত্র এক ক্ষণ—যখন রাগ চূড়ায় পৌঁছাবে, তখনই তা আবার আগুনে রূপ নেবে।
এক জোড়া চোখের মনি অথচ সময়ের সঙ্গে সেই মনির কত রং চেঞ্জ হয় নরমাল থাকে লাল রঙের রেগে গেলে তা সোনালী আর ভয়ংকর রেগে
গেলে আগুনের রং।
তার হাতে তুলে নেয় সেই ভয়ংকর তরোয়াল—”রুহ্-আল-জাহান্নাম”। তরোয়ালের তলে আগুনের রেখা জ্বলছে, যেন তার তলায়ই বিশ্রাম নিচ্ছে দহন।
আর ঠিক তখনই—

ওয়াজফান নিজের পিঠ থেকে বের করে সেই, বিশাল কালো পালকের ডানা , যা আকাশের পটভূমিতে বিশাল ও প্রভাবশালী মনে হচ্ছে।
ডানাগুলোর প্রান্ত খাড়া এবং ধারালো — যেন এক বিপজ্জনক শক্তির প্রতীক।।
একেকটা পালক যেন ধ্বংসের প্রতীক। ডানাগুলোর প্রান্ত থেকে উঠছে হালকা ধোঁয়া, আগুনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে।
চারপাশ কেঁপে উঠছে তার শক্তির ছায়ায়।
তার পেছনে আগুন জ্বলে ওঠে হঠাৎ, কোনও স্পর্শ ছাড়াই—একটা বৃত্ত যেন তৈরি হয় ধ্বংসের জন্য।
তার ঠোঁটের নিচ থেকে বের হয় চাপা উচ্চারণ—
এইবার… মানুষ জানবে, আগুন শুধু পুরে ফেলে না… আগুন বিচার করে।”
এক ঝাঁকুনিতে, বিশাল ডানা মেলে—

Death or Alive part 4

ওয়াজফান উড়ে যায়।
গন্তব্য—মানব দুনিয়া। ঢাকা শহর। ইয়ানার চারপাশে তৈরি হবে এক অদৃশ্য ঘূর্ণি।
শুরু হবে এক খেলা—ভয়, প্রেম, সত্য , জীবন আর মৃত্যু’র মধ্যকার খেলা।
এই খেলায় কে জিতবে জীবন নাকি মৃত্যু।

Death or Alive part 6

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here