Death or Alive part 6

Death or Alive part 6
priyanka hawlader

চারদিক নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ।
একটা অন্ধকার রুম—যেখানে আলো বলতে কিছু নেই,
শুধু বাতাসে জমাট বাঁধা ভয়ের গন্ধ,
আর দূরের কোথাও থেকে ভেসে আসা একটানা ছাদের ফোঁটা ফোঁটা পড়ার শব্দ।
রুমের মাঝখানে চেয়ারে বসে বাঁধা এক মেয়ে—ইয়ানা।
তার চোখ ভয়ে বিস্ফোরিত, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, মুখ থমকে আছে আতঙ্কে।
সে কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক রূপহীন, ছায়ার মত পুরুষ—
ওয়াজফান।
তার গায়ে কালো হুডি, মুখ ঢাকা অন্ধকার ধাতব মুখোশে,
তবে দুই চোখ…

দুই চোখ যেন আগুনে পুড়ে যাওয়া লাল জ্বলন্ত পাথর।
চুলগুলো তার মুখের উপর ঝুলে, একটাও শব্দ না করে সে কেবল তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে।
তার ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ রুমের নিস্তব্ধতা চিরে ফেলে—
এরপর সে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
তোমাকে আমি একটাই চান্স দিচ্ছি মানবকন্যা।
সত্যিটা বলো।
আমার ভাই, জ্যাইম, কোথায়?”
“না বললে… তোমার মৃত্যুর আগে নিজেই তোমায় চিনতে পারবে না।”
ইয়ানার গলাটা শুকিয়ে আসে।
সে বুঝে গেছে—এ লোকটা মানুষ তবে এত অদ্ভুত কেন । আর তাকে মানবকন না কেন ডাকছে,
তার কণ্ঠ, তার উপস্থিতি, চোখ… সবকিছু অমানবিক।
কিন্তু সে একইসাথে অনুভব করে, এই পুরুষটি… জ্যাইমকে ভাই বলেছে।
তাহলে কি… জ্যাইমের ভাই এই লোকটা?
(ভয়ে গলা কাঁপা গলায় ইয়ানা ফিসফিস করে…)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সে এখানে এসেছিল…বাংলাদেশের মানুষের জীবন, তাদের কালচার বুঝতে।
সে বলেছিল, তার রিসার্জ দরকার… বাংলাদেশের প্রকৃতি, মানুষের সম্পর্কে জানার ইচ্ছে ছিল।
তাই আমি ওকে মধুপুর গড়ে যেতে বলেছিলাম…
ওখানেই সে গিয়েছিল… আমি তার সঙ্গে যেতে পারিনি আমার এখানে কিছু কাজ ছিল…
তবে … আমি খুঁজেছি তাকে,
কল করেছি… কিন্তু সে যাওয়ার পর না কল ধরছে আর না কল ব্যাক করেছে।
গ্রামের সাইড হয়তো নেটওয়ার্ক ইস্যু তাই ফোন করতে পারছে না।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে ইয়ানার দিকে এগিয়ে যায়, তার কাঁপতে থাকা কপালের উপর হাত রাখে—
চোখদুটো মুহূর্তে রূপ নেয় সোনালী আগুনে।
এক ঝলকে সে দেখে ফেলে ইয়ানার মনের স্মৃতি।
তার চোখ লালচে হয়ে উঠলেও সে নিজেকে সংবরণ করে।
এক হাত ইশারা করে বলে—

আয়রাক, ওকে ছেড়ে দাও।
মানুষ হলেও, মিথ্যে বলেনি।
আয়রাক নীরবে এগিয়ে এসে ইয়ানার বাঁধন খুলে দেয়।
ওয়াজফান আর কিছু না বলেই ঘুরে দাঁড়ায়—তার চোখে এখন লক্ষ্য স্থির…
মধুপুর গড়,
সেখানে হয়তো লুকিয়ে আছে সত্যের আগুন…
বা ধ্বংসের সূত্রপাত।
ওয়াজফান নিজের থামা গর্জনের মত গলায় বলে উঠে—
“আয়রাক… মধুপুর গড়ে যাও।
এমন এক জায়গা খুঁজে বের করো, যেখানে মানুষ নেই—বা থাকলেও খুব কম।
এক ঘণ্টার মধ্যে সব রেডি চাই…
আমি তখনই বের হব।”
আয়রাক কোনো কথা না বলে মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে যায়।
তার কালো ছায়াময় দেহ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
এক ঘণ্টা পর…

অন্ধকার ঘরে আবার আগমন হয় আয়রাকের।
সে হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে দাঁড়ায়, কিন্তু মুখে একরাশ গর্ব।
বাদশা… আমি জায়গা খুঁজে পেয়েছি।
মধুপুর গড়—সেখানে বিস্তীর্ণ জঙ্গল, চারপাশে কেবল গাছ আর নীরবতা।
দিনের আলো সেই গাঢ় জঙ্গল ভেদ করে ভেতরে খুব কম ঢোকে।
আর… সেখানে একটা পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাংলো আছে।
বাইরে থেকে সেটাকে দেখতে ভয়ংকর, ভুতুড়ে মনে হয়।
লোকজন তো দূরের কথা, গ্রামের মানুষ ওখানে পা রাখতেও চায় না।
কিন্তু ভিতরে…

আমি সেটাকে আপনার জন্য একটা রাজপ্রাসাদে রূপ দিয়েছি।
ঝাড়বাতি, কালো মার্বেলের ফ্লোর, অন্ধকারে জ্বলজ্বলে আলো,
আপনার জন্য যথেষ্ট ছায়া আর শক্তিশালী রক্ষা কবচও স্থাপন করেছি।
বাইরের অবস্থা ঠিক রেখে দিয়েছি,
যেন মানুষ সন্দেহ না করে।
আপনি এখনই রওনা হতে পারেন, বাদশা।
ওয়াজফান ধীরে মাথা ঝাঁকায়, চোখদুটো তপ্ত সোনালি আভায় দীপ্ত হতে থাকে।
তার পিঠ থেকে আবার বেরিয়ে আসে সেই বিশাল কালো ডানা,
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এক শীতল আগুনের দহন।
হাওয়া ভারি হয়ে ওঠে, আকাশের মেঘ থেমে যায়।
চলো, আয়রাক।
আমরা এবার শুরু করবো আমাদের খোঁজ…
এবং ধ্বংস, যদি প্রয়োজন পড়ে।
এরপর তারা দুজনই উড়ে যায়,
চাঁদের নিচে এক মৃত ছায়ার ছায়া হয়ে…
মধুপুর গড়—বাংলার এক গভীর জঙ্গলের দিকে,
যেখানে অপেক্ষা করছে
এক রহস্য…
হয়তো… জ্যাইম-এর সঙ্কেত।

সুন্দর সকালে ঘুম ভাঙে অর্ষার,
উঠেই আগে সে ফোনটা হাতে নাই এরপর তার মুখটা কালো হয়ে যায়।
অর্ষা ফোনটা হাতে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। ক্যালিয়ন প্রতিদিন সকালে একটা মেসেজ দিত কিংবা ফোন করত— “Rise and shine, firefly.” কিন্তু আজ কোনও মেসেজ নেই, কোনও কল নেই। মনে হচ্ছে একটা শূন্যতা ঘিরে ধরেছে তাকে। কাল রাতের কথা মনে পড়ে—সে নিজেই কঠিনভাবে রিজেক্ট করেছিল ক্যালিয়নকে,
সে তাকে ধাক্কা মেরে ওভাবে ফেলে এসেছিলো। সে পিছনে তাকিয়ে দেখেছিল ক্যালিয়নের মুখটা নিঃসাড় হয়েছিল।
আর এখন, সেই নিঃসাড় ক্যালিয়ন যেন তার মনে চেপে বসেছে।
সে কয়েক সেকেন্ড হেসে নেয় নিজের ওপর—”এতটা ভাবছি কেন ওকে নিয়ে?”
তবু মনকে শান্ত করতে পারছে না। অবচেতনভাবে ফোনের স্ক্রিনে ক্যালিয়নের নাম খুঁজে পায় সে। চোখ বুজে ডায়াল করে ফেলে।
ক্যালিয়নের নাম্বারে,
কোনও সাড়া নেই।
রিং বাজছে।
তারপর—

“The number you are trying to reach is unavailable at the moment…”
ফোন কেটে যায়।
অর্ষার মুখ থমথমে হয়ে যায়। কিছু একটা গিলে ফেলার মতো লাগে গলায়।
সে বিড়বিড় করে, “ক্যালিয়ন… তুমি কি রাগ করেছো? নাকি… দূরে চলে গেলে চিরতরে?”
তার বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা গুমোট অনুভূতি জমে ওঠে। সে উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। রোদ পড়ছে, কিন্তু তার মনটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
তারপর সে ভাবে,

“আমার কি সত্যিই ওকে হারাতে খারাপ লাগবে?”
একটু থেমে মনে মনে উত্তর আসে—
হয়তো… আমি এতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি যে একজন অদ্ভুত মানুষকেও আপন ভাবতে শিখে গেছি।
এরপর ভাবে আমি কি সব ভাবছি এসব কিছুই না এত কম সময় কি কাউকে আপন ভাবা যায়। হয়তো সে আমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে, তাই একটু বেশি মিস করছি।
অর্ষা ভাবনার মাঝে,
পেছন থেকে হঠাৎ মায়ের ডাক, “অর্ষা!”
সে চমকে পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়।
মা কপালে হাত রেখে বলে,

— “কি হয়েছে তোর? আসার পর থেকেই টিং টিং করে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিস। এরপর বলবি আবার চলে যাবি। আমাদের তো একটু টাইমই দিস না!”
চোখে মায়ের হালকা অভিমানের ছায়া।
অর্ষা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ধপ করে মায়ের গলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন ছোটবেলার সেই অভ্যস্ত আশ্রয়ে ফিরে যায়।
না মা, তেমন কিছু না… তোমাকে তো বলেছিলাম না, একটা ভিনদেশী টুরিস্ট আমাদের দেশে এসেছে। আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে। এখন বলো, আমাকে ওকে হেল্প করা উচিত না?”
তার মা হেসে উঠে অর্ষার গাল টেনে বলে,
আচ্ছা ঠিক আছে জনাব। আপনি তো আপনার বাবার মতোই—সবাইকে হেল্প করবেন! তবে আজ গেলেন না কেন? প্রতিদিনই তো যান?”
অর্ষা একটু থেমে নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলে,
আজ… সে-ই তো আর… আসেনি…
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত শূন্যতা, আর চোখে মেঘ জমে।
এরপর,

অর্ষা মায়ের কাছ থেকে নিজেকে আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, মুখে একটা চাপা হাসি, কিন্তু চোখে চিন্তার ছায়া স্পষ্ট। মনে মনে ভাবে—
মা তো বুঝতেই পারলো না আমার ভিতরটা এখন কতটা এলোমেলো… ক্যালিয়ন আজ না আসায় কেন যেন কিছু একটা অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। অথচ আমি নিজেই তো তাকে ধাক্কা মেরে চলে এলাম…
সে হাঁটতে হাঁটতে ফারাজের দিকে যায়। ফারাজ—তার ছোট ভাই, সবসময় সবকিছু বুঝে ফেলে, যেন ওর চোখে স্ক্যানার বসানো।
ফারাজ দূর থেকেই বলে ওঠে,
“দিদি, তোর মুখ কেন এত গম্ভীর? ক্যালিয়ন ভাইয়ের সাথে কি হয়েছে?”
অর্ষা একটু চমকে যায়,
“তুই এসব কোথা থেকে বুঝলি?”
ফারাজ হাসে,

“ওরে বাবা, আমি তো এখনকার ছেলে। আজকাল একটা রিংটোন না বাজলে বুঝে যাই কার মন ভালো নেই। আর তোর মুখ তো পুরো নাটকের ক্লাইম্যাক্স। ক্যালিয়ন ফোন করল না?”
অর্ষা মুখ নামিয়ে ফেলে। কিছু না বললেও চোখে যেন সব উত্তর লেখা।
ফারাজ এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলে,
“দিদি, তুই কি ওকে পছন্দ করে ফেলেছিস?
অর্ষা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে না মোটেও না আমি তো শুধু বন্ধু।
অর্ষা না বললেও ফারাজ বুঝে যায় ওর মনের কথা তাই সে বলে ওঠে,
তুই সত্যি বলছিস কিনা জানিনা তবে যদি তাকে পছন্দ করিস তাহলে আর দেরি করিস না,
ভালো লাগা মানেই দুর্বলতা না। কখনো কখনো সেটাই জীবনের সাহস।
অর্ষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মনটা একটু একটু করে স্বচ্ছ হচ্ছে। এবার সে ভাবে—
যদি ওর চোখের সেই কথা সত্যি হয়, তবে ও ফিরবেই। আর যদি না ফেরে, তবে ওর মনও ছিল মিথ্যে।
তারপর সে ফারাজকে বলে,
চল, একসাথে লাঞ্চ করি। কিন্তু আগে… আমি একবার বাইরে যাচ্ছি। একটু হেঁটে আসি।

মধুপুর গড়ের সেই পুরনো বাংলোর ভিতরে গভীর নিস্তব্ধতা।
ছায়া ভেদ করে আলতো করে সূর্যের আলো ভিতরে পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু ভেতরের অন্ধকার ঘর সেই আলোকে স্পর্শ করতে দেয় না।
রাজকক্ষের মাঝখানে কালো রেশমে মোড়া এক বিশাল ছায়াচ্ছন্ন শয়নচৌকি।
সেখানে নিঃশব্দে শুয়ে আছে ওয়াজফান।
তার মুখে অদ্ভুত এক ক্লান্তি, চোখদুটো বন্ধ, কিন্তু ভুরু কুঁচকে আছে—
মনে হচ্ছে ঘুমের মাঝেও সে যুদ্ধ করছে।
রাতের ধ্বংসযজ্ঞের পরে এই প্রথম বিশ্রাম।
কাল রাতে সে এসেছিল এই বাংলোয়,
এরপর ছায়ার মতো উড়ে বেরিয়েছে পুরো মধুপুর গড়—
প্রতিটি গাছ, ঝোপ, পরিত্যক্ত রাস্তা, পাহাড়ি গুহা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে।
কিন্তু জ্যাইম কোথাও নেই।

নেই তার ছায়া, নেই তার গন্ধ…
যেন সে মাটি ফুঁড়ে গিয়েছে,
অথবা এক অজানা বাস্তবতা তাকে গ্রাস করেছে।
বেলা তখন মধ্য গড়াচ্ছে।
ওয়াজফানের চোখ ধীরে ধীরে খুলে যায়।
চোখের পাতায় জমানো ঘুমের ক্লান্তি একপাশে ঠেলে সোনালি চোখদুটো জ্বলে উঠে নিঃশব্দে।
সে উঠে বসে, মুখে আবার সেই শীতল অভিব্যক্তি,
কিন্তু ভেতরে জ্বলছে
অপ্রকাশিত ক্রোধ, হতাশা, এবং… ভয়।
সে জানে, এখন সে নিজের সবচেয়ে বড় যাদু শক্তি ব্যবহার করবে—
একটি নিষিদ্ধ, অথচ সর্বশক্তিমান জাদু
যা দিয়ে সে সময়, বাস্তবতা আর পর্দার আড়ালের চিত্র দেখতে পাবে।
কিন্তু একটাই সমস্যা…

এখনো দিন।
সূর্যের তাপ আর আলো,
যা মানবের জন্য আলো হয়ে আসে,
ওর জন্য এক বিভীষিকা।
তাই আজ আর বাইরে বেরোনো যাবে না।
শুধু অন্ধকারের অপেক্ষা।
ওয়াজফান উঠে দাঁড়ায়,
তার লম্বা পোশাকের ছায়া মেঝে ঘিরে ফেলে।
সে ধীরে হাঁটে, প্রাসাদের পশ্চিম দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়—
যেখানে কোনো আলো পৌঁছায় না।
দূরে জঙ্গলের মাঝে পাখির ডাক শোনা যায়,
মানবিক জীবনের স্বাভাবিকতা যেন তাকে ব্যঙ্গ করে।
রাত নামুক…
সে নিজেকে বলে,
রাত নামুক, আর তারপর…
এই জগতের কোন প্রান্তে জ্যাইম লুকিয়ে আছে, আমি বের করে আনব।
প্রয়োজনে, পুরো পৃথিবী ধ্বংস করবো।

একটা নরম বিকেল। জানালার ফাঁক গলে সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো ঘরের মেঝেতে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্ষা একা বসে আছে বারান্দার কোণার সেই ছোট্ট টেবিলটায়। হাতে ধরা চায়ের কাপ, কিন্তু চায়ের ধোঁয়া অনেক আগেই মিলিয়ে গেছে বাতাসে। কাপের গা ঘেঁষে ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ে তার আঙুলের ছোঁয়া — অথচ এক চুমুকও নেয়নি সে।
চোখ দুটি জানালার বাইরে, কিন্তু মন যেন কোথাও আরও দূরে—যেখানে সে নিজেই জানে না সে কিসের খোঁজে।
ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করে তার বাবা। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে দেখে বুঝে ফেলে—অর্ষা ভাবছে কিছু। কোনো অদৃশ্য ভার যেন নামিয়ে বসেছে তার কাঁধে।
বাবা এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলে, — “কি রে মা, এত মন খারাপ কিসের? বুঝেছি আমি… তোর তো এবার ফেরার সময় হয়েছে। না? এইবার তোদের না কি এক বছরের জন্য একদম ক্যাম্পে যেতে হবে, ডাক্তারি কাজের জন্য। শুনলাম জায়গাটা আবার অনেকটা গ্রামের ধারে, ফোন-নেটওয়ার্কও নাকি ঠিকমতো পাওয়া যায় না।”

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল অর্ষা। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটলেও, চোখে জমে থাকা অনুচ্চারিত কষ্টের ছায়া সেই হাসিকে ছুঁতে পারেনি।
বাবার কণ্ঠে আবারও মমতা ঝরে পড়ে, — “এইজন্যই মন খারাপ, তাই না মা?”
অর্ষা চুপচাপ থাকে। চায়ের কাপটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে, যেন সেই কাপেই জমে আছে তার না বলা সমস্ত অনুভূতি।
এরপর, তার বাবা স্নেহভরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু হাসিতে বললেন,
“যা মা, একবার ঘুরে আয় মিরাদের বাড়ি থেকে। তোর মনটা ভালো হয়ে যাবে। আর ওই যে টুরিস্ট ছেলেটা, তুই তো ওকে গাইড করছিলি… সে কি আজ আসেনি?”
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,
না বাবা, তার আজ নাকি কিছু কাজ ছিল। তাই আসেনি।
তার বাবা একটু ভেবে বললেন,
“ও আচ্ছা।”
তারপর তিনি ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
ঘরে একা বসে অর্ষা নিজেকে শক্ত করে ধরে বলল,

“আর না… আর মন খারাপ করে বসে থাকব না আমি। যদি সত্যিই আমার প্রতি তার এতটুকু অনুভব থাকত, তাহলে আজ এভাবে আমাকে ইগনোর করত না। সারাদিনে একটা বারও ফিরে তাকায়নি… একটা কথাও বলেনি। আমি জানি, আমি এখন তাকে পছন্দ করি। এটা আমার মন আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যদি আজ সে একবারও ফোন না করে … এরপর যদি আর খোঁজ না নেয়… তাহলে আমি ওর কথা ভাবা একদম বন্ধ করে দেব।”
অর্ষা উঠে দাঁড়াল। চোখে একরাশ দৃঢ়তা। নিজেকে বুঝিয়ে, গালে হালকা হাসি এঁকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মিরাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তার পায়ের ছাপ যেন বাতাসে মিশে গিয়ে বলে দিচ্ছিল—
তবে এই পছন্দটা কি শুধুই পছন্দে আটকে থাকবে নাকি ভালোবাসা হয়ে উঠবে।

সন্ধ্যার পর রাত ধীরে ধীরে নেমে এসেছে।
আকাশে ঝুলছে এক টুকরো রূপালী চাঁদ। চারদিক নিস্তব্ধ, গাঢ় সবুজ জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কুয়াশা জমে উঠছে। পাতা ঝরার শব্দও যেন এই নিঃশব্দ রাতের সুরে মিশে গেছে। আকাশের তারারা যেন আজ ক্যালিয়নের মনের মতোই অস্থির—জ্বলে আর নিভে যায়।
এক টুকরো পাথরের উপর বসে ক্যালিয়ন অপলক চেয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। চোখে গভীর চিন্তা।
আজ সারাদিন… ইচ্ছে করে আমি অর্ষা কে জ্বালিয়েছি।”
হালকা ঠোঁট চেপে ধরে ক্যালিয়ন মনে মনে বলে,
“ইচ্ছে করে ফোন ধরিনি। বারবার কল দিয়েছে, একটা কথাও বলওনি। আজ নিজে থেকে?
কিন্তু তার চোখে আছে এক শান্তি । কারণ সে জেনে গেছে —
অর্ষাও তাকে পছন্দ করে।

সে আজ সারাদিন ছিল অর্ষার আশেপাশেই—ছায়ার মতো।
দূর থেকে দেখেছে, হেঁটে গেছে তার পেছন পেছন।
অর্ষা হাসলে তার বুক কেঁপেছে, আর যখন চুপচাপ ছিল, তার চোখ ভিজে উঠেছে।
আমি জানি, ও আমায় চায়। শুধু বোঝায় না। আর এইটুকু বোঝার জন্যই আজ সারাদিন এত দূরে দূরে থাকা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে দাঁড়িয়ে পড়ে।
আর নয়… এবার দেখা করতে হবে ওর সাথে। এবার আমি সামনে যাব। সরাসরি, চোখে চোখ রেখে বলব— আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো।”
চাঁদের আলোয় তার চোখে এক রহস্যময় ঝিলিক। ধীরে ধীরে সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ—
ফুঁস করে এক তীব্র বাতাস ছুটে আসে…
ক্যালিয়নের শরীর রূপ নিতে শুরু করে—
চামড়ায় পশম গজায়, দেহ লম্বা আর সবল হয়ে ওঠে, নখ ও দাঁত তীক্ষ্ণ হয়…
সে রূপ নেয় নেকড়ে-আকৃতিতে।
তার চোখে আগুনের মতো লাল জ্বালা,
পায়ে গতি, মনে উদ্দেশ্য—

অর্ষা।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, গা ছমছমে জঙ্গলের আঁধারে সে দ্রুত ছুটে চলে অর্ষার খোঁজে—
তার ভালোবাসা, তার অভিমানী মেয়ে— অর্ষার কাছে।
চাঁদ তখন জঙ্গলের মাথার ওপর।
নেকড়ে রূপে ক্যালিয়ন দৌড়াতে থাকে কিন্তু হঠাৎ সামনে সে কিছু দেখে থেমে যায় তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সেখানে এইটা দেখবে আশা করেনি।
মধ্যরাতের জঙ্গল নিঃশব্দ।
চারদিকে গা ছমছমে অন্ধকার, মাঝে মাঝে ঝিঁঝি পোকার শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না।
প্রাসাদের অদূরে গভীর জঙ্গলের ঠিক কেন্দ্রে, এক খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজফান।
তার চোখদুটি এখন আগুনের মতো জ্বলছে—
দুই হাতে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধোঁয়াশা ধরণের জাদু-বলয়,
যার চারপাশে গাছপালা কাঁপছে, মাটি কেঁপে উঠছে।
সে উচ্চারণ করছে প্রাচীন এক মন্ত্র…

ভাষা এত পুরাতন যে মানব জাতির ইতিহাসে তার কোনো চিহ্নই নেই।
চারপাশের বাতাস ঘন হতে থাকে,
আর তার শরীরের ভেতর থেকে যেন জীবনশক্তি বের হতে থাকে।
ওয়াজফানের হাঁটু কেঁপে ওঠে…
তার গা বেয়ে ঘাম পড়তে থাকে…
কিন্তু সে থামে না।
দেখাও… আমাকে দেখাও কোথায় আমার ভাই,
ওয়াজফান ফিসফিস করে বলে।
হঠাৎ, তার চোখের সামনে খুলে যায় এক পর্দা…
সেখানে সে দেখতে পায়— এক বিশাল গুহার মতো জায়গা…
আলো-ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে আছে জ্যাইম…
তার সামনে এক রহস্যময় ছায়ামূর্তি…
ওয়াজফান তৎক্ষণাৎ বুজে যায়,
জ্যাইম কোথায় আছে আর তার সাথে কি হয়েছে।
জাদু থেমে যায়।

ওয়াজফান কিছুটা হেঁচকি খেয়ে মাটিতে বসে পড়ে,
তার শ্বাস ভারী, কপালে ঘাম, শরীর নিস্তেজ।
এই মানষের পৃথিবীতে এমন শক্তি ব্যবহার করায় তার শরীর সইতে পারছে না।
কিন্তু মুখে একরাশ নিষ্ঠুর হাসি—
আমি আসছি, জ্যাইম…
তোকে ফিরে নেব, নিজের মতো করে…”
ঠিক তখনই তার পিছনে হালকা একটা শব্দ।
ওয়াজফান ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে তাকায়—
জঙ্গলের গাঢ় ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল নেকড়ে।
রূপ যেন অস্বাভাবিক…
চোখ দুটি ঝলসে উঠছে…

Death or Alive part 5

তার শরীর কাঁপে না, নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছে…
কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, এ কোনো সাধারণ জন্তু নয়।
ওয়াজফানের চোখ একচিমটে ছোট হয়ে আসে।
সে ফিসফিস করে বলে,
“তুই…?”

Death or Alive part 7

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here