Death or Alive part 8

Death or Alive part 8
priyanka hawlader

একটা সুন্দর সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে অর্ষার ঘুমঘুম মুখে এসে পড়ে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে জানালার পর্দা একটু একটু নড়ে ওঠে। দূরে কোথাও পাখির ডাক শোনা যায়, যেন প্রকৃতি নিজেই তাকে জাগিয়ে দিচ্ছে।
অর্ষা ধীরে ধীরে চোখ মেলে, হালকা আলস্যে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। তারপর হঠাৎ কী মনে পড়ে, পাশে রাখা ফোনটা হাতে নেয়। স্ক্রিনে একটা নতুন মেসেজের নোটিফিকেশন। চোখ পড়ে প্রেরকের নামের দিকে—”Kallion”। নামটা দেখেই তার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে যায়, মনে একটু অন্যরকম উত্তেজনা। কিন্তু মেসেজটা খুলেই সেই হাসি মিলিয়ে যায় ধীরে ধীরে।

“আমি ঢাকায় যাচ্ছি। একটু জরুরি দরকার। দু’দিনের মধ্যেই ফিরে আসব। তারপর তোমার সাথে আমার অনেক ইম্পর্টেন্ট কথা আছে।
অর্ষা ফ্রেমে জমে থাকা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে। কিছু একটা যেন বুকের মধ্যে কুঁচকে ওঠে। অনেক ইম্পর্টেন্ট কথা আছে—এই কথাটার মধ্যে যেন অস্পষ্ট একটা ইঙ্গিত, একটা অনিশ্চয়তা, আবার যেন গভীর কিছু লুকানো।
সে ভাবে—”ক্যালিয়ন কী এমন ইম্পরট্যান্ট কথা বলবে? সে কি আমায় প্রপোজ করবে?”
মনে হঠাৎ ভেসে ওঠে সেই রাতের কথা, যখন ক্যালিয়ন হঠাৎ করে বলেছিল,
“Ti Amo.”
আর তার প্রশ্নের জবাবে ক্যালিয়ন হেসে বলেছিল,
“গুগল করো, বুঝে যাবে।”
তখন তো সে মজা ভেবেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আজ… আজ কেন জানি মনে হলো, ওই কথাটার মধ্যেই যেন ছিল এক চাপা ভালোবাসার স্বীকারোক্তি।
সে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে গিয়ে গুগলে টাইপ করে—
“Ti Amo meaning.”
ফলাফল আসে একটাই—
“I love you.”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার চোখ বড় হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে এক লাজুক হাসি জমে ওঠে। নিজের অজান্তেই সে ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে। একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস পড়ে তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।
সে ভাবে—”তাহলে ক্যালিয়ন আমার অনুভবগুলো টের পেয়েছিলো? আমার অপেক্ষাতেই ছিল? আর আমি এতদিন বোকার মত কিছুই বুঝিনি?”
অর্ষা বিছানায় বসে পড়ে, জানালার বাইরে সূর্যের আলোয় চোখ রাখে। ঠোঁটে তখনো সেই মিষ্টি হাসি।
“আমি অপেক্ষা করবো… আপনার,”
সে আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, তারপর চোখ বন্ধ করে যেন অনুভব করে সেই মুহূর্তটাকে—যখন ক্যালিয়ন ফিরে এসে বলবে তার বহু প্রতীক্ষিত সেই কথাটি, এই রোদ ঝলমলে সকালের মতোই উজ্জ্বল ভালোবাসার স্বীকারোক্তি।
চোখে তখন শুধুই স্বপ্ন… ক্যালিয়নের সঙ্গে আগামী দিনের…

দূরের জঙ্গলের ঘন ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল ক্যালিয়ন। অন্ধকারে আড়াল হয়ে সে এতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অর্ষার দিকে—তার চোখের লাজুক চাহনি, বাতাসে দুলতে থাকা চুলের আলতো কম্পন, আর নিঃশব্দ হাসির কোমলতা। যেন সমস্ত অরণ্য থমকে আছে, শুধুই তাকে দেখার জন্য।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে নরম, কিন্তু দৃঢ় স্বরে ক্যালিয়ন বলল,
“আমি আবার আসবো। এবার একা না… তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাব।”
তার চোখে ছিল অদ্ভুত এক প্রতিজ্ঞা।

“আজও চলে যেতে পারতাম না, যদি না আমার রাজ্যে আমার শত্রু প্রবেশ করত। আমাকে যেতে হচ্ছে, কারণ দায়িত্ব আমাকে ডাকছে। আর… আমার শরীরের ক্ষত—আমি চাই না তুমি আমাকে দুর্বল অবস্থায় দেখো। আমি ফিরে আসবো, আরও শক্তিশালী হয়ে। শুধু তোমার জন্য।”
কিছুটা থেমে সে যেন নিঃশ্বাস নিলো অর্ষার উপস্থিতির গন্ধে ভরে। তারপর চোখ সরিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“দুইদিন পর… ঠিক দুইদিন পর, আমি ফিরে আসবো। আজ শুধু দেখতে এসেছিলাম তোমার মুখের সেই লাজুক হাসিটা, যা আমাকে বারবার টানে… আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি। এবার আমি শান্তিতে যেতে পারি, তবে খুব বেশি সময়ের জন্য নয়।”
হঠাৎ পিছন থেকে এক কণ্ঠ ভেসে এলো—

“লর্ড ক্যালিয়ন, আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
ক্যালিয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল, দাঁড়িয়ে আছে তার বিশ্বস্ত সহযোগী, ড্যানিয়েল—যে সবসময় তার ছায়ার মতো পাশে থাকে।
একবার অর্ষার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে ক্যালিয়ন ধীরে বলে উঠলো,
“চলো, ড্যানিয়েল।”
পরক্ষণেই তাদের শরীর আচ্ছন্ন হয়ে গেল ঘন কালো কুয়াশায়। ক্যালিয়নের চোখে তখনো এক ঝলক আলো—যা শুধু অর্ষার জন্যই জ্বলছিল। মুহূর্তে তাদের দেহ রূপ নিল বিশাল নেকড়ে রূপে। ঝাঁপ দিয়ে তারা মিলিয়ে গেল গভীর অরণ্যের অন্ধকারে—শুধু পেছনে রয়ে গেল এক নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি।

নিজের বিশাল এক গাঢ় লাল ছায়াময় রুমে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজফান কায়াস্থ। দেয়ালে ঝুলে থাকা আগুনে ভেসে ওঠা ছায়াগুলো যেন তার ভেতরের আগুনের প্রতিবিম্ব। তার চোখ দুটো লালচে হয়ে আছে, আর ঠোঁট কাঁপছে ক্ষোভে।
তার আঙুলগুলো অসহ্য রাগে নিজেই ঘুরিয়ে চলেছে — যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুর গলা টিপে ধরছে।
নিজের মনে ফিসফিস করে বলে,
“কাল রাতে মেরে ফেললেই ভালো হতো…
ও সেই সাধু থেকেও ভয়ংকর।
ও তো কালো জাদুর অন্য রকম রূপ — হাসি, চোখ, ঠোঁট… এখনও আমার চোখের সামনে ঘুরছে।
এই আমি, ওয়াজফান কায়াস্থ, ঘুমাতে পারিনি সারারাত।
ও আমার উপর কী করেছে?”
তার চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায়।

“She is a little monster.
দেখতে ছোট… কিন্তু আচরণ? একটা ভয়ংকর মনস্টার!
Damn that witch!
ওয়াজফান তর্জনী তুলে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলে ওঠে,
কোন যাদু জানে সে? আমার মন, আমার চিন্তা, আমার মস্তিষ্ক… সব সে বশ করে নিয়েছে!
ইচ্ছে করে করেছে! That little devil dared to enchant me?!
আমি কি এতটাই দুর্বল মনে করল?
এরপর বাসায় এসে বলে হু দুর্বল মানব কন্যা।
এক মুহূর্ত থেমে আবার গর্জে ওঠে,
“তার সেই চোখ দুটো যদি আবার আমার সামনে আসে…
I swear I will kill her. একদম ছিন্ন করে ফেলবো!
আমার উপর কালো জাদু? ওয়াজফান কায়াস্থের উপর?!”
হঠাৎ রাগ চেপে ধরে তার শিরা উপশিরাগুলো। নিজেকে সামলাতে এক গভীর নিঃশ্বাস নেয় সে।
নিজের ভেতরের আগুনকে অন্যদিকে ঘোরাতে, সে এক ইশারায় আয়রাক কে ডাক দেয়।
আয়রাক ছুটে আসে।
ওয়াজফান গম্ভীর গলায় বলে,

আজ রাতেই ওই গুহায় সাধু আসবে। সব প্রস্তুত কর।
আমি কিছুক্ষণ জাদুশক্তি চর্চা করতে চাই —
রাতের অন্ধকারে আমি তার শ্বাসরোধ করবো।
আমার ভাই জ্যাইম কে নিয়ে আসবো —
তারপর আমরা আমাদের জগতে ফিরবো।
আয়রাক ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায়।
ওয়াজফান আবার বলে ওঠে,
এই জগতটা এখন ভয়ংকর হয়ে গেছে।
এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে একের পর এক মনস্টার —
কিন্তু আমি ভুলে যাইনি কে রাজা।
আজ রাতে, একটা মনস্টার কমে যাবে।”
তার মুখে এক রহস্যময় হাসি।
হয়তো কারও মৃত্যুতে… অথবা কারও অভিশাপে… সে খুঁজে নিচ্ছে নিজের মুক্তি।

আকাশছোঁয়া এক বিশাল পাহাড় — তার নাম দামভান্দ। যেন মেঘের গায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে কোনো অতীতের দৈত্য। তার চূড়ায় সারা বছর বরফে মোড়া, কিন্তু নিচের ঢালে সবুজ বনানীতে ভরা প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য। দামভান্দ শুধু একটি পাহাড় নয়—এ যেন এক জীবন্ত ইতিহাস, এক প্রাণবন্ত অস্তিত্ব, যার প্রতিটি পাথরে, প্রতিটি শিলায় লুকিয়ে আছে হাজার বছরের গল্প, হারিয়ে যাওয়া রাজ্য, আর নিঃশব্দে উচ্চারিত অভিশাপ।
এই পাহাড়ের গায়েই গড়ে উঠেছে এক বিস্ময়কর রাজ্য—নিকারো।
নিকারো, যার মানে “আলোকের নিবাস”, সেই রাজ্য যেন পৃথিবীর বুকে এক লুকিয়ে থাকা নরক । চারপাশে দামভান্দ পাহাড়ের প্রাকৃতিক প্রাচীর, মাথার উপর খোলা আকাশে উড়ে বেড়ায় রুপালি ডানার অচেনা পাখিরা, আর রাজ্যের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে এক অগ্নিসদৃশ প্রাসাদ—অর্দালুন দুর্গ, যেটা বলে দেবতারা নিজের হাতে নির্মাণ করেছিলেন।

নিকারোর মাটি সোনার মতো উর্বর, নদীগুলো কাঁচের মতো স্বচ্ছ, আর রাতগুলো—ওহ, রাতগুলো
ভয়ংকর কাহিনীতে ঢাকা।
এই রাজ্যে প্রতিটি বসন্তে পাহাড়ি ফুল ফুটে একসঙ্গে—সাদা, নীল, বেগুনি আর রক্তলাল। এবং যখন দামভান্দ থেকে নেমে আসে কুয়াশা, তখন পুরো নিকারো রাজ্য ঢেকে যায় এক প্রাক-ঐতিহাসিক রহস্যে। কারো চোখে সে কুয়াশা শান্তির প্রতীক, আবার কারো চোখে — সেই পুরোনো যুদ্ধের পূর্বাভাস।
সেই পাহাড়ে সবুজে ঘেরা এক বিস্তৃত উপত্যকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল এক রাজপ্রাসাদ — কালো আর সবুজ রঙে মোড়া এক ধ্বংস পুরী। দূর থেকে দেখলেই মনে হয় যেন গাঢ় সবুজ অরণ্যের বুক চিরে উঠে আসা এক কালো পাথরের রাজার রাজত্ব।

প্রাসাদের মূল ফটকটি বিশাল এবং আকর্ষণীয়। কালো লোহার ফ্রেমে সবুজ লতাপাতা আঁকা। ফটক খুলতেই দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল সবুজ মার্বেলের সিংহমূর্তি যেন আগন্তুকদের অভ্যর্থনা জানায়।
ফটক পেরিয়ে পাথরের পথ ধরে কিছুদূর এগোলেই দেখা যায় এক বাঁকানো সিঁড়ি, যা গিয়ে মিশেছে প্রাসাদের মূল দরজায়। সিঁড়ির ধাপগুলো কালো পাথরে তৈরি এবং মাঝখানে চলার অংশে রয়েছে সবুজ গালিচা। প্রতিটি ধাপে ধাপে বসানো রয়েছে ঝকঝকে সবুজ রত্নপাথর।

ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে একটি বিশাল হলঘর। ছাদ থেকে ঝুলছে সবুজ কাঁচের ঝাড়বাতি, যার আলো পড়ছে চকচকে কালো মার্বেল ফ্লোরে। চারপাশে কালো কাঠের আসবাব, সবুজ মখমলে মোড়া। দেয়ালে ঝোলানো আছে পুরনো রাজাদের প্রতিকৃতি, সবগুলোতেই রয়েছে কালো-সবুজের মিশ্র রঙ।
প্রাসাদের পশ্চিম দিকের একটি গোপন করিডোর পেরিয়ে পৌঁছানো যায় রাজকীয় বেডরুমে। এই ঘরটির রঙই যেন রহস্য আর ঐশ্বর্যের মিশ্রণ। বিছানা বিশাল, মাথার দিকে সবুজ মখমলের ছাউনি, আর কাঠামোটা ঘন কালো কাঠের। জানালার পর্দাগুলো সবুজ রেশমে তৈরি, তাতে সূর্যের আলো পড়লে ঘরটা এক রহস্যময় আলোয় ঝলমল করে।
বেডরুমের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যালকনি থেকে দেখা যায় পুরো বাগান ও আকাশ। সবুজ লতায় মোড়া এই ব্যালকনির রেলিংটি কালো ধাতুর তৈরি। রাতে এখান থেকে আকাশের তারা ও নিচের ঝর্ণার শব্দ একসাথে শোনা যায়।

হঠাৎ,
রাজপ্রাসাদের বিশাল ফটক খুলে গেল গম্ভীর শব্দে।
ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে এক ভয়াল অথচ অভিজাত অবয়ব — ক্যালিয়ন।
তার গায়ে রয়েছে কালো ও রক্তরঙা মিশ্রণের এক দীর্ঘ রাজপোশাক, যেটা যেন সিল্ক ও ছায়ার মিশেলে তৈরি। পোশাকের নিচের অংশটি মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে, যেন এক অদৃশ্য অন্ধকার তার পথ চিহ্নিত করছে।
বুকের ঠিক মাঝখানে রক্তে আঁকা এক রহস্যময় নেকড়ে প্রতীক — আগুনের মত দীপ্তিমান।
হুড লাগানো, কাঁধে নেকড়ের চামড়ার বর্ম, আর ঘাড়জুড়ে ধূসর পশম। হালকা বাতাসে রাজপোশাকের প্রান্ত কাঁপছে, যেন বিদ্রোহী আত্মারা তার পাশে হাঁটছে।

তার ডান হাতে জড়ানো রক্তরঙা চামড়ার বেষ্টনী, আর বাঁ হাতে ধাতব আংটি যার পাথরটি কালো হলেও মাঝে আগুনের মতো লাল আলোর ঝলক দেখা যায়।
তার দুপাশে দুই বিশাল নেকড়ে—
একটি কালো, চোখ দুটো আগুনের মত টকটকে লাল, তার নাম “ভলরন”
আরেকটি সাদা, বরফের মত রঙ, চোখ দুটো নীলাভ বরফের মতো, তার নাম “ইস্মির”।
দুজনেই মাথা নিচু করে ক্যালিয়নের সঙ্গে চলেছে, নীরব কিন্তু ভয় জাগানিয়া ভঙ্গিমায়। পুরো রাজপ্রাসাদ যেন তাদের পায়ের শব্দে কেঁপে উঠছে।

সামনে বিশাল পাথরের তৈরি সিংহাসন— কালো ও রক্তরঙা মার্বেলের তৈরি। তার চারপাশে খোদাই করা আগুন, নেকড়ে ও ছায়ার প্রতীক। সিংহাসনের পেছনে বিশাল জানালা, যেখান দিয়ে দামভান্দ পাহাড়ের রক্তাভ সূর্যরশ্মি ভিতরে পড়ছে।
ক্যালিয়ন ধীরে ধীরে গিয়ে বসে পড়ে সিংহাসনে।
তার বসার সঙ্গে সঙ্গে পুরো প্রাসাদে যেন বিদ্যুৎ কাঁপলো, বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো তীব্র অদৃশ্য শক্তির তরঙ্গ।
সিংহাসনের ডান ও বাম পাশে দাঁড়ানো দুই বিশাল দেহের অন্ধ সাদা যোদ্ধা। মুখ ঢাকা কালো মুখোশে, যেটাতে খোদাই করা রহস্যময় প্রতীক।
তাদের বর্ম রক্ত-কালো ধাতুর তৈরি, এবং তারা হাতে ধরে আছে বিশাল দ্বিমুখী কুঠার।
তারা কোনো প্রাণী নয়, যেন ছায়া থেকে জন্ম নেয়া রক্ষাকবচ।
ক্যালিয়ন সিংহাসনের বসার পর দেখা যায় —তার চোখে আগুনের মতো ঝলকানি। এক হাতে সিংহাসনের বাহু আঁকড়ে ধরে রাখে, আর অন্য হাতে তার লম্বা রাজদণ্ডটা শক্ত করে ধরে থাকে। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে যেন পুরো রাজ্যটাই তার পায়ের নিচে।

তার গলা গম্ভীর, অথচ তীক্ষ্ণ। রাজপ্রাসাদের উচ্চ ছাদে সেই গলা প্রতিধ্বনিত হয়—
আমাকে ছাড়া তোমরা এইটুকু কাজও করতে পারো না!
তার চোখ রক্তাভ আলোয় জ্বলছে, যেন শত্রুর রক্ত চায় এখনই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নেকড়ে—একটি কালো, আরেকটি ধূসর—তার গর্জনের সাথে সাথে নিচু গলা করে গুঁজন দেয়।
“এত ছোট বিষয়ে আমাকে তলব করতে হয়! আমার সবচেয়ে বড় ইম্পরট্যান্ট কাজ থেকে তোমরা আমাকে ছিঁড়ে এনেছো?”

সে উঠে দাঁড়ায় অর্ধেক—তার রাজপোশাক ধীরে ধীরে নামতে থাকা অন্ধকার মেঘের মতো মাটি ছুঁয়ে দেয়।
“একটা সামান্য শত্রু রাজ্যে ঢুকেছে আর তোমরা কেউ কিছু করতে পারোনি! কতটা অক্ষম হলে তোমরা এমন অপদার্থ হতে পারো!
তার কণ্ঠ ধীরে ধীরে আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
“তোমাদের সবাইকে মেরে আমি একাই অনেক আগেই এ রাজ্য সামলালে ভালো করতাম। সেই দিন আসছে…
সে থেমে যায়। তার ঠোঁটে হালকা, অতি হিংস্র এক বিদ্রূপের হাসি।

তার কাঁধে কালো রঙের ভারী রাজ-ক্লোক, যার প্রান্তজুড়ে রক্তরঙা পাড়, যেন আগুন আর ছায়ার মিশেল। বুকজুড়ে চকচকে রুপালি চেইনে আটকে থাকা একখানা সিংহ-আকৃতির ব্রোচ। তার পোশাকের আঁচল মেঝেতে লেপ্টে পড়ে যেমনভাবে রাতের আঁধার মুড়ে ফেলে জমিন। হাঁটার সময় পোশাকের ভাঁজে ছায়া যেন প্রাণ পায়।
দু’পাশে দাঁড়ানো সেনাপতিরা মাথা নিচু করে আছে, মুখ শুকিয়ে গেছে। কেউই চোখ তুলে তাকাতে পারছে না ক্যালিয়নের দিকে।
তখনই কালো নেকড়েটা একটু সামনে এগিয়ে যায়, যেন বুঝিয়ে দেয়—এই রাজার রাগ আরেকটু বাড়লে রক্তপাত অনিবার্য।

সবাই স্তব্ধ, নিঃশব্দ। কেউ কিছু বলে না।
তখনই ক্যালিয়ন উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে বিরক্তি।
তোমাদের নাটক শেষ হলে আমাকে জানিও,
সে বলে, আর তার লাল-কালো রাজচাদর বাতাসে উড়তে উড়তে প্রাসাদের পেছনের করিডোরের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যালিয়ন। তার গায়ের জামাটা ছিঁড়ে গেছে,সে নিজেই ছিড়েছে বুকের ডান পাশে লম্বা একটা আঁচড়ের দাগ। গভীর, তবুও ভয়ংকর সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তার ফর্সা ত্বকের উপর। সে ধীরে ধীরে সেখানে হাত রাখে… আঙুলের ডগা দিয়ে ক্ষতের কিনারা ছুঁয়ে দেখে, আর ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত মুচকি হাসি।
যন্ত্রণায় তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু চোখে যেন আগুন—ভালোবাসা আর প্রতিশোধের আগুন।
ক্যালিয়ন হালকা গলায় বিড়বিড় করে বলে,

“তোমার দেওয়া প্রথম ছোঁয়া… আহ্… কতটা যন্ত্রণার, কিন্তু তবুও কতটা মধুর!”
তার ঠোঁটের কোণে হাসিটা আরও গভীর হয়।
“তুমি তো জানতেই না… নেকড়ে রূপে সেখানে আমি ছিলাম… জানবেই বা কিভাবে? নিজের হাতে আমাকে আঘাত করলে, আমার শরীরে দিলে এমন এক দাগ… যা কখনও মুছে যাবে না।”
তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, স্মৃতির ঝাপটা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেদিনের সেই মুহূর্ত—অন্ধকার জঙ্গলে তার প্রিয়জন যখন ভয় আর বিভ্রান্তিতে ছুরি চালিয়ে দেয় এক ভয়াল ছায়ার উপর, বুঝতেই পারেনি ছায়াটাই ছিল তার ক্যালিয়ন।
সে আবার ক্ষতের উপর হাত রাখে। যেন সেই যন্ত্রণা তার ভালোবাসাকে আরও গভীর করছে।
“তুমি ভয় পেয়েছিলে আমাকে… তাই আঘাত করেছিলে। কিন্তু জানো? তোমার ভয়ও আমি ভালোবাসি,” সে ফিসফিস করে বলে।

এই দাগ আমার গর্ব… কারণ এটা তোমার দেওয়া।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে চোখ বন্ধ করে, নিজের মধ্যে ডুবে যায়। বাইরে এক ঝলক বাতাস হুহু করে জানালা কাঁপিয়ে দেয়, যেন প্রকৃতিও তার সেই নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা শুনতে পায়।
এই দাগ শুধু শরীরে নয়, হৃদয়ে রেখেছো তুমি। আর আমি সেটা সারাজীবন বয়ে নিয়ে যাবো… হোক না তা যন্ত্রণায়, কিন্তু তবুও—ভালোবাসায়।
তার গভীর চিন্তার মধ্যে হঠাৎই ঘরে প্রবেশ করে একজন ডাক্তার। তার চোখে-মুখে এক ধরনের স্থিরতা, তবে চাহনিতে আছে কিছুটা ভিন্নতা—যেন সে সাধারণ মানুষ নয়, বরং তাদেরই মত, কোন এক রূপান্তরিত নেকড়ে। ডাক্তারকে ক্যালিয়নই ডেকেছে।
ডাক্তারের চোখ পড়ে ক্যালিয়নের ক্ষতস্থানে। সে কাছে এসে কিছু বলতে যাবার আগেই ক্যালিয়ন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে,

যা করার জলদি করো। আমার ফিরে যেতে হবে।”
তার চোখে ছিল ধৈর্যের সীমারেখা, অথচ ঠোঁটে এক প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারির রেখা।
দুই দিন সময় দিলাম। এর মধ্যেই এই ক্ষত যেন শুকিয়ে যায়। তবে…” ক্যালিয়ন এক মুহূর্ত থেমে নিজের নখের দাগে ছেঁড়া বুকের অংশে হাত রেখে মুচকি হাসে, “পুরোপুরি সারাতে হবে না। এটুকু থাক… তার ভালোবাসার প্রথম দাগ হিসেবে।”
তার কণ্ঠের টান যেন যন্ত্রণার মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পায়। একটা ব্যথা, যা সে রাখতে চায়, মুছে ফেলতে নয়।

বিকেলের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো মধুপুর জঙ্গলের গায়ে। দূরের পাহাড়ের শিখর ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঘের গলা। ঝিরঝির বাতাসে শিরশিরে একটা শীতলতা ছড়ায়, আর সেই বাতাসে ভেসে আসছে নাম না জানা বুনো ফুলের গন্ধ।
অর্ষা আর মীরা ধীরে ধীরে হাঁটছিল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। বহুদিন পর ওরা একসাথে বেরিয়েছে জঙ্গলে হাঁটতে , তাই কথা আর হাসির তোড়ে হারিয়ে গিয়েছিল দুজনেই। ছোটবেলার কথা মনে করতে করতে তারা দুজন হাত ধরে এগোতে থাকে, গাছের ডালে ঝুলতে থাকা লতাগুল্মের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো যেন সোনার মতো ঝরে পড়ছিল।
হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই অর্ষার চোখ আটকে যায়।

মীরা… ওইটা কি মনে আছে?” অর্ষা হঠাৎ থেমে যায়।
মীরাও থেমে দাঁড়ায়। চোখ বড় বড় করে চেয়ে বলে, “ভূত বাংলো?”
ওদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেই পুরনো ভাঙাচোরা প্রাসাদের মতো দেখতে বাড়িটি—যেটাকে ছোটবেলায় সবাই ‘ভূত বাংলো’ বলে ডাকত। ইটের দেওয়ালজোড়া সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে গেছে, ছাদের একপাশ ধ্বসে পড়েছে, আর জানালাগুলো যেন শতাব্দীর পুরনো নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে।
অর্ষা ছোটবেলায় সত্যিই বিশ্বাস করত এই বাড়িতে ভূত আছে। কিন্তু এখন? সে তো একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী, সাইন্সে বিশ্বাস করে, বাস্তবতায় দাঁড়ায়।

সে মৃদু হাসে।
ভয় পেলে হবে না, আমি একজন হবু ডাক্তার। ভূত-প্রেত এসব তো গাঁজাখুরি।
মীরা কাঁপা গলায় বলে, তবু তো ভয় করে… জানিস তো, অনেক গল্প শোনা যায় এই বাড়ি নিয়ে।
অর্ষা কিছু না বলে সামনে এগোয়। পা ফেলার সাথে সাথে শুকনো পাতার মচমচে শব্দ আর দূরের পাখির ডাক—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
তার চোখে এখন কৌতূহল, ভয় নয়। বিজ্ঞান তাকে শিখিয়েছে প্রত্যেক রহস্যের পেছনে থাকে একটা যুক্তি।
সে ভাবল, “একবার এই বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখিই না কী আছে আসলে।”
ধীরে ধীরে বাড়ির দরজার দিকে পা বাড়ায় অর্ষা।

মীরা ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, বলে, “তুই পাগল নাকি? একা একা যাচ্ছিস?
আরে ভয় পাচ্ছিস কেন কিছু নেই এটার মধ্যে আর তুই না যেতে চাইলে এখানে দাঁড়া আমি ভিতর থেকে আসছি।
এরপর অর্ষা হেসে বলে, “যদি ভূত থাকে, তাহলে আমার প্রথম প্রশ্ন হবে, তার মেডিকেল ইতিহাস কী!”
আর সেই বলে সে হাত রাখে ধুলো জমা লোহার দরজার ওপরে।
দরজাটা হালকা ঠেলা দিয়েই এক কর্কশ শব্দে খুলে যায়…

ভেতরটা অন্ধকার, ঠান্ডা আর ঘামে ভেজা পুরনো ইটের গন্ধে ভর্তি। জানালার ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো এসে মেঝেতে পড়েছে। অর্ষা ভেতরে এক পা বাড়াতেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন টক করে একটা শব্দ হয়।
কে সেখানে?” অর্ষা চমকে বলে।
কোনো উত্তর নেই।
শুধু এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো—কেউ যেন তাকে দেখছে। ঘন ছায়ার ভেতর থেকে একজোড়া চোখ… জ্বলজ্বলে, নিঃশব্দ।
হাত কাঁপে, কিন্তু সে পা সরায় না। বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন ধ্বনি তুলছে, কিন্তু চোখে ভয় নেই, বরং… রহস্যে ঢোকা এক সাহস।

অন্ধকারের দিকে তার চাহনি, দরজার ফ্রেমে তার ছায়া, আর পেছনে অস্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকা… কেউ একজন?
অর্ষা পিছন ফিরে তাকায়, তবে দেখতে পায় না কিছুই। চারপাশ নিস্তব্ধ, হাওয়ার হালকা একটা সোঁ সোঁ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। সে ধীরে ধীরে ভিতরে পা বাড়ায়।
ভেতরে ঢুকে সে যেটা দেখতে পায়, তাতে তার চোখ কপালে উঠে যায়।
ভূত বাংলো, যার বাইরে থেকে মনে হয় একটা পুরোনো ধ্বংসপ্রায় ভয়ংকর বাড়ি, তার ভেতরটা যেন একেবারে উল্টো। যেন কোনো রাজপ্রাসাদ। চারপাশ ঝকঝকে, উজ্জ্বল আলোয় মোড়া। কারুকার্যময় দেয়াল, সোনালী রঙের পর্দা, ঝাড়বাতির আলোয় ঝকমক করছে প্রতিটি কোণা। যেন কোনো রাজা এখানে বসবাস করেন!
অর্ষা থমকে দাঁড়িয়ে ভাবে—এই ভূত বাংলোর ভিতরটা এমন কিভাবে হলো? কে করে এমন সাজালো?
সে ধীরে ধীরে আরও এগোতে থাকে।

হঠাৎ, একটা রুমে তার চোখ যায়।
রুমটার দরজা আধা খোলা। ভিতরে ঝাপসা আলো। আর সেখানে—কেউ একজন বসে আছে।
লোকটা চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে রয়েছে। নিঃশ্বাসের ধ্বনি ছাড়া কোনো নড়াচড়া নেই।
অর্ষার কৌতূহল বাড়ে। সে ধীরে ধীরে লোকটার কাছে এগিয়ে যায়… নিঃশব্দে… খুবই সাবধানে…
কিন্তু সে যখন ঠিক লোকটার সামনে পৌঁছায়—
লোকটা এক ঝটকায় তার গলা চেপে ধরে দেয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
অর্ষা চোখ বড় বড় করে তাকায় লোকটার দিকে। দেখতে পায়—সেই লাল মনি… সামনে ঝুলে থাকা চুল…
তার মনে পড়ে যায়—কাল রাতেই তো এই লাল মনির লোকটিই কে সে বাঁচিয়ে ছিল!
রাতে তো মুখে মাক্স পড়া ছিল

তবে আজ… আজ আর মুখে কোনো মাস্ক নেই।
তবে চোখ আর চুল দেখেই সে নিশ্চিত—এটাই সেই লোক।
আর মুখটা?
আরো বেশি সুন্দর…
চোখে তো সে হারিয়েই গিয়েছিল…
মুক্তার মতো সুন্দর…
নূরের মতো উজ্জ্বল…
তার ভাবনার মাঝে হঠাৎ লোকটা হাতের চাপ বাড়ায়।

Death or Alive part 7

তার গলায় ব্যথা লাগে।
অর্ষা ছটফট করে, চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে…
কিন্তু পারছে না।
চাপ বাড়তেই থাকে…
আরও জোরে… আরও গভীরে…
এবার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

Death or Alive part 9

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here