Love Triangle part 11
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা
রাতের বেলা এগারোটার দিকে বাড়ির ইয়ং জেনারেশনের সবাই খেতে বসেছে। আমি ইফাদ ভাইয়ার চেয়ারের পাশে দাড়িয়ে আছি। সন্ধ্যা থেকে রুম লক করে বসেছিলাম।ভাইয়া বহু সাধ্যসাধনা করে বাইরে নিয়ে এসেছে খাওয়ার জন্য। আমি এসেছি ঠিকই কিন্তু চেয়ার নিই নি। ভাইয়ার পাশে দাড়িয়ে রইলাম।রিমি আপু ও বসেনি। আমি নিচে আসার পর কয়েকবার এসেছে কাছে কিন্তু টোটালি ইগনোর করেছি সেজন্য এখন একটু দূরে নানার সাথে বসে আছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড় মামী এসে বললেন,
‘ আহি বসতেছিস না কেন?খাবি না?’
আমি মাথা নাড়লাম।মুখে বললাম,
‘ আমার খুব মাথাব্যথা করছে মামী।বলছি ঘুমাব তারপরও ভাইয়া জোর করে তুলে এনেছে।তোমরা সবাই আমার সাথে এমন কেন করো বলো তো? সবসময় হুকুম করো,জোর খাটাও। নিজেদের যা মনে হয় তাই করো।আমার কি নিজের মন মর্জি বলতে কিছু নেই?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মামী আমার প্রশ্নে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন।সবার খাওয়া থেমে গেছে অলরেডি। আমি আর দাঁড়ালাম না। একরকম ছুটে গেলাম দোতলায়। আরিফিন ভাইয়া সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। আমি নিজের রুমে এসে আবার দরজা লক করলাম। বেডে শুয়ে পড়লাম রুমে ঢুকেই।বেশ কঠিন কথা বলে এসেছি। কি করব? প্রচুর রাগ হচ্ছিল সবার উপর।রিমি আপু, ক্যাপ্টেন সাহেব আর ডাক্তারের উপর যেই রাগ জমেছিল সেই রাগ আমি এদের সবার উপর ঝাড়লাম যেন। বিকেল থেকে এত সময় পেরিয়ে গেল আমার মনে যেই ক্ষত টা সৃষ্টি হয়েছে তার এতটুকু ও কমছে না। আমি শোয়া থেকে উঠে বেডের সাথে লাগোয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মিনিট মত পর দরজায় টোকা পড়লো।কে এসেছে বুঝার জন্য চুপ করে আছি।
‘ আহি সোনা দরজা টা খোল!’
রিমি আপুর গলা। আমার এই মানুষটাকে আর বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছে না। তার মুখ দর্শনের এতটুকু ইচ্ছে ও নেই।আপু বাইরে কাকুতি মিনতি করতে লাগলো যেন দরজাটা খুলি। আমি গেলাম না দরজা খুলতে।মুর্তির মত বেডে বসে রইলাম।
সময় কাটছে। মিনিট দশেক ধরে দরজায় ধাক্কাধাক্কি বন্ধ। মনে হয় ক্লান্ত চলে গেছে। টানা দুই ঘণ্টা ধরে একটু পর পর খালি ধাক্কা! আমার এতক্ষণ এই শব্দের কারণে ঘুম পাচ্ছিল না।এখন সব নিশ্চুপ হওয়ায় ঘুম পাচ্ছে খুব। আমি শুয়ে পরলাম।ঠান্ডার জন্য কম্বল টেনে নিলাম গায়ের উপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
সকাল পাঁচটার অ্যালার্মে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার।এই রুমের ঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করা ভুলে গেছিলাম আমি। বিরক্ত হয়ে উঠে বসলাম। ঘুম পুরোপুরি হয়নি এখনও। মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছি। ওয়াশ রুমে ও যেতে হবে। আমার রুমে অ্যাটাচড ওয়াশরুম নেই।বাইরে যেতে হবে। কম্বল ছেড়ে নিচে নামলাম।আধ ঘুম আধ জাগনা অবস্থায় দরজা খুলতেই আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো রিমি আপু। ভূত ভেবে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও আপু কে দেখে থেমে গেলাম। আপুর চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে এক রাতেই ডার্ক সার্কেল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল? আমার খানিকটা ভয় লাগল আপুকে দেখে। আমাকে দরজা খুলতে দেখে আপু হাসল। পরক্ষনেই আমাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরল।তার প্রতি মনে এত রাগ জমে থাকা সত্ত্বেও কেন জানি দূরে ঠেললাম না এবার।দরজা ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপু ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
‘ সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে আমার।রুমে আয়।তোকে বলছি সব।’
আমি আপুর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত চোখে তাকালাম তার দিকে।সে সন্ধ্যা থেকে আমাকে বিষয়টা বুঝানোর জন্য হাল ছাড়ছে না।আপু রুমে ঢুকে বেডের উপরে কম্বল মুড়ি দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসলো। আমি দরজা লক করে পাশে উঠে বসলাম। আপু চুপ করে আছে।আমি হাতের নখ খুঁটছি। কিছুক্ষণ পর আপু অনেকটাই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। হেমন্তের রাতে সারারাত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখের কথা নয়। কিভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কে জানে।
‘ তুই আমাকে ভুল বুঝিস না পাখি। আমি বা অর্ক কেউই তোকে একটুও অপমান করিনি।তুই অকারণেই নিজের অপমান বোধ করলি।আসলে আমি তোকে বলব কিভাবে তাই বুঝতে পারছি না এখন।সাহস হচ্ছে না বলার।তবে আজকের মধ্যে ই জানবি সব।কিন্তু সবকিছু জানার পর তুই আমার উপর যেভাবে রেগে আছিস এভাবে আর রেগে থাকবি না।জানি তোর খুব কষ্ট লেগেছে কিন্তু!’
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম।আপু রেসপন্স না পেয়ে ফের বললো,
‘ আমাকে কি না জেনে একটুও ক্ষমা করতে পারবি না?’
‘ বাদ দাও।এসব নিয়ে ভাবলে আমার মেজাজ আরও খারাপ হবে।’
আপু চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ পর আপু ধীরে ধীরে বললো,
‘ এগারোটার দিকে মেহেদি রাত নয়টায় হলুদ। হলুদের সময় দশটার দিকে তুই আমার সাথে গেইটের বাইরে দেখা করবি।’
‘ কেন?’
‘ তখনই তোকে সবকিছু বলার সুযোগ পাব।প্লিজ আহি,এর আগ অব্দি তুই আমার আগের আহি হয়ে যা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোকে এভাবে রেখে। আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি আমাকে বিশ্বাস কর।তুই ছাড়া আমি পরবর্তী জীবনে একেবারেই অসহায়। সাহায্য করার মত কেউই নেই।’
আমি আপুর দিকে তাকালাম।আপু কাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুচকি হাসলাম শুধু। আশ্বাস দিলাম হয়ত বা।এত সহজেই আমি দমে যেতাম না কিন্তু আজ বাদে কাল যার বিয়ে সে যখন এভাবে সারারাত জেগে আমার ভুল ভাঙানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সে আর যাই হোক এতটাও খারাপ না। আপু কে ‘ ঘুমাও ‘ বলে শুয়ে পড়লাম আমি।কম্বল টেনে মাথা ও ঢেকে নিলাম। চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম।
কাঁটায় কাঁটায় দশটা বাজে। আমি হলুদ অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে।মা অবশ্য একবার দেখেছে বাইরের দিকে যেতে। কিন্তু সবার আনাগোনায় কিছু সন্দেহ করেনি। হলুদ ছোঁয়া হবে রাত এগারোটার দিকে।আপু সন্ধ্যা থেকেই বাড়িতে নেই। পার্লারে গেছে সাজতে।সাথে আমাকে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু আগেই মানা করে রাখায় আমি যাইনি।একাই গেছে। আপুর সারাদিনের ব্যবহার আজকে আমি মেলাতে পারিনি। মেহেদি অনুষ্ঠান হয়েছে সকাল এগারোটার পর। আপুর সাথে আমাকেও দুহাত ভর্তি করে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে পার্লারের মেয়েগুলো।
সুন্দর করে ইংরেজি অক্ষরে A ও লিখেছে। আমি আপত্তি করেছিলাম কিন্তু আপু বললো বিয়েতে নাকি লিখতে হয়।লিখেছি, ছবি তুলেছি।ব্রাইডের কাজিন সেমি ব্রাইডাল সাজ,ড্রেস, মেহেদি। ফটোশুট করেছি।আপু সকাল থেকে পুরোটা সময় কেমন নার্ভাস ছিল। অস্থিরতা তার চোখমুখে ও ফুটে উঠেছিল। অস্থিরতা বাড়ল যখন বাড়িতে আর সব মেহমান রা আসতে শুরু করেছে।বিকাল থেকেই বাড়িতে মেহমানদের ভিড়।খালা,নানা রা সবাই আসছে এক এক করে।নানার গোষ্ঠী বিশাল বড়।
শুধু আত্মীয় স্বজন নিয়েই বাড়ি গমগম করছে।সবাই মিলে হলুদের আয়োজন করছে। সন্ধ্যায় সেই ফাঁকে আপু সবাইকে বলে পার্লারে গেল সাজতে।একা একা।নানার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। ড্রাইভার ছিল সাথে।যদিও আপু কে কেউই একা ছাড়তে চাচ্ছিল না, উপরন্তু আমিও না। কিন্তু আপু আর তার যেই ফ্রেন্ডস রা এসেছে তারা বললো এটাই আপুর লাস্ট একা একা বের হওয়া।যাক একটু নিজেকে সময় দিক। কিন্তু আপু যাওয়ার সময় তার আরও দুই ফিমেল ফ্রেন্ড নিয়ে গেছে বলে আমার ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে। কারণ আপু যাওয়ার সাথে সাথে আমি ওই দুটো মেয়ের টিকি ও খুঁজে পাইনি।
গেইটের বাইরে বেঞ্চে বসে আছি দশ মিনিট হয়ে গেছে। কারোরই দেখা নেই।না আপু আর না ড্রাইভার। আমি এইদিকে বাসায় পার্লারের মেয়েদের কাছে সেজেছি।সেমি ব্রাইডাল লেহেঙ্গা,সেমি ব্রাইডাল সাজ। নিজেকেই কেন জানি বউ বউ মনে হচ্ছে সাজার পর থেকে। ভেবেছিলাম আপুর হলুদের আগে আগে ছবি তুলে রাখব এখন দেখছি তা সম্ভব হবে না।কখন যে আসবে এসব ভাবতে ভাবতেই সামনের রাস্তায় চোখ পড়ল।কালো রঙের একটা টয়োটা এসে দাঁড়িয়েছে।
ক্যাপ্টেন সাহেব?আপু তো বলেছিল ক্যাপ্টেনের গাড়ি এরকম।উনি বউয়ের হলুদ দেখতে চলে আসলেন নাকি আবার? আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই গাড়ির দরজা খুলে ক্যাপ্টেন সাহেব নামলেন।ব্লাক কালারের পাঞ্জাবি আর অফ হোয়াইট প্যান্ট।শু পরেছেন। হাসিমুখে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন আর উনার পিছনে গাড়ি স্টার্ট নিয়ে সোজা আমার দিকে এগিয়ে আসলো। বেঞ্চের ওপাশে শুনশান রাস্তা। সেখানে গাড়ি থামলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম।গাড়ি থেকে আপু আর ডাক্তার ফাইয়াজ নামলো দুইদিক দিয়ে। ততক্ষণে ক্যাপ্টেন সাহেব ও আমার কাছে চলে এসেছেন। আপু কে দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। বিয়ের লেহেঙ্গা পরে আছে আপু। বিয়ের সাজ।সাথে ডাক্তার ফাইয়াজ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পরা। আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো ওরা। আপুর চোখ মুখ শুকনো। আমার কাছে এসেই ভয় পাওয়া গলায় বললো,
‘ কেউ কিছু বুঝেনি তো?টের পেয়েছে কেউ কিছু?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না।মনে হচ্ছে কেউ যেন সুপার গ্লু লাগিয়ে দিল আমার ঠোঁটে। আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি এখন যে আপু আর অবিবাহিত না।বিয়ে করে ফেলেছে।আর এটা এই ডাক্তার ফাইয়াজ কে।তার মানে! আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো কেমন জানি।পরে যাচ্ছিলাম, ক্যাপ্টেন সাহেব এসে ধরলেন আমাকে। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।আপু আমার অবস্থা দেখে বললো,
‘ ওকে গাড়িতে নিয়ে বসান।শক কাটানোর সময় দিই আমরা। এরপর দেখা যাবে। আপাতত আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।’
আমি আর কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন। গাড়িতে পিছনের দরজা খুলে বসিয়ে দিলেন।রিমি আপুকে বসতে বলে তিনি ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলেন।আর ডাক্তার ফাইয়াজ তার পাশে। সবাই গাড়িতে উঠার পর গাড়ি স্টার্ট নিলো।একটু স্পিডে চলছে গাড়ি। আমি শুধু পুতুলের মত তাকিয়ে দেখছি ওদের তিনজনকে।মাথা প্রচন্ড রকমের ঘুরছে। এসব কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আমার।
আধ ঘন্টা পর গাড়ি একটা খোলা মাঠের মত জায়গায় এসে দাঁড়াল।ওরা গাড়ি থেকে নামার পর আমি ও নামলাম। ততক্ষণে আমি একটু স্বাভাবিক হয়েছি।পুরো রাস্তা জুড়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করেছে। গাড়ি থেকে নেমে আমি গাড়িতেই হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম।ওরা যা বলবে তা শোনার পূর্ব মানসিক প্রস্তুতি বলা চলে। তিনজনই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আপুর দিকে তাকালাম আমি।বউ সাজে এত সুন্দর লাগছে! মেরুন রঙের লেহেঙ্গা, মেরুন ব্রাইড। আমাকে তাকাতে দেখে আপু একটা ঢোক গিলে বললো,
Love Triangle part 10
‘ আসলে আহি আমি বিয়ে করেছি।’
ডাক্তার ফাইয়াজ কে দেখিয়ে দিয়ে বললো,
‘ ফাইয়াজ কে। আমরা কোর্ট ম্যারেজ করেছি। আমার বিয়ের প্রথম সাক্ষী অর্ক স্যার।
আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে। বাংলা সিনেমার মত কোথাও একটা বাজ পড়ল মনে হচ্ছে।আজ বাদে কাল যার ক্যাপ্টেনের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা সে কি-না এই ডাক্তার কে বিয়ে করেছে! গতকাল সকালে তাহলে আপু এর সাথেই দেখা করেছিল?মজা তাহলে এই নিয়েই হয়েছিল রেস্টুরেন্টে?আপু!!!