mad for you part 14
তানিয়া খাতুন
বৃষ্টি তখনও টিপটিপ করে পড়ছে।
বিকেল নামছে ধীরে ধীরে, আকাশে ঘন মেঘ জমে গেছে।
চারপাশে হালকা কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে এক পরিবেশ।
দূরে গাছগুলোর ছায়া মিশে গেছে মেঘলা আকাশের সাথে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বাইক চালানোর পর হঠাৎ ক্রিশ বাইক থামিয়ে দিল এক কবরস্থানের সামনে।
রুহি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।
নরম বৃষ্টির ফোঁটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, চুল ভিজে গিয়ে কপালে লেগে আছে।
— “এইখানে কেন থামলেন?” রুহি ধীরে জিজ্ঞেস করল।
ক্রিশ কোনো উত্তর দিল না।
বাইক থেকে নামল, তারপর চুপচাপ রুহির হাত ধরে তাকে কবরস্থানেৱ ভেতরের দিকে নিয়ে গেল।
রুহি কিছুটা দ্বিধা নিয়ে তার পেছনে হাঁটল। বাতাসে মাটির গন্ধ মিশে আছে, বৃষ্টিতে সেই গন্ধ আরও গভীর হয়ে উঠেছে।
একটা পুরনো কবরের সামনে গিয়ে ক্রিশ থেমে গেল।
কবরটার চারপাশে ছোট ছোট ঘাস গজিয়েছে, উপৱে কয়েকটা ছোটো ছোটো গাছ হয়েছে।
ক্রিশ হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার ঠোঁট কাঁপছে, গলা ভেঙে যাচ্ছে কথার ভারে।
ক্ৰিশঃ “আম্মু… কেমন আছো?” সে মাটির উপর আলতো করে হাত রাখল, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তার আঙুলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “তোমার ক্রিশ এসেছে, আম্মু।
এত বছর পর… তোমার ক্রিশ আবার ফিরে এসেছে।
তোমার ওপর রাগ করে থাকতে পারিনি।”
তার চোখে জল টলমল করছে, কিন্তু বৃষ্টির জলে বোঝা যাচ্ছে না কোনটা অশ্রু আর কোনটা বৃষ্টি।
রুহি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে, তার বুকের ভেতরটা কেমন জানি ভারী হয়ে উঠেছে।
ক্রিশকে এমন ভাঙা অবস্থায় সে কখনও দেখেনি।
ক্রিশ এক মুহূর্তে মুখ তুলে রুহির দিকে তাকাল।
— “বাটারফ্লাই, ইনি আমার আম্মু,” সে ফিসফিস করে বলল, “আম্মুকে সালাম দাও।”
রুহি চুপচাপ হাত তুলে সালাম করল, চোখে তার অজানা এক অনুভূতি জমে উঠল।
ক্রিশ আবার মাটির দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল,
— “আম্মু, তুমি একদিন বলেছিলে না — তুমি চলে গেলে একজন আসবে,
যে তোমার ছেলেকে সামলাবে, বুঝবে… ঠিক বলেছিলে তুমি।
ও এসে গেছে, কিন্তু… এখনও ও আমাকে বোঝে না, আম্মু। ও আমায় ভালোবাসে না।”
তার গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসে।
— “কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না, আম্মু।
আমি ওকে হারাতে দেব না।
ওকে আমার কাছ থেকে কেউ নিতে পারবে না।”
ক্রিশ অনেকক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিতে বসে আছে, কবরটার দিকে তাকিয়ে।
মনে হচ্ছে, সে কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু কথা যেন গলার ভেতরেই আটকে গেছে।
বৃষ্টি থেমে থেমে পড়ছে, বাতাসে মাটির গন্ধে ভরে গেছে চারদিক।
হঠাৎ ক্রিশ নিচু গলায় বলল,
— “বাটারফ্লাই…”
রুহি নরম স্বরে জবাব দিল,
— “হুম্ম?”
ক্রিশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— “তুমি জানতে চাও না আমি এমন কেন?”
রুহি কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে রইল।
ক্রিশ ধীরে ধীরে বলে,
— “হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো… আমি খারাপ, আমার মন নোংরা, আমার চরিত্র নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুলতে পারো।
কিন্তু তুমি কি কখনও ভেবেছো, আমি এমন হলাম কেন?
জন্মের পর থেকেই কি আমি এমন ছিলাম?”
তার কণ্ঠ কাঁপছে, গলা ভারী হয়ে গেছে।
— “ছিলাম না, বাটারফ্লাই… আমি একসময় আম্মুৱ ভালো ছেলে ছিলাম।
আম্মুর চোখে আমি ছিলাম ওনার গর্ব, ওনার সুখ।
ক্রিশের চোখে জল জমে উঠেছে, কিন্তু বৃষ্টির জলে বোঝা যাচ্ছে না সে কাঁদছে কি না।
রুহির গলা ভারী হয়ে এল। এমন দৃঢ়, কঠিন মানুষটার ভেতরে এত ভাঙা কষ্ট আছে — তা সে ভাবতেও পারেনি।
নিচু হয়ে সে ক্রিশের পাশে হাঁটু মুড়ে বসল।
নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে ক্রিশের মাথায় রাখল, আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল।
বৃষ্টি হঠাৎ আরও জোরে পড়তে শুরু করল, কিন্তু দুজনে যেনো এই দুনিয়ায় নেই।
ক্রিশ ধীরে ধীরে মাথাটা রুহির কোলে রেখে দিল, একদম শিশুর মতো গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল।
রুহির চোখ দিয়ে তখন নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
সে মৃদু স্বরে বলল,
— “বলুন, ক্রিশ… সব বলুন।
আমি শুনতে চাই আপনার সবকিছু।
আপনি কেন, এৱাকম — আমি জানতে চাই।”
বৃষ্টির শব্দের ভেতর দিয়ে শুধু দুইটা নিঃশব্দ হৃদস্পন্দনের শব্দ ভেসে আসছিল —
ক্ৰিশঃ আমি সব সময় চেয়েছি আমার অতীত টাকে সময়ের পাতায় লুকাতে — সেটা বারবার আমায় আঘাত কৱে।
ছোটবেলা থেকে যা দেখেছি, তা আমার রক্তে লেগে আছে; সেই গন্ধ থেকে মুক্ত হওয়া সহজ হয়নি।
আমার স্মৃতিতে এখনও ভাসে আম্মুর কাঁন্নাৱত নিঃশব্দ চোখ, আব্বুৱ রুচিহীন হাঁসি আর আব্বুর সেই কথাগুলো—যেগুলো আমাৱ ঘুম উড়িয়ে দিত।
অতীত,
আমার আম্মু-আব্বু দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন।
তবে আমার আম্মুর বাড়ির লোক তা মানেনি, কারণ আম্মু খ্রিস্টান ছিলেন।
আমার আম্মু নানার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন সংসার শুরু করেন আব্বুর সঙ্গে।
আব্বু তখন নতুন নতুন রাজনীতি করেন।
শরীরে গরম রক্ত বইছে—চারিদিকে তাঁর বেশ নাম ছড়িয়ে পড়ে “ধারালো সুদর্শন” হিসেবে।
তিনি আস্তে আস্তে রাজনীতির নোংরা কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন।
বাড়িতে রোজ এসব নিয়ে ঝামেলা হতো।
আম্মু খুব সরল মানুষ, এসব একদম সহ্য করতে পারতেন না।
তারপর তাঁদের জীবনে আমি আসি—আম্মুর বেঁচে থাকার নতুন কারণ যেন খুঁজে পান তিনি।
কিন্তু তারপরই শুরু হয় আম্মুর জীবনের কালো অধ্যায়।
আব্বু রোজ নতুন নতুন মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন।
আম্মু কিছু বলতে গেলেই তাঁকে মারতেন, বাজে ব্যবহার করতেন।
শেষে আম্মু হাল ছেড়ে দেন, নিজের ভাগ্যকে মেনে নেন।
আমি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি।
যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, তখন অন্য বাচ্চারা খেলা আৱ পড়াশোনা শেখে—
আর আমি চোখের সামনে নোংরামি দেখতে শিখি।
ছোট মাথায় তখনই ঢুকে যায়—বড়লোক বাবাদের মেয়েরা শুধু সংসার ভাঙতে জানে।
সেই মেয়েদের জন্যই আমার মা রোজ নির্যাতিত হতেন।
আমি কিছুই করতে পারতাম না, শুধু দেখতাম।
আম্মু যখন গল্প করতেন, বলতেন—
তোমার আব্বু আর আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।
তখন আমার মনে হতো, এটাকে কি ভালোবাসা বলে?
ভালোবাসা শব্দটার প্রতিই আমার ঘৃণা জন্মে যায়—আর মেয়েদের প্রতিও।
আমার দশ বছর বয়সে আম্মু মারা যান।
আমি সেদিন কাঁদিনি—কারণ আমার মনে রাগ ছিল তাঁর প্রতি।
অনেকবার আম্মুকে বলেছিলাম বাড়ি ছেড়ে যেতে, তিনি যাননি।
তিনি বলতেন, “এই বাড়ির প্রপার্টি সব আমার—আমাকে আমার নানাজান দিয়েছেন।”
শেষে আমি নিজে হাতে আম্মুর কবরে মাটি দিই,
তবু আমি কাঁদিনি।
তারপর থেকে আমি একা থাকতাম।
শুধু পড়াশোনার জন্য বাইরে যেতাম, তাছাড়া কোথাও না।
আমার কোনো বন্ধুও ছিল না।
আব্বুর নোংরামি তখনও বন্ধ হয়নি—
রোজ রাতে মেয়েদের নিয়ে রুমে ঢুকতেন।
আমি সব জানতাম, দেখতাম, কিন্তু কিছু বলতাম না।
তারপর, যখন আমার ১৯ বছর বয়স,
আব্বু আবার বিয়ে করলেন।
সেই মহিলার মেয়ে আমার সৎবোন—কায়া।
আজকে যে তোমাৱ সাথে মিশ বিহেভ কৱেছে।
একদিন ও আমাকে ক্লাবে নিয়ে গেল।
সেখানে গিয়ে দেখি, মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে—
আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো যেন ঝড়ের মতো ফিরে এল।
আমি অনেক বেশি ড্রিংক করলাম।
সেদিন কায়া আমাকে ড্রিংকেৱ মধ্যে ড্ৰাগস মিশিয়ে দেয়।
আমি এক মেয়ের সঙ্গে রুমে যাই, আমৱা ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে পৌঁছায়,
কিন্তু শেষ মুহূর্তে কিছু করিনি—ওকে ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসি।
সেই দিন থেকে বিষয়টা আমার নেশা হয়ে যায়।
মেয়েদের দেখলেই ভিতরটা জ্বলে ওঠে।
মনে হয়—খুন করে ফেলি।
হ্যাঁ, আমি মেয়েদের বিছানায় নিতাম,
কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওদের একা রেখে চলে যেতাম।
আমি আনন্দ পেতাম ওদের তৱপানো দেখে।
আমি কোনোদিন ইন্টিমেট হয়নি কাৱোৱ সাথে কিন্তু ওদেৱ কে এমন ভাবে টর্চার কৱতাম যে
ওৱা কোনো দিনও কোনো পুৱুষেৱ কাছে যাবে না।
চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। বাতাসে মাটি আর বৃষ্টির গন্ধ মিশে আছে।
কবরের পাশে বসে রুহি নিঃশব্দে ক্রিশের মাথাটা কোলে নিয়ে আছে।
ক্রিশের চোখ বন্ধ, মুখে ক্লান্তির ছাপ।
কিছুক্ষণ পর সে ধীরে উঠে বসে, রুহির দুই হাত শক্ত করে ধরে, তার চোখের গভীরে তাকিয়ে বলে
ক্রিশ: “হ্যাঁ, আমি পাপী… আমায় দেখে তোৱ ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক।
আমি ভুল করেছি—অনেক ভুল।
কিন্তু , বাটারফ্লাই আমি আর আগের সেই মানুষটা নেই।
তুই আমাৱ জীবনে আসার পর বুঝেছি, ভালোবাসা মানে শুধু কাউকে পাওয়া না—ভালোবাসা মানে বদলে যাওয়া।
তুই আমায় এমনভাবে বদলে দিয়েছিস, আমি নিজেকে চিনতে পারি না।
তুই আসাৱ পৱ আমি আর কোনো দিন ক্লাবে যাইনি, কোনো মেয়ের দিকে তাকাইওনি।
আমি চাই না আমার অতীত তোর সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়াক।
ক্ৰিশ কবৱে মাথা ৱেখে চিংকাৱ কৱে বলে ,
হ্যাঁ বাটারফ্লাই আমি পাপ কৱেছি অনেক পাপ কৱেছি কিন্তু আমি বদলাতে চাই ।
আম্মু তুমি শুনতে পাচ্ছো তোমাৱ ক্ৰিশ নিজেকে বদলাতে চাই , তোমাৱ ক্ৰিশ ভালোবাসতে শিখেছে আম্মু।
ক্ৰিশ মুখ তুলে তাঁকায় ৱুহিকে জড়িয়ে ধৱে ৰলে বাটারফ্লাই আমি আৱ ক্লাবে যাইনা কোনো মেয়েৱ সংস্পর্শে যায়না , আমি শুধু তোৱ ভালোবাসা চাই বাটারফ্লাই।
ক্ৰিশ ৱুহিকে ছেড়ে আকাশেৱ দিকে তাঁকিয়ে আবাৱ চিংকাৱ কৱে বলে , আমি জানোয়াৱ নয় বাটারফ্লাই আমি মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।
ৱুহি যেনো স্তব্দ হয়ে গেছে সে কোনো দিনও কাউকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি।
ক্ৰিশ তাৱ দু হাতে ৱুহি কে আবাৱ জৱিয়ে ধৱে বলে পাৱবি না আমাকে ভালোবাসতে, পাৱবি না তোৱ পবিএতা দিয়ে আমাৱ সব পাপ ধুয়ে দিতে।
আমি শুধু চাই, সব পাপ, সব ভয়, সব দাগ মুছে যাক… আর আমি আবার মানুষ হয়ে উঠি—তোর জন্য।
আমি ভালো হতে চাই, বাটারফ্লাই… তোর ভালোবাসার যোগ্য হতে চাই।
আমি কিছু চাই না, শুধু তোকে পাশে চাই—একটা জীবন, যেখানে আমি ‘পাপী’ নয়, শুধু তোর ক্রিশ হয়ে বাঁচতে পারি।”
রুহি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।
ঠোঁট কাঁপে, গলা শুকিয়ে যায়।
সে হালকা কাঁপা কণ্ঠে বলে—
“ক্রিশ…
ক্ৰিশেৱ কোনো সাৱা পাওয়া যায় না।
ৱুহিঃ ক্ৰিশ,
ক্রিশ উঠুন , প্লিজ কথা বলুন…”
কোনো সাড়া নেই।
রুহির বুকের ভেতর ধকধক শুরু হয়। চোখের পাতা আৱো ভিজে আসে।
সে ক্রিশের মুখের কাছে হাত রাখে,
হঠাৎই রুহির হাত কাঁপে। ক্রিশের গলা থেকে কোনো আওয়াজ আসে না।
তার মাথাটা ধীরে ধীরে পিছলে পড়ে যায় রুহির কোলে।
রুহির মাথা ফাঁকা হয়ে যায়।
সে জানে না কী বলবে, কী করবে।
তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের মা-বাবার হাসি—সেই মানুষগুলো, যাদের কাছে ভালোবাসা মানে ছিল শান্তি আর নিরাপত্তা।
আর ক্রিশ? তার জীবনে ভালোবাসা মানেই কষ্ট, আগুন, আর অভিশাপ।
কেন এমন হলো তার জীবনটা?
ঠিক তখনই ক্রিশের পকেটের ভেতর থেকে ফোন বেজে ওঠে।
রুহি কাঁপা হাতে ফোনটা বের করে দেখে—“Aman লেখা।
সে কাঁপা গলায় কলটা রিসিভ করে।
রুহি: “ভাইয়া, আমি রুহি… ক্রিশ অচেতন হয়ে গেছেন। দয়া করে আসবেন, আমি এখনই লোকেশন পাঠাচ্ছি…”
আমান (অবাক হয়ে): “কি! জ্ঞান হাৱিয়ে ফেলেছে?
ঠিক আছে, তুমি ভয় পেও না। আমি এখনই আসছি। তুমি শুধু লোকেশন অন করে রাখো।”
রুহি ফোনটা কেটে দেয়।
তার হাত কাঁপছে, বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে “ধপ ধপ ধপ…”
ফোনটা নামাতেই চোখ পড়ে স্ক্রিনে—
ওই ফোনের ওয়ালপেপারে রুহির হাসিমাখা একটা ছবি, ক্রিশের তোলা।
ছবিটা দেখে রুহির বুক কেঁপে ওঠে।
তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।
রুহি কাঁপা হাতে ক্রিশকে জড়িয়ে ধরে, বুকের মধ্যে টেনে নেয়।
দুজনে বৃষ্টিতে পুৱো ভিজে গেছে, হঠাং ৱুহি বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে।
(রুহির কান্নার শব্দ বৃষ্টির শব্দে মিশে যায়।
দূরে বজ্রপাত হয়।
রুহি ক্রিশের মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে—
বৃষ্টি, কান্না—সব এক হয়ে যায় সেই নির্জন কবরস্থানে…)
আমান (চিৎকার করে): “রুহি! রুহি কোথায় তুমি?”
রুহি মাথা তোলে, কাঁপা গলায় বলে—
“এখানে ভাইয়া… তাড়াতাড়ি আসুন ক্রিশ… জ্ঞান হারিয়েছেন।”
আমান ছুটে আসে, কাদা মাড়িয়ে।
সে নিচু হয়ে ক্রিশের মুখে হাত রাখে, নিঃশ্বাস চেক করে, তারপর নিজের জ্যাকেট খুলে ক্রিশের গায়ে চাপায়।
আমান (দ্রুত গলায়): “রুহি, ভয় পেও না। ও শ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু দুর্বল হয়ে গেছে। হয়তো রক্তচাপ বা মানসিক শকের কারণে অজ্ঞান।”
রুহি কাঁপা গলায় বলে—
“ভাইয়া, ওনি ঠিক হয়ে যাবে তো?
আমান এক মুহূর্ত থেমে তাকায় ক্রিশের মুখের দিকে—
মাটি লেগে আছে, কিন্তু মুখে অদ্ভুত প্রশান্তি।
সে ধীরে বলে—
“রুহি, চিন্তা কৱো না ওকে হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে।”
আমান ক্রিশকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়।
রুহি পেছন থেকে দৌড়ে আসে, তার চোখে এখনো কান্না, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা।
রুহি: “আমি হাসপাতালে যাবো আপনাৱ সঙ্গে ।”
আমান: “অবশ্যই যাবে।
দুজন মিলে ক্রিশকে গাড়িতে তুলে দেয়।
রুহি পেছনের সিটে বসে, ক্রিশের হাত নিজের হাতে ধরে রাখে।
গাড়ি ধীরে ধীরে কবরস্থান ছাড়ে। জানালার বাইরে ভেজা পাতা, ধোঁয়াটে আলো আর বৃষ্টির গন্ধ।
হাসপাতালের ভেতর। ক্রিশ বিছানায় অজ্ঞান হয়ে আছে।
রুহি পাশে বসে হাত ধরে আছে, চোখে পানি।
আমান চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার চেকআপ কৱে বলেন,
ডাক্তার: “আপনারা চিন্তা করবেন না, এখন ওনার অবস্থা স্থির।
তবে ওনি মানসিক দিক থেকে খুবই দুর্বল হয়ে গেছেন।”
রুহি (কাঁপা গলায়): “মানে ডাক্তার, ওনার কী হয়েছে?”
আমানঃ আগেও ওৱ এৱাকম হয়ছে আৱ আপনাৱ কাছেই এনেছি।
ডাক্তার: “ওর মধ্যে Intermittent Explosive Disorder বা IED–এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
এটা এমন এক মানসিক অবস্থা যেখানে মানুষ ছোট ছোট কারণে হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো রাগে ফেটে পড়ে।
তখন ওর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
কিন্তু একটু পরেই তীব্র অনুশোচনা হয়।
এটা কোনো খারাপ মানুষ হওয়ার লক্ষণ না—এটা একটা মানসিক অসুখ।”
আমান: “এই রোগটা কি ঠিক হওয়া যায়, ডাক্তার?”
ডাক্তার: “অবশ্যই যায়। চিকিৎসা দরকার—নিয়মিত কাউন্সেলিং, মানসিক থেরাপি আর কিছু ওষুধ।
আমি আগেও ওর পরিবারকে বলেছিলাম চিকিৎসা শুরু করতে, কিন্তু ক্রিশ রাজি হয়নি, আৱ হ্যাঁ ওনাৱ মানসিক শান্তি খুব দৱকাৱ, ওনাকে একা থাকতে দেবেন না।”
রুহি : “আমি থাকব ওনার পাশে, ডাক্তাৱ… ওনাকে একা হতে দেব না।”
ডাক্তার (হালকা হাসি): “এটাই ওনার সবচেয়ে দরকারি ওষুধ।”
রাত নটা।
বিছানায় ক্ৰিশ শুয়ে আছে।
পাশে তিনজন বন্ধু বসে গল্প করছে, তাদের হাঁসির শব্দে ক্ৰিশ পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়, আলোটা চোখে লাগতেই আবার চোখ বন্ধ করে নেয়।
আমানঃ “এই দেখ, ক্ৰিশের জ্ঞান ফিৱছে।”
ক্ৰিশ চোখ খুলে আমান, রুদ্র আর রোহিমকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“আমার বাটারফ্লাই কোথায়?”
রোহিম ভ্রু কুঁচকে বলে, “এই বাটারফ্লাই আবার কে?”
রুদ্র হেঁসে বলে, “আরে, রুহির কথা বলছে, আবাল!”
রোহিম মাথা চুলকে বলে, “ও আচ্ছা! কিন্তু রুহি তো এখানে নেই।”
ক্ৰিশ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে, “মানে কী, কোথায় গেছে ও?”
আমান অবাক হয়ে বলে, “কি সব বলছিস তুই?”
রোহিম চোখ টিপ দিয়ে বলে, “অরে, রুহি একটু আগেই নিজের বাড়ি ফিরে গেল না?”
আমানঃ “হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”
রুদ্র হেঁসে বলে, “তুই চিন্তা করিস না, একটু বিশ্রাম নে, পরে ওর সাথে দেখা করে নিস।”
ক্ৰিশ দাঁত চেপে রুদ্রকে এক থাপ্পর মেরে বলে,
“বোকাচোদা! আমার বউ চলে গেছে আর আমি বিশ্রাম নেব?
সর—তোদের তিনজনকে এমন কেলান কেলাবো যে নিজেদেৱ চিনতে পারবি না।”
বলে ক্ৰিশ দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
রোহিম আর আমান হো হো করে হাঁসতে শুরু করে,
রুদ্র তখনো গাল চেপে ধরে বসে আছে—
“সালা নাটক করলি তোরা, আর আমি মার খেলাম!”
সিঁড়ি বেয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নামছিল ক্ৰিশ,
বাইকটা নিচে দাঁড়ানো, দরজা পর্যন্ত গিয়েই মনে পড়ল—
চাবিটা তো উপরে রেখেই এসেছে!
সে তড়িঘড়ি করে আবার দৌড়ে উঠতে যায়, কিন্তু ঠিক তখনই কারও সঙ্গে ধাক্কা খায়।
সামনের মানুষটা পড়ে যাওয়ার ভয় পেয়ে ক্ৰিশের শার্টের কলার চেপে ধরে, আর তাতেই ভারসাম্য হারিয়ে ক্ৰিশ তার ওপরে গিয়ে পড়ে যায়।
রুহিঃ ‘আহ্’ “ও মা রে! আমার কোমরটা গেল!”
নিচে মেঝেতে পড়ে আছে রুহি, তার ওপর পড়েছে ক্ৰিশ।
দুজনের চোখ এক মুহূর্তের জন্য একে অপরের সঙ্গে আটকে থাকে।
ক্ৰিশের মুখে একরকম দুষ্টু হাসি খেলে যায়, রুহির ঠোঁট চেপে ধরা, চোখ কুঁচকে আছে।
ৱুহিঃ চোঁখ নেই্ নাকি “এভাবে কে ধাক্কা খায়?
উঠুন তো!”
ক্ৰিশ শান্ত স্বরে বলে,
“এভাবেই থাকনা ভালো লাগছে”
রুহির চোখ বড় বড় হয়ে যায়, “আপনি পাগল নাকি?”
ক্ৰিশ মুচকি হেসে ফিসফিস করে,
“হ্যাঁ, তুমিই বানিয়েছো পাগল।”
রুহি ভ্রু কুঁচকে , “কি বললেন?”
ক্ৰিশ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, তারপর হাঁসে, “ৱুহিৱ শৱীৱে চোঁখ বুলিয়ে বলে ভালোই বড়ো বড়ো হয়ছে দেখছি।”
রুহি লজ্বাই ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, “আমার কোমরটা ব্যথা করছে, উঠুন।”
ক্ৰিশ হেসে বলে, “কোনো চিন্তা নেই, রাতে ঝান্ডু বাম লাগিয়ে দেব।”
রুহি বিরক্ত মুখে তাকিয়ে থাকে, আর ক্ৰি ধীরে ধীরে ওর ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আসে।
রুহির নিঃশ্বাস কাঁপে, চোখ পিটপিট করে, যেন কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না—
ঠিক তখনই ওপরে থেকে শিসের শব্দ ভেসে আসে।
দুজনেই চমকে উপরে তাকায়।
দেখে— রুদ্র, আমান, আর রোহিম রেলিং ধরে সিটি মারছে।
আমান হেসে বলে, “উফ! কী সিন, মাইরি!”
রুদ্রঃ “চালিয়ে যাও বস!”
রোহিমঃ “আজ একটা বউ নাই বলে, মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে পাড়ি না ৱে!”
mad for you part 13
তাদের হাসির শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে।
রুহি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে, মুখ লাল হয়ে ওঠে।
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে ৱুহিকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে নরম গলায় বলে,
“আমার বাটারফ্লাই লজ্জা পাচ্ছে?
পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই বাড়ি খালি কর, না হলে সবাইকে পচা পানিতে চুবিয়ে মাৱবো।”
রুহিৱ চোখের কোনে একটুখানি হাসি খেলা করে—
যা ক্ৰিশ দেখতে পায় না।
