Naar e Ishq part 3
তুরঙ্গনা
‘ক্লাসে কথা বলা, নট এলাউড। সো যাস্ট গেট আউট—রাইট নাউ।’
সুহিন বিস্ময়ের নজরে খানিকক্ষণ কেকের দিকে চেয়ে রইল। এই লোক এসব কি বলে? তার সাথে সাথে ক্লাসের বাকি সদস্যরাও যেন বেশ অবাক। সুহিন ভার্সিটির শুরু হতেই,কম-বেশি সকল টিচারের প্রিয় স্টুডেন্টের মাঝে অন্যতম। এর বেশ কিছু কারন আছে। একে তো সে জাভিয়ান হায়দারের পরিচত,একইসাথে যথেষ্ট নম্র-ভদ্র ও পড়াশোনায় মনোযোগী।
আর সেই সুহিনকে নাকি আজ ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে বলছে—সেটাও কিনা ক্লাসে কথা বলার অভিযোগে! এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?
সুহিনের মতো সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে বিধায়,পাশ থেকে নিমরা বেশ সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে, দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“সরি স্যার, কিন্তু আমরা তো সেভাবে…”
নিমরার কথা শেষ হবার আগেই, কেকে পুনরায় কর্কশ গলায় সুইনকে লক্ষ করেই বলে ওঠে,
“আই সেইড গেট আউট।”
সুহিন বুঝে গিয়েছে,এখানে আর হ্যাবলার মতো বসে থাকার অবস্থা নেই। যথারীতি সে আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ নিমরাকে পাশ কাটিয়ে উঠে বেরিয়ে আসে। নিমরা যেন চেয়েও আর তাকে থামাতে পারল না। উল্টো এই কেকের উপর তার ভীষণ রাগ উঠল।
এদিকে সুইনকে বেরিয়ে আসতে দেখে,কেকে পুনরায় নিজের মতো বইয়ের পাতায় নজর দেয়—সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত এক ভঙ্গিতে। সুহিন আর আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না। দাঁতে দাঁত চেপে, তীব্র বিরক্তি-ক্ষোভ নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার চলে যাওয়ায় সকলেই খানিক একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। তৎক্ষনাৎ কেকে পুনরায় নিজের গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“প্লিজ কিপ সাইলেন্ট!”
তার ভারিক্কি অভিব্যক্তিতে সবাই খানিক থমকে যায়। প্রফেসর যেমন আশা করেছিল তার চেয়ে যেন বহুগুণে বেশি কিছু পেয়ে গিয়েছে। তবে সুন্দর মানুষজনদের এমন রাগ থাকাটা মোটেও সুলক্ষণ নয়।প্রথম দিনেই স্টুডেন্টদের মাঝে খানিক ভয় ঢুকে যায়—না জানি আগামী দিনগুলোতে কপালে কি আছে।
সুহিন বাহিরে এসে বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সবগুলো রুমে ক্লাস চলছে,আর সে এখানে এক অকর্মা রূপে একা-একা ঘুরঘুর করছে। এরিমধ্যে আচমকা বৃষ্টির দেখা পেয়ে সে আরো বেশি বিরক্ত হলো। বৃষ্টি তার প্রিয়। কিন্তু এমন অসময়ের বৃষ্টি দেখে সে মোটেও খুশি নয়। এমনিতেই এখন প্রায় শীতের মৌসুম চলছে।
তার এই আনমনা সময়টুকুর মাঝেই, আচমকা তার কাছে ভার্সিটির প্রিন্সিপাল তথা নেওয়াজ সাহেব দেখা দিলেন। সুহিনকে তিনি খুব ভালোমতোই চেনে। কিন্তু হঠাৎ তাকে এখানে দেখে সে বেশ অবাক হলো।
—“সুহিন! তুমি ক্লাসে না গিয়ে, এখানে কি করছো?”
ফর্মাল পোশাক পরিধেয় বয়স্ক ব্যাক্তিটিকে দেখতে পেয়ে,সুহিন তৎক্ষনাৎ যথেষ্ট বিনয়ী হয়ে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
—“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিন্তু তুমি এখানে…”
—“আ…প্রফেসর ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছে।”
তার কথা শুনে নেওয়াজ বেশ অবাক হলেন৷ সে ভ্রুকুটি করে সুহিনের নুইয়ে রাখা মুখটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“তোমার ক্লাসরুমে তো এখন কেকে ক্লাস নিচ্ছে, তাই না? সেই কি তবে…”
নেওয়াজের সন্দিহান কন্ঠস্বরে, সুহিন আলতোভাবে মাথা ঝাকায়। বিষয়টা বুঝতে পেরে, নেওয়াজ ভারী শ্বাস ফেলে।
—“আমি গিয়ে কিছু বলব?”
সুহিন মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। তার স্তব্ধ চাহনিতে, নেওয়াজ কি বোঝে,কে জানে। তৎক্ষনাৎ সে তার উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা বাদ দাও, একটা ক্লাস মিস গেলে কিছু হবে না। তুমি না হয় পরের ক্লাসগুলো করে নিও। এখন আপাতত আমার সাথে চলো। এমনিতেও একটা কাজে এদিকটায় এসেছিলাম,কিন্তু ওসব আপাতত থাক।”
নেওয়াজের বন্ধুসুলভ আচরণে সুহিন মুচকি হাসে। জাভিয়ানের সাথে তার বেশ পুরোনো সম্পর্ক থাকায়, মাঝেমধ্যে এইটুকু সুযোগ-সুবিধা সে পেয়েই থাকে।সুহিনও আর কোনো আপত্তি না করে, তার সাথে সাথে এগিয়ে যায়। একইসাথে ক্লাসরুম অতিক্রম করতে গিয়ে, একপলক আঁড়চোখে কেকের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আওড়ায়,
“কাদের কাউয়া।”
ভার্সিটির শেষে সুহিন নিমরার জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝেমধ্যে জাভিয়ান বাড়ি থেকে তার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিলেও,বেশিরভাগ সময় সে নিমরার সাথেই রিকশা করে বাড়ি ফেরে। এদিকে নিমরা হঠাৎ ক্যান্টিন থেকে আইসক্রিম আনতে গিয়ে, কোথায় গায়েব হয়েছে কে জানে।যদিও এই ঠান্ডা আবহে আইসক্রিম খাওয়ার বায়নাটা সেই ধরেছিল।
তবে সকালের সেসব ঘটনার পর তার মেজাজও বেশ তুঙ্গে। এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে হলেও, মাঝেমধ্যে রাগে ফেটে পড়লে তাকে দমানোর সাধ্য খুব কম কারোরই আছে। যে কারণে সে ইচ্ছে করেও, রাগ বিষয়টাকে তেমন পছন্দ করেনা।
কিন্তু এখন সবমিলিয়ে সে বেশ বিরক্ত। সবাই যে যার মতো ভার্সিটি ছাড়ছে,অথচ এদিকে সে গেইটের কোণায় হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। এরিমধ্য আচমকা কোথায় থেকে যেন,তারই এক ক্লাসমেট এসে তার সামনে হাজির হলো। পরনে ওয়েস্টার্ন টপস্ আর জিন্স। সুহিন এই মেয়েকে ভালো মতোই চেনে। নামটা হয়তো জোয়া।
যথারীতি মেয়েটির ভাবভঙ্গি তার শুরু থেকেই তেমন ভালো লাগতো না বিধায়,কখনো সেভাবে কথাবার্তা বলা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ জোয়ার এমন উপস্থিতিও তার খুব একটা পছন্দ হলো না।
—“হাই সুহিন। ভালো আছো নিশ্চয়!”
জোয়ার কথায় সুহিন মৃদু হেসে আওড়ায়,
—“জ্বী ভালো, তুমি?”
—“কি বলছো,তুমি সত্যিই ভালো আছো? আমি তো ভাবলাম,তোমার মতো স্টুডেন্টকে এই প্রথমবার কোনো প্রফেসর ওভাবে ক্লাস থেকে বের করে দিলো। তাও কিনা তোমারই স্টেপ ফাদার…বিষয়টা কেমন না?”
জোয়ার ভণিতায় সুহিনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো।
—“কি বলতে চাইছো তুমি?”
—“আহা,রেগে যাচ্ছো কেনো। আমি তো সত্যিটাই…”
—“দেখো, যা সম্পর্কে পুরোপুরি জানো না তা নিয়ে এসব অহেতুক কথা বলো না।”
—“জানি না বলছো? আমি কিন্তু অনেক কিছুই জানি। আর দশলোকে যা বলবে,তাই তো বিশ্বাস করব,তাই না? তুমি তো জানোই আমার বাবা কে! বিজনেসের সূত্রে জাভিয়ান আঙ্কেলের সাথে বাবারও কিন্তু ভালো পরিচিতি রয়েছে। যে কারণে কাহসান বাড়িতে কখন কি ঘটছে তার টুকটাক খবর কিন্তু আমাদের কানেও আসে।
সেদিনই তো শুনলাম, বিদেশ থেকে মিস্টার কেকে চৌধুরী এসেছে। তোমার জানা আছে কিনা জানিনা,তবে সে কিন্তু ওখানকার বেশ নামী-দামী রকস্টার;ব্ল্যাকভেইনের লিডার। আর কেউ না হোক,আমি তাকে বেশ ভালো করেই চিনি। আর সেই কেকেই যে আমাদের নতুন প্রফেসর কেকে,তা-ও কিন্তু আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। অবশ্য শুধু আমি একা নই। অনেকেই চিনেছে তাকে। তবে সে যে সম্পর্কে তোমার বাবা…আই মিন সৎবাবাও হয়—তা আপাতত হয়তো আমিই জানি। আর হ্যাঁ,তুমি চিন্তা করো না। তুমি না চাইলে,এসব অতীতের কথা আমি কাউকে বলবো না।”
—“হয়েছে? তোমার বলা শেষ? এবার চুপচাপ আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও।”
সুহিনের ভারিক্কি অভিব্যক্তিতে,জোয়া তাচ্ছিল্য করে বলল,
“হুমকি দিচ্ছো? তা-ও আমাকে? একবার যদি পুরোনো বিষয়গুলো ঘেঁটে ভার্সিটিতে ছড়িয়ে দেই,তখন সামলাতে পারবে তো? অতীত পুরোনো হয়েছো তো কি হয়েছে? সত্য কিন্তু কখনো চাপা থাকে না, মাই ডিয়ার।”
—“কিসের সত্য? কি জানো তুমি? অহেতুক এসব নোংরামি বাদ দাও।”
—“আরেহ বাহ,তোমার মা স্বামী ম’রতে না মরতেই নোংরামি করল,আর এখন আমি বললেই…”
সুহিন জোয়ার কথাটুকু শেষ হতে দেয়না। অকস্মাৎ চড় বসিয়ে দেয় জোয়ার গালে। তার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে। একইসাথে ক্রোধে লাল হয়ে গিয়েছে। এদিকটায় মানুষজন তেমন না থাকায় বিষয়টা কারো নজরে পড়ল না। তবে জোয়া বিস্ময়ে স্তব্ধ। সে ক্ষিপ্ত চাহনিতে সুহিনের দিকে তাকিয়ে, দাঁতে দাঁত পিষে আওড়ায়,
“তোমার সাহস হলো কি করে—আমাকে চড় মারার? সত্যি বললে গালে লাগে, আবার মানুষের বাড়িতে বছরের পর বছর আশ্রিতা হয়ে থেকে—এমন তেজ দেখাতে লজ্জা লাগে না?”
এই বলতে না বলতেই, জোয়া আচমকা নিজের হাত তুলে সুহিনকে চড় মা’রতে নেবে—তৎক্ষণাৎ সুহিন তার হাতটা শক্তভাবে চেপে ধরে আঁটকায়। এবং তীব্র ক্রোধে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,
“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট, জোয়া।তোমার সাহস কি করে হয়, আমার মৃত মা-কে নিয়ে এমন কথাবার্তা বলার। যা সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানো না, তা নিয়ে কেনো কথা বলতে আসো? আরেকবার এসব নোংরামি করতে দেখলে, আমার চেয়ে খারা’প আর কেউ হবে না।”
সুহিন এই বলতে না বলতেই,তার হাতটা ছেড়ে দেয়। একইসাথে অকস্মাৎ নিঃশব্দে কেঁদেও ফেলে। আর এক মূহুর্তও এখানে থাকার ইচ্ছে নেই। তবে চলে আসার পূর্বে,সে জোয়ার দিকে ফিরে, পুনরার ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,
“চড়টার জন্য মোটেও দুঃখীত নই। ওটা তোমার প্রাপ্য।”
সুহিন মাথা নুইয়ে, গেইট পেরিয়ে সোজা রিকশায় চড়ে বসে। অন্যদিকে জোয়া পেছন হতে তার দিকে চেয়ে চেয়ে,আক্রোশের সাথেই বিদ্রূপসরূপ তির্যক হেসে আওড়ায়,
“যা শুনেছিলাম তাই দেখি সত্যি। মা-মেয়ে দুটোই ন’ষ্টা।”
রাত নেমেছে। সুহিন নিজের কক্ষের বারান্দায়—নিজেকে গুটিয়ে বসে আছে। অনবরত নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। চশমাটা ফ্লোরেই একপাশে পড়ে আছে। চুলগুলো সব এলোমেলো। অন্যদিকে খাঁচায় বন্দী মাফিন নিজের মতো এটা-সেটা কামড়ে খেলাধুলা করছে। যেন সুহিনের সঙ্গ দেওয়ার মতো এখন আর কেউই নেই।
সুহিন কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ওঠে। ভার্সিটি থেকে ফেরার পর আর নিচে যায়নি সে। তাকে বিরক্ত করতে কিংবা খোঁজ নিতেও,কেউ আসেনি। এটাই বাস্তবতা। এবং এতে সে সম্পূর্ণ অভস্ত্য। কিন্তু তার খারা’প লাগা কিংবা কষ্ট—সবটার পেছনেই আজ ভিন্ন কোনো কারণ জরিত।
সুহিন ভেজা-সিক্ত ঝাপসা চোখে চাঁদের দিকে তাকায়। চশমা ছাড়া তার সবকিছু পরিষ্কার দেখতে, খানিক সমস্যা হলেও,অতিরিক্ত কান্নার চোটে সম্পূর্ণ চাঁদটাই এখন সে ঘোলাটে দেখছে।
—“ওরা সবাই মিথ্যে বলে। আর কেউ না জানুক,আমি তো জানি তুমি কোনো নোং’রা কাজ করোনি। আমার মা কখনোই খা”রাপ হতে পারেনা। সবটাই তো মিথ্যে অপবাদ। ওরা শুধু শুধু তোমার নামে মিথ্যে অপবাদ ছড়িয়েছে। ওরা সবাই খা’রাপ। ওরা অনেক খা’রাপ। অনেক! অনেক!…”
সুহিন এই বলতে না বলতেই দুহাতে মুখ গুঁজে আবারও কাঁদতে শুরু করে। প্রায় আরো বেশ খানিকক্ষণ এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর, হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ল। তৎক্ষনাৎ আশপাশ ফিরে নিজের ফোনটা খুঁজতে থাকে। ভার্সিটি থেকে ফেরার পর সেটা কোথায় ফেলে রেখেছিল,কিছুই আর খেয়ালে নেই।
যথারীতি সে নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে চশমটা তুলে চোখে পড়ে নেয়। এবং রুমের ভেতরে গিয়ে ফোনটা খুঁজে বের করে। প্রথমেই নজরে পড়ে দানিয়েলের নামটা। ফোনের উপর জ্বলজ্বল করে ভাসছে ‘আরহাম ভাই’। এতোরাতে তাকে ফোন করতে দেখে, সে খানিক অবাক হলো। এরিমধ্যে কলটা ভাইব্রেট হতে হতে কেটেও গেল। সুহিন দ্রুত নোটিফিকেশনগুলো চেক্ করে দেখে—কম করে হলেও সারাদিনে শ’খানেকের বেশি ফোন দানিয়েল নিজেই করেছে। সাথে নিমরা তো আছেই। অথচ ফোন ভাইব্রেট করে রাখায় সে কিছুই টের পায়নি।
তার এমন হতভম্ব পরিস্থিতির মাঝেই,ফোনটা আবারও বেজে ওঠে। সুহিন দেরি না করে, দ্রুত কলটা রিসিভ করে।
—“কি হয়েছে তোমার? কোথায় তুমি? তুমি কি তোমার বাড়িতে নেই? ভার্সিটি থেকে কোথাও গিয়েছিলে? যেখানেই যাও না কেনো,ফোন কেনো সাথে রাখো না, বলো তো? জানো,সারাটাদিন ফোন করেও তোমায় পাইনি—এই টেনশনে আমার কি হাল হয়েছে? এতো কেনো খামখেয়ালি তুমি? এসব তোমার কেমন বাজে স্বভাব বউপাখি?”
দানিয়েলের কন্ঠস্বরে তীব্র অস্থিরতার আবহ। একইসাথে তার এমন প্রশ্নবিদ্ধ অভিব্যক্তিতে সুহিন না চাইতেও,শুরুতে খানিক ভড়কে গেল। নতুন করে আর কাঁদারই বা সুযোগ কোথায়?
এদিকে সুহিন কিছু বলছে না বিধায়, দানিয়েল পুনরায় ভারিক্কি স্বরে বলে উঠল,
“কি হলো, কথা বলছো না কেনো?”
সুহিন থমকায়। খানিক ভারী শ্বাস টেনে নিয়ে,নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আই’ম সরি, ফোন ভাইব্রেট করা ছিল। খেয়াল করিনি।”
—“সুহিনননন! আর কত খামখেয়ালি করবে তুমি মেয়ে?”
দানিয়েল হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ভারী ফেলল। এ মেয়ে একদিন তাকে এভাবেই মে’রে ফেলবে। সে কিছু বলছে না দেখে,সুহিন খানিক ইতস্তত স্বরে আওড়ায়,
“ভাইয়া…বলছিলাম…”
—“ভাইয়া, ভাইয়া না করে নিচে আসো।”
হঠাৎ দানিয়েলের দৃঢ় অভিব্যক্তিতে,সুহিন খানিক অবাক হয়।
—“মানে? নিচে কোথায়…”
—“আমি তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিচে আসো দ্রুত। বেশি দেরি করতে পারব না।”
তার এহেন কথায় সুহিন প্রচন্ড অবাক হয়। এতো রাতে দানিয়েল কেনো এখানে? সে ছুটে বারান্দায় গিয়ে দেখে,সত্যি সত্যি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির দেখা মিলছে। এদিকে দানিয়েল আবারও নিরেট স্বরে আওড়ায়,
“আসবে! নাকি তুমি আমায় আরো পাগল করবে?”
—“না…না…আমি…আমি আসছি।”
সুহিন এই বলেই ফোনটা ঘরে ফেলেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। এই সময় বাড়ির ভেতরের বেশিরভাগ মানুষই হয়তো ঘুমে আচ্ছন্ন। বাদবাকি গার্ডরা জেগে থাকলেও অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। সকলেই সুহিনকে বেশ ভালোমতোই জানে। সেক্ষেত্রে এতো রাতে সে বাড়ির বাহিরে গেলেও, বিষয়টাকে দৃষ্টিকটু করার মতো তেমন কেউ নেই।
ফলে সুহিন খুব সহজেই সোজা বাড়ির বাহিরে গিয়ে, মেইন গেইট পাড় করতেই দেখে দানিয়েলের চিন্তিত মুখখানা। যা তাকে দেখামাত্রই, বিস্তৃত হাসিতে প্রসারিত হয়। দানিয়েলের গায়ে সাদা রঙের জ্যাকেট ছিল। কিন্তু অস্থিরতায় ঘেমে গিয়েছিল বিধায়,তা খানিকক্ষণ আগেই খুলে ফেলে। এছাড়া সবসময় পরিপাটি করে রাখা চুলগুলোও বেশ এলোমেলো হয়ে আছে। সুহিন তার কাছে এগিয়ে যেতেই,দানিয়েল তাকে পরখ করে খানিক ভ্রুকুটি করে বলল,
“এসব কি? তোমার এই হাল কেনো?”
সুহিনের চুলগুলো সব এলোমেলো। অতিরিক্ত কেঁদেকেটে ফর্সা গাল, চোখ-মুখও ফুলে লালচে হয়ে গিয়েছে। সোডিয়ামের আলোয় তা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, কিছু তো একটা ঝামেলা হয়েছে ভেবে দানিয়েল পুনরায় দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তবে এবার সে খানিক নরম স্বরে সুহিনের উদ্দেশ্য বলে,
“কি হয়েছে তোমার? কেঁদেছে কেনো? বলো প্লিজ, কি হয়েছে। আমার দুশ্চিন্তা কিন্তু বেড়েই চলেছে।”
সুহিন নিজেকে ত্বরিত সামলে নেয়। সবটা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই সে কথা কাটিয়ে দিতে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আওড়ায়,
“না তেমন কিছু না। বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছিল। তাই একটু…”
সুহিন থেমে যেতেই, দানিয়েল নিজস্ব ভাবনাচিন্তা পড়ে যায়। সে পুনরায় সন্দিহান স্বরে বলল,
“সত্যি বলছো তো?”
সুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়,’হুম।’
দানিয়েল ভারী শ্বাস ফেলল। হেলমেটটা বাইকের উপর রেখে সুহিনকে বোঝানোর সুবিধার্থে,তার দিকে খানিক এগিয়ে এলো। সুহিনের চুলগুলো আলতো-হাতে গুছিয়ে দিতে লাগল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। সুহিনও এতে কোনো সংকোচ বোধ করল না। অন্যদিকে দানিয়েল তার চশমাটা ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল,
“বউপাখি, তুমি তোমার বাবা-মাকে অনেক ভালোবাসো, তাই না? তাহলে তুমি তাদের জন্য এভাবে কাঁদো কেনো, বলো তো? তোমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে কি তারা ওপারে ভালো থাকবে? তারাও তো কষ্ট পাবে। এইটুকু বিষয় কি তুমি বুঝতে পারো না?”
সুহিন নির্বিকার। তার কান্না থেমে গেলেও,দানিয়েলের কথায় অকস্মাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে। দানিয়েল ভারী শ্বাস ফেলে,পুনরায় সুহিনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দু’পা পিছিয়ে বলল,
“যাই হোক,বেশি দেরি করা হয়তো ঠিক হবে না। যদিও এখানে তেমন কেউ নেই। কিন্ত এইসব বিষয় খারাপ লোকের নজরে পড়লে,অযথা দুটো নোংরা কথা বলতেও মুখে বাঁধবে না।”
এই বলেই সে বাইকের উপর থেকে, একটা বড়সড় বক্স এনে সুহিনের হাতে ধরিয়ে দেয়। বক্সটা ছুঁতেই সুহিন ঠান্ডা অনুভব করল।সে উৎসুক দৃষ্টিতে দানিয়েলের দিকে তাকিয়ে আওড়ায়,
“এটা কি?”
দানিয়েল মৃদু হেসে, নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
“ভার্সিটি শেষে নিমরা নাকি ক্যান্টিনে গিয়েছিল আইসক্রিম নিতে। ও বলল, ওর খানিকক্ষণ দেরি হয়।আর আইসক্রিম নিয়ে আসতে আসতেই দেখে তুমি আর নেই। এতে তুমি রাগ করে চলে এসেছো কিনা, এই ভাবনায় ওকে খানিকক্ষণ বকেওছি। এখন তো মনে হচ্ছে ঘটনাটা ভিন্ন। সে যাই হোক, কয়েকরকম ফ্লেভারের অনেকগুলো আইসক্রিম আছে। পছন্দ বলেই সবটা একসাথে খেতে যেও না। ঠান্ডা লেগে যাবে পাগলী মেয়ে।”
এই বলেই সে সুহিনের সরু নাকটা, দু’আঙুলের ফাঁকে আলতোভাবে টেনে দেয়। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে সুহিন খানিক চমকে গেলেও,নিজেকে সামলে নেয়। অন্যদিকে দানিয়েল নিজের জ্যাকেটটা পড়ে নিয়ে, বাইকে গিয়ে চড়ে বসে। এবং সুহিনের উদ্দেশ্যে শেষ বারের মতো আওড়ায়,
“আসছি তবে, নিজের খেয়াল রেখো। ফোন যেহেতু ইউজ করো, তাই দয়া করে ওটার খোঁজখবর রেখো। নয়তো এই আমি এক অভাগা, তোমার এসব খামখেয়ালিতেই একদিন অপারে চলে যাবো।”
এই বলেই সে নিস্পৃহে হেসে ফেলে। একইসাথে সুহিনও বিস্তৃত মুচকি হাসে। আশেপাশে কেউ না রইলেও, তাদের এই মনোমুগ্ধকর প্রাণবন্ত দৃশ্যটুকুও—বেশ খানিকটা দূর হতে আরো একজোড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টির নজরে পড়ে।
কেকে নিজ কক্ষের বারান্দাতেই দাড়িয়ে ছিল। আঙুলের ফাঁকে ট্রেজারার ব্ল্যাক সিগারেট চেপে, মাঝেমধ্যে তাতে টান দিয়ে ধোঁয়া ওড়াচ্ছিল। পরনে কালো টিশার্ট আর টাউজার। শান্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,চোখে-মুখে কাঠিন্যের ছাপ। চুলগুলো বরাবরের মতোই এলোমেলো। ভাবগাম্ভীর্য কোনো হিংস্র-গম্ভীর নেকড়ের মতোই। তবুও বেশ খানিক অস্পষ্ট। তার মন-মস্তিষ্কে কি চলছে,তা তো কেবল সেই জানে।
কিন্তু প্রতিবার সুহিন আর এই অজ্ঞাত ব্যাক্তিটির প্রতিটি সুক্ষ্ম কার্যক্রমও যেন তার নজরের অগোচর হয়না। বরং সেসব লক্ষ করামাত্রই, তার পেশিবহুল হাতের শিরাগুলো অজানা ক্রোধে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোয়ালও শক্ত হয় অনায়াসে। হাত থেকে কখন যে সিগারেটের ছাইগুলো ঝড়ে পড়ে,তাও সে খেয়াল করে না। পুরো মূহুর্তটায় এভাবেই সে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
ড্রইংরুমে ডিমলাইটগুলো জ্বলছে। আশেপাশে মানুষজনের দেখা এবারও নেই। সুহিন দ্রুত বক্সটা নিয়ে, বাড়িতে ফিরে আসে—নিজের রুমের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়।সারাদিন খাওয়াদাওয়া করেনি। এখন রুমে গিয়ে আগে বসে বসে আইসক্রিম খাবে। তারপর আবার এগুলো নিচে এসে ফ্রিজে রেখে যাবে।
যথারীতি এমন ভাবনাতেই সে আনমনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। এরিমধ্যে আচমকা কারো অবয়ব তার নজরে এলো। সে মুখ তুলে খেয়াল করে দেখে, কেকে দোতলার সিঁড়ির রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, সিগারেট টেনে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। দৃষ্টিটাও হয়তো দূরের দেয়ালগুলোয় ঝুলিয়ে রাখা পেইন্টিংগুলোর মাঝে।
সুহিন শুরুতে তাকে এইমূহূর্তে দেখে ঘাবড়ে গেলেও, সবটা লক্ষ করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল। সে আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে, পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। এবং একটা সময় পর,দোতলায় এসে যেমনি কেকে-কে পাশ কাটিয়ে পা বাড়ায়—ওমনি আচমকা এক শক্তপোক্ত হাত তার বাহু আঁকড়ে থামিয়ে দেয়।
দু’আঙ্গুলের ফাঁকে—জলন্ত সিগারেট ধরা হাতেই, সে সুহিনের বাহু শক্তহাতে চেপে ধরেছে। ফলে নিমিষেই সেই জলন্ত অংশটুকুর সংস্পর্শে সুহিনের কোমল ত্বক যেন ঝলসে যায়। সে ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে খানিক নড়ে উঠলেও,কেকে তা টের পেয়েও সম্পূর্ণ নির্বিকার রয়। সুইনের চোখ জলে ভিজে ওঠে। সে বিস্ময়ের চাহনিতে, মুখ পাশে ফিরিয়ে কেকের দিকে আঁড়চোখে তাকায়। অন্যদিকে কেকেও এবার নিজের মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে,নিস্পৃহে শিস বাজিয়ে ওঠে। যতটা না ব্যাথা সে কেকের শক্তহাতের বাঁধন কিংবা আগুনের উত্তপ্ত ছোঁয়ায় পাচ্ছিল—তার চেয়েও অধিক পরিমানে ভয় ও সংশয় জাগল কেকের সামান্য শিস বাজানোর আওয়াজে।
Naar e Ishq part 2
তার সংশিত ভীতু মুখটার দিকে তাকিয়ে, কেকে শিস বাজানো থামিয়ে দেয়। একইসাথে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে অদ্ভুত এক তির্যক হাসি। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মৃদু হেসে,রাশভারি হাস্কি স্বরে আওড়ায়,
“তুই আমাকে এখনো ভয় পাস?”
