Naar e Ishq part 4
তুরঙ্গনা
“তুই আমাকে এখনো ভয় পাস?”
সুহিন কোনো জবাব দেয়না। সে ভীতু হয়ে, খানিক কুঁকড়ে যায়। হাতজোড়া মৃদু কাঁপতেই,বক্সটা পড়ে যেতে নেয়। সুহিন তৎক্ষনাৎ তা খেয়াল করে শক্তকরে আঁকড়ে ধরে। চোখজোড়া ছলছল করে উঠেছে। এদিকে কেকে তাকে সম্পূর্ণরূপে একবার পরখ করেই,ছেড়ে দেয়। শুরুতে তির্যক হাসলেও,পরক্ষণেই রুক্ষ-ভারী কন্ঠে আওড়ায়,
“চোখের সামনে থেকে সরে যা।”
হুট করে তার রেগে যাওয়ার কারণটা সুহিনের কাছে অস্পষ্ট। কিন্তু সে যাইহোক, এখানে তার আর একমুহূর্তও দাঁড়ানো ইচ্ছে নেই। সে ছাড়া পেয়েছে,তা বোঝামাত্রই ছুটে নিজের ঘরের দিকে ছুটে চলে যায়। এবং রুমে প্রবেশ করেই তৎক্ষনাৎ দরজাটা লাগিয়ে দেয়। যা দূর হতে সবটাই ঘাড় বাঁকিয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকল কেকে। একইসাথে তির্যক হেসে বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে আওড়ায়,
“তুই আমার থেকে যতটা দূরে থাকবি,ততটাই তোর জন্য মঙ্গলজনক।”
আজ ছুটির দিন। ভার্সিটি না থাকায় সুহিনকে সারাটাদিন বাড়িতেই থাকতে হবে। অন্যান্য সময় বন্ধের দিনে সে নানান সব কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এতেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু আজকের বন্ধের দিনটা খানিক ভিন্ন। সুহিন সকাল সকাল নিচে এসেই দেখে, ছেলেগুলো সব ড্রইং রুমে যে যার মতো ঘুরঘুর করছে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও কেকে নেই।
যে কারণে খানিক স্বস্তিতেই সে নিচে নামল। আশেপাশে সবাইকে এড়িয়ে গিয়ে,সে রান্নাঘরে চলে যায়। সেখানে সার্ভেন্টগুলো ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যস্ত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সুহিন সবাইকে এটা-সেটা করার নির্দেশ দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে ড্রইং রুমেও ফিরে তাকাচ্ছে।পায়ের উপর পা তুলে ছেলেগুলো সোফা বসে আছে। সকলেই ফোন-টিভিতে ব্যস্ত। সাদ নামের ছেলেটা টিভিতে ভিডিও গেইম খেলছে। টিভির ভেতরে চলতে থাকা রেসিং কারটাকে ঘুরাতে গিয়ে, কখনো কখনো রিমোটটা নিয়েই সোফায় উল্টেপাল্টে পড়ে যাচ্ছে। সবাই নিজেদের কাজেই ব্যস্ত বিধায়,সুহিন এতেও খানিক স্বস্তি পায়।
এমনিতেও সাদ হাম্মাদি ব্যতীত আর কারো সাথে পরিচিয়ও হয়নি। এমনকি তাদের নামটাও অব্দি সে জানে না। আর জানারও তেমন বিশেষ আগ্রহও নেই। কিন্তু সুহিনের এই স্বস্তিতে পার করা মূহুর্তটার মাঝেই,হুট করে সাদের আগমন ঘটল। গেইমটাকে সে পজ করে, হঠাৎ রান্নাঘরে এসে বলল,
“ব্রেকফাস্ট কি এখনো রেডি হয়নি?”
তার কথা সুহিন সহ বাদবাকি লোকজনও থেমে যায়। একজন সাদা-কালো পোশাকে সজ্জিত সার্ভেন্ট, ইতস্তত ভঙ্গিতে আওড়ায়,
“সরি স্যার,আরেকটু সময় লাগবে।”
সবার এমন ভাবগম্ভীর্যে সাদ জোরপূর্বক বিস্তৃত হেসে বলল,
“আরেহ না, আমি তো এমনিতেই খোঁজ নিতে এলাম।আপনারা সময় নিয়ে করুন, কোনো সমস্যা নেই।”
তার কথায় সবাই আশ্বস্ত হলেও,নিজেদের কাজগুলো দ্রুত গতিতে করতে শুরু করল। সাদ না হোক, কেকে কিংবা জাভিয়ান এই বিষয়গুলো নিয়ে ঘাঁটতে এসে সমস্যা হয়ে যাবে।
এদিকে সাদ সুহিনকে পেয়ে, চলে যেতে চেয়েও আর গেল না। বরং সুহিনের সাথে বেশ সখ্যতা দেখিয়ে বলল,
“আরে মিস ভীতু, তুমি দেখি এখানে। আচ্ছা তুমি সারাদিন থাকোটা কোথায়? তোমায় এতো খুজি,তাও তো তোমাকে সামনে পাইনা।”
সাদের কথায় সুহিন জোরপূর্বক হাসল। সবার মাঝ থেকে সরে এসে, সুহিন সাদের কাছে এগিয়ে এলো। আজ পরনে তার নীল লন শার্ট ও সাদা প্লাজো। গলায় সাদা ওড়না জড়ানো। চুলগুলো কাজের ব্যস্ততায় আলগাভাবে খোঁপা করে বেঁধেছে। সাদা ফ্রেমের চশমাটাও ঠিকঠাকই আছে।
সুহিন এসে কিছু বলবে,তার আগেই সাদ কি যেন খেয়াল করে বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“ওয়াউ! তোমার চোখ তো দেখি নীল রঙের। আমি তো এটা খেয়ালই করিনি।”
সুহিন ইতস্তত হয়ে মৃদু হাসে। সাদ আবারও তার চুল সহ বাদবাকি বিষয়গুলো পরখ করে বলল,
“তুমি তো অনেক ইউনিক! পুরোপুরি এ দেশীদের মতোও লাগে না। সত্যি করে বলো তো,তুমি কে? তুমি জাভিয়ান আঙ্কেলের কোনো আত্মীয় হও। আমি ঠিক বলেছি তাই না?
—“আ…আমি এই দেশেরই। তবে আমার মায়ের বংশ হলো পারস্যে। কিন্তু বাবা বাংলাদেশীই। আর মা বলতো আমি কিছুটা আমার নানুর মতো দেখতে। হয়তো এইজন্যই আমাকে আপনার খানিকটা আলাদা মনে হচ্ছে… ”
—“ওহ আচ্ছা। তার মানে আমার আন্দাজ ভুল নয়। কিন্তু তোমার মা-বাবা এখন কোথায়? তারা কি অন্যকোথাও…”
—“নেই…”
সাদের কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই,সুহিন তাকে থামিয়ে দিলো। তার ছোট্ট একটা কথায়,সাদ খানিক থমকে গিয়ে বলল,
“নেই মানে?”
সুহিন পুনরায় মৃদু মলিন হেসে বলল,
“তারা কেউ বেঁচে নেই। আর জাভিয়ান আঙ্কেল আমার বাবার বন্ধুর মতোই ছিল।এবং তার কারণেই আমি আজও এখানে…”
—“ওহ, আ’ম রিয়েলি সো সরি। আমার একটু দেখে শুনে কথা বলা উচিত ছিল।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”
সাদ জোরপূর্বক মৃদু হাসে। তার একনাগাড়ে কথার ঝুলি খোলার অভ্যাসটা ছাড়ানো উচিত। তবে মেয়েটা এতো নরম-সরম কেনো—তার কারণটা সে বেশ ভালোমতোই আন্দাজ করে নেয়।
সে কথা ঘুরিয়ে নেবার জন্য,সুহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আচ্ছা এসব ছাড়ো। তুমি আমাদের টিমের সাথে কথা বলেছো? আমার তো মনে হয় না। ওরা তো হয়তো তোমায় এখনো ঠিকমতো দেখেওনি। চলো,চলো,তোমাকে আগে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আই’ম ড্যাম সিওর,ওরা তোমাকে দেখলে ফিদা হয়ে যাবে।”
মিউজিয়ামের কোনো আকর্ষণীয় বস্তু ভেবেই যেন, সাদ সুহিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা সুহিনের কাছে এমনই ঠেকল। সুহিন সবার সম্মূখে যাওয়া মাত্রই, প্রচন্ড সংকোচবোধে মাথা নুইয়ে ফেলল। এদিকে সুহিনকে ড্রইং রুমের মাঝবরাবর টেনে এনে দাঁড় করিয়ে,সাদ জোর গলায় উৎসুক কন্ঠে বলে উঠল,
“হেই গাইস, এ্যাটেনশন প্লিজ। আমি জানি তোরা কেউ এখন অব্দি এই কিউট মেয়েটির সাথে পরিচিত হসনি। তবে সবাইকে আগেই বলে রাখছি,ও আমার জুনিয়র বেস্ট ফ্রেন্ড। শী ইজ অ্যা বিউটিফুল গার্ল, অলসো ইউথ অ্যা বিউটিফুল নেইম। আ…কি যেন, হ্যাঁ সুহিন। এই কিউট ভীতু মেয়েটার নাম হলো সুহিন। কথাবার্তা খুব কম বলে,কারণ ও অনেক ভীতু। সরি বাট আমার এটাই মনে হলো।”
সুহিনের যেন আর কিচ্ছু বলার নেই। এতো চমৎকার ভাবে কেউ যে কখনো তার ইন্ট্রডিউস করিয়ে দেবে—তা হয়তো সে কোনোকালেই কল্পনা করেনি। এদিকে সাদের কথা শুনে তালহা,জায়ান ও ফারিস একত্রে তাদের দিকে মুখ তুলে তাকায়। যাতে সুহিন আরো বেশি ভড়কায়।
তবে খানিকক্ষণের মাঝেই জায়ান আর ফারিস বিস্তৃত হেসে বলল,
“ওহ হাই সুহিন। আমি জায়ান সামিদ।”
—“আর আমি ফারিস তাইমুর। তুমি এই বাড়িতেই থাকো? কই সেভাবে তো কোনো চোখে পড়েনি। আ’ম সরি,হয়তো খেয়ালই করিনি।”
ফারিসের কথায় সুহিন জোরপূর্বক মৃদু হেসে আওড়ায়,
“ইট’স ওকে। আর আমিও দুঃখীত। আপনারা বাড়ির মেহমান অথচ আমি আপনাদের সাথে এখন অব্দি দেখাও করতে আসিনি।”
সুহিন খেয়াল করে দেখল, এই ফারিসটা খানিক সাদের মতোই। আর জায়ান নামের লোকটা মোটামুটিভাবে ঠিকঠাক। তবে আরেকটা লোক সোফায় গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। তার নজরের সাথে সাথে সাদের নজরও সেই লোকটির দিকে পড়ল। সাদ খানিক কপাল কুঁচকে তালহার উদ্দেশ্যে বলল,
“ঐ তালহা! তুই কিছু বলিস না কেন?”
তালহা মুখ তুলে একঝলক সুহিনকে দেখে। সামান্য মৃদু হেসে আওড়ায়,
“হ্যালো,আই’ম তালহা রিজভি।”
স্রেফ এইটুকু বলেই,তালহা পুনরায় নিজের মতো মাথাটা নুইয়ে নেয়। সুহিন তাকে লক্ষ করে দেখল—লম্বাচওড়া আকারের, দেখতেও খানিক তার আরহাম ভাইয়ের মতো। তবে একটু বেশিই রুক্ষ স্বভাবের হয়তো। খানিকটা ঐ গম্ভীরমুখো কেকের মতোই।
সুহিন আর কথা বাড়াতে চায়না। এখন বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। দ্রুত এখান থেকে সরে যেতে পারলেই হতো। অথচ এরিমধ্যে হঠাৎ কোথায় থেকে যেন কেকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। হয়তো সে বাড়ির বাহিরে ছিল এতক্ষণ। তবে তাকে এখানে দেখে সে মোটেও খুশি হলো না। বরং চলে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল।
যথারীতি কেকে তাদের কাছে এগিয়ে আসার আগেই,সে সবার উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আচ্ছা, আমি বরং এখন আসছি। সবার সাথে পরে কথা হচ্ছে।”
এই বলেই সে পুনরায় রান্নাঘরে ফিরে যায়। এদিকে সাদ তাকে আটকাতে গিয়েও পারল না। শেষমেশ হতাশ হয়ে সে নিজেও তার পেছন পেছন এগিয়ে গেল। এদিকে বাড়িতে প্রবেশ করে, কেকে আবার কোথায় হারিয়ে গেল—তা দেখার নূন্যতম ইচ্ছে না থাকায়,সুহিন আর একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না।
এদিকে সুহিন অস্থিরতায় কি করবে বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে সাদ এসে তার উদ্দেশ্যে বলল,
“আচ্ছা তুমি এতো ইন্ট্রোভার্ট কেনো? একটু তো নরমাল…”
সুহিন তার কথা আদৌও শুনতে পেল কিনা জানা নেই। তবে তাকে থামিয়ে দিয়ে,সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“আইসক্রিম খাবেন? আমার কাছে আইসক্রিম আছে অনেকগুলো।”
সাদ খানিক থতমত খেয়ে বলল,
“আইসক্রিম? আমি কি বাচ্চা নাকি…আচ্ছা থাকলে দাও। আমার খিদে পেয়েছে।”
তার কথা শোনামাত্রই সুহিন মৃদু হাসে। কেকের বন্ধু বিধায় অবশ্যই সবার বয়স তারমতোই হবে। অথচ সাদ নামের লোকটার সবকিছুই কেমন যেন বাচ্চামিতে ভরপুর।
সুহিন ফ্রিজ খুলে আইসক্রিমের বক্সটা বের করে,সাদের উদ্দেশ্যে বলল,
“নিন,কোন ফ্লেভারের খাবেন?”
সাদ আইসক্রিমের বক্সটার দিকে তাকিয়ে খানিক অবাক হলো।
—“এতোগুলো আইসক্রিম? এই বাড়িতে তোমার চেয়ে পিচ্চি তো আর কাউকে দেখিনা। তাহলে এসব তোমারই?”
সবাই তাকে এমনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে,যেন সে একটা বাচ্চা। সুহিন এতে খানিক হতাশ হলেও,কিছুই বলল না। সামান্য মৃদু হেসে মাথা ঝাকিয়ে আওড়ায়,
“হুম।”
এদিকে সাদ বক্স থেকে একটা চকলেট ফ্লেভারের কোন আইসক্রিম বের করে, তা খেতে শুরু করল। একইসাথে সুহিনের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
“সকাল সকাল খালি পেটে আইসক্রিম খাচ্ছি। যাই হোক, সুহিন তোমায় একটা বিষয় বলার ছিল।”
সুহিন বেশ মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“জ্বী বলুন।”
—“তোমার কাছে আমাদের কেকে ব্রো-কে কেমন লাগে? ওহ্, এক সেকেন্ড। তুমি কি তার সাথে দেখা করেছো? না হলে চলো…”
সুহিন তার কথায় খানিক আঁতকে ওঠে। আমতাআমতা করে আওড়ায়,
“না,না, প্রয়োজন নেই…আমি বরং…”
সুহিনের কথা শেষ হবার আগেই,সাদ নিজের ভ্রুজোড়া খানিক কুঁচকে ফেলে। পরক্ষণেই সে কি যেন ভেবে, স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“ওহ হ্যাঁ,এটা তো কেকেরই বাড়ি। যেহেতু তুমি এই বাড়িতে থাকো, তাহলে তো ওর সাথে তোমার আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো কিছু নেই।”
“জ্বী”,সুহিন জোরপূর্বক হেসে বলল। অন্যদিকে সাদ আবারও খেতে খেতে আনমনে বলতে শুরু করে,
“আচ্ছা,তোমার মতে একদম পারফেক্ট হ্যান্ডসাম হতে কি জ’লাইন থাকা আবশ্যক?”
তার কথায় সুহিন কপালটা খানিক কুঁচকে ফেলে। সে হয়তো বুঝতে পারেনি, সাদ কি বলতে চাচ্ছে। ফলে সে উৎসুক স্বরে ভ্রুকুটি করে বলল,
“এই জ’লাইনটা কি?”
—“এ্যাই তুমি জ’লাইন চেনো না?”,অবাক স্বরে সাদ বলে। সুহিন বোকার মতো মাথা নেড়ে আওড়ায়,
“না।”
—“কি বলো, এটা তো নাকি নিজেকে পারফেক্ট সুদর্শন দেখানোর সবচেয়ে বড় অস্ত্র।”
—“মানে?…এটা আবার কি জিনিস?”
—“আরেহ…ঐ যে চোয়ালের মধ্যে দেখো না, জে-এর মতো একটা তীক্ষ্ণ শেইপ থাকে। আরেহ, এতো কেনো পেঁচাচ্ছি! কেকে-কে তো দেখেছো নিশ্চয়? আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেস্ট শার্প জ’লাইন তো ওরই আছে।”
সুহিন তার কথায় খানিক ভাবনাচিন্তা করে,কেকের মুখটা নিজের মানসপটে ভাসিয়ে স্মরণ করল। পরক্ষণেই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, আনমনা স্বরে বলল,
“ওহ ওইটা! আমি তো আরো ভাবলাম, ওনার চাপা ভাঙা।”
সুহিনের কথায় সাদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। এই মেয়েটা কত সাধাসিধা। অথচ আজকালকার মেয়েগুলো…! এইতো কিছুমাস আগের কথা। তার ভালাভোলা সাড়ে তিনদিনের রিলেশনশিপটা ভাঙ্গল এই জ’লাইনের জন্য। কারণ রিলেশনের শেষ দিনে, গার্লফ্রেন্ড হুট করল বলল—কেকের মতো জ’লাইন বানাতে না পারলে,ব্রেকআপ। আর শেষমেশ উপায় না পেয়ে,তাকে ব্রেকাআপই করতে হলো।
সেইসময় কেকের উপর এই নিয়ে রাগ হলেও,আজ অবশ্য সুহিনের কথায় তার মনে খানিক শান্তির জোয়ার বইছে। একইসাথে তার হাসিও পেল। এরিমধ্যে সে আবারও সুহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আর কেকের এই হাস্কি স্বর? এটা কেমন লাগে তোমার?”
সুহিন সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মুচকি হেসে বলল,
“কাউয়া কাদেরের মতো।”
সাদের কপাল কুঁচকে যায়। সে ভ্রুকুটি করে বলে,
“এই কাউয়া কাদের আবার কে?”
“আপনি কাউয়া কাদেরকে চেনেন না? সে আমাদের দেশের জাতিও কাউয়া। কাউয়াদের লিডার।”
—“কিন্তু তার সাথে কেকের হাস্কি স্বরের কি সম্পর্ক?”
—“আরে এখনো বোঝেননি? ঠিক আছে,আমি তাহলে বুঝিয়ে বলছি।আ…হাস্কি স্বরকে সহজ বাংলা ভাষায় কি বলে জানেন? ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজের কন্ঠস্বর। আর এটা জানার পর আমার শুধু একজনের কথাই মনে পড়ে, সে হলো আমাদের কাদের কাউয়া কিংবা কাউয়া কাদের।একটা বললেই হলো। যাই হোক,আমাদের কাদের কাউয়ার ভয়েসও এই অতিমাত্রায় ঘ্যাসঘ্যাস-ফ্যাসফ্যাস টাইপের।
আরেকটা বিষয় খেয়াল করুন। ওনার নামও কেকে। আবার কাদের কাউয়ার নামও কিন্তু ইংরেজি সর্ট-ফর্মে কেকে হয়। দেখেছেন? একদম মিলে গিয়েছে।”
এ যেন গনিতের কঠিন কোনো অংক মেলানোর খেলা ছিল। যা মিলিয়ে সাদকে বোঝাতে পেরে সুহিন মহাখুশি। সাদ তার কথাগুলো এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কথা শেষ হতেই সে বেশ জোরেসোরে হেসে ফেলল। তার হাসিতে সুহিনও হাসতে লাগল।
এরিমধ্যে সাদ নিজেকে কোনোমতে থামিয়ে,নিঃশব্দে হেসে হেসে আওড়ায়,
“এতো হেঁসো না। তোমার এসব কথা শুনতে পেলে,কেকে বৈশাখমাসের কালো ঘূর্ণিঝড় হয়ে হানা দেবে। যদিও তোমার এসব কথাবার্তা শুনে আমি নিজে যথেষ্ট কনফিডেন্স পাচ্ছি।”
তার কথায় সুহিনও নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু বারবার সাদকে হাসতে দেখে তারও হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে হাসি নিমিষেই গায়েব হয়,খানিকটা দূরে নজর পড়ামাত্রই। পিলারের গায়ে ঠেস গিয়ে,বুকে হাত গুঁজে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাত করে দাঁড়িয়ে আছে কেকে। তার তীক্ষ্ণ-শান্ত রহস্যময় দৃষ্টি—সম্পূর্ণ তার দিকেই নিক্ষিপ্ত। সুহিনের চোখ-মুখ চুপসে যায় অনায়াসে। লোকটা এভাবে কেনো তাকিয়ে আছে? মনে হচ্ছে যেন নিঃশব্দে কাঁচা গিলে খাবে। বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই অথচ ভাবগাম্ভীর্য সম্পূর্ণ অদ্ভুত।
সুহিন না চাইতেও কিঞ্চিৎ ঢোক গিলল। হাতে তার এখনও সিগারেটের পোড়া দাগ ক্ষতরূপে জেগে আছে। লং হাতা হওয়ায় ক্ষতটা কারো নজরে না এলেও,ব্যাথাটা তো এখনও আছে। সুহিন আর একমুহূর্তও দেরি না করে, সাদের উদ্দেশ্যে ইতস্তত স্বরে বলল,
“আ…আমি এখন আসছি। আপনার কিছু লাগলে ওদের বলে দেবেন প্লিজ।”
এই বলেই সে সাদকে কোনো প্রকার সুযোগ না দিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বাড়ির অন্যদিকে চলে যায়। এতে সাদ খানিক অবাক হলেও,তার আর কিছু করার রইল না। মেয়েটার হুটহাট কি হয় কে জানে!
চেয়ারে গা এলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে কেকে। হাতে আঙ্গুলের ডগায় সাদা-কালো কাগজে মোড়ানো সিগারেটের অর্ধাংশ। ওল্ফকাটের চুলগুলো বরাবরের মতোই এলোমেলো। পরনে কালো শার্ট,প্যান্ট। এছাড়া গায়ে ম্যাট ব্লাক লেদার জ্যাকেট জড়ানো। নতুনত্ব বলতে বিশেষ কিছু নেই। যেন এসব মিলিয়েছি কেকে নিজস্ব এক বিশেষত্ব।
তবে তার সামনে পুলিশ ইউনিফর্মে বসে থাকা পুলিশ অফিসারটার কপাল খানিক কুঁচকে রয়েছে। বিত্তশালী-ক্ষমতাধর পরিবারের সদস্য হওয়ায়, আদব-কায়দার আশা অফিসারটি করল না। সে কিছুটা হলেও জানে, এই কেকে কেমন। তাই তার কাছ থেকে আদব-কায়দা, ভদ্রতার আশা করাটা বেকার। এই যেমন একজন পুলিশ অফিসারের সম্মূখে নির্বিকারে বসে, কেকে পায়ের উপর পা তুলে পা নাচাচ্ছে। আবার কখনো কখনো সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। এতো বেয়াদবির পরও আর কি বলার থাকে?
পুলিশ অফিসার রাদিফ হান্নান বিরক্তিতে খানিক ভারী শ্বাস ফেলল। বয়সে সে কেকে চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড় হতে পারে। তবে আজ নিজের গায়ে জড়ানো ইউনিফর্মটাকে এই লোকের সামনে বড়ই তুচ্ছ ঠেকছে।
রাদিফ ঠিকঠাক ভঙ্গিতে বসে,রুক্ষ স্বরে বলল,
“বলুন, এমন কি বিষয়ে কথা বলতে চান—যার জন্য স্বয়ং আপনি এই পুলিশ স্টেশনে এসেছেন?”
আশেপাশে তারা দুজন ব্যতীত আর কেউ নেই। কেকের ইচ্ছেতেই সকল কনস্টেবল হতে সবাই বাহিরে চলে গিয়েছে। কেকে রাদিফের কথায় আরো খানিকটা গা ছাড়া ভঙ্গিতে বসে, রাদিফকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করল। পরক্ষণেই শীতল-গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“একটা পুরোনো কেস নতুন করতে ঘাঁটতে হবে। হাতে সময় খুবই কম।”
তার কথায় রাদিফ কপাল কুঁচকে ফেলল। সে ভ্রুকুটি করে আওড়ায়,
“পুরোনো কেস বলতে, আপনি কোনটার কথা বলছেন?”
—“আমার বাবা শাহমীর কাহসান চৌধুরী ও রাফায় আমিনের মৃত্যুর ঘটনাটাকে নতুন করে ইনভেস্টিগেশন করুন।”
—“মানে? এতোবছর পর হঠাৎ এই ঘটনা…।আর তার চেয়ে বড় বিষয়, ওনাদের মৃত্যুটা যে একটা এক্সিডেন্ট—এটা তো তখনই বলা হয়েছিল। এই কেস আবার নতুন করে কেনো…?”
—“কারণ আমি আমি চাইছি। আমার জানা মতে, এই কেসটা সেইসময় আপনি হ্যান্ডেল করেছিলেন।এন্ড ইউ সেড ইট ওয়াজ জাস্ট এন অ্যাকসিডেন্ট। বাট আই ওয়ান্ট ইউ টু ইনভেস্টিগেট ইট এগেইন।”
রাদিফ হান্নান চিন্তিত ভঙ্গিতে ভারী শ্বাস ফেলল। খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে,নির্বিকারে বসে থাকা কেকের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?”
—“নো।”
—“আ…রাফায় আমিনের স্ত্রী তো আপনার…”
রাদিফ কথাটা সম্পূর্ণ করল না। কেকের তীক্ষ্ণ চোয়াল শক্ত হলো অনায়াসে। একইসাথে তার হিংস্র-শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রাদিফ একপ্রকার ভড়কে গেল। এবং কথার সুর পরিবর্তন করে বলল,
“আ…মানে, রাফায় আমিনের একট মেয়েও আছে। সে তো আপনাদের বাড়িতেই থাকে, তাই না?”
—“হুম।”
—“ওর নামটা যেন কি?”
কেকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিরেট কন্ঠে আওড়ায়,
“হানি! উম্মে হানি সুহিন।”
রাদিফ আর কথা বাড়ায় না। এই উদ্ভট লোকের সামনে তার মতো অফিসারেরও বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক নয়। যথারীতি সে জোরপূর্বক মৃদু হেসে বলল,
“আপনি কিছু নেবেন? চা-কফি…”
—“নো থাংকস্!”
—“আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি যা বললেন তাই হবে। আমি না হয়, আমার টিম নিয়ে আবারও কেসটা রিইওপেন করব।”
কেকে রাদিফকে শেষ একবার তীক্ষ্ণ-শীতল দৃষ্টিতে পরখ করে,সোজা উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবার আগে শেষবারের মতো রাদিফকে ধন্যবাদ জানানোরও প্রয়োজন মনে করে না। বরং যেভাবে এসেছিল,সেখানেই সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
এদিকে কেকে চলে যাওয়া মাত্রই, রাদিফ স্বস্তিতে ভারী শ্বাস ফেলে। এবং তড়িঘড়ি করে কাউকে ফোন করল। কল রিসিভ হওয়া মাত্রই, সে অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,
Naar e Ishq part 3
“একটা খা’রাপ খবর আছে। শাহমীর কাহসান চৌধুরীর ছেলে কাশিফ কাহসান চৌধুরী এসেছিল। আমাকে বলেছে, তার বাবা আর রাফায় আমিনের কেসটা নতুন করে রিইওপের করে ইনভেস্টিগেশন করতে। হঠাৎ তার এমন কেন চাওয়া জানি না। তবে এই কেকে-কে কোনোভাবেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। এর এখন কি করা যায়? বাপের মতোই এটাকেও সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্তা করব?”
