Naar e Ishq part 5

Naar e Ishq part 5
তুরঙ্গনা

তালহা রিজভী দেখতে বেশ উঁচু-লম্বা, ফর্সা গড়নের। সহজ ভাষায় যাকে স্রেফ সুদর্শন বলাই যথেষ্ট নয়। খানিক গম্ভীর স্বভাবের হওয়ার পাশাপাশি, কথাবার্তাও খুব কমই বলে।
আজ কেকে হুট করে কোথায় গায়েব হয়েছে তা কেউ জানে না। হয়তো ফিরে আসবে রাতের মধ্যেই। কিন্তু এরফাঁকে চার বন্ধু মিলে কি করবে,তারও ব্যবস্তা সাদ আর ফারিস করে ফেলেছে।
ফারিস এলাকার আশপাশটা মোটামুটি ভালো মতোই চেনে। যথারীতি তালহার বিশেষ তেমন ইচ্ছে না থাকলেও, চারজনে গাড়ি নিয়ে একত্রে ঘুরতে বেরিয়েছে। সকলের বেশভূষাও প্রায় একই। কেউ কালো জ্যাকেট নয়তো হুডি-প্যান্ট পড়েছে। সচারাচর ব্ল্যাকভেইনের সদস্যদের যেমন সাধাসিধা এক কালো রঙ কিংবা সামান্য সাদার আড়ালের সাজসজ্জায় দেখা যায়—ঠিক তেমনই।

সাদ আর ফারিসের মাঝে জায়ান মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে। বয়সের সাথে সাথে তার মাঝে ম্যাচিউরিটি-অ্যাটিটিউট সবটাই প্রখরভাবে বিরাজ করে। তবে খানিক বন্ধুসূলভ হওয়ায়, সাদ আর ফারিসের মাঝেই তাকে বেশিরভাগ সময় পাওয়া যায়। যথারীতি তিনজন মিলে পার্কের একটা পাশে কিসব আড্ডায় মেতে আছে। অন্যদিকে তালহা তাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিজের মতো হাঁটতে হাঁটতে চারপাশটায় নজর বুলাচ্ছে।
এরিমধ্যে আচমকা কোথায় থেকে যেন,আচমকা একটা সদ্য ভার্সিটি পড়ুয়া অল্পবয়সী মেয়ের সাথে তার বাহুতে সামান্য ধাক্কা লাগল। ধাক্কাটা সামান্য হলেও,রোগা-সোগা মেয়েটা ধপাৎ করে নিচে পড়ে গেল। সকালে হালকা বৃষ্টি হয়েছিল বিধায়, ঘাসে বিছানো বিস্তৃত জায়গাটুকু খানিক ভিজে-সিক্ত অবস্থায় রয়েছে। যথারীতি মেয়েটি নিচে পড়তেই, কাঁদা-মাটিতে তার হালকা গোলাপি রঙের স্নিগ্ধ গাউনটা সম্পূর্ণ নোংরা হয়ে যায়।
অথচ তালহা বিষয়টা খেয়াল না করেই,গুরুগম্ভীর ভাব নিয়েই আনমনা হয়ে আওড়ায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সরি।”
তাহলা ভেবেছিল সামান্য ধাক্কায় তেমন আর কিই বা হয়েছে। তার তো ধারণাতেই নেই,তার মতো বড়সড় আকৃতির মানুষটার সাথে সামান্য খানিক ধাক্কা খেয়েই একটা জ্যান্ত মানুষ নিচে ধপাস করে পড়ে রইছে। যথারীতি সে আবারও নিজের মতো সামনের দিকে পা বাড়াবে—তৎক্ষনাৎ পেছন হতে সেই রমণী ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“ও হ্যালো মিস্টার! বেটা মানুষের যে মেয়ে দেখলে হুঁশ থাকে না জানতাম—কিন্তু এভাবে যে অসভ্যের মতো ধাক্কা মে’রে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন—তা ম্যানার্স-ট্যানার্স বলতে কি কিচ্ছু নেই?”
মেয়েটির কন্ঠস্বরে তালহা পেছন ফিরে তাকায়। ফর্সা গড়নের মিষ্টি একটা রোগা-সোগা মেয়েকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে—তার ভ্রু-জোড়া কুঁচকে যায়। আবার তালহাকে এভাবে স্তব্ধ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,মেয়েটি পুনরায় বিরক্তিতে ভ্রুকুটি করে বলল,

“কি আশ্চর্য! এভাবেই আলু মোটা ভালুর মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন? সাহায্য করুন আমাকে।”
তালহার মতো এমন গম্ভীর মানুষটাও, হঠাৎ এই পিচ্চি মেয়েটার অভিব্যক্তিতে খানিক ভড়কে গেল। নিজের অকর্মের কথা বুঝতেই,সে তড়িঘড়ি করে মেয়েটিকে টেনে তোলে। একইসাথে সে এটাও ভালোমতো টের পেল—মেয়েটির ওজন হয়তো তুলোর চেয়েও হালকা হবে। শরীরে হাড়-হাড্ডি ছাড়া আদৌও আর কিছু আছে কিনা, তা বলা মুশকিল।
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েই সবার আগে মাথা এপাশ-ওপাশ করে নিজের জামাটা দেখল। পরক্ষণেই বিস্ময়ের সহিত তালহার দিকে চেয়ে,দাঁতে দাঁত খিঁচে বলে উঠল,
“এসব কি? কি করলেন এটা? আমি এই অবস্থায় এখন বাড়ি কিভাবে যাব?”
তালহা সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ। একপলকে পরখ করে মেয়েটিকে দেখে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে
নির্বিকার স্বরে বলল,
“আই’ম সরি।”

—“শুধু সরি? এই সরি দিয়ে কি আমি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো?”
তালহা আবারও নিশ্চুপ রয়। ইচ্ছে করছে এখান থেকে চলে যেতে। মেয়ে মানুষের সাথে অতিরিক্ত কথা বলার মতো মুড তার কোনোকালেই নেই। কিন্তু এখান থেকে গটগট করে কিভাবে চলে যাবে,তাও বুঝতে পারছে না। এদিকে মেয়েটি পুনরায় তার মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল,
“ও হ্যালো,মিস্টার ভাল্লুক! কিছু বলছেন না কেনো?”
এই পর্যায়ে তালহা বেশ বিরক্ত হলো। হাঁটুর বয়সী মেয়ের এটা কেমন বিহেভিয়ার? সে ভ্রুকুটি করে খানিক রুক্ষ স্বরে বলল,

“সরি বলার প্রয়োজন ছিল বলেছি। কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষকে আলু মোটা ভালু আবার ভাল্লুক বলা কোন ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে?”
মেয়েটি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,
“তো ভাল্লুকের মতো কাজকর্ম করলে,আর কি বলবো?”
তালহা আর কথা বাড়ায় না। সে চলে যেতে পা বাড়াবে,ঠিক তৎক্ষনাৎ মেয়েটি পুনরায় তার সামনের এসে দাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আরে আরে কোথায় যাচ্ছেন! আমার যে এই হাল করল,তার সাথে আগে পরিচয় করে নেব না?”
মেয়েটি এই বলে বিস্তৃত মুচকি হেসে, তালহার দিকে হ্যান্ডশেক্ করতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“হাই,আমি নাফিসা নূর। তা মিস্টার ভালু আপনার নাম কি?”
তালহা বিস্তৃত হাসিমাখা নাফিসাকে খানিকটা ভ্রুকুটি করে চেয়ে দেখল।তবে হাত না মিলিয়ে,স্রেফ ভারী শ্বাস ফেলে, গম্ভীর স্বরে বলল,
“আমি তালহা। তালহা রিজভী।”

—“ওয়াউ! নাইস নেইম। আপনি বেশ সুন্দর আছেন।”
তালহা তব্দা খেয়ে চোখের পলক ঝাপটে ভারী শ্বাস ফেলে। হয়েছে,এরচেয়ে বেশি এই মেয়ের সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। এই ভাবনায় সে, সামনের দিকে নিজের মতো পা বাড়ায়। নাফিসা তাকে থামানোর চেষ্টা করে বলে,
“আরেহ্ আরেহ্, কোথায় যাচ্ছেন?কথাই তো শেষ…”
—“আমায় যেতে হবে।”, নাফিসার দিকে না তাকিয়েই, গম্ভীর স্বরে তালহা বলল। ওদিকে পেছন হতে নাফিসা বলিষ্ঠ দেহের তালহাকে দেখতে দেখতেই—ফিঁচকে হেসে আওড়ায়,
“আলু মোটা ভালুটা বেশ চমৎকার তো! কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাব। বেটা আসলেই একটা ভাল্লুক!”

রাত এগারোটা বাজতে চলল। বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী সবাই রাতে খাবার আটটা-নয়টা নাগাদ খেয়ে নিয়ে, নিজ নিজ রুমে চলে গিয়েছে। যথারীতি বাড়ির ভেতরের সার্ভেন্টগুলোও যে যার মতো নির্দিষ্ট ঘরে জেগে কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ড্রইং রুম হতে বিশালাকৃতির রান্নাঘর—সবটাই এখন নিস্তব্ধ। কোথাও কারো পদচারণা নেই। আশেপাশে মেইন লাইট গুলোও অফ করে, শুধু ডিমলাইটগুলো জ্বালিয়ে রাখা।
এরিমধ্যে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল কেকে। পরনে এক কাপড়ে বেড়িয়ে যাওয়া একইসব বেশভূষা। হাতে অবশ্য একটা পলিথিনের ব্যাগও আছে। তবে তার চোখে-মুখের ভাবগাম্ভীর্য খানিক ভিন্ন। তাকে দেখে দুজন সার্ভেন্ট এগিয়ে এলে,সে তাদের দুজনকে চোখের ইশারায় ভেতরে চলে যেতে বলল। অতঃপর কি যেন এক ভাবনায় কেকে সরাসরি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

নিজের পরনের কালো জ্যাকেটটা খুলে পাশে রেখে দেয়। একইসাথে নিজের সাথে করে বাহির থেকে নিয়ে আসা কিছু জিনিসপত্রের ব্যাগটাও টেবিলের উপর রাখল। অতঃপর সাদা-কালো কিচেন এপ্রনটা নিজ গায়ে জড়িয়ে পড়ে নেয়। ফ্রিজ খুলে দেখে উপকরণ হিসেবে কি কি রয়েছে। কাজের মতো তেমন কিছু যে বাড়িতে থাকবে না, তা সে জানত। তাই যা যা দরকার ছিল,সেসব বাহির থেকে নিজেই নিয়ে এসেছে। হঠাৎ আজ তার এমন কেনো ইচ্ছে জেগেছে,তা হয়তো সে নিজেও জানে না।

কেকের বাম হাতে KK অক্ষর খচিত একটি কালো ব্রেইডেড ব্রেসলেট এবং একটি কালো ডিজিটাল ওয়াচ সর্বদাই দৃশ্যমান। একইসাথে হাতের মধ্যমা আঙুলে আছে কালো ম্যাটালের দামী প্লেইন রিং। কেকে প্রস্তুতির জন্য সেসব আচমকাই খুলে ফেলল। বুঝতে পারছে না, কোনটা দিয়ে কি শুরু করবে। এসব কাজে সে খুব একটা অভস্ত্য-দক্ষ নয়। যথারীতি উগ্র মেজাজের কেকে নিমিষেই অস্থির হয়ে পড়ল। এবং তৎক্ষনাৎ কি যেন ভেবে, ব্রেসলেট, ঘড়ি আর রিংটা পড়ে নেয়। উদ্দেশ্য তার সরাসরি নিজের রুমে চলে যাবে। এসব কাজকর্ম তাকে দিয়ে হবে না।
আবার কি যেন ভেবেই সে নিজেকে থামায়। সবকিছু ফেলে রেখে চলে যেতে থাকা চাওয়া কেকে,নিমিষেই পেছন ঘুরে আবারও ফিরে আসে। পুনরায় বিশেষ কিছু রান্নার প্রস্তুতি নেয়। নিজের সাথে করে আনা ব্যাগ থেকে এক বক্স ব্লু-বেরি বের করল। এই দেশে এসব ফলের আধিক্যতা তেমন নেই বললেই চলে।তবে তার কাজের জন্য এগুলো প্রয়োজন ছিল।

এরপরই শুরু হলো নিস্তব্ধ রাতের নিশাচর প্রাণীর মতো কেকের নানান কাজকর্ম। শুরুতে প্রচন্ড বিরক্তির সাথে ইন্টারনেট ঘেঁটে নেয়।পরক্ষণেই তোরজোর লাগিয়ে তৈরি করতে থাকে ব্লুবেরি চিজ কেকের ব্যাটার। প্রায় দেড় ঘন্টার মতো খাটাখাটুনির পর, কেকের মিশ্রনটাকে সে ওভেনে ঢুকিয়ে ক্ষ্যান্ত হয়।
কেকে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে,রাত বারোটা ছাড়িয়েছে। কিন্তু এখন তো কেক সম্পূর্ণ বেক হওয়ার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যথারীতি সে ভারী শ্বাস ফেলে, গা থেকে কিচেন এপ্রনটা খুলে ফেলল। অতঃপর তল্লাশি চালায় বাড়ির বড়বড় ফ্রিজ দুটোয়। এবং খুব অল্প সময়ের মাঝেই সে তার কাঙ্খিত জিনিসটা পেয়েও যায়।
কেকে আইসক্রিমের বক্সটা টেনে বের করে। অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বক্সের ভেতরে থাকা অবশিষ্ট আইসক্রিমগুলো গুনতে থাকে। সবমিলিয়ে ছোট-বড় আরো সতেরোটা আইসক্রিম রয়েছে। কেকে আচমকাই আইসক্রিমের বক্সটা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে যাবে—তৎক্ষনাৎ সে নিজেকে থামিয়ে দেয়। আর যাই হোক,খাবার নষ্ট করাটা মোটেও ঠিক নয়।

এই ভাবনায় সে নিজেই খানিক বিরক্তি নিয়ে, আইসক্রিম গুলো খেতে শুরু করল। অথচ আইসক্রিম তার কখনোই তেমন পছন্দের নয়। ভাবভঙ্গি এমন যেন, আইসক্রিমগুলো সে অজানা এক জেদ-ক্রোধ নিয়েই খেয়ে চলেছে।এভাবে কেক বেক হতে হতে, সে গুনে গুনে সতেরোটা আইসক্রিমই খেয়ে ফেলল। এবং আশ্চর্যজনকভাবে এঁটো আইসক্রিমের কাগজগুলো সে বক্সে রেখেই,পুনরায় তা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। একইসাথে তার ঠোঁটের কোণায় ফুটে ওঠে তুষ্টময় তির্যকহাসি। যেন এই কাজটা করতে পেরে,সে জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজটা করে ফেলেছে।
কেকে ওভেন থেকে চিজকেকটা বের করে স্বস্তিতে ভারী শ্বাস ফেলল। যাক খুব বেশি একটা খারাপ হয়নি। তবে এটাকে এখন আবার ফ্রিজেও রাখতে হবে। যথারীতি দ্রুত ঠান্ডা করার জন্য, কেকটা সে ডিপফ্রিজে রেখে দেয়। আরো ঘন্টাখানেকের মতো অপেক্ষা!

কেকে কানে ব্লুটুথ গুঁজে গান শুনতে থাকে। একইসাথে কিচেনের টপ ফ্লোরে বসে, পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে শিস বাজায়। এতোক্ষণ ধরে রান্নাঘরে কেকের অবস্থান করায়, জেগে থাকা সার্ভেন্টদের মাঝে খানিক আগ্রহ জাগলেও—কারো আর সাহস হলো না, কেকের কথা অমান্য করে তার অব্দি আসার।
এভাবে দেখতে দেখতে রাত দেড়টা বেজে যায়। বাড়ির সকলেরই এইসময় ঘুমে থাকার কথা। কিন্তু কেকে প্রচন্ড আত্নবিশ্বাসের সাথে নিজের কাজ করছে। ফ্রিজ থেকে চিজ-কেক বের করে, তাতে কিছু আস্ত ব্লু বেরি সাজিয়ে দেয়। অতঃপর গায়ে জ্যাকেটটা জড়িয়ে,একহাতে কেক ও অন্যহাতে একটা ছুরি নিয়ে—গুনগুনিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে দোতলার দিকে এগিয়ে যায়।

ঠিক সুহিনের কক্ষের সামনে এসেই সে থেমে দাঁড়ায়। হাতের ছুরিটাকে দুআঙুলের সাহায্যে দক্ষ হাতে কয়েকবার ঘুরিয়ে, নীলচে কেকের ঠিক মাঝবরাবর ছুরিটি গেঁথে দেয়। এবং দরজার আলতোভাবে দুবার নক্ করে।
মুহূর্তের মাঝেই দরজা খোলার শব্দ হয়। সুহিন জেগেই ছিল। মাফিনের সাথে নিত্যদিনের অভ্যাসের মতো খেলছিল। কিন্তু আচমকা দরজায় শব্দ হতে দেখে,সে বেশ অবাক হয়। ভেবেই বসে,বাড়ির কার না কার ক্ষ’তি হয়ে বসলো!
কিন্তু দরজটা খোলামাত্রই যে কেকের মুখোমুখি হবে,তা কখনোই কল্পনা করেনি। এলোমেলো চুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কেকে-কে একপলক দেখেই তার হৃদপিণ্ড থমকে যায়। ফলে অজানা এক আতংকে সে অদ্ভুত এক কাজ করে বসে।
আচমকাই সে খট করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে উদ্বিগ্ন হয়। তবে তৎক্ষনাৎ কেকে শক্তহাতে দরজা ঠেকায়। তার তীক্ষ্ণ চোয়াল শক্ত হয় অনিমেষেই। এ্যাশ-ব্ল্যাক চোখজোড়াতেও তীব্র হিংস্রতা ফুটে ওঠে।

—“হাই ব্লু-বেরি!”
কেকে দাঁত কটমট করে এহেন কথা আওড়িয়ে, পুনরায় দাঁতে দাঁত পিষে হাস্কি স্বরে বলল,
“সাহস কি করে হয়,আমার মুখের সামনে দরজা লাগানোর?”
সুহিন তার অভিব্যক্তিতে অজান্তেই কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। পরনে লাল রঙের গাউনটা শক্তহাতে আঁকড়ে ধরে। তবুও নিজেকে দৃঢ় রাখার চেষ্টায় বলল,
“এতো রাতে,এখানে কেনো এসেছেন?”
কেকের মুখশ্রীতেই সুহিনের আতংকিত দৃষ্টিজোড়া নিক্ষিপ্ত। বাদবাকি কোনোকিছুতেই তার খেয়াল নেই। এদিকে কেকে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। আড়ালে খানিক ভারী শ্বাস ফেলে, নির্বিকারে বলল,
“ভেতরে আসতে বলবি না?”

সুহিন কেকের এই শিকারির ন্যায় রহস্যময় চোখজোড়ায় বারংবার ঘাবড়ে যায়। যেন এই চাহনিতেই সে ধ্বংস। যথারীতি এবারও সে বেশ ঘাবড়ে গেল। কেকের চাওয়াকে গ্রাহ্য না করতে চেয়েও,সে অজান্তেই খানিক দূর্বল হয়ে সরে দাড়ায়।কেকেও নিঃশব্দে তির্যক হেসে রুমের ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। এবং তৎক্ষনাৎ পা দিয়ে ঢেলে, দরজটা লাগিয়ে দেয়। ওমনি সুহিন পুনরায় আ”তংকিত স্বরে বলে ওঠে,
“দরজা কেনো লাগাচ্ছেন?”

কেকে জবাব দেয়না। সে ঘাড় বাঁকিয়ে সুহিনকে দেখে। সুহিন আবারও তার চাহনিতে চোখ মিলিয়ে ভীত হয়। এরিমধ্যে কেকে আচমকা কেকের মাঝথেকে ছুরিটা তুলে সুহিনের দিকে এগিয়ে ধরে। এতে সুহিন চমকে উঠলেও,পরক্ষণেই খেয়াল করে দেখে কেকে তার নিজের হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছে।
সুহিন ব্লু বেরি ও চিজের ফ্লেভারেই টের পেয়ে যায়, এটা কি! সাথে খানিকটা অবাকও হয়। এদিকে কেকে পুনরায় শীতল-গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“দ্রুত খেয়ে টেস্ট কর। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
তার কথায় সুহিন অবাক হলো। রাত-বিরেতে এসব কি কাহিনি করতে এসেছে! সে কিছুটা উৎসুক কন্ঠে কেকের উদ্দেশ্যে বলল,

“কেনো এসেছেন এতো রাতে? আর এসবের মানে কি?”
কেকে নিঃশব্দে সুহিনের দিকে দু’পা এগিয়ে যায়। সুহিন তাতে ঘাবড়ালেও নিজেকে শান্ত রাখে। এদিকে কেকে আবারও চোয়াল শক্ত করে, দাঁতে দাঁত পিষে হাস্কি স্বরে বলল,
“তুই ভালো করেই জানিস, আমি কৈফিয়ত দিতে পছন্দ করিনা।”
সুহিন কিঞ্চিৎ ঢোক গিলল। দরজটাও বন্ধ, রুমটাতেও তেমন আলো নেয়। তার এখন সত্যিই ভয় লাগছে।
কেকে তার হাবভাবে তির্যক হেসে বলে,
“ভয় পাচ্ছিস?”

সুহিন কিছুই বলে না। ভয়ে তার ভেতরটা শুকিয়ে আসছে। এমন বলিষ্ঠ দেহের লম্বাচওড়া মানুষটাক, অন্ধকারের মাঝে তার দৈত্যের মতোই ঠেকছে। সে বেশিক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারল না। যথারীতি কয়েকটা পা পিছিয়ে গিয়ে,জোর গলায় বলে উঠল,
“আমার থেকে দূরে থাকবেন আপনি!”
কেকে আচমকা তাচ্ছিল্য সরূপ মৃদু হাসে।

—“তাহলে সবাইকেই নিজের থেকে দূরে রাখ।কেবল আমার বেলাতেই কেনো এই অনিয়ম?”
সুহিন তার কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে ভ্রুকুটি করে বলল,
“মানে?”
এবারও কেকে নিরুদ্বেগ। কিছুক্ষণ সুহিনকে দেখে নিয়ে, সহসাই ভারিক্কি কন্ঠে বলে ওঠে,
“এতো রাতেও কার জন্য জেগে আছিস? ঘুমাসনি কেনো?”
সুহিন যেন থতমত খেয়ে যায়। এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
—“কি আশ্চর্য! আমি আবার কার জন্য…”
—“মুখ বন্ধ রাখ। অতিরিক্ত কথা আমার বিরক্ত লাগে। দ্রুত এটা খেয়ে বল, টেস্ট কেমন।”
—“কিন্তু এতো রাতে…আমি তো রাতের খাবার খেয়েছি।”

সুহিনের অসহায়ত্বের অভিব্যক্তিতে,কেকে বিষয়টা অগ্রাহ্য করে বলল,
“আমার মুখের উপর কোনো কথা বলবি না। যা করতে বলেছি,তাই কর।”
যথারীতি সুহিন আর উপায় না পেয়ে, কেকের কথামতো চিজ-কেকটা নিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। যদিও আজ বাড়িতে ডিনারের সময় কেকে ছিল বিধায়—সে বেশ শান্তিতেই রাতের খাবার সেরেছে। কিন্তু এই মূহুর্তে এই ব্লু-বেরি চিজ কেক খেতে তার খুব ভালো লাগছে। যেন পুরোটাই একাই শেষ করে দিতে পারবে।
সুহিন খেতে খেতেই মুখ তুলে কেকের দিকে তাকায়। কেকে আলমারির সাথে হেলায় নিয়ে,কাঁধ বাকিয়ে তাকে দেখছে। যথারীতি তার রহস্যময় চাহনিতে পুনরায় চোখাচোখি হয়ে, সুহিন ঘাবড়ায়। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“এতো রাতে, এটা আপনি কোথায় পেলেন?”
কেকের ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বলল,
“কেনো? খেতে ভালো না?”
—“না, না, অনেক ভালো। এটা তো আমার সবচেয়ে প্রিয়।”
—“জানি।”,কেকে অস্ফুটস্বরে বলল। ফলে সুহিন তা বুঝতে না পেরে আওড়ায়,
“হু?”

—“চুপচাপ খা। কোথায় থেকে এনেছি,তা তোর দেখার বিষয় না।”
হুটহাট কেকের রূপ বদলানোতে সুহিন থতমত খেয়ে যায়। সে মিনমিন করে বলল,
“আমি তো শুধু জানতে… ”
—“রাস্তার ধারে ফুটপাতে হকাররা বিক্রি করছিল। ওখান থেকেই নিয়ে এসেছি। এবার নিরদ্বিধায় খেতে পারিস।”
সুহিন বোকার মতো ক্ষুব্ধ কেকের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। পরক্ষণেই সহজসরল ভাবনায় বলে ওঠে,
“এটা কোন ফুটপাত? ফুটপাতেও হকাররা এসব বিক্রি করে? এটার কোয়ালিটি তো বেশ ভালো মনে হচ্ছে।”
সুহিনের এহেন সব কথাবার্তা কেকের চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। অজান্তেই ইচ্ছে করল,সুহিনকে ধরে একটা আছাড় দিতে। তবে সে কোনো কথা না বাড়িয়ে, নিজেকে শান্ত রাখে।অন্যদিকে সুহিন তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে, আবারও খেতে শুরু করল। একবার কেকে-কে খাওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করতে চেয়েও, আবার সাহস হলো না। এরিমধ্যে কেকে নিজে থেকেই বলে উঠল,

“এতো বড় খাদক হয়েছিস কবে থেকে? আমাকে তো একবার খাওয়ার জন্য, জিজ্ঞেসও করছিস না।”
কেকের ক্ষুব্ধতায় সুহিন ভড়কায়। সে কাইকুই স্বরে কিছু বলবে, তার আগেই কেকে তার দিকে এগিয়ে যায়। সুহিন আরো বেশি ঘাবড়ে গেলেও,যথাযথ ভাবে বিছানার কোণাতেই বসে থাকে।এরিমধ্যে কেকে আচমকা সুহিনের দিকে ঝুঁকে, তার ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা চিজের সামান্য মিশ্রণটুকু,ঘষে নিজের বুড়ো আঙুলের ডগায় তুলে নেয়। তা সরাসরি মুখে দিয়ে চেটেপুটে খেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে আওড়ায়,

“হুমম,ইট’স গুড।”
এদিকে সুহিন বিস্ময়ের নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ কেকে সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ থেকে,কেকের উপর থেকে কয়েকটি আস্ত ব্লু-বেরি তুলে নিয়ে আনমনে খেতে খেতে সুহিনের কাছ থেকে সরে—রুমের অন্যদিকটায় এগিয়ে যায়। একইসাথে ভারিক্কি গলায় বলে ওঠে,
“পুরোটা খেতে পারলে,এখনই শেষ কর।”

সুহিন নিজের ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে। সে অবাক নজরে এখনও দূরে নির্বিকারে হাঁটতে থাকা কেকের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে এটা কি হলো? সবটাই তো মাথার উপর দিয়ে গেল। অথচ কেকে সম্পূর্ণ নির্বিকার বিধায়,সে নিজেকেও সামলে নেয়। পুনরায় খাওয়াতে মনোযোগ দেয়।
এদিকে কেকে নির্লিপ্তে ‘মে হু না’ নামক সেই জনপ্রিয় এবং একইসাথে তার প্রিয় মিউজিকের শিস বাজিয়ে চলেছে। প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে,রুমের আশেপাশটা ঘুরে-ফিরে দেখছে। এরিমধ্যে তার নজর পড়ল,খাঁচায় মৃদু আলোয় চরকিতে খেলতে থাকা ছোট্ট মাফিন নামক অস্তিত্বটায়। যাকে দেখামাত্রই তার কপাল খানিক কুঁচকে যায়। তবুও সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শিস বাজিয়ে মাফিন অব্দি এগিয়ে যায়। এবং খাঁচায় বাম হাত দিয়ে মাফনিকে ছুঁতে যাবে,ঠিক তৎক্ষনাৎ পেছন হতে সুহিনের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

“খবরদার ওকে ছুঁবেন না! ও ব্যাথা পাবে।”
কেকের হাত থেমে যায়। সে শিস বাজানো থামিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে সুহিনকে দেখে। সুহিন ভড়কে গেলেও,নিজেকে সামলায়। কেকে তির্যক হেসে নিরেট হাস্কি স্বরে আওড়ায়,
“আমি ছুঁয়ে দিলেই বুঝি ব্যাথা লাগে,হাহ্?”
সুহিন তড়িঘড়ি করে নজর নামিয়ে নেয়। কেকে শুষ্ক হেসে, হাতে থাকা শেষ ব্লু-বেরিটা টস করার ভঙ্গিতে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে,সোজা নিজের মুখে ভরে নেয়। এবং হুট করেই আশেপাশে ড্রয়ারগুলো খুঁজে কিছু একটার সন্ধান করে। যা দেখে সুহিন অবাক হয়ে বলল,

“আপনি এখন আবার কি করছেন?”
কেকে উত্তর দেয় না। বরং নিজেই ফাস্ট এইড বক্সটা খুজে নিয়ে, তা থেকে একটা বার্ন ক্রিম বের করে সুহিনের দিকে এগিয়ে আসে। তাকে কিছু বুঝতে না দিয়েই,আচমকা হাতে হেঁচকা টান দিয়ে সুহিনকে তুলে দাড় করায়। সুহিন বোকা বনে গিয়ে শুধায়,
“আবার কি করছেন…”

তার কথা শেষ হতে না হতেই, শান্ত-হিংস্র শিকারি নেকড়ের ন্যায় ভঙ্গিতে, কেকে তার দিকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নিমিষেই সুহিন মিইয়ে গিয়ে,মাথা নুইয়ে ফেলে। অন্যদিকে কেকে ক্রিমের ছিপিটা মুখে ধরে, একটানে খুলে ফেলে। একইসাথে সুহিনের বাম হাতটা টেনে শক্ত করে চেপে ধরে।

Naar e Ishq part 4

আচমকাই জামার হাতাট টেনে সোজা কাঁধ অব্দি তুলে ফেলে। সুহিন এতে ভড়কে গিয়ে বিস্ময়ের নজরে কেকের দিকে মুখ তুলে তাকায়। অথচ কেকে সম্পূর্ণ নির্বিকার ভঙ্গিতে, গতরাতে জলন্ত সিগারেটের কারণে সুহিনের ফর্সা ত্বরে গোলাকার হয়ে থাকা ক্ষত স্থানটায়—মলমের মোটা প্রলেপ লেপ্টে দেয়। একইসাথে সুহিনের চোখে চোখ মিলিয়ে, তার নিকটে মুখ এনে রাশভারি হাস্কি কন্ঠে আওড়ায়,
“এটা তো কিছুই না। আমার কথা না শুনলে, সোজা টুকরো টুকরো করে কেটে নর্দ’মায় ভাসিয়ে দেবো। আর তুই খুব করেই জানিস—আমি ঠিক কি কি করতে পারি।”

Naar e Ishq part 6

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here