Tell me who I am গল্পের লিংক || আয়সা ইসলাম মনি

Tell me who I am part 1
আয়সা ইসলাম মনি

“র*ক্ত যদি তোমার র*ক্তে উন্মাদনা জাগায়, শিরায় আগুন ধরায়, মনকে প্রশান্তির মায়ায় জড়ায়—তাহলে খু*ন করা অন্যায় কীভাবে হয়? শিকারির তৃষ্ণা কি দোষের? যদি ধারালো অস্ত্রের ফাঁক গলে উষ্ণ র*ক্ত ঝরে, আর সেই দৃশ্য তোমার চোখে স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি জাগায়, এখানে ভুল কোথায়?”
অন্ধকারে, কৃষ্ণবর্ণের ট্রেঞ্চ কোট পরিহিত পুরুষটি চোখে অগ্নিময় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উচ্চারণ করল।

সৌন্দর্য এক গভীর অনুভূতি, যা ভাষার সীমা পেরিয়ে যায়। বিশ্বসংসারের প্রতিটি কণায় এর নিবিড় উপস্থিতি রয়েছে; কখনো বাহ্যিক দীপ্তিতে বা কখনো অন্তর্লীন মহিমায়। স্নিগ্ধ সূর্যোদয় বা ফুটন্ত ফুলের পাপড়িতে প্রকৃতি আমাদের তার রসে ভিজিয়ে দেয়। অথচ বাহ্যিক মোহে ডুবে আমরা তার গভীর রহস্য উপেক্ষা করি। সৌন্দর্য কারো কাছে পবিত্র, কারো কাছে নিষ্পাপ, আবার কারো কাছে অপার মায়া। কিন্তু যখন এই মোহ সীমা ছাড়ায়, তখন আমরা নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে সেই মোহময় ঘোরে ডুবে থাকি, যেখানে ভালো-মন্দের সব বিভাজন বিলীন হয়ে যায়।
আব্দুর রহমান হাওলাদার ঢাকার একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গত চব্বিশ বছর যাবত একটি খ্যাতনামা কলেজে বাংলা সাহিত্যের আলো ছড়াচ্ছেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সহজ-সরল, নম্র-ভদ্র এবং জ্ঞান-গম্ভীর এই মানুষটির শিকড় বরিশালের খাস মাটিতে হলেও, দুই দশক আগে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে ঢাকার মতিঝিলে নিজের নতুন ঠিকানা গড়ে তুলেছেন।
তার স্ত্রী আনোয়ারা মমতাজ বেগম গভীর ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। যিনি ঠান্ডা মাথায় সংসারটিকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। মমতাজের রূপের মোহ তার শৈশব থেকেই তাকে মায়াবী জগতে বন্দী করে রেখেছে। অপার সৌন্দর্যের অধিকারিণী মমতাজকে ঘিরে সমাজে ছিল নানাপ্রকার আলাপচারিতা। একজন নারীকে যখন অনেক পুরুষের আকর্ষণ লক্ষ্য করে, তখন তা তার মায়ের মনে গভীর উদ্বেগের সঞ্চার করে, কারণ এই পরিস্থিতি মেয়ের উপর অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে।
অত:পর মমতাজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেনার সেই ভয়ও তীব্র হতে থাকে। তাই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই মমতাজকে আব্দুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেন। অর্থাৎ কন্যার রূপকে সুরক্ষিত রাখার একটি উপায় খুঁজে পান।

মমতাজের দুই কন্যা; আইদাহ আহসান মিরা ও ইলিজা আহসান মাহিমা–দুই ভিন্ন মেরুর প্রতীক। মিরার রূপ বর্ণনায় ভাষা হারিয়ে যায়, সে হলো আকাশ থেকে নেমে আসা একটি উজ্জ্বল তারা। যার মুখমণ্ডলের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে কেউ অনন্তের পথে হারিয়ে যেতে পারে। তার অপরিসীম সৌন্দর্য মমতাজকে শৈশব থেকেই ভীত করে রেখেছে। মমতাজ মাঝে মাঝে মিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যান। মনে হয়, মেয়ের মুখ যেন আয়নার মতো। যেখানে তিনি নিজের অতীত, নিজের ভয়, নিজের রূপের অভিশাপ সব দেখতে পান। তাই সে মিরাকে সর্বদাই পর্দার আড়ালে রেখেছেন, যেন সেই ভয়ংকর সৌন্দর্য কারো মনে অস্থিরতা তৈরি না করে।
মিরা নিজেও মা-বাবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল, বিনয়ী এবং ধর্মপরায়ণ, এমন এক মেয়ে যার মধ্যে শান্ত নদীর প্রবাহ বহমান।
মমতাজ মিরাকে নিজের জীবনের মতো আগলে রেখেছেন। জানেন, অতিরিক্ত সৌন্দর্য যেমন আশীর্বাদ, তেমনই তা অভিশাপও বটে। সেই রূপ যেন মিরার জীবনের কোনো বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেইজন্য মমতাজ চিরকাল মিরার রূপকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন।

অন্যদিকে ইলিজা স্বভাবতই উচ্ছল, চঞ্চল। সে কোনো নিয়মকানুন মানার তোয়াক্কা করে না। তার চলনে-বলনে বিক্ষিপ্ততা আর নিজস্ব স্বাধীনতা তাকে আলাদা চরিত্রে রূপ দিয়েছে। মায়ের মতো রূপবতী হলেও ইলিজার মধ্যে রয়েছে স্বাধীন আত্মার স্পর্শ, যা তাকে পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে পৃথক করে রেখেছে।
মতিঝিলের শান্ত কোণে দাঁড়িয়ে আছে সাদামাটা, মায়াময় ‘মিরা মঞ্জিল’। লোহার গেট পেরিয়ে চোখে পড়ে ছোট্ট সবুজ বাগান, যার মাঝে লাল ইট বিছানো পথ। দুই পাশে সারি ধরে কাগজফুল, জারবেরা আর গন্ধরাজ গাছ দাঁড়িয়ে আছে। বামদিকে এক কোণে পাথরের ছোট একটি বেঞ্চ বসানো।
বাড়ির বাইরের দেয়াল হালকা অফ হোয়াইট রঙের। ঘরের ভেতরে পা রাখলেই মনজুড়ে প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়বে। দেয়ালের রং ধবধবে। মেঝেতে সাদা মার্বেলের ওপর ছড়ানো কিছু হাতের বুননের নকশা করা নরম গালিচা, আর ঠিক পাশে কাঠের তৈরি একটি ছোট্ট বুকশেলফ। ঘরের মাঝখানে সাধারণ টেবিলে কাঁচের ফুলদানিতে রাখা রজনিগন্ধা আর গোলাপ। আর এক পাশে রয়েছে পুরোনো দিনের একটা গ্রামোফোন। যেটাতে মাঝে মাঝে আব্দুর রহমান রবীন্দ্রসঙ্গীত কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলার গুনগুন সুর শুনতে থাকেন।

২২ জানুয়ারি, ২০১৬। ঘড়ির কাঁটা ভোর আটটা ছুঁয়েছে। বাড়ির ছোট কন্যা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখে পাউডারের কোমল ছোঁয়া দিতে ব্যস্ত। আজ তার বিদ্যালয়ে একটি ছোটখাটো অনুষ্ঠান রয়েছে। সে সেখানে গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। যদিও তার মন নাচের প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিতে চেয়েছিল, তবে বড় বোনের নিষেধে সেই ইচ্ছেটি পূর্ণ হয়নি।
স্কুলের ফর্মাল পোশাকে সেজে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ইলিজার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “আম্মু, পানির পটটা দাও তো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ইলিজা খাবার টেবিলের কাছে পৌঁছাতেই পানির পট ধরিয়ে দিয়ে মমতাজ বিলাপ জুড়ে দিল, “কত বলি যে একটু আগে আগে ওঠ। তা না, মরার মতো ঘুমিয়ে থাকবি। টেবিলে খাবার রেখেছি, খেয়ে যা।”
ইলিজা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “মা, আবার শুরু করো না তো। টাকাটা দাও, বাহির থেকে কিছু খেয়ে নেব। তাড়াতাড়ি করো।”

“হবে না। তোর বাবা কোনো টাকা দিয়ে যায়নি।”
ইলিজা ভ্রুকুটি করে শুধালো, “তাই না? ঠিকাছে, লাগবে না টাকা। প্রাইভেটের টাকা মেরেই কাজ চালিয়ে নিব। গেলাম গেলাম।”
সে হাসতে হাসতে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল।
মমতাজ রুষ্ট কণ্ঠে বলেন, “আসিস বাসায়। আবার টাকা দেব তোমায়।”
তিনি আবার কাজে মনোযোগ দিলেন।

অপরাহ্ণের সময় পেরিয়ে প্রায় গোধুলির দিকে মিরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফিরে এলো। পরনে কালো বোরকা, সঙ্গে কালো নেকাব। বোরকার উপরে শরীরটা রঙিন একটি চাদরে আবৃত। বাড়িতে ঢুকেই হাঁসফাঁস করতে করতে নেকাব খুলে নিজ কক্ষে প্রবেশ করল। কনকনে শীতের মধ্যে সারাদিন ক্লাস শেষে ফিরে এসে অ্যাসাইনমেন্টের জন্য হন্যে হয়ে বসতে হয়। সন্ধ্যের দিকে গোসল করা তার জন্য আরেক নতুন শাস্তি।
মিরা কক্ষে প্রবেশ করেই ত্বরিত ভঙ্গিতে পোষাক পরিবর্তন করে গোসলখানায় প্রবেশ করল। স্নানশেষে কাঁপতে কাঁপতে সে ভেজা কেশরাশি তোয়ালের সহিত আলতো হাতে মুছতে লাগল। ভেজা চুল থেকে জলকণাগুলো তার গ্রীবা ও কণ্ঠার দু’ধার বেয়ে ঝরে পড়ছে। সেই জলস্পর্শে তার গায়ে থাকা শুভ্র বসনটি ভিজে গিয়ে পরিপূর্ণভাবে তার কোমল ত্বকে লেপ্টে আছে। মিরার আঁখিপল্লবের সিক্ত পাপড়িগুলো ক্ষীণ কম্পনে কাঁপছে। অতিরিক্ত শৈত্যের পরশে তার কপোলে ও গলদেশে রক্তিম দীপ্তি জেগে উঠেছে।
ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল মমতাজ ধোয়া ওঠা চা হাতে কক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন।
মিরা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “দাও, মা। খুব দরকার ছিল। উফ, এই হিম ধরা ঠান্ডায় ক্লাসে যাওয়া আর ভালো লাগে না।”

চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ একটানে খেতে থাকে। মমতাজ মিরার মাথায় হাত নেড়ে কোমল সুরে বলেন, “আর তো মাত্র একটা বছর। তারপর তো চাকরি করবি।”
“এতো সহজ না, মা। চাকরি পেতে আবার হাজার কষ্ট। চলো, এসব বাদ দাও। বাবা কোথায়?”
“কোথায় আবার? কলেজ থেকে ফিরে আবার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে বেরিয়েছে।”
“আর মাহি?”
মমতাজ কপালের ভাঁজে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে বলেন,
“সে তো রাজরানীর মতো শুয়ে শুয়ে গেম খেলছে।”
মিরা হেসে ফিসফিস করে বলে, “আচ্ছা মা, তুমি যাও তাহলে।”
“হুম। খাবার বেড়ে রেখেছি টেবিলে,” বলে মমতাজ সেখান থেকে চলে যান।

রাতের খাবার শেষ করে মিরা ইলিজাকে ডাকার উদ্দেশ্যে তার ঘরে প্রবেশ করল। প্রবেশ করতেই দেখল, ইলিজা একনজরে ল্যাপটপে কোরিয়ান নাটক দেখায় ব্যস্ত। সাধারণ মেয়েদের মতোই গায়ে ছিল সাদামাটা একটি গেঞ্জি আর কালো প্লাজো।
কখনো চোখ ঝলকানো হাসিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে তুলে নীচু গলায় বলে উঠছিল কোনো সংলাপ, যেন স্ক্রিনের ভেতরকার চরিত্রগুলোর সঙ্গে আত্মিক আলাপ চলছে তার। আবার উচ্ছ্বাসে নিজেই সেই সংলাপে হেসে উঠছিল। ইলিজার মনে মনে কোরিয়ান ছেলেরা সবসময়ই বাসা বেঁধে রেখেছে। তার ইচ্ছা, পড়ালেখা শেষ করে বড় হয়ে কোরিয়া গিয়ে কোরিয়ান কোনো নায়ককে বিয়ে করবে। নায়ক না হলেও কোরিয়ান কোনো ছেলেকে তো বিয়ে করবেই, এই আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ইলিজা।
মিরা কিঞ্চিৎ হাসতে হাসতে পিছন থেকে ইলিজার পিঠে হালকা চাপড় মেরে ধমকের সুরে বলে, “কি রে, খেতে হবে না?”
মিরার আকস্মিক আহ্বান শ্রবণ করে ইলিজা ভূত দেখার মতো ভয় পেয়ে বুকের মধ্যে থু থু দিল। শঙ্কিত গলায় বলল, “ওরে মা!”

তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মিরাকে দেখে শান্ত গলায় পুনরায় বলল, “মিরু আপু, তোমার কি ভালো লাগে সবসময় আমাকে ভয় দেখাতে? উফফ, আর একটু হলেই যাচ্ছিলাম!”
“খারাপ লাগে না। এখন বল, রাত নেই দিন নেই, কি এতো ড্রামা দেখা শুরু করেছিস তুই?”
টেবিলে রাখা ল্যাপটপটি বন্ধ করে পুনরায় বলল, “আগে খেয়ে নিবি, তারপর ড্রামা।”
ইলিজা বিরক্তি নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলে, “এই জন্যই আব্বুকে বললাম আমাকে একটা ল্যাপটপ কিনে দাও। তা তো দিবে না। ধুর ধুর।”
“হয়েছে? আমার ল্যাপটপটা তো আপনার কাছেই থাকে। আবার কি?”
“খোঁটা দিলে?” ইলিজা ক্ষুণ্ন গলায় বলে।
“না রে বাপ। খেতে আয়,” বলে মিরা জোর করে ইলিজাকে কেদারা থেকে তুলে নিচে নিয়ে গেল।

শীতের প্রকোপ আগের থেকে কমে এলেও, বাইরে গেলে হালকা শীতল বাতাস এখনো গায়ে লাগে। যদিও ঘরের ভেতরে সেই শীতের আমেজ নেই, কারণ দরজা-জানালা বন্ধ রাখা। আবার এদিকে শীতের মৃদু হাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে আছে পুরোনো দিনের আলমগীর-সাবানার চলচ্চিত্রের মাধুর্য। আজকে মিরার বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। এমন মনকাড়া পরিবেশে, মিরা নিজকক্ষে বাদাম খেতে খেতে পুরোনো সিনেমার জগতে হারিয়ে গেছে। পরনে ছাপার অনাড়ম্বর এক কামিজ, তার সঙ্গী নীলরঙা সালোয়ার। অন্তঃপুরের নিভৃতিতে অবসান ঘটেছে ওড়নার আনুষ্ঠানিকতার। সেটা সযত্নে পাশে রাখা।
মিরা স্থির ভঙ্গিমায় বিছানায় পা মেলে বসে আছে। একাগ্র চাহনিতে অপলক তাকিয়ে আছে ল্যাপটপের দীপ্তিমান প্রান্তরে।

একটু আক্ষেপের স্বরে বলে উঠল, “এখনকার মুভি যতই সুন্দর হোক না কেন, আগের মুভিগুলোর মতো সিনেমা কখনোই হবে না। যদিও কিছু কিছু সিনেমা এখনো সুন্দর বানায়, আর সেই জন্যই সিনেমা জগৎটা টিকে আছে।”
কিঞ্চিৎ সময়ের পর ইলিজা সহসা ঘরে ঢুকে মিরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। মৃদুস্বরে বলল, “কি করছো, আপু?”
মিরা ঈষৎ হাসি দিয়ে বলল, “দেখছিস তো মুভি দেখছি। হুম, এবার বল তো ব্যাপারটা কি? কারণ ছাড়া তো তোকে কখনো জড়িয়ে ধরতে দেখিনি।”
ইলিজা জানে, মিরাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলার চেষ্টা বৃথা। বোন তার মতলব ঠিকই রপ্ত করতে পেরেছে।
ইলিজা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে, “আরেহ না না, তেমন কিছু না। শুধু আম্মুর থেকে ৩০০ টাকা এনে দেও না আপু। প্লিজ প্লিজ।”
মিরা মুচকি হেসে বলল, “তাই তো বলি, কাহিনি কি! আমি পারব না। আর টাকা দিয়ে কি করবি তুই?”
“সামনেই বার্থডে, ওদের ট্রিট দেব।”
“তুই বললেই তো হয়।”

ইলিজা আকুতি করে বলে, “না না, তুমি বলো। তোমার কথা আম্মু শোনে। আমি বললে দিবে না।”
মাথা চুলকাতে চুলকাতে মনে মনে বলে, “অলরেডি সেদিন সেইম কথা বলে টাকা নেওয়া হয়ে গেছে। এখন আবার নিলে সব ক’টা বেতের বাড়ি পিঠ বরাবর পড়বে।”
“ঠিক আছে, আমি ৫০০ টাকা চাইব। বলবো তোর স্কুলের জন্য লাগবে। সেখান থেকে তোর ৩০০ আর আমার ২০০,” বলে ভ্রূ উঁচিয়ে বিছানার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে মিটিমিটি হাসল মিরা।
ইলিজা ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে, “কি? তুমি কেন টাকা নিবে?”
মিরা অবহেলায় নড়ে চড়ে বসে বলে, “ঠিকাছে, নিব না। আর বলবোও না।”
ইলিজা এবার মিরার গা ঘেঁষে বসে মিনমিনে গলায় বলে, “না না, ঠিকাছে ঠিকাছে।”
বোনকে রাজি করিয়ে বিছানা থেকে উঠে বেরোতে যাবে, কিন্তু দু’পা পিছিয়ে ফিরে প্রশ্ন করল, “মিরু আপু, ফ্রিজের ক্যাডবেরিটা কার?”
মিরা সিনেমায় ডুবে থেকে বলে, “কার আবার! আমার। একদম হাত দিবি না কিন্তু।”

“ঐটা না, আমি ভুল করে খেয়ে ফেলেছি।”
যেতে যেতে গলা উঁচিয়ে বলল, “বাবাকে বলে আনিয়ে দিব,” বলে হাসতে হাসতে প্রস্থান করে।
মিরা সচকিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “মাহির বাচ্চাআআ!”
এসব বাদেও তুচ্ছ কলমচুরির মধ্যেও ইলিজার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্রত নিহিত। মিরার ইউনিভার্সিটি ব্যাগ থেকে রঙিন কলম চুপি চুপি সরিয়ে নিজের স্কুলব্যাগে লুকিয়ে রাখা তার গৌরবের অলিখিত অভ্যাস। প্রতিবারই মিরা যখন হন্যে হয়ে চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজে, আর অবশেষে হতাশ স্বরে বলে ওঠে, “মা, আজকেও কলম পাচ্ছি না।”
তখন ইলিজা মুখে ভিন্ন ছলনায় অভিনয় করে বলবে, “প্রতিদিনই এমন হারিয়ে ফেলো, আর দোষ পড়ে মাহির টাকানষ্ট করার ওপর। হুহ!”

প্রতিবারই কিছু না কিছু নতুন অজুহাতে সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, এসব ছলাকলার বিরুদ্ধে মিরা কখনো রাগ প্রকাশ করে না। বরং তার ঠোঁটের কোণে এক ফালি মুচকি হাসি খেলে যাবে। কারণ এই অল্পবয়সী ঢংপসন্দ বোনের চালাক নাটকীয়তা তার অপছন্দ নয়, বরং প্রিয়। সে জানে, ইলিজার এই চাতুর্যমিশ্রিত কাণ্ডগুলোতে স্নেহের শাখা বিস্তার করে আছে।
আরো এক মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে ইলিজার। মিরা যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়, তখন সে মেকআপ কীট নিয়ে হাজির হয়। মিরার মুখশ্রীতে আঁকিবুঁকি টেনে তাকে একেকদিন একেক রকম ভূতের সাজে রূপ দেয়। অবশ্য ঘুম ভাঙার আগেই সেই সাজসজ্জা সযত্নে মুছে ফেলে সে।
তবে একদিন ছোট্ট এক ভুলে ফাঁস হয় তার এই নিপুণ অপকর্ম। সেই ছাঁটানো তুলির আঁচড়ে ঘুম ভাঙে মিরার। এবার পালানোর পথ রুদ্ধ! ইলিজার মুখ শুকিয়ে আসে। কিন্তু মিরা রাগ না করে হেসে ওঠে। সেই সুযোগে ইলিজা দৌড়ে পালায়। কিন্তু বুঝে যায়, হাসির আড়ালেও এবার সত্যিই একটু রাগ করেছে মিরা।
তাই রাতের নিস্তব্ধতা যখন দেয়াল ছুঁয়ে নেমে আসে, ইলিজা নিঃশব্দে মিরার ঘরে প্রবেশ করে। পিছন থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ এনে নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, “আমার মিরু আপুর মতো সুন্দর এ্যাঞ্জেল আর কেউ নেই।”

জানে যে এত সহজে মিরার অভিমান গলবে না। তাই পেছনে হাতে লুকিয়ে রাখা একখানা রক্তিম গোলাপ তুলে এনে মিরার খোঁপায় আলতো করে গুঁজে দেয়। এরপর দুই হাতে মিরার গলা জড়িয়ে ধরে, কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলবে, “জানো, আজ সকালে এই ফুলটা ফুটেছে। মনে হলো, তোমার চুলেই সবচেয়ে মানাবে, তাই লুকিয়ে নিয়ে এলাম তোমার জন্য।”
সেই মুহূর্তে মিরার সকল বিরাগ তুষারের মতো গলে পড়ে হৃদয়ের উষ্ণতায়। সে জানে, এ ফুল তারই প্রিয় গাছ থেকে ছেঁড়া, তবুও ইলিজার সেই শিশুতোষ আন্তরিকতায় সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সেও ইলিজাকে জড়িয়ে ধরে। এই ছোট ছোট দুষ্টুমিগুলোই তাদের সম্পর্কের সবচেয়ে মূল্যবান অলংকার।

তবে ইলিজার দুষ্টুমির তালিকায় যে কাণ্ডটি মিরার জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর, সেটি নিঃসন্দেহে তার চুল নিয়ে খেলা। মিরার ঘন কালো চুলগুলো তার অহংকার—যার যত্নে সে মুখের চেয়েও অধিক সচেতন। কিন্তু ইলিজার কাছে সেটিই সবচেয়ে মোহময় খেলার মাঠ। মিরা যখন পাঠ্যবইয়ের গভীরে ডুবে থাকে, তখন ইলিজা নিঃশব্দে পেছন দিয়ে এগিয়ে এসে চেয়ারের আড়ালে নিজেকে আড়াল করে ফেলে। এরপর নিপুণ হাতে মিরার চুলগুলোকে পাখির বাসার আকৃতিতে রূপ দিতে শুরু করে। মনে হবে, সেখানে কোনো পাখি একটা নিখুঁত বাসা বানাচ্ছে। এমন সূক্ষ্ম ভঙ্গিতে করে যেন মিরা বিন্দুমাত্রও টের না পায়। এ কাজ করতে করতেই ইলিজার মুখে একপ্রকার পৈশাচিক আনন্দ খেলে যায়। ঠোঁটে ফোটে দুষ্টু বিজয়ের অনাবিল হাসি।
কিন্তু যখন মিরার চোখ হঠাৎ আয়নায় পড়ে কিংবা কোনো অনুচ্চার ব্যথা টের পায়, তখন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, “মাআআআ! আবারও মাহি আমার চুলগুলো নষ্ট করেছে।”
যে চুলগুলোর যত্নে সে ভোরবেলা সময় ব্যয় করে, যার প্রতিটি রেখায় সে মমতার ছোঁয়া রাখে, সেই চুল যদি কেউ এভাবে বিকৃত করে, তবে তার প্রতিক্রিয়া তো এমন হওয়া স্বাভাবিক। মিরার এমন প্রতিক্রিয়া শুনে ইলিজা ছোট পা দুটো দিয়ে মেঝেতে টুপটাপ শব্দ তুলে দ্রুত পালিয়ে যায়।

ইদানীং ইলিজার দৌড়ে পালানোটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে একবার মমতাজ বেগমের বাঁশের ছড়ি থেকে রেহাই মেলেনি। পিটুনি খেয়ে কান্নায় ভেসে যায় সে। তবুও দোষ স্বীকারে প্রস্তুত নয়। একটু পরে আবার চুপিচুপি এসে মিরার সামনে বসে পড়ে। ভেঙে পড়া স্বরে, চোখ নামিয়ে, মুখে কান্নার ছাপ টেনে রাগ ভাঙানোর অপচেষ্টা শুরু করে। কিন্তু অপরাধ গুরুতর, কারণ তার চুল নিয়ে খেলেছে সে; তাই মিরাও মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। তবে ইলিজার কাণ্ডজ্ঞানহীন শয়তানির সঙ্গে তার চাতুর্যও সমানভাবে প্রবল। পুরোনো সেই ‘গোলাপ কৌশল’ আবার কাজে লাগায় সে। মিরার খোপায় গুঁজে দেয় লাল গোলাপ, আর বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমার পছন্দের গাছের ফুলটা আজকে আমার হাতে নিজে থেকেই পড়ে গিয়েছিল। আমি কিন্তু চুরি করিনি, বুঝলে?”
এরপর আর মিরা কল্পনায়ও রাগ ধরে রাখতে পারে না। মিরার কঠোর রাগ বরফের মতো গলে পড়ে। মুখে হাসির রেখা খেলে যায়। অর্থাৎ ফুলের গন্ধেই সব অনুযোগ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

তবে এমন দুষ্টুমিতে প্রায়ই মমতাজ বেগমের ধমক পড়ে ইলিজার উপর। কখনও তো তেড়ে এসে ইলিজার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হন। ঠিক তখনই ইলিজা ছুটে গিয়ে মিরার পেছনে লুকিয়ে পড়ে। মিরার গায়ে লেপ্টে থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “মিরু আপু, তোমার এই দুষ্টু বোনটা যদি মায়ের পিটুনি খেয়ে খেয়ে ম*রে যায়, তাহলে তোমাকে জ্বালাবে কে? এবারের মতো বাঁচিয়ে নাও। কথা দিচ্ছি—একদম ভালো হয়ে যাব। প্লিজ, সোনা আপুটা।”
যদিও তার এই আবেগি সংলাপে যতটা নাটক থাকে, বাস্তবতা ততটাই কম। ইলিজার এই আবেগসিক্ত নাটক আর অদ্ভুত আবেদন শুনে মিরা হেসে ফেলে। দুই হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, “আজকের মতো মাফ করে দাও, মা। ও এবার সত্যিই শুধরে যাবে।”
মমতাজ ফুঁসতে ফুঁসতে বলে ওঠেন, “প্রতিবারই তোর মুখের কারণে বেঁচে যায় পা*জিটা।”
কিন্তু তিনি জানেন, ইলিজা ঠিকই আবার এমন কিছু করবে। ভিতরে ভিতরে তিনি এটাও জানেন, এই দুরন্ত মেয়েটার জ্বালাময়ী ভালোবাসাই তাদের সংসারের সবচেয়ে উষ্ণ প্রলেপ।
মা চলে গেলে, মিরা চোখ রাঙিয়ে বলে, “আরেকবার এমন করিস না, আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই তখন তোকে চিনবো না।”

ইলিজা তখন মুখে শিশুসুলভ শপথ জুড়ে দেয়, “একদম ভালো হয়ে যাব, পিঙ্কি প্রোমিস।”
তারপর নিজস্ব ছন্দে নাচতে নাচতে আবার দুষ্টুমির কোনো নতুন পরিকল্পনার দিকে ছুটে যায়।
এ দুই বোনের সম্পর্ক এমনই। প্রতিনিয়ত দুষ্টুমি আর খুনসুটির মধ্য দিয়েই দিন কাটে, অথচ একে অপরকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না।

মো. আসাদ চৌধুরি শহরের প্রভাবশালী অভিজাতদের মধ্যে প্রথম সারির নাম। ধন-সম্পদের ভাণ্ডার এবং ক্ষমতার দাপট নিয়ে বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক, যার দৃষ্টান্তস্বরূপ ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিস্তীর্ণ জমিতে গড়ে উঠেছে আলিশান এক বাংলো। বাংলোতে গৃহের প্রতিটি সদস্যের জন্য রয়েছে একটি করে বিলাসবহুল গাড়ি।
তার পিতা মো. মুস্তাফা কামাল চৌধুরিও ছিলেন একাধারে বিত্তবান ও প্রভাবশালী।
আসাদের অনুজ, মো. ইসহাক চৌধুরি পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অর্থাৎ ডিআইজি। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আরিয়ান চৌধুরি এতদিন ধরে দেশের বৃহত্তম শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানি’ পরিচালনা করে আসছিল। আসাদের কনিষ্ঠ পুত্র কারান চৌধুরি; যার বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ়তা ছোটবেলা থেকেই তাকে আলাদা করে তুলেছে।
কারানের জীবনের এক গভীর ক্ষত তার মায়ের চলে যাওয়া। মাত্র আট বছর বয়সে তার মা হঠাৎ ঘর ছেড়ে চলে যান। কেন যান, সে রহস্য আজও অজানা। কিন্তু পিতা তাকে বুঝিয়েছিলেন, তার মা অন্য কারো হাত ধরে পালিয়েছে। সেই তিক্ততা থেকে কারানের মনে তার মায়ের প্রতি এবং সমস্ত নারী জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা জমে ওঠে। এরপর মাত্র দশ বছর বয়সে সে আমেরিকায় পাড়ি জমায়, যেখানে সে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ওপর পড়াশোনা করে, এবং নিজেকে বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
আজ বহু বছর পর কারান দেশের মাটিতে ফিরে আসছে। কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানির আসল অধিকারী সে-ই। নিজের হাতে আবার নিজের সাম্রাজ্যের হাল ধরতে সে ফিরছে; এক আত্মপ্রত্যয়ী এবং জেদি মন নিয়ে, যার জীবনে কোনো আপোষ নেই।

ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামার মুহূর্তে কারান গভীর নিশ্বাস নিল। দীর্ঘ বছর পর নিজের দেশের মাটিতে পা রেখে সেই পরিচিত বাতাস বুকের ভেতর টেনে নিল সে। আকাশে মিশে থাকা সোনালি আলোয় একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁকে দিল।
বিমানের সিঁড়ি দিয়ে নামতেই পাহারাদাররা নীরবে তার পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পরনে একখানা ধূসর ওভারকোট, ভিতরে কালো শার্ট-প্যান্ট, হাতে হ্যাবলট বিগ ব্যাং-এর ঝকঝকে ঘড়ি। চুলগুলো ঘাড় ছুঁই ছুঁই করে ছাঁটা, স্টাইলিশ অথচ ব্যক্তিত্বময়। তার মুখাবয়ব জুড়ে ফুটে আছে এক অনন্য আকর্ষণ, তার উপস্থিতি বাতাসকেও থমকে দিতে সক্ষম।
বিমানবন্দরে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি কারানের ওপর আটকে গেল। এরই মধ্যে একজন তরুণী তার বান্ধবীকে উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বলল, “হু ইজ হি ইয়ার? উফফ!”
পাশে দাঁড়ানো আড়িয়া, কারানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই জবাব দিল, “হি ইজ দ্য মোস্ট স্ট্রাইকিং অ্যান্ড চার্মিং ম্যান, কারান চৌধুরি।”

তরুণীটি বিস্ময়ের সুরে বলল, “এই জিনিস বাংলাদেশের মাটিতে আসলো কি করে, বেবি? ভাইইই!”
বিমানবন্দরের যাত্রীদের দাঁড়ানোর স্থানে দাঁড়িয়ে আছে আরিয়ান চৌধুরি। সে কারানকে দেখেই হাত নাড়ল। কারানও মাথা নেড়ে তাকে সায় জানালো।
কাছে যেতেই কারান গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “হোয়াট’স নিউ, ভাই?”
“এই তো, সব ঠিকঠাক। চল, সামনে যাই।”
তাদের দুজনের পদক্ষেপ এগিয়ে চলল। একটু হাসির ছলে আরিয়ান বলল, “এয়ারপোর্টের সবাই তোর দিকে তাকিয়ে আছে, দেখতে বেশ মজাই লাগলো।”
কারান ভারী গলায় ভাবলেশহীনভাবে শুধালো, “লেটস ড্রপ দ্য সাবজেক্ট। বাট আই ডিডেন্ট এক্সপেক্ট ইউ টু কাম। ড্যাড কোথায়?”

“এভাবে বলছিস কেন? আমি কি আসতে পারি না? ড্যাড একটা কাজে ব্যস্ত আছেন। চল, গাড়িতে ওঠ।”
গাড়ির কাছে গিয়ে কারান গায়ে জড়ানো কোটটা খুলে হাতে নিল। ঠিক তখনই আঠারো কি উনিশ বছরের এক মেয়ে দৌড়ে আসতে আসতে বলে উঠল, “কে.ছি স্যার, ওয়ান মিনিট।”
মেয়েটাকে দেখে কারান দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েটি দৌড়ে কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “স্যার, আ’ম লিনা। আই ক্যান্ট বিলিভ ইট’স রিয়েলি ইউ! নিউজে যখন আপনার স্পিচ দেখি, আমি শুধু আপনার দিকেই তাকিয়ে থাকি। আ’ম ইয়োর হিউজ ফ্যান। স্যার, মে আই প্লিজ হ্যাভ আ সেলফি?”
ওদিকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দুই তরুণী নিজেদের মধ্যে আলাপ চালাচ্ছে, “মামা, ঐ মেয়ে যদি সিরিয়াসলি পিক তুলতে পারে, তারপরেই আমি যাব। কোনোভাবেই এই চান্স মিস করা যাবে না। ভাব, যদি কারান চৌধুরীর সাথে পিক তুলে এফবিতে আপ দেই, ফলোয়ার্স কত বাড়বে! ড্যাএএম!”
এদিকে কারান ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি ঝুলিয়ে বলল, “বাট আ’ম নট আ সেলিব্রেটি।”

লিনা উত্তরে বলল, “ইউ মে নট সি ইয়োরসেলফ অ্যাজ আ সেলিব্রিটি, বাট ফর আস, ইউ’র ট্রুলি এন ইন্সপিরেশন। আমার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল আপনার আইডি ফলো করে। স্যার, জাস্ট একটা পিক। প্লিজ, স্যার।”
কারান ঠান্ডা গলায় বলল, “এক্সকিউজ মি।”
এরপর গাড়িতে উঠে বসল। মেয়েটি করুণ স্বরে বলে উঠল, “স্যার, প্লিজ।”
এর মধ্যেই পাহারাদাররা মেয়েটিকে সরিয়ে দিল।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আরিয়ান কপাল কুঁচকে বলল, “মেয়েটা এতো রিকোয়েস্ট করল, একটা পিক তুলতে সমস্যা কোথায় ছিল?”
কারান ফোনের দিকে তাকিয়ে টাইপ করতে করতে আওড়ায়, “আশেপাশে তাকিয়ে দেখেছিস? আই ডোন্ট হ্যাভ মাচ টাইম টু ওয়েস্ট।”
আরিয়ান চারপাশে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তাও তো ঠিক। একজনকে সুযোগ দিলে বাকিরাও ঝাঁপিয়ে পড়তো। তবে তোর দেশে না ফিরলেও চলতো। এদিকটা তো আমি সামলাচ্ছিলামই।”
কারান ফোনের পানে তাকিয়েই ঠান্ডা স্বরে বলল, “এর জন্যই আসতে হলো।”
এটা শুনে আরিয়ান আড় চোখে কারানের দিকে তাকালো। অর্থাৎ কারান যে আরিয়ানকে বিদ্রুপ করে কথাটা বলেছে সেটা সে ভালোভাবেই রপ্ত করেছে।

চৌধুরি বাড়ির পরিবেশে অদ্ভুত উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। কারণ কারান ফিরে এসেছে। আশমিনি আলিঙ্গন করে গলা চড়িয়ে বলেন, “আমার বাবাটা কতদিন পর বাড়িতে পা রাখলি। দেখ, চেহারার কি অবস্থা হয়েছে!”
ইসহাক সিঁড়ি থেকে নেমে এসে উজ্জ্বল মুখে গলাটা উঁচু করে বলেন, “ওয়েলকাম, মাই সান। কেমন আছিস, তাই বল?”
আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে, কারানের পিঠে চাপড় দিয়ে জানান দেয়, তিনি ঠিক কতটা খুশি। কারান মৃদু হেসে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ, কাকাই। তোমার খবর বলো?”
ইসহাক হেসে বলেন, “সবই চলছে। এবার ফ্রেশ হয়ে নে। আশমিনি, খাবার রেডি করো।”
“ওকে কাকি, ফ্রেশ হয়ে নিচে আসছি,” বলে কারান উপরের দিকে উঠে চলে যায়।

রাতে আসাদ চৌধুরি বাড়িতে ফিরে নিজ কক্ষে প্রবেশ করেন। জামাকাপড় পরিবর্তন করে কারানের কক্ষে গিয়ে দেখতে পান, কারান ল্যাপটপে কাজ করছে। কানে ব্লুটুথ ইয়ারপিস গুঁজে একের পর এক কথা যোজন করছে। আসাদ এসে সোফায় বসে কারানের কাঁধে হাত রাখেন।
হাত রাখতেই কারান কলে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে বলে, “ওকে ইমন, সব ফাইলগুলোর কপি আমাকে ই-মেইল করে দিও।”
এটা বলে কল কেটে দিল সে। আসাদ শান্ত গলায় বলেন, “এসেই কাজ শুরু করে দিলি? বল, কী অবস্থা?”
“আলহামদুলিল্লাহ, চিল ড্যাড। তবে মনে হয় না বেশিদিন এই খুশিতে থাকতে পারব। অফিসের কোনো খবর রাখো?”

“আরিয়ান তো ঐ দিকটা দেখছেই। চিন্তা করিস না। কিন্তু বল, এখন প্ল্যান কি?”
কারান কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “প্ল্যান আর কি! সবে তো আসলাম। এখন অফিসের কাজ গুছিয়ে নেব।”
“ওদিকের কথা বলছি না। তা বিয়ে শাদি করবি না নাকি?”
বিয়ের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অচিরেই কারানের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যায়। গম্ভীর হয়ে বলল, “ড্যাড, আজকেই তো আসলাম। এর মধ্যেই মেজাজ খারাপ না করলে চলতো না?”
আসাদ ঠান্ডা স্বরে বলেন, “কুল ডাউন, কুল ডাউন। আচ্ছা, তাহলে রেস্ট নে। কাজটা এখন একটু রাখ, বুঝলি?”
এমনটা বলে প্রস্থান করলেন তিনি।
এভাবে টানা কয়েকদিন আসাদ ইনিয়ে-বিনিয়ে কারানকে বিয়ের কথায় উসকাতে থাকলেন। কিন্তু প্রতিবারই কারান কোনো না কোনো ভাবে কথা ঘুরিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গেল বা রাগ দেখিয়ে চলে গেল।

প্রভাতের কোমল আভায় কারান অফিসযাত্রার প্রস্তুতি নিল। সুপরিপাটি ভঙ্গিতে পরিধান করলো ইস্ত্রি করা ধূসর কোট, সুচারু ছাঁটের প্যান্ট এবং নিখুঁতভাবে পরিপাটি শ্বেত শার্ট। প্রতিদিনের মতো আজও শরীরে ছড়িয়ে নিল ‘রোজা হট লাক্স’-এর মিষ্টি সুবাস, যার তীব্র ঘ্রাণ বাতাসে মিশে তার উপস্থিতিকে নিঃশব্দে জানান দিয়ে যায়।
সিঁড়ি থেকে নামতেই, সামনে আসাদ চৌধুরীর পরিচিত আক্রমণ শুরু হলো। আসাদ বলল, “ওয়েট কর।”
ধীর পদক্ষেপে কারানের কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। কারান একেবারে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কণ্ঠে অসহিষ্ণু ক্রোধ ঢেলে বলে উঠল, “আবার কিন্তু বিয়ের কথা বলো না। তাহলে গেলাম আমি।”
আসাদ বিন্দুমাত্র দমলেন না, বরং নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, “আচ্ছা বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়, সেটা তো ক্লিয়ার করবি।”
কারান কথাটা শুনে আর শোনার দরকার নেই এমন ভাব করে সামনে পা বাড়াল।
“রাতে ফিরে বলবো। বাই ড্যাড,” বলেই বেরিয়ে গেল।
আসাদ কিছুটা চিন্তিত মুখে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বিড়বিড় করে বললেন, “ওকে যেকোনো মূল্যে রাজি করাতেই হবে।”
কিন্তু জানে, কারান নাছোড়বান্দা। একবার যখন না বলেছে, তা আর পাল্টাবে না। অর্থাৎ সরাসরি চেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না। তাই কূটবুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে নতুন ছক কষলেন, যেখানে কারানের জেদ এবং না বলার স্পর্ধা, দুটোই বুদ্ধির কাছে হার মানবে।

রাতে কারান নিজ কক্ষে অফিসের ফাইলগুলো নিয়ে গভীর মনোযোগে কাজ করছে। ঘরের নির্জনতা ভেদ করে হঠাৎ আসাদ চৌধুরীর আগমন ঘটে। তিনি গভীর এক পরিকল্পনা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। লক্ষ্য একটাই; কারানকে বিয়েতে রাজি করানো। আসাদ স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “ডিনার করেছিস?”
“হুম,” আসাদের দিকে না তাকিয়ে কোনো উত্তেজনা ছাড়াই কারান উত্তর দিল।
“আচ্ছা, তাহলে এবার বল, বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
কারান চোখ তুলে আক্রোশ মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “ড্যাড, আর ইউ স্টার্টিং দিস এগেইন? তুমি তো জানো, হাউ মাচ আই ডিসপাইজ (অবজ্ঞা) গার্লস অ্যান্ড উইমেন।”
আসাদ হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, “কি বলিস? তাহলে তো চিন্তায় পড়ে গেলাম! তুই কি ছেলেদের পছন্দ করিস নাকি? বাহিরে গিয়ে এই হাল তোর!”
এমনটা কর্ণগোচর হতেই কারান অসহায়ের মতো আসাদের দিকে তাকাল।
আসাদ হাসি থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, “চল মজা বাদ দেই, সিরিয়াস টপিকে আসি। তোর জন্য একটা অফার ছিল।”

কারান আবারও ফাইলের দিকে মনোযোগ দিয়ে প্রশ্ন করল, “কীসের অফার?”
“তুই যদি বিয়ে করতে রাজি থাকিস, তাহলে আমেরিকার কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানির সঙ্গে মিস্টার জন জ্যাকসনের ডিলটা হয়ে যাবে। আমি ব্যবস্থা করে দেব।”
কারান কিছুটা বিস্মিত হয়ে আসাদের দিকে তাকাল। “হোয়াট? জেনুইনলি ড্যাড?”
“শাওনকে চিনিস তো?”
“হুম, শাওন আঙ্কেল; তোমার ফ্রেন্ড না?”
“হ্যাঁ, ওরই ফ্রেন্ড জন। ও জনকে বললেই ডিলটা কনফার্ম হয়ে যাবে উইদাউট এনি ইনকনভিনিয়েন্স।”
“ড্যাড, সিরিয়াসলি? এটা তুমি আমাকে এতদিন পর জানাচ্ছ?”
আসাদ মৃদু হেসে বললেন, “আমি নিজেই তো কাল শাওনের সঙ্গে কথা বলার পর জানতে পারলাম।”
“উফফ! এতোদিন ধরে এটা নিয়ে কতটা সাফার করেছি জানো?”
কারান স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে দিল।
আসাদ হাসিমুখে বললেন, “হুম, কিন্তু যেটা বললাম সেটা বুঝেছিস তো?”
কারান একটু ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠল, “কোনটা?”
“আমি তখনই কথা বলব, যদি তুই বিয়ে করতে রাজি থাকিস।”
কারান হাসি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “দিস ইজ রিডিকিউলাস (হাস্যকর), ড্যাড। তুমি তোমার ছেলের সাথে ডিল করছো?”
আসাদ হাসতে হাসতে বললেন, “উপায় নেই। কি করবো?”

“তুমি মিস্টার জন জ্যাকসনের সঙ্গে কথা বলো, আর এসব বিয়ের ঝামেলায় আমি নেই। সো ফরগেট ইট।”
“ঠিক আছে। তাহলে তোর কোম্পানি আরও পাঁচ-ছয় মাস খাটুক। তারপর তো এমনিতেই কনফার্ম করেই ফেলবি।”
কারান বিরক্তি প্রকাশ করে ঠোঁটের কোনে আঙুলের সহিত চুলকাতে চুলকাতে বলল, “সুযোগ নিচ্ছো তুমি?”
আসাদ শান্ত গলায় বললেন, “তুই শুধু বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা।”
কারান খানিক বিরক্ত হয়ে বলল, “ওকে, তোমার সাথে পরে কথা বলছি। কাজ করছি। এখন যাও।”
“না না, তোকে তো চিনি। এখনই বল, নাহলে পরে আবার তোর মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে যাবে।”
কারান কণ্ঠে নিস্তেজ স্বর এনে বলল, “ওকে, ডান। তুমি শাওন আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলো, আমি বিয়ে করবো।”
আসাদ খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,”দ্যাট’স মাই সান।”
“হুম, কিন্তু আমার কিছু কন্ডিশন আছে। মেয়ে হতে হবে নম্র, ভদ্র, সুশীলা। আমার কথায় উঠবে আর বসবে।”
আসাদ হাসতে হাসতে বললেন, “তুই কি প্ল্যান করছিস বলতো? ইউএসএ-তে থেকেছিস, তোর তো এমন মেয়ে পছন্দ হওয়ার কথা না। আর এই যুগে এমন মেয়ে পাবি না বললেই চলে। এই জেনারেশনের মেয়েরা কারো কথাই শোনে না।”

কারান গম্ভীর মুখে বলল, “তাহলে বিয়ের চিন্তা বাদ দাও।”
“তোর মতলব কি, সেটা বল? আসলেই এমন মেয়ে চাইছিস? আই মিন মর্ডান, চঞ্চল টাইপ না?”
কারান হালকা হাসি দিয়ে বলল, “অবভিয়াসলি মর্ডান, স্মার্ট হবে, কিন্তু আমার কথা শুনবে। মানে ঐ সুশীলা, স্বামী ভক্ত টাইপের।”
আসাদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আচ্ছা, ঠিকাছে। এমন মেয়ে হলে তুই বিয়ে করবি, শিওর তো?”
“ইয়েস, ড্যাড।”
তবে মনে মনে ধূর্ত হাসি দিয়ে বলল, “বিয়েটা তো শুধু ডিল কনফার্ম করার একটা ওয়ে মাত্র। বিয়ের পর ঐ মেয়েকে এমনিতেই ডিভোর্স দিতে বাধ্য করবো।”

অপরাহ্ণের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে, এমন সময় আসাদ চৌধুরি তার পুরোনো বন্ধু আব্দুর রহমানকে ফোন করলেন। প্রফুল্লচিত্তে কথোপকথন শুরু হলো।
“আসসালামু আলাইকুম। কী হে আব্দুর রহমান, কেমন আছিস?”
আসাদের কণ্ঠে উচ্ছ্বাসের ঝলক স্পষ্ট।
অপর প্রান্ত থেকে আব্দুর রহমান হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে সাড়া দেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। সেই যে গত মাসে কথা হলো তারপর তো তোর আর কোনো খোঁজ-খবরই নেই।”
“আর বলিস না! কিছুদিন ধরে খুব ব্যস্ততার মধ্যে যাচ্ছি রে।”
এভাবে খানিকক্ষণ দুই বন্ধুর মধ্যে কথাবার্তা চললো। একে অপরের খোঁজখবর নিতে নিতে আড্ডার আবহ তৈরি হলো।

একপর্যায়ে আসাদ হঠাৎ বললেন, “কারান দেশে ফিরেছে রে!”
“কি বলিস? এটা তো দারুণ খবর! কবে ফিরলো?”
“এই তো, কিছুদিন হলো। এখন ওর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছি। তোর জানাশোনা কোনো ভদ্র, শিক্ষিত মেয়ে আছে নাকি?”
আব্দুর রহমান হেসে বললেন, “এমন বললে তো নিঃসন্দেহে নিজের মেয়ের কথাই বলতে হয়।”
আসাদের গলায় আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল।
“কি বলিস! তাহলে তো ছক্কা লেগে গেল। তোর মেয়ে যদি আমার ঘরে আসে, আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।”
আব্দুর রহমান একটু থমকে গিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। তবে শোন, মিরাকে এখন বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই। মেয়েটা পড়ছে, পড়ুক।”
“আরে, ও চাইলে বিয়ের পরও পড়তে পারবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু একবার দেখে আসলে ক্ষতি কি? তোর মেয়ে মানে নিঃসন্দেহে সে খাঁটি সোনা হবে।”
আব্দুর রহমানের কণ্ঠে খানিক দ্বিধা ফুটে উঠলো। “সেটাই তো আরেক সমস্যা রে। আমার মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই ঘরকুনো, মানুষের সামনে সহজে যায় না। আমি কারানের জন্য অন্য মেয়ে খুঁজে দিব, যেমন তুই চেয়েছিস। কারানের জন্য বেস্টটাই দেখবো।”
আসাদ হাসতে হাসতে বললেন, “আরে শোন, একবার দেখে তো আসি। চিন্তা করিস না। মিরা ঘরে রাজরানীর মতোই থাকবে, এই ভরসা আমি তোকে দিতে পারি।”

“কিন্তু…”
আসাদ কথা কেটে বলেন, “কিন্তু মিন্তু কিছু না। কথাটা তবে থাকলো। তুই বাড়ির সবার সাথে কথা বল। কবে দেখতে যাবো, জানাবি।”
এই বলে হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিলেন।
অপর প্রান্তে আব্দুর রহমান গভীর নিশ্বাস ফেললেন। আপনমনে বললেন, “মিরা কি রাজি হবে? মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তো মেয়েকে বিয়ে দিতে পারি না।”
তবে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও, তাদের দু’জনের মনে অনাবিল প্রশান্তির রেখা খেলা করে। আসাদ চৌধুরি ও আব্দুর রহমান হাওলাদার—দুটি আত্মার মধ্যে নিবিড় এক সত্তাগত সংলগ্নতা। যা কালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বাস ও হৃদ্যতার সুশীতল ছায়ায় যুগের পর যুগ ধরে অটুট বন্ধনে পরিণত হয়েছে।
শৈশবকাল থেকেই তারা ছিল পরস্পরের ছায়াসঙ্গী। একত্রে বিদ্যালয়গমন, ধুলোমলিন প্রান্তরে বিকেলের ছুটোছুটি, আর শ্রেণিকক্ষের শেষ বেঞ্চে কাঁধ ছুঁয়ে বসে শেখা জীবনের প্রাথমিক পাঠগুলি; তাদের সবথেকে প্রিয় মুহূর্ত। যেদিন একজন অনুপস্থিত থাকত, সেদিনের ক্লাসটা আরেকজনের কাছে শূন্য মনে হতো।

একদা ফুটবল খেলায় দুর্ঘটনাবশত আব্দুর রহমানের পা ভেঙে যায়। তখন শ্রাবণের দুর্যোগময় দিনে, কাঁধে ভর করে তাকে নিজ গৃহে পৌঁছে দিয়েছিল আসাদ। সেই সিক্ত পথ, কাদামাখা জুতো ও নীরব ভালোবাসার স্মৃতিচারণ আজও তাদের মুখে অনাহুত হাসি আনয়ন করে।
তবে সম্পর্কের মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝড় আসবেই। তাদের মাঝেও হঠাৎ হঠাৎ রাগ, অভিমান, আর কিছুটা দূরত্ব এসে ভিড় করত। কিন্তু এতটুকু ফাঁকও বেশিক্ষণ টিকত না। একজন মুখ ফিরিয়ে নিলেই আরেকজন বাড়িয়ে দিত আত্মসমর্পণের হাত। তবে বাইরের কেউ যদি তাদের একজনকে অপমান করত, তখন এই দুইজন একসঙ্গে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে যেত।

কালক্রমে বয়সের ভার, জীবনের বহুবিধ দায়িত্ব ও পেশাগত ব্যস্ততা তাদের মাঝে সামান্য ভৌগোলিক ব্যবধান সৃষ্টি করলেও, অন্তরের সংযোগে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য আসেনি। বরং প্রতিদিনের অন্তিমপ্রহরে যখন তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপচারিতার শেষে অনাবিল হাসির জন্ম নেয়, তখন স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়; তাদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট ও অপরিবর্তনীয়।
কিন্তু যদি সেই বন্ধনকে আরও এক ধাপ উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করা যায়? যদি একদিন এই দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠে আত্মীয়তার নতুন সম্পর্ক? যদি মিরা ও কারানের শুভ পরিণয় বহুবর্ষীয় বন্ধুত্বকে রূপান্তরিত করে র*ক্তসম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায়? তাহলে তো সেই সম্পর্কের শিকড় আরও অস্তিত্বের মর্মস্থলে গভীরতর হয়ে যাবে।

মিরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে নিজের কক্ষে মনোযোগ সহকারে অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করতে লাগলো। একসময় মমতাজ কক্ষে ঢুকে আলতো করে বিছানায় বসে পড়লেন।
“কিছু বলবে মা?” মিরা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল।
মমতাজ কণ্ঠে স্নেহ ধরে বললেন, “না না, তুই কিছু খাবি? এনে দিব?”
“না মা, লাগলে মজিদা খালাকে বলবো।”
এবার মমতাজ একটু রয়ে সয়ে শুরু করলেন, “তুই এখন পড়া রেখে রেডি হয়ে নে তো, মা।”

“মা, আমি কিছুক্ষণ আগেই ভার্সিটি থেকে ফিরলাম। এখন কোথাও বের হওয়ার ইচ্ছে নেই। তোমরা গেলে যাও।”
“বের হবো না রে। তুই রেডি হয়ে নে। ভালো দেখে সুন্দর একটা শাড়ি পড়বি, যেন পরী লাগে আমার মেয়েটাকে।”
মিরার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনি পুনরায় বললেন, “যদিও আমার মেয়ে তো এমনিতেই পরী।”
এর মধ্যে ইলিজা ঘরের ভিতরে এসে বললো, “মা হেডফোনটা কোথায়? পাচ্ছি না তো।”
“হেডফোন পরে নিবি, তুই পাশে বস,” শান্ত গলায় মমতাজ বললেন।
ইলিজা কিছু না বুঝে চুপচাপ মিরার পাশে বসে পড়লো। মিরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হঠাৎ শাড়ি পড়বো কেন? কি ব্যাপার, বলো তো?”
এবার মমতাজ গলা কিছুটা নরম করে বললেন, “আজকে তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, মা। তোর বাবা সেই কখন আমাকে বলেছে।”
অকস্মাৎ বিয়ের কথা শুনে মিরার হুঁশ উড়ে গেল। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ক্রোধ প্রকাশ পেল।
“মা, মজা করো না তো। তুমি তো ভালো করেই জানো, অনার্স শেষ না করে আমি বিয়ে করছি না। যাও তো তুমি। দিলে তো মাথাটা বিগড়ে।”

এদিকে ইলিজা খুশি হয়ে ভ্রূ উঁচিয়ে আপনমনে বললো, “ওত্তরিইই! তার মানে মিরু আপুর বিয়ে হবে। আহা, কতদিন এই দিনটার ওয়েট করলাম। সেই মজা হবে। এবার মিরু আপু গেলে বিন্দাস লাইফ কাটাবো। অন্তত একজন তো বকা দেওয়ার মানুষ কমবে।”
এসব চিন্তা করে মুখ টিপে হাসলো ইলিজা।
মমতাজ স্নেহের সহিত মিরার শরীর পোঁছাতে পোঁছাতে বললেন, “রাগ করিস না, মা। আমিও কি জানতাম নাকি? তোর বাবা ঠিক করেছে। তাছাড়া আজকে তো শুধু দেখতে আসবে। দেখলেই কি বিয়ে হয়ে গেল? আর ছেলে নাকি অনেক সুন্দর, লম্বা। বড় বিজনেস কোম্পানি আছে। আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে এসেছে, বুঝলি?”
“মা, তুমি থাকো তোমার আমেরিকান ছেলে নিয়ে। আমি এখন বিয়ে টিয়ে করছি না। আমার কিন্তু কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হচ্ছে।”

ইলিজা অবাক হয়ে ভ্রূ উঁচিয়ে বলে, “ওরে বাবা! আমেরিকান ছেলে। আম্মু, আপু রাজি না হলে সমস্যা নাই, আমি রাজি আছি। যদিও কোরিয়ান হলে বেশি ভালো হতো, তবে মানিয়ে নিব।”
লাজুক মুখ করে কিঞ্চিৎ হাসতে থাকলো সে।
মমতাজ ভ্রূ কুঁচকে ইলিজার কান মলা দিয়ে বললেন, “পা*জি মেয়ে, একটা দিব। যা গিয়ে পড়তে বস।”
ইলিজা কানে হাত দিয়ে বললো, “উফফ, লাগছে তো। শুধু আমার সাথেই পারো।”
“যাবি? নাকি বেতটা আনবো?”
ইলিজা চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, “যাচ্ছি যাচ্ছি।”
যেতে যেতে ব্যঙ্গ করে মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড়িয়ে পুনরায় বললো, “বেতটা আনবো? ধুরো।”
কক্ষ থেকে চলে গেল সে।
মিরা বিরক্তি নিয়ে বললো, “তোমার মাথা থেকে এসব বিয়ের ভূত নামাও বুঝছো। এখন সুন্দর করে কেটে পরো তো।”
ঠিক তখনই আব্দুর রহমান মিরার কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে আনন্দিত গলায় বললেন, “কই গো, আমার মা-রে তৈরি করছো?”
“তুমি তোমার মেয়ের সাথে কথা বলো। অনেক কাজ আছে। আমি নিচে যাই,” বলে মমতাজ বিছানা থেকে উঠে কক্ষ ছেড়ে বের হয়ে গেলেন।

আব্দুর রহমান নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, “কিরে মা, যা তৈরি হয়ে নে। ছেলে পক্ষ তো চলে আসবে।”
মিরা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। নতজানু হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, বিয়েটা কি এখনই করা খুব দরকার?”
“বুঝতে পেরেছি। তোকে না জানিয়ে আমার এই ডিসিশন নেওয়া উচিত হয় নাই। কিন্তু ছেলে আমার চেনা। আমার ছোটবেলার বন্ধু আসাদের ছেলে। মা শিক্ষিত, সুদর্শন ছেলে। আশা করি তোরও দেখলে পছন্দ হবে।”
মিরা বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো, “কিন্তু বাবা, আমি তো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে একটা জব করতে চেয়েছিলাম। এত কষ্ট করে পড়ালে কি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য?”
আব্দুর রহমান স্নেহের সহিত অনুনয় করে বললেন, “বিয়ে তো একদিন দিতেই হতো। আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আমার কাছে ছেলের ছবি আছে। ওটা দেখ। তারপর না হয় তোর সিদ্ধান্ত জানাস। কিন্তু মা, একবার শুধু ওদের সামনে যা। আমার সম্মানটা রাখ। কিছুক্ষণ পর তো ওরা চলে আসবে।”
ছেলের ছবি মিরার ফোনে পাঠিয়ে দিয়ে পুনরায় বললেন, “তোকে ছেলের ছবি পাঠিয়েছি। দেখ কেমন মনে হয়। ওর নাম কারান। তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমি যাই, দেখি তোর মায়ের একটু সাহায্য করি,” বলে প্রস্থান করলেন তিনি।

মিরা বাবার মুখের ওপর আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সাহস পেল না।
তবে মিরা কক্ষে এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে অস্থির কণ্ঠে বললো, “এটা কিছু হলো? এভাবে তীরে এসে তরী ডুবতে দেওয়া যায়? কত স্বপ্ন ছিল; জব করে মা-বাবাকে খুশি করবো, নিজের মতো করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিব। এখন বিয়ে হয়ে গেলেই তো সব শেষ।”
তার হৃদয়ের গভীরে তখন প্রশ্নের এক ঝড়ো তাণ্ডব চলছিল। অজানা আশঙ্কায় বুকে জমে উঠছে শীতল কুয়াশা। তার চোখে ভেসে উঠছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়াবহ ছায়াপাত। ছেলেটি যদি রুষ্ট হয়? যদি বুঝতে না পারে তাকে? যদি তার স্বপ্নগুলোকে নিঃশব্দে গলা টিপে হ*ত্যা করতে হয়? নিজেকে কি তখন বিসর্জন দিতে হবে? স্বাধীনতা! সেটা কি ওখানে গিয়ে থাকবে? নাকি সে শুধুই আরেকটা মুখোশ পরা নামহীন সত্তা হয়ে যাবে?
এসবের মধ্যেই হঠাৎই তার মনে প্রশ্ন জাগে—ছেলেটি দেখতে কেমন? পরমুহূর্তেই মুখটা সংকুচিত করে খোঁচামারা ভঙ্গিতে বলে ওঠে, “হবে তো একটা বুড়া ব্যাটাই! আচ্ছা, বাবাকে বলে দিই; ছেলে পছন্দ হয়নি, তাহলেই তো মিটে যায়।”

আবার এক মুহূর্ত চুপ থেকে নিজের যুক্তির ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে পড়ে বলল, “কিন্তু সিন না করলে তো বুঝবেই যে ছেলে দেখিনি। কি জ্বালা!”
মিরা এবার বিরক্ত হয়ে দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে চিন্তিত কণ্ঠে শুধালো, “মাথাই কাজ করছে না, উফফ।”
ব্যর্থ চিন্তায় বিধ্বস্ত হয়ে পালঙ্কে বসে পড়ল সে। একটু দম নিয়ে, দৃষ্টি এক পয়েন্টে স্থির রেখে, এক গ্লাস পানি হাতে তুলে নেয়। সাথে দ্বিধাগ্রস্ত হাতে মোবাইল তুলে নেয়। পানি খেতে খেতে সংকল্প করল, কারানের ছবি দেখে নিবে, যেন এক ক্লিকেই সকল জটিলতার উত্তর মেলে।
আর ঠিক সিন করতেই তার পুরো স্নায়ুপ্রবাহে বিদ্যুৎ খেলে গেল। হাত কেঁপে উঠে, গলাস থেকে পানি ছলকে মাটিতে পড়ে যায়। মিরার হৃৎস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে আবার তীব্র বেগে ধুকপুক করতে লাগল। মুগ্ধতার চূড়ায় পৌঁছে তার আঁখি যুগল ললাট ছুঁয়ে যায় যেন। ঠোঁট কেঁপে উঠল। চোখদুটো পর্দার ওপারে থাকা সেই পুরুষের মুখে আটকে গেল।

অবর্ণনীয় বিস্ময়ে কণ্ঠে চঞ্চল কাঁপন এনে, সে কাশতে কাশতে বলে উঠে, “ওমা!”
তার গলা দিয়ে শ্বাসের সাথে লাজুক কণ্ঠ বেরিয়ে এলো, “আমি তো ভাবছিলাম… এ তো হ্যান্ডসাম, হট নিকলা। কি হাইপ দেওয়া ছেলে রে বাবা! এর দিকে আর তাকানো যাবে না, তাহলে শেষ আমি।”
সে লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেলে। মুহূর্তেই গালে লালিমার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। হাতের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নেয় সে। কানের লতিতে ছুঁয়ে যায় লজ্জার উষ্ণ আভা।
ক্ষণকাল থেমে চোখে তীব্র কৌতূহল নিয়ে ঠোঁটে স্মিত হাসি এনে মৃদু কণ্ঠে বলে, “তার মানে, সামনে থেকে আরও বেশি অপূর্ব লাগবে।”
বলতে বলতেই হৃদয়ে জ্বলে উঠে আবেগের দাবানল। মিরা মাথাটা হেলিয়ে রুদ্ধ আবেগে তাকায় কারানের ছবির দিকে। তার চোখে তখন ঢেউ খেলানো স্বপ্নের জল।
অতঃপর সে অদ্ভুত লজ্জা-মিশ্র বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলে, “কি একটা অবস্থা! লজ্জা লাগছে কেন? জীবনে প্রথম কোনো ছেলেকে এমন চোখে দেখছি। তাও কিনা নিজের ফিয়ন্সেকে! ভাই, এই ছেলের চোখ… উফ! মনে হচ্ছে নীল রং মাখানো কোনো সমুদ্র, ডুবে গেলেই শান্তি!”

হঠাৎ তার ভিতরে নাটুকে সত্তা জেগে ওঠে। দুই হাত বুকের কাছে এনে চোখদুটো বিস্ময়ে বড় করে ঠোঁট চেপে ধরে হাসে। কণ্ঠে একরাশ কবিত্ব ভাব এনে বলে ওঠে, “একটা লাইন না বলে পারছি না। ওহে সুদর্শন পুরুষ! জানি না আপনার রূপে কত নারী হৃদয় আত্মবিসর্জন দিয়েছে, তবুও এই হৃদয়ের নিঃশর্ত অনুরাগ, আপনার ঐ নয়নজোড়ার নীরব আহ্বানে বন্ধক দিলাম। ওই স্নিগ্ধ দৃষ্টির মোহে আমার অন্তরটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন আপনি। আপনি তাকালেই, আমার সমস্ত আত্মা যেন কুয়াশার মতো গলে পড়বে।”
সে মুখ ঢেকে ফেলে লজ্জায়। চোখ-মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। হৃদয়ের গভীরে অজানা এক উচ্ছ্বাসের ঢেউ ধাক্কা দিতে থাকে বারবার। সে অনুভব করে— তার অন্তর্দৃষ্টি জুড়ে এখন রঙিন স্বপ্নেরা পাখা মেলছে; আর অনির্বচনীয় অনুরাগের ঘোরে সে চোখ লুকিয়ে হেসে যাচ্ছে। বুকের গহীনে স্বপ্নেরা প্রথমবারের মতো খেলা করছে। কারণ ছাড়াই অনাবিল আবেশে মুখ ঢেকে হাসতে রইল মিরা।

ক্ষণকাল বাদে মিরা একটি গোলাপি বর্ণের জামদানি শাড়ি পরিধান করল। কানে ঝুমকা ঝুলিয়ে, চোখে সামান্য কাজল আর ঠোঁটে লিপগ্লস দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে। তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে; গোলাপি রংটি তার গায়ের রঙে এক নতুন দীপ্তি এনেছে। সে যেন একটা বিশেষ পদ্মফুল, যার মনে নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য অবিরাম আকুলতা। এই আকুলতা আর আনন্দ তার মুখশ্রীতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, তার মনে জমেছে মিশ্র অনুভূতি।
মিরা নিজেকে আয়নায় দেখতে দেখতে আপনমনে বলে, “না, বিয়ে করাটা খুব একটা খারাপ না। একদিন তো করতেই হতো। কিন্তু যদি ছেলে এমন হয়… ওরেএএ, আমি মনে হয় পা”গল হয়ে গেছি, আল্লাহহ!”
খানিকটা শব্দ করেই হাসতে লাগল সে। তার চোখমুখে লজ্জার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
কিছুক্ষণ পর মমতাজ মিরার আলয়ের দুয়ারে এসে বলেন, “কি মা, হলো তোর? পাত্রপক্ষ চলে আসলো বলে।”
মিরা মায়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “এইতো মা।”
মমতাজ মিরার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আনমনে বলেন, “কি অপূর্ব লাগছে আমার মেয়েটাকে।”
ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকার পরে উচ্চ আওয়াজে বলেন, “আচ্ছা, তুই থাক তাহলে। ওনারা আসলে আমি নিতে আসব।”
“আচ্ছা মা।”
মমতাজ মৃদু হাসি মুখে প্রস্থান করলেন।

পাত্রপক্ষের লোকজন এসে পৌঁছেছে। আসাদ চৌধুরি এবং ইসহাক চৌধুরি ফরমাল স্যুট ও কোট পরিধান করে আসলেন। আরিয়ান শুভ্র শার্ট ও প্যান্টে সজ্জিত, তার হাতে রয়েছে রোলেক্স ঘড়ি।
আরিয়ানের স্ত্রী রোমানা, পাকিস্তানি সালোয়ার কামিজে শোভিত, কাঁধ অবধি কাটা চুলগুলো খোলা, কানে ঝুলছে ছোট একটি ডায়মন্ড দুল, হাতে রয়েছে ব্র্যান্ডের হ্যান্ডব্যাগ।
তবে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থিতি নিয়ে এসেছেন ইসহাকের স্ত্রী, আশমিনি। গাঢ় সবুজ কাঞ্চিপুরম শাড়িতে তার আবেদন অনন্য; গলায় একটি হীরা বসানো পেন্ডেন্ট, হাতে কয়েক জোড়া সোনালি চুরি, কানে হীরার দুল এবং পায়ে রয়েছে জমকালো হিল। তার একগুচ্ছ চুল শক্ত করে পিছনে খোঁপা বাঁধা। সাথে তার ছেলে আয়াশও এসেছে।
আসাদ চৌধুরি উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,”আসসালামু আলাইকুম, আব্দুর রহমানজি।”
আব্দুর রহমান আলিঙ্গন করতে করতে উত্তর দিলেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমি মিয়া কথাই বইলো না! ছেলের বিয়ের ব্যাপার না হলে তো তোমার খোঁজই ছিল না।”

আসাদ রসিকতা করতে করতে বললেন, “এখন তো বেয়াই হতে চলেছি। এখনও কি ঝগড়া করবি আব্দুর রহমান?”
“আরেহ বস। কই তোমরাও বসো। মিরার মা!” গলা উঁচিয়ে ডাকলেন তিনি।
মমতাজ বৈঠকখানায় এসে আহ্লাদি কণ্ঠে বললেন, “আসসালামু আলাইকুম, ভাই। কেমন আছেন?”
আসাদ হাসতে হাসতে বললেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, ভাবি। আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে ভুল শুনিনি। ভাবি তো দেখছি মা শা আল্লাহ। তাহলে আমার বৌমা কেমন হবে!”
মমতাজ ঈষৎ হেসে বললেন, “আপনারা বসেন তাহলে। শিলার মা, খাবারগুলো নিয়ে এসো। আমি গিয়ে মিরুকে নিয়ে আসি।”

মমতাজ ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। কিছুক্ষণ পর মিরাকে সাথে নিয়ে নিচে নামলো সে।
মিরা শাড়ির আঁচলটি মাথায় টেনে নিল৷ লজ্জাশীলা ভঙ্গিমায় এসে সোফায় বসলো। মুহূর্তেই এতক্ষণের কথাবার্তার কোলাহল থেমে গেল। যেন কেউ শব্দহীনতার এক পর্দা টেনে দিয়েছে সবার চোখের উপর।
মিরার পরনের অভিজাত গোলাপি শাড়ির কোমল আভায় তার দুধে-আলতা গায়ের দীপ্তি এমন এক অপার্থিব ঔজ্জ্বল্যে মিশে গেছে, যেন সে কোনো সদ্য বিকশিত চন্দ্রমল্লিকা, যার পাপড়িতে বিন্দু বিন্দু শিশির লেগে আছে। তাকে দেখলে মনে হয়, শত ফুলের সমারোহে স্থাপিত এক অনুপম প্রতিচ্ছবি—যার সৌন্দর্য নির্বিচারে সমস্ত চেনা সৌন্দর্যকে অতিক্রম করে। শত সহস্র পুষ্পের মাঝে মিরাকে স্থাপন করলেও, তার অপরূপ সৌন্দর্য এমন স্বতন্ত্র দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হবে যে অনায়াসেই সবকিছুকে ছাপিয়ে মন কাড়বে।
আরিয়ানের চোখ মিরার মুখশ্রীতে আটকে গেল। পলক পড়লো না একটিবারও। আশমিনি ও রোমানা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বিস্ময়ের আদান-প্রদান করলো। উপস্থিত সবাই যেন হঠাৎই রূপকথার কোনো পাতায় প্রবেশ করেছে, আর মিরা সেই পাতার মূর্তিমান নায়িকা। যেন তারা কোনো মানুষ নয় বরং একটা পরী দেখছে কিনা, কারোর বোধগম্য হলো না।

মিরা আলতো কণ্ঠে বললো, “আসসালামু আলাইকুম।”
তার কণ্ঠে মোহনীয় কম্পন ছিল। তবে সে চোখ তুলে তাকাতেই সবাই যেন পুনরায় পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।
এটা দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে ভেতরে আলোড়ন অনুভব করলেও নিজেকে মুহূর্তেই সংযত করে নিল মিরা। তারপর নতজানু হয়ে লাজুক স্বরে বললো, “আপনারা চা নিন।”
এমন সময় ছোট্ট আয়াশ হঠাৎ উদ্ভাসিত গলায় বলে উঠলো, “ভাবি তো দেখছি প্রিন্সেস, ফেইরি!”
এই অনুচ্চারণে উপস্থিত সবার চেতনায় ঝড় বয়ে গেল। ঘোর কাটলো। আর মিরার মুখ পুষ্পবর্ণ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো। তার গালজোড়া যেন টকটকে গোলাপের পাঁপড়ি, লাজে আর সৌন্দর্যে জ্বলে উঠেছে সেই মুহূর্তে।
কিন্তু হঠাৎই মনোজগতের আকাশে উঁকি দিলো একটি চেনা নাম —কারান।
তার নাম মনে হতেই মিরার চোখ দুটো অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যাকুল হয়ে এত মুখের ভিড়ে সেই পুরুষের মুখ খুঁজতে লাগলো। কাঙ্ক্ষিত সেই মুখপট কোথায়? কিন্তু না, কোথাও নেই সে।
মিরার মুখাবয়বের শান্ত জলরঙ হঠাৎ উদ্বিগ্নতার ঘন রঙে ছড়িয়ে পড়লো। হৃদয় থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

“কারান কি তবে আসেননি? ইশ… তার মানে বরটাকে এক নজর দেখবোও না!”
এই প্রশ্ন উচ্চারিত হলো না, কিন্তু হৃদয়ের গহীনে প্রতিধ্বনি তুললো বারবার। এক অজানা কষ্ট, অস্পষ্ট অভিমানে মনের কোণে জেগে উঠলো বেদনার কুয়াশা। তবে বাহ্যিক মুখাবয়বে কিছুই প্রকাশ না করে, সেই কষ্টকে হৃদয়ের গভীরে বালির নিচে চাপা দিলো মিরা।
সব আয়োজনের অবসান ঘটলো। সবাই কথাবার্তা চূড়ান্ত করে চলে গেল।
মিরা নিজ কক্ষে ফিরে গিয়ে শাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে অসন্তোষে গলা নামিয়ে বললো, “ধুর! যাকে দেখার জন্য গেলাম, সে-ই আসলো না। অন্যায় হলো আমার সাথে।”
তার কণ্ঠে ছিল অভিমানের তীক্ষ্ণতা, ছিল অব্যক্ত ক্ষোভের উত্তাপ। কারানের অনুপস্থিতি মিরার হৃদয়ে অদৃশ্য ঈষৎ ক্ষত তৈরি করেছে। গলা নামিয়ে শুধালো, “কারান কেন এলো না? আমি কি তবে তার কাছে এতটুকুও গুরুত্বপূর্ণ নই? না কি… তার কোনো গোপন কারণ আছে?”
এইসব ভাবনার ভারে মুহূর্তেই ভারাক্রান্ত হলো তার হৃদয়ের অলিন্দ। আকুল প্রতীক্ষার দুয়ারে এসে থেমে গেল সকল স্বপ্ন। মিরার মুখশ্রী মলিন হয়ে গেল। কারানকে একটিবার দেখার যে ব্যাকুলতা তার চোখে ছিল, তা আজ শুধু বিফলতা হয়ে রয়ে গেল।

ঢাকার অভিজাত গুলশানের এক প্রান্তে বিস্তৃত চৌধুরি ভিলা। মূল ফটকটি কালো ও সোনালি রঙের ইটালিয়ান নকশায় গড়া, লোহার গেটের উপর খোদাই করা চৌধুরি পরিবারের প্রতীক চোখে পড়ে আগেই। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় মার্বেল পাথরের রাজপথ, দু’পাশে সারি দিয়ে বাগানবিলাস, রোজ গার্ডেন ও আধুনিক ফোয়ারা। মোশন সেন্সর লাইট গাড়ির আগমনে জ্বলে ওঠে। পাশে প্যাভিলিয়ন-স্টাইল গ্যারেজে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো রোলস-রয়েস, হোয়াইট ল্যাম্বরগিনি, মেটালিক গ্রে ম্যাকলারেন, আর কারানের প্রিয় বুগাটি শিরন। বাড়ির প্রবেশমুখে বিশাল গ্র্যান্ড ফয়ার, যার মাঝে ঝুলছে ১২ ফুট লম্বা ক্রিস্টাল শ্যান্ডেলিয়ার। সাদা মার্বেল ফ্লোর, সোনালি ফ্রেমের আয়না, আর ভিক্টোরিয়ান অ্যান্টিক ফার্নিচারে সাজানো ঘরটি যেন রাজকীয়তার প্রতিচ্ছবি।
চৌধুরি বাড়িতে প্রবেশ করেই আসাদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সম্ভাষণ করে, “কারান, কোথায় তুই?”
কারান সিঁড়ি থেকে ধীর পায়ে নামছিল। কালচে নীল শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো, বুকের উপর একদিক থেকে আরেকদিকে টানাটানির মতো চেপে থাকা ফিটিং কাট করা। গলার কাছটায় একটা বোতাম খুলে রাখা ছিল—সেখান দিয়ে হালকা ঘামচকচকে ত্বক উঁকি দিচ্ছিল। কোমরে গ্রে শেডেড ট্রাউজার, আর পায়ে ইটালিয়ান লেদার লোফার পরিহিত। গাড়ির চাবির রিংটি আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে, চোখে-মুখে সেই চিরচেনা নির্বিকার ভাব নিয়ে সে বলল, “হুম, বলো।”

আসাদ চোখে উন্মাদনার ঝিলিক নিয়ে বলল, “যাকে দেখে এসেছি, তুই দেখলে পা”গল না হয়ে যাস। এই মেয়ে এই বাড়ির জন্য পারফেক্ট। এমন মেয়ে তো পুরো দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
কারান বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল, “তোমার বলা হয়েছে? মেয়ে যেমন চেয়েছি, তেমন হলেই হবে। আমার আর কিছু জানার দরকার নেই।”
অন্যদিকে তাকিয়ে হালকা কুটিল হেসে গম্ভীর কণ্ঠে ফের বলল, “বিয়ে করাতে চেয়েছো, আই অ্যাগ্রি। আর কি চাও?”
আসাদ চৌধুরি হাসি থামিয়ে বলল, “আচ্ছা, তুই শুধু মেয়ের একটা ছবি দেখ। তারপর নাহয় তোর ওপিনিয়ন জানাবি।”
“আমি কাহিনি বাড়াতে চাই না। বিয়ের কাজ শুরু করো,” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে তার বুগাটি শিরন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
এদিকে আরিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কপাল কুঁচকে মনে মনে বলল, “কারান বিয়ে না করতে চাইলে, তাহলে কি দরকার ওর বিয়ে করার? মিরাকে না হয় আমিই বিয়ে করি। ইশ, যদি একবার পেতাম!”
হাত মুঠ করে নিল সে। অর্থাৎ আশা ও আকাঙ্ক্ষার তাড়না তার মনে ঝড় তুলছে।

সালটি ২০১৮, জুলাইয়ের ৪ তারিখ। সায়াহ্নের উজ্জ্বল আলোয় একটি অচেনা মেয়ে রক্তমাখা শাড়িতে, হাতে রক্তে ভিজে থাকা একটি ছুরি নিয়ে থানার গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অকস্মাৎ এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখে পাহারায় থাকা হাবিলদার আঁতকে উঠে দৌড়ে থানার ভিতরে গিয়ে আমান হোসেনকে ডেকে আনলেন। যখন আমান মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল।
মেয়েটি ঘোলাটে নিষ্প্রভ চোখ তুলে দুর্বল ভাঙা গলায় বলল, “আমি কারান চৌধুরীকে মে*রে ফেলেছি,” বলেই ধপাস করে নিচে বসে পড়ল।
মেয়েটি আর কোনো কথা বলেনি, শুধু দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আমানের দিকে বাড়িয়ে দিল, অর্থাৎ তাকে যেন গ্রেফতার করা হয়। অথচ তার দুই হাতই থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটিকে হাতকড়া পরিয়ে জেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। পরবর্তীতে জানা গেল, কারান চৌধুরি এখনো মা*রা যায়নি; তিনি আইসিইউতে ভর্তি, তবে তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, বাঁচবে কিনা সেটাও বলা মুশকিল।

মেয়েটিকে দেখার দায়িত্ব পড়েছিল শারমিন নামের একজন কম বয়সি পুলিশ কর্মকর্তার উপর। উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে, মেয়েটিকে যেন কোনো প্রকার আঘাত বা জেরা না করা হয়; যেহেতু সে নিজেই আত্মসমর্পণ করেছে, তাই তাকে কথা বলার জন্য সময় দেওয়া হোক। কিন্তু এমনটা কখনো কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। কেন খু*নি মেয়েটির সঙ্গে এতো সম্মানের সঙ্গে আচরণ করতে বলা হয়েছে, সেটা পরবর্তীতে শারমিন বুঝতে পারল।
সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েকবার শারমিন মেয়েটির জেলে প্রবেশ করে নানা প্রশ্ন করেছে, কিন্তু মেয়েটির মুখ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি; সে নড়াচড়া বিহীন এক স্থানে নিস্তব্ধভাবে বসে আছে। মেয়েটিকে দেখে শারমিনের মনে হলো, যেন এক জীবন্ত নিথর দেহ—প্রাণ আছে, কিন্তু সত্তা নেই। পরের দিন সকালেও কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিন্তু আগের মতোই মেয়েটির মুখে টু শব্দও বের হয়নি। তার দেহ অসার, মুখমণ্ডল অবসাদে ছেয়ে গেছে, চক্ষুদ্বয় নিথর হয়ে গেছে।
অপরাহ্ণের দিকে শারমিন বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, “ম্যাডাম, অনেক হয়েছে। নয় মুখ খুলুন নাহলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এবারও মেয়েটি নিশ্চুপ, স্তব্ধ জেলের মধ্যে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে কোনো অনুসন্ধান ছিল না, শ্রবণে কোনো সাড়া ছিল না; শুধু নিরুচ্চার, নিস্পন্দ এক উপস্থিতি হয়ে বসে ছিল সে। শারমিন হয়ত কোনোভাবে মেয়েটির পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে। তাই নিজের রাগ সামলে নিয়ে কিছুটা নরম কণ্ঠে বলল, “ম্যাডাম, আপনি ধীরে সুস্থে সব বলুন। কেন কারান স্যারকে খু*ন করতে চাইলেন?”
শারমিনের স্নেহময় বাক্য শুনে মেয়েটি নিষ্পলক অসহায়ের মতো তাকিয়ে অস্পষ্টভাবে মুখ খুলল। পরবর্তীতে জানা গেল, মেয়েটির নাম মিরা।

মিরাই এতক্ষণ ধরে দুই বছর আগের কিছু ঘটনা শারমিনকে বলছে।
শারমিন বিষম খেয়ে বলে, “তার মানে, কারান স্যার বিয়েতে রাজি ছিলেন না?”
মিরা আটকে থাকা নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে, “নাহ।”
শারমিন আফসোসের সঙ্গে বলে, “ইশ, স্যার যদি একবার আপনার মুখ দেখতেন! ম্যাডাম, আমি শতভাগ নিশ্চিত, স্যার যদি একবার আপনার সৌন্দর্য দেখতেন, তবে নিশ্চয়ই আপনার প্রেমে পড়তেন।”
কিছুক্ষণ আগে যতক্ষণ ঘটনা বলছিল, পুরো সময় জুড়ে মিরার দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু শারমিনের এই কথাটি কর্ণধার হতেই মিরা ভারাক্রান্ত চেহারায় শারমিনের মুখপানে তাকিয়ে বলল, “তার মানে আপনিও মনে করেন সৌন্দর্যই সবকিছু?”

Tell me who I am part 2