Tell me who I am bonus part 1

Tell me who I am bonus part 1
আয়সা ইসলাম মনি

সকালবেলার স্নিগ্ধ আলো জানালার কাচ ছুঁয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। কক্ষে ছড়িয়ে আছে এক প্রাতঃস্মরণীয় প্রশান্তি। কারান অফিসের জন্য প্রস্তুত হলো। তার দেহে গাঢ় নেভি ব্লু স্যুটপ্যান্ট, ভেতরে নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা সাদা শার্ট, গলায় সিল্কের কালো টাই। কব্জিতে হ্যাবলট বিগ ব্যাং-এর ঝলমলে ঘড়ি দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। বুকপকেটে গোঁজা তুষারশুভ্র পকেট স্কয়ার পুরো সাজসজ্জায় রাজসিক ঔজ্জ্বল্য যোগ করেছিল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে অনায়াস ভঙ্গিতে চুলগুলো সযত্নে গুছাচ্ছিল। হঠাৎই তার চোখে-মুখে দুষ্টু ভাব প্রকাশ পেল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে, উচ্চকণ্ঠে ডাকল, “সুইটহার্ট।”
মিরা পাশের কক্ষে জানালার ধারে একটি পুরোনো কাঠের আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসেছিল। সকালবেলার আলো জানালা পেরিয়ে এসে তার গায়ের উপর এক নিস্তরঙ্গ আভা ফেলছিল। বহুদিন পর বই হাতে ডুবে গিয়েছিল এক বিদেশি উপন্যাসে। কারানের ডাক শুনে সে বিরক্তি চেপে বই বন্ধ করে গলা উঁচিয়ে বলল, “বলো…”

“অফিসে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।” বলে আবার সে বইয়ের পাতায় মন ডুবিয়ে দিল। কপালের উপর নেমে আসা আলগা চুলটা আঙুল দিয়ে সরিয়ে নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়তে লাগল।
কিন্তু মিরার এমন নির্লিপ্ত জবাবে কারানের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বুকের কাছে হাত বাড়িয়ে সে নিপুণ ভঙ্গিতে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেলল। তারপর ড্রয়ার থেকে তুলে নিল তার প্রিয় ‘রোজা ওট লাক্স’ এর পারফিউমের বোতল। বুকের কাছ থেকে শুরু করে কাঁধ পর্যন্ত এক ঝলকে ছড়িয়ে দিল মাদকতাময় গন্ধ। গোলাপের গভীর সুবাসের সাথে চন্দন ও ভ্যানিলার ঘন মিশ্রণ কক্ষে রাজকীয় আবেশ তৈরি করল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কারান গলা উঁচিয়ে আবার ডাক দিল, “মিরা, একবার এদিকে এসো।”
মিরা বইটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বইটা শেলফে তুলে রেখে ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করল। চোখেমুখে কোনো বাড়তি আবেগ না এনে নিরুত্তাপ গলায় বলল, “বলো।”
কারান বোতামটা হাতে তুলে ধরে মিরার দিকে বাড়িয়ে দেখাল, “এটা খুলে গেছে, লাগিয়ে দাও।”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে হাত বাড়াল, “অন্য একটা পরে নিলেই তো হয়।”
“না, সময় নেই। এখন এটাই পরে যেতে হবে।”
মিরা চোখ সরু করে তার শার্টের দিকে তাকাল। ঠান্ডা স্বরে বলল, “তা আমি লাগিয়ে দিতে গেলে বুঝি সময় থেমে থাকবে? তোমার কালো শার্ট অন্তত চার হাজার পাঁচশোটা তো হবেই, আর সাদা শার্টও পাঁচ হাজারের কম নয়। বাকিগুলোর কথা না বলাই ভালো। এত পোশাক দিয়ে কী করো?”

কারান ঠোঁট বাঁকিয়ে একপ্রকার অহংকারী ভঙ্গিতে জবাব দিল, “আমি কোনো পোশাক রিপিট করি না।”
মিরা হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হয়েছে। মোট কথা, আমাকে দিয়ে এখন খাটানো লাগবে।”
কারান ঠোঁটের কোণে প্রগলভ হাসি ফুটিয়ে তুলল। মিরাও মৃদু হাসল, তারপর পাশের কক্ষ থেকে সূক্ষ্ম সুতোর রিল ও সুঁই হাতে নিয়ে ফিরে এলো। কাছে এসে সে সযত্নে কারানের শার্টের বুকে বোতাম লাগানোর প্রস্তুতি নিল।
ঠিক তখনই কারানের গায়ে ছড়িয়ে থাকা রোজা ওট লাক্স পারফিউমের ঘন আবেশে মিরা মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেল। চেতনার অতল থেকে যেন এক অকারণ মোহ তাকে আচ্ছন্ন করল। কারান তীক্ষ্ণ চাহনিতে অনুধাবন করল স্ত্রীর এই আকস্মিক বিভোরতা। এ জন্যই সে দেহে সুগন্ধি ছড়িয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মিরা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে পুনরায় সূক্ষ্ম সেলাইয়ের কাজে মনোযোগ দিল।

কারান অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মিরার মুখাবয়বে। মিরা বোতাম লাগানো শেষ করে সামান্য ঝুঁকল সুতা কাটতে। সেই মুহূর্তে কারান চোখ বন্ধ করে অনুভব করল মিরার চুলের সুগন্ধি। নিশ্বাসের সাথে তার বুক ভরে উঠল সেই অদৃশ্য মাদকতায়। মূলত এই গোপন কারণেই কারান ইচ্ছে করে বোতামটা খুলেছিল।
সেলাই শেষ হলে মিরা গলা উঁচু করে বলল, “হয়ে গেছে।”
কিন্তু তার চোখে পড়ল ভিন্ন দৃশ্য। কারান চোখ বন্ধ করে হাতে মুঠো করে রেখেছে মিরার কয়েকগুচ্ছ চুল, সেই সুবাসে নিমগ্ন সে। মিরার ঠোঁটে খেলল সংযত হাসি। আস্তে করে তার হাত থেকে চুলগুলো ছাড়াতে চাইতেই কারান হঠাৎ শাড়ির আবরণ ভেদ করে কোমর শক্ত করে টেনে নিল কাছে। তার দৃষ্টি তখন গভীর, স্থির; সেই শিকারি চোখে একান্ত অধিকার জেগে উঠেছে।
মিরা মৃদু হাসিতে দু’হাত দিয়ে কারানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “কি ব্যাপার, মিস্টার একে চৌধুরি? একটু আগেই না খুব তাড়া দেখাচ্ছিলেন।”

কারানের চোখে তখন নেশালো দীপ্তি খেলল। কোমরে দৃঢ় বাঁধন চাপিয়ে টেনে নিল আরো কাছে। দু’জনের উদর মিলিয়ে গেল। তার গলা থেকে বেরোল কোমল স্বর, “মুড চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে যে, স্টারলিং।”
মিরা মৃদু হাসি ছড়িয়ে তার বুকে হালকা ধাক্কা দিল। “অফিসে যান।”
কারান হাসতে হাসতে সরে গিয়ে বলল, “ওকে, সুইটহার্ট। সাবধানে থেকো।”
কারান দরজার দিকে এগোতে যাবে, তখনই পেছন থেকে মিরার কণ্ঠ শোনা গেল, “কারান…”
কারান বিস্মিত চোখে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। মিরা ধীরপায়ে এগিয়ে এলো, তারপর হঠাৎ নীচু হয়ে বসে পড়ল তার সামনে। কারান কপালে ভাঁজ ফেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। মিরা নিখুঁত যত্নে কারানের জুতোর ফিতে বাঁধতে শুরু করল।

কারান স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এই যত্ন তার কাছে অমূল্য, অপ্রত্যাশিতও বটে। ফিতে বাঁধা শেষ হলে মিরা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। দু’হাত বাড়িয়ে তার গলা ধরে সামান্য নিচে নামালো, তারপর গালে রাখল এক গভীর চুম্বন। মুহূর্তেই কারানের বুক ভরে উঠল প্রশান্তির অপরূপ স্রোতে। মুখে কোনো হাসি ফুটল না, কারণ সেই নিঃশব্দ যত্নে সে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল।
মিরা আলতো হাসল, শান্ত কণ্ঠে বলল, “এবার যাও।”
কারান মিরার দিকে অপলক দৃষ্টি রাখল। এতটা নিখুঁত যত্নশীল কেন তার স্ত্রী? সে নিজেও বিস্মিত, সাথে হৃদয়ে গর্বের এক মৃদু তপ্ততা অনুভব করল। সংযত কণ্ঠে বলল, “লাভ ইউ।”

মিরা হালকা হেসে উত্তর দিল, “হয়েছে, বাবা। এখন যাও, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।”
কারান আলতো করে মিরার কপালে চুম্বন করল। মিরা বন্ধ চোখে গভীর নিশ্বাস নিল।
তারপর কারান হালকা হাসি টেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়াল। গাড়ির সিটে বসার পর পুরো রাস্তাটাই মিরার সৌম্য উপস্থিতি আর গৃহপরিচর্যার মায়াজালেই বন্দী হয়ে গেল সে। ঠোঁট ভিজিয়ে নিজের অজান্তে ফিসফিস করল, “আমি জানি না তোমাকে কতটা অনুভব করাতে পারি, বা কতটা যত্নে আবৃত করতে পারি। তবে তুমি যে প্রতিদিন নিজের ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ঋণী করে দিচ্ছ, সুইটহার্ট।”

ঘরে কয়েক ঘণ্টা কাটল অচেতন পরিশ্রমে। কারান না থাকার কারণে মিরা নিজেকে অতিরিক্ত ব্যস্ত রাখছে। বসার ঘরের বুকশেলফ অনেকটাই পরিষ্কার, তবুও সে গাঢ় কাঠের তাকগুলো একে একে মুছে নিল। জানালার পর্দা ইতোমধ্যেই গুছানো, তবু আবার ভাঁজ মেলল, নিখুঁতভাবে সাজিয়ে রাখল। ছোট ছোট জিনিসগুলো হাতেনাতে সাজালো, মেঝেতে হাত বুলিয়ে পরিষ্কার করল। আসলে কাজ নয়, একাকিত্বের ভার কমানোই ছিল তার উদ্দেশ্য।
তবু মন বসছিল না। বিছানায় এসে ধপাস করে বসে মনখারাপের স্বরে বিড়বিড় করল, “ইশশ, কখন যে আসবে তুমি! একটুও ভালো লাগছে না।”

কিছুক্ষণ পরে অস্থির হয়ে পা নাড়াতে শুরু করল। একবার শুয়ে পড়ল, আবার উঠে দাঁড়াল।
“না, শুতেও ভালো লাগছে না। সব কাজই তো শেষ হয়ে গেছে। এবার কি করি?”
হঠাৎ মনে এলো, ইলিজাকে কল করা যায়। মুখে হঠাৎ প্রশস্ত হাসি ফুটল। তৎক্ষণাৎ ফোন হাতে নিল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ল—আজ তো ইলিজার স্কুল আছে। আবার মন খারাপ হয়ে গেল।
“তাহলে কাকে কল করি? আচ্ছা, তারান্নুমকে করি। ওর ভাইয়ের নামে একটু বদনাম করার জন্য এখনই মোক্ষম সময়।”

অন্যদিকে, প্রাচীন চৌধুরি পরিবারের আঙিনায় দুপুরের রোদে তারান্নুম পাটি বিছিয়ে বসেছে। পাশে তার ছোট বোন তুব্বা। দু’জনের সামনে ছড়ানো ছিল রঙিন লুডুর গুটি। এই খেলায় তারান্নুম প্রায়ই হেরে যায় তুব্বার কাছে। আজও সেই পরিণতির মুখোমুখি। তবে তার বুকের ভেতর গোপন প্রতিজ্ঞা হলো, একদিন না একদিন খেলায় তুব্বাকে গো হারানো হারাতেই হবে।
আপাতত খেলা শেষের দিকে। পাশা হাতে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে মনে মনে বলল, “এইবারও হারলে তুব্বার বাচ্চায় আমারে নিয়া যে মজাটা করব রে। আয়হায়!”
ওদিকে তুব্বা চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক নিয়ে হেসে বলল, “এইবার হারলে সোজা ফারহান ভাইয়ারে বইলা দিব যে, তোমার মতোন হেরো ভূতরে যেন বিয়া না করে।”

কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে।
তারান্নুমের চোখ-মুখ কুঁচকে গেল, ঠোঁটে রাগ জমলো। সে জোরে বলে উঠল, “আমি জানতাম, মা তোরে ব্রিজের নিচের পচা ডোবাটা থেইকাই কুঁড়াইয়া আনছিল। তুই আমার বইন হইলে তো ওই আঁটকুড়া ব্যাটার পক্ষ নিতি না।”
আপনমনে হেসে বলল, “যদিও সে দামড়া, খাটাশ, কিন্তু আঁটকুড়া নামটাই ভালো মানায়!”
তারান্নুমের ক্ষোভ আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাগের দর্শন দেখে তুব্বা হাসি আটকাতে পারল না। হেসে হেসে সে লুটোপুটি খেল। বলল, “ফারহান ভাইয়ের ছবি দেইখাই আমার মেলা পছন্দ হইছে। না জানি সামনে থেইকা কত সুন্দর! তুমি যে আমারে পিটাও, আর আগে কারান ভাইয়ার জন্য দেওয়ানা ছিলা—সব আমি বইলা দিব।”
তারান্নুম ঠোঁট কামড়ে বলল, “খাড়া তুই।”

এই বলে সে মারধরের জন্য হাতের কাছে কিছু খুঁজতে ঝুঁকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনের বেজে উঠা রিং টোনে তার ক্ষুদ্র হিংসা উবে গেল। কে কল করেছে তা দেখার আগেই তুব্বা হেসে বলল, “হইবো না! আগে দান দাও, তোমারে হারাইতে সেই মজা!”

তারান্নুমও অবচেতন বুদ্ধি প্রয়োগ করল। কারণ সে জানে, এ খেলায় তার পরাজয় অবধারিত। পরাজয়ের লজ্জা মেনে নেওয়ার চেয়ে, খেলা ভেঙে ফেলা তার কাছে অতি বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো। ইচ্ছাকৃত ভঙ্গিতে পাশে রাখা ফোনটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। স্ক্রিনে মিরার নাম দেখে তার ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠল। তৎক্ষণাৎ ফোনটা কাড়ল আর সগৌরবে বলল, “এমনিতেও আমার লগে পারতি না তুই। মিরা ভাবি কল দিছে—গেলাম কথা কইতে।”
এই বলে সে সামনের গুটি সব এলোমেলো করে দিয়ে দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে গেল। তুব্বার চোখের সামনে মুহূর্তেই ভেঙে গেল তার এতক্ষণ ধরে গড়া খেলার সব পরিশ্রম। দম আটকে আসা রাগ ও অভিমানের স্রোত থামাতে না পেরে তুব্বা হাত-পা ছড়িয়ে, গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আর যদি তোমার লগে খেলি আমি… না পারলেই এমন করো। এ্যাআআআ!”

কিন্তু তারান্নুমের ঠোঁটে তখন মুচকি হাসির লাবণ্য ফুটল। ফোন রিসিভ করতেই উৎফুল্ল কণ্ঠে ডাক দিল, “ভাবিইইই, কেমন আছো?”
অপাশে মিরা ঘরের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল। জানালা দিয়ে ঝরে পড়া আলো তার চুলে খেলা করছিল। চোখেমুখে দীপ্তিময় প্রশান্তি নিয়ে সে হেসে উঠল, “এই তো তরু, অনেক বেশি ভালো আছি। তোমাদের খুব মনে পড়ছে।”
“তা তো আমগোও মনে পড়ে। কবে আইবা তুমি? ভাল্লাগে না আর।”
মিরা হালকা হাসি দিয়ে বলল, “আসব আসব। কিন্তু তোমার যে একটা একরোখা ভাই আছে, সে যে আমাকে যেতে দেয় না।”

তারান্নুম ঠোঁট কামড়ে ঠাট্টার সুরে ঝাঁঝ মেশাল, “দিব না তো। আসলে সব ব্যাটারাই হারে বজ্জাত।”
“তাই তো। শোনো, ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি—বিয়ে নামক অশান্তিতে জড়িও না। এ এক অন্তহীন গহ্বর, যেখানে সুখ কেবল ছলনার মায়াজাল।”
তারান্নুম এক গভীর হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল, “ওইসব আকাইম্মা জিনিসে জড়াইন্নার ইচ্ছা আমারো নাই। খালি একটু টেস্ট করতে মন চায় যে, ব্যাটা মানুষরে চুমু দিলে কেমন ফিল হয়। নইলে ওসব পাপের থেকে আমি শতহাত দূরেই থাকতাম।”

মিরা জোর করে ঠোঁট চেপে রাখল। অথচ তার বুকের ভেতর খিলখিল হাসির বন্যা হয়ে যাচ্ছিল। সে গলা খাকারি দিয়ে বলল, “কে বলল তোমাকে বিয়ে করা পাপ কাজ?”
তারান্নুম তখন সামনের দিকে হাঁটছিল। গ্রামীণ বাতাসে তার গোল জামার ঘের বারবার উড়ছিল। তার কিশোরী মুখে সেই বাতাসের ছোঁয়া স্নিগ্ধ আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। চোখ পাকিয়ে সে বলল, “বিয়ে করা তো পাপ না, বিয়ের পর যেগুলা করে ওইগুলা পাপ। আমি অনেক সুশীল মাইয়া, ওইসব অশ্লীলতার ধারেকাছেও নাই। শুধু একবারের জন্য হইলেও চুমু খাওয়ার কৌতূহলটা মিটাইতে বিয়া করবার মন চায়।”

তারান্নুমের বেপরোয়া সরলতায় মিরার বুক ভরে উঠল নিঃশব্দ হাসিতে। কিন্তু সে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের আবরণে মুখ লুকিয়ে তার সাথে সায় দিল। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে ননদ-ভাবির আলাপে বোনা হলো অগোছালো কথার জাল—যার অধিকাংশই ছিল কারান ও ফারহানের নিন্দা-পরিহাস। সময় গড়িয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর অবশেষে ফোনের সংযোগ ছিন্ন হলো।
তারান্নুম কল কেটে চঞ্চল ভঙ্গিতে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকল। এবার তার উদ্দেশ্য রান্নাঘরে গিয়ে ফাতিমাকে উত্ত্যক্ত করা।
অন্যদিকে ফোন কেটে যেতেই মিরার মুখমণ্ডল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে এলো। তার হাসি মিলিয়ে গিয়ে স্থির হলো বিষণ্নতার মুখোশে। কিছুক্ষণ চেয়ার ধরে বসে রইল, তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় গেল। ওপাশে টেক্সাস শহরের বিশাল স্কাইলাইন চোখে পড়ল। সামনে শুধুই বিস্তৃত প্রকৃতির শ্যামল প্রান্তর, অথচ কোনো জনবসতি নেই।

মিরা সেই দৃশ্যের দিকে চেয়ে থেকে গভীর নিশ্বাস ফেলল। ফিরে এসে ফোনটা হাতে নিল। ডায়াল প্যাড থেকে নাম্বার বের করল। স্ক্রিনে কারানের নাম উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল, অথচ আঙুল স্থির হলো না। নিজের সাথে বিড়বিড় করে বলল, “কারানকে কল করা কি সত্যিই ঠিক হবে? অফিসে আছে, নিশ্চয়ই ব্যস্ত… হয়ত এখন বিরক্ত করা উচিত নয়। কিন্তু এই অবাধ্য মন যে কোনো যুক্তির কাছে মাথা নত করছে না।”
এই আত্মসংঘাত তাকে অস্থির করে তুলল। একবার ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। আবার কিছুক্ষণ পর তুলে নিল। হৃদয়ের টান প্রতিবারই বুদ্ধির দেয়াল ভেঙে ফেলছে। অবশেষে চোখ বন্ধ করে দৃঢ় আঙুলে চাপ দিল কল বাটনে।

অন্যদিকে কারান ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ আটকে কাজ করে যাচ্ছিল। ফাইলের একের পর এক অনুচ্ছেদ পড়তে পড়তে যখনই সে গভীর মনোযোগে তলিয়ে গেল, ঠিক তখনই অফিসঘরের নীরবতা ভেঙে ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। কারানের ভ্রূ কুঁচকে গেল। মুখের প্রতিটি রেখায় অপ্রকাশিত বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে তো প্রতিদিন অফিসে ঢোকার আগেই ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। আজ তাহলে করল না কেন? এমনটা তো তার স্বভাববিরুদ্ধ! ভ্রূ নাচিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই বিরক্তি মিলিয়ে মুখটা উজ্জ্বল হাসিতে বদলে গেল। ডিসপ্লেতে স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে —My Queen Victoria.

ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি খেলিয়ে কারান ইচ্ছে করেই ফোন ধরে না চিনার ভান করল। গম্ভীর স্বরে বলল, “হ্যালো, কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে সামান্য নিশ্বাস ফেলার শব্দ পেল সে। তারপরই মিরার হাসির আলতো শব্দও শুনলো। মিরাও গম্ভীরমুখে বলল, “আপনার বউ বলছি।”
কারান ঠোঁট টিপে হাসল, মিরার এই অভিনয় বরাবরই তার পছন্দ। তবে আমোদটা ধরে রাখতে গম্ভীর গলায়ই বলল, “জি, বলুন?”
এবার মিরার কণ্ঠ বদলে গেল। কঠোরতার চাদর খুলে বেরিয়ে এলো নিবিড় কোমলতা। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে এক নিমেষের জন্য চোখ বন্ধ করল সে। তারপর গভীর মায়ায় ভেজা স্বরে বলল, “মিস ইউ, হানি।”
কারান নিঃশব্দে হাসল। ওপারে থাকা মানুষটিকে অনুভব করতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না। চোখে স্বচ্ছ উষ্ণতা নিয়ে সে শান্ত স্বরে বলল, “মিস ইউ টু, সুইটহার্ট।”
মিরার ঠোঁট থেকে হালকা হাসি ঝরে পড়ল, কিন্তু বাক্য আর গড়াল না। তবে তার নিস্তব্ধতার ভেতর কোনো অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা দোদুল্যমান। কারান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর মিরার নিরবতা দেখে নিজেই মুখ খুলল, “আর কিছু বলবে?”

মিরা ঠোঁট কামড়ে দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, “কখন আসবে?”
কারান হালকা হেসে বলল, “যখন সময় হবে।”
“আচ্ছা।”
“আর?”
“আসার সময় একটা কোক নিয়ে এসো।”
“ওকে। আর?”
অল্পক্ষণ নীরব থেকে মিরা আবার বলল, “আর…”
কারান চুপচাপ কানে ফোন লাগিয়ে পিছনের চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে থাকল। মিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল। তারপর হালকা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অশান্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি কিছু বলবে না?”
কারান হাসল, জানে মিরার ফোন করার মূল উদ্দেশ্য কি! তাই শান্ত, গভীর স্বরে বলল, “লাভ ইউ, মহারানি ভিক্টোরিয়া। উম্মাহ…”

Tell me who I am bonus last part 

মিরার মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠল। সেই মুহূর্তে তার মনের গভীরে নিগূঢ় প্রশান্তির শিহরন ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিবারই কারানের গম্ভীর কণ্ঠের প্রতিটি শব্দই তার মনপ্রাণকে আলোকিত করে দেয়, সমস্ত তৃষ্ণা ম্লান হয়ে যায়। আজও এই অনুভূতির ব্যতিক্রম হলো না। মিরা হেডবোর্ডে মাথা হেলিয়ে বলল, “ডিনারে কি খাবে, কারান?”
কারান নেশালো গলায় উত্তরে বলল, “তোমাকে।”

Tell me who I am bonus part 2

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here