Tell me who I am part 13
আয়সা ইসলাম মনি
মিরা সামান্য মাথা তুলে প্রশ্ন করল, “আবার?”
“কি আবার? আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। বলো মিরা, ভালোবাসো?”
“মন থেকে না বললে শুনেও কি শান্তি পাবেন?”
কারান হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তার মানে এখনো মনের ভিতর জায়গা হলো না আমার। আর কত দিন লাগবে?”
“বলবো, কখনো… হয়ত।”
কারানের মুখের ভাব মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল। চোখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, “আমি বুড়ো হয়ে গেলে?”
মিরা সামান্য হেসে বলল, “হুম, হতেও পারে। যখন আমরা দু’জন বয়সের ভারে নুইয়ে যাবো, যখন আপনার হাতে লাঠি থাকবে আর আমার চুল পুরোপুরি সাদা; তখন আপনাকে এই তিনটি শব্দ বলবো।”
কারান নিষ্পলক দৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, মিরা।”
মিরা এবার মৃদু হাসিতে চোখ নামিয়ে বলল, “ধৈর্য ধরুন, কারান সাহেব। ধৈর্যের ফল সবসময় মিষ্টিই হয়।”
কারান গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুচকি হেসে বলল, “ধৈর্য্যই তো ধরছি, মহারানি। নাহলে এতদিনে এক বাচ্চার বাবা হয়ে যেতাম।”
তার হাসির খটখট শব্দে মিরার কপালে ভাঁজ পড়ল। মিরা ভ্রুকুটি করে বলল, “আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।”
কারান এবার স্বচ্ছ হাসল। মিরার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “আচ্ছা, রাগ করতে হবে না।”
মিরা মুখ ফিরিয়ে বলল, “হয়েছে, ঘুমাবো আমি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তো ঘুমাও না।”
“এভাবে?”
“হুম, এভাবেই।”
তারপর মিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কোমল গলায় বলল, “এখন থেকে এভাবেই ঘুমাবো। তোমাকে হার্ডলি জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। শুভরাত্রি, আমার অর্ধাঙ্গিনী।”
কারানের উষ্ণ আলিঙ্গন ধীরে ধীরে তার হৃদয়ের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে দিতে শুরু করল। কারানকে থামানোর চেষ্টা করল না, তবে নিজের হাত দুটো কারানের চারপাশে রেখে তাকে আঁকড়েও ধরলো না।
কিন্তু কারানের শক্ত আলিঙ্গন, তার গভীর ভালোবাসার অনুভূতি মিরার হৃদয়ে অজানা প্রশান্তি এনে দিল। সে চোখ বুজে কারানের সেই উষ্ণতায় ডুব দিতে থাকল।
কারান সকালে খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। আসাদ চৌধুরীও সকাল সকাল কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে বেরিয়েছেন। চৌধুরি বাড়ির গা শূন্যতায় শুধু রোমানা আর মিরা উপস্থিত।
অপরাহ্ণের আলো যখন ধীরে ধীরে সোনালি রূপে রাঙাতে শুরু করলো, মিরা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির সন্নিকটে হাঁটতে শুরু করলো। একটু দূরেই অবস্থিত কয়েক বিঘা জমি নিয়ে সাজানো এক অপূর্ব বাগানবিলাস। মসৃণ বাতাস গায়ে লাগতেই তার সারা শরীরে শীতল স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো।
মিরা স্নিগ্ধ হেসে বলল, “বোঝা যায়, অনেক যত্নের সাথে বাগানটা তৈরি করা হয়েছে।”
মিরা খানিকটা হেঁটে গিয়ে মিষ্টি হাসনাহেনার গন্ধে মনোমুগ্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল।
হঠাৎ রোমানা পেছন থেকে একটু দূরে সামান্য আওয়াজ তুলে বললো, “এই বাগানটা আসাদ চৌধুরীর অত্যন্ত প্রিয়, বিশেষ শখের বাগান। তিনি তো আবার সবুজের প্রতি গভীর ভালোবাসা রাখেন। তাই মন খারাপ হলেই বাবার পা সময় কাটাতে এখানে চলে আসে।”
মিরা পিছনে ঘুরে মুচকি হেসে বলল, “বাবার পছন্দের প্রশংসা করতে হয়। কী সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে বাগানটা! যেন মন ও দেহে অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে আসে।”
রোমানা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল, “তবে আর কতক্ষণ হাঁটবে? চলো, একটু বসে চা খাওয়া যাক,” বলে সোজা সামনে হাঁটতে লাগলো।
মিরাও তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কাঠের কারুকাজ করা এক দোলনায় দু’জন গা এলিয়ে দিয়ে শান্তির নিশ্বাস ফেলল। রোমানা পিউয়ের মাধ্যমে দু কাপ চা আনানোর ব্যবস্থা করলো।
কিছুক্ষণ পর কাপে চুমুক দিতে দিতে শান্ত গলায় সে বলল, “একা একা ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না, তাই বেরোলাম। ওই জা’নোয়ারটাকে তো জেলে নিয়ে গেছে, এখন কয়েকদিন নিশ্চিন্তে আরাম আয়েশ করতে পারবো।” বলেই স্নিগ্ধভাবে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নিল।
মিরা রোমানার কথা শুনে মিশ্র হাসি দিয়ে বলল, “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনাদের সম্পর্ক যেন স্বামী-স্ত্রীর নয়, সাপে-নেউলের সম্পর্ক।”
“সে তুমি যা খুশি ভাবো। শয়তানটা তো কম জ্বালায়নি। ওর কথা ছেড়ে দাও, তোমার কথা বলো। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবে না তো?”
“কিছুই মনে করবো না, আপনি বলুন ভাবী।”
“তোমার আর কারানের সম্পর্কটা কেমন? মানে, আমার দেবর রোমান্টিক নাকি হুটহাট ঝাঁপিয়ে পড়ে?”
মিরা আশ্চর্যের সহিত রোমানার দিকে তাকিয়ে রইলো।
রোমানা সঙ্কোচহীনভাবে মিরার চোখে চোখ রেখে বলল,
“যেভাবে তাকিয়ে আছো, মনে হচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছো না। তোমার স্বামী কেমন জানি না, তবে স্বামীরা প্রায়ই এমনই হয়। (মুখ ভেঙিয়ে) বউয়ের মুড আছে কিনা সেসবের দিকে কখনো তাকায় না, নিজের হক আদায় করতে ব্যস্ত থাকে। (থেমে) আচ্ছা বুঝেছি, তুমি খুব লাজুক। তোমার লজ্জা দেখলে আমার হাসি পায়, বুঝলে?”
মিরা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ ভাবী, উনি একটু বেশিই রোমান্টিক।”
রোমানা মুচকি হেসে বলল, “তাহলে তো তুমি ভাগ্যবতী। আমার জামাইটা তো একদম মগা। আচ্ছা, তুমি আমার দেবরকে কয়বার দাগ বসিয়েছো বলো তো?”
“মা.. মানে?”
“মানে কামড়ের দাগ টাগ বসাও নাই নাকি?”
রোমানার কথা শোনে মিরার মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো।
রোমানা মুচকি হেসে কথা ঘুরিয়ে বলে, “চলো, বাদ দেই এই কথা। তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না।”
খানিক থেমে আরো বলে, “আরিয়ান তো শুধু মুলার মতো সাদা, ওর মধ্যে আর কিচ্ছু নেই। মানে রোমান্টিক না তো, তাই ফিল আসে না বুঝলে। তবে বিয়ের আগে একটা প্রেম করেছিলাম। সেই ছেলে কি যে হ্যান্ডসাম ছিল, কিন্তু তোমার কারানের মতো না। কারান চৌধুরি তো দুনিয়ায় একটাই ইগজিস্ট করে।”
থেমে পুনরায় বলল, “কারানকে আগে পেলে কারানের সাথেই প্রেম করতাম।”
শুনে মিরা ঘাড় ঘুরিয়ে রোমানার দিকে তাকিয়ে থাকলো। মিরা মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছে, এ আবার কেমন মেয়ে! মিরার স্বামীর সাথে প্রেম করার কথা তার সামনেই বলছে?
কিন্তু রোমানা যেন মিরার চিন্তাগুলো তার চোখে দেখে ফেলেছে।
তাই মুচকি হেসে সে বলল, “তুমি কিন্তু আবার চেতে যেও না। কথার কথা বললাম, আর কিছু না। কারান তো আমার ভাই-ই। আচ্ছা, তুমিও কিছু বলো। আমিই তো কতক্ষণ ধরে বলে যাচ্ছি।”
মিরা একটু নড়েচড়ে বসে ভাবুকস্বরে বলল, “আচ্ছা ভাবী, আসার পর থেকে কাকিকে তো দেখলাম না, উনি কোথায় গেছেন?”
রোমানা একটু ভেংচি কেটে বলে, “উনি তো আরেক জিনিস। কোথায় আবার? বাপের বাড়ি।”
মিরা মুচকি হেসে বলল, “তবে ভাবী, কাকি কিন্তু অনেক স্টাইলিশ, বলতে গেলে এখনো ওনাকে আবার বিয়ে দেওয়া যাবে। চেহারায় যৌবন যেন গলে গলে পড়ে, কথার মধ্যেও দাম্ভীকতা।”
“ঠিকই বলেছো। কাকির স্টাইল সত্যিই বোল্ড। এমন স্টাইলিশ হবেন না-ই বা কেন? ছোটবেলা থেকেই উনি অভিজাত পরিবারের সদস্য। ওনার বাবা তো একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সম্ভবত এসপি ছিলেন। আর উনার ব্যক্তিত্ব? দেখো না, শাড়ি পরার কি অপূর্ব সৌন্দর্য! শাড়ি এমনভাবে আঁটসাঁট করে পরেন যেন মাধুর্যের পরাকাষ্ঠা। মাঝখানে সিঁথি করে শক্ত খোঁপা বেঁধে রাখেন। প্রতিদিন ওনার কানে নতুন কোনো ডায়মন্ড বা সোনার দুল দেখা যায়। আর ওনার ওয়ারড্রব একবার দেখে এলে মাথা ঘুরে যাবে। সেখানে রাজশাহী রেশমি শাড়ি, টাঙ্গাইলের তাঁত, জামদানি, ঢাকাই বেনারসি, কাঞ্চিপুরম, মণিপুরি – কি নেই! শুধু শাড়ি নয়, জুতো আর হ্যান্ডব্যাগ পর্যন্ত নিজে ডিজাইন দিয়ে কাস্টম করে বানান। জানো, উনি কিন্তু বিদেশ থেকে পিএইচডি করেছেন। এমনকি বিসিএসও দিয়েছিলেন। ভাবতে পারো? প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছিলেন! তবে প্রিলিমিনারি দেওয়ার আগেই নাকি উনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিলেও ভাইভা দিতে পারেননি। আয়াশের জন্মের পর তিনি পুরোপুরি ওকেই ঘিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।”
মিরা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, “তাহলে তো উনি সব দিক থেকেই নিখুঁত একজন মানুষ।”
রোমানা ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি ছড়িয়ে বলল, “তা তো বটেই। তবে ওনাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই। (বাঁকা হেসে) ওনাকে সামলানোর কৌশল আমি ভালোই জানি। নইলে কি পাঁচটা বছর একটুও ঝামেলা ছাড়া সংসার চালাতে পারতাম!” বলে আত্মবিশ্বাসের ছাপ রেখে চুলে একটা ঝটকা দিল।
মিরা হেসে বলল, “আপনি তো খুব মিশুক ভাবী। আমিও যদি আপনার মতো হতে পারতাম!”
“আরেহ, সবার সাথে এতটা মিশুক নই আমি। তোমার প্রতি তো একটু অন্যরকম মায়া লেগেছে। সকালে গা গরম থাকায় আমাকে স্যুপ বানিয়ে দিয়ে আসলে, সেই কারণেই তোমার প্রতি আলাদা ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেছে।”
মিরার মুখে অমলিন হাসি ফুটল।
রোমানা আবার বলল, “তবে আবার বেশি খুশি হয়ে যেও না। আমার মনের রং পাল্টাতে কিন্তু দুই মিনিটও লাগে না।”
মিরা হাসলো। একটু পর মিরা কৌতূহলভরা কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা ভাবী, কাকাই কি বাবার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট?”
রোমানা ভাবলেশহীনভাবে বলল, “শোনো মিরা, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব বেশি উত্তর আশা করো না। আমাকে যতটুকু দেখানো হয়েছে, আমি ততটুকুই জানি। এই বাড়ির অনেক রহস্য আমার অজানা। এমনকি আমাদের শাশুড়ি মা সম্পর্কেও কিছু জানি না। কখনো জিজ্ঞেসও করিনি।”
মিরা বিস্ময়ে চোখ কুঁচকে বলল, “কেন ভাবী? আচ্ছা, আমাদের শাশুড়ি মা এখন কোথায় আছেন?”
“এসব কথা বরং তোমার জামাইকেই জিজ্ঞেস করো। আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। কী দরকার বলো?”
মিরা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বিড়বিড় করে বলল, “হ্যাঁ, কোনো একদিন নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবো। (হালকা আওয়াজ তুলে) আচ্ছা ভাবী, চলুন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, মাগরিবের নামাজ আদায় করে নেই।”
দুজনেই দোলনা থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
শহরের সন্ধ্যার পরিবেশ যদিও পরিচিত আবহ, তবুও ঢাকার বুকে আজকাল সন্ধ্যার পর অচেনা স্তব্ধতা নেমে আসে। রাতের পানে গড়িয়ে যাওয়া এই সময়টুকুতে শহরতলির কোলাহল বিস্মৃতির অন্ধকারে মিশে গেছে। এরই মধ্যে এক লালাভ মাধুর্যে মোড়া মেয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। তার পরনে শর্ট টপস, যার ওপর চাপানো একটি জ্যাকেট, আর পায়ের তলায় উঁচু হিল; সব কিছুতেই রক্তিম ছায়ার স্থায়ী প্রতিফলন। চুলের অগ্রভাগও লাল। বুকের মাঝখানে আঁকা এক ডাইনির বিকট মুখাবয়ব। মেয়েটির মুখমণ্ডল গাই ফক্স মাস্ক দিয়ে ঢাকা।
ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে আসে আরেকটি মেয়ে। একটি খালি বোতলকে খেলাচ্ছলে লাথি দিতে দিতে হেঁটে আসছে সে। তার কাঁধে ঝুলছে একটি স্কুলব্যাগ; যা সম্ভবত তার কোচিং থেকে ফেরা নির্দেশ করে। তার সাধারণ পোশাক আর উচ্ছল ভঙ্গি একেবারেই দিনশেষে শহরের নিত্য দৃশ্যের মতো। তবে মেয়েটি যে মগ্নতায় বোতলকে লাথি মারছে, তা থেমে যায় যখন লাল পোশাক পরিহিতা মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
পথরোধকারী মেয়েটির মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। তার স্থির চোখ আর ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বর গভীর অন্ধকারের মর্মে ধাক্কা দেয়।
“তুমি দেখতে কেমন?”
এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে কপাল ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে দ্বিতীয় মেয়েটি।
“সুন্দর, কেন?”
মাস্ক পরিহিতা রহস্যময়ী মেয়েটি সামান্য বিদ্রূপে ঠোঁট বাঁকিয়ে, বাচ্চা মেয়েটির পেছনের চুল মুঠো করে টেনে ধরে। বাচ্চাটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে, “আহ লাগছে! তুমি কি পাগল? আমার চুল ছাড়ো।”
কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত না করে, রহস্যময়ী মেয়েটি তাকে আলোয় টেনে নিয়ে আসে।
তার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিমশীতল কণ্ঠে বলে, “হ্যাঁ, তুমি সত্যিই সুন্দর।”
তার চোখে হিংস্রতার ভয়াল স্রোত ফুটে ওঠে। বাচ্চা মেয়েটি আতঙ্কিত হয়ে পালানোর চেষ্টা করলে, রহস্যময়ী মেয়েটি অপ্রত্যাশিত দ্রুততায় ব্যাগ থেকে তীর-ধনুক বের করে। মুহূর্তে তীরটি ছুটে গিয়ে বাচ্চাটির ঘাড়ে বিদ্ধ হয়।
বাচ্চা মেয়েটি ব্যথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্নার ধ্বনি বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়।
রহস্যময়ী মেয়েটি ধীরে ধীরে আহত বাচ্চাটির কাছে এগিয়ে আসে। বাচ্চা মেয়েটির থরথর করে কাঁপতে থাকা চেহারার দিকে হিংস্র নজরে তাকিয়ে সে মুঠো খুলে বের করে একটি ক্ষুদ্র, তীক্ষ্ণ ব্লে*ড।
তার চোখে নির্দয় জিঘাংসার ছাপ, আর সেই জিঘাংসা অনুসারেই সে বাচ্চাটির চেহারায় প্রথম পোচটি দেয়।
“আআআআ… আম্মুউউউ!”
বাচ্চাটি চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু অন্য মেয়েটি এই আর্তনাদে আরও আনন্দিত হয়। সে শীতল হেসে দ্বিতীয়, তৃতীয় পোচ দিতে থাকে। প্রতিটি আঘাতে বাচ্চাটির কোমল মুখে র*ক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ে, ভূমিতে আঁকতে থাকে নির্মম লালচিহ্ন। র*ক্তের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
এরপর অমানবিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটাতে, রহস্যময়ী মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে লেজার গান বের করে। ঠান্ডা নির্দয়তায় তা বাচ্চাটির মুখের উপর তাক করে ট্রিগারে চাপ দেয়। তীব্র আলোকরশ্মি মেয়েটির মুখে আঘাত হানে। সঙ্গে সঙ্গে তার কোমল ত্বক ঝলসে যেতে শুরু করে, কালচে পোড়া মাংসের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
বাচ্চাটি ছটফট করে, কাতরায়, কান্নায় তার কণ্ঠ ফেটে যায়। কিন্তু সেই নির্দয় মেয়েটির মুখে ফুটে ওঠে শীতল আনন্দের হাসি। এই নির্মমতার মধ্যেই তার পরম তৃপ্তি। তবুও তার দৃষ্টি বলছে; এখনও সে সম্পূর্ণ শান্ত নয়।
নির্দয় মেয়েটির চোখে জিঘাংসার আগুন আরেকবার দপ করে জ্বলে উঠল। এবার সে ঠান্ডা মাথায় ব্যাগ থেকে এসিডের একটি বোতল বের করল। নিষ্ঠুর অঙ্গভঙ্গিতে মেয়েটির মুখের উপর সেই তরল ঢেলে দিল।
“আআআহ্!”
বাচ্চা মেয়েটির আর্তনাদ বাতাসে ছুরির মতো কেটে গেল। তার ত্বক মুহূর্তেই জ্বলতে শুরু করল, মাংস পুড়ে গিয়ে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াল। তার মুখ, চোখ; সবকিছু বিকৃত হয়ে যেতে লাগল। ব্যথায় হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকা মেয়েটির আর্তনাদ চারপাশে প্রতিধ্বনিত হলেও কেউ তা শোনার মতো নেই।
এরপর শুরু হলো নির্মমতার চরম রূপ। মেয়েটির চুল মুঠো করে ধরে এক পোচে কেটে ফেলল। তীক্ষ্ণ ছু*রির ধারেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল তার মাথার সৌন্দর্য। তবুও তৃষ্ণা মেটেনি। এবার ফ্লেশ হুক বের করে মেয়েটির মাথার চা*মড়ায় আ*ঘাত করে টেনে তুলল। চাম*ড়া খুলে যাওয়ার সাথে সাথে তাজা র*ক্তের গরম স্রোত মাথা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
বাচ্চা মেয়েটি তখন যন্ত্রণায় আধমরা, নিস্তেজ দেহ কাঁপছে ব্যথা*র অতলে। অথচ সেই নির্মমতার পরও গাই ফক্স মাক্স পরিহিতা মেয়েটি ছিল নির্বিকার। তার ঠান্ডা, নিঃস্পৃহ হাতে ধীরে ধীরে একটি ব্রেসলেট পরিয়ে দিল শিশুটির কবজিতে। তারপর মাথা থেকে খুলে নেওয়া চামড়ার টুকরো হাতে নিয়ে সে ধীর পায়ে অন্ধকারে মিশে গেল।
পিছনে পড়ে রইল বাচ্চা মেয়েটির বিকৃত মুখ, মাথার উপর থেকে চামড়া উঠে যাওয়া কঙ্কালসার মস্তক, আর রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া শরীর। রাস্তাটি র*ক্তে ভিজে লাল হয়ে গেল। অতিরিক্ত র*ক্তক্ষরণে অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েটির নিথর দেহ মাটিতে পড়ে রইল।
কিছুক্ষণ পরেই দীর্ঘদেহী এক পুরুষের ছায়া এগিয়ে এল। কোনো অনুভূতি নেই তার মুখে, শুধু দায়িত্বপরায়ণতার মতো স্থিরতা। শিশুটির লা*শ কাঁধে তুলে নিয়ে গাড়ির ডিকিতে রাখল সে। এরপর একটি জলাধার থেকে বালতি ভরে এনে র*ক্তে ভেজা রাস্তাটিকে যত্নসহকারে ধুয়ে দিল।
কিন্তু এই মানুষটি কে? সে কি কেবল এক নির্বিকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নাকি এক নীরব শিকারি, যে হ*ত্যার দাগ মুছে দেয়?
মিরা নামাজ শেষ করে আয়াশের কক্ষে গেল। ছোট্ট আয়াশ নীল পাঞ্জাবি পরে নামাজ শেষে বিছানার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। মিরার চোখে এ দৃশ্য হাসির ঝিলিক তোলে। পাশে বসে মৃদু স্বরে ডেকে উঠল, “আয়াশ।”
মিরার কণ্ঠ আয়াশের কানে পৌঁছতেই সে চমকে উঠে লাফ দিয়ে বসে বলে উঠল, “ওএমজি, ফেইরী ভাবী!”
মিরা হেসে তার চুলে স্নেহের হাত বুলিয়ে বলল, “হুম। এবার বই নিয়ে আমার রুমে এসো। একটু পড়াশোনা করা যাক, কেমন?”
আয়াশ একগাল হেসে মাথা নাড়ল, “হুম হুম।”
কিছুক্ষণ পর আয়াশ মিরার কক্ষে হাজির। বই খুলে পড়ায় মন দিয়েছে। মিরার মুখে অনবরত উৎসাহ আর কোমল নির্দেশনা।
ঘড়ির কাঁটা নয়টা বেজে সতেরো মিনিট। কারান অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢুকল। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই চোখে পড়ল—তার স্ত্রী আয়াশকে পড়াতে ব্যস্ত। দৃশ্যটি দেখে কারানের ঠোঁটে আভাসিত হাসি ফুটে উঠল।
ফ্রেশ হয়ে ঘরে ফিরে পোশাক পরিবর্তন করতে করতে করান বলল, “আয়াশ, এখনো ঘুমাওনি?”
মিরা কোমল স্বরে উত্তর দিল, “না, আর কিছুক্ষণ। পড়া শেষ হলেই ঘুমিয়ে পড়বে। আয়াশ, এবার বলো ‘দ্য মাউন্ট এভারেস্ট’…”
আয়াশ গম্ভীর ভঙ্গিতে বইয়ের দিকে তাকিয়ে পড়া শুরু করল।
এটা দেখে কারান বিছানার একপাশে আলগোছে বসে মুচকি হেসে বলল, “এখন আর আয়াশকে পড়াতে হবে না, এবার আমাকে পড়াও।”
মিরা বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, “এসব মজা বন্ধ করে খেয়ে আসুন। পিউকে বলে রেখেছি, খাবার দিয়ে দিবে।”
কিন্তু কারান মিরার কথা এড়িয়ে আয়াশের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ছোট্ট গালে হাত রেখে আদর করে বলল, “আয়াশ সোনা, তুমি এখন ঘুমাতে যাও। তুমি তো ছোট, তোমার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু করতে চাই না।”
মিরা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলানোর চেষ্টা করেও সহিংস স্বরে বলল, “মাথা ঠিক আছে? বাচ্চাটার সামনে কি বলছেন এসব?”
“কি এমন বললাম? এখন যদি আমার বউকে আদর করতে ইচ্ছে হয়, সেটা কি বলবো না? আর আয়াশ, শোন বেটা, তুই বড় হলে তোর ভাবিকে নিয়ে সব প্রাকটিক্যালি শিখিয়ে দেব।”
মিরার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে মুহূর্তে আয়াশের দুই কান চেপে ধরল। তার মুখশ্রীতে একইসঙ্গে লজ্জা আর রাগের গভীর ছাপ ফুটে উঠল।
তবু নিজেকে সংযত করে মিরা শান্ত গলায় বলল, “আয়াশ, তুমি রুমে যাও। তোমার খাওয়া তো হয়ে গেছে, এখন ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট, বাচ্চা।”
আয়াশ মিষ্টি হেসে বলল, “ওকে, ফেইরী ভাবি।”
তার ছোট্ট পা দুটি টুপটাপ শব্দ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আয়াশ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মিরা হুড়মুড়িয়ে কারানের সামনে এসে দাঁড়াল।
ভ্রূ কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বলে উঠল, “আপনাকে ঠিক কি করলে শোধরানো যাবে বলুন তো? বাচ্চাটার সামনেও নিজের অসভ্য রূপটা দেখাতে হলো?”
কারান এই ঝড়ো রাগটাকে আরও উসকে দিতে, হেসে সম্মোহনী স্বরে বলল, “তুমি ভালোবাসলেই আমি শুধরে যাব, সোনা।”
এবার মিরার বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেল। সে সামনের দিকে পা বাড়াতেই কারান হঠাৎ হেঁচকা টানে মিরাকে নিজের কোলের মধ্যে বসিয়ে দিল। মিরার বিস্মিত চোখ কারানের মুখে স্থির হলো। কারান দুই হাত দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল, “স্বামী হিসেবে এই আবদারটুকু তো করতেই পারি, বেগম।”
মিরা রাগে ধমক দিয়ে বলল, “আপনাকে চোখ বন্ধ করে একটানা গালি দেওয়া উচিত, বুঝলেন?”
কারান মুখ টিপে হেসে আরো রসিকতার ছলে বলল, “ঐটা তুমি আমার সাথে পারবে না, মহারানি। গালিতে পিএইচডি করেছি, মেরি জান।”
মিরা ভ্রুকুটি করে বলল, “আচ্ছা, তাই নাকি? তাহলে আমাকেও কিছু শিখিয়ে দিন। মাঝেমধ্যে তো আপনাকে দিতে হয়।”
“ঠিক আছে, এই গালিগুলো তোমার শেখা খুব ইম্পরট্যান্ট, বুঝলে? শুরু করছি।”
“হ্যাঁ বলুন।”
কারান মিরার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “জান, পাখি, লক্ষ্মী, টিয়া, ময়না, কলিজা, হাবি, মাই লাভ, মাই হার্ট, সুইটহার্ট, বেবি, বাবু, বেবস, ডার্লিং, সোনা, লোহা, তামা… তুমি এর মধ্যে যেকোনো গালি আমাকে দিতে পারো। আমি একদমই মাইন্ড করব না।”
এগুলো শুনে মিরা স্তব্ধ হয়ে কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
এরপর মিরা শব্দ করে হেসে ঠোঁটে হাত চেপে বলল, “এগুলো গালি? হুম?”
“হ্যাঁ, শুধু আমার জন্য। অন্য কাউকে আবার এই গালি দিতে যেও না, বাবু।” এই বলে সে মিরার মাথার সাথে নিজের মাথা লাগিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিল।
তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে নেশালো স্বরে বলল, “দেখেছেন বেগম, আপনার স্বামী কতটা ভদ্র। আপনার এতটা কাছে থেকেও কিছু করছি না।”
“কেন, কি করতেন?”
“কি করতাম না তাই বলো! এতদিন যেটা হয়নি… আই মিন সে…”
মিরা তৎক্ষণাৎ তার কথা শেষ করতে না দিয়ে নেত্রপল্লব খানিক কুঞ্চিত করে বলল, “চুপ চুপ! বি’চ একটা।”
কারান মুহূর্তে মাথা সরিয়ে নিল। মুখে বিস্ময়ের ছাপ নিয়ে চোখে-মুখে কঠোর ভাব এনে বলল, “কী বললে তুমি?”
মিরার হাসি মিলিয়ে গেল। সে ঢোক গিলে ক্ষীণ গলায় বলল, “না মানে, বি… ঐ আরকি।”
কারান গম্ভীর গলায় কাটকাট স্বরে বলল, “নেক্সট টাইম তোমার মুখ থেকে এমন কোনো শব্দ যেন বের না হয়, বুঝেছো?”
মিরা নতশিরে শান্ত স্বরে বলল, “হুম।”
কারান খানিকক্ষণ মিরার পানে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মিরার বিনীত ভঙ্গিতে তার অভিমান ধীরে ধীরে গলে গেল। হালকা হেসে বলল, “বড় কোনো শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তোমার এই ভোলাভালা মুখ দেখে দয়া হয়ে গেল।”
মিরা মুখ নীচু করে হাসি চাপার চেষ্টা করল। কারান হেসে মধুরস্বরে বলল, “এখন আমার গালে চুমু খাও, এটাই তোমার ছোটখাটো একটা শাস্তি।”
মিরা বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখমুখ কুঁচকে বলল, “কিহ? আমি করব না! (মুখ বাঁকিয়ে) আসছে, মামাবাড়ির আবদার।”
“গালেই তো বলেছি, অন্য কোথাও তো বলিনি। আর তুমি যদি না করো…”
তার চোখ ধীরে ধীরে মিরার শরীর বেয়ে নেমে গেল, “তাহলে জানোই তো, আমি তোমার কোথায় কোথায় করব।”
মিরা হন্তদন্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা করব, করছি।”
তারপর দুরুদুরু বুকে কারানের গালে টুপ করে একটা চুমু এঁকে দিল।
কারান হেসে মিরাকে আরো কাছে টেনে নিল। মিরার শাড়ি ভেদ করে তার কোমরে হাত রাখল। অতঃপর তৃষ্ণার্তের মতো মিরার অধরে নিজের অধর চেপে ধরল। মিরার শরীর এক লহমায় শিহরণে কেঁপে উঠল। কারানের ঠোঁটের আগ্রাসনে মিরার ওষ্ঠ বারংবার করায়ত্ত হচ্ছে।
Tell me who I am part 12
তবে অকস্মাৎ মিরার মনে শূন্যতা ভর করলো। তার সমস্ত হাসি, সমস্ত উচ্ছ্বাস এক পলকেই কোথায় যেন বিলীন হয়ে গেল। তার চোখে ভাসছে অতীতের সেই দৃশ্য—কারান এমন গভীর চুম্বনে মত্ত ছিল অন্য এক নারীর ওষ্ঠাধরে। সে স্মৃতি, সে আঘাত কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়?
কারান চোখ বন্ধ রেখেই মিরার ঠোঁট ছেড়ে জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। তারপর মস্তক সামান্য নীচু করে মিরার ঘাড়ের কাছাকাছি চলে এল। তার উষ্ণ নিশ্বাস মিরার ঘাড়ে আছড়ে পরতে থাকে।
সে মিরার ঘাড়ে মুখ ডুবাতে উদ্যত হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে মিরা অকুতোভয় চাহনিতে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল, “আপনাকে কি আমি থাপ্পড় মারতে পারি?”