Tell me who I am part 14

Tell me who I am part 14
আয়সা ইসলাম মনি

কথাটি কারানের কর্নকূহরে পৌঁছাতেই তার মন স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখ খুলে মিরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কি?”
কিন্তু মিরার মুখাবয়বে স্পষ্ট কঠোরতা আর রাগের মিশেল। তার চোখ দুটি যেন ক্ষিপ্র বাঘিনী, সশব্দে প্রতিশোধের বন্যায় বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। চক্ষু দুটি এত ধারালো হয়ে উঠেছে যে মনে হয়, মুহূর্তে কারানকে ছিন্নভিন্ন করে ছাই করে ফেলবে। কারান মিরার এত তীব্র রাগ দেখে হতবাক হয়ে গেল। এমন একটি রূপ যেখানে দীর্ঘদিনের জমে থাকা সব অভিমান, ঘৃণা, ক্ষোভ একসাথে উদ্‌গিরিত হয়েছে। তার চোখের সামনে দৃশ্যমান এই উন্মত্ততার রূপ দেখে কারানের গা ছমছম করে উঠল। তার শরীরে শীতল ঘাম বয়ে যেতে শুরু করেছে।
কারান চুলের ফাঁকে আঙুল চালাতে চালাতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে, শান্ত গলায় বলল, “হুম, মারোহহ।”
মিরা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল, “কেন? কারণ জানতে চাইবেন না?”

কারান ঢোক গিলে কিছুটা সংকুচিত হয়ে বলল, “না।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকে বলব। আপনার তো জানা উচিত, তাই না?”
এভাবে কথাগুলি বলে মিরা একাধিক বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল।
এরপর কারানের সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, “একটা কাজ করুন। চেয়ারে বসুন, কারণ আপনাকে এখন দীর্ঘক্ষণ আমার কথাগুলি শুনতে হবে, আর দাঁড়িয়ে থাকলে হয়ত তা সহ্য করতে পারবেন না।”
কারান দৃষ্টি মেঝের দিকে নামিয়ে মৃদু গলায় বলল, “তুমি বলো।”
মিরা মুখচ্ছবি কুঁচকে কঠোরভাবে প্রশ্ন করল, “আপনার কি একটুও অনুশোচনা হয় না? মনে হয় না, আপনার অনেক বড় শাস্তি প্রাপ্য, হ্যাঁ?”
কারান অসহায়ভাবে মিরার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলল, “শাস্তি তো পাচ্ছি, মিরা। তুমি আমার স্ত্রী, অথচ এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে নিজস্বভাবে আমার করে নিতে পারিনি। নিজেকে বারবার আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেও। এটা কি কম শাস্তি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
“অবশ্য কীভাবে মনে হবে? আমি তো আপনাকে তেমন কিছু অনুভব করাইনি, তাই না? (আড়াল হাসিতে) একটা কাজ করি চলুন, আমি একদম প্রথম থেকে শুরু করি। কেমন? (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) শুরুটা ছিল গায়ে কফি ফেলা দিয়ে। তারপর আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে কাজের মধ্যে দিয়ে কষ্টে ভরিয়ে রাখলেন। যদিও কাজ করতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু সেই কাজগুলোর মধ্যে তো শান্তি ছিল না, ছিল শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণা। ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি, কিন্তু তারপরও আপনার হুকুম মেনে চলতাম। (থেমে) আচ্ছা, তারপর আসি। তারপর একের পর এক আমার অপছন্দের কাজ করতে থাকলেন। যেমন: ওয়াইন খাওয়া, সিগারেট টানা, গভীর রাতে বাড়ি ফিরা, এমনকি আমি জ্বরে কাঁপছিলাম তবুও আপনি আমাকে হুকুম জারি করেছেন। সব ঠিক ছিল, কিন্তু… (খানিক থেমে) কিন্তু তারপর আপনি আপনার স্ত্রীর গায়ে হাত পর্যন্ত তুললেন। ছিঃ, কতটা নীচ হলে, এরকম ঘৃণ্য কাজ করতে পারে একজন মানুষ। তাও ইসলামের নিষিদ্ধ কাজ! জান্নাতে কি আপনার কোনো স্থান হবে?”

কারান নিস্তব্ধ হয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে-মুখে একরাশ বিষণ্নতা স্পষ্ট, আর মিরার প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
মিরা এবার খানিকটা শান্ত ও বিষণ্ন গলায় বলে উঠলো,
“আর এগুলো সব আমি সহ্য করেছি।”
এরপর ঠোঁটে তিক্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমার প্রচুর ধৈর্য, জানেন। ছোটবেলা থেকেই তো ধৈর্যের পাঠ নিয়ে বড় হয়েছি। মানুষের কত কথা শুনেছি, কত সহ্য করেছি। সবাই বলত, আমি দেখতে খারাপ, তাই মুখ ঢেকে রাখি। নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কোনো দোষ আছে; নাহলে কেন মেয়েদের থেকেও নিজেকে আড়ালে রাখি? ইউনিভার্সিটিতে উঠে এটাও শুনলাম, আমার চরিত্রে সমস্যা। তাই মুখ লুকিয়ে থাকি।”
কথাগুলো শেষ করেই সে এক গভীর নিশ্বাস ফেলল।
অথচ শেষ কথাগুলো কারানের কানে পৌঁছাতেই তার অসহায়তা প্রবল ক্রোধে রূপ নিল। চোখে জ্বলে উঠল বজ্রের তেজ, রক্তে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল।
কারান রোষে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কে বলেছে?”

“তা জেনে আপনি কি করবেন? আর আমার কথায় বা হাত দিবেন না। আমি এখনো কথা শেষ করিনি।”
এরপর মিরা ধীর পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কণ্ঠে গভীর আবেগ আর চাপা কান্নার সুর মিশিয়ে বলল, “আপনি কাল আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা? আজ উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। এরপর থেকে আর কখনোই সেই প্রশ্ন করার প্রয়োজন হবে না। হ্যাঁ, আমি আপনাকে ভালোবাসতাম।”
কথাগুলো কারানের হৃদয়ে বজ্রপাতের মতো আঘাত করল। ছলছল চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে রইল সে। কারানের মনের ভেতর একটাই প্রশ্ন ঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘ভালোবাসতে? সত্যিই ভালোবাসতে, মিরা?’
মিরার কণ্ঠে ফুটে ওঠা প্রতিটি শব্দ কারানের হৃদয়ের গভীরে অভাবনীয় শূন্যতা তৈরি করল। তার দৃষ্টি মিরার দিকে নিবদ্ধ রইল। অথচ তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। কিন্তু মনে হলো, মিরার সঙ্গে এই পুরো পৃথিবীটাই তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

মিরা এবার গভীর ভারী কণ্ঠে বলল, “আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। অনেক বেশি, যাকে বলে ইনফিনিটি লাভ। বিয়ের আগেই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অথচ আপনার এত অন্যায়, এত অবহেলা সত্ত্বেও কখনো আপনাকে ঘৃণা করতে পারিনি। শুধু চুপচাপ অপেক্ষা করেছিলাম; কবে আপনি আমাকে ভালোবাসবেন। ছয় মাস ধরে সেই ধৈর্যের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু যেদিন…”
মিরার কণ্ঠটা থেমে গেল, চোখে শূন্য দৃষ্টি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে উঠল, “যেদিন রাশাকে ঘরে আনলেন, ওকে জড়িয়ে ধরলেন, চুম্বন করলেন… আর বাকি যা করার তা তো করলেনই। সেদিন থেকেই আমার সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। অথচ জানেন? সেদিন আমি কোনো রাগ দেখাতে পারিনি, রাগ আসেইনি।”

মিরা হঠাৎ কারানের কাছে এসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “জানেন কেন? কারণ সেদিন আমি ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলাম। আমার পুরো অস্তিত্বটা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আমার শরীরে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ আমার বুকের ভেতর বারবার তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে আঘাত করছিল। ভেতরে ভেতরে আমি দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। গোঙাচ্ছিলাম, আর আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।”
মিরা কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে আরো দৃঢ় স্বরে বলল, “তারপর? তারপর আরো মেয়েদের নিয়ে এলেন। রাশার পরের মেয়েগুলোকে দেখে আমি একটাই কথা বলেছিলাম, ‘কারান, এমন করবেন না। ধ্বংস হয়ে যাবেন।’ কিন্তু আপনি তো তখন আমাকে দেখতেই পেতেন না। আমি যেন এক অদৃশ্য প্রাচীরের আড়ালে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার কোনো কথাই আপনার কানে পৌঁছায়নি। তারপর থেকে আমি আর আপনাকে থামানোর চেষ্টা করিনি। শুধু প্রতিদিন পাহাড়সম ঘৃণা নিয়ে দিন কাটিয়েছি। সয়ে গিয়েছিলাম। আপনার প্রতি কোনো অনুভূতিই আর বাকি ছিল না। আপনার রোজকার রুটিন ছিল; অফিস, মদ, মেয়ে আর ঘরে ফিরে ঘুম। ঘরের স্ত্রী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে; আপনার তাতে কিছুই এসে যেত না।”

মিরা হেসে উঠল। সেই হাসিতে বিষাদ আর অবহেলা মিশে আছে।
“আপনি তো এতোটাই অচেতন ছিলেন যে আমি ঘরে আছি কিনা, সেটাই জানতেন না।”
মিরা গভীর শ্বাস টেনে একটুখানি থামল। তারপর চোখ তুলে কারানের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, “আপনি তো সবসময় ডিভোর্স চাইতেন, তাই না?”
কারান কোনো উত্তর দিল না। কেবল চুপচাপ তাকিয়ে রইল মিরার দিকে। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, যেন বুক থেকে নিশ্বাসটুকুও বেরোতে পারছে না। তার অতীতের অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে।
শুধু মনের ভেতর প্রশ্ন ঘুরছে; মিরা এসব জানল কীভাবে? আমি তো কিছুই বলিনি… সে কি আমার মনের কথা পড়তে পারে?

কারানের চোখের সামনে তার নিজের অপরাধের আয়না ফুটে উঠল। প্রতিটি পাপের ভার তাকে চেপে ধরছে, আর মিরার কণ্ঠস্বর সেই অপরাধবোধকে আরও গভীরে প্রোথিত করে দিচ্ছে।
মিরা শ্বাসরুদ্ধকর আওয়াজে বলল, “চলুন, এ প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর দিয়ে দিই। ইসলামের সর্বোচ্চ নিকৃষ্ট এবং ঘৃণিত কাজ হলো স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ। কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘তোমরা বিয়ে করো, কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেননা তালাক দিলে তার দরুন আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।’ (আকামুল কুরআন, ৩৯ খ-, পৃষ্ঠা : ১৩৩) আপনি কি জানেন, এই কথাটির কি গভীর অর্থ? আল্লাহর সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ, এর মানে কি বুঝেন? (ক্রূর হাস্যরাশিসহ) অবশ্য, আপনি কীভাবে বুঝবেন, আপনার মধ্যে সেই জ্ঞান থাকলে তো। তার ওপর মায়ের নিষেধাজ্ঞা। উফফ!”

মিরার প্রতিটি বাক্য তীরের মতো বিঁধছে কারানের অন্তরজগতে। সে এক পাপী হৃদয়ের মতো মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে গভীর কাতরতা। একে একে তার সমস্ত আত্মবিশ্বাস বাষ্প হয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
এক পলকের বিরতির পর কণ্ঠে চাপা ক্ষোভ আর চোখে অবিশ্বাসের তীব্রতা নিয়ে মিরা ফের বলল, “এরপর আসে আপনার হঠাৎ পরিবর্তন, আকস্মিক প্রেম। কীভাবে সম্ভব বলুন তো? একটা স্বপ্নের মোহ কি এতো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে? আগে যা বলেছিলেন, আমি নির্বোধের মতো মেনে নিয়েছিলাম। এখন বলুন, কেন এই পরিবর্তন? কেন কারান?”

কিন্তু কারান চুপ রইল। মিরা এবার রাগে ফেটে পড়ে হুংকার করল, “কেন বলুন?”
তবুও কারান নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সত্য প্রকাশের পথ তার জন্য নিষিদ্ধ। সে জানে, মিরা যদি একবার উপলব্ধি করে যে তার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে কারান তাকে ভালোবেসেছে, তবে আজকে মিরার এই ক্রোধ বিধ্বংসী আগ্নেয়গিরির মতো হয়ে উঠবে। তারপর রইলো কারানকে ভালোবাসা, এ কথা সারাজীবনের জন্য তাকে ভুলতে হবে। তাই নিজের আবেগের জ্বালাকে চেপে ধরে, নিজের হৃদয়ের সমস্ত মুগ্ধতা আর ভালোবাসাকে গলায় পিষে ফেলে।
মিরা ক্ষুব্ধভাবে চিৎকার করে উঠল, “কথা বলছেন না কেন, হুম?”

তারপর তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে আবার বলল, “অবশ্য, কোন মুখে কথা বলবেন! আপনার তো অনুতাপে, লজ্জায় মরে যাওয়ার কথা। কিন্তু আপনি তো মানুষ হিসেবে গণ্য হন না, আপনার আবার কীসের অনুশোচনা! আর একটা সত্যি কথা কি জানেন, আপনি যে শুধু আমার চেহারা দেখতে চাননি এমন নয়; আমিও কখনো চাইনি আপনি আমার চেহারা দেখুন।”
এই বলেই সে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কারান ঢোক গিলে মিরার চোখের দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকাল। সে দেখল, মিরার চোখে কোনো ভীতি নেই, কোনো আবেগ নেই; শুধু ঘৃণা আর ক্রোধের অগ্নিতে ভরা দুটি চক্ষু।

কারান সেই এক ন্যানোসেকেন্ডের বেশি তাকানোর সাহস পেল না। তার সমস্ত সাহস, সমস্ত রাগ, সমস্ত হিংস্রতা, অহংকারের পৌরুষ সবকিছুই যেন ঐ অগ্নিবাণের ন্যায় আঁখিদ্বয়ের কাছে জীবানুর মতো ক্ষুদ্র।
মিরার গলা যেন একটি বিষাক্ত সাপের মত ফোঁসফোঁস করে উঠছে, “আপনার প্রেম দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, বুঝলেন? আমার পুরো শরীরে অসহ্য অস্থিরতা বিরাজ করে। আপনি তো আসলে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নন। আপনাকে শুধু ঘৃণা করা যায়, স্রেফ ঘৃণা। (থেমে) একটা কথা বলুন তো, টেক্সাসে কয়টা মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছেন? (ক্রূর হেসে) আপনি তো আবার প্রতি মেয়ের সাথে এক রাতের বেশি কাটান না। কোথায় কোথায় টাচ করেছেন ওদের? সম্পূর্ণ শরীরে? হুম? আবার কাউকে আপনার বাচ্চার মা তো বানিয়ে দিয়ে আসেননি? নাকি…(চিৎকার করে) আরো কিছু বলবো?”

কারান এখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মিরার অগ্নি-মুখের কথাগুলো তার মনকে ছিঁড়ে ফেলছে। কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে সে? কী ভাবে এমন কথাগুলো তার মুখ থেকে বের হচ্ছে?
তাই কারান গভীর এক নিশ্বাস ফেলে শীতল কণ্ঠে বলল, “সিমার ডাউন, মিরা।”
শব্দগুলো তুষারের মতো শীতল, তবে মিরার প্রগাঢ় উত্তেজনায় তার কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং যেন আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। তাই মিরা পাশের ছোট, ছিমছাম টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারে।
কারান কষ্টের মাঝে স্থির দৃষ্টি দিয়ে সেই ফুলদানির ভগ্নাবশেষে তাকিয়ে রইলো। তার প্রিয় ফুলদানিটি ভেঙে চুরমার হয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু সে জানে, মিরার প্রতি তার গভীর ভালোবাসার সামনে এই ক্ষতি তুচ্ছ।
মিরা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “ঠান্ডা হও? হ্যাঁ? ঠান্ডা হবো আমি?”

কারান ধীরে ধীরে মিরার কাছে গিয়ে, শান্ত করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াল।
কিন্তু মিরা তার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল, “একদম ছোঁবেন না আমাকে। আপনার ঐ নোংরা হাত পরেরবার থেকে আমার গায়ে লাগাবেন না।”
থেমে আবার বলল, “আপনাকে মাঝে মাঝে খুব মারতে ইচ্ছে করতো আমার। ইনফ্যাক্ট, এখনো ইচ্ছে করছে। আপনাকে থাপ্পড় দিতে দিতে আপনার গাল দুটো লাল করে ফেলি।”
কারান কিঞ্চিৎ মুখ খুলে, অবাক দৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটি কি আসলেই মিরা? এই মেয়ে কীভাবে এত অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো? নাকি এক মুহূর্তের মধ্যে কেউ মিরাকে পাল্টে দিয়ে গেল? এটা কি বাস্তব, নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন? এতো বড় কথা মিরা কীভাবে বললো?
মিরার রাগ আর কোনো স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। তার চোখে যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে, তা কারানের সমস্ত অস্তিত্বকে রক্তকম্পনে ভাসিয়ে দিয়েছে।

মিরা আড় হেসে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “আপনার ভাগ্য ভালো যে এখনো আমি সম্মানের সহিত আপনার সাথে কথা বলছি। কথায় আছে, স্বামীর স্থান সবার উপরে। সে-কথাকে আমি কীভাবে মিথ্যে প্রমাণ করতে পারি। অর্থাৎ..”
একটু থেমে, “আমার হাত-পা অদৃশ্য জালে বাঁধা ছিল।”
এটা বলার পর সে স্নিগ্ধ হাসল। তবে সেই হাসি কেমন যেন ক্ষতবিক্ষত।
“ভালো তো আমি আপনাকে কম বাসিনি, সত্যিই অনেক ভালোবাসতাম কারান। ধরাছোঁয়ার বাইরে, গভীর ভালোবাসা ছিল। কিন্তু আমার কাছে তখন শুধু একটাই অস্ত্র ছিল, চোখের পানি। প্রতিটা মুহূর্তে আপনি আমাকে যে যন্ত্রণায় ফেলেছিলেন, আপনার উপর রেগে কাঁদতাম আমি। আবার প্রতিদিন সকালবেলা, কোরআন তিলাওয়াত করে রাগগুলো ধুয়ে ফেলতাম। (থেমে) কিন্তু এখন আপনাকে ভালোবাসার তো প্রশ্নই আসে না। বরং আমি আপনাকে কীভাবে ক্ষমা করবো, সেটা বলুন। মানে… আপনি তো আমাকে লাথি অবধি মেরেছেন। বুঝেন, কতটা নীচু মানসিকতা আপনার? আপনাকে যদি জন্তু বা জানোয়ারও বলা হয়, সেটাও কম বলা হবে। ধৈর্য..ধৈর্য.. ধৈর্য…”
তার বুক চিড়ে গভীর ব্যথায় নিংড়ে এক নিশ্বাস বের হলো।

মিরা এবার চোখে জল এনে শোকার্ত কণ্ঠে বলে, “রাশাকে যেদিন নিয়ে এলেন, ঐদিন যদি আপনি আমাকে কুপিয়ে মারতেন, তাও আমার ভিতরে রাগের উদয় হতো না। শুধু কান্নাই আসতো। আমার হৃদয়ে যে… ”
একটি ঢোক গিলে সুর স্থির করে, “মানে, আমি কীভাবে বোঝাতে পারবো আপনাকে, যে আমি কতটা তীব্র অসহ্যকর কষ্ট অনুভব করেছিলাম। জখম হয়ে, ভেতরটা পুরে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের স্বামীর সাথে অন্য এক নারী এক রুমে… আমি আসলে মুখের ভাষা দিয়ে কোনোভাবে তা ব্যাখ্যা করতে পারবো না।”
মিরার বুক চেপে অব্যক্ত কান্না চেপে বসেছে কিন্তু সে তার চোখে সেই কান্না দৃশ্যমান হতে দিল না। কারান অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তার হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে মিরার প্রতিটি অনুভূতি ধারণ করতে চেয়েও। কী অদ্ভুত ব্যাপার! যার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেও হাসি-খুনশুটিতে মেতে ছিল, একসঙ্গে ভালোবাসার সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল। মিরার ঠোঁট প্রথমবার নির্দ্বিধায় আঁকড়ে ধরেছিল। আর মনে মনে ভেবেছিল, ‘এখন তো সবকিছুই ঠিক হয়ে গেছে, এখন শুধু মিরাকে নিজের করে নেওয়ার সময়।’

কিন্তু কেন, কেন এভাবে সবকিছু শেষ হয়ে গেল? ভালোবাসা এতটা হতাশ করে কেন? কারানের হৃদয় এক গভীর খাঁজে পড়ে গেল, সেই হাহাকার ও হতাশার মধ্যে দিয়ে চুপ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
এতক্ষণের সমস্ত রাগ ঝেড়ে দিয়ে মিরা খানিকটা নিজের ভেতরের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করে। তারপর নরম গলায় বলল, “এই কয়েকদিন যা ঘটেছে, সবকিছু ভুলে যান। কিছু সময়ের জন্য আমি যেন হিপনোটাইজড ছিলাম। আপনার মিথ্যে প্রেমটা অনুভব করেছিলাম খুব। কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনার পাপের কথাও তো আপনাকে মনে করানো উচিত।”

একটুখানি থেমে শীতল কণ্ঠে পুনরায় বলল, “আমাদের সম্পর্কটা আর স্বামী-স্ত্রীর মতো নেই, কারান। আফসোস, যদি হতো…”
বলেই এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়ালে ঝুলানো কয়েকটি পুরোনো প্রতিকৃতি নামিয়ে আনমনে সেগুলো মুছতে শুরু করলো।
প্রতিকৃতিগুলো এমনিতেই ঝলমলে ছিল, তবে এটা মিরার অন্তরের প্রশান্তি ফিরে পাওয়ার উপায়। কে.ছি হাউজে থাকলে এতক্ষণে মিরা হয়ত দোতলা থেকে নিচে নেমে চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শ্বাস টানত, যেন কিছুক্ষণের জন্য সব কিছু ভুলে যায়। কিন্তু এখানে সে সুযোগও হারিয়ে ফেলেছে। সাউন্ড প্রুফ কক্ষ, তাই বাইরে কারো কানে একটুও আওয়াজ পৌঁছায় না।

কারান পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে আলমারির সাথে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই কয়দিনের গড়ে ওঠা ভালোবাসার অস্থির প্রতিচ্ছবি বাষ্পের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বুকের ভেতর যেখানে একসময় আগুনের শিখা জ্বলছিল, সে আগুনও ধীরে ধীরে নিভে গেছে। প্রতিটি অব্যক্ত ব্যথার চাপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সে। তার শ্বাস প্রশ্বাসও আটকে যাচ্ছে। তার শরীর অসাড় হয়ে গেছে।
দুটি মানুষ একই ঘরে, একই কক্ষে উপস্থিত। অথচ তাদের মধ্যে কোনো শব্দ বা কোনো বাক্য নেই। কারানের মনে এক একটি সেকেন্ড মনে হচ্ছে, এক যুগের সমান। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, কারান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মুখ খুলল।

Tell me who I am part 13

“তোমার হাত-পা তো বেরি দিয়ে বাঁধা, কিন্তু আমার তো বাঁধা না।”
মিরা এক পলক চোখ বন্ধ করে আবার চোখ খুলে, কিন্তু টু শব্দটি করে না। অতএব, মিরা মনে মনে অবাক হলো। মনে অজানা প্রশ্নও জাগে, এতকিছু বলার পরও কেউ কথা বলতে পারে? তার মানে মানুষটা কতটা বেহায়া!
কিন্তু কারান তার কথার তাল ঠিক রেখে আবার বলল,
“তুমি স্বামীকে শাস্তি দিতে পারবে না, ইসলাম তো নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমি তো নিজেকে শাস্তি দিতেই পারি।”

Tell me who I am part 15