Tell me who I am part 15
আয়সা ইসলাম মনি
মিরা থমকে দাঁড়িয়ে কারানের দিকে তাকালো, তার চোখে গভীর বিস্ময়ের রেখা। হঠাৎ করেই কারান কোমরের বেল্ট খুলে নিজের শরীরে অমানবিক আঘাত হানতে শুরু করলো। এ দৃশ্য দেখে মিরার শ্বাস আটকে এলো। এ কেমন বিভীষিকাময় কাণ্ড! এমন অমানবিকতার প্রকাশ কেউ নিজের ওপর কেমন করে ঘটায়?
কারান নির্বিকার দৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকিয়ে নিজের সুঠাম দেহে একের পর এক সপাট আঘাত করে চলল। প্রতিটি আঘাতে তার পেশির কাঁপন স্পষ্ট হলেও মুখের রেখায় কোনো অনুভূতির ছাপ নেই। মিরার হৃদয় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ঝড়ের বেগে ছুটে গেল কারানের দিকে।
“কারান, থামুন! আপনি কি উন্মাদ হয়ে গেছেন? হে আল্লাহ! থামুন বলছি!”
মিরার কণ্ঠস্বর আতঙ্কে ক্ষত-বিক্ষত হলো। কিন্তু কারান যেন অনন্ত শূন্যতায় হারিয়ে গেছে। মিরার কথা তার কর্ণগোচর হলো না। তার চামড়ার নিচে লুকিয়ে থাকা ব্যথাগুলো উদ্দাম বন্যার মতো বেল্টের প্রতিটি আঘাতে বাইরে আসছে। প্রহারের প্রতিধ্বনি চারপাশের নিস্তব্ধতাকেও ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।
মিরা একসময় কারানের হাত ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। কারানের অন্য হাতের এক ঝটকায় মিরা দূরে সরে গেল। কিন্তু কারানের চোখ স্থির। মনে হয় না সে কোনো অনুভূতির দাস। মিরার চোখে একটাই প্রশ্ন, ‘এ কেমন প্রলয়? নিজের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা কার সাধ্য?’
কারানের এই অমানুষিক দৃশ্যপট কোনো শত্রুর চোখেও হয়ত সহ্য হতো না। এত তীব্র আঘাতের শব্দ ভূমিকম্পের মতো মস্তিষ্ককে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কারানের এই প্রহার কি মিরার জন্য? নাকি নিজের অপরাধবোধের নিষ্ঠুর শাস্তি? এগারো মাসের মিরার কষ্টের ভার কি সে নিজের শরীরে ধারণ করার চেষ্টা করছে?
মিরার ভেতরের স্নায়ু বিদীর্ণ হলো। কারান মানুষ না অমানুষ, তাতে তার কিছু যায় আসে না। কারান তার, একান্ত তার। কিন্তু এই আঘাতের তাণ্ডব দেখে মিরার হৃদয়ের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে গেল।
মিরা ক্রমাগত চেঁচিয়ে চলেছে, তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব আর আকুতি স্পষ্ট, “থামুন বলছি! কারান, প্লিজ! একবার আমার কথা শুনুন। কারান, শুনুন তো! থামুন না!”
তার কণ্ঠ বাতাসেও ঢেউ তোলে। অথচ সেই ঢেউ এসে কারানের পাষাণ দেহে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়।
কারান থামলো না। অদ্ভুত ধ্যানে নিজের ওপর মারের ভার ঝুলিয়ে রেখেছে, এই আঘাতের মাধ্যমে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে। তার গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ কেবল বোঝায় শরীর ভাঙছে, কিন্তু মুখের অবিচল শান্তিতে সেই যন্ত্রণার ছায়াটুকুও নেই।
মিরার কণ্ঠ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। কারানকে এভাবে দেখার যন্ত্রণায় তার সমস্ত সত্তা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
শেষমেষ মিরা কারানের হাত শক্ত করে ধরে, অসহায় স্বরে বলে ওঠে, “প্লিজ, কারান! আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আল্লাহর দোহাই, থেমে যান। আমার কথা শুনুন। থামুন, প্লিজ।”
তার চিৎকার বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। কিন্তু কারানের অনমনীয় দেহ আর অপরিসীম কষ্টের দেয়াল সেই শব্দগুলোকে আটকে রাখে, মিরার আকুতি সেখানে পৌঁছায় না।
“কারান, একটা বার আমার কথা শুনুন। আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? কেন করছেন? থেমে যান, দয়া করে থামুন। আল্লাহ! থামুন বলছি। কারান।”
মিরা বাক্যের পর বাক্য ছুঁড়ে যেতে থাকলো। কিন্তু তার সব চেষ্টা বৃথা। বারবার কারানের হাত চেপে ধরে তাকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে, তবু পারেনি। কীভাবে পারবে? শক্তিশালী বলিষ্ঠ এক পুরুষের সামনে একটি নারীর অসহায়ত্ব যেন মহাসাগরের কাছে নদীর ক্ষীণ ধারা। বলিষ্ঠ নারী হোক বা দুর্বল, কারানের এই শক্তির স্রোত ঠেকানোর সাহস কারো নেই।
অবশেষে ক্লান্তি এসে মিরার শরীরকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখের কোণ ভিজে ওঠে, কিন্তু অশ্রু বাইরে বের হতে দেয় না। নিজের দুর্বলতা দেখানোর সময় নয়; এই মুহূর্তে নিজেকে ভেঙে পড়তে দেওয়া মানে আরেকবার হেরে যাওয়া। ভেতরে ভেতরে কারানের এই আত্মবিধ্বংসী মারের প্রতিধ্বনি তার হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। তবু সে দৃঢ় থাকে, শক্ত থাকে। কারণ জানে, যদি একবার তার মনোবল ভেঙে পড়ে, তাহলে সব হারিয়ে যাবে।
মিরা একের পর এক রুদ্ধ নিশ্বাস ছেড়ে ফিসফিস করে কারানের নাম ধরে ডাকতে থাকে। তার কণ্ঠস্বর আকুতি, ক্লান্তি, আর নিরুপায় ভালোবাসায় ভারী হয়ে ওঠে।
“কারাআআআন… থামুন… প্লিজ। কারান, থামো। থামো, কারান।”
এই ‘থামো’ শব্দটি বাতাসে ভেসে কারানের কানে গিয়ে ধাক্কা খায়। তার শরীর আচমকা থমকে যায়। ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ শীতল হাসি খেলে ওঠে। অর্থাৎ সেই শব্দটি তাকে বিদ্ধ করেছে। এবার সত্যিই কারান নিজেকে থামিয়ে দেয়। তার হাত নেমে আসে। সে মিরার দিকে বাজপাখির দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। সেই চোখের অভিব্যক্তি বলে, ‘থামো’ শুধু তার শরীর নয়, তার পুরো অস্তিত্বকে থামিয়ে দিয়েছে।
মিরার শরীর ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তার হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি ধুকপুক স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে একরাশ শূন্যতা আর হৃদয়ে গভীর ব্যথা নিয়ে। কারানের এই শীতল দৃষ্টি তার সমস্ত সত্তাকে বিদ্ধ করে। কিন্তু সে জানে, এখন তার নিজেকে ভাঙতে দেওয়া যাবে না। তার প্রতি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মিরা এক হাতে কারানের গলা পেঁচিয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। মিরার অগ্নিসংবলিত চক্ষু বিদীর্ণ করতে চাইলো কারানের আত্মার গভীরতম স্তর।
বিক্ষোভে কাঁপতে থাকা কণ্ঠে ঝরে পড়লো তীক্ষ্ণ বাণী, “আপনার আসলে সমস্যাটা কী? মাথার সব তার ছিঁড়ে গেছে নাকি?”
কারান হেসে মিরার দিকে তাকালো। তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। মিরার রাগে লাল হয়ে ওঠা মুখমণ্ডল, আর তিরস্কারের ভাষা তার কাছে অন্য রকমের আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। মিরার জ্বলন্ত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কারান সম্মোহনী অভিব্যক্তি নিয়ে আপনমনে বলে উঠলো, “আমি কিন্তু এর মধ্যে তোমাকে তেমন কোনো স্পর্শ করিনি, বেগম। কিন্তু তুমি হাজারবার আমাকে স্পর্শ করেছো। ইভেন, এখন তো তুমি আমার নেক গ্রাব করে তোমার কাছে টেনে নিয়েছো। হোয়াট আ মোমেন্ট বেইব! উফফ!”
কারানের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা, আর চোখের গভীরতর দৃষ্টি মিরার ক্ষোভকে আরো দাহ করে তুললো।
মিরা তেতে উঠে বলে, “ষাঁড়ের মতো এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? নিজেকে এভাবে কেউ আঘাত করে? পশুর ন্যায় নিজেকে মেরে কী প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? আপনি আসলেই একজন অস্বাভাবিক, পুরোপুরি এ্যাবনরমাল।”
মিরার দেহ ভাষায় প্রবল ক্রোধ, তবু তার হৃদয়ের গহীনে অসহায়তা লুকিয়ে থাকে, যা সে প্রকাশ করতে চায় না।
কারান ঢোক গিলে আহত দৃষ্টিতে মিরার দিকে চেয়ে বলল,
“তোমার এগারো মাসের কষ্টের তুলনায় তো এটা কিছুই নয়।”
“ড্রামা বন্ধ করুন,” বলে কারানের হাত থেকে বেল্টটি দ্রুত ছোঁ মেরে নিল মিরা।
কারান চুপচাপ চিরন্তন কষ্টে মাথা নীচু করে ছাদে চলে গেল।
মিরা চোয়াল শক্ত করে বেল্টটি আঁকড়ে ধরে, নিজের রাগকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তার চোখের কোনে এক ফোঁটা পানি জমে, কিন্তু সেই পানির ফোটা হাত দিয়ে আঙ্গুলের ডগায় এনে টোকা দিয়ে ফেলে দিল।
মিরা ফুঁসতে ফুঁসতে শ্বাসের সঙ্গে ধারালোভাবে বলল,
“আপনার জন্য আর এক ফোঁটা পানির কণাও খরচ হতে দেব না, কারান সাহেব। এই রূপটা তো অনেক আগেই আপনাকে দেখানো উচিত ছিল। কিন্তু প্রেমের মোহে ডুবে, নিজের অতীত ভুলতেই বসেছিলাম। আর নয়, এবার আপনাকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে। না, ঠিক তেমনভাবে নয়, যেমনভাবে আপনি আমাকে আঘাত করেছেন। আমি তো আর আপনার মতো নিষ্ঠুর নই, যে আপনাকে শারীরিকভাবে আঘাত করব। আপনি আমার স্বামী, তাই আমি আপনাকে আপনার মতো অপমানিত বা অপদস্থ করব না। কথায় আছে, প্যাটিয়েন্স ইজ দ্য বেস্ট ওয়েপন অ্যান্ড সাইলেন্স ইজ দ্য বেস্ট রিভেঞ্জ। ধৈর্য আমি ধারণ করেছি, এবার দ্বিতীয়টি প্রয়োগ করার সময় এসেছে। এগারো মাসের কষ্ট আমি এত সহজে ভুলব না, কারান। প্রতিটি মুহূর্তে আপনাকে বুঝিয়ে দেবো, ভালোবাসার মানুষের অবজ্ঞা কত নির্মম শাস্তি হতে পারে।”
অন্যদিকে রোমানা শুয়ে শুয়ে, ফোন স্ক্রল করতে করতে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “ধুরো, আরিয়ান তো এক ধরনের ভালোই ছিল। অন্তত ঝগড়া করলে, সময়টা তো কাটত। এখন যেন সময় এক জায়গায় থেমে গেছে, বেলা যায় না। কিন্তু এটাও জানি, জেল থেকে বের হলেই আবার তুলকালাম শুরু করবে। আমিও প্রস্তুত, আসিস তুই। এক কামড়েই তোর সমস্ত রাগ ছিন্নভিন্ন করে দেবো,” বলেই সে ভাব নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে মনোযোগ সহকারে উপরের পা নাচাতে থাকল।
সম্প্রতি হাওলাদার বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। কারণ প্রায় প্রতিদিনই আলোচনার কেন্দ্রে মিরা আর কারান। এমন চমৎকার মেয়ে জামাই পাওয়া সত্যিই এক বিরল সৌভাগ্য। আজকালকার ছেলেদের মধ্যে যেখানে শিষ্টাচারের অভাব প্রকট, সেখানে কারান এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বিদেশি সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা সত্ত্বেও, তার মধ্যে যে সামাজিকতা ও শালীনতার মিশ্রণ রয়েছে, তা মন ছুঁয়ে যায়। মিরার প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা ও রসবোধ প্রতিনিয়ত মিরার মুখে হাসি ফোটায়। এসব ভাবনার গভীরে ডুব দিয়ে মিরার বাবা-মা একই সুরে বলেন, “মেয়ে আমাদের সুখেই আছে।”
মাহিমা বরাবরই আধুনিকতার অনুসারী। এতদিন মিরার পছন্দের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজ রুচি প্রকাশে সংযত ছিল সে। কিন্তু এখন মিরার অনুপস্থিতিতে, ঘরটি তার মনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। দেয়ালে ঝুলছে কোরিয়ান সুপারহিরোদের বিশাল পোস্টার, পাশাপাশি সযত্নে সাজানো ডিজনি রাজকন্যাদের ছবি। এই ঘরেই কখনো সুরের ছন্দে নাচে মাহিমা, কখনো মৃদু গলায় গুনগুন করে আপন মনে।
ঘরের মধ্যে এই মুহূর্তে সাধারণ এক ছাপার গেঞ্জি আর প্লাজো পরে সে নিজের মতো করে দোল খাচ্ছে। একটুপর দোলাচলের সুর থামিয়ে সে টেবিলের সামনে বসে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়।
হঠাৎ করেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। সে চমকে উঠে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকাল।
মমতাজ দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে স্নেহভরা সুরে বলেন, “স্নেহা কল করেছিল। কিন্তু ধরতে পারিনি, কেটে গেছে।”
ঘরের ভেতরে এসে ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে, “এই নে, কল দিয়ে কথা বল।”
মাহিমা ফোন হাতে নিয়ে মায়ের বিদায়-চলাকে নিরীক্ষণ করে। তারপর একটু নিশ্বাস নিয়ে স্নেহাকে কল ব্যাক করে।
মাহিমা বিরক্তির সুরে দরাজ কণ্ঠে বলে উঠল, “কি রে, সেনুর বাচ্চা! এগারোটার সময় কল দিস কেন? কালকে দিলে কে মারত তোকে?”
অন্যপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো স্নেহার চিরচেনা উচ্ছ্বসিত গলা। তার কথায় সব সময়ের মতোই মিশে আছে হাসি আর স্নেহের ছোঁয়া, “আরে বেবি! আমি এখন যা বলব, সেটা শুনে তুমি উড়ে না যাও।”
মাহিমা নিঃসন্দেহে বিরক্ত হলেও কৌতূহলের হাসি চাপতে না পেরে বলে, “মামা, ফাজলামো পরে করিস। বল বল, খবর কী?”
“তোকে ড্রামার লিংক পাঠিয়ে দিয়েছি। দেখিস এগুলো একদম মাস্ট-ওয়াচ। হাইউন রে যা লাগে না! ভাইইইইইই!”
মাহিমার চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে ওঠে। উচ্ছ্বাস থামিয়ে বলে, “কি কি, নাম বল তো?”
“লিজেন্ড অফ দ্য ব্লু সি, গবলিন, টু ওয়ার্ল্ডস।”
মাহিমা ঠোঁট উল্টে বিরক্তির ভান করে বলে, “আয় তোকে জোরে একটা মার দেই। এগুলো তো আগের বছরের মামা!”
“হোক, কিন্তু আমি জানি, তুই সবগুলো দেখিসনি।”
“তা দেখিনি। তবে লিজেন্ড অফ দ্য ব্লু সি দেখেছি; জলপরীর কাহিনি। ইশ! লি মিন হোকে সেই লাগে!”
“সে তুই নিয়ে যা ওকে। আমার হাইউন আর ডং উকের দিকে নজর না দিলেই হলো।”
“হয়েছে? তবে শোন মামা, আমার জিজুকে তো দেখিস নাই। বিলিভ মি, কলিং হিম আ হিরো উড বি অ্যান আন্ডারস্টেটমেন্ট। ইভেন হিরোজ উড পেইল ইন কম্প্যারিসন।”
(অনুবাদ: “বিশ্বাস কর, তাকে নায়ক বলাও কম হয়ে যায়। নায়করাও তার সামনে মলিন হয়ে যাবে।”)
স্নেহার কণ্ঠ আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, “কি বলিস! তাই নাকি? তাহলে তোর জিজুকে বলিস তো সেকেন্ড বিয়ে করবে কিনা। আমি কিন্তু এক পায়ে রাজি।”
মাহিমা চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্তির ঝাঁজ মিশিয়ে বলে উঠল,
“কানের ওপর দিব একদম! আমার জিজু মানে আমারও ভাই, তোরও ভাই। তার ওপর তার বয়স জানিস? আমাদের ডবল।”
স্নেহা হেসে মৃদু গলায় কৌশলে বলে, “ঠিক আছে বাবা, রাগ দেখাস না। আর তাছাড়া বয়সে কী আসে যায়! আচ্ছা বাদ দে ইয়ার। এবার বল, সঙ্কংকে কেমন লাগে তোর?”
দুজনে এভাবেই কথার জালে মেতে উঠল।
এরই মধ্যে তাদের কথায় ছেদ টেনে মমতাজ দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর কতক্ষণ? ঘুমানো লাগবে না নাকি?”
মাহিমা তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখভঙ্গি বদলে দ্রুত বলে, “পরে কথা বলি, সেনু। বা বাই!”
কল কেটে মায়ের হাতে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে ভ্রুকুটি করে কিছুটা অভিমানী সুরে বলে, “মা, আর কবে? আমার সব বান্ধবীর ফোন আছে, শুধু আমার নেই। নিজেকে কী মনে হয় ওদের সামনে।”
মমতাজ কপাল ভাঁজ করে শান্তভাবে বলেন, “ততোটাও বড় হয়ে যাস নাই। কলেজে উঠলে কিনে দেব।”
মাহিমা ভেংচি কেটে বিরক্তি নিয়ে বলে, “হয়েছে, আর বলতে হবে না! নাইনে পড়ি মা। আমার বয়সি মেয়েদের তো বিয়েও দিয়ে দেয়।”
মমতাজ হেসে বলেন, “তাহলে ঠিক আছে। তোকেও বিয়ে দিয়ে দেই। ছেলে দেখা শুরু করি, কি বল?”
মাহিমা আপনমনে ভাবতে থাকে, “তা দিলে দাও! তবে কোরিয়ান কোনো হিরোর সঙ্গে। তাহলে অন্তত বকুনিঝকুনি আর এই পড়ালেখা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু তা তো আর বলতে পারি না। বললেই তো একটা মারও নিচে পড়বে না!”
তবু কথাটা মনে চেপে রেখে মুখ বাঁকিয়ে আওয়াজ তুলে বলে, “আমি এখনো শিশু মা, তাই বিয়ে পরে করব। এখন ঘুমাব। যাও যাও, গুড নাইট!”
“হুম, লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়।”
এ কথা বলে তিনি দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে আবার নেমে এলো নিঃশব্দ রাতের নীরবতা।
রাত দুইটার অন্ধকারে চারপাশে গভীর নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে একফালি চাঁদ আর কিছু দূরের তিমিরে ঢেকে থাকা তারা মিলিয়ে শান্ত নিদ্রার আবহ তৈরি করেছে। চৌধুরি বাড়ির সামনে সোলার লাইটগুলো নিভু নিভু জ্বলছে, আর দূরের ঘরবাড়িতে কয়েকটি পড়ুয়া ছেলেমেয়ের কক্ষে আলোর মৃদু ঝিলিক। এই নিস্তব্ধতা ও শান্ত পরিবেশে কারান ছাদের রেলিং ধরে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ নিমজ্জিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো।
হঠাৎ করেই ক্রোধের আগুনের তাপে তার মাথা গরম হয়ে উঠল, তার চোখে তীব্র ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলো। চাঁদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল, “কেন মিরা? কেন? আমি তো আর কম ভালোবাসা দিচ্ছি না। তবুও কেন বারবার নিজের মুডে এমন পরিবর্তন এনে আমাকে শেষ করতে চাও? তোমার ধারণা নেই, তোমার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আমাকে কীভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে।”
তীব্র নিশ্বাস ফেলে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে সে আবার বলতে থাকে, “I’m no longer drawn to just your beauty; I’m falling in love with every part of who you are. Mira, to the world, you might be just one person, but to me, you are my entire world.”
(অনুবাদ: আমি আর শুধু তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ নই; তোমার প্রতিটি গুণে, প্রতিটি অভিব্যক্তিতে ভালোবাসায় ডুবে যাচ্ছি। মিরা, পৃথিবীর কাছে তুমি হয়ত একজন মানুষ মাত্র, কিন্তু আমার কাছে তুমি পুরো পৃথিবী।)
কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলল, “আমি হাজারবার তোমার প্রেমে পড়তে চাই; তোমার সৌন্দর্যের জাদুতে অথবা তোমার অপার ভালোবাসার গহীনে। কিন্তু আমি শুধুমাত্র তোমার প্রেমেই আবদ্ধ হতে চাই। তোমার চোখের মায়ায়, তোমার হাসির মধুর সুরে, তোমার প্রতিটি ছোট ছোট অভ্যাসে আমি হারিয়ে যেতে চাই। (খানিক থেমে) তোমার জন্য আমার আত্মা ক্ষুধার্ত, মিরা। তুমি একমাত্র ব্যক্তি, যার জন্য বিশ বছর পর কারান চৌধুরীর মুখে হাসি ফুটেছে। আমি জানি, তোমার চোখে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নীচ, ঘৃণ্য, কলঙ্কিত ব্যক্তি। কিন্তু আমি সেইভাবেই থাকতে চাই। তোমার সামনে কখনোই আমার ভালো দিক প্রদর্শন করবো না। তুমি এই কারানকেই ভালোবাসবে এবং তোমার সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে, আই প্রমিজ,” বলেই চাঁদটিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ এখানে চাঁদটাই হলো মিরা।
মিরা বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ, আরেকবার ওপাশ করছে। ঘুম যেন রূঢ় অভিমান নিয়ে তার চোখের পাতা এড়িয়ে চলেছে। তাই বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো সে।
তার শুষ্ক কণ্ঠে বলে, “আজব ঘুম! কত চেষ্টা করলাম, তার আসার নামই নেই। আরও একটা রাত নষ্ট করবো ওর জন্য? একদম না। এবার থেকে আমি আমার মতো গুছিয়ে নেবো জীবনটাকে। ওর কাছে যেমন এগারো মাস থেকেও ছিলাম না, ও আমার কাছে ঠিক তেমনই থাকবে।” কথাগুলো বলে মিরা লম্বা এক শীতল নিশ্বাস ফেললো। অর্থাৎ বুকের গহিন থেকে একটা পাথর সরানোর চেষ্টা করছে।
হঠাৎ পাশের টেবিলে রাখা কারানের ফোনটা চোখে পড়লো। সেদিন রাশার মেসেজের কথা মনে পড়তেই তার ভেতরে একটা চাপা অস্থিরতা খেলা করে। তাই ফোনটা হাতে তুলে নিল।
“কিন্তু পাসওয়ার্ড তো জানি না,” বলে স্ক্রিনে আঙুলের ছোঁয়া দিতেই ফোনটা আনলক হয়ে গেল।
মিরা বিস্ময়ে স্তব্ধ। তার চোখে অবিশ্বাসের ছায়া।
“অদ্ভুত! ওর ফোনে পাসওয়ার্ড রাখে নাই? অথচ সেবার তো ছিল। আবার কোনো নতুন নাটক শুরু করলো না তো?”
স্বগতোক্তির পর একটু থেমে ফোনের বিভিন্ন অ্যাপসে ঢুকতে শুরু করলো। মেসেজগুলো একের পর এক খুলে দেখে।
এদিকে কারান ছাদ থেকে ফিরে এসে দরজার ফাঁক দিয়ে সবটা দেখে, ঠোঁটের কোণে তুচ্ছতম হাসির রেখা টেনে নিল।
মিরা ভ্রূ উঁচিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“বাবা! এ-তো সাধুসন্ন্যাসী লাগছে একদম। অফিসের কিছু মেয়ে এমপ্লয়ি ছাড়া আর তো কেউই নেই। কিন্তু সেই আগের মেয়েগুলো কোথায়? ব্লক করে রেখেছে? নাকি আমার অজান্তে অন্য কোনো ফোন আছে? কিন্তু কখনো চোখে পড়লো না কেন? ওকে নিয়ে চিন্তা দেখছি বেড়েই চলেছে। কিন্তু একটা খটকা থেকেই যায়। হঠাৎ একটা মানুষের এতো পরিবর্তন কীভাবে হতে পারে? এ কি আসলেই অলৌকিক?”
অন্যদিকে কারান দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে চুপচাপ ঘরে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। মিরা কারানকে দেখে ফোনটা দ্রুত আগের জায়গায় রেখে দেয়। পরে বিছানায় বসে অন্যদিকে ফিরে রইলো।
কারান ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিলো। এরপর নেভি ব্লু ট্রাউজার পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে, আলমারির দিকে এগিয়ে গিয়ে টিশার্ট খুঁজতে শুরু করলো। সেই মুহূর্তে শূন্য দৃষ্টিতে মিরার দিকে এক ঝলক তাকাল।
অথচ মিরা কারানকে দেখেও না দেখার ভান করে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে ধীরে ধীরে খেতে শুরু করলো। কারান টিশার্ট হাতে নিয়ে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করলো এবং এরপর একে একে খুলে শার্টটা পাশে রাখলো।
তৎক্ষণাৎ মিরার চোখ পড়ে কারানের শরীরে। তার হাতের গ্লাস মুহূর্তেই শব্দহীন নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে নিচে পড়ে চৌচির হয়ে যায়। কারানের বুকে আর পিঠে গভীর দাগগুলো রক্তাক্ত আকার ধারণ করেছে। তার চামড়া যেন দগ্ধ আগুনের মতো ক্ষত-বিক্ষত।
মিরার শরীর হঠাৎ কেঁপে ওঠে, চোখ বিস্ফোরিত হয়। গলার কাছে দলা পাকানো আতঙ্কের ভার জমতে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে হন্তদন্ত হয়ে কারানের কাছে ছুটে গেল।
কারান শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলবে?”
মিরা কিছুক্ষণ কোনো কথা খুঁজে পায় না। তার হাত অনবরত কারানের ক্ষতগুলো পর্যবেক্ষণ করছে; একবার সামনের দিক, আরেকবার পিছনের দিক। চোখের পাতা থমকে গেছে, শ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যুৎ খেলে গেল। শেষে দগ্ধ লাভার মতো গলিত ক্রোধে বলে উঠলো, “আপনার মাথায় শিওর ছিট আছে। কালকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে আসবেন। আমি বুঝতে পারছি না কোন শব্দটা আপনার সাথে মানানসই হবে। এটা কী ধরনের মারার প্রক্রিয়া? কী বিশ্রী অবস্থা! আল্লাহ! উন্মাদ একটা।”
মিরার কণ্ঠে তীক্ষ্ণ তিরস্কার, তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার রেখা খেলা করছে। কপালে হাজারটা ভাঁজ পড়েছে।
অথচ কারান কোনো কথা বলে না। চোখের গভীরে কিছু একটা জ্বলজ্বল করে, কিন্তু মুখে নিস্তরঙ্গ শান্তি। মিরার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চেয়ে তার ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য হাসি ফুটে ওঠে। এই চিন্তাগ্রস্ত মুখশ্রী তার কাছে আশ্বাসের মতো, সে আনন্দ পায় তার জন্য মিরার হৃদয়ের বিক্ষিপ্ততায়।
মিরা ঝাঁঝালো স্বরে বলে ওঠে, “আমি কি রোবটের সঙ্গে কথা বলছি? জলদি এদিকে আসুন।”
কারান নির্বিকারভাবে মিরার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। মিরা চোখের ইশারায় তাকে বিছানায় বসতে নির্দেশ দেয়। কারান অবাক না হয়ে বসে পড়ে। মিরা ড্রয়ার থেকে মলম বের করে, ঢাকনা খুলতেই কারান তাচ্ছিল্য ভরে বলে ওঠে, “অমানুষের জন্য এত মায়া?”
মিরার চোখে বিদ্বেষের আঁচ আসে। তীক্ষ্ণ গলায় বলে, “এসব ফালতু কথা বন্ধ করুন। আপনার প্রতি আমার কোনো মায়া নেই। তবে মনুষ্যত্ববোধটুকু আছে। চুপচাপ থাকুন। আমি মলম লাগাচ্ছি।”
মিরা মলম লাগাতে শুরু করতেই, কারান তার অনাকাঙ্ক্ষিত হাস্যরসে ভরা কথাটি উচ্চারণ করে, “ওষুধ লাগানোর কি দরকার, জান? তুমি চুমু খেলেই তো ব্যথা চলে যাবে। ভাবছি, এতগুলো দাগে তোমাকে কত হাজার কিস করতে হবে!”
কথাটি শোনামাত্র মিরার চেহারায় রাগের আগুন জ্বলে ওঠে। সে তীব্র গলায় বলে, “আপনি আসলেই একটা… আপনার মতো অদ্ভুত জীব আমি কখনো দেখিনি। বলেছিলাম তো, কথা বলবেন না। বললেন তো, তাহলে ঠিক আছে, নিজেই লাগিয়ে নিন। ফালতু লোক, গন্ডারের চামড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।”
এটা বলে মিরা দ্রুত ঘুরে পড়ে, তবে ফের পিছনে ফিরে কারানের নীল রক্তাভ দাগগুলো দেখতেই তার মনে গলে গেল। সে আবার তার পাশে বসে, অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তার পিঠে মলম লাগাতে থাকে। এবার রাগে ঝলসে উঠেই বলে, “চুপচাপ বসে থাকুন, নয়তো আমি আপনার দাগগুলোর উপর মরিচ মেখে দেব।”
কথাটা কারান শুনেই খুক খুক করে কাশতে শুরু করে। বিষণ্ণভাবে মিরার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে, “হে আল্লাহ, আমার স্ত্রীকে কী করে এমন বদলে দিলেন? এই বউ আর বউ নেই, এখন সে এক ভয়ংকর রাক্ষসী হয়ে গেছে। কেউ আমাকে বাঁচান!”
মিরা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে কারানের কাশির শব্দের দিকে তাকায়। টেবিল থেকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “নিন, পানি খান।”
“না, আমি এক কাপ হট কফি খাবো।”
মিরা বিস্ময়ে ফুঁসে ওঠে। ভ্রূ উঁচু করে তাচ্ছিল্যের হাসিতে বলে, “এই সময়ে আপনার কফি খেতে ইচ্ছে করছে?”
“করতে পারে না?”
“না, ঠিকই আছে। আপনার ক্ষেত্রে হতেই পারে। উফফ, আল্লাহ! ছেলের অভাব পড়েছিল, বাবা? এই অদ্ভুত প্রাণীটাকেই আমার কপালে জুটিয়ে দিলে!”
কারান মিরার কথা শুনে হেসে ওঠে। মিরা মনে মনে ভাবল,
“নির্লজ্জ কত প্রকার ও কী কী, এই লোকটাই তার উদাহরণ। আবার হাসে!”
লম্বা শ্বাস ছেড়ে আওয়াজ তুলে বলে, “ওষুধটা লাগিয়ে নেই। তারপর কফি বানিয়ে আনছি। সামনের অংশে এখনো লাগানো বাকি।”
“না, আগে কফি আনো।”
মিরা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে, “বুঝেছি। না আনলে আপনি ক্ষান্ত হবেন না।”
কিছুক্ষণ পর এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি এনে মিরা ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে, “এবার গিলেন।”
কারান কফিটা হাতে নিয়ে হাসিমুখে নিজের ডান হাতে সম্পূর্ণ কফি ঢেলে দিল। এ দৃশ্য দেখে মিরার চোখের পাতা পর্যন্ত স্থির হয়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে চোখে-মুখে বিস্ময় জমিয়ে বলে উঠল, “কফিটা কতটা গরম ছিল আপনার ধারণা আছে?”
মিরা আর দেরি না করে তৎক্ষণাৎ ঠান্ডা বরফ পানি এনে কারানের হাতে লাগাতে থাকে। আঘাতের গভীরতা তার চোখে ভেসে উঠেছে। এক হাতে কারানের হাত ধরে, অন্য হাত ঠোঁটে রেখে হতবাক দৃষ্টিতে ফিসফিস করে বলে, “এটা… (থেমে ঢোক গিলে) কেন করলেন?”
“তুমি নিজেই ভেবে দেখো।”
মিরা রাগে বিস্ফোরিত হয়ে বলে, “আমি না, আপনার মতো পাগলের সঙ্গে আর একটা শব্দও ইউজ করবো না।”
মিরা দ্রুত পুড়ে যাওয়া ব্যথা উপশমের মলম এনে কারানের দিকে ছুড়ে দিয়ে স্বগতোক্তি করল, “লাগিয়ে নিয়েন।”
এই বলে সংযুক্ত কক্ষে চলে গেল। কারান মুচকি হেসে আড়মোড়া ভেঙে ঘাড়ের শিরা ডলতে ডলতে বলে, “আঘাত নিজেকে করলাম নাকি আপনাকে, সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না, মহারানি ভিক্টোরিয়া। (ভেঙিয়ে) উনি নাকি আমাকে ভালোবাসেন না!”
সহসা হাতের পুড়ে যাওয়া ব্যথা অনুভব করে বলে ওঠে, “উফফ! হাতটা একটু বেশিই পুড়েছে। মনস্টারের মতো দেখাবে, তার চেয়ে ওষুধটা লাগিয়ে নেই। নাহলে আমার সুন্দরী অর্ধাঙ্গিনী আবার পাত্তা দিবে না।”
কারান মলম লাগাতে লাগাতে এক গভীর নিশ্বাস ছাড়ে।
Tell me who I am part 14
অন্যদিকে সংযুক্ত কক্ষে রাখা কারানের একটি ছবির দিকে মিরার চোখ আটকে যায়। তার চোখে রাগের সঙ্গে কোথাও লুকিয়ে থাকা অপরিচিত বেদনা জ্বলে ওঠে। ছবির দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে, “সত্যিই আপনার এমন দাগ আমি সহ্য করতে পারছি না। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটানো, তার কী হবে? এসব করে মিরার ক্ষতবিক্ষত মন গলানো যাবে না। আপনার শাস্তি শুরু হয়ে গেছে, কারান চৌধুরি। প্রস্তুত হন।”