Tell me who I am part 17

Tell me who I am part 17
আয়সা ইসলাম মনি

আচমকা এমন একটা বাক্য শুনে মিরার মনোযোগ একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল, কারান হাস্যোজ্জ্বল মুখে মিরার দিকে নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। মিরা একটু ভ্রূ কুঁচকে, কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “আজকে কত তারিখ?”
কারান একটু হাসি লুকিয়ে, সুরেলা গলায় উত্তর দিল, “থার্টিন এপ্রিল, টু থাউজ্যান্ড সেভেনটিন।”
এই কথাটা মিরার কর্ণে পৌঁছাতেই, সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ইশশ, আমার তো একেবারে মনেই ছিল না।”

“হুম, এবার ওঠো।”
মিরা একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল, “উঠবো কেন?”
“আগে ওঠো, তারপর বলছি।”
মিরা কিছুটা বিরক্ত হলেও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। কারান দ্রুততম গতি নিয়ে বলল, “আচ্ছা মিরা, হ্যাং অন আ মোমেন্ট। আমি আসছি।”
সে পাশের কক্ষে চলে গেল।
এদিকে মিরা আফসোসের গাম্ভীর্যে আপনমনে বলল, “আপনার সাথে একটা বছর কাটিয়েও ফেললাম। আহা, যদি ঐ এগারো মাসও শেষ মাসের মতো হতো।”
তারপর এক দীর্ঘ আহত নিশ্বাস ছাড়লো। অর্থাৎ হৃদয়ের অগোচরে জমে থাকা অসীম বেদনা তার বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।
এতটুকু সময়ের মধ্যেই কারান হাতে একটি শপিং ব্যাগ নিয়ে হাসিমুখে মিরার সামনে এসে দাঁড়াল। মিরার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা তোমার জন্য।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এটা কি?”
“নিজেই খুলে দেখো।”
মিরা ধীরে ধীরে ব্যাগটি খুলল। ব্যাগের মধ্যে থেকে একখানা টকটকে লাল গোলাপের মতো পোশাক বের করলো।
মিরা ভ্রূ উঁচিয়ে পুরো চেহারায় আশ্চর্যভাব প্রকাশ করে বলল, “আল্লাহ! ড্রেসটা কত সুন্দর! সত্যিই অনেক বেশি সুন্দর!”
কারান মৃদু হাসি দিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার পছন্দ হয়েছে?”
মিরা প্রশংসায় মনোমুগ্ধ হয়ে বলল, “তা আর বলতে! সত্যিই খুব সুন্দর। আপনার চয়েজের প্রশংসা না করলেই নয়।”
কারান মিরার ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসি লক্ষ্য করে বুঝতে পারে, পোশাকটি সত্যিই তার মনে জায়গা করে নিয়েছে। তবে শেষ বাক্যটি শুনে, কারান মিরার মুখমণ্ডলে তাকিয়ে ঈষৎ হাসির মধ্যে আনমনে বলল, “সে তো অবশ্যই।”
অর্থাৎ মিরাকেও তো সে পছন্দ করেছে।
এরপর আওয়াজ তুলে বলল, “Alright then, go and slip into the dress now.”

“এখন?”
“এনিভার্সারির গিফট কি তুমি অন্যদিন পড়তে চাও?”
মিরা কিছু সময় চুপ থেকে, একটু ভাবনার পর সম্মতি জানিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি নিচে অপেক্ষা করুন, আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি।”
“ওকেএএ।”
কারান দরজা দিয়ে বের হতে যাবার সময় হঠাৎ থেমে গিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে আবার বলল, “আহ, বেবি… আজকে একটু সেজে এসো। তবে হ্যাঁ, উলটো পালটা কিছু দেওয়া অ্যালাউড না, মনে রাখবে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা। আপনি এবার যান।”

কারান আলতো হেসে পাশের কক্ষে চলে গেল। সে নিজের টিশার্ট আর ট্রাউজার পরিবর্তন করে শুভ্র একটি শার্ট, যার সাথে কালো কোট এবং প্যান্ট পরিধান করলো। কালো টাই-টি পরে সে নিজের উপস্থিতিকে আরও একাধিক শানিত করে তুলল। তার শরীরে লাগাল ক্লাইভ ক্রিস্টিয়ান নং ১ ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টি এর মিষ্টি সুগন্ধ। হাতে পরে নিল কালো পাটেক ফিলিপ ঘড়ি, আর পায়ে একজোড়া ব্রান্ডের কৃষ্ণকায় সুজ পড়লো। চুলগুলো পিছনে নিয়ে ললাটের এক কোনায় কয়েকটি চুল ছেড়ে দিল। বুক পকেটে একটা সতেজ লাল গোলাপ রেখে দিল।
তারপর নিচে বৈঠকখানায় গিয়ে একবার পুরো আয়োজনটি পরখ করল, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। বৈঠকখানাটি কারান নিজ হাতে সাজিয়েছে। পুরো কক্ষটি সাদা পিলার মোমবাতির আলোর আভায় আলোকিত হয়ে এক স্বপ্নময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কক্ষের এক কোণে প্রজ্বলিত গোলাপের মতো আকৃতির সয়া ওয়াক্স মোমবাতি, আর তার পাশেই জলের মধ্যে ভেসে আছে পদ্মফুলের মতো ফ্লোটিং মোমবাতি। মোমবাতির আলো থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে মিষ্টি, মধুময় সুভাস। আর সাউন্ড বক্সে ভেসে আসছে রোমান্টিক সফট মিউজিকের সুর। প্রতিটি নোট কক্ষের প্রতিটি কোণায় সুর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে ডাইনিং টেবিলটি মিরার পছন্দের খাবারের পদগুলোতে সাজানো। প্রতিটি পদই কারান নিজে রান্না করেছে। আর এক পাশে রাখা লাভ আকৃতির রেড ভেলভেট কেক, এবং তার উপর সাদা জীবন্ত গোলাপ সাজানো। কেকের মাঝে নকশা করে লেখা 𝕸𝖎𝖗𝖆𝖓। কেকটি কারান নিজ হাতে যত্নসহকারে তৈরি করেছে।
আর সবকিছুই ছিল মিরার অগোচরে, যখন মিরা ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের মধ্যে মনোনিবেশ করেছিল।
এদিকে মিরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে দোতালার করিডোরে পা রেখে ধীর গতিতে সামনে এগিয়ে আসছে। কারান অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবারের জন্যও চোখের পলক ফেলল না। নিশ্বাস নেবার কথাও ভুলে গেছে সে।
লাল গাউনটি যেন শুধুমাত্র মিরার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। তার আকর্ষণীয় দেহবিন্যাসে একদম নিখুঁতভাবে মানিয়ে গেছে। তার দীর্ঘগ্রীবা, ক্ষীণ কোমর, আর অনুপম বক্ষ অজানা নান্দনিকতার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করছে। তার ধবধবে ফরসা ত্বকের উপর রক্তিম আবরণটি কেবল তার সৌন্দর্যকেই নয়, বরং তার নিখুঁত শুচিতাকেও গভীরভাবে প্রকাশ করছে।
তার কানে ছোট একটি হীরের দুল, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক, আর ব্লাশঅনের মাধ্যমে নরম কপোলদ্বয়কে খানিকটা আরক্ত করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, সে স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অপ্সরা বা আলোকছায়ার মূর্ছনায় জন্ম নেয়া এক পরাবাস্তব রূপকথার চরিত্র।

কারানের বুকের ভেতর ঝড় বইছে। হৃদয়টা থেমে গিয়েও আবার জোরে ধুকপুক করে উঠেছে।
মিরা করিডোর থেকে হেঁটে এসে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখতেই, কারান নেশালো গলায় উচ্চারণ করে, “হেই, রেডরোজ।”
মিরা মুচকি হাসি দিয়ে ধীর পায়ে সিঁড়ির নিচে নামতে থাকে। সে যখন সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে, তার গাউনের পেছনের অংশটিও ধীরে ধীরে সিঁড়ির ধাপে ধাপে নেমে আসে। সিঁড়ির তিন ধাপ উপরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ পড়ার মতো করে কারানের আপাদমস্তক পরখ করে নিল। মিরা হেসে আপনমনে বলল, “আপনাকেও অসম্ভব সুন্দর লাগছে, কারান সাহেব।”
ততক্ষণে কারান নিজের ডান হাতটা মিরার দিকে বাড়িয়ে দিল। মিরা যখন কারানের ডান হাতটি স্পর্শ করল, কারান মধুর ও মন্ত্রমুগ্ধ সুরে বলল, “কোহ্কাফ নগরী থেকে পরীদের রানি আজ মর্ত্যে অবতরণ করেছে। ওয়েলকাম, মিসেস কারান চৌধুরি।”

মিরা কিছুটা লজ্জা অনুভব করে মধুর হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। তারপর কারানের হাত ধরে এক পা এক পা করে সিঁড়ি থেকে নিচে নামতে লাগল। কারান মিহিকন্ঠে কোমল আহ্বানে বলল, “এদিকে আসুন, মহারানি।”
তারপর মিরার হাত আরও দৃঢ়ভাবে নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করল কারান। সে ধীরে ধীরে মিরাকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বৈঠকখানার এক কোণায় রাখা এক বিশাল সিংহাসনের সামনে দাঁড়ালো। সিংহাসনটি ছিল খাঁটি সোনার তৈরি। সিংহাসনের উচ্চ পেছনটা সূক্ষ্ম নকশায় খোদাই করা। তার হাতলজোড়া ছিল দু’পাশে সিংহের মাথার অবয়বে গঠিত। সোনার সেই কঠিন কাঠামোর উপর একমাত্র কোমলতা ছিল মখমলের গাঢ় রঙের গদি। সিংহাসনের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নকশাগুলি আলোতে ঝলমল করছিল। অর্থাৎ এখানে মিরা রাজরানি, আর কারান তার রাজা।
মিরা বিস্ময়ে চোখ বড় করে কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সিংহাসন?”
কারান অল্প হাসল। তারপর এক শীতল নিশ্বাস ছেড়ে আবিষ্ট স্বরে বলল, “জি, আপনার জন্য। এবার বসুন।”

“কিন্তু…”
মিরার কথাটি অসমাপ্ত রেখেই কারান ডান হাতটি সিংহাসনের দিকে বাড়িয়ে বলল, “প্লিজ।”
মিরা আর কিছু না বলে মুখে প্রশান্ত হাসি নিয়ে সিংহাসনে আসীন হলো। সে বসতেই কারান শ্রদ্ধায় হাঁটু গেড়ে তার পায়ের সামনে বসল। এক হাতে তার পোশাকের প্রান্ত আলতো করে তুলে, একজোড়া প্রাসাদীয় জুতা পরিয়ে দিতে লাগল৷ জুতোজোড়া স্বচ্ছ কাচের তৈরি, যার উপর নিখুঁতভাবে শতাধিক বহুমূল্য সাদা হীরে বসানো। প্রতিটি হীরা কাচের মতো জ্যোতির্ময়, আর আলো পড়লেই চারপাশে রাজকীয় দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়।
জুতার ফিতে ঠিক করতে করতে কারান মৃদুস্বরে বলল, “আমি যেন সোনার পা-কে হীরার প্রলেপে আচ্ছাদিত করছি। আপনার আগমনে চারপাশে শুভ্র আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে, বেগম সাহেবা।”
মিরা চোখে অবাক বিস্ময় নিয়ে শুধু কারানকে দেখে যাচ্ছে। কি মনোযোগ ও যত্ন নিয়ে তার পায়ে হীরার জুতা জোড়া পরানো হচ্ছে! মিরার মনে হলো, সে সত্যিই কোনো এক জাদুকরী রাজ্যের অমূল্য রানি।
মিরা হাসি মুখে বলে উঠল, “আমার মনে হচ্ছে আমি সিন্ড্রেলা আর আপনি মিস্টার কীট।”

কারান উঠে দাঁড়িয়ে মিরার দিকে মাথা ঝুঁকে ভ্রুকুটি করে বলল, “ছি, মিরা! তুমি কেন সিন্ড্রেলা হতে যাবে? সিন্ড্রেলা তো ছিল ছাইমাখা মেয়ে। আর তুমি তো রানি, কারানের মহারানি ভিক্টোরিয়া।”
মিরা মুখ চেপে মুচকি হেসে নিল। কারান কিছুক্ষণ চুপ থেকে কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে সহসা বলে উঠল, “একটা জিনিসের কম পরে গেছে ,সুইটহার্ট।”
মিরা চমকে উঠে বলে, “আবার কি?”
“ওয়েট, সোনা।”
তারপর সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা মাঝারি আকারের গহনার বাক্স হাতে নিয়ে মিরার সামনে চলে এলো। কারান মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “এবার উঠুন।”
মিরা কিছুটা অবাক হয়ে হেসে উঠে দাঁড়াল। কারান মিরার পিছনে গিয়ে, তার খোলা চুলগুলো হাতের সাহায্যে মিরার গলার সামনে রাখলো।

তারপর সে ধীরে ধীরে বাক্সটি খুলল। বাক্সের ভেতর থেকে এক অবিশ্বাস্য হীরকনেকলেস উঠে এলো। নেকলেসটির কেন্দ্রে বসানো ছিল ‘দ্য হোপ ডায়ামন্ড’, যার মূল্য প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার। প্রায় ৪৫.৫২ ক্যারেট ওজনের এ হীরাটি ছিল গভীর নীলচে বেগুনি আভায় দীপ্ত। হীরাটি স্বর্ণের মতো হালকা আলো ছড়াচ্ছিল। মূল হীরাটিকে বেষ্টন করে সুশৃঙ্খলভাবে ষোড়শটি উজ্জ্বল শ্বেত হীরা বসানো ছিল।
আর ঠিক সেই নীল হীরার মাঝখানে, অপূর্ব সূক্ষ্মতায় উৎকীর্ণ ছিল 𝕸𝖎𝖗𝖆𝖓 লেখাটি। গথিক স্টাইলের কালো রঙের হালকা খোদাই করা লেখাটি হীরার মধ্যেই জ্বলজ্বল করছিল, যাকে শুধু কাছ থেকে নজর দিলেই দেখা যায়।
চেইনটিও ছিল নীলাভ রুপালি, যেখানে হীরার রেখায় বিস্তৃত ছিল দুই দিক থেকে প্রবাহিত দুটি ধ্রুপদী শ্বেত হীরার অনুপম নকশা। সে নেকলেসটি মিরার গলায় পরিয়ে দিল। নীল হীরাটির ভার এসে মিরার কণ্ঠনালির একেবারে কেন্দ্রে স্থির হয়ে রইল।

সে নেকলেসটি মিরার গলায় ঝুলানোর পর, মিরার চোখে নীরব প্রশংসা আর ভালোবাসার উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল।
পিছনে ঘুরে কারানের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এগুলো কেন, কারান?”
কারান এক নিঃশ্বাসে নিজের মনের গভীরতা প্রকাশ করে বলল, “It embodies my eternal devotion to you, my beloved. Together we are two souls entwined, united in a singular rhythm.”
(অনুবাদ: “এটি আমার চিরন্তন নিবেদনের প্রতীক, প্রিয়তমা। আমরা দুই আত্মা একত্রিত, একটি একক ছন্দে বাঁধা।”)
মিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার চোখে অদ্ভুতভাবে অতীতের কষ্ট আর বর্তমানের আনন্দ মিশে গেছে। সে মনে মনে ভাবল, “এই মানুষটাকে আমি সত্যিই চিনতে পারছি না। কীভাবে ওকে ঘৃণা করবো আমি? এত প্রেমের পরও কি কোনো মেয়ে ঘৃণা করতে পারে? আপনাকে ভালোবাসতে না পারলেও ঘৃণা করা অসম্ভব।”

এরপর মিরার হঠাৎ নজরে এলো কারানের পিছনের পুরো বৈঠকখানাটি। যা মোমবাতির আলোয় এতটাই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে সাজানো যে, যে কেউ আশ্চর্য হয়ে যাবে। এতক্ষণ সে শুধু কারান আর তার অভিনব সব কর্মকাণ্ডেই মুগ্ধ ছিল, কিন্তু এবার কারানের পাশ ছাড়িয়ে মুগ্ধ চোখে পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। মোমবাতির স্বল্প আলো আর তার সঙ্গে মিলিয়ে গোলাপের মিষ্টি সুবাস চারপাশকে মোহময় আবেশে আবৃত করে রেখেছে।
মিরা অল্প হাসিতে চোখ বুজে এক গভীর শ্বাসে সমস্ত অনুভূতি মনের ভেতরে ধারণ করলো। চোখ খুলতেই দেখলো আরেকটি চমকপ্রদ দৃশ্য; কারান বিশাল একটা লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় তোড়া যে কারানের মুখটাই আড়ালে চলে গেছে।

কারান তোড়ার পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, “ধরছো না কেন, বেগম?”
মিরা চমকে উঠে একটু হাসল। এরপর তোড়াটা হাতে নিতেই ভারের চাপে সামলাতে না পেরে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু কারান দ্রুত এগিয়ে এসে তার সাথে একসাথে তোড়াটা ধরলো।
মিরা এতক্ষণ পর অবশেষে মুখ খুলল। মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, “এত্ত গোলাপ! আল্লাহ, এগুলো কী করেছেন আপনি! আমার তো মনে হচ্ছে আমি সত্যিই স্বপ্ন দেখছি, যেন পুরো গোলাপের বাগানটাই আমার হাতে। আমি তো এবার সত্যিই পাগল হয়ে যাবো।”
কারান ঈষৎ হাসল। মিরার এত খুশি অবলোকন করে তার চোখে প্রশান্তির ছায়া খেলা করে। মিরা তোড়ার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এখানে মোট কতগুলো গোলাপ আছে বলুন তো?”
কারান ঠোঁটের কোণে একটু হাসি নিয়ে বলল, “বেশি না, মাত্র ৯৯৯টা।”
মিরা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “কি! ৯৯৯টা গোলাপ?”

“জি, বেগম।”
“তা আর একটা হলেই তো এক হাজার হতো! ঢাকায় বুঝি আর একটা গোলাপের অভাব পড়েছিল?”
কারান কিঞ্চিৎ হাসিতে কিছু না বলে হাঁটু গেড়ে মিরার সামনে বসে পড়ল। বুকপকেট থেকে লাল গোলাপটি বের করে সে এক গভীর শ্বাস নিল। তারপর একরাশ আবেগ নিয়ে গোলাপটা মিরার দিকে বাড়িয়ে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “আই লাভ ইউ, মিরা।”
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই মিরার চোখে-মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। সে গোলাপের তোড়াটা পাশে সোফায় নামিয়ে রেখে পেছন ঘুরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃদয়ের গভীরে অজানা ভার তাকে টেনে ধরল। কারানের প্রতি সেই আগের মতো ভালোবাসাটা যেন কোথাও নেই। হয়ত এত তাড়াতাড়ি সেই অনুভূতি জাগানো সম্ভবও নয়। মনের অগোচরে চাপা বেদনার স্রোত বয়ে গেল।

সে আপনমনে বলল, “না, কারান। আপনাকে আমি অ্যাকসেপ্ট করতে পারবো না, যত কিছুই করুন না কেন। হাউ ক্যান আই ইরেজ দ্য মেমোরি অফ ইউ লকিং দ্য ডোর ইন ফ্রন্ট অফ মি অ্যান্ড হ্যাভিং রুম ডেটস উইথ আদার গার্লস? সেই যন্ত্রণা ভুলতে চাইছি, তবুও পারছি না।”
কারানের সামান্য হতভম্ব হয়ে যাওয়া বোঝা যায়, কিন্তু সে কিছু বলে না। মিরার অপ্রকাশিত আক্ষেপ তাদের মাঝে অসীম দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে।
মিরার চোখের পাতা খানিকটা ভিজে উঠেছে, কিন্তু সে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে। কারান এক পলকে বুঝে নিলো, তার মিরা এখনো সেই আগুনের ক্ষত বয়ে চলেছে। কারান জানে, এখনই তার সমস্ত ক্ষত মুছে দিতে পারবে না।

তাই একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে কারান উঠে দাঁড়াল। তারপর মিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফুলটা মিরার কানের পাশে আলতো করে গুঁজে দিতে দিতে মিহি গলায় বলল, “ঠিক আছে বেগম, আপনাকে কোনো উত্তর দিতে হবে না। বাট আই শ্যাল ওয়েট ফর ইউ ফর ইটার্নিটি (চিরকাল), মাই কুইন ভিক্টোরিয়া।”
মিরা মৃদু শ্বাসে কারানের কথাগুলো শুনল। তার মনে কষ্ট থাকলেও কারানের মমত্ববোধের কোমলতা তার মনে একরাশ নীরব সান্ত্বনা এনে দিল। কারানের এই ধৈর্যশীল ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি তাদের সম্পর্কের মাঝে আশার একটি ক্ষীণ আলো হয়ে জ্বলে রইল।
মিরা পিছনে ফিরে চরম বিস্ময়ে কারানের দিকে তাকিয়ে রইলো। কারান সামান্য হেসে নিজের হাত দিয়ে মিরার চোখ বন্ধ করে দিল। তারপর মিরার চোখের উপর স্নেহপূর্ণ একটি চুমু রাখল। সে চুমু ছিল শুধুমাত্র মিরার মন ভালো করার জন্য।

মিরা চোখ খুলে তাকাতেই, কারান হাসি মুখে তার হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে গেল। টেবিলের কাছে এসে মিরার নজর সোজা চলে গেল সেই অপরূপ কেকের দিকে। যা তার সকল বিষাদ কুড়িয়ে নিয়ে নতুন আনন্দে পূর্ণ করে দিল। মিরা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ শুধুই কেকটিকে লক্ষ্য করল।
সে মনে মনে মুচকি হেসে বলল, “ইশশ, কেকটা কত সুন্দর! ‘মিরান’, বাহ! নামটা তো বেশ লাগছে।”
এরই মধ্যে কারান আস্তে আস্তে বাকি খাবারগুলোর ঢাকনা খুলতে শুরু করলো। একে একে মিরার চোখে পড়তে লাগলো তার প্রিয় সব খাবার। মুহূর্তের মধ্যে মুখ খুলে বলেই ফেললো, “এগুলো… এগুলো তো সব আমার পছন্দের খাবার। আপনি কীভাবে জানলেন? আর সন্দেশ যে আমি অনেক ভালোবাসি, আপনাকে তো কখনো বলিনি।”
কারান হেসে বললো, “আপনি খুশি তো?”

“না হয়ে উপায় আছে? আর কত সারপ্রাইজ করবেন আমাকে? হে আল্লাহ!”
“ইলিজা আর আপনার মায়ের থেকে জেনে নিয়েছিলাম।”
মিরা ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসি রেখে বললো, “আপনি তো আমাকে ঋণী করে ফেললেন। এত কিছু করেছেন যে আমার… আল্লাহ! আপনাকে কী গিফট দেওয়া যায় বলুন তো?”
মিরা আনমনে বলে, “কি রাগ দেখাবো আমি? নিজেকে এখন সত্যিই মহারানি মনে হচ্ছে।”
কারান হেসে দৃপ্তস্বরে বলে, “তুমি তো অলরেডি আমাকে সবচেয়ে অমূল্য উপহারটি দিয়ে দিয়েছো, মিরা। সেই উপহার এমন এক অতুলনীয় রত্ন, যা কোনো ভাষা বা মূল্য দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমি যা-ই করি না কেন, পুরো পৃথিবী একত্র করলেও সেই উপহারের কাছে তা তুচ্ছ মনে হবে।”
মিরা অবাক হয়ে কপাল কুঁচকে বললো, “কই, আমি তো আপনাকে কখনোই কোনো গিফট দিইনি।”
কারান গভীর চাহনিতে বললো, “দিয়েছো। ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে অমূল্য গিফটটা তুমি আমাকে দিয়েছো।”
মিরা কিছুটা হতবাক হয়ে জানতে চাইলো, “কী গিফট?”

“তুমি।”
মিরা এবার সত্যিই সুমধুর হাসিতে ভেসে গেল। কারান হেসে বললো, “এবার কেকটা কাটুন, মিসেস চৌধুরি।”
“ওহ, হ্যাঁ।”
কারান আর মিরা একসাথে ছুরি ধরে কেকের এক টুকরো কেটে নিলো। কারান স্বচ্ছ হাসি দিয়ে টুকরোটি তুলে মিরার ঠোঁটে পৌঁছে দিল। মিরা নিজে খেয়ে, একইভাবে কারানকেও খাইয়ে দিল। তারপর সে হেসে খেলার ছলে কেকের ক্রিমের এক অংশ তুলে কারানের গালে আলতো করে লাগিয়ে দিল।
কারান হেসে বলল, “বড্ড রোমান্টিক হয়ে গেছেন দেখছি।”
“হুম, বাট আপনার কাছে এই রোমান্স তো কিছুই না। এখন আপনিও লাগিয়ে দিন।”

অকস্মাৎ কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “No, I don’t want to risk any infection on your face from using this.”
“But Karan, it’s a normal thing. Mahi and I have used it before. Besides, I don’t have any allergies to cake,” বলে মিরা মন খারাপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মিরার মন বিষণ্ন দেখে কারান আর কাঠিন্য ধরে রাখতে পারল না। এবার একটু দুষ্টুমির ছলে নিজের গাল মিরার গালের সাথে আলতোভাবে ঘষে দিয়ে তার গালেও কেক মাখিয়ে দিল। তারপর একটুখানি হাসি ঝরিয়ে বলল, “এবার তৃপ্ত তো আপনি?”

মিরা একটু লজ্জা মেশানো হাসি দিয়ে জবাব দিল, “হুম।”
“ঠিক আছে, এবার খাবারগুলো চেখে দেখুন। আপনার প্রিয় স্বামী নিজ হাতে সব তৈরি করেছে।”
“আমি জানি, ভালোই হবে।”
কারানের মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠে। কারান বলল, “ওয়াও! প্রথমবার আপনার মুখে আমার প্রশংসা শুনলাম। এনিওয়ে, এবার শুরু করুন।”
“কিন্তু এতগুলো খাবার কে খাবে?”
“আর কে! আমরা। তবে আমি কোনো কিছুই খুব বেশি পরিমাণে বানাইনি, যেন অপচয় না হয়।”
মিরা মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”
তারপর একে একে সব খাবারের স্বাদ নিতে শুরু করল। সঙ্গে কারানকেও চামচ দিয়ে খাইয়ে দিল। কিন্তু মিরার খোলা চুল বারবার খাবারের মধ্যে পড়তে থাকায়, মিরার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। কারান সেই অসুবিধা টের পেয়ে একহাতে আলতো করে মিরার চুলগুলো পেছনে সরিয়ে ধরে রাখল। মিরা একচিলতে হাসি ঝরিয়ে বলল, “এভাবে কতক্ষণ ধরে রাখবেন? দাঁড়ান, আমি উপর থেকে একটা রাবার ব্যান্ড নিয়ে আসি।”
সে পা বাড়াতেই কারান দ্রুত বলে উঠল, “থামো। আমি নিয়ে আসছি। তুমি বসো।”
কথা শেষ করেই সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে খুঁজে একটি রাবার ব্যান্ড বের করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে নিচে নেমে এলো। মিরার কাছে এসে নিজ হাতে তার চুল যত্ন করে বেঁধে দিল। এরপর এক টুকরো হাসি ছড়িয়ে বলল, “এবার নিশ্চিন্তে খাও।”
মিরা চুপচাপ কারানের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
সে ঢোক গিলে আপন মনে বলল, “এগুলো আমার কল্পনাতেও আসে না। এতটা গভীর ভালোবাসা, এতটা যত্ন… স্বপ্নের বাইরে কিছুই নয়।”
তারপর একটু থেমে ক্ষীণ গলায় বলল, “আমাকে একটা চিমটি কাটবেন?”
কারান অবাক হয়ে হেসে বলল, “কী বলছ?”

মিরা দৃষ্টি নামিয়ে খানিকটা ভেবে বলল, “সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে! আজ যা দেখলাম, যা অনুভব করলাম, সেগুলো… আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয় যেন আমার শব্দগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে বলব, বুঝতেই পারছি না।”
কারান নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মিরার হাত ধরে মৃদু হাসি ঝরিয়ে বলল, “এবার খাওয়া শেষ করুন, বেগম। অযথা চিন্তা করে আমার বউয়ের মাথায় চাপ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।”
“আর পারবো না, কারান।”
“ওকে, বেইবি। আর খেতে হবে না।”
এবার মিরা তার গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার একটা উইশ পূরণ করবেন?”
কারান মুখে প্রশস্ত হাসি এনে বলল, “অবশ্যই, আপনার সব ইচ্ছে পূরণ করব, যদি তা কারান চৌধুরীর সাধ্যের মধ্যে থাকে। বলুন, আপনার সেই ইচ্ছেটা কী?”
মিরা ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আবেগ মাখা কণ্ঠে বলল, “আমি চাই, আমাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সমস্ত অনাথ শিশুদের খাওয়াতে।”

“ব্যস, এতটুকুই? আর কোনো উইশ নেই?”
“এই মুহূর্তে এটুকুই পূরণ করুন।”
কারান মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল আমি অরফান শিশুদের খাওয়ানোর জন্য নিজে সমস্ত আয়োজন করব।”
মিরার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। সে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “থ্যাংক ইউ সো মাচ। আর আমিও কিন্তু আপনার সঙ্গে যাব।”
মুহূর্তে কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “না, মিরা। তুমি মেয়ে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে? তাও কিনা কারান চৌধুরীর স্ত্রী হয়ে! আমি সব সুষ্ঠুভাবেই ম্যানেজ করতে পারব। তোমার কোনো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
“ঠিক আছে, আপনি যা ভালো মনে করেন। কিন্তু কারান, আমরা কি একটা এতিমখানার দায়িত্ব নিতে পারি না?”
কারান মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে বলল, “অবশ্যই পারি। বরং আমি তোমার জন্য একটা ওরফানেজ খুলে দেব। তুমি সেখানে চেয়ারপারসন থাকবে। আর প্রতি সপ্তাহে তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে সমস্তকিছু নিজে দেখাশোনা করবে। কেমন?”

মিরার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। খুশির সুরে বলল,
“আপনি জানেন না, আমি ঠিক কতটা আনন্দিত। এটা আমার জীবনের অন্যতম বড় সুখের মুহূর্ত।”
কারান আপনমনে বলে, “তোমার এই হাসিটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়, সুইটহার্ট। সবসময় তোমাকে এমনই খুশি দেখতে চাই।”
উঁচু আওয়াজে বলল, “এন্ড টু সেলিব্রেট দিস জয়, লেটস হ্যাভ আ ড্যান্স টুগেদার টুডে।”
মিরা হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। কারান রিমোট তুলে একটি সুরেলা গান চালিয়ে দিল। তারপর মিরাকে আলতো টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। গানের সুরে তাল মেলাতে মেলাতে কারান নিজেও গুনগুন করে গাইতে লাগল, “অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে।”
মিরাকে নিবিড় করে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“কাছে আসো না, আরও কাছে আসো না।
ইশ, কোনো কথা বলো না, কিছু কথা বলো না।”
মিরা চোখ-মুখ কুঁচকে নাক সিটকে বলল, “ছি! আপনার গানের চয়েজ এত বাজে।”
শুনে কারান একটু লজ্জায় পড়ে গেল। গানটা তো সে নিছক মজার ছলেই ছেড়েছিল। তাই বলে এমন অবজ্ঞা?
খুক করে কাশি দিয়ে সে গান বন্ধ করে বলল, “চলো, এবার আমার সবচেয়ে ফেবারিট একটি গান প্লে করি।”
তারপর রিমোট হাতে নিয়ে আরেকটি গান চালাল। মৃদু আলো আর সুরের আবেশে সে মিরাকে হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। তার গভীর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো,

“I found a love, for me…
Darling, just dive right in and follow my lead…
Well, I found a girl, beautiful and sweet.
Oh, I never knew you were the someone waiting for me…”
কারান ডান হাত আলতো করে মিরার কোমরে রাখল, আর অন্য হাত মিরার হাতের সাথে মিলিয়ে ধীরে ধীরে নৃত্যের ছন্দে এগিয়ে চলল। গানের সুরের সাথে তার কণ্ঠেও মুগ্ধতার জাল বুনল।
“I will not give you up this time…
But darling, just kiss me slow.”
এই লাইনটি গেয়ে থেমে হালকা হাসি ছড়িয়ে কারান মিরার ঠোঁটের দিকে একটুখানি দৃষ্টি ফেলল। তার চোখে ভালোবাসার নীরব ভাষা ফুটে উঠল।

“Your heart is all I own
And in your eyes, you’re holding mine…” বলে কারান মিরাকে আলতোভাবে শূন্যে তুলে ঘুরিয়ে নিল। মিরার চুলগুলো বাতাসে উড়তে লাগল, আর তার মুখে বিস্মিত হাসি ঝরে পড়ল।
তারপর কারান আরও গভীর চাহনিতে গানটি ধরে রাখল। যেন প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসছে,
“Baby, I’m dancing in the dark
With you between my arms.
Barefoot on the grass.
Listening to our favourite song.
When you said you looked a mess,
I whispered underneath my breath,
But you heard it.”

এরপর মিরাকে ধীরে ধীরে মাটিতে নামিয়ে কারান তার মুখের কাছে এতটাই এগিয়ে এলো যে তাদের নিশ্বাস একে অপরকে স্পর্শ করছে। কারান নীচু স্বরে গানের শেষ লাইনটি বলে উঠল,
“I don’t deserve this, darling, you look perfect tonight.”
এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা তাদের ঘিরে ধরল। একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের সঙ্গে তাদের হৃদয়ের তালে ভালোবাসার সুর বেজে উঠল।
কারান আর মিরার মধ্যে সৃষ্ট ক্ষুদ্র দূরত্বটি অদ্ভুত উত্তে”জনায় পরিণত হলো। দুজনেই ঢোক গিলে একে অপরকে শীতল দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করল। হঠাৎ কারান নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে মিরার ঠোঁটে একে একে অবিরাম চুম্বন করল। দুজনই চোখ বন্ধ করে নিল। মিরাও হয়ত এই চুমুর জন্যই অপেক্ষা করছিল। তার নিশ্বাস গভীর হলো। শরীর অস্থির হয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে চাইল।
মিরা আজ আর আটকালো না, কারানকে সমর্থন দিল। মিরার কারানের ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মেলানোর গভীর ইচ্ছা সত্ত্বেও, মনে যেন অচেনা বাঁধা অনুভূত হচ্ছে-‘অন্য নারী’। তাই মিরা নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা করলো, কিন্তু এরপরও তার হাত গড়িয়ে গেল কারানের ঘাড়ে। মিরার স্নিগ্ধ স্পর্শ কারানের উন্মাদনা তীব্র করে তুলল।
কারান মিরাকে দু হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মিরার উপরের ওষ্ঠে নিচের ওষ্ঠে বারংবার নিজের ঠোঁটের মধ্যে আয়ত্ত করে নিল। প্রতিটি চুম্বনে তার আত্মা মিরার মধ্যে মিলিয়ে যেতে চাইছে। মিরার হাত দুটি দেয়ালে চাপা দিয়ে, কারান তার শরীরের প্রতিটি অংশে নিজেকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরল। মিরার শরীর উত্তেজনায় জ্বলে উঠল। কারানের সুগন্ধির ভ্যানিলা, চন্দনকাঠ আর মিষ্টি ফুলের সুবাস মিরার চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেই, অদৃশ্য মোহ তাকে কারানের দিকে টেনে নিল।

কারান ক্ষণকাল পর নিজের ডান হাতে মিরার একটি হাত দেয়ালে চেপে ধরে, বাম হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে তাকে আরও কাছে টেনে তাকে নিজের উদরের সাথে মিশিয়ে নিল। তাদের দেহের উষ্ণতা একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছিল। আর কারান এই গভীর চুম্বনে নিজেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলল। কিন্তু মিরার শরীরে ধীরে ধীরে অস্বস্তি ভর করল, কারণ কারানের চুম্বন ক্রমেই আরও গভীর ও তীব্র হয়ে উঠল।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ ব্যথার অনুভব করে মিরার চোখে জল চলে এলো। ব্যথার সেই অনুভূতি তার অন্তরের গভীরে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে কারান কোনো দিকেই খেয়াল না রেখে মিরার ঠোঁটের ওপর চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছে, এতটাই তীব্রভাবে যে মিরার ঠোঁটের কোণায় র”ক্তের ক্ষীণ ধারা বেয়ে নামতে শুরু করল। মিরা অসহায়ভাবে তাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কারণ কারান তার বদ্ধ উন্মাদনায় মগ্ন।
শেষমেশ অসহ্য ব্যথার তীব্রতা বেড়ে ওঠায় মিরা সমস্ত শক্তি দিয়ে কারানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। তীব্র শ্বাস নিতে নিতে তার মুখে কষ্টের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল।
কারান বড় বড় নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে, ঘোর লাগা চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে নেশায় আচ্ছন্ন গলায় বলল, “কি হয়েছে, জান?”

মিরা নিরুত্তর, ডান হাতের মাঝের আঙুল দিয়ে ঠোঁটের কোনায় আঙুল নিয়ে দেখল র”ক্ত পড়ছে। মিরা ভাঙা ভাঙা গলায় গম্ভীরভাবে বলল, “আপনি কি মানুষ? আর একটু হলেই আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যে…”
তবে মিরাকে কথাটি শেষ করার সুযোগ না দিয়েই, কারান দৌড়ে এসে মিরাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরল। গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “একবার বলেছি না, এসব কথা আর কখনো বলবে না।”
মিরা শক্তি দিয়ে কারানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আহত গলায় বলল, “ছাড়ুন আপনি, র”ক্ত বের হচ্ছে আমার ঠোঁট থেকে।”

কারান অবাক হয়ে মিরার থুতনি ধরে মুখ তুলে ঠোঁটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “কই দেখি?”
কারান দেখতে পেল, সে এমন দুর্দমন উন্মাদনায় মিরাকে চুম্বন করেছিল যে, তার নরম ঠোঁটের একাংশ ছিঁড়ে রক্তিম হয়ে গেছে। অথচ একফোঁটা অপরাধবোধও কারানের চোখে প্রতিফলিত হয়নি। বরং মুহূর্তকাল নীরব থেকে, সেই ক্ষতবিক্ষত ঠোঁটটিই আবার তার ঠোঁটের মাঝে পুরে নিল। এবার আলতো কোমলতায় চুম্বন করল। যেন এই চুম্বনের গভীরতায় সে মিরার রাগকে ধুয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এ তো আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করল। মিরা চোখ বন্ধ করলো না। মিরার মুখশ্রী কঠিন হয়ে উঠল। তার চোখে প্রবল ঘৃণা ও হতাশা ঝলসে উঠল।
কারান ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে মধুর সম্মোহনী গলায় বলল, “একটু পরে ওষুধ লাগিয়ে দিব, সোনা। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি জানো, এই ব্যথা তোমাকে একবার নয়, হাজারবার সহ্য করতে হবে। বিকজ হোয়েনএভার ইউ আর উইথ মি, আই উইল হোল্ড ইউ সো ডিপলি দ্যাট দিস পেইন উইল ওয়ান ডে টার্ন ইনটু আ মিস্টিরিয়াস প্লেজার, নোন অনলি টু আস।”

মিরা হতবাক। যন্ত্রণার মুহূর্তে কারান তার কাছে আশ্রয় হয়ে উঠবে ভেবেছিল। ভেবেছিল হয়ত একবিন্দু মমতা ঝরবে তার চোখ থেকে। কিন্তু তার ঠোঁট-ফাটা র”ক্তের উপর এ কেমন কথার তীক্ষ্ণ ছুরি চালাল সে?
এদিকে কারানের গভীর, নেশায় ঘোলাটে চোখদুটি মিরার আত্মার কণ্ঠচিৎকারকে স্তব্ধ করে দিল। কারানের নেশায় নুয়ে থাকা চোখের দৃষ্টি মিরাকে বুঝিয়ে দিল, এখন এখানে থাকা মানে নিজের সমস্ত সত্তাকে অনুগ্রাসনের অনুমতি দেওয়া।

সে আর দেরি না করে পলায়নের প্রয়াস নিল, কিন্তু কারানের বাহু এক ঝটকায় তাকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে সোফায় শুইয়ে দিল। মিরা শ্বাসের ভারে ক্লান্ত গলায় বলল, “কা-কারান, কী করছেন আপনি?”
তার কণ্ঠে লজ্জা, সংশয় মিশে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু কারানের চোখ ততক্ষণে তার মুখমণ্ডলের প্রতিটি রেখা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। মিরার শরীরের প্রতিটি কোষে বিদ্যুৎ খেলে যেতে থাকে। হৃদয়ের স্পন্দন যেন স্তব্ধ হতে গিয়ে আরও উন্মত্ত হয়ে ওঠে। কারান ধীরে ধীরে তার দিকে ঝুঁকে এলে মিরার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে ওঠে, অনুভূতির ঝড় বয়ে যায় দেহমন জুড়ে।

কিছুক্ষণ আগেও ঠোঁটে জ্বলে ওঠা সেই যন্ত্রণার তীব্রতা তাকে কুঁকড়ে দিয়েছিল, অথচ এই মুহূর্তে তা যেন নির্বাপিত হয়ে গেছে। মনোযোগ এখন কেবলই কারানের চোখে; সেই চোখের বিস্ময়কর নিষ্ঠুর মমতা ভয়ংকর অথচ আকর্ষণীয় লাগছে তার কাছে। মিরা একটি চাপা ঢোক গিলে ফেলল।
কারান মিরার ঠোঁটে আঙুল রেখে গম্ভীর স্বরে বলল, “হুশশশ…চুপ। একদম চুপ।”
মিরা বুঝে গেল—পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারান যেকোনো মুহূর্তে সীমা অতিক্রম করতে পারে। তার ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাসই সেই ইঙ্গিত বহন করছে। মিরা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই, কারান হঠাৎ তার উপরে উঠে নিজেকে তার ওপর আরোপ করল। তার উত্তপ্ত নিশ্বাস এসে মিরার মুখমণ্ডলে পুঞ্জীভূত উষ্ণতার ছাপ রেখে যেতে লাগল। মিরার শরীর অনিচ্ছায় কেঁপে উঠলো। গলা কাঁপিয়ে সে বলেই ফেলল, “কারান, আমি কিন্তু তোমাকে এর শাস্তি দেব। সত্যি বলছি। এখনও থামতে বলছি।”

মিরার কণ্ঠে ‘তোমাকে’ শব্দটি কারানের অন্তরে নেশার মত ঢুকে গেল। ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে সে চাহনির সমস্ত ঘোর নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “মঞ্জুর। সব শাস্তি মঞ্জুর।”
এরপর মোহের মোহনায় এক নিমিষে হারিয়ে গেল কারান। নিঃশব্দ উষ্ণতায় সে মিরার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। তার ঠোঁট বারবার মিরার গলার বা পাশ ছুঁয়ে গেল। প্রতিটি চুম্বনে একখণ্ড ভালোবাসার সুর আঁকা হলো। মিরা চোখ বুজে নিল। তার শ্বাস দীর্ঘ ও ভারী হয়ে উঠল। কারানের স্পর্শে তার সত্তার প্রতিটি স্তর গলে যেতে লাগল। মিরার চোখের কোন বেয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তবে এ জল কষ্টের নয়, পরম শান্তির। তার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে, আর শরীরের প্রতিটি কোষে অচেনা মধুর শিহরন খেলে যাচ্ছে।
তারপর কারান মিরার গলার ডান পাশে চুম্বনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করল। এমনভাবে যে সেই স্থানটি শুধুই তার। প্রতিটি স্পর্শে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো প্রবল আবেগ ছুটে বেড়াল মিরার সারা শরীর জুড়ে। কিছুক্ষণ পর কারান গাঢ় নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। নিজের কোটটিকে খুলে অনবধানী ভঙ্গিতে ছুঁড়ে ফেলল। টাই আলগা করল, আর কব্জির ঘড়িটি খুলে টেবিলে রাখল। অর্থাৎ শরীরে অতিরিক্ত পরিহিত এসবের এখন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কেবল অনুভবের।

এই ফাঁকে মিরা পালাবার ক্ষীণ প্রচেষ্টা করল; দ্রুত সোফা থেকে উঠতে গেল। কিন্তু কারান আগেই আঁচ করেছিল, তাই এক টানে মিরার চুলের রাবার ব্যান্ড খুলে দিল। মুক্তির স্বাদ পাওয়া মসৃণ চুলগুলো আলতো বাতাসে দুলে উঠল। এরপর মিরার হাত ধরে তাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিল। এমনভাবে যেন দুই শরীরের মাঝখানে একটুও ফাঁক না থাকে। তার কানে গুঁজে রাখা ফুলটি খুলে নিয়ে টেবিলে রাখল।
তারপর পেছন থেকে মিরার চুল সরিয়ে নিল সে। তার ঘাড়ে একের পর এক চুম্বনের বন্যা বইয়ে দিল। প্রতিটি স্পর্শে মিরার শরীর জুড়ে অভূতপূর্ব অনুভব জেগে উঠল। কারানের নিশ্বাস আগুন হয়ে মিরার ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। সেই নিশ্বাসের হালকা ঝাপটায় মিরার কয়েকটি চুল বারবার উড়ে এসে মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

চোখ বন্ধ করে, দিশেহারা শিহরণে কাঁপতে কাঁপতে মিরা বলে উঠল, “কারান… প্লিজ। থামো না… প্লিজ, থামো।”
কারান মিরার কথায় আরো আনন্দের গভীরে ডুবে গিয়ে, তার ঘাড়ে একের পর এক আবেগময় গভীর চুম্বন এঁকে দিল। মিরার শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি স্পর্শে সে যেন একেবারে অবশ হয়ে পড়ছে। নিশ্বাসের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততম হয়ে উঠেছে। মিরার মনে হলো, নিজেকে কারানের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনো পথ নেই। কারান দুহাতে তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে থাকল। দুজনের শরীর এক হয়ে ঘেমে গেল।
মিরা উত্তে”জনায় ডুবে গিয়ে কারানের হাঁটুতে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। এমনভাবে যে তার নখের আঁচড় প্যান্ট ভেদ করে কারানের শরীরে প্রবাহিত হয়ে গেল। একসময় কারানের উরুতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হলো, তবে প্যান্টের রং কালো হওয়ায় র”ক্তের চিহ্ন দৃশ্যমান হয়নি।
কারান উত্তে”জনায় কাতর হয়ে তীব্র শ্বাস ছেড়ে বলল, “উফফ…”

তারপর সে মধুর হাসি দিয়ে মিরাকে আরও কাছে টেনে নিল। মনে হচ্ছে, দুটো শরীর এক হয়ে মিলিয়ে যাবে। অথচ কারান মিরার পিছনের জিপটা সামান্য খুলতেই তার মুখের সমস্ত উত্তে”জনা হারিয়ে গেল। কারানের চোখে অজানা উদ্বেগ আর হতাশার ছাপ ফুটে উঠল। তার ঘাড়ের শিরাগুলো ফুলে নীল হয়ে গেল। কারান মিরাকে নিয়েই সোফা থেকে নিচে পড়ে গেল, কিন্তু মিরা তখনও উ”ত্তেজনায় আচ্ছন্ন হয়ে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। হঠাৎ কারান চিৎকার করে উঠে বলল, “মিরাআআ!”
তার চিৎকারে মিরা চমকে উঠে চোখ খুলে ফেলে।
মিরা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কারানের দিকে চেয়ে ফিসফিসে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কি… কি হয়েছে? কি হয়েছে, কারান?”
কারানের চোখ উদ্বেগ আর কিঞ্চিৎ অশ্রুতে ভারী হয়ে উঠল। কাঁপা গলায় সে বলল, “এই… এই দাগ, মিরা! কীসের দাগ এটা? কীভাবে এলো?”

সে একের পর এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতে লাগল। মিরা চমকে উঠে দাঁড়াল। তার মুখে চিন্তার গভীর ছায়া ফুটে উঠলো। কণ্ঠে বিস্ময় আর উৎকণ্ঠার মিশ্রণ নিয়ে মিরা বলল, “দাগ? কীসের দাগ?”
কারান এক পা এগিয়ে এসে মিরাকে ধরে ঘুরিয়ে তার পিঠ দেখতে লাগল। গলা শুকিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল, “তো.. তোমার পিঠে, মিরা। লাল হয়ে গেছে। কেন এমন হলো? আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে। এটা… এটা কেন হলো, মিরা? হ্যাঁ? ”
তার চোখে আতঙ্কের গভীরতা ফুটে উঠে। কোনো গোপন আশঙ্কা তাকে গ্রাস করছে। মিরা আরো বিস্মিত হয়ে বলল, “কিন্তু দাগ হবে কেন? আর আসবে-ই বা কোথা থেকে?”

কারান অসহায় কণ্ঠে বলল, “জানি না, জানি না মিরা। তবে এটা নিশ্চিত, কিছুক্ষণ আগেও ছিল না। তুমি যখন শাড়ি পড়া ছিলে, তখন আমি স্পষ্ট দেখেছি, ত্বক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ এমন র‍্যাশ হলো কীভাবে? হুম?”
কারান ভেতরে ভেতরে অজানা শঙ্কায় ভেঙে পড়ল। কারানের এমন উৎকণ্ঠা দেখে মিরা বিস্ময়ে কারানের দুটো গাল দু-হাতে স্পর্শ করে শান্ত কণ্ঠে বলল, “কারান, আপনি শান্ত হোন। কিছুই হয়নি। এই পোশাক তো সচরাচর পরি না, হয়ত সেজন্যই র‍্যাশেস হয়েছে। তেমন কিছু গুরুতর নয়।”

কিন্তু কারানের চোখে ভয়ের ছায়া আরও গভীর হলো। সে কাঁপা গলায় বলল, “না, মিরা। এটা কেন হবে? কেন থাকবে? আমি তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেব না। জা…জানো, সেদিন যখন তোমার আঙুল কেটে গিয়েছিল, আমার মনে হয়েছিল, আমার.. আমার প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে। অথচ বাবা-মায়ের সামনে কিছুই প্রকাশ করতে পারিনি। আর আজ এই দাগ… উফফ! আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি ওষুধ নিয়ে আসি। না। না না, ওষুধে কাজ হবে না। ডাক্তার লাগবে।”

মিরা অবাক হয়ে বলল, “আপনি কীসব বলছেন, কারান? একটু পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আর ঠোঁট থেকেও তো র”ক্ত বের হয়েছিল, তখন তো এতটা উদ্বিগ্ন হননি। এখন কেন এমন করছেন?”
কারান মিরার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে গভীর কণ্ঠে বলল, “সেটা আলাদা। ঠোঁটের দাগটা আমার ভালোবাসার প্রতীক। কিন্তু এই র‍্যাশ? এটা.. এটা আমার মানসিক শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। চলো, ডাক্তারের কাছে যাই। এক্ষুনি চলো।” বলেই মিরার হাত ধরে টেনে বাহিরের দিকে নিয়ে চলল।
মিরা হতবাক হয়ে বলল, “কারান, আমি একদম ঠিক আছি। এত রাতে ডাক্তার পাবেন কোথায়? একটু শুনুন তো।”
কিন্তু কারান তার কোনো কথাই শুনল না। তাড়াহুড়ো করে গাড়ির কাছে গিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি উঠো, মিরা।”
“কারান, করছেনটা কি?”

কারান তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “মিরা, কথা বাড়িও না। দেখতে পাচ্ছ না, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি ওঠো।”
তার মুখে এমন দৃঢ়তা আর আতঙ্ক দেখে মিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। কারান শ্বাসের দমে হাঁপাতে হাঁপাতে মনে মনে বলল, “তোমার সৌন্দর্য এক অক্ষত শ্বেতপুষ্প, যার উপর কোনো কালিমা কিংবা ক্ষতচিহ্ন আমি কখনোই পড়তে দেব না, মিরা। কখনোই না।”
তারপর বুকের ভার হালকা করার চেষ্টা করতে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে লাগল।

মিরা দ্রুত গাড়িতে উঠে বসল। কারান নিজের হাত দিয়ে মিরার সিটবেল্ট আটকে দিল। পরক্ষণেই সে একহাতে গাড়ি চালাতে চালাতে আরেক হাতে ফোন তুলে ড. নওশীনকে কল করতে লাগল। মিরা স্তব্ধ দৃষ্টিতে কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কারান শুষ্ক বিবর্ণ কণ্ঠে বলল, “কিচ্ছু হবে না, বেবি। আমি তোমাকে কোনো কষ্ট পেতে দেব না।”
মিরা তার এমন উদ্‌ভ্রান্ত আচরণে অভিভূত হয়ে মনে মনে ভাবল, “ও এতটা উদ্বিগ্ন কেন? সামান্য র‍্যাশেসও সহ্য করতে পারছে না? এতটাই ভালোবাসে আমাকে? সত্যিই?”
কারানের চোখে অদৃশ্য কান্নার ছাপ ফুটে উঠল। প্রায় ভাঙা কণ্ঠে সে বলে উঠল, “এই.. এই ডাক্তার ফোন ধরছে না কেন? উফফ! মিরা, তুমি একদম চিন্তা করো না। আর.. আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব।”
সে আবারও ডাক্তারের ফোনে কল দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। মিরা কারানের এ অস্থির অবস্থা দেখে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেল।

বারবার ফোনের দিকে নজর দিয়ে গাড়ি চালানোর এমন বিপজ্জনক চেষ্টা দেখে, মিরা ধমকের সুরে বলল, “আপনি কী করছেন, কারান? এভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন করলে দুর্ঘটনা ঘটবে তো।”
কিন্তু কারান তার কথা কানেই তুলল না। পুরোপুরি নিজের উদ্বেগে ডুবে থাকা কারান নির্বিকারভাবে ফোনে কল দিতে ব্যস্ত। মিরা এবার কিছুটা অধৈর্য হয়ে জোর গলায় বলল, “কারান, দয়া করে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিন। ফোনটা নামান।”

Tell me who I am part 16

ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে একটি গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে তাদের দিকে আসতে শুরু করল। মিরার চোখ ভয়ে বড় হয়ে গেল। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, “কারাআআআআন!”

Tell me who I am part 18