Tell me who I am part 18
আয়সা ইসলাম মনি
মিরার হৃদয় উলটপালট হয়ে যায়, আতঙ্কের দপদপানি তাকে গাড়ির সিটে ঠেলে দেয়। তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে নেয় সে।
“মিরা।”
কারানের দৃপ্ত কণ্ঠ বিদ্যুতের মতো ছুটে এসে তার ভেতরের জমে থাকা ভয়টাকে এক ধাক্কায় ভেঙে ফেলে। বিস্ফোরিত চোখে মিরা দেখে, কারান ইতোমধ্যেই বিপদ এড়িয়ে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষে গাড়িটি থামিয়ে দিয়েছে। তার বুক ওঠানামা করছে, শ্বাস ভারী হয়ে এসেছে।
কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিরা সিটবেল্ট খুলে কারানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার, কান্নার ফাঁকে থেমে থেমে নিশ্বাস নিচ্ছে। কারানের ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা খেলে গেল, গভীর প্রশান্তিতে মিরাকে বাহুডোরে টেনে নিয়ে বলল, “তুমি কীভাবে ভাবলে আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দেব?”
উত্তরে মিরা কিছু না বলে তার বুকের ওপর ছোট ছোট ঘুসি মারতে লাগল। তার হাত কাঁপছে, অভিমান আর আতঙ্ক মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কারান ব্যথার ভান করে বলল, “আহ, মিরা! সত্যি লাগছে।”
মিরার কান্নাভেজা কণ্ঠে রাগের ঝাঁজ, “লাগুক। আমাকে আতঙ্কের মধ্যে রাখতে কি আপনার ভালো লাগে?”
কারান হেসে তার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। তারপর গাড়ির গ্লোভ বক্স খুলে টিস্যুর বাক্স থেকে একখানা টিস্যু বের করে মিরার চোখ মুছে দিয়ে বলল, “কান্না বন্ধ করো, বাবা। কিচ্ছু হয়নি। সবসময় নাকের ডগায় কান্না লেগেই থাকবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গভীর নিশ্বাস নিয়ে মিরা কান্না থামিয়ে কারানের বুকে মাথা চেপে ধরল। স্বরে অস্পষ্ট আতঙ্ক, “হয়েছে, আর কোথাও যাব না। বাসায় ফিরে চলুন। আমার ভালো লাগছে না।”
কারানের মুখ থেকে এক নিমেষে হাসি উবে গেল। চোখের উজ্জ্বলতা নিভে গিয়ে তার মুখে কঠিন ছায়া নেমে এল।
“না, মিরা। তোমার র্যাশেস…না, এখন আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা যাবে না।”
আর বিলম্ব না করে, কারান মিরার সিটবেল্ট ঠিক করে দিয়ে আবার গাড়ি চালানো শুরু করল। বিস্ময়ে হতবিহ্বল মিরা এক দৃষ্টিতে কারানের দিকে তাকিয়েই বাকি পথটুকু অতিক্রম করল।
ডাক্তার নওশীনের বাড়িতে পৌঁছেই কারান তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে উঠল, “ডাক্তার নওশীন! ডাক্তার নওশীন!”
তার এমন ব্যাকুল আচরণ দেখে মিরা হতভম্ব। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে কারানের বাহু চেপে ধরে বলল, “কারান, থামুন প্লিজ। আমি একদম ঠিক আছি।”
কারানের চোখে তীব্র উৎকণ্ঠা। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ক্ষীণস্বরে বলল, “তুমি ঠিক নেই, মিরা…”
বলেই আবার চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, “ডাক্তার নওশীন!”
“কারান, এখন রাত দুইটা বাজে। এত রাতে এভাবে চিৎকার করা কেমন দেখায়, বলুন?”
কারান এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। পরক্ষণেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল, “তুমি এটা দেখতে পারলে, কিন্তু আমার অবস্থা বুঝলে না? মিরা, তুমি কি টের পাচ্ছ না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার শরীরের… উফফ, আমি আর নিতে পারছি না।”
সে আবারও গলা চড়িয়ে ডাকতে শুরু করল, “ডাক্তার নওশীন! ডাক্তার নওশীন!”
কারানের নিশ্বাস দ্রুততর হচ্ছে। এ সময় পাহারাদার ছুটে এসে, কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “স্যার, এত রাতে এভাবে চেঁচামেচি করছেন কেন? কী দরকার, আমাকে বলুন।”
“ডাক্তার নওশীন কোথায়? ওনাকে ডাকুন। এক্ষুনি।”
“সরি, স্যার। এত রাতে ডাক্তার ম্যামের কাছে নিয়ে যাওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আপনি কাল সকালে আসুন। এখন দয়া করে চলে যান।”
কারান বিস্মিত দৃষ্টিতে পাহারাদারের দিকে চেয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল, “আপনি জানেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন? যা বলছি, তাই করুন। ডাক্তার নওশীনকে ডাকুন। নাহলে আমাকে গেট ভেঙে ঢুকতে হবে।”
সে হাঁসফাঁস করতে করতে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে পুনরায় বলল, “জলদি ডাকুন।”
পাহারাদার চোখ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, “সরি, স্যার। তাহলে আমিও আর ভদ্রতা বজায় রাখতে পারবো না। আপনি ফিরে যান।”
শব্দগুলো কারানের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। মুহূর্তেই তার ক্রোধ উগ্র হয়ে উঠল। উন্মত্তের মতো লোকটার কলার টেনে ধরে ঘুসি মারতে উদ্যত হতেই মিরা আতঙ্কিত স্বরে চিৎকার করে উঠল, “কারান! কি করছেন আপনি? ছেড়ে দিন ওনাকে।”
কারান পিছন ফিরে মিরার চিন্তিত মুখশ্রী দেখে নিজেকে সংযত করল। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, তারপর ধীরে ধীরে লোকটার কলার ছেড়ে দিল। চেঁচামেচির শব্দে, দোতলার বারান্দা থেকে ডাক্তার নওশীনের কণ্ঠ শোনা যায়, “আরে, কারান স্যার আপনি? রাফেজ, ওনাদের ভেতরে ঢুকতে দাও।”
কিছুক্ষণ পর বৈঠকখানার সোফায় বসে ডাক্তার নওশীন মিরার পিঠ পরীক্ষা করল। তার পিঠে ক্যালামাইন লোশন মেখে দিয়ে ওষুধ লিখে দিল। কারান সোফার পাশে দাঁড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল।
নওশীন নির্ভার কণ্ঠে বলল, “স্যার, টেনশন করার কিছু নেই। আমি মেডিসিন লিখে দিয়েছি। (থেমে) আচ্ছা, আমার কাছেই এই ওষুধটা আছে। একটু অপেক্ষা করুন।”
সে দোতালায় চলে গেল। নওশীন চলে যেতেই কারান মিরার পাশে বসে তার পিঠের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, সব ঠিক আছে কি না।
মিরা বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে, সামনের চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে একপাশে নিয়ে পিঠে ছেড়ে দিল।
কারান স্বচ্ছ হাসিতে বলল, “এমন ভাব করছো, যেন মনে হচ্ছে অন্য কেউ দেখছে।”
মিরা আরও লজ্জায় রাঙা হয়ে সংযত স্বরে বলল, “আপনি সরুন তো। আপনি কাছে থাকলেই আমার বডি টেম্পারেচার হাই হয়ে যায়।”
এটা শুনে কারান মিরার লজ্জা বাড়ানোর জন্য স্মিতহাস্যে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নওশীন ফিরে এলো। কারান তৎক্ষণাৎ উঠে পাশে দাঁড়াল।
নওশীন একটু খুকখুক করে কেশে নিয়ে বলল, “স্যার, এই মেডিসিনটা নিয়মমতো খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আর ম্যাম, আপনার ঠোঁটের কয়েকটা জায়গা কেটে গেছে। এজন্য একটা মলম লিখে দিয়েছি, সেটি লাগালেই সেরে যাবে।”
এ কথায় মিরা লজ্জায় গুটিয়ে গেল। আড়চোখে কারানের দিকে তাকিয়ে সে নিশ্বাস ফেলল। কারান চোখ ঘুরিয়ে মুচকি মুচকি হেসে বিড়বিড়িয়ে বলল, “এই মলমটা যে দিনে কয়বার লাগাতে হবে, বেগম।”
এবার সরাসরি বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, ডক্টর। অ্যান্ড আ’ম এক্সট্রিমলি সরি টু বোদার ইউ দিস লেট অ্যাট নাইট।”
নওশীন সহজ ভঙ্গিতে হাসল, “ইটস ওকে, স্যার, নো প্রবলেম। আফটার অল, আমি তো আপনার ফ্যামিলি ডাক্তার। আর আপনার কাছে তো পার্সোনাল নাম্বারটা দেওয়া, ঐটা আসলে সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুইদিন রেস্টে আছি তো। আচ্ছা, আপনাকে অফিসিয়াল নাম্বারটা মেসেজ করে দিচ্ছি, পরেরবার ওটাতে কল দিলেই পাবেন। আর ম্যাম, চিন্তার কিছু নেই, কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”
মিরা মাথা নাড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, “জি।”
কারান মিরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, “তাহলে এবার চলো। বাই, ডাক্তার।”
নওশীন হেসে বিদায় জানাল। মিরা কারানের হাত ধরতেই সে ধীরপায়ে এগিয়ে চলল।
বাড়িতে ফিরেই মিরা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আপনি আর এমন কাজ করবেন না তো। এতটুকু ব্যাপারে এত হা-হুতাশ করলে চলবে?”
কারান চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, “এটা ছোট ব্যাপার না, মিরা। তুমি কি বুঝতে পারো না, তুমি আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?”
মিরা কারানের গভীর দৃষ্টি দেখে একটু নরম হয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার চলুন ঘুমাতে যাই। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে আজ।”
কারান মিরার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “হুম, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি ঘুমাবেন না?”
“আমি ঘুমালে ড্রয়িং রুমের বেহাল দশা ঠিক করবে কে?”
মিরা একটু শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল, “থাকুক না, এখন ঘুমিয়ে যান। ওগুলো কাল আমি গুছিয়ে দেব। (হেসে) তাছাড়া আমার তো ড্রয়িং রুমটা এমনই বেশ ভালো লাগছে। থাক না কয়দিন এভাবেই।”
কারান ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসল, “আচ্ছা।”
“হুম, এবার আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন। সারাদিন এত কিছু করেছেন, আপনিও তো ক্লান্ত।”
“তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, সোনা। আমি শুধু ডিসগুলো ওয়াশ করে আসি।”
“কাল সকালে করলে হতো না?”
কারান মিরার কাছে এসে তার মুখের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে রোমান্টিক ভঙ্গিতে বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও… তোমার কি ঘুমাতে আমাকে লাগবে? আই মিন, আমার বেগম কি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারবে না? হুম?”
এই কথাটা শোনা মাত্র মিরা কোনো উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে লজ্জা লুকিয়ে অন্য কক্ষে চলে গেল। ভেতরে গিয়ে তাড়াতাড়ি পোশাক পরিবর্তন করে শাড়ি পরে নিল। ফের ফিরে এসে কারানকে এক ঝলক দেখে হালকা হাসল, তারপর নিঃশব্দে বিছানায় শুয়ে অন্যদিকে ফিরে গা এলিয়ে দিল।
কারান মিরার এই চটজলদি বদলানো ভাবভঙ্গি দেখে হাসল। তারপর নিজেও পোশাক পরিবর্তন করে নিচে নেমে গেল।
নিচে গিয়ে ওয়াটারপ্রুফ এপ্রোনে গা গলিয়ে দিয়ে থালাবাসন ধোয়া শুরু করল। কিচেনের নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে পানির ঝিরঝির শব্দ আর থালাবাসনের হালকা টুংটাং শব্দে ভাঙছিল। ধোয়া শেষ করে সব গুছিয়ে রেখে ধীর পায়ে ওপরে উঠল। তার একমাত্র আকর্ষণ, তার মনোহরিনী পত্নীকে একবার দেখে নিতে হবে যে।
গিয়েই দেখে, মিরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কারান নিঃশব্দে মেঝেতে বসে মিরার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে রইল। এই একমাত্র দৃশ্যই তার সমস্ত ক্লান্তি মুহূর্তের মধ্যে মুছে দিতে জানে। মিরার কপালের ছোট ছোট চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিয়ে সে আবার তাকিয়ে থাকল। তার দৃষ্টি স্থির অথচ গভীর; এক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার তৃষ্ণা যেন শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না।
একসময় সে ঢোক গিলে উঠে পাশের কক্ষে চলে গেল। কারণ সে জানে, এভাবে তাকিয়ে থাকলে তার ঘুমপরীর স্বপ্নের রাজ্যে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
পাশের কক্ষে গিয়েই আস্তে করে দরজা আটকে দিল। তারপর প্রজেক্টরে একটা ভিডিও চালিয়ে সামনে দাঁড়াল। একটু পর মদের বোতল খুলে গ্লাসে ঢেলে নিল। ভিডিওটা শুরু হতেই কারানের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে। মিরা, তার মিরা; লাল গাউনে মোহময়ী হয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসছে। লুকানো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে তাদের একান্ত মুহূর্তগুলো। স্ক্রিনে ফুটে উঠছে মিরার প্রতিটি অভিব্যক্তি—তার লজ্জা, তার দ্বিধা, তার উত্তেজনা। কারান মদের গ্লাস ঠোঁটে চেপে গভীর চুমুক দিল, আর স্ক্রিনে মিরার মুখের সেই অভিব্যক্তি দেখে তার ঠোঁটের কোনে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠল।
ভিডিওটা থামিয়ে দিয়ে সে ডান হাতের তর্জনী স্ক্রিনের মিরার ঠোঁটে ছোঁয়ালো। ঢোক গিলে মোহাচ্ছন্ন চোখে স্ক্রিনের মিরার সর্বাঙ্গ পরখ করে নিল। এক অদৃশ্য শিকল তাকে বেঁধে রেখেছে এই ফ্রেমের মধ্যে।
তারপর আবার চালিয়ে দিল ভিডিওটা। একবার, দু’বার, তিনবার… শতবার, হাজারবার; তার দৃষ্টি আটকে রইল মিরার প্রতিটি মুদ্রার ওপর। তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে, মোহাচ্ছন্ন চোখে শুধু দেখতেই থাকল।
তারপর গলা শুকিয়ে আসা কণ্ঠে সে ফিসফিস করে বলে, “আমার মিরা।”
শব্দগুলো উচ্চারিত হতেই কারানের হৃৎস্পন্দন যেন থেমে যেতে চাইল। মুহূর্তখানেক স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মদের গ্লাসে এক চুমুক দিল। কিন্তু এতেও নিজেকে সামলাতে পারল না, প্রবল আবেগে হাঁটতে হাঁটতে মিরার কক্ষে প্রবেশ করল।
ঘুমন্ত মিরার পাশে দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে তার শরীরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত নেশান্বিতভাবে ঘ্রাণ নিতে থাকল কারান। তারপর নিঃশব্দে মিরার মাথার পাশে মেঝেতে বসে, বিছানার কিনারায় কপাল ঠেকিয়ে মিরার প্রশান্ত মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিটোল, নির্ভার, প্রশান্ত মিরাকে দেখেই তার অন্তরাত্মা শান্তি খুঁজে পেল।
একটুপর নিজের মুখে হাত বুলিয়ে পুনরায় পাশের কক্ষে ফিরে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল শক্ত করে। অর্থাৎ মিরার সম্পূর্ণ কাছাকাছি গিয়ে না তার ঘুম ভাঙাতে পারছে, না আবার নিজেকে মিরার থেকে দূরে রাখতে পারছে।
প্রজেক্টরের পর্দায় তখনও মিরার উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা শরীরের প্রতিচ্ছবি ভাসমান, যা কারানের ঠোঁটের স্পর্শেই জ্বলে উঠেছিল। কারান বসে এক হাতে গ্লাস ধরে মদ পান করতে করতে, অন্য হাতে প্রজেক্টরের পর্দায় মিরার প্রতিচ্ছবির ওপর আঙুল বুলিয়ে দিতে থাকল।
ঢোক গিলে শুষ্ক গলায় ফিসফিস করল, “আমি তোমাকে কখনো হারাতে দেব না, মিরা। সারাজীবন তুমি আমার থাকবে। শুধুই আমার।”
কেননা, মিরা ছাড়া কারানের অস্তিত্বের সব অর্থ ফুরিয়ে যাবে।
এরপর কারান প্রজেক্টরের সেই দৃশ্যই বারবার দেখতে থাকল; মিরার সিঁড়ি থেকে নামার মুহূর্ত, তার উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা চাহনি। হাজারবার, লক্ষবার, শেষ রাত পর্যন্ত দেখতেই থাকল।
প্রভাতবেলা ঘুম ভাঙতেই মিরা পাশের জায়গাটা শূন্য পেয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। আশপাশে তাকিয়ে খোঁজাখুঁজি করেও কারানের দেখা না পেয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ডাকল, “কারান, কোথায় আপনি?”
এই মিষ্টি, সুরেলা ডাক শুনেই কারানের তন্দ্রাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠল। দ্রুত প্রজেক্টর বন্ধ করে, চারপাশ গুছিয়ে নিয়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমে। মাউথওয়াশ দিয়ে কুলকুচি করে নিয়ে, মদের বোতল আর গ্লাস লুকিয়ে ফেলল। চোখে-মুখে পানি দিয়ে সতেজ হওয়ার চেষ্টা করল। মুখে ব্রেথ স্প্রে ছড়িয়ে কয়েকবার গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলে দিল।
দরজা খুলতেই মিরার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “আপনি দরজা আটকে কী করছিলেন? আর আমি না উঠালে তো কখনো নামাজের জন্য জাগেন না, আজ এত ভোরেই উঠলেন যে!”
কারান শুকনো ঢোক গিলে নিল, কিন্তু গলায় যেন কিছু একটা আটকে গেল।
“আ-আজকে…” কথা শেষ করতে গিয়েও থেমে গেল সে।
মিরার চোখ তীক্ষ্ণ হলো, কপাল কুঁচকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “আপনি ঘুমাননি নাকি? চোখ এত লাল কেন? আর চেহারার এই অবস্থা কেন, কারান?”
কারান একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে দু’হাত দিয়ে চুল পেছনে ঠেলে নিয়ে বলল, “ঐ ডিসেস ওয়াশ করতে করতেই রাত কেটে গেছে। আচ্ছা, তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি নামাজ পড়ে আসছি।”
আর অপেক্ষা না করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। মিরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে সন্দেহ সরিয়ে রেখে নিজেও ফ্রেশ হতে চলে গেল।
সকালের নাশতার জন্য কারানকে ডাকতে গিয়েই মিরা দেখল, সে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মৃদু হেসে ধীরে বিছানায় বসে পড়ল মিরা, কারানের নিস্তব্ধ মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে মনে বলতে লাগল, “আমাকে কেন রাগ করে থাকতে দিচ্ছেন না আপনি? আমার যে সত্যিই অনেক অভিমান, ঘৃণা জমে আছে। আপনার তো শাস্তি প্রাপ্য, কারান। কিন্তু এত ভালোবাসলে আমি যে ভুলেই যাব কখনো আপনি আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করে দিয়েছেন।”
এভাবে ক্ষণকাল কারানকে অদৃষ্ট দেখতে থাকলো। কারান ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ মিরার হাত চেপে ধরে নিজের মাথার নিচে রাখল। তন্দ্রাঘোরেই কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আমি বাঁচবো না, মিরা। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও না। যেও না… প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যেও না…মিরা…আমার মিরা…”
তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। শার্ট ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে, পা বিছানার চাদরে ঘষতে ঘষতে কাতরাচ্ছে সে। একফোঁটা অশ্রু কারানের চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
মিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে কারানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার মুখ দু’হাতের মাঝে ধরে জোরে ডাকল, “কারান! এই কারান! কী হয়েছে?”
কিন্তু কারান শুষ্ক ঠোঁটে শুধু একই কথা বলে যাচ্ছে, “প্লিজ, মিরা… মরে যাব আমি। মিরা… মিরাআআ…”
মিরা এবার কারানকে ঝাঁকুনি দিয়ে আরও দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না, কারান। (চিৎকার করে) কারান, উঠুন।”
আচমকা কারান চোখ মেলে মিরাকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসে শক্ত হাতে মিরাকে জড়িয়ে ধরল। ভগ্ন গলায় ফিসফিস করে বলল, “আমাকে ছেড়ে যেও না, মিরা। প্লিজ যেও না…প্লিজ…”
ভয়ের কারণে তার গলা কেঁপে আসছে, শ্বাস অস্থির। কারানের ধাতস্থ ছটফটানি দেখে মিরার মনটাও খচখচ করছে। সে ধীরেসুস্থে কারানকে আলিঙ্গন করে শীতল কণ্ঠে বলল, “যাব না, কারান। কোথাও যাব না।”
কারান প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর দুজনই পরস্পরকে শক্ত করে ধরে রাখল। কিছুক্ষণ পর মিরা ফিসফিস করে বলল, “দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?”
কারান কেবল মাথা নাড়িয়ে বলল, “হুম।”
তারপর মিরার ললাটে আলতো চুমু খেয়ে আবার শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। মিরা আলিঙ্গনমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কারান ছাড়লো না।
“এবার ছাড়ুন, অনেকক্ষণ ধরে আছেন।”
“আর একটু।”
কিছুক্ষণ পর মিরা নরম গলায় বলল, “হয়েছে, এবার নিচে যাই।”
সে উঠে পড়তেই কারান পিছন থেকে ডাকল, “মিরা।”
মিরা ফিরে তাকাল।
“তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?”
মিরা মৃদু হাসল, চোখে গভীর নিশ্চয়তা নিয়ে বলল, “আল্লাহ চাইলে মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল সে। কারান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসল। অর্থাৎ একটা বিশাল বোঝা তার বুক থেকে নামল। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
বাইরে কাঠফাটা রোদে চারদিক খাঁ খাঁ করছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, পাখিরাও ক্লান্ত হয়ে গাছের পাতার ছায়ায় ঠাঁই নিয়েছে। উত্তপ্ত বাতাসে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়, অথচ কে.ছি হাউজের ভেতর তার লেশমাত্র নেই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের স্নিগ্ধ পরিবেশে গ্রীষ্মের দহন যেন অনধিকার প্রবেশের সুযোগই পায়নি। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে রবির তীব্র আলো বিছানায় এসে পড়ছে, ফেনফেনে সাদা পর্দাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে, কিন্তু ঘরের মালিকের সে সব দিকে খেয়াল নেই। তিনি অবশ্য অন্য ভাবনায় নিমগ্ন।
কারান বিছানায় বসে ডান পায়ের ট্রাউজারের কাপড় উরুর ওপরে তুলে মলম লাগাতে লাগাতে বলল, “সবার বউ আঁচড় দেয় পিঠে, আর আমার বউ হাঁটুতে।”
তার কথার সঙ্গে সঙ্গে হাসির রেশ ছড়িয়ে গেল মুখে।
ঠিক তখনই মিরা ঘরে ঢুকে বলল, “কারান, আজকে কী মাছ রান্না করব, বলুন তো?”
কিন্তু কারানের পায়ে মলম লাগাতে দেখে মুহূর্তেই সে উদ্বিগ্ন হয়ে কারানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “আরে! আপনার পায়ে কী হয়েছে?”
কারান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিছু না, জান। আচ্ছা, তুমি কি নেইল কাটো না নাকি? এত ধারালো, উফফ!”
মিরা অবাক হয়ে বলল, “মানে? আমার নখ তো ছোটই। নখ বড় রাখলে কি নামাজ হবে?”
কারান মাথা নাড়িয়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ বুঝেছি, ছোট মরিচের ঝাল বেশি।”
মিরা ভ্রুকুঞ্চন করে বলল, “কী সব বলছেন! দেখি তো, আপনার পায়ে কী হয়েছে!”
“তেমন কিছু না। আমার বউ একটু ভালোবেসে নখের আঁচড় দিয়েছে, এই আরকি।”
মিরা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি? আমি কখন আঁচড় দিলাম আপনাকে?”
কারান ঈষৎ হাসল, তারপর আড়চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “না, তুমি দাও নাই। আমার আরও কয়েকটা বউ আছে তো, তারা দিয়েছে।”
তৎক্ষণাৎ মিরার মুখমণ্ডলে আগুন ধরে গেল। চোখমুখ রাগে লাল হয়ে উঠল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলল, “কি বললেন?”
কারান চোখ তুলে তাকাতেই বুঝল, মিরার মুখশ্রীতে ধ্বংসের ইঙ্গিত। চোখের আগুনে রাগ, হিংসা, অভিমান একসঙ্গে জ্বলছে। কারান স্মিতহাস্যে গলা ছেড়ে বলল, “পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে। তুমি কি কিচেনে কিছু রান্না অবস্থায় রেখে এসেছ নাকি?”
এটা শুনে মিরার চোখ-মুখ আরও কঠোর হয়ে উঠল।
কারান হাসতে হাসতে আবার বলল, “ওহো! তাহলে পোড়ার গন্ধ এখান থেকেই আসছে। আমার বউ জেলাস নাকি?”
সে মিরার আরও কাছে গিয়ে কণ্ঠে মিষ্টতা এনে বলল, “জান, রাগ করার কী আছে বলো? এমনিতেও তো ইসলামে চারটা বিয়ের পারমিশন আছে। তাছাড়া তোমার হাসবেন্ডের চারটা বউ সামলানোর যথেষ্ট স্ট্রেংথও আছে।”
সে ডান হাত তুলে নিজের পেশিবহুল বাহু দেখাতে লাগল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে মিরা একটিও কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কারানের কপালে ভাঁজ পড়ল। সন্দিহান কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, “ব্যাপারটা কী হলো? আমার বউ কোনো রিয়েকশন দিল না কেন?”
নিচে গিয়ে সবজি কাটতে কাটতে মিরা নিজেই নিজেকে বলল, “করাচ্ছি তোকে বিয়ে। সকালে ভাবলাম, থাক, আজকে ক্ষমা করে দিই। কিন্তু শয়তান কি আর ভালো হয়? বিয়ে করবি তুই? দাঁড়া।”
দ্বিপ্রহর।
কারানের কক্ষের দরজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মিরা ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি এনে বলল, “আসুন, সোয়ামি জি। খেতে আসুন।”
কারান কপাল কুঁচকে, এক চোখ বন্ধ করে গুনগুনিয়ে বলল, “আজকে সূর্য কোনদিকে উঠল?”
তারপর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “খেতে না হয় গেলাম। তা হাতে খুন্তি নিয়ে কেন এসেছ? মারবে নাকি?”
মিরা মনে মনে বলল, “এই অনুমতি থাকলে তো কবেই মারতাম।”
তারপর মুখে মিষ্টি হাসি এনে সুরেলা কণ্ঠে বলল, “কি যে বলেন! আপনাকে কি আমি মারতে পারি? আসুন আসুন, খেতে আসুন, সোয়ামি জি।”
সে ঘুরে চলে গেল। কারান ঘাড় চুলকে বিড়বিড় করল, “প্রেমটা একটু বেশি হয়ে গেল না? কোনো ঝড় আসতে চলেছে নাকি?”
সে ধীর পায়ে নিচে নামতে লাগল। তবে কোনো অজানা শঙ্কা তার মনের কোণে ধাক্কা দিতে লাগল।
মিরা হাসিমুখে নিজের হাতে কারানকে খাবার পরিবেশন করল। তার মুখে এত কোমলতা, এত যত্ন—যেন কোনো অভিমানই নেই। কারান একটু অবাকই হলো। মনে মনে ভাবল, “এত ভালো ব্যবহার? ব্যাপার কী?”
তবে রহস্য বেশি সময় অজানা রইল না। খাবার মুখে তুলতেই কারানের চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। দুই কানের পাশ দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোতে লাগল। ঝাল! এমন ঝাল, যা মুখে রাখা দায়। কারান চিৎকার দিয়ে উঠল, “আআআআ! পানি, পানিইইই!”
সামনেই টেবিলে রাখা গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল সে। কিন্তু তার আগেই মিরা গ্লাসটা তুলে এক নিঃশ্বাসে সব পানি খেয়ে ফেলল। তারপর নির্দোষ মুখে হাসতে হাসতে গ্লাসটা আবার টেবিলে নামিয়ে রাখল। কারান প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। তার মুখে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, আর সামনের মহিলা নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে হাসছে। পরক্ষণেই কারান ঝাঁপিয়ে পড়ে মিরার সরু ঠোঁটে তীব্র চুম্বন বসিয়ে দিল।
হঠাৎ এত ঝাঁঝালো স্পর্শে মিরার চোখ-মুখও লাল হয়ে উঠল। মুহূর্তেই কারানের জ্বলন্ত ঠোঁটের তাপে সে নিজেই হাঁসফাঁস করতে লাগল।
কারান অবশেষে তার ঠোঁট ছেড়ে দিল। মিরা এবার সত্যি সত্যিই বিপদে পড়েছে। তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে, মুখ দিয়ে শুধু কয়েকটি শব্দই বেরোচ্ছে, “আহ, ঝাল… উফ! পানি… পানি…”
কারান মিরার এই অবস্থা দেখে দ্রুত মধু এনে তার ঠোঁটে ধরল।
“নাও, এটা খাও।”
মিরা বিনা দ্বিধায় মধু খেয়ে ফেলল। কারান নিজেও একটু নিয়ে মুখে দিল। খানিকক্ষণ পর কারান মুচকি হেসে বলল, “এরপর থেকে আমাকে শাস্তি দিতে চাইলে, সাবধান হোন, বেগম। না হলে আপনিও আমার সঙ্গে সেই নিঃসীম দগ্ধতায় জ্বলে যাবেন।”
সে হেসে চলে গেল। মিরা আপনমনে বলল, “সেগুরেবালি, হচ্ছে তোমার। উফফ…”
সূর্য যখন দিগন্তরেখার কাছে অরুণিমার আলোর স্নান নিতে শুরু করেছে, কারান ফোনে কাঁপানো হেসে কথা বলে চলেছে। তার মুখাবয়বে প্রশান্তি স্পষ্ট। খানিকটা হেসে বলল, “হ্যাঁ, ফারহান, আজকে বের হ।”
ফারহান কৌতূহলী হয়ে বলল, “শুরু থেকেই তোর মুড অনেক ফুরফুরে আর চাঙ্গা লাগছে। কাহিনি কি, বস?”
“কাহিনি কিছু না। শোন, আবিদকে বল, ৪টায় পুরোনো ক্লাভে সবাই মিট করছি।”
ফারহান হাসতে হাসতে বলল, “এটা বেটার ভাই। তোর সাথে তো আবার বাহিরে মিট করা যায় না। কতগুলো মেয়েছেলে হুমড়ি খেয়ে আসে।”
কারান গম্ভীর হয়ে তীক্ষ্ণ হাসি দিল। ফারহান পুনরায় বলে, “মামা, কোনো মেয়েও ডাকবো নাকি। তাহলে চিল হবে, মাম্মাআআ।”
“তুই শালা বদের হাড্ডি। এসব নষ্টামি বাদ দিয়ে আমার মতো বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার কর।”
“মামা, তুমি হুট করে বিয়েটা করে যে সারপ্রাইজ দিলা। আমরা তো ভাবছিলাম, তুইও আমার মতোই বিন্দাস সিঙ্গেল লাইফ কাটাবি। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি, তোর মতো জলজ্যান্ত একটা মা’লের সাথে ওই মেয়ে সংসার কীভাবে করছে!”
এ কথা শুনে কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “অনেকদিন তোকে মারা হয়নি, উড়ছিস বেশি।”
ফারহান ঠোঁট কামড়ে বলল, “যদিও তুই হট আছিস! আমার না, বেনজামিনের কথা মনে পড়ছে। গে শালা তোর জন্য কি পাগল ছিল।”
এটা বলে ফারহান উচ্চস্বরে হাসতে থাকে।
“উফফ! আবার বা’লটার কথা মনে করলি! আর তুই এসব প্লে বয়গিরি বাদ দিয়ে বিয়ে কর। বিয়ে করলে এতদিনে দুই বাচ্চার বাপ থাকতি, ফা’কার।”
ফারহান হেসে বলল, “নর্মাল মেয়ে সামলাতেই হিমশিম খাই, বউ তো সারাজীবনের ব্যাপার, ভাই।”
কারান মুচকি হাসে, “কিন্তু বউয়ের সাথে রোমান্সে যে ফিল পাবি… চল বাদ দে। তোর দ্বারা এসব কিচ্ছু হবে না। আচ্ছা, তাহলে দেখা হচ্ছে।”
“ওকে ওকে।”
কথা শেষ করে ফোন কেটে দিল।
তারপর একখানা ফুলহাতার শুভ্র শার্ট, সাথে গাঢ় অলিভ রঙের কার্গো প্যান্ট পরিধান করল। শার্টের হাতা দুবার ভাঁজ করে উপরে উঠিয়ে নিল। শীতল বাতাসে গায়ে লাগালো সেই ফুল, ভ্যানিলা আর চন্দনকাষ্ঠের ঘ্রানযুক্ত সুগন্ধি। কাঁধে নিল পুরুষালি প্রাদার ব্যাগ, যার ছোট্ট অংশ বা কাঁধ বেয়ে, মূল অংশ ডান পাজরের সাথে মিশে গেল। চোখে পড়ল স্টাইলিশ একখানা সানগ্লাস। মিরা দরজার সন্নিকটে এসে হেসে মনে মনে বলল, “প্রথমবার সাদা কালো প্যান্ট বাদে অন্য কালারে ভালোই লাগছে আমার কারানকে।”
আবার দুপুরের কথা মনে পড়তেই মুখের ভাবটা বদলে বলল, “না, মিরা। এ বেটার প্রেমে পড়ে ওকে শাস্তি দেওয়ার কথা তো ভুলে গেলে চলবে না।”
তাই চোখমুখ কুঁচকে কক্ষে প্রবেশ করে টেবিলে বই হাতরাতে থাকল। কারান মিরাকে দেখেই চুল ঠিক করতে করতে বলল, “বউ, একটু বের হচ্ছি। ওদের সাথে অনেকদিন আড্ডা দেওয়া হয় না।”
“তো বের হন না। আমাকে বলার কি আছে।”
“না, জান। তুমি যদি না বলো, তাহলে বের হবো না।”
মিরা অবাক হয়ে বলল, “বাবা, এত প্রেম! সত্যিই আমি না বললে যাবেন না?”
কারান মিরার কাছে গিয়ে মিহি গলায় বলল, “বিলিভ মি, মিরা। তুমি না বলবে আমি যাব না।”
মিরা সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে সানগ্লাস পড়লেন যে?”
“ধুলোবালির জন্য।”
“যাবেন তো গাড়িতেই, আবার কি?”
কারান পুনরায় চুল ঠিক করতে করতে শুধালো, “না, ক্লাভ থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার প্ল্যান আছে। অনেকদিন ওদের সাথে ট্রাভেলিং করা হয় না।”
“ওহ আচ্ছা। যান, তাহলে।” বলে আবার বই খোঁজায় মনোযোগ দিল।
কারান হেসে মিরার গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “তাড়াতাড়ি চলে আসবো, সোনা। লাভ ইউ। বাই।”
মিরা কপাল কুঁচকে বলল, “যাও তুমি। আজকে আর আপনার খুশি মুডে পানি ঢেলে দিলাম না। কালকে দেখাবো মজা। চারটা বিয়ে করবি?”
সে বই নিয়ে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে পুস্তিকায় অভিনিবিষ্ট হল। খানিক বাদে পুস্তক রেখে ফোনের পানে চোখ মেলল। ফেসবুক স্ক্রল করতেই মিরা আশ্চর্য হয়ে গেল। নিউজফিডে একটাই খবর বারবার উঠে আসছে। খবরটি এই যে, কয়েকদিন ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীসহ দুজন শিক্ষক উধাও। এদের মধ্যে একজন শিক্ষক হিন্দু। এমনকি তল্লাশি নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষক দুজন শুধুমাত্র দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও পা রাখেননি। কিন্তু হঠাৎ কি এমন হলো যে সবাই নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে?
মিরা অবাক হয়ে বলল, “মানে কি? উধাও মানে? আল্লাহ, হচ্ছেটা কি দেশে?”
এরপর নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের দেখে মিরার আশ্চর্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। অলৌকিক ব্যাপার! এরা প্রত্যেকেই মিরার পরিচিত। মিরা ডিভান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবল, “আজিব। ওরা তো…”
Tell me who I am part 17
আশমিনি দু’দিন হলো চৌধুরি বাড়িতে ফিরেছে। এসেই তার রূপচর্চার আয়োজন জমিয়ে তুলেছে।
রাত প্রায় দশটা বাজতে চলেছে। আশমিনি আয়নার সামনে বসে ধীরগতিতে নাইট ক্রিম মাখছে। ইসহাক কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত, কী যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গুছিয়ে নিচ্ছে।
আশমিনি আয়নার প্রতিচ্ছবিতে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কেসটার কী খবর?”
ইসহাক কাগজপত্রের মাঝে ডুবে থেকেই জবাব দিল, “কোনটা?”
“ফুচকাওয়ালার কেসটা।”
ইসহাক চোখ তুলে তাকাল না, শুধু মৃদু স্বরে বলল, “হুম, খুনিকে পেয়ে গেছি।”