Tell me who I am part 19

Tell me who I am part 19
আয়সা ইসলাম মনি

ইসহাকের কথা শুনে উৎকণ্ঠিত আশমিনি জিজ্ঞাসা করল,
“কি বলছো! কে সেই খুনি?”
ইসহাক শান্ত গলায় বলল, “তুমি চিনবে না। দু-দিন আগে আমান একজনকে গ্রেফতার করেছে। লোকটা এখন রিমান্ডে আছে, পুলিশ তদন্ত করছে। কয়েক দিনের মধ্যে কোর্টে তোলা হবে।”
আশমিনি কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চিন্তা করল, তারপর অবিশ্বাসের সুরে বলল, “কিন্তু খুনিকে ধরলে কীভাবে? তুমি তো বললে, কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি?”

ইসহাক ফাইল ওলটপালট করতে করতে বলল, “আমি কি ধরেছি নাকি? কেসটা আমানের আন্ডারে ছিল, ও-ই লিড করেছে। আমি শুধু ইনভেস্টিগেশনের জন্য গিয়েছিলাম।”
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু প্রমাণ পেল কীভাবে?”
“লোকটার নাম স্বাধীন মৃধা। আশপাশের অনেক মানুষ দেখেছে, সে কয়েক মাস ধরে ওই ফুচকাওয়ালার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছিল। এমনকি সর্বসমক্ষে খুনের হুমকিও দিয়েছে। ঝামেলাটা ছিল নাকি দেনাপাওনা নিয়ে।”
আশমিনির কপালে গভীর ভাঁজ পড়ল।
“একটা মানুষ সামান্য দেনাপাওনার জন্য এত নির্মমভাবে খুন করতে পারে? আমার কাছে এটা স্বাভাবিক লাগছে না। তোমার সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি সব ব্যাপারে অতিরিক্ত ভাবো। শুধু হুমকি দেওয়ার কারণে ওকে গ্রেফতার করা হয়নি, লোকটা কিছু অসংলগ্ন কথা বলেছে, আর আমানের কাছে ওর জবানবন্দির ভিডিও আছে। তবে এটা এখনো কোর্টে টেকসই হবে কি না, সেটা বিচারকই দেখবেন।”
“ঠিক আছে, মানলাম স্বাধীন মৃধাই খুন করেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়— খুন করা এক ব্যাপার, আর মৃতদেহ খুবলে খুবলে খাওয়ার বিষয়টা আরেক। কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব না। এই ব্যাপারে সে কিছু বলেছে?”
“মেডিকেল টিম বলেছে, শরীরের ক্ষতগুলো জটিল এবং অস্বাভাবিক। সব রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না।”

আশমিনি এবার চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি ভালো করেই জানি, তুমিও জানো; এই খুন কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না। এখন মনে হচ্ছে, না, মনে হচ্ছে না; আমি ৯৯% নিশ্চিত আমান কোনো না কোনো প্রেশারের কারণে তাড়াহুড়ো করে এই লোকটাকে অভিযুক্ত করছে। কারণ সামান্য দেনাপাওনার জন্য এতটা নৃশংস খুন অসম্ভব।”
ইসহাক এবার স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে কঠোর স্বরে বলল, “তোমার এই বাড়াবাড়িটা একদম সহ্য হয় না। সব ব্যাপারে খামখেয়ালি ভাব দেখাবে! পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দাও। কোর্টেই ঠিক হবে দোষী কে।” বলে সে কাগজপত্র নিয়ে উঠে গিয়ে সোফায় বসল।

আশমিনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ইসহাকের আচরণে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে। সে মনে মনে বলল, “তুমি চাও এই কেসটা দ্রুত শেষ হয়ে যাক, তাই জেনেও না জানার ভান করছো। কিন্তু তোমার হয়ত জানা নেই; অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনই সমান অপরাধী।”
ওদিকে ইসহাক সোফায় বসে ফাইলের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বিড়বিড় করে বলল, “ওনার মতো ঘরে বসে শুধু খাও দাও আর ঘুমাও। নতুন করে আবার জবির দুইজন টিচার উধাও, সঙ্গে এক স্টুডেন্টও। এই ঝামেলা থেকে কবে বের হবো, তার ঠিক নেই। উনি আবার আদিকালের কেস নিয়ে পড়ে আছে।”

রাত এগারোটা বেজে বায়ান্ন। মিরা এখনো অপেক্ষায়, কখন কারান ফিরবে। ঘড়ির কাঁটা অবিচল গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কারানের আসার খবর নেই।
বিরক্ত হয়ে সে ফুঁসে ওঠে, “ধুর, এখনো আসছে না কেন? সেল্ফ রেসপেক্টের জন্য কলও দিতে পারছি না। তাহলেই তো তার আজগুবি সব চিন্তা শুরু হয়ে যাবে। অথচ আমি এখানে ওকে নিয়ে কত ফন্দি আঁটছি। (ক্ষণিক থেমে বিরক্তি চেপে) ধুর বাবা, আসে না কেন! একা একা থাকা ভালো লাগে নাকি? ফরিদ কাকাও ঘুমিয়ে পড়েছে।”
একটু ভেবে নিয়ে মিরা ফোন বের করল, মাহিমা অনলাইন আছে কিনা দেখবে। কিন্তু পরক্ষণেই কী যেন মনে পড়ল, আবার ফোন নামিয়ে রাখল।

“না, এত রাতে মা ওকে ফোন দিয়ে রেখেছে নাকি!”
তারপর হেসে বলল, “ভাবছি মাহিকে এবার একটা ফোন গিফট করব। জানি, কারানকে বললেই মাহির জন্য সবচেয়ে দামি ফোনটাই কিনে দেবে, কিন্তু আমি চাই না ওনার টাকায় আমার বোনের জন্য কিছু কিনতে। আমার নিজের জমানো টাকাই যথেষ্ট। আচ্ছা, এখন কত টাকা জমানো আছে? উমম… হ্যাঁ, ভালো একটা ফোন হয়ে যাবে। আর কিছুদিন যাক, তারপর একটা সারপ্রাইজ দেব। মেয়েটা একদম খুশিতে লাফিয়ে উঠবে।”
এসব ভেবে মিরার মুখে প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠল। এরপর সে বাইরে অগোছালো পড়ে থাকা কিছু কাপড় গুছিয়ে আলমারিতে রাখতে লাগল।
হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত বাহু তার কোমর ঘিরে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে এক উষ্ণ, লম্বা নিশ্বাস তার কানের পাশে ঝরে পড়ল।

“ডু ইউ মিস মি, সুইটহার্ট?”
কঠিন, গা ছমছমে স্বরটা শুনেই মিরা আঁতকে উঠে পিছনে ফিরল। পরক্ষণেই কারানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”
কারান তীক্ষ্ণ হেসে বলল, “বউকে একটু সারপ্রাইজ দিতে চাইলাম, আর বউ ভয়েই কাবু হয়ে গেল?”
মিরা কপাল কুঁচকে বলল, “আপনার এই অদ্ভুত সারপ্রাইজ দেওয়ার অভ্যাসটা ছাড়তে বলেছি তো। উফফ, বিরক্তিকর মানুষ একটা।”
“আমি বিরক্তিকর?”
“তো নয়তো কি! সরুন তো। এমনিতেই আপনাকে আমার ভালো লাগে না।”
সে মুখ ঘুরিয়ে কাজে ব্যস্ত দেখাতে লাগল। কারান আলমারির গায়ে হেলান দিয়ে, দু’হাত বুকে গুটিয়ে বলল, “লাগে লাগে, শুধু মুখে বলো না।”

মিরা কারানের কথার জবাব না দিয়ে শুধু মৃদু হাসল। আর কারান অপলক তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মিরা নরম স্বরে বলল, “এত দেরি হলো যে?”
কারান এক ঝটকায় মিরার হাত ধরে কাছে টেনে আনল, তার কোমরে আঙুলের আলতো ছোঁয়া দিয়ে গভীর কণ্ঠে বলল, “কেন, খুব মিস করছিলে, তাই না? একটা কল দিলেই তো হতো, জান। আমি দৌড়ে চলে আসতাম তোমার কাছে।”
মিরা কারানের হাত ছাড়িয়ে বিছানা গুছিয়ে নিতে নিতে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, “সবসময় শুধু বাঁদরামো। আমার ইচ্ছে করেনি, তাই কল করিনি। কিন্তু আপনি কেন করেননি?”

কারান খানিকটা অভিমানী ভঙ্গিতে বলল, “দিলে তো মনটা খারাপ করে। আমার মহারানীর কবে আমার কথা মনে পড়বে, আল্লাহ জানে। আর আমি ব্যস্ত ছিলাম সোনা, তাই কল করিনি।”
“ছিলেন তো আড্ডায়, আবার কীসের এত ব্যস্ততা?”
“আপনি ভুলে গেলেও কারান চৌধুরি ভুলে না, বেগম। আপনাকে বলেছিলাম না যে অরফান শিশুদের খাওয়াবো। ক্লাভে গিয়ে সবার সাথে সেটারই আয়োজন করেছিলাম। পরে নিজে গিয়ে রাস্তার সব বাচ্চাদের ব্যাগভরে খাবার, সাথে আরও যাবতীয় কিছু জিনিস সবার হাতে হাতে দিয়ে এসে কাজ শেষ করলাম। আবার অরফানেজ করার জন্য জায়গা ঠিক করে আসলাম। কিছু দিনের মধ্যে কাজও শুরু হয়ে যাবে। ফাইনাললি আমরা একটু ট্রাভেলিং করে দেন বাসায় ব্যাক করলাম। এই জন্যই দেরি হলো।”
মিরার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।

“আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে তো সত্যিই অনেক কাজ করেছেন। আর… থ্যাংকস এগেইন।”
কারান ঠোঁটের মাঝে আঙুল রেখে চুমুর জন্য মিরার দিকে ইঙ্গিত করল। এটা দেখে মিরা কটমট করে তাকিয়ে রইল।
কারান সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল ভুল সময়ে ভুল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তাই গলা খুঁটতে খুঁটতে চুপচাপ মাথা নীচু করে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। মিরা চোখ উল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, “আসছে! কাল থেকে আমি কিনা ওনাকে শাস্তি দেওয়ার প্ল্যান করছি, আর উনি প্রেম করতে আসছেন।”
কারান ফ্রেশ হয়ে এসে রাতের পোশাক পরে খানিকটা মন খারাপ করে মিরার পাশে শুয়ে পড়ল। ক্ষণিক নীরবতার পর মিরা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “ঘুমিয়ে পড়েছেন?”

শব্দটি শুনে মুহূর্তেই কারানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হঠাৎ করেই শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে মুচকি হেসে উঠে বসলো, তারপর মিরাকে দু’বাহুতে টেনে জড়িয়ে ধরলো। মিরা বিরক্ত মুখে তার হাত ছাড়িয়ে নরম স্বরে বলল, “এছাড়া আপনার মাথায় আর কিছুই আসে না, তাই তো?”
কারান চোখে একরকম বেহিসাবি ভালোবাসার ছায়া ফুটিয়ে নেশালো কণ্ঠে বলল, “বউকে আদর করা ছাড়া আর কী আসবে বলো?”
মিরা কিছুক্ষণ নীরব চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টিতে একরকম চাপা ধিক্কার, যেন সে বুঝে উঠতে পারছে না, এই মানুষটাকে শাসন করা আদৌ সম্ভব কিনা। কারানও বুঝল, মিরার অভিব্যক্তিতে একটা প্রবল প্রতিরোধের আভাস আছে। তাই পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল, “বলো, কী ভাবছো?”
“নিউজ দেখেছেন?”

কারান ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, “কোনটা?”
“জবির ব্যাপারটা। আচ্ছা, মানুষ কীভাবে উধাও হয় বলুন তো? মানে যদি তারা মারাও যায়, লাশ তো পাওয়া যাবে। আর যদি বেঁচে থাকে, বাংলাদেশ বা কোনো না কোনো দেশে তো থাকবেই। আজব না বলুন?”
কারানের মুখে গভীর ভাবনার ছাপ ফুটে উঠল। ধীর কণ্ঠে বলল, “হতে পারে তারা কোথাও আছে, কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। কিংবা হয়ত সত্যিটা এতটাই অদৃশ্য যে, কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না।”
মিরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “জানি না, বাদ দিন। গুড নাইট।”
এই বলে চোখ বন্ধ করল।
কারান কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে মিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। অর্থাৎ তার চিন্তার গভীরতা মাপার চেষ্টা করছে। তারপর ধীরে ধীরে সেও চোখ বুজল।

সকালটা স্নিগ্ধতার আবরণে মোড়ানো। সোনালি রোদের ছোঁয়ায় ঘাসের পাতাগুলো ঝলমল করছে, আর দূর থেকে ভেসে আসা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে পরিবেশটা আরও মিষ্টিমধুর হয়ে উঠেছে। মিরা বরাবরের মতোই ভোরবেলা উঠে গাছগাছালির তৃষ্ণা মিটিয়ে হালকা নাস্তা সেরে নিল। অথচ আজ যেন তার মন একটু বেশিই প্রফুল্ল।
হাস্যরসে মোড়া মুখে বলল, “আজ থেকেই আপনার সঙ্গে সুন্দর একটা খেলা খেলব, নাম তার সুইট রিভেঞ্জ। জানি, আপনার মতো করে শাস্তি দিতে পারব না, আর চাইও না। শত হোক, আপনি আমার প্রাণপ্রিয় স্বামীজি, আপনাকে আঘাত দেওয়া কি সম্ভব? তবে টুকটাক শায়েস্তা করতেই পারি, নাহলে আবার পার পেয়ে যাবেন।”
ঠিক তখনই কারান সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে বলল, “আমার নামে এত কী বিড়বিড় করছ?”

মিরা ঈষৎ ভেংচি কেটে উত্তর দিল, “আমার অনেক কাজ আছে, আপনার নামে বিড়বিড় করার অত সময় কোথায়?”
কারান গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “তোমার কি সবসময়ই আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে?”
মিরা বৈঠকখানার সোফার কুশন ঠিক করতে করতে শান্ত গলায় বলল, “এভাবে কথা বলে লাভ নেই, বুঝেছেন? ঐদিন শুধু এনিভার্সারি ছিল বলে আপনার সব কিছুতে সায় দিয়েছি, এর মানে এই নয় যে আমি সব ভুলে গেছি। আপনাকে শাস্তি পেতেই হবে, বুঝলেন?”

কারান চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, আর মিরা ভাবলেশহীনভাবে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
মিরা যেতেই কারান হঠাৎ খট করে হেসে দিল। নিজের মনে বলল, “আমার বউ একটা বিনোদন। দু’দিন পরপর আমার বউয়ের মাথায় শয়তান ভর করে নাকি? ঠিক আছে, আপনি চাল চালতে থাকুন, বেগম। কারান চৌধুরিও পালটা চাল চালবে। অনেক তো প্রেম হলো, এবার না হয় সাপ-লুডুর খেলায় নামি। তুমি গুটি চেলে উপরে উঠতে থাকো, আমি এক ছোবলেই নিচে নামিয়ে দেব।”
রান্নাঘর থেকে মিরার চড়া গলা শোনা গেল, “হাসছেন কেন?”

“এমনি।”
মিরা আবার গলা উঁচিয়ে বলল, “আজ অফিস নেই?”
“আছে, দুটোর পর যাব।”
তারপর একখানা রুটির সঙ্গে জ্যাম লাগিয়ে খেতে খেতে সে উপরে উঠে গেল।
মিরা মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আঁটতে আঁটতে ফিসফিসিয়ে বলল,
“উঁহুঁ, আজ যেহেতু বাসায় আছেন, পুরোনো প্রতিশোধটা নিয়েই নেই।”
তার ঠোঁটের কোণে একরকম শয়তানি হাসি ফুটে উঠল।

কিছুক্ষণ পর সে উপরে গিয়ে দেখল, কারান গভীর মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে। মিরা কৌশলে দু’বার খুকখুক করে কেশে উঠল। কারান ম্লান হেসে তাকিয়ে বলল, “বলুন, বেগম।”
মিরা ধীরেসুস্থে একপাশে বসে কোমল কণ্ঠে বলল, “আমার শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না।”
শুনতেই কারানের চোখমুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, বিষাদের ছাপ গভীর হলো তার দৃষ্টিতে। উদ্বিগ্ন পায়ে এগিয়ে এসে মিরার মুখখানা দুই হাতের মাঝে আবদ্ধ করে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে, বউ? ডাক্তার ডাকবো? বলো না, কি হয়েছে?”
মিরা মনে মনে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল, “ধুর! কাকে কি বলি? শেষ উনি। নাহ, ওনাকে আর এমনটা বলা যাবে না দেখছি।”

তবে প্রকাশ্যে কোমল স্বরে বলল, “আপনার কি পদে পদে ডাক্তার ডাকতে হবে?”
কারানের চোখের গভীরে তখনও চিন্তার ছায়া। বিরক্তি প্রকাশ করল, “এসব বাদ দাও তো। আগে বলো কি হয়েছে?”
দ্রুত মিরার কপালে আর গলায় হাতের উলটো পাশে ছুঁয়ে দেখল, জ্বর আছে কি না।
মিরা ঠোঁট উল্টে বলল, “কিচ্ছু হয়নি বাবা, সবকিছুতেই এতটা হয়রান হবেন না তো।”
“তাহলে বললে কেন যে তোমার শরীর ভালো লাগছে না?”
“মানে একটু ক্লান্ত লাগছে। আরকি… রান্না করতে ইচ্ছে করছে না।”
কারান গভীর শ্বাস ছেড়ে প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে বলল, “আচ্ছা, তাহলে আজকের রান্নাটা কারান চৌধুরি করবে। একটু কাজ করছি, শেষ করেই চলে আসছি কিচেনে।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
মিরা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতেই কারানের হাত দ্রুত মিরার কব্জি আঁকড়ে ধরল। মিরা থমকে পিছন ফিরে তাকাতেই কারান তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে ঢোক গিলে বলল, “লাভ ইউ, মিরা।”
কারানের সেই অপার্থিব দৃষ্টি দেখে কেন যেন মিরার মন গলে গেল। বুকের গহীনে নরম এক শিহরন বয়ে গেল। অকস্মাৎ মধুর স্বরে বলে উঠল, “হাগ লাগবে?”
কারান বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল। এমন প্রশ্ন যে মিরার কাছ থেকে আসতে পারে, তা যে ভাবনার অতীত! সে অবিশ্বাসে গভীর চোখে মিরার দিকে চেয়ে থাকল।
মিরা লজ্জা পেয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সামনে পা বাড়াতেই, কারান এক হ্যাঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে টেনে নিল। তারপর গভীর আন্তরিকতায় বলল, “কীভাবে বুঝলে?”

মিরা নিশ্চুপ, শুধু চোখ বন্ধ করে কারানের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করতে লাগল। বুকের গহিন থেকে একরাশ প্রশান্তি যেন ধীরে ধীরে গলে পড়ছে সময়ের ফাঁকে। কিছুক্ষণ পরে মিরা মৃদু হেসে বলল, “আমি আপনার হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। এত দ্রুত বেগে চলছে যে, আমার ভিতরে ভিতরে কেমন জানি লাগছে।”
কারান মিরার চুলে আঙুল বুলিয়ে স্মিতহাস্যে বলল, “জানি না, মিরা। কেন যেন তোমার আশেপাশে থাকলেই সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে। হৃৎস্পন্দন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, অথচ শ্বাস আটকে আসে। চারপাশের দুনিয়া থমকে দাঁড়ায়, সময়ের প্রবাহ থেমে যায়। কেন এমন হয়, বলো তো?”

মিরা চোখ বন্ধ করে শুধু অনুভব করল কারানের বুকে ধুকপুক শব্দের তাল। কী বলবে, সে নিজেও জানে না। শুধু এতটুকুই বুঝল—এটাই ভালোবাসার ভাষা, যে ভাষায় শব্দের প্রয়োজন হয় না।
মিরা কিছুক্ষণ কারানের উষ্ণ আলিঙ্গনে হারিয়ে যেতে থাকলেও হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল। এক নিমেষে সেই প্রশান্তি উবে গেল তার ভেতর থেকে। আবেগের সেই নরম স্রোত ধাক্কা খেয়ে পিছু হটল বাস্তবতার কঠিন শিলাস্তম্ভে।
অবিচল স্বরে বলল, “হয়েছে, ঘরের অনেক কাজ বাকি।”
কারানের বাঁধন আলগা করে দ্রুতই চলে গেল সে। অথচ কারানের চোখে একরাশ অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করল। বিমর্ষ কণ্ঠে বলল, “আর কবে? কবে তুমি সম্পূর্ণভাবে আমার হবে, মিরা? কেন যেন তুমি সবকিছু বুঝেও বুঝতে চাইছো না। আমাকে এতটা কষ্ট দিতে তোমার কি খুব আনন্দ হয়?”
তার কণ্ঠের গভীর হতাশা বুকে মোচড় দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস হয়ে বুকের গহিন থেকে বেরিয়ে এলো।

মিরা নিচে নেমে বৈঠকখানার সোফায় বসে পড়ল। এক অজানা বেদনাভারে তার গলা ভারী হয়ে আসছে। তারপর নিজেকেই বলল, “আমি পারছি না ভুলতে… কিছুতেই পারছি না। আমার মন বলে, তাকে ক্ষমা করে দাও, আর মস্তিষ্ক বলে, তাকে ভয়ংকর রকম কষ্ট দাও। কোনটার কথা শুনব আমি? কেন, কারান? কেন সেই এগারোটা মাসেও আমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলেন না? আমার যন্ত্রণা হচ্ছে, কারান… বুকের কোনো গভীর কোণে এক অসহনীয় ব্যথা ক্রমাগত শেকড় গেড়ে বসছে।”
বলতে বলতে গাল বেয়ে এক ফোঁটা জল নীরবে ঝরে পড়ল মেঝেতে।

মিরা ঠোঁট চেপে ধরে, গভীর শ্বাস নিয়ে পুনরায় বলল, “আমি বুঝি, অন্য মেয়েগুলোর সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল না। ওরা কেবল আমার চোখের সামনে আপনার অভিনয়ের অংশ ছিল, আমাকে কষ্ট দেওয়ার নির্মম কৌশল ছিল। কিন্তু রাশা? রাশার সাথে তো আপনার সম্পর্ক বহু আগের। অর্থাৎ রাশাই হয়ত আপনার প্রথম ভালোবাসা। তাকেই আপনি প্রথম স্পর্শ করেছেন, তাকেই প্রথম জড়িয়ে ধরেছেন, তাকেই প্রথম চুম্বনে আবদ্ধ করেছেন।”
কথাগুলো উচ্চারণ করতেই হৃদয়ের ভেতর বিষাক্ত কাঁটার মতো খচখচ করতে লাগল। একবার চোখ বন্ধ করে, গিলতে চাইল এই বেদনাকে, কিন্তু না, গিলে ফেলা যায় না এতো সহজে!
“আমার খুব ব্যথা হচ্ছে, কারান…”

চোখ মেলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল মিরা। কাঁপা কণ্ঠে বলল, “এটাই আমাকে ছিঁড়ে ফেলছে, আপনাকে প্রথমবার আমি স্পর্শ করিনি, অন্য কেউ করেছে। আপনার প্রথম চাওয়া আমি ছিলাম না, অন্য কেউ ছিল। আমি কিছুতেই এটা মানতে পারছি না, কারান। কিছুতেই পারছি না। (থেমে) কিন্তু সত্যি বলতে, আইদাহ আহসান মিরার হৃদয়ে আপনি সর্বদাই জাগ্রত ছিলেন। আপনি আমার প্রথম ভালোবাসা, কারান… আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
শেষ কথাটা বলার সাথে সাথে বুকে চেপে থাকা পাহাড়টা খানিকটা হালকা হলো মিরার।
অনেকক্ষণ পর ধীর গতিতে উঠে দাঁড়াল মিরা। চোখের জল মুছতে মুছতে শক্ত হলো তার চোয়াল, কঠিন হলো দৃষ্টি। তারপর সংকল্পবদ্ধ স্বরে বলল, “না, এবার আর কোনো রং-তামাশা নয়। মনকে স্থির করেই ফেলেছি। আপনাকে আপনার মতো করেই শায়েস্তা করব, কারান। তবে হ্যাঁ, নিষ্ঠুর পথে নয়। অর্থাৎ আপনি কষ্টের স্বাদ পাবেন, অথচ বুঝতেও পারবেন না।”
তার ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি খেলে গেল।

মধ্যাহ্নে কারান বেশ চটপটে মনে রান্নার প্রস্তুতি নিল। একের পর এক বিদেশি কৌশলে তৈরি হতে লাগল সুস্বাদু সব পদ।
সে প্রথমে একটি পাত্রে তেল গরম করে নিয়ে মশলা দিল, তারপর সবজি কেটে ফেলল। তরকারির টুকরো কয়েকবার শূন্যে ছুড়ে দিয়ে নিখুঁতভাবে পাত্রে ধরল। এরই ফাঁকে অন্য একটি ডিশের প্রস্তুতি শুরু করল; পাত্রে মশলা ঢেলে ক্যাপসিকামের রঙিন টুকরোগুলো মিশিয়ে দিল। সবশেষে আস্ত একটি মুরগি সেই পাত্রে রেখে, মশলায় মিশিয়ে নিল।

কিছুক্ষণ পর মুরগির গায়ে অ্যালকোহল ঢালতেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে নিভেও গেল। এটি ছিল ফরাসি রান্নার বিশেষ কৌশল, Chicken Flambé, যা খাবারে গভীর স্বাদ ও সুবাস যোগ করে।
এরপর আরেকটি পদ শুরু করল। নিখুঁতভাবে জাপানিজ টুনার কাঁটাগুলো সরিয়ে নিল। তারপর মাছ দুটো মশলা মাখিয়ে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে নিল। এগুলো কড়া আঁচে ভেজে নিয়ে একপাশে রাখল। কিছুক্ষণ পর ফয়েল খুলতেই ধোঁয়া ওঠা, ঝলসানো সুগন্ধে ভরে উঠল রান্নাঘর। পরে প্লেট সাজিয়ে সুস্বাদু পদগুলো পরিবেশন করল।
কারান চৌধুরি যেকোনো কাজেই নিখুঁততা পছন্দ করে, রান্নার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। সব কাজ শেষ করেই সে গোসলের জন্য চলে গেল।
এদিকে মিরা রান্নাঘরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেল। রান্নার ঘ্রাণ, প্রতিটি সুসজ্জিত পদ; সবকিছুতেই যেন রেস্তোরাঁর ছোঁয়া!

সে আর লোভ সামলাতে পারল না। আঙুলের ডগায় একটু ছুঁয়ে নিয়ে স্বাদ নিতেই বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল।
তার ঠোঁটের কোণে হেসে মৃদু স্বরে বলে উঠল, “ডিলিশিয়াস!”
এরপর চুপচাপ বৈঠকখানায় বসে ফোন স্ক্রল করতে শুরু করলো মিরা। কিছু সময় পর কারান ভেজা চুলে, কালো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পরে নিচে এল। মিরা একপলক তাকিয়ে, তৎক্ষণাৎ আবার না দেখার ভান করে ফোনের স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মিরা মনে মনে হেসে বললো, “ইচ্ছে তো করছে আপনার সদ্য ধুয়ে আসা শরীরের গাঢ় সুগন্ধে ডুবে যেতে, কিন্তু তা তো এখন সম্ভব নয়।”
কারান মুচকি হেসে ডাইনিং এর সামনে গিয়ে বলল, “রানি ভিক্টোরিয়া, খেতে আসুন।”
মিরা উঠে সোজা খাবারের টেবিলের দিকে পা বাড়াতেই, কারান এক টান দিয়ে চেয়ারটি টেনে দিল। মিরা বসে পড়লো। তারপর কারান একে একে নিজ হাতে সব খাবার পরিবেশন করে দিল। মিরা প্রথম প্লেট থেকে খাবার মুখে নিতে গিয়েই হঠাৎ বলল, “উমমম… কি লবণ!”

কারান চমকে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি বাজে কথা বলছো? লবণ কেন হবে? অন্য একটা ডিশ ট্রাই করো তো।”
পরবর্তী প্লেটেও একই প্রতিক্রিয়া দেখে, কারান অবাক হয়ে নিজের প্লেট থেকে একটুকরো খাবার খেয়ে নিল। তৎক্ষণাৎ তার চোখ দুটি বিস্ময়ে আর কৌতূহলে একে অপরকে ছুঁয়ে যেতে লাগলো। দ্রুত উঠে গিয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ কুলকুচি করল। তার কপালে একাধিক ভাঁজ পড়ে গেছে।
কারান চিন্তিত চেহারায় বলল, “আমি তো লবণ চেক করেই দিয়েছিলাম। তখন তো ঠিকই ছিল।”
মিরা দীপ্তস্বরে উত্তর দিল, “তাহলে এত লবণ আসলো কীভাবে?”
চোখে অদ্ভুত প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে কারানের দিকে তাকালো। কিন্তু কারান তার দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো। এরপর কারান শান্ত গলায় বললো, “আচ্ছা, বাদ দাও। খেতে হবে না। আমি খাবার অর্ডার করছি।”
কারান টেবিল থেকে ফোন তুলে নিতে গেল, তখনই মিরা আচমকা লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না না!”

কারান ভ্রূ কুঁচকে, অবাক অভিব্যক্তি নিয়ে বলল, “কেন না? খাবো না নাকি?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই খাবেন। তবে আপনি তো বাহিরের খাবার খেতে পারেন না।”
“আজকের জন্য নাহয় খেয়ে নিলাম।”
“কিন্তু আমি তো খেতে পারবো না,” বলে মিরা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল।
“তো তুমি কি চাও?”
“আআ, আরেকবার না হয় রান্না করুন।”
কারান গম্ভীর সুরে বলে, “মিরা, তোমার মাথা ঠিক আছে? অলরেডি দেড়টা বেজে গেছে, আমাকে অফিসে যেতে হবে না নাকি? তাছাড়া আবার রান্না করার মানে বুঝো তুমি?”
মিরা আপনমনে ভাবে, “সমস্যা কোথায়? আমাকে দিয়েও তো কতবার কফি বানালেন।”

তারপর নিশ্বাস ফেলে নীচু কণ্ঠে বলে, “আচ্ছা ঠিকাছে, তাহলে আজকে আমাকে না খেয়েই থাকতে হবে।”
কারান বুঝে গেছে, মিরা হয়ত ইচ্ছা করেই এমন করছে। একদিন বাহিরের খাবার খেলে কী এমন ক্ষতি হতো? তার মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ উঁকি দেয়, তবে প্রেয়সীর জন্য রাগ সামলে নিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে যায়। প্রায় আধঘণ্টা পরে খিচুড়ি রান্না করে, তাড়াহুড়ো করে টেবিলের উপর রেখে উপরে ছুটে গেল।
এদিকে মিরা পিছন থেকে একটু দুষ্টুমির সুরে বলে, “এখন তাহলে খিচুড়ি খেতে হবে?”
কারান থেমে গিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই বলে, “কিছু করার নেই, বেব। আধঘণ্টায় এর চেয়ে বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না।”
“কিন্তু আপনি খাবেন না?”

“তুমি খাও। আমার সময় নেই, মিরা,” বলে সে আবার উপরের দিকে পা বাড়ায়।
তবে মিরা দ্রুত শব্দের বেগ বাড়িয়ে বলে, “আপনি না খেলে আমিও খাচ্ছি না।”
কারান আর কিছু বলার উপায় পায় না। শেষপর্যন্ত পুনরায় নিচে নেমে এসে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে। এরপর শান্ত গলায় বলে, “প্রেম দেখানোর আর সময় পাও না? এখন সিরিয়াসলি টাইম নেই।”
“আপনি খেয়ে তারপর যাবেন।”
“মিরা, আমি যেমন অন্য কারোর ক্ষেত্রে ইন্ডিসিপ্লিন পছন্দ করি না, তেমনি নিজেও কখনো ইন্ডিসিপ্লিন ছিলাম না। আর এখন তোমার জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মিরা কারানের কথায় তেমন মনোযোগ না দিয়ে সুনিপুণ হাতে কারানের ও নিজের প্লেটে খিচুড়ি তুলে নেয়। পরে নিজের খাবারের দিকে মনোযোগী হয়ে খেতে বসে। এমন সময় কারান তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছে দেখে, মিরা তার কনুইতে নরমভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “আরে বাবা, আস্তে আস্তে। গলায় বাজবে তো।”
কারান তাড়াহুড়ো করে খেতে খেতে জানায়, “সময় নেই, বেবি।”
মিরা হাসি চাপতে চাপতে বলে, “আচ্ছা, আমি সালাদ নিয়ে আসি। ওটাতে তো আর লবণ বেশি হবে না।”
“তুমি খাও। আমি যাচ্ছি।”
কিন্তু কারান দুই কদম গিয়ে আবার ফিরে এসে টেবিলের সামনে বসে পড়লো। অর্থাৎ পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার স্মৃতি আবার তাকে জাগ্রত করেছে। আগের বার মিরাই সমস্ত খাবারে অতিরিক্ত লবণ দিয়ে দিয়েছিল। এবারও সে একই কাজ করবে কিনা, সেই সন্দেহে কারান ফিরে এসেছে। মিরা মুচকি হাসে, চোখের কোণে কৌতুকের ঝিলিক ফুটিয়ে বলল, “কি হলো?”

কারান মিরার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে, গলা উঁচিয়ে বলল, “ফরিদ কাকা, কিচেন থেকে সালাদটা নিয়ে এসো।”
মিরা মুখ টিপে হেসে মনে মনে বলল, “আর লবণ দিব না বাবা, আমি এত খারাপ নই যে স্বামীকে দিয়ে দুইবার রান্না করানোর পরও আবার রান্না করাবো।”
তারপর হালকা হাসতে হাসতে আবার খেতে শুরু করল।
ফরিদ মিয়া সালাদ নিয়ে আসলে, কারান তাড়াহুড়ো করে খেয়ে পোশাক পালটে অফিসে চলে গেল। কারান চলে যাওয়ার পর, মিরা নির্বিকার গলায় বলল, “জানি, আমি না বললে আপনি আজকে না খেয়েই অফিস করতেন। কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিব না।”
এরপর হেসে রান্নাঘরে গিয়ে, কারানের হাতে বানানো ফিশ ফ্রাই থেকে শুরু করে অন্যান্য সব পদের স্বাদ গ্রহণ করতে করতে মিরা বলল, “লবণ তো শুধু প্লেটেই দিয়েছিলাম। এত মজার খাবার আমি এভাবে নষ্ট হতে দিব, এটা আপনি ভাবলেন কীভাবে?”
মুচকি হাসিতে খাওয়া শুরু করলো। এবার গলা উঁচিয়ে ডেকে বলল, “ফরিদ কাকা!”
ফরিদ মিয়া এসে নরম গলায় বললেন, “জি মা, বলুন।”
মিরা হাসি মুখে উত্তর দিল, “খেতে বসুন, কাকাই। আজকে সেই সেই রান্না হয়েছে। আপনার স্যার রান্না করেছে, একদম জমে যাবে।”
দুজনেই হাসি মাখা মুখে গালগল্প করতে করতে খেয়ে নিল।

কারান অফিস থেকে ফিরেই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে ল্যাপটপ খুলে বসল। চোখের পাতায় ক্লান্তি জমলেও দায়িত্ববোধের শিকল তাকে টেনে ধরে রেখেছে। দেরি করে যাওয়ার কারণে কাজের চাপ দ্বিগুণ হয়ে গেছে, আর এই চাপ পুষিয়ে দিতেই নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতায় ডুবে গেল সে।
মিরা ততক্ষণে নতুন এক দুষ্ট পরিকল্পনায় মগ্ন। পপকর্নের বাটি হাতে নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এসে কারানের পাশে বসলো। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে স্বচ্ছন্দে টিভি চালিয়ে দিলো। স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল, মুভির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ঘরের নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে দিল।
কারান এতেও নিরুত্তর রইলো। তার হাতে আঙুলের চাপ একটু বাড়ল, কপালে ভাঁজ গভীর হলো, কিন্তু সে তার চোখ ল্যাপটপ থেকে সরালো না।
মিরা একটু ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এত নির্বিকার কেন? এত মনোযোগ দিয়ে কাজ করার কী আছে? অফিসের কাজ কি জীবন-মরণের প্রশ্ন নাকি?
সে টিভির ভলিউম আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। এবার অবশ্য কারানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। চোখ ল্যাপটপের পর্দা থেকে না সরিয়েই কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠল, “কানে কি কম শোনো? এত ভলিউম দেওয়ার কী আছে?”
মিরা একটা অলস আড়মোড়া ভাঙলো, গলার স্বরে চরম অনাগ্রহ এনে বলল, “মুভি সাউন্ড না দিয়ে দেখলে মজা নেই।”

কারান এবার সরাসরি তাকালো। চোখে বিরক্তি, কণ্ঠে ধৈর্যচ্যুতির আভাস।
“ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখো। ফুল সাউন্ডে দেখতে চাইলে ওখানে যাও। আমি কাজ করছি মিরা, ডিস্টার্ব করো না।”
মিরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “না, এখন শুয়ে শুয়েই দেখতে ভালো লাগছে।”
কারান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাজে মন দিলো। কিন্তু মিরা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। সে এবার ভিন্ন পথ ধরলো। গলার স্বর খানিকটা আবেগমাখা করলো, চোখে এনে দিলো কল্পনার আলোড়ন। তারপর এক গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “উফফ, আমার ফেভারিট ক্রিস ইভানস!”
এবার কারানের ধৈর্যের বাঁধ সত্যিই টলে উঠলো। ঠান্ডা চোখে এক ঝলক তাকালো মিরার দিকে, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শুধু কপালের শিরা সামান্য টান টান হলো, আর ঠোঁটের কোণে চাপা অভিব্যক্তি খেলা করলো—রাগ নাকি অন্যকিছু, বোঝা দায়।

কারানের আঙুলের গতি একটু ধীর হলো। মিরা সেটা লক্ষ্য করলো। সে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ইশশ, আপনাকে যদি একবার পেতাম… আমি যে কী করতাম!”
এইবার আর সহ্য হলো না। কারান ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো। ধীর শ্বাস নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠলো, “এই, সমস্যা কী তোমার? তুমি কি অন্ধ? দেখছো না আমি এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি, আর তুমি এখানে বসে সাউন্ড বাড়িয়ে গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছ।”
মিরা সচকিত হয়ে এক মুহূর্ত চুপ করে গেল। তারপর কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, “আচ্ছা, তাহলে একটা কাজ করুন না! আমাকে ক্রিস ইভানসের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন, তাহলেই তো সব মিটে যায়। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না।”

কারান দাঁতে দাঁত চেপে, চোখে গভীর ধূসর ছায়া এনে বললো, “তারপর তুমি কী করবে?”
মিরা হাসতে হাসতে বলল, “জড়িয়ে ধরবো।”
এবার কারানের ধৈর্যের শেষ সীমা ছুঁয়ে গেল। চোখের তারা ক্রোধে জ্বলে উঠলো, মুখ যেন উত্তপ্ত রক্তিম আভায় ভরে উঠলো। কোনোকিছু না বলে সে এক ঝটকায় মিরাকে শুইয়ে দিলো বিছানায়, নিজের শক্তিশালী শরীরের ওজন তার উপর ফেললো। মিরার নিশ্বাস আটকে গেল। কারান কপালে গভীর ভাঁজ ফেলে নীচু গলায় বললো, “এমনভাবে স্বরনালী চেপে ধরবো যে, এই মুখ থেকে আর কোনোদিন শব্দ বের হবে না। প্রথমবার বললে বলে ক্ষমা করলাম, কিন্তু দ্বিতীয়বার যেন এই ভুল না হয়, মিরা। তুমি শুধুই কারানের। তোমার এক বিন্দুও অন্য কারোর সাথে সহ্য করবো না।”

মিরা এবার কিছুটা ভীত হয়ে গেল। তার সামনে থাকা মানুষটা পরিচিত হয়েও যেন অপরিচিত। সেই চোখের আগুন, সেই চোয়ালের তীক্ষ্ণতা—এই কারানকে সে চেনে, তবুও যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে।
তার কণ্ঠস্বর এবার অনেকটাই কোমল হয়ে এলো, “এতক্ষণ তো এত কিছু বললাম, তখন তো রাগ দেখালেন না। হঠাৎ এত প্রতিক্রিয়া কেন?”
কারান ঠোঁটের কোণে নিস্তরঙ্গ হাসি ফুটিয়ে বললো, “তুমি কি আমাকে বাচ্চা মনে করো? যে তোমার আবোল-তাবোল কথায় রেগে যাবো? অসম্ভব কিছুর জন্য রাগ খরচ করার কোনো মানে নেই। কিন্তু শেষ কথাটা…”
সে এবার সামান্য ঝুঁকে এলো, গলার স্বর আরও তীক্ষ্ণ হলো, “শেষ কথাটা আমার পছন্দ হয়নি।”
মিরা চুপ করে গেল। কারান এবার উঠে দাঁড়ালো, ল্যাপটপ তুলে নিলো, তারপর দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো, “এবার ফুল ভলিউমে দেখুন আপনার হিরোকে।”

দরজা অবধি গিয়েও কারান থমকে গেলো। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, মুঠি বদ্ধ হলো। কিন্তু সে কিছুই বললো না। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে, ধীর পায়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলো।
মিরা হতবাক হয়ে বসে রইলো। তার ঠোঁট কাঁপল, চোখে কেমন এক চাপা অভিমানের ছায়া ফুটে উঠলো।
তারপর অনেকটা ফিসফিস করে বলল, “আমি তো আর আপনার মতো পরকীয়া করিনি, কারান। সামান্য কথাই আপনার সহ্য হলো না, তাহলে আমার জায়গায় থাকলে কী করতেন?”
ঘরটা এবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। টিভির পর্দায় নায়কের হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে, মুভির মিউজিক এখনো বাজছে। কিন্তু মিরা সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে না।

গাড়ির ভেতর বসে আছে মেয়েটি, মুখে সেই চিরচেনা গাই ফক্স মাস্ক। তার দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ। কারও জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর গাড়ির দরজায় হালকা ধাক্কা এল। মেয়েটা জানালার কাচ নামিয়ে দিল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক মুখ বাড়িয়ে বলল, “ম্যাম, এই নিন আপনার পানি।”
লোকটি পানির বোতল বাড়িয়ে ধরতেই মেয়েটি তা ধরলো। শান্ত কণ্ঠে নির্দেশ দিল, “এবার গাড়ি চালানো শুরু করো।”
ড্রাইভার বাইরের দরজা খুলে ভেতরে এল, স্টিয়ারিংয়ে বসার আগে এক ঝলক মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, যদিও মুখোশের আড়ালে কিছু বোঝা গেল না। পিছনে বসে মেয়েটি সিটে মাথা এলিয়ে দিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটি ছোট্ট মেয়ে—বয়স সাতের বেশি নয়। সঙ্গে তার মা-বাবা। মেয়েটির ছোট্ট হাত মায়ের আঙুল আঁকড়ে ধরে আছে। মহিলা বিরক্ত স্বরে বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি, রাস্তায় এভাবে আমার কলিজার টুকরাকে বের করে আনবে না। কারও চোখ লেগে গেলে?”
এটা শোনামাত্র গাড়িতে বসে থাকা মুখোশধারী মেয়েটির চোখ তীক্ষ্ণভাবে চকচক করে উঠল৷ অর্থাৎ তার শিকার ধরার সময় হয়ে এসেছে।
বাচ্চা মেয়েটির বাবা হেসে বলল, “তুমি সবকিছুতেই এত দুশ্চিন্তা করো কেন? মেয়েটা এখন বড় হচ্ছে, ওর তো বাইরের পৃথিবীটা দেখা দরকার।”

“হ্যাঁ, এভাবেই ওকে প্রশ্রয় দাও। সৌন্দর্য বেশি লোকের চোখে পড়া ভালো নয়।”
“আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু আজ তো শপিংয়ের জন্যই মেয়েটাকে এনেছি। ও ঘরে একা থাকতে পারত?”
মহিলা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি কোনোদিন মায়ের উদ্বেগ বুঝবে না।”
লোকটি মৃদু হাসল, তারপর তিনজন রিকশা ধরে চলে গেল।
গাড়ির ভেতর ড্রাইভার এবার মুখ খুলল, “ম্যাম, লহরীগঞ্জের সেই মেয়েটাকে নাকি এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী যে হচ্ছে দেশে! একটা মেয়ে এভাবে উধাও হয়ে গেল, অথচ কেউ প্রতিবাদও করছে না। শুনেছি, মেয়েটা এতিম ছিল, চাচা-চাচির বাড়িতে থাকত। কেউ পুলিশেও রিপোর্ট করেনি।”
গাই ফক্স পরিহিত মেয়েটি তখনও দূরে হারিয়ে যাওয়া রিকশাটার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর কণ্ঠে একটাই প্রশ্ন করল, “লহরীগঞ্জের মেয়েটার কথা তুমি জানলে কীভাবে?”
ড্রাইভার হেসে বলল, “ওই মেয়ে আর আমার মেয়ের বান্ধবী ছিল, ম্যাম।”
তারপরই মেয়েটির কণ্ঠ কঠিন হলো, “গাড়ি থেকে নামো।”
ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে পেছন ফিরে তাকাল, “কিন্তু ম্যাম, তাহলে গাড়ি কে চালাবে?”

“আমি বলেছি, নামো।”
কঠোর হুকুমে লোকটা আতঙ্কে গা শিউরে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলে দ্রুত নেমে গেল। মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের সিটে বসল, স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরল। কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে কাচ একটু নামিয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল, “তোমার মেয়ে দেখতে কেমন?”
ড্রাইভার স্তব্ধ হয়ে গেল। আপনমনে বিড়বিড় করল, “মালকিন হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছে কেন?”
এরপর ঢোক গিলে ম্লান হেসে বলল, “আমার মেয়ে তো সাধারণ, কালাকোলা আমার মতোই দেখতে। তবে শুনেছি, লহরীগঞ্জের মেয়েটা ছিল অপূর্ব সুন্দরী।”
এদিকে মুখোশধারী মেয়েটি কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। সামনে ধুলোর ঝড় তুলে গাড়িটা সেই রিকশাটার পেছনে ছুটে গেল।
একটু পর মেয়েটি রিকশাটাকে দেখতে পেল, এবার গতি কমিয়ে ওদের অনুসরণ করতে থাকল। তার চোখে ধীরে ধীরে অন্ধকার চেপে বসছে, ঠোঁটে অমঙ্গলের হাসি ফুটল।
নিজের মনেই ফিসফিস করে বলল, “ড্রাইভার উধাও হওয়ার কথা কেন বলল? লাশ তো আমি সরাইনি। তাহলে কে সরাল?”

তারপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি এনে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আর.এ-কে পুলিশ এমনিতেই ধরতে পারত না। লাশের সন্ধান পেলেও, তারা সেই ব্যক্তিকেই গ্রেফতার করত, যার বিরুদ্ধে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রমাণ রেখে এসেছি। তবে তাকে ধরার চেষ্টা করা মানে আকাশ-পাতাল এক করার মতো দুরূহ কাজ। অথচ এত নিখুঁত পরিকল্পনার পরও—লাশ সরাল কে?”
কিছুক্ষণ পর রিকশার চাকা ধুলো উড়িয়ে থেমে গেল। আর.এ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আজ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়। তার শিকার হাতের মুঠোয়।

সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দম্পতি দুজন একে অপরকে কিছু কথা বলল। পাশেই ছোট্ট মেয়েটা পায়ের পাতায় ভর দিয়ে হালকা লাফাচ্ছিল। তারপর পুরুষটি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে রিকশায় চড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর.এ-র ঠোঁট বাঁকা হাসিতে টান লেগে উঠল। তার চোখে দানবীয় উন্মাদনা খেলে গেল। অর্থাৎ আজকের রাত এক শিশুর জীবনের অন্তিম অধ্যায় হতে চলেছে।
মহিলাটি আদেশের স্বরে বলল, “সারাদিন শুধু দুষ্টুমি করো। এসো, ভিতরে এসো।”
মা-মেয়ে ঘরে ঢুকতেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল আর.এ। ঠিক যখন মা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, তখনই দ্রুত হাতে দরজার ফাঁকে হাত গলিয়ে দিল সে। মহিলা চমকে উঠে কপাল কুঁচকে বলল, “আজব! কে আপনি?”
কিন্তু তার আর কিছু বলার সুযোগ রইল না। এক নিমিষে মুখে চেপে ধরা হলো ভারী কাপড়, যার গাঢ় রাসায়নিক গন্ধ মুহূর্তেই তার স্নায়ু অবশ করে দিল। কয়েক সেকেন্ডের কাঁপুনি, তারপর সে নিথর হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। আর.এ ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল।
ঘরের ভেতর অন্ধকারের কোণে একজোড়া চোখ ভয়মিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। বিছানার পাশে বসে থাকা ছোট্ট মেয়েটি বুঝতে পারছে, কিছু একটা ভয়াবহ ঘটতে চলেছে, কিন্তু তার ছোট্ট মন আতঙ্কের গভীরতা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না।

আর.এ ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে একটা কাচের বোতল বের করল। বোতলের গায়ে লাল রঙের স্টিকার সাঁটা। সে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “তুমি জানো, সুন্দর চেহারা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে?”
কণ্ঠে কোনো উন্মত্ততা নেই, নেই কোনো উষ্ণতা। বরং এক ধরনের শীতল আনন্দ মিশে আছে।
“কে আ..আপনি? প.. পি.. প্লিজ এদিকে আসবেন না৷ আম…আম্মু আম্মুউউ।”
শিশুটি ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিছানার এক পাশে গুটিয়ে বসে পড়ল। কিন্তু চারপাশের ঘরটা যেন আচমকা সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, কোথাও পালানোর জায়গা নেই। মুহূর্তের মধ্যে আর.এ তার চুল মুঠো করে ধরে ফেলল। শিশুটির ক্ষীণ শরীর নিস্ফলভাবে কাঁপছে, সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু ঠিক তখনই ভারী একটা কাপড় মুখে চেপে ধরল আর.এ।
একটা দমবন্ধ করা রাসায়নিক গন্ধ…
কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটির চারপাশ দুলে উঠল। চোখ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এল। জগৎটা কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে আসছে। মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা নিস্তেজ হতে লাগল। ঠিক অজ্ঞান হওয়ার আগ মুহূর্তে তার কানে এল ফিসফিসে কণ্ঠ, “তুমি আর সুন্দর থাকবে না, বেবিগার্ল। আমি তোমাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেব।”

পরদিন সকাল। রাস্তার পাশে বসে এক মুচি তার কাজ করছিল। পাথরের উপর হাতুড়ির তাল ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ চোখ গেল দূরে পড়ে থাকা একটা ছোট বস্তুতে। প্রথমে ভেবেছিল পলিথিনের ব্যাগ, কিন্তু ভালো করে দেখতেই হাতুড়িটি তার হাত থেকে খসে পড়ল।
তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল। বুক ধক ধক করতে লাগল।

“মাগোওও!”
চিৎকার করে উঠল সে, কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই।
তার সামনে পড়ে আছে একটা ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত ছোট্ট দেহ। তার মুখ… না, সেখানে কোনো মুখমণ্ডল নেই!
মাংস গলে গলে পড়েছে, চোখের জায়গায় দগদগে ফাঁকা গর্ত। পোশাক ছেঁড়া, র*ক্তে ভিজে আছে। একপাশের হাত নেই, আরেক হাতে চকচকে ব্রেসলেট ঝুলছে। তার চারপাশে তখনও অ্যাসিডের পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে আছে।
মুচির শরীর কাঁপতে লাগল। ঠোঁট শুকিয়ে এল। মুচি লোকটি আতঙ্কে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার ঠোঁট কাঁপছে, গলা দিয়ে বের হলো, “আল্লাহ গো… ও আল্লাহ, মাইয়াটারে কে এমনে মারলো! ও মা গো, ও আল্লাহ গো। এগুলো কি দ্যাখলাম আমি? ও মাবুদ…”
ঠিক তখনই দূরের একটা গাড়ির ভিতর থেকে কেউ তার দিকেই তাকিয়ে হাসল। স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসা গাই ফক্স মাস্ক পরা এক নারী আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখল। ঠোঁটের কোণে বিকৃত তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তার হাতে এখনও লেগে আছে পো*ড়া চামড়ার টুকরো।
সে আঙুলের ফাঁকে সেটি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “হোলি ব্রো। আরেকটা ফা*কিং সুন্দর মুখ নরকে পাঠিয়ে দিলাম।”

তারপর প্রতিজ্ঞার স্বরে বলল, “এভাবেই একে একে সুন্দরীদের নিঃশেষ করে একদিন আমি পৃথিবী থেকে সমস্ত সৌন্দর্যের চিহ্ন মুছে ফেলব।”
সে কালো সানগ্লাস চোখে পড়ল। ইঞ্জিন গর্জে উঠল, আর ধুলো উড়িয়ে সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল মেয়েটি।
মুচি লোকটি উঠে দাঁড়ালো। তার শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল, ঘাম জমে গাল বেয়ে নামছে। কিন্তু ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে এলো একটা ধাতব শব্দ। লোকটা পেছনে তাকানোর আগেই তার ঘাড়ের উপর কোদালের তীক্ষ্ণ ফলক নেমে এলো। এক ঝটকায় তার মেরুদণ্ড বিদীর্ণ হয়ে বুক ফুঁড়ে কোদাল বেরিয়ে এলো সামনের দিকে। ঠোঁট সামান্য কেঁপে উঠল, তারপর তার দৃষ্টির শেষ ছাপ রইল ফ্যাকাশে আকাশের দিকে। সে দমবন্ধ হয়ে ঢলে পড়ল মাটিতে। রক্তের স্রোত একপাশে গড়িয়ে পড়ছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি নিঃশব্দে হেসে উঠল। আরেকটি কো*প, তারপর আরেকটি। তার বুকের একই জায়গায় একাধিক কো*প মারা হলো। একটু পর মুচির দেহ কেটেকুটে ছিন্নভিন্ন করা হলো। র*ক্তে রাস্তা রঞ্জিত হলো।
লোকটি পা বাড়িয়ে সামনে গেল। তারপর পানি এনে জায়গাটা ধুয়ে দিল। ব্যাগ খুলে প্রথমে মুচির ছিন্নভিন্ন দেহ ঢুকাল, তারপর সেই বিকৃত শিশুটির দেহ। ব্যাগ বন্ধ করল। গাড়ির ডিকিতে চাপিয়ে দিল। গাড়ি চলতে শুরু করল, রক্তের গন্ধ বাতাসে মিশে গেল।
গন্তব্য অজানা।

অফিসে যাওয়ার আগে কারান বাথরুমে ঢুকে গোসল শুরু করল। কয়েক মিনিট পরই মিরার ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটে উঠল। সে ফোন বের করে স্মার্ট হোম অ্যাপে ঢুকে ‘ওয়াটার সাপ্লাই অফ’ অপশন টিপে দিল। এর মধ্যেই ভেতর থেকে কারান বিরক্ত স্বরে বলে উঠল, “ফরিদ কাকা, পানি গেল কোথায়? ওয়াটার পাম্প চেক করো।”
ফরিদ মিয়া কিছু বলতে যাবে, তখনই মিরা গম্ভীর মুখে বলে, “কাকা, আমি দেখে নিচ্ছি। আপনি যান।”
ফরিদ মিয়া কিঞ্চিৎ পরিমাণে হেসে প্রস্থান করলো। আর মিরা ফোন হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেও পানি না পেয়ে কারান আরও চেঁচিয়ে উঠল, “পানি আসছে না। ফরিদ কাকা, তাড়াতাড়ি দেখো, অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
অন্য সময় হলে সে অপেক্ষা করত, কিন্তু আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। কোনো উপায় না দেখে সে দরজা খুলে রুমে বেরিয়ে এল, চোখ আধবোজা রেখেই বলে উঠল, “ফরিদ কাকা।”

কিন্তু সামনে ফরিদের বদলে মিরাকে দেখে তার চোখ কুঁচকে গেল। এদিকে কারানের তোয়ালে জড়ানো, সাবানে ঢাকা ভেজা শরীর দেখে এবার আর মিরা হাসি চেপে রাখতে পারল না। খিলখিল করে হেসে উঠল।
তার হাসির ঝংকারে কারানের বিরক্তি আরও বেড়ে গেল। দাঁত কামড়ে বলল, “এত হাসার কী হলো? আমার চোখে সাবানের ফেনা ঢুকে যাচ্ছে। মিরা, জলদি ওয়াটার সাপ্লাই চালু করো।”
কারানের চোখে সত্যি সত্যিই ফেনা চলে যাচ্ছে দেখে মিরা দ্রুত ফোনে অ্যাপ খুলে ‘ওয়াটার সাপ্লাই অন’ অপশন টিপে দিল। এরপর গলা মিষ্টি করে বলল, “এবার গোসলে যান, জাঁহাপনা।”
কিন্তু কারান এক চোখ আধবোজা রেখেই মিরার দিকে এগিয়ে এসে, তাকে নিজের ভেজা শরীরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিল। এরপর চুল ঝাঁকিয়ে সমস্ত সাবানের ফেনা মিরার গায়ে উড়িয়ে দিল। মিরা চোখ বন্ধ করে মুখ কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠল, “কারান! কী করছেন?”

কারান আর সময় নষ্ট করল না। রাগের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। সে যেতেই মিরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল, “আল্লাহ! ওনার চেহারাটা দেখার মতো ছিল। ভাগ্যিস এই সুযোগটা হাতছাড়া হয়নি।”
খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে সাবানের ফেনা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বিড়বিড় করল, “বেটা, কত্ত বড় খারাপ! ধুর, শাড়িটা চেঞ্জ করতে হবে।”
তারপর ওয়ার্ড্রোব থেকে আকাশরঙা একখানা শাড়ি বের করে পরে নিল।
কিছুক্ষণ পর শুভ্র বাথরোব গায়ে দিয়ে কারান ঘরে ঢুকল। কিন্তু ঢুকেই আচমকা মিরার দুই হাত এক করে দেয়ালে ঠেসে ধরল। ক্রোধের চরম সীমানায় পৌঁছে বলল, “কি শুরু করেছ তুমি?”
মিরা কারানের মুখের লেলিহান শিখার মতো রাগ দেখে একটু থমকে গেলেও স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমার হাতে লাগছে।”

কারান মুহূর্তেই সংযত হলো। ধীরে ধীরে তার হাত ছেড়ে দিল। কিন্তু শক্ত বাঁধনের চাপে মিরার ফরসা কব্জায় লালচে ছাপ বসে গেছে। সে চোখ নামিয়ে হাত ডলতে লাগল।
কারান দাঁত চেপে বলল, “রিভেঞ্জ নিচ্ছো তুমি?”
মিরা এবার চোখ তুলে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল।
“হ্যাঁ নিচ্ছি। আর এটা আপনার প্রাপ্য।”
কারান ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের ছাপ টেনে বলল, “ঠিক আছে। তা কতদিন চলবে এসব?”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে?”
কারান ঠান্ডা স্বরে বলল, “মানে, তোমার এই প্রতিশোধের খেলা কতদিন চলবে? আর কবে থেকে তুমি আমাকে ভালোবাসবে?”
“এটা কেমন প্রশ্ন? আমি মন থেকে যেদিন আপনাকে গ্রহণ করতে পারব, সেদিনই ভালোবাসব। সেদিনই এসব শেষ হবে।”
“উঁহুঁ। দুই মাস।”

মিরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। কারান নিঃসংকোচে বলে চলল, “তোমাকে আমি দুই মাস সময় দিলাম। এগারো মাসের তুলনায় এটা কিছুই না, জানি। কিন্তু আমি চাই না, এই টম অ্যান্ড জেরির খেলায় আমাদের অর্ধেক জীবন কেটে যাক। তোমার সাথে আমি অনেক মধুর সময় কাটাতে চাই, মিরা। তাই দুই মাসের মধ্যে যত আক্রোশ আছে, মিটিয়ে নাও। আমাকে শাস্তি দাও, প্রয়োজনে মারো, আমি কিছু মনে করব না। কিন্তু দুই মাস পর তোমাকে আমাকে ভালোবাসতেই হবে।”
মিরা হতবাক হয়ে কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কারান কাঠখোট্টা গলায় বলল, “কিছু বলার থাকলে বলো।”
মিরা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল, “আর যদি ভালো না বাসি?”
কারান শীতল হেসে বিড়বিড় করল, “তাহলে তোমাকে আমি বাধ্য করব ভালোবাসতে।”
মিরা চমকে উঠে কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “কি বললেন?”

Tell me who I am part 18

কারান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ক্লান্ত চোখে বলল, “nothing. But once more, I want to tell you, Mira, you will love me.”
তার চোখের সেই মুগ্ধতার আভা মিরার অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে চাইল। সে অবচেতনে ঢোক গিলে নিল। অথচ কারানের দৃষ্টি থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারল না।

Tell me who I am part 20