Tell me who I am part 2
আয়সা ইসলাম মনি
শারমিন ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি নিয়ে বলল, “ম্যাডাম, একটা প্রবাদ আছে না; আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী। সৌন্দর্য কে না ভালোবাসে বলুন?”
মিরা কোনো উত্তর দিল না। শুধু একটি গভীর নিশ্বাস ফেলে মন থেকে বেদনাকে সরানোর চেষ্টা করল। শারমিন আবার বলল, “ম্যাডাম, পৃথিবীতে কত রকম ফুল আছে বলুন। কিন্তু আমরা সেই ফুলটাই হাতে নিই, যা আমাদের চোখে সুন্দর লাগে। আপনিও কি তাই করেননি?”
মিরা মৃদু হাসির আড়ালে গভীর বেদনাকে লুকিয়ে বলল, “আপনার কথা ঠিক। তবে জানেন, আমার চোখে দেখা প্রতিটি ফুলই সুন্দর ছিল। তাই হয়ত আমি সৌন্দর্যের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারিনি।”
এই আলাপের মাঝেই আমান হোসেন কয়েদখানায় প্রবেশ করল। শারমিনের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলল, “কতদূর কাজ হলো, শারমিন?”
শারমিন ধীরস্বরে মাথা নত করে উত্তর দিল, “জি স্যার, উনি স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন।”
আমান শারমিনের কথায় একটু মাথা ঝাঁকিয়ে মিরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ সংকুচিত করে ভারী কণ্ঠে বলল, “বড়লোকের বউ হয়েও খু*ন করতে যাওয়ার কী দরকার ছিল? তাও কিনা নিজের স্বামীকে! নাকি পরকীয়ার কোনো কেস?”
মিরা উত্তরহীন দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে রাখে। তার এমন নিস্তব্ধতায় আমানের ভ্রূ কুঞ্চিত হলো। তিনি ক্রুদ্ধ স্বরে শারমিনকে নির্দেশ দিলেন, “প্রত্যেকটি কথা রেকর্ড করবেন। হোক সে কারান চৌধুরির স্ত্রী বা আসাদ চৌধুরির বৌমা, ছাড় দেওয়া হবে না। যথেষ্ট সম্মান করা হচ্ছে। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে…”
আমান উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে থেমে গেল। কিন্তু এর বেশি কিছু বলার সাহস করলেন না, কারণ মিরাকে কিছু বলার অর্থ হলো চাকরিচ্যুত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আমান ক্রুদ্ধ মুখে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই মিরার ঠোঁট অতি মৃদু নড়ে উঠলো, “ও কি বেঁচে আছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মিরার প্রশ্ন শুনে আমান থমকে দাঁড়াল। বিস্ময়ভরা চোখে পেছন ফিরে বলল, “কে? মিস্টার কারান চৌধুরি?”
মিরা চোখ নামানো অবস্থাতেই নীচু গলায় জবাব দিল, “হ্যাঁ।”
আমান একটু আড় হেসে বিদ্রুপের সুরে বলল, “বাবাহ! আপনার কি মনে হয় যেভাবে আ*ঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করেছেন, তারপরও কি তার বেঁচে থাকার কথা?”
এ কথায় মিরার মুখ বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। সহসা তার চোখ থেকে নিঃশব্দে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এটা অবলোকন করে আমান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। কারণ কাল জেলে আসার পর থেকে ক্ষণকাল আগে পর্যন্তও মিরার চোখে এক বিন্দু জল দেখা যায়নি। আমান কঠোর স্বরে বলল, “এভাবে কেঁদে পুলিশের মন গলাতে পারবেন না। প্রতিদিনই আপনার মতো চার পাঁচটা কয়েদি দেখি।”
থেমে শারমিনের পানে তাকিয়ে বলল, “শারমিন, ওনার মুখ থেকে বাকি কথা বের করুন। আমি রিপোর্টটা লিখে আসি।”
“ওকে, স্যার।”
আমান প্রস্থান করলেন, কিন্তু মিরার অশ্রুধারা থামবার নয়। সে এমন কিছু শুনতে প্রস্তুত ছিল না। যাকে সে নিজের হাতে প্রাণনাশের চেষ্টায় আক্রমণ করেছিল, আজ তার জন্যই বুকের গভীরে মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হলো, যেন স্বামীকে আঘাত করে আসেনি, নিজেকেই ধ্বংস করে এসেছে।
শারমিন কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “ম্যাডাম, কান্না করে কোনো লাভ হবে না। এখানে আপনার কান্নার কদর নেই। তার চেয়ে ভালো হবে আপনি ঘটনাটা খুলে বলুন।”
মিরা ডান হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে, নিজের ভিতর থেকে উঠে আসা সব আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “জি।”
তারপর ঢোক গিলে কণ্ঠ পরিষ্কার করে, ধীরে ধীরে ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করল।
ঘড়ির কাঁটা রাত একটার ঘর ছুঁইছুঁই। মিরা নিজের কক্ষে শুয়ে আছে, কিন্তু নিদ্রা তার চোখের পাতায় স্পর্শ করছে না। মনে যেন অজানা এক অশান্তি। বারবার এপাশ-ওপাশ করতে করতে সে ভাবে, “আজকে কি ঘুম আসবে না? ওকে দেখার পর থেকেই সবকিছু যেন এলোমেলো লাগছে।”
অস্থির হয়ে উঠে বসে সে। খানিকক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থেকে, চার্জ থেকে ফোনটি খুলে হাতে নিল। কারানের ছবিটি খুঁজে বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। কখনো ছবিটি জুম করে কারানের গভীর নীল চোখ দুটো খতিয়ে খতিয়ে দেখে, আবার কখনো দূর থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিঞ্চিৎ হাসি ছড়িয়ে বলে ওঠে, “ব্লু আইজ হিপনোটাইজ তেরি কারদি অ্যায় মেইনু… আয়হায়! আমি তো গেলাম একেবারে।”
তারপর হঠাৎই চোখ ফিরিয়ে নেয়। ফের ফিসফিস করে বলে, “না, ওর চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যাবে না।”
তবুও লুকোচুরি করা দৃষ্টিতে আবারও কারানের ছবি দেখতে শুরু করে। এবার মুখে এক চপল হাসির রেখা ফুটে ওঠে। মনে মনে বলে, “এমন ভাব করছি যেন ও আমার পাশে বসে আছে, আর আমার এসব পাগলামি দেখছে। আমার বাগদত্তা, আমি দেখব না তো কে দেখবে?”
মিরার ভাবভঙ্গিতে তখন এক শিশুসুলভ কৌতুক খেলে যায়। সে পুনরায় বলল, “আচ্ছা, বাবা শুধু একটাই পিক দিল! আরও কয়েকটা দিতে পারত না? ওয়েট ওয়েট, ওর নিশ্চয়ই ফেসবুক আইডি আছে। আসাদ আঙ্কেলের ছেলে, সারনেইম তো চৌধুরিই হবে।”
এই ভাবনায় সে দ্রুত ফেসবুক খুলে অনুসন্ধানে মগ্ন হয়ে যায়। একটু পরই সবার উপরে কারানের প্রোফাইল দেখে মিরার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে ওঠে। ভ্রূ উঁচিয়ে বলে, “বাবাহ, ফেমাস! আচ্ছা, উনি কি সেই কারান চৌধুরি, যাকে টিভিতে দেখেছি?”
প্রোফাইলের ছবিগুলো দেখতে দেখতে অবিলম্বে সে যেন নিজেকে অন্য জগতে খুঁজে পায়।
“ওহ, তার মানে এই কারানই আসাদ আঙ্কেলের ছেলে, সেই হট টপ বিজনেসম্যান কারান চৌধুরি!”
মিরার মুখে হালকা লজ্জার আভা ফুটে ওঠে। সে সারা রাত বসে বসে কারানের ছবিগুলো দেখতেই থাকে। তার মনপ্রাঙ্গণে আজ অনাবিল বাসন্তিক ছোঁয়া নেমে এসেছে। তার হৃদয় আকুল হয়ে উঠেছে সেই পুরুষের জন্য, যার ছবি একে একে তার মনের কোণে কোণে জায়গা করে নিচ্ছে। অথচ এই অপরূপা নারী নিজেও জানে না যে, তার নিজের সৌন্দর্যই কতখানি অমোঘ।
কিছুদিন পর তার বিয়ে, তার এই রূপের অধিকারী অন্য কেউ হবে। তখন হয়ত মমতাজের দীর্ঘস্থায়ী ভয়ের অবসান ঘটবে। কিন্তু এখানেই কি ভয়ের শেষ?
ঘরটা পুরো অন্ধকার নয়, সিলিং এ একটা হলদেটে বাল্ব ঝুলছে। বাল্বটা মাঝে মাঝে মিটিমিটি করে জ্বলছে। এক কোণে পড়ে আছে পুরোনো একটা চেয়ার, তাতে শুকনো র*ক্ত লেগে আছে, আর কিছু ভাঙা দাঁতের টুকরো পরে আছে। ঘরটা প্রায় নিঃশব্দ। শুধু লোহার শিকলের ঠুনঠুন শব্দ ভেসে আসছে। কালো কোট পরা পুরুষটি ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলো। তার পায়ের নিচে র*ক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে আছে, সেই র*ক্তে ধুলো জমেছে। তার দুই হাতে কালো হ্যান্ডগ্লাভস, আর ডান হাতে একটা ছোট হাতু”ড়ি ধরে রয়েছে। ঘরের বাতাসে ভেসে আসছে র*ক্তের গন্ধ।
অন্যদিকে কাঠের চেয়ারে চারজন মানুষ বাঁধা। কারও হাত পিছনে বাঁধা, কারও পা শক্ত করে মোটা দড়িতে আটকানো। তবে চারজনেরই মুখে টেপ লাগানো। কেউ কেউ এতক্ষণ এতো লড়াই করেছে যে, চেয়ারের পেছনে আঙুলগুলো নীলচে হয়ে গেছে। কেউ ঘেমে একাকার, কেউ তো মূত্রত্যাগ করে ফেলেছে, কেউ আবার পাথরের মতো বসে আছে। একজনের চোখ বড় হয়ে গেছে, সে দম আটকে আসার মতো নিশ্বাস নিচ্ছে। আরেকজন এতটাই অসাড় হয়ে আছে যে চোয়াল কাঁপলেও চোখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। পুরোনো ঘামে ভেজা শরীরের গন্ধে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে সবার।
কালো কোট পরিহিত পুরুষটি টেবিলের ওপর রাখা ধাতব যন্ত্রপাতির ওপর হাত রাখল। ধাতব টেবিলটা র*ক্তে বিবর্ণ। যেখানে তার হাত রাখা, সেখানেই পুরোনো র*ক্তের দাগ আর আঁচড় দেখা যাচ্ছে, যেন কেউ নখ দিয়ে আঁচড়ে বের হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। কিছু জায়গায় চুল পরে আছে, আর একটা কোণায় আধা গলে যাওয়া একটা কানের দুল ঝুলে আছে। পুরুষটির আঙুল ধারালো কাঁচি, জংধরা করাত, পেরেক ঠোকার হাতুড়ি আর ইলেকট্রিক প্লায়ারের ওপর দিয়ে বুলিয়ে গেল। মনে হচ্ছে, বেছে নিচ্ছে—কার জন্য কোনটা লাগবে। তার হাতুড়িটা ধাতব টেবিলের গায়ে ঠুকিয়ে একটা টং করে শব্দ তোলে, আর সেই ধ্বনি ঘরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে যেন বন্দিদের হাড়ে গিয়ে লাগে।
সে মোলায়েম গলায় বলল, “অনেক সময় দিয়ে ফেলেছি। নাও ইটস টাইম ফর মি টু শো মাই গেম।”
কথাটা শুনে সবাই কাঁপতে লাগলো। সে প্রথম বন্দির সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি কাঁপছে, তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। মুখের টেপ সরানোর দরকার নেই, কারণ আতঙ্কের চোটে সে এমনিতেই বোবা হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে দূরে একটা ইঁদুর দৌড় দিয়ে গেল। এটা দেখে বন্দির শরীরটা কাঁপল। ঝুলন্ত বাল্বটা অঅকস্মাৎ বন্ধ হয়ে আবার জ্বলে উঠল, আর তাতে সেই পুরুষটির মুখটা কিছুক্ষণ অন্ধকারে গলে গিয়ে নতুন বিকৃত রূপে আবির্ভূত হলো।
পুরুষটি টেবিল থেকে প্লায়ারটি তুলল, তারপর লোকটির ডান হাতের তর্জনী আঙুল চেপে ধরল। এভাবে কয়েক সেকেন্ড চেপে ধরে রাখল। অল্প সময় পর পুরুষটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে লোকটির ন*খটি আস্তে করে উপড়ে নিল। নখ উপড়ানোর পর আঙুলটার মাংস আলগা হয়ে ঝুলে আছে। ভেতরের তাজা মাংসটা লালচে নয়, বরং কাঁচা মাংসের মতো ঘোলাটে আর ফ্যাকাশে। আঙুলের ডগা মুহূর্তেই র*ক্তে ভিজে উঠল। ক্ষতস্থান থেকে র*ক্ত টুপটাপ করে মেঝেতে পড়তে লাগল।
অথচ লোকটি একবারও চিৎকার করতে পারছে না। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে, কিন্তু গলায় আটকে থাকা গোঙানি ছাড়া আর কিছুই বেরোচ্ছে না। ধীরে ধীরে চাপ বাড়িয়ে পুরুষটি পরবর্তী নখের নিচের র*ক্তাক্ত মাংস ছিঁড়ে ফেলল। প্রথমে তুলে ফেলল তর্জনীর নখ, তারপর মধ্যমার। প্রতিটি টানে র*ক্তের প্রতিটি ফোঁটার সঙ্গে যেন বন্দির প্রাণশক্তি ঝরে পড়ছিল। ব্যথায় বন্দির সারা শরীর খিঁচিয়ে উঠল। তার পেটের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। কিন্তু মৃ*ত্যু হয় না কেন? মৃ*ত্যু হলেই তো এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।
এদিকে নির্যাতক পুরুষটি এগিয়ে গিয়ে হাতে একটা জার নিয়ে আসতে আসতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “মানুষ ভাবে মৃ*ত্যু ভয়ংকর। আসলে মৃ*ত্যু তো মুক্তি। ভয়ংকর হলো… ম*রতে না পারা।”
কথার তালে তালে সে নখ উঠিয়ে কাচের জারে ভরে রাখছে। এদিকে নখ তোলার পরেও খেলা শেষ হয়নি। এখন শুরু হবে আসল পরীক্ষা। পুরুষটি টেবিল থেকে লবণের কৌটা তুলল। চকচকে সাদা দানাগুলো বন্দির র*ক্তাক্ত আঙুলে ছড়িয়ে দিল। ক্ষতস্থানে লবণ পড়তেই সেখানকার শিরাগুলো কেঁপে উঠল, আর একধরনের হলদেটে তরল পড়তে লাগল। ব্যথার যন্ত্রণায় বন্দির মুখ কুঁচকে এলো, কিন্তু মুখ তো বাধা, চিৎকার করারও যে উপায় নেই। লোকটির শরীর ঝাঁকি খেল, চোখগুলো কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইলো।
দ্বিতীয় বন্দি তখনো নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চোখের সামনে এসব দেখে তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। দাঁতের কোঠরে দাঁত চেপে সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু ইতিমধ্যে চোখের কোণে জল জমে উঠেছিল। সে আগেও অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। এখন তার চোখ জোড়া অপূর্ণ নিদ্রার ক্লান্তি আর অসীম বেদনার ভারে ফুলে উঠেছে। চোখের কোল ঘিরে নেমে এসেছে বিষণ্নতার গাঢ় অন্ধকার। একটানা অশ্রুপাতে তার চোখের মণি বিবর্ণ হয়ে গেছে—নীলাভ গভীরতা হারিয়ে র*ক্তিম বেদনায় রঞ্জিত অচেনা দৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে তা। হৃদয়ের রক্তঝরা কষ্ট যেন গলে গলে এসে জমা হয়েছে চোখের পাতায়।
কালো কোট পরা সেই ব্যক্তিটি তখন কব্জির ঘড়ির দিকে তাকাল। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলল, “তুমি কি জানো, মানুষ কতক্ষণ ব্যথা সহ্য করতে পারে?”
এরপর সে দ্বিতীয় লোকটির হাত ধরল। অন্য হাতে তার মুখ থেকে টেপ সরিয়ে নিল। বন্দি লোকটা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কে… কে তুমি? কে-কেন মারছো? কি ভুল আমাদের?”
“তোমার টেপটা খোলা উচিত হয়নি। বড্ড প্রশ্ন করছো তুমি। কিন্তু চিৎকারের শব্দ শুনতে যে আমার আনন্দ হয়।”
সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকালো। সেই ভয়াবহ দৃষ্টিতে বন্দি লোকটার ঘাম ছুটে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। বন্দির শরীর হিম হয়ে গেল। কিন্তু দড়ির বাঁধনে তার হাত-পা অসাড় হয়ে আছে। এরমধ্যেই কালো কোট পরিহিত পুরুষটি নিজ পকেট থেকে একটা সরু, লম্বা সুঁই বের করল। অদ্ভুতভাবে সে সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। তারপর এক ঝটকায় লোকটির নখের নিচে সূক্ষ্ম সূঁচ বিঁধে দিল। ক্ষীণ একটা শব্দ হলো। মুহূর্তেই আঙুলের কোষ ছিঁড়ে সূক্ষ্ম এক র*ক্তরেখা চিরিৎ করে গড়িয়ে পড়ল। লোকটির শরীর কেঁপে উঠল। তার একপাশের আঙুল এতটাই ফুলে উঠেছিল যে, চাপ দিতেই পুঁজ বেরিয়ে এলো। সে চেঁচাতে চাইলো, কিন্তু গলা দিয়ে কেবল হাঁচির মতো একটা কুৎসিত শব্দ বের হলো।
নিশ্ছিদ্র নীরবতায় বন্দির গলা চিরে ওঠা গোঙানির আর্তনাদ যেন হঠাৎ করেই ঘরটিকে বিভীষিকাময় জীবন্ত সত্তায় রূপ দিল। মনে হলো, কোনো অদৃশ্য অস্তিত্ব বন্দির ব্যথায় উপভোগ করছে। আতঙ্কের তীব্রতা বন্দীদের মনোজগতকে গ্রাস করতে শুরু করল। কেউ কেউ বিভ্রমে ভুগতে লাগল। দেখতে পেলো, ছায়া থেকে নেমে আসছে র*ক্তমাখা ছায়ামূর্তি, যাদের হাতে নেই মাংস, চোখে নেই পাতা, তবু তারা তাকিয়ে আছে ক্ষুধার্ত চোখে। কারো চোখে পাশে বসা বন্দিই মৃত্যুদূতের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হলো। চিন্তার বিক্ষিপ্ত প্রবাহে কেউ কেউ হ্যালুসিনেশন ও মানসিক বিপর্যয়ে ভুগতে লাগল। ক্রমশ অজানা মানসিক ভার ঘনীভূত হতে থাকল, যার ভারে তারা কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও যন্ত্রণার অতল গহ্বরে ডুবে যেতে লাগল।
অথচ কোট পরিহিত পুরুষটি থামেনি। নিপুণ শিকারির মতো সে আরেকটি আঙুল বেছে নিল। ঠান্ডা মাথায় সেখানে সুঁই ঢুকিয়ে দিল। ফের অনিবার্য যন্ত্রণা শুরু হলো। র*ক্ত এবার আরেকটি সরু ধারা হয়ে বেয়ে নামল। এবার আরেকটি আঙুলে আরও একটি সুঁই ঢুকিয়ে দিল। একে একে দশ আঙুলেই এভাবে চলতেই থাকলো। বন্দির মনে হলো, প্রতিবার সূঁচ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষজুড়ে অদৃশ্য প্রেতাত্মারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।
লোকটির নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। ফুসফুস দু’টি এখন অনাহূত বেদনাবাহকের ভার বহন করছে। চোখের তারা উল্টে যাচ্ছে, মুখে বমির ঢেকুর ঠেলছে, বমির ভাব দমন করতে তার সারা শরীর কাঁপছে। কিন্তু সে জানে, এই কামরায় দুর্বলতা প্রকাশ মানে মৃত্যুর আমন্ত্রণ নয়, বরং মৃত্যুর পূর্বাভাসস্বরূপ কঠোর শাস্তি। সে কেবল গভীর শ্বাস টেনে চেয়ারের পেছনে মাথা হেলিয়ে দিল। কিন্তু কথা বলল না। কারণ তাহলে শাস্তি দ্বিগুণ হতে পারে। অথচ তার কানজুড়ে তখনো বাজছে অন্য বন্দিদের ক্ষীণ গোঙানির করুণ সুর।
কালো কোট পরা লোকটা এবার মেঝে থেকে একটা ছোট হাতুড়ি তুলল। ধাতব শব্দে সেটা ধরা মাত্র ঘরটা কেঁপে উঠল। সবার মনে হলো, এবার হয়ত কোনো চোয়াল ভাঙবে, অথবা হাঁটু কিংবা হয়ত মেরুদণ্ড।
প্রথম দুইজনের শাস্তি অবলোকন করে তৃতীয় বন্দি নিজের অজান্তেই প্রস্রাব করে ফেলেছে। তার চোখে শূন্যতা খেলা করছে, ঠোঁট নড়ে না, শুধু শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। তবে এখন চোখ বন্ধ করে রয়েছে। অর্থাৎ এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। এদিকে পুরুষটি হাতুড়িটা টেবিলে রেখে এবার টেবিল থেকে একটা ছোট, ধারালো ব্লেড তুলল। সে বন্দির হাতের পেছনে ব্লেডের মাথাটা রাখল, তারপর খুব ধীরে টান দিল। ত্বকটা ফেটে গিয়ে এক সরু র*ক্তের রেখা বেরিয়ে এলো।
কোট পরিহিত পুরুষটি তির্যক হেসে বলল, “কেন জানি না, নিষ্পাপদের সাথে খেলতে আমার বেশি ভালো লাগে। কিন্তু আজকের মজাটা আরো দীর্ঘ করে নিতে চাই।”
সে এবার লোকটার কাঁধের কাছ থেকে শুরু করল। পোচ দিতেই ব্লেডের নিচে মাংস কেঁপে উঠল। এরমধ্যেই ধীর গতিতে র*ক্ত বেরোলো, আর এক ঝলক কাঁচা মাংস দেখা গেল। বন্দী এবার সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলল।
চারজনের মধ্যে একজন এখনও অপেক্ষা করছে। সে একজন মহিলা। তার ভাগ্যে কী আছে, সে জানে না।
কিন্তু চোখের সামনে যা দেখছে, তাতে শরীরের প্রতিটা রক্তকণা জমে যাচ্ছে। চোখ তখন ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ঠোঁট ফাটিয়ে সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু মুখ বাঁধা। সে কেবল কাঁপছিল। মনে হচ্ছে আতঙ্কে শরীরের প্রতিটা কোষ বিদীর্ণ হয়ে গেছে। নিজের ঠোঁট কামড়ে র*ক্ত বের করে ফেলেছে সে। চোখের সামনে বাস্তব বিভীষিকার নাটক চলছে আর সে দর্শক—কিন্তু জানে, একটু পরেই সে এই নাটকের অভিনেত্রী হতে চলেছে।
ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাপড়, র*ক্তমাখা ছুরি, দেয়ালে লালচে ছোপ দেখে নারী বন্দী আরও আতঙ্কিত হয়ে পরে।
সে ভাবতে থাকে, “তার-তারমানে… আগেও এমন করেই কাউকে মে*রেছিল।”
ঢোক গিলে নিল সে।
ওদিকে একটা সাদা কাপড় দিয়ে পুরুষটি হাতের র*ক্ত মুছতে মুছতে বলল, “তোমার জন্য একটু ভিন্ন কিছু রেখে দিলাম। তবে এটা ভেবো না, মেয়ে বলে ছাড় দিব। আমার কাছে নারীপুরুষ সব একই। আমি আবার খু*নের ক্ষেত্রে বৈষম্য পছন্দ করি না।”
সে মহিলার চোখের পানি দেখে বলল, “তুমি কাঁদো, আমি হাসি। এটা দারুণ ভারসাম্য, তাই না? তুমি জানো, গন্ধ… পো*ড়া মাংসের গন্ধ, এটা আমার ঘুমের ওষুধ।”
কথাটা শুনে মহিলাটার অন্তত কেঁপে উঠলো। বারবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালানো। সেই চেষ্টায় পিছনে বাধা দড়িও র*ক্তাক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু কথা বলার উপায় নেই। মুখ যে বাধা। আবার উপায় থাকলেও হয়ত বলতো না।
এদিকে পুরুষটি ঘরের কোণে রাখা একটা ভারী ব্যাগ খুলতে গেল। ব্যাগের জিপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে ধাতব কিছু একটা ঠকঠক শব্দ করে উঠল। পুরুষটি ঠোঁটের একপাশে হাসি টেনে ভারী ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট গ্যাস বার্নার, সঙ্গে এক জোড়া লোহার চিমটা বের করল।
সেই সরঞ্জামের দিকে মহিলার দৃষ্টি জমে গেল। তার নিশ্বাসের গতিও থমকে এলো। অন্য বন্দিরা কাতরাচ্ছে, গোঙাচ্ছে, কিন্তু কেউই এখন আর প্রতিবাদ করতে পারছে না। কক্ষের একমাত্র শব্দ হলো পুরুষটির শান্ত নিশ্বাস আর ধাতব যন্ত্রপাতির খচখচানি। মহিলার শ্বাস রোধ হয়ে আসে, মুখে বমির ভাব হয়। ইতোমধ্যে কপাল ঘামে ভিজে গেছে। তার হাত-পা জড়সড় হয়ে আছে।
পুরুষটি গ্যাস বার্নারের সুইচ ঘোরাল। একটা নীলাভ শিখা জ্বলে উঠলো। শিখাটি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। আলোটা মহিলার চোখে পড়ে ভয় আরও বাড়িয়ে দিল। বার্নারের শব্দটা ধীরে ধীরে তীব্রতর হয়, আর সেই শব্দে নারীর হৃদকম্পনের গতিও বাড়তে থাকে।
পুরুষটি শান্ত গলায় বলল, “শ্যাল উই বিগিন দেন? হুম?”
সে আড় হেসে একহাতে গ্যাস বার্নার ধরে, অন্যহাতে ধাতব চিমটা তুলে নিল। তারপর সেই চিমটাটা বার্নারের শিখার ওপর ধরল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধাতু লালচে গরম হয়ে উঠল। একটা শো শো শব্দ শোনা গেল। মহিলাটি নড়েচড়ে উঠল। তার চোখে অসহায় আকুতি স্পষ্ট। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তবে এ পানির ফোঁটা দেখে লোকটার চোখে-মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠে। পুরুষটি ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। গরম ধাতব চিমটাটা মহিলার মুখের সামনে ধরে বলল, “আমি শুনেছি, ব্যথার সবচেয়ে তীব্র অনুভূতি হয়, যখন চামড়ার নিচের স্নায়ুগুলো একসঙ্গে পু*ড়ে যায়। বাট নাও, ইটস টাইম টু প্রুভ ইট।”
শুধু আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বার্নারটা একবার তার গায়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে থামায়। এরপর চিমটা দিয়ে মেয়েটার চুলের গোড়া ধরে, এক টানে কিছুটা ছিঁড়ে ফেলে। ব্যথায় মহিলার মুখ কুঁচকে এলো। তারপর হালকা হেসে সে চিমটার একপ্রান্ত মহিলার কাঁধের ওপর রাখল। চামড়া দ*গ্ধ হওয়ার একটা বিকট সিজলিং শব্দ হলো। মুহূর্তের মধ্যে পো*ড়া মাংসের দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। মহিলা চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলার ভেতর থেকে শুধু শ্বাসরুদ্ধ গোঙানি বেরোল।
তারপরও খেলা শেষ হয়নি। পুরুষটি তার মুখের টেপ খুলে দিয়ে এবার চিমটা তার গালে ছুঁয়ে দিল। মহিলার কাঁপতে থাকা নিঃশ্বাসের শব্দ হতে থাকল। গরম চিমটার ছোঁয়ায় মহিলার চামড়ার নিচে স্নায়ুগুলো যেন হাহাকার করে উঠল। পুরো শরীরটা ঝাঁকিয়ে উঠল। পু*ড়ে যাওয়া জায়গার চারপাশে চামড়া বুদ্বুদের মতো ফুলে উঠছে। ধাতুর উত্তাপে চামড়া পু*ড়ে গিয়ে ফা*টল ধরল। মহিলা এবার সত্যি সত্যিই চেঁচিয়ে উঠল। চোখে পানি জমে গেল, কিন্তু সেটাও গালের গরম তাপে শুকিয়ে যেতে লাগল। পুরুষটি পা*গলের মতো হেসে উঠল।
ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “দেখেছো? আমি ঠিক বলেছিলাম। যদিও আমি কখনো ভুল বলতেই পারি না।”
পুরুষটি নির্যাতন শেষে চিমটা নিচে নামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর অন্য বন্দিদের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটে সেই একই পাগলাস্মিত হাসি খেলে গেল।
“নেক্সট… হু হ্যাজ দ্য ব্রেভেস্ট ফেইস?”
সে আবার এগিয়ে গিয়ে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে এবার একটা ছু*রি বের করল। ছু*রিটার ফলা চিকচিক করছে। অন্য বন্দিরা এতক্ষণ কষ্টে গোঙাচ্ছিল, কিন্তু এবার একসঙ্গে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কারণ সবাই জানে, এই ছু*রি মানেই ভয়াবহ কিছু আসছে। পুরুষটি এবার মহিলার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আমার খেলা এখনও শেষ হয়নি, ডার্লিং।”
সে মহিলার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর তার ঠোঁটে রহস্যময় প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো। তার সেই হাসি এবং দৃষ্টির অতল গভীরতায় যেন অন্তর্হিত সংকেত লুকিয়ে ছিল—যা মহিলার আত্মস্থ তনুতে প্রবল কম্পন তুলল, চেতনাকে আলোড়িত করল।
ধাতব ছু*রির ফলা ধীরে ধীরে মহিলাটির শরীরের দিকে এগিয়ে গেল। পুরুষটি ছু*রিটা মহিলার গলার কাছে নিয়ে এলো। মহিলাটি ঢোক গিলে পুরুষটার পানে শুধু তাকিয়ে থাকলো। মুখ বাধা নেই, অথচ সে কথা বলতেও ভুলে গেল। এখন আর গোঙাচ্ছেও না, চিৎকারও করছে না। কারণ মৃত্যু আসন্ন। অন্ধকার ঘরে ধাতব ফলা চকচক করে উঠল। বাকি বন্দিরা নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে।
সে হঠাৎই মহিলার চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় তার মাথা পেছনে টেনে নিল। তার ঘাড়ের ধমনি উন্মুক্ত হয়ে গেল। মহিলাটি এবার চিৎকার করে উঠল, “আমি ম*রতে চাই না। না না, প্লিজ আমি ম*রতে চাই না। মে-মে*রো না। আআআআআ…”
ছু*রির ফলা তার গলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। গলা চিরে ফিনকি দিয়ে র*ক্ত ছিটকে কাঠের মেঝেতে পড়ল। মহিলাটি কয়েক সেকেন্ড ছটফট করল, তারপর নিস্তেজ হয়ে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিল।
পুরুষটি পুনরায় হাতের র*ক্ত মুছে ধীরপায়ে বাকি বন্দীদের দিকে তাকাল। গভীর কণ্ঠে বলল,
“তোমাদের অপেক্ষায় রেখে অন্যায় করেছি। আ’ম সরি। যেহেতু ভুল করেছি, সেহেতু সে ভুলের মাশুলও আমারই চুকাতে হবে। সো, বা বাই…”
সে দ্বিতীয় বন্দির দিকে এগোল। এই বন্দী আগেই আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সে বন্দির চুলের মুঠো ধরে তার মাথাটা এক ঝটকায় পেছনে নিয়ে এলো, তারপর টেবিলের একপাশ থেকে একটা ভারী হা*তুড়ি তুলল। এক সেকেন্ডও সময় নিল না। একটা প্রচণ্ড আঘাত করলো। খট করে একটা বিকট শব্দ হয়ে মাথার খুলি ভে*ঙে গেল। র*ক্ত আর মগজ দেয়ালে ছিটকে পড়ল।
পুরুষটি এবার তৃতীয় বন্দির দিকে তাকাল। এবারের বন্দী নিঃশব্দে কাঁদছে, তার ঠোঁট নড়ছে, হয়ত প্রার্থনা করছে। পুরুষটি হেসে বলল, “দেখেছ, ঈশ্বর তোমাকে বাঁচাতে আসেননি। নিশ্চয়ই তুমি পাপী। কিন্তু গর্ব করতে যেও না। আমার মতো মহাপাপী কখনোই হতে পারবে না।”
তারপর সে ছু*রিটা তুলে লোকটির পেটের ওপর রাখল। অল্প অল্প করে চাপ দিল। ছু*রির ফলা বেয়ে লোহিত র*ক্ত গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সে ছু*রিটা উপরের দিকে টান দিল, যে কারণে ভেতরের মাংস আর নাড়িভুঁড়ি বে*রিয়ে এলো।
লোকটা প্রথমে কেঁপে উঠল, তারপর নিঃশ্বাসের সঙ্গে একটা গাঢ় গোঙানি বেরোল। তারপর নিস্তব্ধতা। অর্থাৎ সেও এই নিষ্ঠুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।
এবার শুধু একজন বাকি। পুরুষটি এবার শেষ বন্দির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই বন্দী একদম নড়ছে না। তার দিকে তাকিয়ে পুরুষটি বলল, “শান্ত ব্যক্তি আমার পছন্দ নয়। তোমার ভয়ানক চিৎকার শুনতে চাই আমি।”
লোকটা অসহায়ের মতো শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ জানে, তার মৃত্যু নিশ্চিত। আর সে কিছুই করতে পারবে না। কালো কোট পরিহিত পুরুষ লোকটি টেবিল থেকে একটা মোটা দড়ি নিয়ে বন্দির গলার চারপাশে পেঁ*চিয়ে ধরল। ধীরে ধীরে দড়িটা শক্ত করে টেনে ধরল, বন্দী ছটফট করতে লাগল, পায়ের আঙুলগুলো মাটিতে খামচে ধরল। তার চোখের সাদা অংশ উল্টে গেল, তীব্র যন্ত্রণায় মুখটা বেগুনি হয়ে উঠল। তার শরীরের সব শক্তি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে। শেষ দম বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই পুরুষটি একটানে দড়িটা ছেড়ে দিল। বন্দির নিথর শরীর ধপ করে চেয়ারে ঢলে পড়ল। ঘরটা আবার নিঃশব্দ হয়ে গেল। বাতাসে শুধু র*ক্তের গন্ধ ভাসছে। পুরুষটি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তারপর শান্ত চেহারায় বলল, “এত সহজে মরে গেল? হাউ ডাল!”
এরপর সে প্রতিটি শবদেহের কানে গোলাপ ফুল গুঁজে দেয়। তারপর হাতে র*ক্ত মেখে একে একে প্রতিটি কাটা মৃ*ত দেহের উপর ছবি আঁকতে থাকে। সবশেষে সে উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, “লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, ওয়েলকাম টু দ্য গ্র্যান্ড ফিনালে।”
তারপর হেসে একটি লা*শ কাঁধে তুলে, ঘরের দরজা খুলে সুইমিংপুলের দিকে এগিয়ে গেল। তার চেহারা এতটাই শান্ত যে বোঝার উপায় নেই, এই লোকটিই কিছুক্ষণ আগে চার চারটা খু*ন করেছে। শীতল, নীরব জলে অকস্মাৎ লা*শটি ফেলে দিল। পুলের জল ছিটকে উঠলো। এরপর আবার ঘরের মধ্যে ফিরে গেল। সেখান থেকে হাতে করে একটা বোতল নিয়ে এলো। সেই বোতল থেকে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড পুলের মধ্যে ঢেলে দিল। এসিডের ঘন, বিষাক্ত তরলটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, আর লা*শটি আস্তে আস্তে পানির মধ্যে গলে যেতে লাগলো। শুধু অ্যাসিড নয়, সে আগে থেকেই পুলের পানিতে অ্যাসিড রেসিস্ট্যান্ট পাউডার ছিটিয়ে রেখেছিল, যেন গলে যাওয়া দেহ কোনোভাবে তীরে না ভেসে ওঠে। তারপর সে পুল ফিল্টারের পাইপ খুলে বাকি অংশগুলো শোষণ করে ফেলতে থাকে। এভাবেই প্রতিটি লা*শ পরপর পুলের মধ্যে ফেলল। তার একটা নীতি হলো, সে সবসময় গ্লাভস পরে থাকে।
এদিকে লা*শ গলে গেলে সেখান থেকে উঠে আসা বাতাসেও অ্যামোনিয়া বা অ্যাসিড স্প্রে করে, যেন কোনো ডিএনএ, চুল, ত্বক কিছুই না থাকে। কিন্তু তার চোখে কোনো অনুভূতি নেই।
সমস্ত কাজ শেষে সে অবিচলভাবে সামনে এগিয়ে চলল। পেছনে মৃ*তদেহগুলো গলে গলে পানির সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এবং অবশিষ্টভাবে লা*শগুলো এমনভাবে পানির সাথে মিশে যাবে যে, এখানে যে কিছু ঘটেছে, এমন কিছুর চিহ্নও থাকবে না। এদিকে অন্ধকার গলিপথ পেরিয়ে সে গাড়িতে উঠলো।
প্রায় এক ঘণ্টা পর সে একটা আধভাঙা বাড়ির সামনে পৌঁছাল। বাড়িটির বাইরের দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, কাঠের দরজায় ছত্রাকের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। বাড়িটি এতটাই পরিত্যক্ত যে মনে হবে, এখানে তো মানুষ দূরের কথা, কোনো পশুও বাস করতে চাইবে না। চারপাশে আর কোনো বাড়িঘর নেই। এই বাড়িটি কোনো শহর বা গ্রামে নয়, একটা গভীর অজানা জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লোকটি পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অন্য এক জগৎ উন্মোচিত হলো। বাইরের জরাজীর্ণতার বিপরীতে ভেতরটা বিলাসিতার প্রতিচ্ছবি। ঝাড়বাতির আলোর নিচে চকচকে মার্বেল মেঝে, দামি আসবাব, দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে সাজানো প্রতিটি কোণ।
কিন্তু দরজা খুলতেই একজন মেয়ের দিকে তার দৃষ্টি আটকে গেল। মেয়েটার বয়স বোঝা কঠিন, চেহারার উপর অসংখ্য কা*টা দাগের আড়ালে তার আসল চেহারাটাই মুছে গেছে। তার গালের ক্ষতগুলো এতটাই ভয়াবহ, যে কেউ দেখলে আতঙ্কে শিউরে উঠবে, কিংবা কোনো অসহনীয় বেদনা তাকে গ্রাস করবে। সবুজ টপস আর কালো জিন্সে মেয়েটি কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় খুব বেশি না, লাল চুলগুলো কোঁকড়ানো। তবে তার চোখের গভীরে জমে থাকা বেদনা স্পষ্ট বোঝা যায়।
পুরুষটি একঝলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। উপরে উঠতে উঠতে গা থেকে র*ক্তে সিক্ত কালো কোটটি খুলে আঙুলের অগ্রভাগে জড়ালো। অন্তর্বাসের কালো শার্টটিও র*ক্তের প্রলেপে লালাভ। তার মুখাবয়ব বেয়ে র*ক্তের একরাশ ধারা নেমে এসেছে। ভ্রূ ছুঁয়ে, গাল মেখে, থুতনিতে এসে জমে থাকা সেই ধারা তার ভিতরের হিংস্রতার ছায়াপাত। তার হাতে-পায়ের কয়েক জায়গায় ছেঁড়া দাগ, কাটা চিহ্ন ছাড়াও, দেহের যে অংশ অনাবৃত, সেখানে নখের আঁচড় কিংবা ছু*রির ক্ষত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
দুই হাতের পেশিগুলো অস্বাভাবিকভাবে স্ফীত—তপ্ত র*ক্তে স্নায়ু যেন জ্বলন্ত দাবানলের মতো প্রতিটি শিরায় কাঁপছে। মনে হয়, তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা উগ্রতা সদা জাগ্রত, ধমনিতে প্রতিনিয়ত ঢেউ তোলে র*ক্তপিপাসু উন্মত্ততা।
চুলের গোছায় র*ক্ত এত ঘনভাবে জমাট বেঁধে রয়েছে যে, তা দেখে সহজ হৃদয়বিশিষ্ট কেউ নিঃসন্দেহে অজ্ঞান হয়ে পড়বে। তার চুল থেকে ঘাড় বেয়ে র*ক্তের ধারা ধীর লয়ে নামছে।
এসব অবলোকন করে হঠাৎই পেছন থেকে মেয়েটির স্বর ধাক্কা দিয়ে এলো, “আজকেও নিশ্চয়ই খু*ন করে এসেছ? আজ কতজনের প্রাণ নিলে?”
পুরুষটি কয়েক সেকেন্ড সিঁড়ির ধাপে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। তারপর আবার পা বাড়াল।
তখনই মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, “অ্যাব্যান! আমি তোমার সাথে কথা বলছি।”
এবার অ্যাব্যান থামল। এক ঝটকায় পিছনে ঘুরল। তার চোখে-মুখে তীব্রভাবে জ্বলতে থাকা আগুন দেখে মেয়েটি মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে ফেলল। তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু আর কোনো শব্দ বেরোল না।
অ্যাব্যান গভীর, ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “কৈফিয়ত জিনিসটা আমার অপছন্দ। এটা তোর অজানা নয়।”
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে সে আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। যেতে যেতেই গায়ের শার্টটা খুলে হাতে নিল। তখনই তার পিঠজুড়ে উন্মোচিত হলো এক রহস্যময় ট্যাটু। সেখানে দেখা যায় একটা শিকলে বাঁধা নেকড়ে, তার দেহ ক্ষতবিক্ষত গা থেকে টপটপ করে র*ক্ত ঝরে পড়ছে। নেকড়েটার মুখের অর্ধেকটা র*ক্তমাখা কঙ্কালে পরিণত। এদিকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির চোখ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এলো। তার মুখের আদল ভারী হয়ে গেল।
প্রভাতে মমতাজ মিরার ঘরে এসে দেখে মিরা ফোনের দিকে মগ্ন, চোখ দুটো এক দৃষ্টিতে কী যেন দেখছে। মমতাজ শীতল স্বরে ডেকে ওঠে, “মিরু।”
মায়ের ডাক শুনেই মিরা চমকে উঠে। দ্রুত চুলগুলো একটু ঠিকঠাক করে ঈষৎ হেসে বলে, “দাঁড়িয়ে আছো কেন, মা? বসো।”
মমতাজ এসে মিরার পাশে বসে। কিছুক্ষণ চুপচাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুদিন পরই মেয়ে অন্য বাড়ির মানুষ হয়ে যাবে, এই ভাবনা মমতাজের বুকের ভেতর হাহাকার জাগিয়ে তোলে। মিরা মায়ের কাঁধে মাথা রেখে নরম স্বরে বলে, “মা, কিছু বলছো না কেন? বকা দেবে না? বলবে না যে এখনো শুয়ে আছি কেন?”
মিরার কথায় মমতাজ হালকা হাসে, কিন্তু মুখে গাঢ় বিষণ্নতা স্পষ্ট। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখের কোণে জমে থাকা জল আঁচলের মাধ্যমে মুছে মেয়ের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, “মা, পরশু তোর বিয়ের দিন ঠিক হলো। ভাবতেই কেমন লাগে; আমার মেয়ে এত বড় হয়ে গেল!”
মিরা মায়ের কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মাআআ, এমনভাবে বলো না তো। তাহলে আমি কিন্তু বিয়ে টিয়ে করছি না।”
মমতাজ মেয়ের মাথায় স্নেহভরে হাত বুলিয়ে বলেন, “মেয়ে হয়ে জন্মেছিস রে। কোনো না কোনোদিন তো স্বামীর সংসার করতেই হবে।”
তারপর কিছুটা থেমে স্বপ্নালু স্বরে বলেন, “জানিস মিরু, আমি এক শ্যামপুরুষের প্রেমে পড়েছিলাম। গভীরভাবে প্রেমে পড়েছিলাম।”
মিরা মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে বিস্মিত স্বরে বলে, “বাবা?”
মমতাজ মৃদু হাসে। তারপর মনের গভীর থেকে বলেন, “তোর বাবা যদি আমাকে বন্দিনী করেও রাখত, তবুও আমি সারাজীবন তার সেবায় নিজেকে নিবেদিত করতাম। বিয়ের পর থেকে তোর বাবা যে গ্লাসে পানি খেত, আমি সেই গ্লাসের তার ঠোঁট ছোঁয়া অংশ থেকে পানি পান করতাম। তোর বাবা যখন খাওয়া শেষে হাত ধুতে যেত, আমি তার প্লেটে পড়ে থাকা চাবানো হাড়টাও পুনরায় চিবাতাম। আর যেই নিমঠাল দিয়ে তোর বাবা মিসওয়াক করত, আমি সেটি দিয়েই মিসওয়াক করতাম। সোজা কথা, তোর বাবা যদি কোনোদিন জানতে চায়, তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি? সেদিন আমি আমার বুক চি*রে তাকে দেখিয়ে দেব। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে কতটা গভীরভাবে শুধু তাকেই ভালোবেসেছি।”
এই কথাগুলো বলে মমতাজ একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অর্থাৎ মনের গভীরে পুঞ্জীভূত সবকিছু নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন।
মমতাজ ঈষৎ হাসি ধরে রেখে পুনরায় বলেন, “কিছু বুঝলি?”
এদিকে মিরা মায়ের কথাগুলো শুনে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইল। তার কণ্ঠস্বর থেমে গেছে, কিন্তু হৃদয়ে তোলপাড় চলছে। মমতাজ হালকা হেসে আবার বলেন, “তুই আর কারানও একদিন এমনই ভালোবাসার গল্প লিখবি, দেখিস।”
মিরা লজ্জা পেয়ে একটু হেসে নিল। তারপর বলে, “কিন্তু মা, বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি কেন ঠিক হলো? আরও কিছুদিন সময় নেওয়া যেত না?”
মমতাজ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “ছেলেপক্ষ থেকে এটাই জানানো হয়েছে রে। আমি তোর বাবাকে সময় নিতে বলেছিলাম। কিন্তু তোর বাবা বলল, ‘ছোটবেলা থেকে চিনি ওদের, কি আর দেখব? তারা যখন বলেছে, পরশুই বিয়ে হোক।’ তাই আমিও আর আপত্তি করিনি।”
মমতাজ ফোন বের করে কারানের নম্বর মেসেজ করে মিরাকে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, “তুই চাইলে ওকে কল করতে পারিস।”
কিন্তু মমতাজের স্নেহদৃষ্টি মিরার ওপর স্থির থাকে। অর্থাৎ মেয়ে চলে যাওয়ার আগে তার প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। খানিকটা সময় পর সে উঠে দরজা দিয়ে বের হতে যাবে, তৎক্ষণাৎ মিরার ডাক শোনা গেল, “মা, আজ রাতে আমার পাশে শোবে?”
মমতাজ কথাটা শুনেই ফিরে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আচমকা তার চক্ষুজোড়া পানিতে ভরে উঠল। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে হেসে বললেন, “তুই না বললেও আমি আজ তোর সাথেই শুতাম, মা।”
মা-মেয়ে একটু আবেগ ভাগাভাগি করায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই ইলিজা তড়পাতে তড়পাতে কক্ষে ঢুকে পড়ল। তার মুখশ্রী ক্রোধে রক্তিম।
“মানি না! মানবো না!”
মমতাজ অবাক হয়ে বলে উঠলেন, “কি মানবি না? আর এত ছটফট করছিস কেন? আগে বস।”
ইলিজা ক্রোধ নিয়ে বলল, “কীসের বসাবসি। আগে বলো, আপুর বিয়ে পরশু দিন কেন ঠিক করেছো?”
মিরা হেসে বলল, “বাবা বলেছে?”
“হুম, কিন্তু আমি এই বিয়ে মানি না। এত পরিকল্পনা করলাম, গান-নাচ, শপিং… কীভাবে একদিনে সব করব?”
মমতাজ শান্ত গলায় বললেন, “এই বিয়েটা ছোট করে করা হবে, শুধু পরিবারের লোকজন নিয়ে।”
ইলিজা আশ্চর্য হয়ে চোখ উল্টে বলে, “কিইই? নাআআআ… এটা হতেই পারে না। আমি সেনু, আদিবাদের সব বলে রেখেছি। ওদেরকে ইনভাইটেশন দিব। এত এত প্ল্যান করলাম। হবেই না।”
মিরা হেসে বলল, “তোকেই বা কে বলেছিল সবাইকে জানিয়ে বেড়াতে?”
ইলিজা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি কি জানতাম, বাবা-মা আমাকে এইভাবে ঘোল খাওয়াবে।”
মমতাজ হেসে বললেন, “থাক, আর রাগ করিস না। মিরুর বিয়ের অনুষ্ঠান যখন জমিয়ে করা হবে, তখন আনন্দ উল্লাস করিস। তাছাড়া মুসলমানদের বিয়ে ধুমধাম করে করতে হয় না। আর বিয়ে কম খরচে কম মানুষ নিয়ে করাই ভালো। তুই বড় হলে সব বুঝবি।”
অথচ এসব শুনে ইলিজা রাগ করে মুখে বিরক্তির ভঙ্গি নিয়ে, কোনো উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যদিও আয়োজনে সীমিত জনসমাগম করবে, এর নেপথ্যে একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, মিরার মুখশ্রী যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে। অর্থাৎ অপরিচিত দৃষ্টির ধৃষ্টতা যেন তার রূপলাবণ্যকে স্পর্শ না করতে পারে।
রাতের নির্জনতা ভেদ করে মিরা মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। মন থেকে কোনোভাবেই সেই চিন্তাগুলো সরাতে পারছে না। আপনমনে বিড়বিড় করে, “আমি তো বিয়ের পরও পড়াশোনা করতে চাই, চাকরিও করতে চাই; ওনাকে কি এটা বলব? যদি না করতে দেয়? না না, এ যুগের ছেলেরা এমনটা করে না। কিন্তু আমি যে এই লোকটাকে নিয়ে এত ভাবছি, ও কি সেটা জানে?”
ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে এক ফালি মুচকি হাসি খেলে যায় তার।
মনে মনে সে আবার ভাবে, “আচ্ছা, আমার কি ওকে একবার কল করা উচিত? কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করবে ‘কে আপনি?’ তখনই তো আমার সব গুলিয়ে যাবে। এমনিতেও তো অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে গেলেই আটকে যাই, আর ওর সাথে কথা বলতে গেলে তো শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভির মতো ঝিরঝির শুরু হয়ে যাবে। থাক বাবা, এতদিন যেমন ছিলাম, তেমনই থাকি। যা হবে হালালভাবেই হবে।”
এ কথা ভেবে মিরা লজ্জায় মায়ের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে নেয়।
হঠাৎ মমতাজ নড়ে ওঠে, নরম কণ্ঠে বলেন, “কি রে মিরু, ঘুমাচ্ছিস না কেন?”
মায়ের কণ্ঠ শুনে মিরা কোনোরকম রা না করে মাকে আরও দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কথায় আছে, প্রেম যে কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না। মিরার মনের অবস্থা এখন সেরকমই। ভালোবাসার বুনন তার মনের কোণে কোণে জমাট বেঁধে আছে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরও তার ঘুম আসছে না। সামনে থেকে অদেখা পুরুষটির ভাবনা, প্রতিনিয়ত কল্পনায় এসে ভেসে উঠছে। প্রতিটি চিন্তা একে একে মস্তিষ্কের সব কোষে জট পাকিয়ে দিচ্ছে।
মিরা হালকা আক্ষেপের সুরে মনে মনে বলে, “ধুর, বিয়ের আগে সামনাসামনি একবার ওকে দেখলামও না।”
এই বলে মায়ের হাতটা আলতো করে সরিয়ে দিয়ে আবার মায়ের বুকের কাছে গুটিয়ে যায়। যেন সেই বুকের উষ্ণতায় সে নিজের দুশ্চিন্তাগুলোকে ভুলে থাকতে পারে, তবুও মনের ভিতরের সেই গভীর তোলপাড় তাকে প্রতিমুহূর্তে জাগিয়ে রাখছে।
কোনোভাবেই ঘুম ধরা দিল না। বারবার মনে হতে লাগল—একবার যদি তার কণ্ঠস্বর না শোনা যায়, তবে এ রাত ঘুমহীনই কাটবে। মনের গভীরে সেই পুরুষের মুখ থেকে শব্দ শোনার আকাঙ্ক্ষা বেড়েই চলল। তাই আস্তে করে বিছানা ছেড়ে উঠল মিরা। ঘড়ির কাঁটায় তখন ১১টা ৫ মিনিট।
আধো আলোয় তাকিয়ে বিড়বিড় করল, “কিন্তু এত রাতে একজন অচেনা ছেলেকে ফোন দেওয়া কি শোভা পায়? যদি ভুল বোঝে! যদি আমাকে বাজে ভাবে?”
ভাবনার ভারে কপাল কুঁচকে গেল। মনে হচ্ছে, দেয়ালে প্রতিফলিত হওয়া ছায়াগুলোও তার দোটানায় সঙ্গ দিচ্ছে। মনের অস্থিরতা শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে বিদ্ধ হতে লাগল।
“না, এবার আর পারা যাচ্ছে না।”
এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে হাঁটতে লাগল সে। বুকের ভেতর অস্থিরতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সে ঢেউ আর থামছে না, বরং আরও ফেনিয়ে উঠছে। হঠাৎ থেমে বুকভরে এক দীর্ঘ নিশ্বাস নিল মিরা। এরপর অনেক ভেবেচিন্তে, মনে সাহস সঞ্চয় করে নম্বরটি ডায়াল করল। কিন্তু তার হাত কাঁপছে, বুকের মধ্যে সাহস আর সংশয়ের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু একবার কল করতেই হবে। এই অনিবার্য সিদ্ধান্ত তাকে এক পলকে সাহসী আবার পরমুহূর্তে ভীতু করে তুলছে।
‘কি হবে, কে জানে! কিন্তু একবার কল না দিলে মন শান্ত হবে না’, এই যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝালো সে। কল বাটনে ক্লিক করার আগে চোখ বন্ধ করল। ঠোঁট নড়ে উঠল; আস্তে আস্তে দোয়ার কিছু লাইন পড়ল। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ভাবল—কি বলবে? কীভাবে পরিচয় দেবে?
তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “যেহেতু মা ওর নাম্বার দিয়েছে, নিশ্চয়ই ওর কাছেও আমার নাম্বার থাকবে। চিনে ফেলবে। এক পলকেই হয়ত চিনে ফেলবে। কিন্তু… আমি? আমি মেয়ে হয়ে একটা ছেলেকে কল দিব? মানইজ্জত সব যাবে যে!”
গভীর নিশ্বাস ফেলে আবার নিজেকেই বলল, “যা হওয়ার হবে। আল্লাহ, সাহস দাও। শুধু হ্যালো বলেই কেটে দেব, উফফ!”
ভয়টা যেন শরীরের গভীর শিরা-উপশিরায় বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। বুকের কাঁপন সামলাতে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পান করল। এত আয়োজন, এত মানসিক প্রস্তুতির পর উপরে তাকিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার আগে শেষ প্রার্থনা করে অবশেষে ‘কল’ বাটনে ক্লিক করল। ফোনের স্ক্রিনে রিং হতে লাগল।
“কি হবে এখন? কিছু তো একটা হবেই”, ভাবতে ভাবতে ঠোঁট কামড়াতে লাগল সে।
হৃদপিণ্ডের শব্দ এখন ফোনের রিংটোনকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ফোন রিসিভ করল কারান।
মিরার চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল। মুহূর্তে বুকটা ধকধক করে উঠল। এমন সময় ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো, “হ্যালো।”
তার ভারী কণ্ঠস্বরের গম্ভীরতা রাতের নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে কানে বাজল মিরার। কারানের সেই গভীর, গাঢ় কণ্ঠস্বর যেন মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ রেখার মতো ছুটে এলো। বুকের ভেতর অপার্থিব শিহরন বইয়ে দিল। এক অনির্বচনীয় অনুভবে ঠোঁট কেঁপে উঠল মিরার। তবে মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না। সে ঠিক করেছিল পরিচয় দেবে, হয়ত দু’একটা কথা বলবে, কিন্তু কারানের গলার গভীরতা এমন আকর্ষণীয় অচেনা কম্পন তৈরি করল, যেটা এক নিমিষে তার শরীরকে স্থবির করে দিল।
মিরা নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে বলে ফেলল, “কি ডিপ ভয়েস…!”
গলার সেই ভার, মিরার স্নায়ুতে যেন মাদক ছড়ালো। রক্তনালিতে ঠান্ডা কিছু বয়ে যেতে লাগল, হৃৎপিণ্ডের তালে তালে তার শরীর সাড়া দিতে লাগল। অথচ সে ভুলেই গেল কেন ফোনটা করেছিল।
ওদিকে কারান কোনো সাড়া না পেয়ে আবার সেই একই গম্ভীরতা নিয়ে বলল, “হেই, হু’জ স্পিকিং?”
ভয় আর লজ্জায় মুখে শব্দ আটকে গেল মিরার। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেছে তার। শুধু নিঃশ্বাসের গতি বেড়েই চলেছে। সেই ঘন ঘন নিশ্বাসের শব্দ এতটা স্পষ্ট যে ওপাশ থেকে কারানও শুনতে পেল। সে কপাল কুঁচকে ফোনের নম্বরের দিকে তাকাল। ‘না, এই নাম্বার তো চেনে না সে।’ কেউ হয়ত ভুল করে কল করেছে, এমনটাই ভেবে যখন ফোন কেটে দিতে যাবে, ঠিক তখনই মিরা নিজেই কল কেটে দিল। কারান কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফোন রাখল। আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফিরে গেল।
কিন্তু মিরার ভেতরে ঝড় শুরু হলো। তার কানে গেঁথে রইল সেই কণ্ঠস্বর, ‘হ্যালো… হেই, হু’জ স্পিকিং…’
মিরা বিড়বিড় করে বলে উঠল, “হ্যালোওও… হায় আল্লাহ!”
তারপর নিজের অস্থিরতার পাগলামিতে হেসে ফেলল। তার চোখে ছিল আকাঙ্ক্ষা, মুখে ছিল একরাশ লজ্জা মেশানো প্রশান্তি।
রাতজুড়ে তার মনে শুধু সেই চারটা শব্দ ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘুম তো দূরে থাক, বরং সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে গড়াগড়ি করতে লাগল।
শুধু সেই শব্দগুলোই বারবার মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, “হ্যালো… হেই, হু’জ স্পিকিং…”
সকালবেলার মৃদু আলো তখনো পুরোপুরি প্রসারিত হয়নি। জানালার পর্দার ফাঁক গলে রোদ ঘরে ঢুকে মেঝেতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
মিরা ধীরপায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা বোরকা পরছিল। অর্থাৎ সাদা রঙের পবিত্রতার চাদরে নিজেকে মুড়ে নিচ্ছে সে। সাদা নেকাব তার মুখাবয়ব ঢেকে দিলেও চোখ দুটো স্পষ্ট দৃশ্যমান ছিল। জানালার পাশের আলমারি থেকে বেছে নেওয়া একটা কালো রিমের সানগ্লাস পরে নিল চোখে। কোমরে ফ্যানি ব্যাগটা ঝুলিয়ে আয়নায় একবার নিজেকে পরখ করে নিল।
তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। এদিকে ড্রয়িং রুম জুড়ে রান্নাঘরের ধোঁয়া আর গরম ভাজির গন্ধ মিলেমিশে স্নিগ্ধতা তৈরি করছিল। রান্নাঘরে টুংটাং শব্দে ব্যস্ত মমতাজ। সে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে তেলচিটচিটে হাতটা মুছছিলেন।
“মা, একটু ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। জলদি আসব,” এক হাতে পাউরুটি, আরেক হাতে কলা চিবোতে চিবোতে বলল মিরা।
মমতাজ তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন, “আরে ধীরে ধীরে, গলায় বাজবে তো।”
“বাজবে না,” একরকম ছোট্ট উত্তর দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল মিরা।
মমতাজ পেছন থেকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “আসবি কখন?”
“বেশি সময় লাগবে না,” বলে বেরিয়ে পড়ল মিরা।
বাইরে বের হতেই রাস্তায় কয়েকটা রিকশা, দু’একটা ভ্যানের গাড়ি দেখতে পেল সে। একপাশে রাস্তার ধারে শিশুরা হাতে হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে। কেউ মুখে বিস্কুট চিবাচ্ছে, কেউ আবার বাবার হাত টানছে। শহরের বাতাসে ধুলোর গন্ধ, কাকের ডাক, আর রিকশার টুংটাং ঘণ্টা ভেসে বেড়াচ্ছে।
মিরা একটা রিকশায় উঠে বসল। শহরের ধুলোবালির ভিড় ঠেলে চলতে থাকা রিকশার গা-ধরা কাঁপুনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার দৃষ্টিটা আটকে রইল দিগন্তবিস্তৃত আকাশপানে। এখন তার সবটুকু ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু—কারানের কাল রাতের বলা কথাগুলো।
সেই গম্ভীর কণ্ঠের শব্দগুলো মিরার মস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়, আর তাতে তার ঠোঁটে প্রশান্তির মুচকি হাসি খেলে যায়। হৃদয়-অন্দরে অনির্বচনীয় উষ্ণতা বয়ে যায়। ভালোবাসার নিঃশব্দ স্পর্শ ছুঁয়ে যায় স্নায়ুর পরতে পরতে।
সময়ের গড়ায় প্রায় বিশ মিনিট পার হয়ে গেলে রিকশাটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ফটকের সামনে ধীরে ধীরে থামে। ভাড়াটা বুঝিয়ে দিয়ে রিকশা থেকে নামল সে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেরোতেই ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে চায়ের সুগন্ধ ভেসে আসে। তার পাশেই কিছু ছাত্রছাত্রী আড্ডায় মত্ত—কেউ অকরণীয় আনন্দে হেসে উঠছে, কেউ ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে দিগন্তে ছুটে চলেছে, কেউ বা ক্যাম্পাসের সিঁড়ির ধারে হাত ধরাধরি করে বসে আছে। এই কোলাহলের মাঝেও একা দাঁড়িয়ে মিরা খুঁজে ফেরে একটি পরিচিত মুখ।
সে ব্যাকপ্যাক সামলে চোখে সানগ্লাসের নীচ থেকে সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে লাগল। ঠিক তখনই হঠাৎ করে তার কানের পাশে মিষ্টি চঞ্চল কণ্ঠ ভেসে এলো, “ভাউ!”
মিরা চমকে উঠে বুকের বাঁ পাশে হাত রাখল। তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। ভ্রূ কুঁচকে গেল মুহূর্তে। ভয় আর অভ্যাসের মিশেলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তবে মেয়েটাকে দেখামাত্র তার ঠোঁটের কোণে অগোচর হাসি ফুটে উঠল।
তবুও গম্ভীর গলায় বলল, “ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, নিরু।”
নৌরিনের গায়ে ছাপার কামিজ, নিচে জিন্স। ওড়নাটা গলায় জড়ানো এমনভাবে যে একরকম নামমাত্র দায় পালন। যদিও তাকে দেখলে কিশোরী বলার থেকে কিশোরসুলভ ভাবই বেশি জাগবে মনে। তার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যামলা। চোখজোড়া গভীর, তার অন্তরে জমে থাকা সমস্ত মায়ার আলো যেন চোখে এসে জমে আছে। চুলগুলো এমন অগোছালোভাবে খোপায় বাঁধা, যে যা দেখলে যেকারো মনে দুঃসহ মায়ার সৃষ্টি হবে। আর বলতে ইচ্ছে করবে, ‘এসো, আমি ঠিক করে দিই।’ তার চলনে-বলনে রয়েছে প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস, আর ছেলেদের মতো রুক্ষতা।
তবে ইচ্ছাকৃত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও অনবদ্য মায়াবতী সে। এই দুজনের বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। তারা একে অপরের রাগ, দুঃখ, হাসি, কান্না সব কিছু শেয়ার করে চলেছে বছরের পর বছর।
চঞ্চল ভঙ্গিতে নৌরিন বলে উঠল, “মহারানি এতদিন কই ছিলেন? কতগুলো কল দিলাম, একটাও রিসিভ করিসনি বেয়াদব!”
মিরা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর ক্ষেপিস না। আমি আছি আরেক চিন্তায়। ফোনটা সাইলেন্টে রেখেছিলাম যেন কল না শুনি।”
নৌরিন থমকে গিয়ে বিস্ময়ে বলল, “ওমা! ক্যান, বইন?”
একটা নিস্তব্ধতা নামল মিরার চোখে-মুখে। সে নীচু গলায় বলল, “আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
এই কথা শুনে নৌরিন স্তব্ধ হয়ে গেল। পরমুহূর্তে সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে মিরার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “কংগ্রেস বেবি! এই তুই এমনভাবে বললি কেন রে? অ*সভ্য মেয়ে, না না, তুই অনেক ভালো মেয়ে। আয়হায়! আমার বেবির বিয়ে হবে!”
মিরা বিষণ্ন চোখে একবার তাকাল নৌরিনের দিকে। মেয়েটার মুখভর্তি আনন্দ, চোখদুটো চকচক করছে। মনে হচ্ছে, কোনো উৎসবের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই নিখাদ খুশি দেখে মিরার বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে এলো। এক অজানা অস্থিরতা, এক অচেনা শূন্যতা তার নিঃশ্বাসে জড়িয়ে রইল।
সে চোখ নামিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “এত খুশি হোস না, নিরু। এই বিয়েতে দুই পরিবারের লোক ছাড়া কেউ থাকবে না। আর তোদের এটা বলতেই এসেছি। আফিফাকে অনেকক্ষণ খুঁজলাম, পরে শুনলাম আজ নাকি আসেনি। বিয়ের পর কেমন জীবন যাবে জানি না। কবে আবার তোদের সঙ্গে দেখা হবে, তাও জানি না। তাই ভাবলাম আজ বলে যাই। অন্য কেউ বিয়ের ব্যাপারে জানে না। আমি চাইও না জানুক।”
তার গলা অজান্তেই ভিজে উঠল। কিন্তু মিরার সেই ক্লান্ত কণ্ঠস্বরের বিপরীতে নৌরিন হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। একরাশ নির্ভার আনন্দের মতো সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মিরা চোখে বিস্ময় নিয়ে তার পানে তাকাল। এই মুহূর্তে তো তার রাগ করা উচিত ছিল। হয়ত বলে উঠত, ‘তাই বলে বেস্ট ফ্রেন্ডকেও দাওয়াত দিবি না? তাহলে এসেছিসই বা কেন? চলে যা।’ অথবা ক্ষীণ কণ্ঠে ঠাট্টা করে খোঁচাও দিত।
কিন্তু না। সে হাসল। তবে তার হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে এক পাহাড় সমান আবেগ, যা কাউকে বোঝানো যায় না।
মিরা বুঝতে পারল—এই হাসি নিছক হাসি নয়। এই মেয়েটি এমন কিছু করে না যার পিছনে কারণ থাকে না। সে আস্তে বলল, “এখানে হাসির কী হলো? তুই কি আমাকে কোনোদিনও সিরিয়াসলি নিবি না, নিরু?”
এই প্রশ্নের উত্তরে এবার নৌরিন মোলায়েমভাবে মিরাকে জড়িয়ে ধরল। এক ধরনের আত্মিক বন্ধনের মতো জড়িয়ে ধরলো। মিরাও আবেগের জোয়ারে জড়িয়ে ধরল নৌরিনকে। নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। বুকের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো আলতো করে খুলে যেতে লাগল।
কিন্তু সেই নিঃশব্দ আলিঙ্গনের মাঝেও, নৌরিনের চোখ থেকে হঠাৎ টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু মেঝেতে পড়ল। সেই কান্নার শব্দ নেই, কিন্তু ওজন আছে। নৌরিনের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস থাকলেও মনের গভীরে ছিল বাস্তবতার অনিবার্য জ্ঞান। বিয়ের পর মেয়েদের জীবনে যে নীরব বিপর্যয় নেমে আসে, সে কথা তার অজানা নয়।
যতই হোক, বিয়ের পর অধিকাংশ নারীর জীবন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে—স্বামীর হাতে কিংবা শ্বশুরবাড়ির অজস্র অনুচ্চারিত নিয়মে। দিনশেষে ভালো থাকার চেয়ে মানিয়ে নেওয়াটাই প্রধান ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ের আগের উচ্ছ্বাস, নির্ভার ঘোরাঘুরি, বন্ধুত্বের চিলতরে ভাগাভাগি; সব মিলিয়ে যে জীবনটা নিজের মতো ছিল, তা এক সময় অচেনা কাঠামোয় বন্দী হয়ে যায়। হ্যাঁ, সবার ক্ষেত্রে এমন হয় না; কিন্তু কে বলতে পারে মিরার ভাগ্যে কী লেখা আছে? তাই হয়ত এখনই আবেগের লাগাম টেনে ধরা শ্রেয়। কারণ ধীরে ধীরে যখন সংসারের দায়-দায়িত্বেরা ভালোবাসার স্থান দখল করে নেয়, তখন বন্ধুত্বের সম্পর্কটা থেকেও আর থাকে না। হয়ত মিরার সঙ্গে আবার দেখা হবে, কথাও হবে। কিন্তু সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকবে না। সময় ছেঁটে দেবে পুরোনো সহজাততা, রেখে যাবে কেবল স্মৃতি। বা হয়ত এটাই তাদের শেষ দেখা—এই ভাবনাটা নৌরিনের বুকের গভীরে কাঁটার মতো বিঁধছিল। তবে মিরাকে এসব বুঝতে দেওয়া যাবে না। এত বছরের সঙ্গিনী আজ অন্য জীবনের পথে পা রাখবে। তাই তার বান্ধবী যেন নেচে-গেয়ে, আনন্দে উদ্বেল হয়ে নিজের বিয়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে; এই চেষ্টাতেই নিজেকে সংযত করল নৌরিন।
যদিও তার মন ভার হয়ে এলো। কিন্তু শুধু জোর করে হাসছে সে। নিজের কষ্ট না দেখানোর মানেই তো বন্ধুত্ব। যদিও চোখের কোণে তখনও কাঁচের মতো টলটল করছিল অশ্রু। হয়ত আজকের এই আলিঙ্গনটাই ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ, আর কথোপকথনটা ছিল সবচেয়ে অর্থপূর্ণ।
নৌরিন আস্তে করে জিন্সের পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখটা মুছে নিল। তারপর মুখে আগের চেনা উচ্ছ্বাস টেনে এনে সুন্দরভাবে হাসার চেষ্টা করল।
মিরার গলা থেকে নিজেকে আলগা করে বলল, “তুই কি রে, আইদাহ? আমাকে কি ভাবিস বলতো? আমি কি তোকে বুঝি না নাকি? আর আমি খুশি, খুব খুশি; এই ভেবে যে তোর বিয়ে কম মানুষের ভিড়ে হবে। আমি তো চাই না তোর মতো মণিমুক্তোর উপর কারো নজর পড়ুক। আমি না আসলেও আমার দোয়া তোকে আগলে রাখবে সবসময়। ছেলেদের মতো চলি মানে তো এই নয় যে আমি নামাজ কালাম পড়ি না। তোর জন্য আমার মোনাজাতে আলাদা জায়গা থাকবে, বেবি।”
তারপর দুই হাত দিয়ে মিরার নেকাবঢাকা গাল স্পর্শ করল। কোমল ছোঁয়ায় হেসে আবার বলল, “আফিফাকে সব আমি বুঝিয়ে বলব। তুই এসব ভেবে মাথা ভার করিস না। এখন বাড়ি যা। ফেইসপ্যাক লাগা। বাসর রাতে দুলাভাইকে তো অজ্ঞান করতে হবে, নাকি?”
কথাটা বলেই মনের দুঃখটা ঢেকে আবার হেসে উঠল নৌরিন। নিশ্ছিদ্র কোমলতায় মিরার মুখের হাসিটা এবার কেমন অনুচ্চারিত লাজে মিলিয়ে গেল। নৌরিনের পায়ে একটুখানি নরম ঠেলা দিয়ে সে বলল, “অ*সভ্য মেয়ে, সবসময় ওসব চিন্তা! এবার আমার কথাটা একটু শোন। তুইও একটা বিয়ে করে সংসারী হয়ে যা।”
নৌরিন খিলখিল হাসির সাথে তার গম্ভীর মুখ আরও একবার আড়াল করতে চাইল। সে সোজা মিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর কোন কথাটা শুনিনি? আজ যতটুকু ভদ্র, তোর জন্যই তো হয়েছি। আগে তো কত ছেলের নাক ফাটালাম।”
মিরা হালকা হাসল। কিন্তু নৌরিন তখনও তার স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্যে বলেই যাচ্ছিল, “শুধু বোরকার ব্যাপারটা এখনো আয়ত্ত করতে পারিনি। তবে চাইলে ওটাও পারবো। কিন্তু বিয়ে? না রে বাপ, ওটা আমার দ্বারা হবে না। বিয়ে করলে সেই ছেলেটাকে বাসার থেকে হসপিটালে বেশি থাকতে হবে। আবার যদি ভুল করে ওর বংশের বাতিটাই নিভিয়ে দিই? আমার রাগ তো তুই জানিসই!”
এই কথা শুনে আর মিরা কোনোভাবেই তার হাসি থামাতে পারল না। যদিও মিরাকে হাসানোর জন্যই সেটি ছিল তার কৌশলী এক অভিনিবেশ। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মনঃপীড়ায় ক্লিষ্ট থেকে মিরা বিয়ে করবে, এটা তো সে হতে দিবে না। তবে তার হাসি দেখে, নৌরিনও ঠোঁটের কোণে চঞ্চল হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, “মুখ তো আর কোনোদিন দেখাবি না, তাই এবার আর জোর করলাম না। তবে তোর জন্য গিফট আনতে ভুলিনি কিন্তু।”
মিরা জানে, সেই উপহার কী। তাই লাফিয়ে উঠে নৌরিনের ব্যাগ খুলে লাল গোলাপটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, “কখন আনলি রে?”
“এক ফাঁকে এনেছি। কাঁটা নেই, ছাড়িয়ে দিয়েছি।”
মিরা তখন নৌরিনের গালজোড়া টিপে দিয়ে ভালোবাসার স্নেহে বলল, “এটা তো তুমি ভালো করেই জানো, আমি জানি। এবার চল, তোকে ট্রিট দেব।”
নৌরিন মাথা নাড়িয়ে বলল, “না রে, মা একা আছে বাসায়। এখন শেষ ক্লাসটা করে বেরিয়ে যাব। তুইও দেরি করিস না।”
নৌরিনের এই কথাগুলো মিরার হাসির মাঝে কষ্ট ছড়িয়ে দিল। মিরা দৃষ্টি হালকা করে বলল, “আরেকটু সময় দিবি না?”
নৌরিন হাসির মাঝে বিষণ্নতা চাপা দিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের বন্ধুত্ব কি শুধুমাত্র আজকের? আমাদের বন্ধুত্ব তো সারাজীবনের। পরে সময় করে দেখা করবো, বুঝলি? এখন চল, তোকে আমি গেটে অবধি পৌঁছে দেই।”
দুজন একসাথে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। মিরাকে শেষবারের মতো ইউনিভার্সিটির গেটে এগিয়ে দিয়ে নৌরিন বলল, “এটা কিন্তু শেষ মুহূর্তের বিদায় নয়, শুধু একটা ছোট্ট বিরতি নামল আমাদের মাঝে। কি বলিস?”
কিন্তু মিরা উত্তরে তাকে জড়িয়ে ধরল। শেষবারের মতো একটা আলিঙ্গনে দুজন একে অপরের বাহুতে হারিয়ে গেল। দুই জনের হৃদয় তখন একে অপরের প্রতি পূর্ণ ভরসা দিয়ে, একে অপরকে ধারণ করতে শুরু করল। চোখের কোনে জল ছলছল করছিল, তবে হাসি দিয়ে তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিল তারা।
কিছুক্ষণ পর হাতের ইশারায় একটি রিকশা ডাকল মিরা। মিরা রিকশায় ওঠার আগেই নৌরিন হেসে বলল, “আল্লাহ হাফেজ, লাভ ইউ দোস্ত।”
মিরা তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “লাভ ইউ টু, নিরু। তোকে কল করব, চিন্তা করিস না। বিয়ের পরেও ঠিক আগের মতো ঘুরাঘুরি করব আমরা। টাটা।”
মিরা রিকশায় উঠে বসে, এক ঝলক পিছনে ফিরে তাকাল। নৌরিনের দিকে দীর্ঘ দৃষ্টি দিয়ে হাসি দিল।
রিকশাটি এগিয়ে চলতে শুরু করতেই মিরা তার হাত নাড়িয়ে দিল, নৌরিনও হেসে তাকে বিদায় জানালো। কিন্তু মিরার মন যেন কেন জানি ভার হয়ে এলো। রিকশাটি ধীরে ধীরে চলছিল, কিন্তু মিরা অনুভব করল, যেন কিছু একটা আলাদা হয়ে গেছে। তার বুকের ভেতরে কেমন অজানা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ অনুভব হলো, নৌরিনের হাসির আড়ালে একটা অসীম শূন্যতা লুকিয়ে ছিল। এটা ভেবে তার মনের ভেতর অস্থিরতা ঢুকে গিয়েছিল। সে পুনরায় পিছনে তাকিয়ে নৌরিনকে দেখলো। দেখল, সে হাসছে। তাই মিরা এবার সামনের দিকে ফিরে তাকালো। কিন্তু নৌরিন যে তার হাসির আড়ালে আবেগ লুকিয়ে রেখেছে, তা মিরা কিছুতেই জানবে না, জানতেই দিবে না।
পেছনে নৌরিনের চোখে পানি জমে উঠছিল। কেন যেন তার বারবার মনে হলো, এ বিদায় চিরকালীর হতে চলেছে। সে হারিয়ে ফেলেছে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে। এতদিনের যে সম্পর্ক, যে বন্ধুত্ব, যা ছিল একে অপরের জন্য অমূল্য, আজ সেই সম্পর্কের শেষ মুহূর্ত এসে দাঁড়িয়েছে। নৌরিন চুপচাপ রিকশাটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মিরার সামনে কখনোই তার বুকের বেদনা প্রকাশ করবে না। তবে বিদায়টা ছিল জোর করে। মায়ের আর ক্লাসের প্রলম্বিত বাহানা দিয়ে সে নিজের আবেগ লুকিয়ে রেখেছিল। নাহলে মিরার সামনেই চোখ থেকে পানি পরে যেত।
মিরা হাতের গোলাপটির পানে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। মিরার প্রিয় পুষ্প লাল গোলাপ; এ অনুপম তথ্য যেমন ইলিজার চেতনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিস্থাপিত, তেমনি নৌরিনের বোধেও সুগভীরভাবে সংরক্ষিত৷ তাই নৌরিন প্রতিদিনই তার জন্য একটি করে গোলাপ এনে দিতো—তবে আজকের সেই গোলাপের মাঝে ছিল না কোনো সুখের আশ্বাস। মিরা প্রতিবার সেই গোলাপটি নিঃসীম যত্নে ডায়েরির পাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখবে। অর্থাৎ কালের কঠিন করাল স্পর্শে শুকিয়ে গেলেও যেন স্মৃতির সুবাসে রয়ে যায়।
একটু পর মিরা ভ্রূ কুঁচকে আপনমনে বলল, “বিয়েই তো করছি, ম*রে তো আর যাচ্ছি না। কিন্তু আজকে নিরুর ব্যবহারটাও কেমন যেন ছিল। আমারও ভালো লাগছে না। এই কি তবে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম?”
এরপর আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না না, বোকা তুই মিরা? কিসব ভাবছিস? যতসব আজেবাজে চিন্তায় ডুবে আছি। তবে এটাও সত্যি, এই নিরুটাকে আমি কোনোদিনও সম্পূর্ণ বুঝতে পারলাম না।”
তার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। গোলাপের ঘ্রাণ নেয়ার জন্য নাকের কাছে এনে, চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে দিল সে। যেন তার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা সমস্ত চিন্তা বেরিয়ে আসে।
তারপর চোখ খুলে মনে মনে বললো, “আচ্ছা, এভাবে একটা ছেলেকে যাচাই না করে, তার চরিত্র না জেনে, তাকে বিয়ে করে ফেলব? তখন হয়ত ওকে দেখে, ওর ভয়েস শুনে একটু বেশিই আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু চেহারা আর কোয়ালিটি থাকলেই তো আর কেউ জীবনের সাথে বন্ধন গড়ে তুলতে পারে না। না, ঠিক করেছি মাকে বলবো, প্রথমে আমি পুরোপুরি তাকে জানবো, তারপর বিয়ে করবো। কারণ আমি আমার নিরুকে হারাতে পারব না। ওর সাথে এখনো কত আনন্দ ভাগ করা বাকি। এভাবে একটা অচেনা ছেলের জন্য সব তো মাটি হতে দেওয়া যায় না।”
ঠিক তখনই হঠাৎ রিকশাটা রাস্তার মাঝে থেমে গেল। আর মিরার শরীরেও হালকা এক ধাক্কা লাগল। তার চিন্তাভাবনায়ও তীব্র ব্যাঘাত ঘটল। মিরা তৎক্ষণাৎ বলল, “কি হলো, আঙ্কেল?”
Tell me who I am part 1
রিকশাওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে বললেন, “সামনে কি যেন হইছে, আম্মা। সবাই কেমন ভিড় করে আছে দেখেন।”
মিরা মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল। রাস্তা জুড়ে এক বড় ভিড় দেখা যাচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যে কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। তার কপাল কুঁচকে গেল, কিছু একটা অস্থিরতা মনে জেগে উঠলো। মিরা শঙ্কিত গলায় বলে উঠলো, “আবার কারো অ্যাকসিডেন্ট হলো না তো?”