Tell me who I am part 29

Tell me who I am part 29
আয়সা ইসলাম মনি

চিঠির দ্বিতীয় টুকরো হাতে ধরতেই কারান বুঝতে পারে, এটি কৌশিকার হাতের লেখা। মুহূর্তেই তার মুখে রাগের আগুন জ্বলে ওঠে। চিঠির টুকরো দুটি ডান হাতের মুঠোয় মুচড়ে শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। রাগে তার মুখমণ্ডল তীব্র কাঁপনে ভরে ওঠে।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে সংযত করে, সে কটাক্ষপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “কীসের কেমন আছি! কেন এত বছর পর তোমার চিঠি আমার হাতে পড়লো? তুমি জানো না তোমাকে আমি কতটা ঘৃণা করি।”
ক্ষণকাল পর অশ্রুভরা চোখে বলে, “কেন চলে গেলে, মা? একবারও কি আবরারকে মনে পড়েনি তোমার? একবারও কি মনে হয়নি, আমি চলে গেলে আবরার যে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি ধ্বংস হয়ে গেছি, মা। ধ্বংসের গভীরতম অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছি। যেখানে ক্ষত ও ভাঙনের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেমন আছি জানতে চাও তো। আমি ভালো নেই।”

ঢোক গিলে চিৎকার দিয়ে বলল, “আমি ভালো নেই, মাআআ… (থেমে) জানো মা, শেষ উনিশ বছরে একবার কেঁদেছি; তাও তোমার জন্য। মিরার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদেছিলাম, যেন তার নরম স্পর্শে আমার বুকের অমোচনীয় ব্যথা কিছুটা শান্তি পায়। আমি আর চিৎকার করে কাঁদতে পারি না, মা। এখন আমার ভেতর কান্নার কোনো ভাষা নেই, শুধু কঠোরতা আর নিষ্ঠুরতার আঁধার। আর এসবের জন্য একমাত্র দায়ী তুমি। আই হেইট ইউ মা, আই হেইট ইউ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি চলে যায় দূরের পাহাড়ের অস্পষ্ট আকারে।
ক্ষণকাল পর শান্ত গলায় বলে, “হয়ত আমি পাপী, কিন্তু এই পাপের নির্মাতা তুমিই, মা। যদি শাস্তির কথা তোলো, তবে একা আমার নয়, তোমারও প্রাপ্য। কিন্তু এ দুনিয়ায় আমাকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। (থেমে) তুমি যদি এখনো বেঁচে থাকো, নিজেকে দূরেই রেখো। আমার সামনে আসার দুঃসাহস করো না। তুমি আমার জন্মদাত্রী হলেও, অন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই আমার কাছে। তোমাকে এমন শাস্তি দিব, যা নিষ্ঠুরতার সব সীমা অতিক্রম করবে। তুমি তো আমার সব সুখ-শান্তি ছিনিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলে। এখন বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ, একমাত্র আশ্রয় মিরা। সে-ই আমার হৃদয়ের শেষ প্রান্তের আলো, আমার নিঃসঙ্গ জীবনের শান্তির নিশ্বাস। তোমার মতো তাকেও হারাতে চাই না আমি। ভেতরে ভেতরে অজানা একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায়, জানো? মানুষ তার নিজের অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকে, আর আমার সমস্ত শঙ্কা কেবল মিরাকে ঘিরে আবদ্ধ। আই উইল নেভার লেট মাইসেল্ফ শো উইকনেস বিফোর মিরা। আই লাভ ইউ, মিরা; এ্যান্ড আই লোথ ইউ, মা।”
এরপর কারান গভীর এক নিশ্বাস ফেলল। চিঠির টুকরোগুলো ফেলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই হঠাৎ ফোনের শব্দে থেমে গেল।

কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত নিজের আবেগের বাঁধন গুটিয়ে নিয়ে টুকরোগুলো পকেটে গুঁজে রেখে ফোনটা কানে তুলল।
ওপাশ থেকে ইমন বলল, “আসসালামু আলাইকুম, স্যার। ইংল্যান্ডের এভার্দো কোম্পানির সেই প্রজেক্টের কাজ চলছে। ডিল কনফার্মেশনের জন্য আপনাকে নিজে উপস্থিত থাকতে হবে। নেক্সট উইকে তারা আসছে, আপনার থেকে তারিখ জানতে চাচ্ছে।”
কারান কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল।
ইমন অস্থির স্বরে পুনরায় ডাকল, “স্যার?”
এদিকে কারান দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল, “ডিলটা ক্যান্সেল করে দাও।”
ইমন বিস্মিত হয়ে বলে উঠল, “কিন্তু স্যার, এত বড় ডিল…”
কিন্তু কারান ইমনের বাকিটুকু শোনার আর প্রয়োজন অনুভব করল না। ফোনটা কেটে পকেটে ঢুকিয়ে নিল।

ওদিকে আম্বিয়া দ্রুত পা চালিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে। সেখানে আলমারিতে রাখা একটা পুরোনো, কারুকাজ করা কাঠের বাক্সে চিঠির টুকরোগুলো সাবধানে লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু পিছনে ফিরে হঠাৎ ঘরে মিরাকে দেখে আম্বিয়া চমকে কেঁপে ওঠেন।
মিরা নরম কণ্ঠে বলল, “দাদিজান, সকালের খাবার তৈরি হয়েছে। খেতে আসুন।”
আম্বিয়া কিছু না বলে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করল। তারপর তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মিরা কিছুক্ষণ আম্বিয়ার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে তার চলে যাওয়ায়, আচমকাই মিরার মনে কিছু একটা সন্দেহ এলো, তবে সেসব চিন্তা অন্যদিকে রেখে বাহিরের প্রকৃতির দিকে চোখ যাওয়ায় সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে পেছনের বাগানটা পরিষ্কার দেখা যায়। মিরা কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে বহির্ভাগের স্বচ্ছ বাতাস অনুভব করতে থাকে। মাথা ঘুরাতে যাবে, এর মধ্যেই নজরে এলো, ফাতিমা বাগান থেকে ঘরের দিকে আসছে। মিরার কপাল সামান্য কুঁচকে গেল, তবে সে তাতে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। মনে মনে ভাবল, ‘ফাতিমা নিশ্চয়ই হাঁটতে গিয়েছিল।’

এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে কারান মিরাকে জড়িয়ে ধরল। প্রথমে মিরা খানিকটা ভয় পেয়ে গেল, তবে কারানের পরিচিত ছোঁয়া অনুভব করে তার ভয়ের ছায়া মুছে গিয়ে তার মুখশ্রীতে মিষ্টি হাসি মুখে ফুটে উঠল।
সে মৃদু গলায় বলল, “সবসময় আমাকে ভয় পাইয়ে দাও কেন, বলো তো?”
এদিকে কারান নিরুত্তর। মিরার কাঁধে থুতনি রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবসময় মিরার কথার কোনো না কোনো উত্তর সে দিত; এটা মিরা জানত। কিন্তু আজ অদ্ভুতভাবে নীরব সে। এই নীরবতা মিরার বুকের ভেতরে অজানা একটা শঙ্কা ঢুকিয়ে দিল। তাই সে ধীরে ধীরে ঘুরে কারানের মুখের দিকে তাকাল।
কারানের শুকনো ঠোঁট, ফ্যাকাসে চোয়াল আর চোখের পাতায় চাপা ক্লান্তি স্পষ্ট ফুটে আছে। চোখ দুটো যেন গভীর কোনো বিষাদের পুকুর। এসব দেখে মিরার বুকের ভিতরে গভীর শূন্যতা দোলা দিল। চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে, কারান?”

কারান কোনো তাড়াহুড়ো করল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মিরার চোখের গভীরে। তারপর খুব নরম কণ্ঠে বলল, “আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো, মিরা।”
আর কোনো প্রশ্ন না করে মিরা দ্রুত তাকে নিজের বুকে টেনে নিল। তার হাতদুটো কারানের পিঠে জড়িয়ে গেল। কারান গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ভিতরের ঝড় কিছুটা থেমে গেল। বুকটাও ঠান্ডা হয়ে এলো। মিরা কিছু বলল না—শুধু তার অস্থিরতা অনুভব করে তাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। একসময় সে কারানের ঘাড়ে আলতো করে একটি চুমু দিল।
কারান চোখ বন্ধ করল। সেই একটুখানি ছোঁয়াতেই তার ভেতরের কষ্টেগুলো শান্তির ঘুমে ঢলে পড়ল।

সূর্য পশ্চিম আকাশের অন্তিম রঙে নিভে যাওয়ার প্রাক্কালে, আম্বিয়া, মিরা ও সোফিয়া আম্বিয়ার বিছানায় বসে আড্ডায় মগ্ন। এতক্ষণ ধরে সোফিয়া তালহার সঙ্গে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনুপম প্রেমকাহিনী বর্ণনা করছিল।
তার মনে পরে যায়, সিডনির ঘন মেঘে ঢাকা এক বিকেলে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে তালহার কণ্ঠে শোনা প্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা আশ্চর্য মুগ্ধতায় মোড়া মুহূর্তে তাকে স্থবির করে দিয়েছিল। তারপর শুরু হয় রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতির সহযাত্রী হয়ে ওঠা, একে অপরের জন্য ক্যানটিনে খাবার রেখে আসা, কিংবা শীতের রাতের টিউটোরিয়াল শেষে চুপচাপ বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকা; এভাবেই আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্ক আগাতে থাকে।
তবে সোফিয়ার সবচেয়ে প্রিয় ছিল তালহার গায়ের রং। শ্যামবর্ণের আবরণ অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাপটে ছিল অন্যরকম বিপরীত সৌন্দর্য। সেই সাথে তার মায়াময় চক্ষুদ্বয় সোফিয়াকে প্রতিবার, প্রতিক্ষণে তালহার দিকে অনিবার্যভাবে আকর্ষিত করত।

এসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে হঠাৎই সোফিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে, “You know, once a girl in class directly confessed her love to him. He politely rejected the proposal, and then the girl, feeling dejected, angrily said, ‘I might be a thousand times more beautiful than her, so why don’t you like me?’ Talha replied, ‘When the heart finds its true home, no matter how beautiful others may be, there is no affection or captivation towards them.'”

(অনুবাদ: “তুমি জানো, একবার ক্লাসের একটি মেয়ে সরাসরি তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল। সে বিনয়ের সাথে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিল, আর তখন মেয়েটি বিষন্ন হয়ে রেগে বলেছিল, ‘ওর থেকে তো আমি হাজার গুণ সুন্দর, তাও কেন তুমি আমাকে পছন্দ করছ না?’ তখন তালহা বলেছিল, ‘যখন হৃদয় তার আসল বাড়ি খুঁজে পায়, অন্যরা যতই সুন্দর হোক না কেন, তাদের প্রতি কোনো স্নেহ বা মোহ কাজ করে না।'”)
মিরা হেসে বলল, “তাহলে তো তালহা ভাইয়া ভীষণ লয়াল।”
সোফিয়া মৃদু হেসে কিছুক্ষণের নীরবতা বেছে নেয়।
এর মধ্যে তারান্নুম এসে আম্বিয়ার কোলে শুয়ে বলল, “তোমার আর নানার প্রেমকাহিনী কও তো, নানু।”
আম্বিয়া মুখ কুঁচকে হেসে বলল, “আইছে কলাবতী। ওঠ, তরু।”
কিন্তু তারান্নুম ভেংচি কেটে আর উঠে না। তারান্নুমের বাচ্চামি দেখে মিরা ও সোফিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে উঠল।

মিরা এবার আকুতির ভঙ্গিতে বলল, “দাদিজান, বলুন না, দাদাজানের সাথে বিয়ের কাহিনি।”
এবার আম্বিয়া হেসে শুরু করে, “তানার লগে (তার সাথে) যহন আমারে বিয়া দিল, আমি তহন তেরোতে পা দিছি। এইদিকে আমার বিয়াও হইয়া গেছে, অথচ আমি জানিও না। যেইদিন বউ হইয়া এই বাড়ি আইলাম, ওইদিন পোরথোমবার তানারে দেহি। দ্যাকতে হুনতে (দেখতে শুনতে) খারাব আছিলো না। তবে সবাই কইতো আমার নাকি ভাগ্য ভালা, আমি কম বয়সি পোলা বিয়া করবার পারছি। অথচ তানার বয়স আছিল তহন ৩১ বৎসর। আবার তানার আমি ২ নাম্বার বউ, পোরথোম বউ নাকি শাউড়ীর অত্যাচারের ঠেলায় পালাইছে। কারণ হেই বউর মাইয়া পোলা হইতো না।”
সবাই খুব সুন্দর মনোযোগ দিয়া গল্প শুনছিল। কিন্তু অকস্মাৎ তারান্নুম কৌতূহল বশত বলে বসে, “হে কার লগে ভাগছিল, নানু?”
এমন একটা ভঙ্গিতে বলে যে মিরা আর সোফিয়া না চাইতেও সামান্য শব্দ করেই হেসে ফেলে।
আম্বিয়া নাক ফুলিয়ে বলে, “দ্যাকছুনি, মাইয়া কি কয়! এ মাইয়া উনি কারো লগে পালায় নাই, বাপের বাড়ি চইলা গেছিল।”

মিরা কথার মধ্যে বলে বসে, “তার পরের কাহিনি বলুন ,দাদিজান।”
সোফিয়াও হেসে বলে, “ইয়েস গ্রানি, দেন হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
আম্বিয়া এবার কাহিনির পর থেকে শুরু করে, “হেরপর আর কি, যহন হুনলাম আগের বউ অত্যাচারের ঠেলায় পালাইছে, আমার কইলজা ওইহানেই শুকাইয়া গেল। কিন্তু আমি হইলাম সাহসী মাইয়া, আমি শাউড়ীতে ভয় পামু না, এমন একটা ভাব নিজের মধ্যে ধইরা রাখছিলাম। কি আর কমু মাইয়ারা! সোয়ামি একখান পাইছিলাম! বাবা রে! তানার গোস্বার (রাগ) ঠেলায় আমারে চুপ থাকতে হইতো হারাদিন। আইতে যাইতে থাপড়াইতো আমারে। আমারও জেদ লাগতো, তয় আমি কিছু কইবার পারতাম না, যদি আবার পিডায়। হের মধ্যে ১৪ গুষ্টির রান্দন আমারে রানতে হইতো। আবার…”
তারান্নুম কথা কেটে বলে উঠে, “রাখো তোমার অত্যাচারী কাহিনি, আগে কও বিয়ার রাইতে নানায় কেমন আদর করছিল গো?”

কথাটা শুনে মিরা চোখ বড় করে ঠোঁট চেপে একটু চুপিসারে হেসে নিল।
অথচ আম্বিয়া লজ্জায় মলিন হয়ে তারান্নুমের কাঁধে একটি স্নেহপূর্ণ চাপড় মেরে বলল, “তুই ঘইরদা (ঘর থেকে) বাইরা, নটি মাইয়া।”
এবার তারান্নুম আম্বিয়ার গা ডলে বলে, “হইছে, যাও কও তুমি। আর কিছু কইতাম না।”
মিরাও হেসে বলে, “তারপর বলুন, দাদিজান।”
আম্বিয়া নরম গলায় বলেন, “হেরপর পান থেইক্কা চুন খসলেই আমার চুলের মুঠি ধইরা কি মাইরটাই না দিত রে। আইজও মনে পড়লে কান্দন (কান্না) আহে। সোয়ামীর মুখের উপর কথা কইলেও আল্লাহ গোস্বা করে জানতাম, হে কারণে মুখ বুইজ্জা সহ্য করোন লাগতো। হের উপর আমি আছিলাম সুন্দরী। বাড়ির বুড়া বেটা থেইক্কা গুড়া, সবগুলা চোখ দিয়াই গিল্লা (গিলে) খাইতো আমারে। ওইদিকে আগের বউও ফিররা আহে, হেরে বাপের বাড়ির মানুষ রাকবে না ঘরে তাই। ওই মাইয়া আছিল ভালা–দুইজনে এক সাথ হইয়া কাম করতাম, গপ্প জমাইতাম। সোয়ামির ভালোবাসা কেউই ঠিক মতোন পাইতাম না,” বলে কিঞ্চিৎ বিষাদভরা চেহারায় হাসলো।

মিরা একটু ভ্রূ কুঁচকে বলে, “দাদাজান, আপনাদের দুজনের কাউকেই ভালোবাসতো না?”
আম্বিয়া হেসে বলে, “পাইবো কেমনে? হের ভালোবাসা তো আছিল নিষিদ্ধ পল্লিতে।”
সোফিয়া পুরোপুরি না বুঝলেও, মিরা আর তারান্নুম তার বেদনাকে হৃদয়ে অনুভব করে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফেলে।
আম্বিয়া শ্বাস টেনে আবার শুরু করে, “হে সব কতা আমি আবার জানতাম না।
তয় একদিন আমি বড় গিন্নির চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে জিগাই, ‘বুবু, কদ্দিন (কয়দিন) ধইরা দেহি তানায় রাইতে ঘরে আহে না, থাহে কই? কামে গেছে নাকি?’

তহন বুবু একটু হাইসা কয়, ‘তোমার আইবার আগেও আমি এই বাড়তে আট বৎছর ছংছার (সংসার) করচি, তাই তুমি কিচুই জানো না। এই বাড়ির হক্কলেরই (সবাই) নিছিদ্ধ পল্লিতে যাওয়ার নাম আচে (আছে)।’
তয় তহন আমি জানতাম না নিষিদ্ধ পল্লি আবার ক্যারে কয়, তাই বুবুকে কৌতূহলী হইয়া জিগাইলাম, ‘হে কি, বুবু?’
বুবু মলিন হাইসা কয়, ‘আমগো ছোয়ামির ভালোবাছার কোল আচে বুঝলা? তানায় হেই কোলে পরম ছুকে (সুখে) ঘুমায়। মাঝেমধ্যে আমগো মনে পড়লে বাত্তে (বাড়িতে) পা রাহে।’
তহন আমি বুঝবার পারি নিষিদ্ধ পল্লি কি জিনিস। হের কয়দিন পর তানায় কি একটা কামে শহুরে যাহে, হেইদিন আমার লগে জিন্দেগির বিরাট খারাব কামটা হয়, য্যা আমি কল্পনাতেও আনতে পারতুম না।”
তারান্নুম আর মিরা উদ্বিগ্ন হয়ে একসাথে বলে উঠে, “কি হয়?”
আম্বিয়া আরেকবার শ্বাস টেনে বলে, “আমি খু*ন কইরয়াছি (করেছি)। তাও একটা দুইটা না, সাত সাত খানা খু*ন কইরয়াছি।”

এটা শুনেই তারান্নুম চোখ বড় করে অবাক হয়ে, কোলের শোয়া থেকে এক লাফে উঠে পড়ে। মিরা ও সোফিয়া স্তম্ভিত হয়ে, একে অপরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে একই প্রশ্ন— এটা কি উচ্চারণ করলেন আম্বিয়া?
কিন্তু আম্বিয়া ঠান্ডা গলায় বলে, “তানারা পাঁচ ভাই আছিলো, হে তিন নাম্বারে। বড় গিন্নি অনেক কাল আগেই দুনিয়া ছাড়ছে, হের দুইটা মাইয়া হইছিল, দুইডায়ই নাকি কলেরায় ম”রছে। পরেরডার বউ হের দুই পোলা লইয়া বেশিরভাগ সময় বাপের বাড়ি থাকতো। হে গিন্নি জমিদারের মাইয়া, হের ভাব আছিলো অন্য রহমের (রকমের)।

তবে, বাড়তে তানার গোস্বার জইন্যে তানারে হক্কলেই ডরাইতো। তয় হেদিন তানায় কামে গেছে–ঘরে আছি আমি, খাদিজা বুবু, শাউড়ী, শউর, আমার চার দেওর, বাসুর, লগে আরেকটা কামলা (কাজের ছেলে)। রাইত তহন নয়টা বাজে, বুবু ঘুমাইছে; শাউড়ীও সন্ধ্যায়ই বিছানায় গা লাগাইছে। আমার ঘুম আহে না, তাই আমি আবার একখানা কাঁথা সেলাই করতাছিলাম। তহনই হুট কইরা আমার বাম কাঁধে একটা শক্ত হাত পড়ে। হেই হাত আমার কাঁধটারে এত্ত শক্ত কইরা ধরে যে আমার ভিতরটা কাঁইপা ওঠে। আমি লগে লগে পিছে ফিররাই দেহি, আমার বড় বাসুর। আমার কইজাডা একটুখানি হইয়া যায়। এর মধ্যে দেহি আমার শউর হের বাকি পোলারা আর হেই কামলাও একসাথ হইয়া আমার দিকেই সামনে আগাইতেছিল।

আমি কিছু একটা আন্দাজ কইরা চিল্লানি দিতেই ওরা মুখ চাইপা ধরে। তহনই শুরু হইয়া যায় আমার উপর পাশবিক হামলা। পুরা কাপড় খুলবার পারে নাই, এর মধ্যে খাদিজা বুবু আইয়া একখানা মুগুর লইয়া উরা ধুরা হক্কলরে পিডাইতে (পিটাতে) থাহে। আমিও ওই হট্টগোলে ছাড়া পাইয়া, খাটের নীচদা একখানা রা*ম দা বাইর করি। কিন্তু আ*ঘাত করতে যামু, তহনই ছোটো দেওরে আমারে এক থাপ্পড়ে বিছানায় শোয়াইয়া দেয়। এর মধ্যে আমি দেহি খাদিজা বুবুরে কেমনে ওরা পিটাইতেছে, সাথে বুবুর কাপড় খুইলা ধ*র্ষণ করতাছে। আমি হন্তদন্ত কইরা উইঠা বুবুরে বাঁচাইতে যামু, অমনি শাউড়ী আইয়া আমার চুলের মুঠি ধইরা সরাইয়া দেয়। ওই দ*জ্জাল বে*শ্যা মা*গি সব দেখতাছে, অথচ হেয় আমারে আর বুবুরে বাঁচায় না।
আমি ওনার পাওডা ধইরা কানতে কানতে কই, ‘আম্মাগো, আমি আমনের সব কতা শুনুম, আজীবন গোলামি খাটুম, আমনে বুবুরে বাঁচান।’

হে হাইসা কয়, ‘এই যন্ত্রণা আমিও ছইবার আইচি (সয়ে আসছি), তোরা বাদ যাবি কিল্লাই?’
কইয়াই আমারে ধাক্কা দিয়া পিশাচ গুলানের মধ্যে ফালাইয়া দেয়। আমি জলদি কইরা আমার আঁচল দিয়া বুবুর শরীর ঢাকবার থাহি।
বুবু আমারে জড়াইয়া ধইরা কয়, ‘তুই পালাইয়া যা, আম্বি। পালাইয়া যা। বাহের বাড়ি জায়গা না পাইলেও, লাগলে ভিক্ষা কইরা খাবি, তাও জানোয়ারগুলানের ধারে নিজেরে বিলাইছ না। পালা, আম্বি।’
আমি বুবুরে ঝাঁপটাইয়া ধইরা কানতে কানতে (কাঁদতে কাঁদতে) কই, ‘বুবু, তোমারে এমনে রাইখা আমি যামু না।’
বুবু কয়, ‘আট বৎছর এই যন্ত্রণা ছইবার আইচি, আর (আমার) ধারে এছব কিচু না। তুই যা।’

আমিও তহন আর বুবুর দিকে না চাইয়া পালাইন্নার সিদ্ধান্ত নিলাম। দুই পা অন্দরের বাইরে রাকতেই ওরা আমার পা টাইনা ধইরা ঘরে লইয়া যায়। কিন্তু আল্লাহ মনে হয় চায় নাই, ওইদিন আমার কিছু হউক। কেমনে জানি শরীরে অনেক জোর অনুভব করতাছিলাম। দৌড়াইয়া রা*ম দাটা আইনাই বড় বাসুরের কল্লাডা (মাথাটা) কা*ইটা ফালাই, ক*ল্লাডা নিচে গড়াইতে থাহে। আর র*ক্তে আমার মুখ, কাপড় আর মেঝে ভিজজা যাইতে থাহে। আমার ওমন রূপ দেইখা বাকিদের ঘাম ছুইট্টা যায়। কিন্তু আমি আর দইমা যাই না। একে একে সবগুলার হাত, পা, কল্লা কা*টি। ওগো ধারে তো কোনো অস্ত্রশস্ত্র আছিলো না, এই লাইগা ওগো মারতেও আমার বেশি সময় লাগে নাই। কিন্তু ছোটো দেওরে আঁশ বটি আইনা আমার পিডে একটা কো*প মারছিল।”

পিঠ থেকে শাড়ির কাপড় সরিয়ে দেখিয়ে আবার বলে, “এই হেই দাগ, এহনো আছে।”
দাগটা দেখে মিরা, তারান্নুম, সোফিয়া—তিনজনেই নীরব থাকে। তাদের মনের মধ্যে অজানা ভয় এবং বিস্ময়ের মিশ্রণ। এমন একজন মানুষের পিছনে যে এত ভয়ানক ঘটনা ও অদেখা রূপ লুকিয়ে রয়েছে, তা ভাবতে তাদের কল্পনাও অক্ষম।

আম্বিয়া আবার ঘুরে বসে, শাড়ির প্রান্ত কিছুটা ঠিক করে নিয়ে বলে, “কিন্তু ওই কোপে আমার কিচ্ছু হয় নাই। আমি হাসতে হাসতে দেওরের (দেবর) কল্লাডা কাইটা ফালাই। রক্তে ঘরের লগে আমার মুখটাও এমন ডুইবা গেছিলো যে, আমারে দেখলে শয়তানও মনে হয় ডড়াইতো। শ্যাষম্যাশ বাঁইচা আছিল একজন, হে হইলো আমার শাউড়ী। উনি আমার অমন রূপ দেইখা ওইখানেই মলমূত্র দিয়া কাপড়চোপড় মাইখা ফালায়। আর এটাও বুঝবার পারে, অহোন হের পালা। হে আমার পা ধইরা কাঁনতে (কান্না) থাহে, আর মাফ চায়। কিন্তু আমি রাগে বেটির কোমরে একখান লাথি মাইরা ওরও কল্লা*ডা ঘাড় থেইক্কা নামাইয়া দেই। এদিকে আমার অমন অগ্নিকা রূপ দেইখাও খাদিজা বুবু আ উ কোনো আওয়াজ করে নাই। হে কোনায় বইয়া (বসে) আমার দিকে ফ্যালফ্যাল কইরা তাকাইয়া খালি হাসছে।
হেরপর আমি রাম দাটা পাশে রাইখা, বিছানার চাদরদা লইয়া বুবুর গায়ে জড়াইয়া দিয়া কই, ‘বুবু, আইজকা থেইক্কা তুমি মুক্ত।’

ওদিকে এইসব করতে যাইয়া ততক্ষণে সকাল হইয়া গেছে। শিউলির মা আবার মাঝেমধ্যে আমগো বাড়িরদা গরুর গোবর নিতে আইতো। তয় ওইদিনও আহে, হে আবার কারো কোনো আওয়াজ না পাইয়া জানলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া ঘর দেখতেই ‘ও মা গো’ কইয়া একটা চিল্লানি (চিৎকার) দিয়া ওইহানেই অজ্ঞান হইয়া যায়। হেরপর হের চিল্লানিতে মানুষজন আইয়া যা দেহার তো দেইখাই লয়। এইদিকে এতক্ষণ বাদে বুবুর চেতনা আহে। হের মধ্যে বাড়তে পুলিশ লইয়া গ্রামবাসী আইয়া পড়ে। বুবুরে আমি জলদি কইরা কাপড় পড়াইয়া দেই। বুবু হাইসা রাম দাটা তার হাতে লয়। আমি বুঝবার পারি, বুবু আমার দোষ তার ঘাড়ে লইতে (নিতে) চায়।
আমি অনেক জোরাজুরি করি, ‘এইটা ঠিক না, বুবু। তুমি আট বৎসর অনেক কষ্ট পাইছো, অহোন তোমার সুখের দিন, দা খানা আমারে দিয়া দাও।’

হে স্নিগ্ধ একখান হাসি মাইখা কয়, ‘সুখ কি, তাহা আমি জানি না, জীবনের সুধার কণা কখনো আমার কপালে বরাদ্দ ছিল না। তবে আজ তোমার প্রতি আমার দোয়া রহিল—যেমন তুমি দৃঢ়, তেমনই অবিচল থাকো। আমি অসৎপথে নিজেকে কলুষিত করিয়াছি, আর তুমি সেই কলুষতার প্রতিপক্ষ হইয়া নারীর মুখ উজ্জ্বল করিয়াছ। তোমার এই জেদ, তোমার অগ্নিস্ফুলিঙ্গই তোমার শক্তি এবং এই শক্তি তোমাকে চৌধুরি বাড়ির শাসন প্রতিষ্ঠিত করিবার পথ প্রদর্শন করিবে। তুমি সেই অমোঘ সাহস, যাহা নারীর অন্তরে দগ্ধ ক্ষোভ থেকে উদ্ভূত হয়ে অনির্বাণ শিখা হিসেবে জ্বলে উঠিতেছে। তুমি হইবে সেই সংগ্রামের প্রতীক, যাহা নারীর মর্যাদার জন্য জাগ্রত হইবে।’

এইটুকু কইয়া হাইসা আমার মাথায় হাত রাইখা, রাম দা লইয়া দরজার বাইরে পা দেয়। আমি দুয়ারে দাঁড়াইয়া খালি দেইখা গেলাম, কেমনে বুবুরে টানা হ্যাঁচড়া কইরা লইয়া যাইতেছে পুলিশগুলান।”
এটুকু বলে আম্বিয়া গভীর শ্বাস ফেলে নীরব হয়। মিরা এতক্ষণ যা শুনল, তাতে বুঝতে পারে এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের ভেতরেই কোনো না কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। আম্বিয়ার এমন এক অতীত ছিল, যা শুনে যে কারোর শরীর শিউরে উঠবে এবং তাদের তিনজনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল।

আম্বিয়া এবার কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “নিজেরে কহনোই ক্ষুদ্র ভাইবো না। অন্তরে ঢেউ তুললেও, চোক্ষের জলরে ধরা দিতে দিও না। মানুষ দুর্বলতারে শিকার করিতে সদা উদগ্রীব; তাই নিজেরে কারোর সামনে ভাইঙা পড়তে দিও না। সহানুভূতির আশায় পা বাড়িও না, তাহাতে পাইবা কেবল তাচ্ছিল্যের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।”
কথাটার অর্থ সবার মনেই গভীরভাবে প্রবেশ করে।
ঠিক এমন সময় ফাতিমা এসে হেসে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে, “গপ্প শ্যাষ হইলো? আহো সবাই। তোমাগো লাইগা জলপাইয়ের আচার বানাইছি, খাইবা আহো।”
ফাতিমার কথায় সবার মুখে হাসির আভা ফুটে ওঠে, সেই গাঢ় পরিবেশ হঠাৎই হালকা হয়ে গেল। একে একে সবাই খুশিমনে ফাতিমার পিছু নেয়। তবে মিরা আম্বিয়ার প্রতিটি শব্দ অন্তরের সব কোণায় গেঁথে নেয়।

এদিকে রোমানার মন আজ শপিংয়ের দিকে বায়না ধরেছে, আজকেই বেরোতে হবে। আরিয়ানও আজ বাসায় থাকায় কোনো দ্বিধা ছাড়াই তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শপিং মলে পা রাখতেই রোমানার চোখে-মুখে উচ্ছ্বাসের ছাপ ফুটে ওঠে। এটা-ওটা করে একের পর এক কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে। আরিয়ানও বেশ কিছু জিনিস কিনতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ পর ট্রায়াল কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে আরিয়ান, পরনে একটি নতুন স্যুট। আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে রোমানার সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মাখা মুখে বলে, “কেমন লাগছে, বেবি?”
রোমানা নিজের ড্রেস দেখতে দেখতে আরিয়ানের দিকে না তাকিয়েই হেলদোলহীন ভাব নিয়ে বলে, “কাককে যতই ময়ূর সাজাও, কাউয়াই লাগবে।”

“তোকে যদি এখন মলের ফিফথ ফ্লোর থেকে ফেলে দেই, তোর হাড্ডিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
এর প্রত্যুত্তর রোমানা কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখনই খেয়াল করে, পেছনে একটা মেয়ে আরিয়ানকে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
রোমানা হেসে মনে মনে বলে, “এই গরুর ঘণ্টার উপরও কেউ আবার ক্রাশ খায়!”
এরপর মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, “এক্সকিউজ মি, মিস ওর মিসেস? ওই যে ছাগলটাকে—ওপস, সরি! ওই যে মানুষের মতো দেখতে লোকটাকে দেখছেন, ওকে চাইলে আপনি নিয়ে যেতে পারেন। অনেকদিন ইউজ করেছি তো, এখন ইন্টারেস্ট উঠে গেছে।”
মেয়েটা কিছুটা ভ্রূ কুঁচকে বলে, “মানে?”
রোমানা মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “আরে সেকেন্ড হ্যান্ড মা’ল। অলরেডি ওকে খেয়ে দিয়েছি। আপনি চাইলে আবার খেতে পারেন, একদম পচে যায়নি।”
এসব দেখে আরিয়ান লজ্জায় চোখমুখে হাত বুলিয়ে অসহায়ভাবে বলে, “দিল মানইজ্জত শেষ করে।”
তারপর তাড়াহুড়ো করে রোমানাকে টানতে টানতে বলে, “প্লিজ, কিছু মনে করবেন না। হেমায়েতপুরের পাবনা হাসপাতাল থেকে আজকেই পালিয়েছে। আবার পাঠিয়ে দিচ্ছি,” বলে রোমানাকে নিয়ে দ্রুত সরে যেতে থাকে।
পিছন থেকে রোমানা গলা উঁচিয়ে বলে, “অফারটা কিন্তু খারাপ না, মিস। ভেবে দেখতে পারেন।”

পরেরদিন সকালে কারান গোসল শেষে তোয়ালে জড়িয়ে আয়নার সামনে চুল ঠিক করছিল। হঠাৎ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকায়। মিরা ঘরের ভেতরে এসে দরজা আটকে দিয়েছে।
কারান একটু মুচকি হেসে বলে, “দরজাটা খোলা ছিল? খেয়াল ছিল না।”
মিরা দেয়ালে হেলান দিয়ে দুষ্টুমিভরা চেহারা নিয়ে কারানের পুরো শরীরটা বিস্তারিতভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে।
কারান ভ্রূ কুঁচকে হেসে বলে, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
মিরা এক ভ্রূ তুলে মুচকি হেসে বলে, “ভাবছি, আজকে তোমার সর্বনাশটা করেই ফেলি।”
কারান ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে, “এই, তোমার চেহারার এক্সপ্রেশন চেঞ্জ করো। সিরিয়াসলি তোমাকে বখাটে মনে হচ্ছে।”

এদিকে মিরা চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক নিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে কারানের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।
কারানও এক পা এক পা করে পিছনে যেতে যেতে বলে, “কে.ছি হাউজে তো আপনার এমন রূপ দেখা যায় না। দেখো মিরা, এই বাড়িতে আমি উলটো পালটা কিছু করতে চাই না।”
মিরা ভাবের সহিত চুলে ঝাড়া দিয়ে বলে, “বাড়ির সবাই হাঁটতে বেরিয়েছে। আমাকেও বলেছিল, তবে আমি তো আমার সোয়ামিজির পারমিশন ছাড়া বেরোতে পারি না, তাই যাইনি। ভাবলাম এই সুযোগে তোমার লজ্জাহরণ করেই ফেলি।”

কারান মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলে, “আমি কিন্তু তোমার নামে কেস করবো, সুইটহার্ট। এগোবে না বলছি।”
দুজনই পায়ের ছন্দে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলে, একসময় কারান দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
মিরা তখন তার একপাশে হাত রেখে নেশালো গলায় বললো, “আয়হায়! কি লাগছে আমার বরকে। আচ্ছা, কে যেন বলেছিল, ইফ ইউ ওয়ান্ট, আমি টাওয়ালটাও খুলে ফেলতে পারি। আজকে নাহয় খুলেই ফেলুন, কারান চৌধুরি।”
কারান এবার চেহারায় উত্তেজনা ভাব নিয়ে সম্মোহনী গলায় বলে, “আমি যদি সত্যিই টাওয়ালটা খুলে ফেলি, সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
মিরা পায়ের গোড়ালি উঁচিয়ে কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “জানি তো, আজকে তোমার সর্বনাশ হবে।”
“উঁহুঁ, আমার না, তোমার। কারণ সেদিন তো আন্ডারওয়্যার ছিল, আজকে সেটাও পড়া নেই।”
এবার মিরা রসগোল্লার মতো চোখ করে বুঝতে পারে, কারানের সাথে মজা করতে গিয়ে সে কিছুটা সীমা লঙ্ঘন করেছে। তাই দ্রুত পালাতে যায়। কিন্তু তার আগেই কারান মিরার হাত ধরে তাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। নেশালু গলায় বলল, “দেড় বছরের অপূর্ণ কাজটা আজকে করেই ফেলি, জান,” বলেই তার ঠোঁট মিরার গলায় ডুবিয়ে দেয়।

মিরার সারা শরীর সেলাইয়ের মতো টানটান হয়ে ওঠে, চোখ বন্ধ করে হাসি মুখে শ্বাস ফেলে সে। কিছুক্ষণ পর কারান মুখ তুলে মিরার ঠোঁটে চুম্বন করতে থাকে। মিরাও তার সঙ্গে চুম্বনের অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে থাকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার দিকে কিছু একটা ঠকঠক আওয়াজ হলে, তাদের প্রেমের অগ্নি মুহূর্তে বিশাল এক বাধা সৃষ্টি হয়ে যায়।
মিরা জলদি করে বলে, “সরো না কেন এখনো?”
কিন্তু কারান যেন কোনো অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে। তাই আবারও মিরার ঠোঁটে চুম্বন করে, তার শরীর ও মনে অসম্ভব শান্তি অনুভব করে। অর্থাৎ তার পৃথিবী এখন শুধুই মিরা, আর কোনো কিছুই তাকে সেখান থেকে টেনে আনতে পারবে না।
এদিকে দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। মিরার মনে কিছু একটা ঘোর পাক খায়। তাই উপায় না পেয়ে কারানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
তারপর একটু অস্থির হয়ে উঠে শাড়ি ঠিক করে নিতে নিতে বলল, “এভাবেই থাকবে? তাড়াতাড়ি টাওয়াল খুলে শার্ট প্যান্ট পরো।”

কারান দুষ্টুমি হেসে বলে, “ঠিকাছে, আমি তোমার সামনেই চেঞ্জ করছি।”
সে তোয়ালে খুলতে যাবে এর মধ্যে মিরা পিছন ফিরে বলে, “নির্লজ্জ কাকে বলে!”
কারান হেসে বলে, “মুখ ঘুরালে কেন? পিছনে তাকাও জান, লাইভ দেখাই।”
মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আল্লাহ, এই অসভ্যটাকে একটু লজ্জা দিয়ে দুনিয়ায় পাঠালে কি হতো?”
কারান হাসতে হাসতে শার্ট ও প্যান্ট পরিধান করে। পরে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে তা খুলতেই, মুহূর্তে তার সমস্ত উত্তেজনা হালকা হয়ে যায়।
এদিকে মিরা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় তারান্নুম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছিল। এটা দেখে মিরার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় রাগের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু তার চোখে অগ্নিশিখার মতো তীব্রতা থাকলেও সে কিছু বলল না। এক ঝলক কারানের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যায়।
পরে হাত মুঠো করে ঘুষির ভঙ্গিমা দেখিয়ে কারানকে ইশারায় বুঝিয়ে দেয়, ‘যদি এই মেয়ে তোমার কাছে ঘেঁষে, তোমাকে একটুও স্পর্শও করে, তো আমি শুধু তোমার না, ওর মাথারও একটি চুল রক্ষা করতে দেব না।’
এরপর মিরা প্রস্থান করে।

কিন্তু মিরার প্রতিক্রিয়া দেখে কারান মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
এদিকে তারান্নুম চোখমুখ কুঁচকে বলে, “আমারে দেখলেই কি তোমার হাসি পায়?”
এবার কারান মুখে গম্ভীরভাব এনে বলে, “তোর কি জন্মই হয়েছে আমার প্রেমে বিষ ঢালার জন্য?”
তারান্নুম ভেংচি কেটে বলে, “কুটনি, ইবলিস, পেত্নী মিরা। ওরে আমি সাবান দিয়া ধুইয়া দিউম।”
তারান্নুমের কথা শুনে কারান হাসবে না রাগ করবে বুঝতে না পেরে বলে, “তোর মুখ আমি সেলাই করে দিব, বেয়াদব। কত্ত বড় সাহস! আমার সামনেই আমার বউয়ের দুর্নাম করিস?”
কিন্তু তারান্নুমের ভাবলেশহীন মুখ দেখে কারানের চোখে অন্য চমক জ্বলল। তৎক্ষণাৎ টেবিল থেকে ফোনটি তুলে ফারহানকে ভিডিও কল করে, ফোনটা তারান্নুমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। ফোনের স্ক্রিনে ফারহানের মুখমণ্ডল দেখা মাত্রই, তারান্নুম পুরোপুরি অবাক হয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ফারহান হেসে বলল, “মা শা আল্লাহ।”

এটা শোনামাত্র তারান্নুম কপাল কুঁচকে বলে, “এই বেটা, আপনি কে?”
ফারহান মুচকি হেসে বলে, “আমি আপনার ফিয়ন্সে, মিস গোবরচারিনী।”
এবার তারান্নুম রাগে আগুন হয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলে, “তুই গোবরচারিনী, তোর মা গোবরচারিনী, তোর বাপ গোবরচারিনী, তোর ১৪ গুষ্টি গোবরচারিনী। শালা, কে রে তুই? মাথায় একটা গাঁট্টা মারবো, সব বেরিয়ে যাবে। মশার বাচ্চা, মাছির বাচ্চা, ইঁদুরের বাচ্চা, পিঁপড়ার বাচ্চা।”
ফারহান জিভ কেটে বলে, “একটু শ্বাস নিন। আর আপনি গ্রামীণ মেয়ে তাই গোবরচারিনী বলেছি। ডোন্ট মাইন্ড, বেবি।”
তারান্নুম কিঞ্চিৎ হা করে বলে, “কুত্তে কি ওলাদ! বেবি? তাই না? আমারে দেইখা কি তোর বাচ্চা মনে হয়? আম্মাআআ, এই বেটারে আমি মুরগির খোপের মধ্যে আটকাইয়া রাখুম,” বলে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে তারান্নুমের এমন বাচ্চাসুলভ স্বভাব দেখে ফারহান মনে মনে দারুণ খুশি হয়ে হাসতে থাকে।
ফারহান ঠোঁট কামড়ে বলে, “কেয়াবাত, কেয়াবাত, কেয়াবাত! এতো মেঘ না চাইতেই জল। এমন মেয়েকেই তো খুঁজছিলাম।”

বিকেলের শহরের পার্কে প্রশান্তিময় পরিবেশে কিছু আচার বিক্রির ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকে। যেখানে সাজানো থাকে আম, জলপাই, তেঁতুল, আমড়াসহ নানা ধরনের আচার। এই স্বাদের টানে স্নেহা আর ইলিজাও এসে গোগ্রাসে আচার খেতে থাকে।
অন্যদিকে পার্কের এক কোণে কিছুটা দূরে কাব্য কারো আসার অপেক্ষায় একা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু সময় পর শুভ্র গাড়ি নিয়ে এসে থামলো। শুভ্র হেসে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। পরনে কালো শার্ট, প্যান্ট ও কোট। পায়ে কালো সুজ আর হাতে ঝলমলে একটা কালো ঘড়ি।

কাব্য তাকে দেখেই বলে, “কি মামা, কার শোক দিবস পালন করতে আইছোস?”
শুভ্র হেসে বলে, “হালারফো, আগে ক কেমন লাগছে?”
“মাইয়া হইলে প্রশংসা করা যাইতো। পোলা তো, কিছু কইলাম না। কিন্তু কাহিনি কি?”
শুভ্র কিছু উত্তর না দিয়ে গাড়ি থেকে লাল সাদা মিশ্রণে একখানা গোলাপের তোড়া, সাথে একটা আইফোন বের করে।
এবার কাব্য অবাক হয়ে বলে, “এগুলো কার জন্য, ভাই?”
“সামনে আয়।”
দুজন হেঁটে সামনে এগোতে থাকে। কাব্য বিস্মিত হয়ে বলে, “আগে বল, কই যাচ্ছি আর কার জন্য?”
শুভ্র মৃদু হেসে বলে, “ইলিজার লাইগা, অরে আইজগো প্রোপোজ করমু।”
কথাটা কর্ণগোচর করে কাব্যের মুখটা মুহূর্তেই পানছে হয়ে যায়। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গিয়ে সে বলে, “শোন না, আমার না কাজ আছে। তুই যা, প্রোপোজ কর। আমি গেলাম,” বলে পিছনে ফিরতেই শুভ্র বলে উঠে,
“আরে, দাঁড়া দাঁড়া। কোথায় যাচ্ছিস? আজকে কোনো এক্সকিউজ দিয়া লাভ নাই। তুই ছাড়া আমি প্রোপোজাল দিতে পারবো না।”

কাব্য শুভ্রের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আপনমনে বলে, “তাহলে দিস না, ভাই। (আওয়াজ তুলে) আজকে আমি কোনোভাবেই যেতে পারবো না। আর তুই কীভাবে জানলি মিস ইলি এখানে থাকবে?”
“আমি জানি, প্রতি শুক্রবার ওরা এখানে ঘুরতে আসে।”
“তুই ওকে ফলো করিস?”
“শোন মামা, প্রেমে পড়লে বুঝবি। ঢং বাদ দে, চল এখন।”
তবে কাব্য কোনোভাবেই যেতে চায় না। শুভ্র শেষে একপ্রকার জোর করেই তাকে টেনে নিয়ে চলল। কিছুক্ষণ পর পার্কে পৌঁছাতেই ইলিজাকে দেখে কাব্যের চোখে খুশির ঝলক ঝিলমিল করে ওঠে। কিন্তু মুহূর্তেই তার মুখে কষ্টের ছায়া পড়ে। কারণ আজই ইলিজার সঙ্গে তার শেষ দেখা, এখন থেকে ইলিজা অন্য কারো হবে।

কাব্য মলিন হেসে আপনমনে বলে, “একতরফা ভালোবাসা এতটা বেদনাদায়ক কেন, মিস ইলি? চাইলেও কাছে টেনে নিতে পারি না, আবার ভালো না বেসে থাকাও অসম্ভব। একদিকে ভাঙা নদীর স্রোত, অন্যদিকে নির্মিত নদীর পাড়। আর আমি মাঝখানে প্রবাহের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি। অথচ আপনি আমাকে দেখতেই পাচ্ছেন না।”
শ্বাস টেনে পুনরায় বলে, “ও ইলিজা, আপনি কি আমার মনের ব্যথা বুঝতে পারছেন না?”
এদিকে শুভ্র হেসে ইলিজাকে সম্বোধন করে বলে, “মিস ক্যালিস্তা।”

Tell me who I am part 28

ইলিজা আর স্নেহা দুজনই একসাথে পিছন মুড়ে তাকালো। স্নেহা তো শুভ্রকে দেখেই খুশিতে হেসে খুন।
কিন্তু তার খুশি ভেঙে দিয়ে শুভ্র হাঁটু মুড়ে, পকেট থেকে রিং বক্স খুলে বলল, “I want you with me for every step of this journey called life. From the moment I first saw you, I knew my heart belonged to you. Will you make my world complete by being mine forever?”
(অনুবাদ: “আমি চাই তুমি আমার জীবনের প্রতিটি ধাপে আমার সাথে থাকো। প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম, আমার হৃদয় তোমার জন্য। তুমি কি আমার পৃথিবী পূর্ণ করবে, সারাজীবনের জন্য আমার সঙ্গী হয়ে?”)

Tell me who I am part 30