Tell me who I am part 33
আয়সা ইসলাম মনি
তারান্নুম ভয়ে মাথা নীচু করে কেবল সম্মতি জানালো। ওর চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। কারান তীব্র রাগের ছায়া মুখে এনে সবার উদ্দেশ্যে বলল, “যথেষ্ট হয়েছে, আর শপিং করার প্রয়োজন নেই। এবার চলো সবাই।”
সবাই সামনে এগিয়ে গেল, কিন্তু মিরা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। কারানের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে মনে মনে শুধালো, “এত রাগ কেন তোমার, কারান? এত অগাধ রাগ! জানি না কেন, কিন্তু তোমাকে এত ক্রুদ্ধ দেখলে আমার ভীষণ ভয় হয়।”
ওদিকে কারান পা বাড়াতে গিয়ে পিছনে মিরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আপনাকে কি আলাদা করে বলতে হবে?”
কথা শেষ করেই মিরার কাছে এসে তার হাত ধরে জোরে টেনে নিয়ে চলল।
বাসায় ফিরেই কারান বিছানায় বসে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মুখে চিন্তার রেখা গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। মিরা ধীরে ধীরে এসে কারানের পাশে বসে পড়ে। কারানের দিকে চেয়ে কোমল স্বরে বলল, “তুমি সবসময় এমন কি ভাবো, কারান? আমাকে কি বলা যায় না? আমি কি এতটাই অজ্ঞ?”
কারান সামান্য মাথা নেড়ে মিরার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, “অজ্ঞতার কথা নয়, মিরা। আমি কেবল চাই না, তুমি দুশ্চিন্তার ভারে জর্জরিত হও।”
সে দৃষ্টি নামিয়ে আবারও গভীর ভাবনার জগতে ডুবে গেল। নিজ মনে বলতে শুরু করল, “সবকিছু এত অগোছালো আর অস্থির কেন মনে হয়? আমি তো নিজেকে সেই অন্ধকার অধ্যায় থেকে সরিয়ে এনেছি, তবুও কেন এর ছায়া আমাকে ঘিরে রেখেছে? আর কত প্রাণ কাড়বে তুমি, কারান? তোমার হাতে কি শুধুই র*ক্তের ইতিহাস লেখা?”
একটা তীব্র তাচ্ছিল্যের হাসি তার ঠোঁটে ভেসে উঠল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিকে কারানের এমন বিমর্ষ আর ক্লান্ত চেহারা দেখে মিরার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। মিরা নিরুত্তর উঠে যেতে চাইতেই, কারান হঠাৎ তার হাত ধরে টেনে মিরাকে কোলে বসিয়ে দিল। মিরার গলায় দুই হাত পেঁচিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, “আমি তোমার কাছে একটা কিছু চাইব, দিবে?”
মিরা হেসে বলল, “শুধু একবার চেয়ে দেখো, তোমার জন্য সব দিতে প্রস্তুত, কারান।”
মিরার এই অকপট উক্তি শুনে কারানের চোখে একধরনের আলো ঝিলমিল করে উঠল। গভীর ভালোবাসার আবেশে মিরাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যদি তোমার প্রাণ চাই?”
মিরা মিষ্টি হেসে বলল, “তোমার হাতে যদি আমার মৃ*ত্যু ঘটত, তবে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মনে করতাম। তোমার ভালোবাসার স্পর্শে আমি মুছে যেতে চাই। তোমার দহনজ্বালায় পুড়ে ছাই হয়ে তোমার সত্তায় মিশে যেতে চাই। আমি শুধু তোমার হতে চাই, কারান চৌধুরি।”
মিরার এই গভীর আর আবেগঘন কথাগুলো শুনে, কারান আর কোনো চিন্তা-ভাবনা না করে মিরার ঠোঁট নিজের করে নিতে শুরু করল। মিরাও কারানের ঘাড় জড়িয়ে ধরল। তাদের চুম্বনের গভীরতায়, তারা দুজনেই অনন্ত ভালোবাসার জগতে প্রবেশ করল।
রাতের অন্ধকারে, ২টা বেজে ২২ মিনিট। চারপাশ নিস্তব্ধ, সবাই গভীর নিদ্রায় লীন। মিরাও কারানকে আঁকড়ে ধরে পরম সুখের ঘুমে হারিয়ে গেছে। তবে কারান মিরার পাশে শুয়ে থাকলেও, বাস্তবে তার চোখ অনেক আগে থেকেই খোলা শুধু মিরার দিকেই স্থির। এরপর কারান হেসে নিজেকে উজ্জীবিত করে আপনমনে বলে, “যদি কেউ সৌন্দর্যের আধ্যাত্মিক মাপজোখ জানতে চায়, আমি তাকে মিরার রূপের দিকে নির্দেশ করব, তবে যদি সে নারী হয়। আর পুরুষদের মধ্যে শুধুমাত্র আবরার কারান চৌধুরীই আপনার সৌন্দর্যের মহিমার সামনে হারিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখে, বেগম সাহেবা।”
পরে মিরার কপালে এক গভীর চুম্বন রেখে তার হৃদয়ে মধুর প্রশান্তি অনুভব করে।
এরপর উঠে টেবিলে রাখা একটি রাবার ব্যান্ড হাতে নিয়ে, নিজের সমস্ত চুল টেনে পেছনে বাঁধল। কারান তার ব্যাগ থেকে ট্রেসিং পেপার, পেন্সিল, রাবার এবং ল্যাপটপ বের করে পাশের কক্ষে প্রবেশ করল। দরজার কাছে এসে একবার গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন মিরার দিকে এক পলক তাকাল। স্ত্রীর শান্ত মুখাবয়ব দেখে তার ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির ইঙ্গিত ফুটে উঠল। পরে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে নিজের কাজে মনোযোগী হলো।
কারান ডেস্কে বসে ল্যাপটপ খুলল। তার চোখে তখন গ্রামের রহস্যকে আলোকিত করার অদম্য সংকল্প। ল্যাপটপের GIS সফটওয়্যারে স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহীত ডেটার সঠিক বিন্যাস শুরু করল। LiDAR প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ভূমির বৈশিষ্ট্য, উচ্চতা, সীমানা এবং গ্রামবাসীদের চলাচলের সূক্ষ্ম কৌশল বিশ্লেষণ করল সে। সকালে ড্রোনের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলোকে জিপিএস পয়েন্টের সঙ্গে সংযুক্ত করে, গ্রামটির ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল।
ট্রেসিং পেপারটি টেবিলে বিছিয়ে, কনটুর লাইনগুলোর সঠিক রেখা আঁকতে শুরু করল। পরে পেন্সিলটি তার তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলের মাঝে ঘোরাতে ঘোরাতে, মনে মনে পরিকল্পনার বীজ বুনতে থাকল। গ্রামের প্রতিটি কোণ তার আঁকার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠল।
এই মানচিত্র শুধু কাগজের রেখা নয় বরং অঙ্গ পাচারকারীদের গোপন আস্তানা, নিষিদ্ধ পথ কিংবা সন্দেহজনক কার্যকলাপকে প্রকাশ করার জন্য অপ্রতিরোধ্য হাতিয়ার। কারান এক সময় চিত্রটি উপরে তুলে গম্ভীর মুখে বলল, “ওরা যদি এই গ্রামেই থাকে, তবে ওদের খুঁজে বের করা একেবারে কঠিন হবে না, আবার সহজও হবে না। তবে এই টপোগ্রাফিক ম্যাপিং অনেক কাজে লাগবে।”
প্রতিটি রেখা, প্রতিটি চিহ্ন তার অনুসন্ধানের পথে এক একটি নতুন দরজা খুলে দিল। একটুপর কারান একটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে ধরল। কিছুক্ষণ পর তা আঙুলের ফাঁকে রেখে নিজে নিজে বলল, “না, ঘরে বসে এটা খাওয়া যাবে না। আমার বেগমের নাকে এর ধোয়ার গন্ধ চলে যাবে।”
এ কথা ভেবে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। কিছুটা সময় পর সামনে হেঁটে গ্রামটির প্রান্তে এসে পৌঁছাল। পাহাড়ের কাছাকাছি প্রায় চলে এসেছে। সিগারেট শেষ হয়ে গেলে, সেটি ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু পর সামনে কিছু একটা দৃশ্য তার নজরে আসলো।
নয়নগোচর করে বলল, “ওগুলো কি?”
ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সামনে এগিয়ে গেল। কিছুটা এগোতেই, তার চোখে পড়ল কিছু মাথার খুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এটা দেখে তো কারানের চক্ষু চড়কগাছ। দ্রুত বসে খুলিগুলো হাতে তুলে নিল। গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আকারে যেহেতু খুব বড় নয়, তাহলে এগুলো বাচ্চাদেরই হওয়ার কথা। তার মানে… (একটু থেমে) তার মানে, মাদা*ফা*কা*গুলো ওদের মে*রে এখানে খুলিগুলো ছড়িয়ে গেছে। আচ্ছা, তাহলে প্রথমদিন যখন এলাম, তখন তো চোখে পড়ল না।”
এরপর আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। কারান দেখলো কিছু জন্তুর পায়ের ছাপ। আর সাথে পাশে একটা গর্ত। ব্যাপারটা কারান বুঝে কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “তার মানে শিয়াল বা কুকুর এগুলো গর্ত থেকে তুলে এনেছে।”
এবার পকেট থেকে একটি ফোল্ডেবল ব্যাগ বের করে, মাথার খুলিগুলো সযত্নে তাতে ভরে নিল।
“এগুলো এমেকাকে দিতে হবে। ও-ই বাকিটা জানাবে,” কারান গভীর মনোযোগের সঙ্গে বলল।
এরপর যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, হঠাৎ একটি কাটা হাত তার হাত চেপে ধরল। কারান মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল। হাতটি থেকে রক্তের ধারা অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে। প*চা, ক্ষ*তবিক্ষত সেই হাত তাকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। কারান তার মুখে কঠোরতা আর রাগের রেখা ফুটিয়ে বলল, “না, কারান। ভ্রম থেকে বের হও। এটা মিথ্যা, আমি জানি। কারান, উঠে দাঁড়াও। উফফ, এ হাত যেন আমাকে ছাড়ছেই না।”
কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। এরই মধ্যে এক ভয়াবহ আওয়াজ তার সমস্ত কান ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। শিশুদের ভয়ানক চিৎকারের প্রতিধ্বনি ক্রমশ তার মস্তিষ্কের গহীনে ঢুকতে লাগল। তার মাথাকে ধ্বংস করার জন্য নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করতে শুরু করল। কারান শেষমেশ উঠে দাঁড়িয়ে, প্রচণ্ড ক্রোধের আওয়াজে বলে, “নাআআআ! এই হ্যালুসিনেশন আমাকে শেষ করে দিবে।”
এরই মধ্যে কিছু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়। প্রতিটি চেহারা ভ*য়ংকর, যেন কোনো ভয়ের অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে। কারো চো*খ নেই, কারো ক*লিজা নেই, আবার কারো হৃ*ৎপিণ্ড কিংবা কিড*নি কিছুই নেই। তাদের প্রতিটি শরীর উন্মুক্ত, যেখানে জায়গায় জায়গায় কা*টা ছিঁ*ড়ার দাগ। এক এক করে তারা কারানকে ধরতে শুরু করে, তাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তাদের মুখ দিয়ে একরাশ আকুল চিৎকার বেরিয়ে আসে, “আমাদের বাঁচান, আমাদের বাঁচান!”
কারানের পৃথিবী একদম অন্ধকার হতে শুরু করে। এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবী তার মাথা ছিঁড়ে নিতে চায়। কেন কারানকে ওরা শান্তি দিচ্ছে না? কি চায় ওরা? মুক্তি? তাহলে কারানকে পা*গল কেন করে তুলছে? কারান চোখ বন্ধ করে বেদনার কাতরতায় চিৎকার করে বলে, “দূরে সরো তোমরা! প্লিজ… না! আমি.. আমি সহ্য করতে পারছি। প্লিজ.. দূ.. দূরে সরো।”
তখনই সামনে থাকা সব শিশুরা একে একে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর চিৎকারের শব্দটিও থেমে যায়। কারান তার চোখ মেলে আশপাশের দিকে তাকাল। কিন্তু সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার।
এবার কারান দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বাড়ির দিকে পা বাড়াতে লাগল। কিন্তু ঠিক তখনই এক ভয়াবহ চিৎকার আবার তাকে প্রকম্পিত করে তুলল। কারান রেগে বলে উঠে, “I will help you, but please don’t scream (চিৎকার).”
কিন্তু তাও চিৎকারের শব্দ থামার নামই নেয় না। কারান মাথা ঝাঁকাতে থাকে, চোখ কঠিনভাবে বন্ধ করে, মনোযোগ দিয়ে সেই অস্বাভাবিক, শোচনীয় শব্দগুলো শোনার চেষ্টা করে। কিছু সময় পর শব্দটি হঠাৎ করেই থেমে যায়। কারান চোখ খুলে, তবে তার আশপাশে আবার সেই ভীতিকর চিৎকার শুরু হয়। এবার কারান স্থির হয়ে শান্ত গলায় বলে, “নাহ… এটা… এটা আমার ভ্রম হতে পারে না।”
তারপর চিৎকারের ধ্বনি অনুসরণ করতে করতে দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যায়।
ক্ষণকাল পর তার সামনে এমন একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে, যা দেখে তার চোখ বিস্ময়ে আকুত হয়ে যায়। সামনে এক অদ্ভুত গন্ডারের মতো দেখতে পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখে কাপড় পেঁচানো, হাতে লোহার ধারালো নখ। লোকটি ছোট একটি শিশুর বু*কের মধ্যে তার নখ ঢুকিয়ে যকৃৎটি বের করে আনে। বাচ্চাটির বুক থেকে র*ক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে। সে এক অর্গান প্রিজারভেশন কন্টেইনারে যকৃৎটি রেখে দেয়। তারপর ভয়ঙ্করভাবে ছেলেটার হৃৎপিণ্ডটি বের করে আনতে থাকে। হৃদপিণ্ডটি আনার পর তার হাতে হৃদপিণ্ডটি সংকুচিত ও প্রসারিত হতে থাকে। বাচ্চাটি নিচে চিৎকার করতে করতে গড়াচ্ছে, তার চোখ আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে। কারান রাগে গর্জে ওঠে, “এইইই শু*য়ারের বাচ্চা!” বলে তৎক্ষণাৎ দৌড় দিল।
এদিকে লোকটি কারানকে দেখে কন্টেইনারটি নিয়ে দ্রুত পালাতে শুরু করে। কারান দ্রুত শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়। উরুর উপরে মাথা শুইয়ে কাঁপতে কাঁপতে শিশুর মুখে তাকিয়ে বলে, “হেই… তোমার কিছু হবে না, বেবি… প্লিজ কথা বলো…”
তারপর শ্বাস টেনে হাঁসফাঁস করতে করতে চিৎকার করে বলে, “এই উঠো… উঠছো না কেন? প্লিজ, উঠো বেবি! আমি আছি, হেই…”
ক্ষণকাল পর কারান তার হাতের পালস চেক করে বুঝতে পারে, শিশুটি আর বেঁচে নেই। নিশ্বাসও থেমে গেছে, শরীরের মধ্যে কোনো সাড়া নেই। কিছু সময়ের জন্য কারানের সমস্ত শরীর কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন আর অপেক্ষা করার সময় নেই। ভয়াবহ এক গন্তব্য তার সামনে। এক ঝটকায় উঠে কারান দ্রুত দৌড় শুরু করে। তার চোখে অদম্য প্রতিজ্ঞা, বুকের ভেতর অদৃশ্য আগুন।
কিন্তু কিছু সময় খোঁজাখুঁজির পর, লোকটিকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। হঠাৎ কারানের মনে পড়ে যায় আজকের সেই মানচিত্রের কথা। চোখ বন্ধ করে মানচিত্রটি মনে করে। এরপর মানচিত্র অনুযায়ী কিছু দূর যাওয়ার পর মুহূর্তে, তার চোখে দুইটি রাস্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই দুটি পথ দিয়েই ওই দানবটি পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কারান জানে ভুল পথে গেলে, সে কখনোই পাবে না তাকে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মুহূর্তে ফোনের আলোতে কারান লক্ষ্য করে রক্তের কিছু ফোঁটা মাটিতে পড়ে আছে। সেই পথেই সে এবার পা বাড়ায়।
কারান কঠিন স্বরে বলে, “একবার শুধু কারান চৌধুরীর হাতে পড় জা*নোয়ার। মৃ*ত্যুর আগ পর্যন্ত শুধু আমার নামটাই জপ করতে থাকবি।”
তবে সে জানে, এই দানব অন্ধকারের চেয়েও অন্ধকার। কিন্তু কারান এই অন্ধকারে ডুব দিতে প্রস্তুত। তাই র*ক্তাক্ত চোখে আগাতে থাকে।
কিন্তু এই সরল পথ দিয়ে লোকটাকে ধরা সম্ভব নয়। তাই সে পাহাড়ের গা বেয়ে বাঁকানো পথে চলতে শুরু করে। বেশ অনেকটা সময় পর, হঠাৎ করেই কারান লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কারানের ভয়ানক চেহারা দেখে লোকটি বুঝতে পারে আর কোনো পথ নেই তার কাছে। তাই সে নিজের অঙ্গভঙ্গিতে আক্রমণ করতে শুরু করে। তার ধারালো ন*খ দিয়ে কারানকে আ*ঘাত করতে চায়।
কারান হাতের মাধ্যমে আ*ঘাত এড়ায়। কারানের হাতে আজ কুঠারটা থাকলে হয়ত এই যুদ্ধের পরিণতি একেবারেই অন্যরকম হতো। কিন্তু তাও যে তীব্রতা ও দৃঢ়তা নিয়ে সে লড়াই করছে, তাতে এই র*ক্তপিপাসু পিশাচটি বুঝতে পারে, সে এক খাঁটি যোদ্ধার মোকাবিলা করছে। এরমধ্যেই শত্রু যখন তার বুক বরাবর ন*খগুলো দিয়ে হৃৎপিণ্ড বের করার চেষ্টা করে, তখন কারান তার হাত শক্ত করে ধরে ফেলে।
তবুও লোকটি হিংস্র চোখে কারানের বুকে আক্রমণ চালাতে থাকে। কারানের সাদা শার্ট ছিঁড়ে যায়, শরীরের বাম পাশের অংশ র*ক্তে ভিজে যায়। কিন্তু কারান এক ঝটকায় লোকটাকে ঘুরিয়ে দিয়ে, তার উরু বরাবর এমন এক জোরালো কিক মারে যে লোকটির উরু ভে*ঙে যায়। লোকটি সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে বসে ছ*টফট করতে থাকে।
এখন কারান আর থেমে থাকে না। সে দ্রুততার সাথে লোকটির বুকে আরো একাধিক শক্তিশালী লাথি মারে। সেই লাথি যতই চলে, ততই লোকটির শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভেঙে পড়তে থাকে। শ্বাস নেওয়ারও সুযোগ পায় না।
এরপর কারান বসে লোকটির আঙুল থেকে একটি লোহার নখ খুলে এনে সুঁচের মতো ওর চোখের গভীরে প্রবাহিত করল। মুহূর্তেই রক্তের ফোটা ছিটকে উঠল। কারানের ভারী গলায় শীতল ও ভয়ংকর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “বল তোকে কে পাঠিয়েছে? এসবের মাস্টারমাইন্ড কে?”
কারানের ভয়ংকর গলার আওয়াজে লোকটি শরীর থেকে সাহস হারিয়ে ফেলল। কাঁপতে কাঁপতে সে কোনো উত্তর দিতে পারল না। কারান এরপর নখটি চোখের আরও গভীরে প্রবাহিত করল, আর তা সরাসরি ওর মস্তিষ্কের কোষে আঘা*ত হানে। মুহূর্তের মধ্যে সে নখটি বের করে এনে, ওর গলার গভীরে প্রবাহিত করল। গলার ফিনকি থেকে অঝোরে র*ক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তারপর তার বুকের ওপর হাঁটু চেপে ধরে গম্ভীরভাবে বলল, “আর একবার তোকে সুযোগ দিব। এরপর তোকে আমার টর্চারের মুখে পড়তে হবে। কে পাঠিয়েছে তোকে?”
কারানের এমন নির্মম দৃষ্টি দেখে লোকটি বুঝে গেল, আর পালানোর কোনো পথ নেই, কারান সত্যিটা বের করেই ছাড়বে। তাই নিজের গলায় থাকা ন*খটি সে নিজেই পোচ দিয়ে দিল। গরগর শব্দে তার গলার ষড়যন্ত্র কেটে গেল। তার জীবনের শেষ মুহূর্ত ভলভলিয়ে র*ক্তে ভেসে উঠল। তবে এমন একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটাবে, তা কখনোই ভাবেনি কারান। কারান দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল, “এই না, না তোকে বলতে হবে। এই, ফা*কিং হো*র.. না…”
লোকটাকে ঝাঁকাতে থাকল সে। কিন্তু লোকটা তখনো বাঁকা হাসছে। তার মুখের প্রতিটি রেখা বলতে চাইছে, সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
যখন কারান অনুভব করল মৃ*ত্যু তার খুব কাছে চলে এসেছে, তখনই কারানের ঠোঁটে লুকানো ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। কণ্ঠে ভয়াবহ ধ্বনি নিয়ে বলে, “ওকে, তোকে আমি মৃ*ত্যুই উপহার দিচ্ছি।”
ধারালো দীর্ঘ নখটি লোকটার গলা থেকে শুরু করে সোজা পুরু*ষা* পর্যন্ত মর্মান্তিকভাবে ছিঁ*ড়ে ফেলে। র*ক্ত দ্রুত গড়িয়ে তার দেহের দুপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
মাঝখানের কাটা এত গভীর যে লাল র*ক্তমাংস হা করে থাকে। কারানের হাত সেই ফাটলের মাঝে ঢুকে পড়ে, তার আঙুলগুলো শিকারি পাখির নখ*রের মতো মাংস আঁ*চড়ে ধরে। এরপর এক টানে চামড়া ছিঁ*ড়ে নিয়ে আসে হাতে। লোকটা তীব্র আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ে। তার কণ্ঠ ভাঙা বাঁশির মতো কেঁপে উঠে থেমে যায়।
কিন্তু কারানের চোখে কোনো করুণা নেই। সে লোকটির পা দুটো শক্ত করে ধরে লোকটার অন্ড*কো* টেনে ছিড়ে ফেলে।
“তোকে মুক্তি দিচ্ছি।”
গর্জে উঠে লোকটার পা দুটো দুই দিকে টান দেয়। সাথে সাথে মাংসের সঙ্গ ছিন্ন হয়, হাড় ভাঙার ঠাস ঠাস শব্দ বাতাসে ভেসে আসে। বুকের মাঝখান থেকে শরীরটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।
একদিকে পড়ে থাকে বুকের কিছু মাংস, একটি পা আর মাথাটি। অন্যদিকে পেট আর পু*ষা*ঙ্গের সঙ্গে ঝুলতে থাকে কেটে যাওয়া মাংসের র*ক্তাক্ত ভগ্নাংশ। এরপর কারান দুটো অংশ দুদিকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
পরবর্তীতে তার শরীরের সমস্ত রাগ, ক্রোধ, হতাশা ফেটে বেরিয়ে আসে। কারান হাঁপাতে হাঁপাতে আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে ওঠে, “আমি পারলাম না। আমি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারলাম না… আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করো… ওর মৃ*ত্যু সহ্য করার মতো শক্তি দাও। হে আল্লাহ…”
তার কণ্ঠে ভীষণ যন্ত্রণার সুর, তার গর্জন আকাশে মিশে গিয়ে পরিবেশ নিস্তব্ধ করে দেয়।
বাচ্চাটি কারানের সামনেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। এটা ভেবে অসহায়ভাবে কারান মাটিতে বসে পড়ল। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠল, বুকের ভেতর যেন কেউ ছুরি চালিয়ে গেছে। অস্থির কণ্ঠে নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে বলল, “কেন পারলাম না? কেন? এটা আমারই ব্যর্থতা। যদি আরেকটু আগে আসতে পারতাম… শালা, ফা*কিং বি*চ!”
কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে লোকটার মৃত দেহটির দিকে তাকিয়ে থাকার পর, নিজের ভেঙে পড়া মনকে ধমক দিয়ে কাজে ফিরে গেল। মৃ*ত লোকটির পকেট, কাপড়সহ শরীরের প্রতিটি কোণায় খুঁজতে শুরু করল। যেন তার হাত থেকে কোনো তথ্য ফসকে না যায়। কিন্তু হতাশা তাকে গ্রাস করতে লাগল, কিছুই পেল না। নিজের ভেতর জমে থাকা ক্রোধ আর হতাশা নিয়ন্ত্রণ করে নিজের সঙ্গেই ফিসফিসিয়ে বলল, “কিছু একটা থাকবে… অবশ্যই কিছু থাকবে। আবার খুঁজে দেখ, কারান। হাল ছাড়িস না।”
লোকটির শরীর থেকে যতটুকু কাপড় ছিল, সব সরিয়ে দিল সে। তারপর আবার তল্লাশি চালালো। অবশেষে তার চোখে পড়ল একটি অদ্ভুত চিহ্ন। লোকটির পিঠের রক্তমাখা চামড়ায় লেজারের আঁচড়ে পু*ড়িয়ে আঁকা হয়েছিল একটি লোগো। উপরে জমে থাকা রক্ত আর ধুলো সরিয়ে সেটি ভালো করে দেখতে শুরু করল কারান। বুঝতে পারল, পুরো চিহ্নটি প্রকাশ পেতে হলে চামড়ার উপরের স্তরটা তু*লে ফেলতে হবে।
চোখে ক্রোধ আর সংকল্পের ছাপ নিয়ে কারান হাতের ফোন বের করে সেই লোগোর ছবি তুলল। তারপর সাবধানে চামড়ার অংশটুকু ছিঁ*ড়ে তুলে নিল। চামড়ার ঠান্ডা, ভেজা টুকরো হাতে ধরে এগিয়ে গিয়ে আরেকবার বাচ্চা ছেলেটির দিকে ফিরে তাকাল। নিথর সেই দেহটি দেখে তার চোখ ভিজে এলো। কিন্তু তবুও শক্তি সঞ্চয় করল সে। কণ্ঠে বিষাদের সুর নিয়ে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো, বেবি। আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি।”
শিশুটির দেহটি সেই খুলির গর্তে রাখল। মাটি চাপা দিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিল।
এরপর খুলির ব্যাগ, কনটেইনার আর চামড়ার টুকরো নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো সে। পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে দ্রুত সবকিছু নির্ভুলভাবে রেখে দিল। এরপর পুকুরে গিয়ে গোসল সেরে শরীর থেকে র*ক্তের দাগ মুছে ফেলল।
টি-শার্ট পরিধান করে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বাড়িতে ফিরে র*ক্তমাখা শার্ট আর প্যান্ট ধুয়ে শুকাতে দিয়ে মানচিত্রসহ উদ্ধার করা জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখল। একদম নিঃশব্দে পাশের দরজাটা খুলতেই তার চোখ আটকে গেল মিরার দিকে।
সামনে মিরা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে কিছু একটা প্রশ্ন, তার চেহারায় গভীর কিছু জানার আকাঙ্ক্ষা। এদিকে কারান বিস্ময়ে হতবাক। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হলো, এই মুহূর্তে তার সমস্ত গোপন সত্য মিরার সামনে ন*গ্ন হয়ে গেছে। কারান ঢোক গিলে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে শান্ত গলায় বলল, “তুমি… তুমি ঘুমাওনি?”
মিরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কারানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারান চোখে-মুখে একবার হাত বুলিয়ে ঠান্ডা গলায় হেসে বলে,
“কখন উঠলে, সুইটহার্ট?”
“অনেকক্ষণ।”
কারান নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। মনের মধ্যে গুমরে ওঠা কষ্ট চেপে রাখার শীতল অভ্যস্ততায় মিরার দিকে তাকিয়ে আপনমনে বলে, “না, মিরা… তুমি এখন সবকিছু জানতে পারো না। এটা সঠিক সময় নয়।”
এবার মিরা স্বাভাবিক শীতলতা বজায় রেখে কারানের চোখে চোখ রেখে বলে, “কোথায় গিয়েছিলে? আর এইভাবে টাওয়াল পড়ে… বুঝলাম না।”
কারান তার বড় বড় চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, “গরম লাগছিল, তাই গোসলে গিয়েছিলাম। এখানে তো আর এসি নেই।”
মিরা এবার হেসে কারানের বুকে হাত রেখে সুপ্ত কষ্টের অশ্রু মুছে বলতে থাকে, “আর আমি এর মধ্যে কত কিছু ভেবে ফেলেছি জানো? কখন থেকে তোমাকে ডাকছি অথচ তোমার খবর নেই।”
এবার কারান নিশ্চিন্ত হয়ে হাসিমুখে মিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না, বেগম সাহেবা। তোমার দোয়া সবসময় আমার সঙ্গে রয়েছে।”
মিরার কপালে এক অভ্যস্ত, আদরণীয় চুমু খেয়ে নেয় সে। ক্ষণকাল পর মিরা তার স্বাভাবিক শীতলতায় ফিরে কারানকে আলতোভাবে ছাড়িয়ে বলে, “এবার ঘুমাতে চলুন, কারান সাহেব।”
এরপর কারান তোয়ালে বদলে প্যান্ট পরিধান করে। মিরার হাত মুঠোয় ধরে হেসে তাকে নিয়ে শুতে চলে যায়। মিরাকে জড়িয়ে ধরে কারান ঘুমিয়ে পড়ে। যেখানে সে শান্তির অমৃত মুহূর্তে ডুবে যায়। কিন্তু মিরা কিছুক্ষণ পরই চোখ মেলে কারানের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সন্দিহান ভাবনায় ভরা চোখে আপনমনে বলে, “কারান, তুমি কি এটাই, যেটা আমি দেখছি? কেন জানি, তোমাকে আমার সবার থেকে আলাদা মনে হয়।”
কারানের গালে আলতোভাবে চুমু খেয়ে আবার শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মলিন চেহারায় আপনমনে বলে, “কখনো বদলে যেও না কারান। জানো, আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। না, আর অপেক্ষা করাবো না তোমাকে।”
কারানকে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে কারানও ঘুমের মধ্যেই মিরাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
সকালে মিরা আর তারান্নুম গল্পে মেতে উঠে। তারান্নুম মুচকি হাসিতে বলে, “জানো ভাবি, ফয়সাইল্লার পোলা আমারে গোবরচারিনী বইলা ডাকে। এইটাই নাকি তার ভালোবাসার ডাক।”
এটা শুনে মিরা হাসি চেপে রাখতে চাইলেও, অমিত অনুকরণের মতো খিলখিল করে হাসি ফেটে পড়ে। তবে তারান্নুম তাচ্ছিল্যভরে মুখ উদাস করে বলে, “ধুর, তুমিও হাসতাছো।”
এবার মিরা হাসির ঝংকার থামিয়ে প্রশ্ন করে, “আর কিছু ডাকে না?”
তারান্নুম মুচকি হেসে বলে, “মাই কুইন ডাকে।”
বলতেই তারান্নুমের গাল বাল্বের মতো লাল হয়ে যায়। এদিকে মিরা তার গালের লাল ভাব দেখে, আরো লজ্জা দেওয়ার ইচ্ছায় কিছু বলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে কারানকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গলা উঁচিয়ে বলে, “ওই আসাদের ছেলে, এদিকে আয়!”
মিরার মুখে কথাটা শোনার পর, কারান আশেপাশে একবার চেয়ে তাকায়। মিরা চোখ কুঁচকে বললো, “এদিক-ওদিক কাকে খুঁজছিস? এখানে আসাদ, তোর ছাড়া আর কার বাবার নাম?”
যদিও কারানের মুখে ঠান্ডা ভাব, কিন্তু মনে মনে বলে, “কত বড় সাহস আমার বউয়ের! আমাকে তুই করে বলে, আবার আমার বাবার নাম ধরে ডাকে। মুডটা একটু ঠিক হোক, তারপর তোমাকে সামলাচ্ছি, সোনা।”
এবার সামনে এগিয়ে এসে মিরার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “বলুন!”
মিরা আর তারান্নুম দুজনেই মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। এদিকে কারান অগ্নি চোখে মিরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। এটা দেখে তারান্নুম দুটো কাশি দিয়ে বলে, “এহেম এহেম, আমি তাইলে গেলাম।”
সে বেরিয়ে যায়। তারান্নুম চলে যাওয়ার পর, কারান আস্তে করে দরজাটা আটকে দেয়। এরপর হিংস্র চোখে মিরার দিকে এগিয়ে যায়। মিরা পিছু হটে গিয়ে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে, “দেখো কারান, আমি কিন্তু মজা করে বলেছি। এত রাগের কি আছে, হ্যাঁ?”
কিন্তু কারান কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে এগিয়ে চলে। একসময় মিরা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর কারান তার দুপাশে হাত রেখে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়।
“আসাদের ছেলে, তাই না? আর কি যেন বলেছিলে… ওহ হ্যাঁ, এদিকে আয়…”
মিরা মাথা নীচু করে এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “স…সরি।”
মিরার এই অসহায় ভাব দেখে কারান মুচকি হাসতে থাকে। কিন্তু মিরা আবারও কারানের দিকে চোখ তুলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলে, “বলেছি ভালো করেছি, কি করবে তুমি?”
কারানের এখন মিরার সাথে তর্ক বির্তক করার মোটেও ইচ্ছে নেই। একে তো এত চিন্তা, তার উপর হাজার কাজ বাকি। তাই কোনো উত্তর না দিয়ে সামনে চলে যেতে শুরু করলে, মিরা পিছন থেকে হেসে বলে, “আমাদের হানিমুনে যাওয়া উচিত, কারান।”
এ কথা শুনে কারান অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকায়। মিরা চোখ নীচু করে, মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলে, “তুমি কি বলো?”
কারান ছুটে গিয়ে মিরার কাছে পৌঁছে উত্তেজিত হয়ে বলে, “আবার বলো? কি বললে..মানে, হানিমুন? তুমি শিওর?”
মিরা তার গলা জড়িয়ে ধরে হেসে শুধালো, “মালদ্বীপে যাই? কি বলো?”
কারান যদিও আনন্দিত হয়, তবে তার মনে কালকের ঘটনা হঠাৎ ভেসে ওঠে। কিন্তু মিরা যেহেতু প্রথমবার এমন কিছু বলেছে, তাই সে নিজেকে সামলে নিয়ে মিরাকে কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে, “রেডি হয়ে নাও, আজকেই যাব।”
মিরা বিস্মিত হয়ে কারানের ঠোঁটে চুম্বন দিয়ে বলে, “সত্যি?”
কারান স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
বিকেলের সূর্য অস্ত যেতে যেতে মিরা তার ব্যাগ গুছিয়ে নিল। তারপর গলা উঁচিয়ে বলল, “কারান, আজ কি পড়বো?”
কারান চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে স্বচ্ছ হাসি দিয়ে উত্তর দিল, “নিচে কিছু না পড়লেও সমস্যা নেই, উপরে বোরকা থাকলেই হবে।”
এ কথায় মিরা পাশের ঘর থেকে এসে কারানের দিকে নেতিয়ে পড়া দৃষ্টিতে তাকাল। কারান হাসিমুখে বলল, “হারি আপ, জান।”
মিরা এবার নিচে শাড়ি পরে উপরে বোরকা পরল। আর কারান নিজেকে শার্ট প্যান্টে সাজিয়ে, বরাবরের মতো ক্লাইভ ক্রিস্টিয়ান নাম্বার ওয়ান স্নিগ্ধ পারফিউমে সজ্জিত করল। তারপর হেসে মিরার হাত ধরে বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে মিরা ফাতিমার হাত ধরে বলল, “ফুফিজান, আসছি। দোয়া করবেন। আর পারলে এর মধ্যে দাদিজানকে সত্যিটা জানিয়ে দিবেন।”
ফাতিমা মলিন হেসে মিরাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল।
প্রাইভেট জেটের চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রার পর, মালদ্বীপের মালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের বিমান অবতরণ করল। প্লেন থেকে নামতেই, শীতল ও সতেজ হাওয়া তাদের অভ্যর্থনা জানালো। বিমানবন্দরের গেটে ‘সোনেভা জানি’র নির্দিষ্ট স্টাফরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটি প্ল্যাকার্ডে ‘Mr. & Mrs. Chowdhury’ নামটি লেখা।
মিরা আর কারান এগিয়ে যেতেই একজন স্টাফ কুর্নিশ করে সম্মান জানিয়ে বলে উঠল, “Saar, Ma’am, Aadhage Mihaaru Maldives ah. Miadhakun ves Furaathumah thaakuribaadhakameh. Dheemaak Fenihen meehun vanah VIP Lounge aa Service.”
(অর্থ: “স্যার, ম্যাম, স্বাগতম মালদ্বীপে। দয়া করে এই পথে আসুন। আমরা আপনাদের জন্য ভিআইপি লাউঞ্জ এবং সি-প্লেনের ব্যবস্থা করেছি।”)
কারান কিছুটা মুচকি হেসে বলল, “Ith’s okay. Ingilaai thaana huri busy nuvarun.”
(অর্থ: “ইটস ওকে। এতটা ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।”)
এদিকে মিরা এসবের কোনো অর্থই বুঝল না। আসলে তারা সবাই মালদ্বীপের ‘ধিবেহী’ ভাষায় কথা বলছিল। মিরা তার শালটি ঠিক করতে করতে, মুচকি হাসি দিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য অবলোকন করতে শুরু করল। পরিবেশের এত বিশালতা ও অপূর্বতা তার চোখের অঙ্গুলি ছুঁয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিচ্ছে।
তারা একটি বিলাসবহুল গলফ কার্টে চড়ে, অত্যন্ত আরামদায়কভাবে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালো। সোনালি আলোয় সিক্ত সেই লাউঞ্জ রাজকীয় অভ্যর্থনার জন্য সজ্জিত।
ভিআইপি লাউঞ্জটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় পরিপূর্ণ; নরম সাদা সোফা, টেবিলে তাজা ফল এবং ঠান্ডা পানীয় সাজানো। মিরার চোখ আটকে গেলো জানালার বাইরে নীল সমুদ্রের দিকে। এরপর একজন স্টাফ এসে বিনয়ের সাথে বলল, “Saar, VIP Seaplane faaraai raajjehen gadha, Miyaalu meehun ves Furaathumah.”
(অর্থ: “স্যার, ভিআইপি সি-প্লেন প্রস্তুত। আপনারা কি প্রস্তুত? দয়া করে জানান।”)
কারান হাত তুলে বলল, “উই আর রেডি। চলো, মিরা।”
মিরা জানালার পাশে বসে আকাশ থেকে দ্বীপগুলোর মোহময় দৃশ্য উপভোগ করছে। আর এদিকে কারান নিজেকে পুরোপুরি আরামের মধ্যে মেলে দিয়েছে। প্রায় ৪৫ মিনিটের যাত্রা শেষে তারা নুনু অ্যাটল-এ অবস্থিত ‘সোনেভা জানি’ রিসোর্টে পৌঁছাল।
রিসোর্টের পিয়ারে নামতেই বাটলারের একটি দল তাদের স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন বাটলার হালকা ধনুকের মতো কুর্নিশ করে বলল, “Welcome to Soneva Jani, Mr. & Mrs. Chowdhury. We are ready to take you to your villa. It is our responsibility to make every moment here special for you.”
(অর্থ: “স্বাগতম সোনেভা জানিতে, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরি। আমরা আপনাদের ভিলায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত। এখানে প্রতিটি মুহূর্ত আপনাদের জন্য বিশেষ করে তোলার দায়িত্ব আমাদের।”)
কারান মাথা নেড়ে হেসে বলল, “We have faith in you.”
বিলাসবহুল গলফ কার্টে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হলো রিসোর্টের সবচেয়ে নির্জন এবং প্রাইভেট ভিলায়। ভিলাটি একদম পানির উপর, চারপাশে নীল জলের স্বচ্ছতা, ব্যক্তিগত সুইমিং পুল, আর এক কোণে একটি ছোট স্লাইড যা সরাসরি সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত। ভিলায় ঢোকার সাথে সাথেই তাদের জন্য তাজা ফুল, একটি বিলাসবহুল ডাইনিং টেবিলে বিশেষ মালদ্বীপীয় খাবারের আয়োজন, এবং তাদের নাম লেখা একটি হাতের তৈরি চকোলেট কেক রাখা ছিল।
মিরা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল, “তারা আমাদের জন্য এত আয়োজন করেছে!”
কারান মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “আমার ধারণা, আমরা ভুল জায়গায় আসিনি।”
ততক্ষণে এক বাটলার বিনয়ের সাথে এগিয়ে এসে বলল, “If you need anything else, do not hesitate to let me know.”
এই সমস্ত বিলাসবহুল আয়োজন তাদের দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি মুহূর্তেই ভুলিয়ে দিল। মিরা ও কারান, দুজনেই নিজেদের ফ্রেশ করে, টেবিলে সাজানো সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহণ করে, পরে নিজেদের কক্ষে প্রবেশ করল। মিরা বোরকা খুলে, কারানের কাছে এসে বলল, “আমার নিজের চোখে বিশ্বাস হচ্ছে না, কারান। সব কিছু এতটা অপূর্ব।”
কারান মিরাকে কোমলভাবে টেনে শুইয়ে দিয়ে বলল, “এটা তো শুরু, জান। আপনি মিসেস কারান চৌধুরি, কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানির মালিকের স্ত্রী, এটা বুঝতে হবে।”
মিরা মৃদু হাসি দিয়ে, কারানের গালে একটি চুমু দিয়ে বলল, “সে তো হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।”
কারান মিরাকে কাছে টেনে নেশালো গলায় বলল, “Tonight will be unforgettable, Mira. It will be the best night of our lives, one you’ll cherish forever.”
(অনুবাদ: “আজকের রাতটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে, মিরা। এটা হবে আমাদের জীবনের সেরা রাত, এ রাত তুমি চিরদিন মনে রাখবে।”)
মিরার গালে লজ্জার রক্তিমা ছড়িয়ে পরে। মিরা কারানের বুকে মাথা রেখে স্নিগ্ধভাবে জড়িয়ে ধরে। কারানও মিরাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখে।
সন্ধ্যা বেলায় মিরা ও কারান গভীর আলাপে মগ্ন। কারান বিছানায় মিরার কোলে মাথা রেখে মিহি গলায় বলে, “মিরা, কালকে তোমাকে মালদ্বীপের কিছু অতুলনীয় স্থান দেখাবো। যেমন: গাথিফুশি, ফিহালহোলি, আর মিয়ধু অ্যাটল-এর বিস্ময়কর সামুদ্রিক জীবন। এই সব জায়গার নীল পানি, সূর্যাস্তের দৃশ্য আর পাথরের উপরে বিক্ষিপ্ত সাদা বালুকাবেলা, তোমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হবে। আর জানো, এই অ্যাটলে ডুবুরি দিয়ে স্নরকেলিং করলে তুমি খুঁজে পাবে নানা প্রজাতির রঙিন মাছ আর প্রবালদের অসীম সৌন্দর্য। একদিনে যদি এত কিছু দেখো, মনে হবে পুরো পৃথিবীটা তোমার হাতে বন্দি।”
মিরা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “একদিনে কেন দেখতে হবে, কারান? আমরা ধীরে ধীরে সময় নিয়ে দেখবো।”
কারান গভীর চিন্তা থেকে ফিরে এসে গম্ভীর মুখে বলে, “না, মিরা। এখান থেকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আমার হাতে সময় নেই, অনেক কাজ বাকি।”
মিরা স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে কারানের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
তারপর পানি খাওয়ার জন্য উঠতেই, কারান মিরার হাত ধরে এক হেঁচকা টান দেয়।
এই হঠাৎ টানে মিরার শাড়ির আঁচলে ঝটকা লেগে টেবিলে থাকা ফুলদানির টপটি ভেঙে যায়। আর তার মধ্যে রাখা জীবন্ত ফুলের পানি মিরার পুরো শাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। মিরা কারানের দিকে এগিয়ে এসে গোমড়া মুখে বলে, “এটা কি করলেন, কারান সাহেব?”
কারান মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “যাও, শাড়ি চেঞ্জ করে আসো।”
“কারান, ক্লান্ত লাগছে। আমি একেবারে গোসল করে আসি, বুঝলে।”
“আচ্ছা, যাও।”
মিরা হেসে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। কারান হেসে সুরেলা কণ্ঠে বলল, “কিন্তু মহারানি, আপনাকে যে আরো একবার গোসল করতে হবে।”
এরপর উঠে হোটেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদের কক্ষ বিশেষভাবে সাজিয়ে দিল। অর্থাৎ রাতের অন্ধকারে, মিরা কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তাকে অভ্যর্থনা জানাবে।
সোনালি আলোয় সজ্জিত কক্ষ, সাথে পাটি বিছানো বিছানায় সুগন্ধী ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা। মোমবাতির কোমল আলোয় সোনালি রেশমি পর্দা ঝুলছে, আর কক্ষের কোনায় কাচের গ্লাসে ঝলমলে তাজা ফুলের তোড়া রাখা। একটি শৌখিন টেবিলের উপর মিষ্টি, ফল ও পানীয় রাখা।
অপরদিকে মিরা গোসল শেষে বাথরুমে থাকতেই গলা উঁচিয়ে বলল, “কারান, আমার লাগেজ থেকে একটা ড্রেস বের করে দাও তো।”
কারান ঈষৎ হাসিতে, মিরার লাগেজ খুঁজতে লাগল। কিন্তু এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করেও পেল না। পরে ভ্রূ কু্ঁচকে বলল, “কোথায় রেখেছ, মিরা? পাচ্ছি না তো।”
“দেখো না, আছে তো।”
কারান আরও খুঁজলো, “পাচ্ছি না, সোনা।”
Tell me who I am part 32
এবার মিরার মনে পড়লো; বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে লাগেজটা ভুলে রেখে এসেছে। মিরা কপাল চাপড়ে বলে, “ধুরো! কারান, ভুলে এয়ারপোর্টেই রেখে এসেছি। এবার কি হবে?”
কারান হেসে বলে, “কি আর হবে? তোমাকে এখন আমার সামনে ওভাবেই আসতে হবে।”
মিরা কপাল কুঁচকে বলল, “মজা করো না তো। একটা ড্রেস আনার ব্যবস্থা করে দাও না।”