Tell me who I am part 34 (2)
আয়সা ইসলাম মনি
পরদিন সন্ধ্যায় তিনজনেই নিজেদের সাজপোশাকে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
কারানের পরনে ছিল নিখুঁত কাটের স্লিক ডার্ক ব্লু স্যুট; ভেতরে প্রেশারাইজড সাদা শার্ট, আর গলায় গাঁথা ছিল গভীর কালো টাই। চকচকে অক্সফোর্ড জুতোয় প্রতিফলিত হচ্ছিল তার সূক্ষ্ম রুচিবোধ, আর কব্জিতে বাঁধা বিলাসবহুল ব্র্যান্ডেড ঘড়ির ঔজ্জ্বল্যে তার আভিজাত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
ফারহানের পোশাকে ছিল অনায়াস গাম্ভীর্য। প্যাস্টেল শেডের স্লিম-ফিট শার্টের উপর পরা হালকা ধূসর ব্লেজার, আর তার সঙ্গে পরিপাটি নেভি ব্লু ট্রাউজার। পায়ে ছিল ছিমছাম এলিগেন্ট জুতো, আর কব্জিতে শোভা পাচ্ছিল ধূসর প্রলেপে মোড়া সিলভার রিস্টওয়াচ, যা তার আত্মস্থ পেশাদারিত্বকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
আয়লার পরনে ছিল সাদা শার্ট ও কাঠামোগত কালো শর্টস, যার উপর কাঁধে ছড়ানো ছিল এক নিঁখুত ফিটিংয়ের স্মার্ট ব্ল্যাক কোট। গলায় আলতো করে জড়ানো ছিল এক টুকরো রেশমি স্কার্ফ। তার কালো হিলের কষাঘাতপূর্ণ শব্দে তার আত্মপ্রত্যয়কে আরও দৃঢ় করে তুলছে।
তিনজনই আলাদা গাড়িতে রওনা হলো। গন্তব্য দুবাইয়ের এক অভিজাত পার্টি রেস্টুরেন্ট। সেখানে পৌঁছাতেই ইব্রাহিম বিন জায়েদ নিজে এগিয়ে এসে কারানের সাথে করমর্দন করে হাসিমুখে বললেন, “ওয়েলকাম, মিস্টার কারান। আমরা আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম। ভিতরে চলুন।”
কারান মৃদু হেসে এগিয়ে গেল। হাতের ইশারায় আয়লা আর ফারহানকে পিছু নিতে বলল।
রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করার পর মুহূর্তেই তাদের চোখে ধরা পড়ল অন্য রকম এক পরিবেশ। চারপাশে ঝলমলে সোনালি-রূপালি আলোয় গোটা স্থানটা জ্বলে উঠেছে। তারাগুলো যেন নেমে এসেছে ছাদে ঝোলানো ঝাড়বাতিগুলোয়। দেয়ালজুড়ে সুক্ষ্ম আর্টওয়ার্ক, টেবিলগুলোতে রাখা মোমবাতির আলো হালকা নিভু নিভু করে জ্বলছে, আর তার পাশে ফুলের টব থেকে ছড়িয়ে পড়ছে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ। কোণের দিকে একটি ছোট মঞ্চে কেউ ভায়োলিন বাজাচ্ছে।
অতিথিরা নানা রঙের রুচিশীল পোশাকে সেজে প্রাণবন্ত আলাপে মেতে উঠেছে। কেউ হালকা হাসিতে মুখর, কেউ বা আবার চোখের ভাষায় অনুভূতি প্রকাশ করছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফারহান ধীরপায়ে কারানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “আমরা তো ভাবলাম বিজনেস মিটিং হবে। কিন্তু এখানে তো পুরো রাজকীয় পার্টির আমেজ।”
কারান চুপচাপ চারপাশের পরিবেশ এক নজরে জরিপ করল। কিছুক্ষণ পর ইব্রাহিম বিন জায়েদ এক মহিলাকে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল, “এই হলো আমার স্ত্রী, মিসেস আমিরা নূর।”
আমিরা নূর হালকা কণ্ঠে সালাম জানালেন। কিন্তু তাকে দেখে ওদের মনে অদ্ভুত সন্দেহের দোলা লাগল। ইব্রাহিমের বয়সের তুলনায় আমিরা তার অর্ধেক। বলতে গেলে, এক যুবতী। কিঞ্চিৎ হাসি ধরে আমিরা বলল, “আসসালামু আলাইকুম। আপনার কথা অনেক শুনেছি।”
কারানও বিনম্র হাসিতে উত্তর দিল, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনাকে দেখে ভালো লাগল।”
এদিকে আয়লার চোখ আমিরার দিকে আটকে গেল। বয়স হয়ত ২০ কিংবা ২২ এর বেশি নয়। তবে তার চেহারায় এমন মাধুর্য রয়েছে যে অবলোকনের দাবি রাখে।
এরপর কারানকে ইব্রাহিম আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ অতিথির কাছে নিয়ে গেল। সেখানে তাদের ব্যবসায়িক আলোচনা শুরু হলো। ইব্রাহিম, কারান এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীরা কথোপকথন এগোল।
ওদিকে ফারহান চুপ থাকতে পারল না। আয়লার দিকে ফিরে গোপন স্বরে বলল, “এই মেয়ে ওই বুড়ার বউ হলো কীভাবে, ইয়ার?”
আয়লা তীক্ষ্ণ হাসল। তার চোখে চটুল বুদ্ধির ঝলক খেলা করল। সে বলল, “তোমার ডিকশনারিতে জ্ঞানের ভাণ্ডার বড়ই সীমিত। এটাকেই তো বলে সুগার ড্যাডি। কেন? তোমার কি একেও মনে ধরেছে?”
ফারহান হেসে বলল, “আমার কুইনের কাছে এই বান্দি নিছকই একটা সাধারণ মেয়ে।”
তারপর চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে বলল, “এই আয়লা, ওই কাইল্লা কই? মানে ওই এমেকা?”
আয়লা একটু উদাসীন ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “আমি কি জানি? কারানকে জিজ্ঞেস করো। তবে আমি তো অন্য প্ল্যানে আছি।”
ফারহানের দিকে শ”য়তানি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল সে। ফারহান আয়লার মতলব খানিকটা হলেও আন্দাজ করতে পারল।
অন্যদিকে কারান হাসিমুখে ব্যবসায়িক আলোচনায় তৎপর। সে নিখুঁত আত্মবিশ্বাসে বলল, “হ্যাঁ, অবশ্যই। এটা নিশ্চিত হলে দু’পক্ষই লাভবান হবে।”
এরপর ইব্রাহিম কারানকে নিয়ে আরেক পাশে গেলেন, এবং তার শ্যালক ইলিয়াস জেহেরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন।
ইলিয়াস জেহের মৃদু হাসিতে বলল, “মিস্টার কারান চৌধুরি, ভাবিনি সামনে থেকে আপনাকে কখনো দেখতে পারব।”
কারান হাসিমুখে লোকটাকে পরখ করল। বয়সে তার থেকে বড়জোর পাঁচ বছরের বড় হবে, কিন্তু তার চেহারার গম্ভীরতা এবং হাসির বিশ্রী ভঙ্গি যে কারো অস্বস্তি বাড়াতে বাধ্য। তবে কারান চোখে চোখ রেখেই কথায় নামল, “ইলিয়াস জেহের মানে ‘IJ’?”
জেহের আড় হেসে বলল, “হ্যাঁ, এটাই আমার শর্ট ফর্ম।”
কারান একই ভঙ্গিতে হাসল এবং গভীর কণ্ঠে বলল, “আপনার সাথে আবার দেখা হবে।”
কারানের এই কথায় জেহের মুহূর্তেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তবে কারানের চোখে ছিল অদ্ভুত ঠান্ডা আত্মবিশ্বাস। কিছুক্ষণ পর তারা সফট ড্রিংক হাতে তুলে চিয়ার্স করল।
একটুপর পার্টিতে সফট মিউজিক শুরু হতেই অতিথিরা নাচের তালে তাল মেলাতে শুরু করল। কিন্তু কারান, ফারহান এবং আয়লা একটু দূরে একত্রিত হয়ে দাঁড়াল। কারান গম্ভীর মুখে বলল, “এভাবে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না, ওরা সন্দেহ করবে। ফারহান, আমিরা নূরের দায়িত্ব তোকে দিলাম। মানে ওকে পটাতে হবে।”
কারানের কথা শুনে ফারহান কাশি দিয়ে দ্রুত বলল, “আসতাগফিরুল্লাহ! আমি আমার গোবরচারিণীর সঙ্গে এমনটা করতে পারব না। আমি লয়াল ,ভাই।”
ফারহানের এমন নেকামি কথা শুনে কারান এবার সরাসরি তার চোখে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “তুই তাহলে ভা”র্জিন?”
ফারহান একেবারে হকচকিয়ে গেল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “মানে, ভাই! এমন না। আসলে… আমার থেকে তোকে দেখলে ওই মেয়ে আগে আগে গলবে।”
কারান হেসে ফারহানের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমার বউ জানলে আমাকে মা”র্ডার করবে। তাই কাজে লেগে পর, ব্রো।”
এবার ফারহান উপায় না দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নাচের ফ্লোরে গেল। কিছুক্ষণ পর সেখানে কিছু মেয়ে ফারহানের সঙ্গে নাচের তালে তাল মেলাতে শুরু করল। অথচ ফারহান এসব পরিস্থিতিতে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। অন্যদিকে নূর তীক্ষ্ণ নজরে ফারহানের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছিল।
এদিকে আয়লা চুপিচুপি কারানের কাছে এসে বলল, “তোমাকে একটা পারসোনাল প্রশ্ন করতে পারি?”
কারান গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, “আমাকে নিয়ে হলে ঠিক আছে, তবে আমার বউকে নিয়ে কিছু নয়।”
এই সময় ফারহান নিজেকে আরো বিব্রত অবস্থায় আবিষ্কার করল। কয়েকজন মেয়ে নাচের ছলে তার সঙ্গে এতটাই মিশে যাচ্ছে যে সে কি করবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। তাই হাত নেড়ে আয়লাকে ডাকল, যেন আয়লা এসে তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচায়।
কিন্তু আয়লা তারান্নুমের ব্যাপার জানে বলে ইচ্ছে করেই কোনো সাহায্য করল না। ফারহানের ইশারা দেখে আয়লা ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে মিডল ফিঙ্গার দেখিয়ে দিল। এরপর নির্বিকার ভঙ্গিতে কারানের দিকে তাকিয়ে রইল।
আয়লার এমন আচরণ দেখে ফারহান মনে মনে বলল, “তুমি কারানকে চেনো না, বেবি। চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু লাভ হবে না।”
এক মেয়ের হাত ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিল সে।
এদিকে আয়লা ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “How many girls have you slept with?”
কারান তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, একটুও বিচলিত না হয়ে বলল, “Just Mira, the love of my life.”
কারানের কণ্ঠের দৃঢ়তা, আর তার চোখে ফুটে ওঠা মায়ার ছায়া আয়লাকে এক মুহূর্তের জন্য নির্বাক করে দিল। তারপর আয়লা কিছুটা উন্মুক্ত হয়ে, ধীরে ধীরে কারানের সামনে চলে এসে এক হাতে তার ডান হাতটি ধরল, আর অন্য হাতে কারানের বাম গালটিকে আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল, “এখানে তো আর মিরা নেই। তুমি চাইলে আমার সাথে চান্স নিতে পারো। তুমি অবশ্যই একটা নয়, অনেকগুলো মেয়েকে ডিজার্ভ করো।”
কথার সঙ্গেই একটু এগিয়ে গিয়ে কারানের ঠোঁটে চুম্বনের উদ্দেশ্যে মাথা বাড়ালো। কিন্তু কারান এক ঝটকায় আয়লাকে সরিয়ে দিয়ে চোখে আগুনের মতো ক্ষোভ নিয়ে দ্রুত কক্ষটি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ফারহান মুহূর্তেই ঘটনাটি বুঝতে পেরে, আয়লার কাছে চলে এসে রাগান্বিতভাবে বলল, “বারণ করেছিলাম তোমাকে।”
এটা বলেই দ্রুত বাহিরে যেতে শুরু করল সে।
অথচ আয়লা একটু হেসে বেরিয়ে এসে দেখল, কারান পানির বোতল দিয়ে নিজের হাত আর গাল ধুয়ে নিচ্ছে। আয়লা বাহিরে আসতেই, কারান সজোরে আয়লাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে কণ্ঠে কঠোরতা নিয়ে বলল, “আমার অর্ধাঙ্গিনী বাদে পৃথিবীর সব নারীকেও যদি বিনামূল্যে আমাকে ভোগ করতে দেওয়া হয়, আমি নিঃসন্দেহে সে অফার রিজেক্ট করবো। শুধুমাত্র মিরা যদি একবার চোখ তুলেও তাকায়, আমি সম্পূর্ণ কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ি।”
একটু পর আবার বলল, “আমি তোমার মতো মেয়েকে হেইট করি। তুমি চলে যেতে পারো।”
কারান এত জোরে প্রহার করেছে যে আয়লার ঠোঁটের কোনা বেয়ে র”ক্ত পড়তে শুরু করে। তবে কারানের রাগ দেখে আয়লা ভিতরে ভিতরে খুশি হয়, তার চোখে একটা অন্যরকম আনন্দ ফুটে ওঠে। সে কারানের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঠোঁটের র”ক্ত মুছে ফেলতে থাকে।
আয়লার এমন দুঃসাহস দেখে কারান অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আয়লা হেসে বলে, “আমি শুধু তোমার লয়ালিটি চেক করছিলাম, কারান। তুমি যখন মিরার পিক দেখছিলে, আমি সেটা দেখেছি। এমন বউ থাকতে কোনো ছেলেরই সেকেন্ড কোনো মেয়ের প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু তুমি আলাদা, তাই তোমাকে শুধুমাত্র… যাই হোক, সরি। আর কখনো আমার থেকে এমন কোনো আচরণ পাবে না।”
আয়লা কারানের পকেটে রুমালটি গুঁজে দিয়ে পিছনে সরে যায়। কিন্তু এতেও কারানের রাগ থামল না। সে গাড়ি নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
ফারহান তখন আয়লাকে বলল, “আয়লা, তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি। কারান ঠিক কতগুলো খু”ন করেছে, ও হয়ত নিজেও জানে না। তুমি বেঁচে গেছ, কারণ কারান চৌধুরি গভীরভাবে একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সেই আগের কারান থাকলে বুঝতে সিংহের গুহায় পা দিয়েছিলে।”
এটা বলে ফারহান পা বাড়াল। কিন্তু তখনই পিছন থেকে আয়লা বলে ওঠে, “সিংহের গুহায় একমাত্র সিংহিনীই পা দিতে পারে, ফারহান। তবে এটা ভেব না, সেই সিংহিনী আমি।”
ফারহান কপাল কুঁচকে আয়লার দিকে ফিরে তাকায়। আয়লা হাসতে হাসতে বলে, “মিরা।”
ফারহানের চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আয়লা ফারহানের দিকে এগোতে এগোতে আবার বলে, “তুমি নিশ্চয়ই জানো, আয়লার চোখ আর হারপিয়া ঈগলের চোখের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।”
এ কথা বলে আয়লা ফারহানের হাত ধরল, এবং মুঠোয় কিছু একটা গুঁজে দিয়ে বলে, “আমি তোমাকে বলছি, এই মিরাই কারান চৌধুরীকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, দেখে নিও।”
এটা শুনে ফারহানের কপালে কয়েকটা ভাঁজের রেখা দেখা গেল। ফারহান মুঠো খুলে দেখতে পেল একটি পেনড্রাইভ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে আয়লার দিকে তাকায়। আয়লা গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলে, “এটা থেকে ইব্রাহিম বিন জায়েদ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে।”
এটা বলে আয়লা গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল। ফারহান ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে চিন্তাভাবনা করে, তারপর নিজেও গাড়িতে উঠে পড়ল।
এদিকে বাসায় ফিরেই দ্রুত বাথরুমে ঢোকে কারান। গোসলের প্রয়োজন শুধু শরীরের জন্য নয়, যেন নিজেকে সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে মাথার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অস্থিরতা প্রশমিত করতে পারে। ঠান্ডা পানির ধারায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ।
গোসল সেরে ভেজা শরীরটা তোয়ালে দিয়ে মুছে নেয়। হালকা ধূসর টিশার্ট আর নেভি ব্লু ট্রাউজার পরে ঘরে আসে। চুলগুলো এখনো ভেজা, কপালের পাশে কয়েকটা সুতির মতো চুল ললাট ছুঁয়ে পড়ে থাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এক ঝলক দেখে নেয়।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে ইব্রাহীমের একের পর এক মিসড কল। কপালটা একটু কুঁচকে ওঠে। দ্রুত কল ব্যাক করে বলে, “এভাবে চলে আসার জন্য, আ’ম এক্সট্রিমলি সরি। আসলে হঠাৎ একটা কাজে চলে আসতে হয়েছে।”
ওপাশ থেকে ইব্রাহিম হেসে বলল, “আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। আপনি হুট করে চলে যাওয়ার মানুষ নন। এখন বলুন, পরের বার কোথায় কখন ডিল নিয়ে কথা বলবো?”
“আমি আপনাকে জানিয়ে দিব।”
দুজন আরো কিছু সময় জরুরি কথা সেরে ফোন কেটে দেয়। তারপর কারান মিরাকে ভিডিও কল করতে শুরু করে।
কারান অনেকটা সময় ধরে মিরাকে কল করছিল, কিন্তু মিরা ফোন না তুললে তার চেহারায় স্পষ্ট অসন্তোষ ফুটে উঠে। অবশেষে তারান্নুমের নাম্বারে কল দেওয়ার চিন্তা করতে থাকলে, ঠিক তখনই মিরার ফোন আসে। ভিডিও কল রিসিভ করার সাথে সাথে কারানের চোখমুখে কাঠিন্য ফুটে ওঠে। সে গম্ভীরভাবে কটমট করে বলে, “কোথায় গিয়েছিলে?”
এদিকে মিরার মুখে হাসি স্পষ্ট। কিন্তু কারান বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। কারানের বিরক্তি ভাব দেখে মিরা ‘উম্মাহ’ শব্দে একটা উড়ন্ত চুমু দেয়। চুমুর শব্দে কারান একটু মুচকি হেসে বলে, “এসব ফ্লাইং কিস কারান ধার ধারে না।”
মিরা অবিরাম হাসিতে বলল, “তো এখন তো আমার স্বামী বিদেশে। কীভাবে কিস করবো, বলুন?”
কারান মুখে গম্ভীর ভাব এনে বলে, “তোমাকে দেখে গরম লাগছে, বেবি। টি-শার্টটা খুলে ফেলি, তারপর তুমি আমার সমস্ত শরীরে কিস দাও।”
মিরা চোখমুখ কুঁচকে বলে, “আবার?”
“আ’ম হাংরি, সুইটহার্ট।”
মিরা অবাক হয়ে কপাল কুঁচকে বলে, “তো খাও।”
কারান ক্যামেরার কাছে এসে নেশালো গলায় বলে, “আমার খাবার তো আমার থেকে অনেক দূরে। পাঁচ ঘণ্টা লাগবে যেতে।”
এটা শুনে মিরা বড় বড় চোখ করে অবাক হয়ে কারানের দিকে তাকায়। কারান শীতল কণ্ঠে বলে, “এখন অন্তত আমার বউয়ের লজ্জা পাওয়া মানায় না।”
মিরা খুক খুক কাশি দিয়ে মিনমিনে গলায় বলে, “আমার পাশে ফুফিজান।”
ফাতিমা কারানের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে দ্রুত বেরিয়ে যায়। ফাতিমা চলে যাওয়ার পর, মিরা তীব্র আগুন চোখে বলল, “তোমার কি ভালো লাগে আমাকে লজ্জায় ফেলতে?”
কারান হাসতে হাসতে বলে, “আমি কি জানতাম, জান? তুমি কেন ফুফির সামনে আমার রূপটা দেখাতে গেলে? তাছাড়া পুরো দুনিয়ার সামনেও আমি তোমাকে চুমু খেতে পারি।”
মিরা হেসে বলে, “হুম, তা তো জানিই আপনাকে। ফুফিজান মাত্রই এসেছিল। যাই হোক, এখন বলো, আসবে কবে?”
“এইতো এলাম, জান।”
মিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ নামিয়ে রাখে। আর কারান এক দৃষ্টিতে মিরাকে দেখতে থাকল। এরমধ্যেই মিরা মাথা তুলে বলল, “কারান, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
কারান হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মিরা গভীরভাবে বলে, “তোমাকে আমি লাস্ট দেড় বছর আগে কান্না করতে দেখেছি। আর সেদিন দেখলাম। তুমি কান্না কেন করেছিলে, কারান?”
কারান দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু মুহূর্ত নীরব থাকে। তারপর বলল, “জানি না, মিরা। তবে কেন যেন মনে হচ্ছিল তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। তোমার যদি কিছু হয়ে যেত, আমি ম”রে যেতাম মিরা।”
“ম”রে কেন যাবে? কাউকে না কাউকে তো আগে বা পরে ম”রতেই হবে। কিন্তু তোমার চোখে পানি মানায় না, কারান।”
“তুমি মা”রা যাওয়ার আগে যেন আমি ম”রে যাই, মিরা। আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বেঁচে থাকতে পারবো না।”
এ কথা শুনে মিরা অবাক হয়ে কারানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিরার চোখের চাহনিতে স্পষ্ট, মিরা অনুভব করতে পারছে তার হৃদয়ের গভীরতা। একটু পর কারান পুনরায় বলে, “তবে দীর্ঘ ১৮ বছর পর আমার চোখ থেকে পানি পড়েছিল, যা তুমি প্রথমবার দেখেছিলে।”
মিরা আকুলতা নিয়ে বলল, “কিন্তু তোমার চোখে আমি পানি দেখতে চাই না, কারান।”
কারান নিশ্চুপ মাথা নুইয়ে রাখে। এদিকে মিরা মৃদু হাসি দিয়ে বলে, “তোমার ওই চোখ দুটো আমার খুব প্রিয়, জানো?”
এরপর সে কিছুক্ষণ চুপ করে কারানের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে। কারানও এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না, মিরার চোখের অন্তর্গত গভীরতা তাকে অব্যক্ত আহ্বানে বন্দী করে রেখেছে। মিরার চোখের ভালোবাসার ঝলক তার বুকের ভিতর অজানা অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
কারান কণ্ঠে গম্ভীরতার ভার নিয়ে বলে, “মিরা, তুমি ভুল করেছো। তোমার উচিত ছিল আমাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া। আমি যে আবার একই কাজ করব না, তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
মিরার ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা খেলে যায়। কারান কিছুটা অবাক হয়েই বলে, “আজব এক বউ তুমি!”
একটু থেমে আবার বলে, “আমি কিন্তু সিরিয়াস, মিরা। তুমি আমাকে যে-রকম দেখছো, আমি সেরকম নই। বাইরে থেকে যতই ঠান্ডা দেখাক, কিন্তু ভিতরে আমি অন্ধকারের বাসিন্দা। আর তোমার মতো পবিত্র আত্মা যখন আমাকে স্পর্শ করে, তখন বাম পাশের ফেরেশতা হয়ত গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার খাতায় পাপের সংখ্যা যে বেড়েই চলেছে।”
মিরার হাসি এবার আরো মোলায়েম হয়। গভীর, ঠান্ডা গলায় বলল, “তুমি কতটা খারাপ হতে পারো?”
“তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমার ভিতরের দানব এতটাই ভয়ানক যে তোমার সাহসও তাকে ছুঁতে পারবে না।”
মিরার চোখে এবার বরফের ধার। কণ্ঠে জ্বলন্ত দৃঢ়তা নিয়ে বলল, “কারান, যদি কোনোদিন জানতে পারি; আমি যা দেখছি, যা বিশ্বাস করছি, তার কিছুই সত্য নয়। তাহলে তুমি মিরার দ্বিতীয় রূপ দেখবে। আর সেই রূপের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁচার আশা করো না। বিশ্বাস করো, আমি সেই যুদ্ধে জয়ী হবো, আর তুমি পরাজিত।”
এ কথা কারানের কর্ণগোচর হতেই তার চোখ মিরার মুখে স্থির হলো। তাদের মাঝে গভীর নিরবতা নেমে আসে। কিছুক্ষণ পর কারান চাপা স্বরে বলে উঠল, “তাহলে দেড় বছর ধরে তুমি আমার সাথে অভিনয় করেছো?”
মিরার ঠোঁটে এবার নিস্পৃহ ও তীক্ষ্ণ হাসি ফুটে ওঠে। “অভিনয়? না, আমি অভিনয় জানি না। কিন্তু তুমি যদি নিজেকে অ্যাক্টর ভেবে থাকো, তবে আমি তোমার জীবনের ডিরেক্টর। আমি ঠিক করি কোন দৃশ্যে আলো পড়বে আর কোন দৃশ্যে অন্ধকার।”
এ কথা শোনামাত্র কারানের চোখে অদ্ভুত ঝলক ফুটে উঠে। যেখানে সন্দেহের সঙ্গে মিশে থাকে বিস্ময়। কিন্তু মিরার মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। কারান আপনমনে বলে, “আমার তো এখন তোমাকেই সন্দেহ হচ্ছে, বেগম। তুমি কে?”
কারান মিরার দিকে নয়নগোচর করে তাকিয়ে থাকে।
কিছু সময় বাদে মিরা হেসে বলে ওঠে, “আচ্ছা ওয়েট, তোমাকে একজনকে দেখাই।”
এ কথা বলেই সে সেখান থেকে চলে যায়। কারান দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “বে”য়াদব মেয়ে। স্বামী এত সময় পরে কল করেছে, কিনা আমাকে প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে, তা না… গেছে।”
লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে দিল সে।
এদিকে একটু পর মিরা একটি ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এসে চেয়ারে বসে বলে, “দেখো, ও কত্ত গুলা কিউট। আমার কিন্তু ওকে অনেক ভালো লেগেছে।”
বাচ্চাটি হাসতে হাসতে মিরাকে দেখতে থাকে। অথচ কারান হেলদোলহীন ভাব নিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্থাৎ মিরার এই কাজটা কারানের মোটেও পছন্দ হয়নি। বউকে কল করেছে, তাকে দেখার জন্য, এসব বাচ্চা দেখে কারান কি করবে?
কিন্তু এর মধ্যেই বাচ্চাটি মিরার গালে এক টুকরো মিষ্টি চুমু দিয়ে বলে, “বড় হয়ে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো, সিজুকা।”
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কারান রাগে আগুন হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। তার সারা শরীর উত্তেজনায় কেঁপে ওঠে। কারান কটমট করে বলে, “এই মিরা! ওকে নামাও, এক্ষুনি নামাও বলছি।”
কারান কঠিন মুখাবয়বে চিৎকার করে বলে, “কত্ত বড় সাহস! আমার বউয়ের গালে চুমু খায়! আবার আমার বউকে বিয়ে করবি তুই? তুই সামনে থাকলে…এই মিরা, এক্ষুনি নামাও।”
কারানের অদ্ভুত আচরণে মিরা না চাইতেও বাচ্চাটিকে নামিয়ে দেয়, কিন্তু তার চোখে অসহায়তার ছাপ স্পষ্ট।
“আচ্ছা বাবু, তুমি তোমার মায়ের কাছে যাও,” বলে সে বাচ্চাটির মাথায় আলতোভাবে হাত রাখে।
বাচ্চাটি মিরার গাল টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়, আর মিরা তার চলে যাওয়ার দিকে বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এদিকে কারান রাগে অস্থির হয়ে উঠে, ঠোঁট কামড়ে মিরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
মিরা তার রোষ দেখে ঠান্ডা হাসি দিয়ে বলে, “ও একটা বাচ্চা, কারান। ওর বয়স মাত্র চার বছর।”
কারান বিরক্ত হয়ে বলে, “কিন্তু ছেলে তো।”
মিরা মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আই মিস ইউ, জান। এবার বসো।”
“আমি আসছি,” বলেই কারান কল কেটে দেয়।
মিরা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে ফোনের পর্দায় তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার কারানকে কল করে। কিন্তু কারান আর কল রিসিভ করে না।
এদিকে ফারহান এসে দেখে কারান গম্ভীর মুখে তৈরি হচ্ছে। অবাক হয়ে ফারহান জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছিস?”
কারান শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “বাংলাদেশ।”
ফারহান ভ্রূ কুঁচকে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “মানে কি? কেন?”
কারান কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়, “আমার এখন মিরাকে লাগবে। মিরাকে খে”য়ে ফেলতে যাচ্ছি।”
ফারহান একটু থেমে কাশি দিয়ে বলে, “মানে… তুই এখন ই”ন্টিমেইট হওয়ার জন্য দুবাই থেকে বাংলাদেশ যাবি? মাথা ঠিক আছে? রাত নয়টা বাজে, ভাই।”
কারান অদ্ভুত হাসি দিয়ে ফারহানের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই এটা বুঝতে পারবি না, ফারহান। মিরা আমার নেশা। আর জানিস তো, নেশায় আক্রান্ত হলে মানুষ তখনই শান্তি পায়, যখন সে তার সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারে। একমাত্র নেশার ডোজই তার সমস্ত তৃষ্ণা দূর করতে পারে।”
এমনটা বলেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় সে। ফারহান কিছুটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার সামনেই আয়লা দাঁড়িয়ে থাকলেও, কারান তাকে অগ্রাহ্য করে চলে যায়। আয়লা ভিতরে ঢুকে ফারহানের কাছে এসে বলে, “ও কোথায় গেল?”
ফারহান মুচকি হেসে বলে, “এই কারান আমার বিয়ের তৃষ্ণা বাড়িয়েই চলেছে। উফফ, কবে যে আমার কুইনকে সম্পূর্ণভাবে আমার করে পাবো।”
অন্যদিকে মিরা কিছুটা অস্বস্তিতে আবদ্ধ। কারানের আচরণ, তার প্রগাঢ় চোখের নীরব প্রশ্ন, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি তার হৃদয়ে অজানা দোলাচল সৃষ্টি করছে।
“আসছি…মানে?”
এই কথাটি তার মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। মিরা চেয়ারে বসে পা নাচাতে নাচাতে, একসময় বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। তার চিন্তা একের পর এক ছুটে চলল, কিন্তু ক্ষণকালের মধ্যেই ধীরে ধীরে মিরার চোখের পাতা একে অপরের মধ্যে ঢুকে গেল। তাই বসা অবস্থাতেই সে নিদ্রায় তলিয়ে যায়।
রাত প্রায় আড়াইটা। ঘরের অন্ধকারে কারো পদচিহ্ন ভেসে আসছে। মিরার ঠোঁটের একদম কাছে একটি শীতল ছায়া নেমে এলো। লোকটা অনেকটা সময় ধরে মিরার মুখশ্রী পলকহীন দেখতে থাকলো। কিছুক্ষণ পরই তার কানের কাছে গভীর, ভারী কণ্ঠস্বর বেজে উঠলো, “সুইটহার্ট।”
এই শব্দ শুনে মিরা হঠাৎ করেই এক লাফে জেগে উঠল, কিন্তু কারানকে চোখের সামনে দেখেও মিরার স্বপ্ন মনে হলো। অথচ কারান তখনো তার ঠোঁটের কাছাকাছি, নিজের দেহের উষ্ণ আবেশে মিরাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মিরা বাধা দিলেও লাভ হলো না। কারান তাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে তার গলায় চুম্বন ছড়িয়ে দিল।
এমন আবেগঘন মুহূর্তে, মিরার শরীর কেঁপে উঠল। আতঙ্কে সে কারানকে ধাক্কা দিয়ে উঠে আলো জ্বালিয়ে দিল। আলো পড়তেই দেখল, কারানের মুখমণ্ডলে অদ্ভুত পরিবর্তন। মিরার শ্বাস প্রশ্বাস আরও দ্রুত হতে লাগল। তার বুকের ওঠানামা স্পষ্টভাবে কারান লক্ষ্য করছে। সে বিছানা থেকে উঠে এসে মিরাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।
মিরা নীরবতার মধ্যেও কারানের গভীর আবেগকে অনুভব করল। কিন্তু তবুও সে কারানের হাত সরিয়ে ফেলল।
মিরা অশান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলার সুযোগও দেবে না?”
কারান গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “ও কেন তোমাকে চুমু দিল?”
মিরা অবাক হয়ে চোখে-মুখে অল্প অসন্তোষ ফুটিয়ে বলে, “আমি, আমি ভাবছিলাম, তুমি আমাকে মিস করো বলে এসেছ, আর তুমি…তুমি কিনা সামান্য একটা বাচ্চার আচরণে রেগে গিয়ে… ছি!”
এটা বলে মিরা চোখ নীচু করে ফেলে।
কিন্তু তার কথার পর, কারান মিরার ব”ক্ষস্থলের ভাঁজ থেকে বাম কানের নীচ পর্যন্ত দাঁতের সহিত এক ভয়ানক দা”গ কে”টে দিল। সেই দাগের তলানিতে কিঞ্চিৎ র”ক্ত দৃশ্যমান হলো।
মিরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে যেখানে সেই বাচ্চা ছেলেটি চুম্বন রেখেছিল, কারান সেই গালে সেখানেই এক গভীর চুম্বন দিয়ে মিরাকে পুনরায় অবশ করতে চাইল, কিন্তু মিরা কারানের হাত নিজের শরীর থেকে সরিয়ে বিরক্তির কণ্ঠে বলল, “আমার অসহ্য লাগছে, কারান।”
তার এই কথায় কারানের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মুহূর্তেই তার মুখে আগুনের শিখার মতো রাগ ছড়িয়ে পড়ল। পরমুহূর্তে মিরার গলা চেপে ধরে দেয়ালের সাথে ধাক্কা দিয়ে আটকে দিল। তার হাতের শক্ত বাঁধনে মিরার শ্বাস আটকে এলো। মিরার চোখের কোণে কিঞ্চিৎ পরিমাণে অশ্রু জমলো। কারান দৃষ্টিতে জ্বলন্ত লাভার ঝলক ছড়িয়ে বলল, “তোমার অসহ্য লাগলেও সারাজীবন তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে, সুইটহার্ট।”
কারানের এ কথায় মিরার দেহের গভীরে অজানা শক্তি উথলে উঠল। তার চোখের ভয় মিলিয়ে গেল, সেখানে জায়গা করে নিল প্রতিরোধ। হঠাৎ সেও একই রকম দৃঢ়তায় কারানের গলা চেপে ধরল। কারান স্তম্ভিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। মিরার শক্ত হাতে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। প্রতিযোগিতার মতো একে অপরের গলায় চাপ বাড়িয়ে চলল।
কিন্তু শেষমেশ কারান ধীরে ধীরে মিরার গলা থেকে হাত সরিয়ে নিল। তখন মিরাও সরিয়ে নিল। কিন্তু মিরার শ্বাস ভারী হয়ে এলো। খুক খুক শব্দে কাশতে কাশতে সে গলা ডলতে লাগল। এদিকে মিরার এই অপরিচিত রূপ দেখে কারান মিরার পানে অপলকভাবে তাকিয়ে রইল।
সে হাত দিয়ে মিরার এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমিহ… তুমি তোমার স্বামীর গলা চেপে ধরলে?”
কারানের চোখে র”ক্তিম ক্রোধের ছাপ থাকলেও তার কণ্ঠে প্রশংসার সুর স্পষ্ট। মিরা গলা ডলতে ডলতে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। কারণ বুঝে গেছি, তোমার পাশে টিকে থাকতে হলে আমাকেও তোমার মতোই হতে হবে।”
কারানের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় তীক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠল। সে গভীর সুরে বলল, “আমি কখনো চাইনি, তুমি কঠিন হয়ে যাও। কিন্তু এখন কেন জানি, তোমার এই রু”থলেস রূপটাই আমাকে মেসমেরাইজ করে তুলেছে।”
মিরা তীক্ষ্ণ, শীতল হাসি হেসে কারানের কাছে এসে তার শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে, “কি ভেবেছিলে? আমি নরম মাটি বলে চাইলেই আমাকে নিজের মতো করে শেইপ দিতে পারবে?”
মিরার কথাগুলোর মধ্য দিয়ে তার মনোভাব স্পষ্ট। এদিকে মিরার এমন মুখাবয়ব আর গভীর গলার শব্দ শুনে কারান তার নেশায় তলিয়ে যেতে থাকে।
মিরা কারানের শার্টটি খুলে পাশে রেখে, তার বুকে সেই লোকটার ন*খের দাগের উপর হাত বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন করে, “এটা কীভাবে হয়েছে? এটা তো আমার দেওয়া দাগ নয়, তাই মিথ্যে বলবে না।”
কারান ঠান্ডা গলায় বলে, “একটা অ্যাকসিডেন… আহ!”
কথা শেষ করতে না দিয়েই মিরা তীক্ষ্ণতার সাথে তার বুড়ো আঙুলের ন*খ কারানের বু*কে চেপে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে র*ক্তের সূক্ষ্ম ধারা বের হয়ে আসে। মিরা তৎক্ষণাৎ টিস্যু এনে র*ক্ত মুছে দিতে দিতে কঠোরভাবে বলে, “বলেছিলাম, মিথ্যে বলবে না।”
কারান চোখ বন্ধ করে একটুখানি শান্ত হতে চেষ্টা করে। এরপর চোখ খুলে সম্মোহনী গলায় বলে, “আমার এখন তোমাকে চাই, মিরা। আই লাভ দ্যাট ইয়োর গেটিং ওয়েট ফর মি।”
মিরার ঠোঁটে গভীর চুমু খেতে শুরু করে সে। মিরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
কারান যখন মিরার মুখের কঠিন ভাব দেখে, তখন সে বাঁকা হেসে মিরাকে কোলে তুলে বাহিরের দিকে যেতে শুরু করে। মিরা বিরক্তির সুরে বলে, “কারান, আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”
কিছুক্ষণের মধ্যে কারান মিরাকে গাড়িতে তুলে ড্রাইভিং করার দিকে মনোযোগ দেয়। মিরা অতিরিক্ত রেগে গিয়ে কারানের ড্রাইভিং সিটে তার কোলে উঠে বসে। কারান হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বলে, “পা”গল তুমি? আরেকটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেত!”
মিরা তার গাল দুটো ধরে, তার ঠোঁটের একদম সামনে এসে গভীরভাবে বলে, “কি বলেছি তোমাকে?”
এর মধ্যে বাহিরে আকাশও গর্জন শুরু করছে, তাদের মধ্যে বাতাসেও উ”ত্তেজনা ছড়িয়ে পরে।
Tell me who I am part 34
এদিকে কারান প্রত্যুত্তর না দিয়ে মিরাকে চুম্বন করতে করতেই গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত দেয়। এ দৃশ্য দেখে মিরা সজাগ হয়ে ওঠে, তার হৃদয়ের মধ্যে অস্থিরতা তোলপাড় করতে থাকে। দ্রুত নিজের সিটে ফিরে গিয়ে বসে সে, কিন্তু কারানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কারান দ্রুত মিরার সিট বেল্ট আটকে দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর, যখন কারান তাকে প্রাইভেট জেটে উঠতে বলে, মিরা তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কারণ কারান এবার সত্যিই তার ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। অথচ কারান গম্ভীর চাহনি নিয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরে শীতল কণ্ঠে বলে, “আপনার কাছে আর কোনো অপশন নেই, মহারানি। আমার সাথে যেতেই হবে।”
তারপর মিরাকে টেনে জেটের দিকে নিয়ে যায়। দরজা সজোরে বন্ধ হয়ে গেলে, কারান মিরার দিকে ধীর পদক্ষেপে এগোতে থাকে। মিরা তীব্র গলায় বলে, “আমি কিন্তু এখন রেগে যাচ্ছি, কারান।”