The Silent Manor part ৩০

The Silent Manor part ৩০
Dayna Imrose lucky

আরিব এবং রায়ান সিঁড়ির মাঝ বরাবর এসে হঠাৎ কি যেন কি মনে করে দুই ভাই থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনে কোন বিষয় গভীর আলোচনা করছে। বিষয়টি লক্ষ্য করছে শফিক। শফিক অপেক্ষা করছে কখন তাঁরা ছাদে পৌঁছাবে। কিন্তু শফিক এর ইচ্ছে পূরণ হয়নি।আরিব এবং রায়ান ছাদের দিকে না এসে নিচের দিকে নেমে গেছে। শফিক এর ভালো লাগল না।ও মুখে গামছা চেপে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল।ফারদিনা সুফিয়ান কে জড়িয়ে ধরেছে।ও স্বচোক্ষে দেখেছে, তাঁদের মধ্যে প্রেম চলছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন প্রমাণ নেই।রশীদ তালুকদার কে বললে বিশ্বাস করবে না।ফারদিনার ভাইদের বললে মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। উল্টে শফিক বিপদে পড়বে।ও ছাদে আর আসল না।ছাদের মূল দরজার আড়ালে থেকে নিচে নেমে যায়।
সুফিয়ান ফারদিনাকে ছেড়ে দেয়।ফারদিনা বলল “আজমাত আর ক’দিন পর চলে যাবে।যে দু’দিন আছে আমি আর তাঁর সামনে যাব না।”

“মনে থাকবে?
“থাকবে!
“দ্বিতীয় বার যদি দেখছি ওঁর সামনে রংঢং করছো তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।বুঝেছো?
ফারদিনা নাড়িয়ে বোঝাল সে বুঝেছে।সুফিয়ান বলল “মাথা নাড়ালে হবে না।মুখে বলো।”
“আমি আর কখনো আজমাত এর সামনে যাব না।আর যদি যাই তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। এবার হয়েছে?”
“বাবা, এখন দেখছি আমাকেই প্রশ্ন করছো!”
ফারদিনা ছাদের মূল দরজার দিকে তাকিয়ে বলল “কেউ চলে আসবে।এসব নিয়ে আর কথা না বলি। আমার গোলাপ গাছ দেখেছো?
“না।চলো দেখাও”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছাদের একপাশে নানান ধরণের ফুল গাছ।কিছু ফুলের ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে আছে চারপাশ। সুফিয়ান দু হাত পেছনে বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।ফারদিনা ফুল গাছ গুলোর কাছে বসে হাত দিয়ে স্পর্শ করে করে সুফিয়ান কে দেখাচ্ছে। শেষ ছুঁয়ে দেখছে গোলাপ চারাটা। সুফিয়ান বলল “কবে গোলাপ গাছে গোলাপ ধরবে?
“যেদিন তুমি আমাকে নিজের করে নিবে!” ভাবলেশহীন ভাবে বলল ফারদিনা। সুফিয়ান দৃঢ়তার সাথে বলল “আমিত শিগগিরই তোমাকে নিজের করে নেব।”
“ধরে নাও সেদিনই গোলাপ ফুটবে।”

“যত্ন নিও ভালো করে।” বলে সুফিয়ান পাথরের বেঞ্চে বসল।ফারদিনা শান্ত ভাবে বলল “আমি যদি কখনও হারিয়ে যাই তখন আমার গোলাপের খোঁজ নিও।যদি গোলাপ গাছটা জীবিত থাকে তাহলে ভাববে আমিও জীবিত আছি।আর যদি গোলাপ গাছটা অযন্তে মরে যায় তাহলে ভেবে নিও আমিও মরে গেছি।” বলে ফারদিনা আনন্দে হেসে উঠল। এমনটা বললে সুফিয়ান রেগে যাবে সে জানে। ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁর রাগ তোলার চেষ্টা করল। এতক্ষণ সুফিয়ান তাঁর উপর রাগ দেখিয়েছে,চেঁচিয়েছে।এখন সে আলাদা করে এর শোধ নিতে চাইল।ফারদিনা হাঁসি থামিয়ে সুফিয়ান কে দেখছে। সুফিয়ান এর দৃষ্টি একটি ছোট্ট ফুল গাছের দিকে।সে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।যেন তাঁর সাথে ফারদিনা নয়, ফুল গাছটা কথা বলছে।ফারদিনা সুফিয়ান এর চাহনি অনুসরণ করে তাকাল ফুল গাছটির দিকে।

এরপর সুফিয়ান কে বলল “কি দেখছো?আমি তোমার সাথে কথা বলছি আর তুমি ফুল গাছের দিকে তাকিয়ে আছো” আশ্চর্য হল সে। সুফিয়ান ফারদিনার কথার কোন প্রতিক্রিয়া করছে না।সে সমস্ত ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাকিয়ে রইল ফুল গাছের দিকে।ঠিক সেদিন এর মত,যেদিন ফারদিনা সুফিয়ান কে স্বর্ণের বাঁশি উপহার দিয়েছে। কিন্তু,সেদিন সুফিয়ান এক-ধ্যানে তাকিয়ে ছিল দিঘীর জলের দিকে।আর বলেছিল ‘আমি ছোট্ট মাছ দেখছিলাম। কিন্তু আজ সে কিছুই উপহার দেয়নি তাঁকে,বরং সুফিয়ান রেগে যাবে এমনটি আশা করেছিল।রাগ তো দূরের কথা সুফিয়ান তাঁর কথাই শোনেনি বলে ধরে নিল ফারদিনা।
ফারদিনা সুফিয়ান এর কাঁধে হাত রাখল। তাঁর হাত রাখাতে সুফিয়ান এর হুঁশ ফিরল।বলল “কিছু বলছিলে?

“এত গভীর ভাবে কি ভাবছিলে তুমি? আমি এতক্ষণ যা বলেছি, সেসবের কিছুই শুনোনি তুমি?”
সুফিয়ান বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল “শুনেছি। তোমার গোলাপ যেদিন ঝড়ে যাবে,সেদিন তুমিও ঝড়ে যাবে তাইতো। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে কখনই ঝড়ে যেতে দেব না।ঝড় যদি তোমাকে ভেঙ্গে দিতে চায়,তবে আমি সেই ঝড়ের দিক বদলে দেব।”
ফারদিনা মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিস্তেজ ভঙ্গিতে বলল “তোমাকে কখনো কখনো আমার পর মনে হয়।প্রথম যেদিন রাখাল বাঁশিওয়ালা কে দেখেছিলাম, সেদিন এর বাঁশিওয়ালা আর আজকের বাঁশিওয়ালার অনেক তফাৎ।”

সুফিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল “আমি আমাতে কোন তফাৎ দেখছি না। তুমি আমাকে কখনো কখনো অন্য চোখে দেখছো।” বলে থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল “চলো”
“কোথায়?
“ঝর্ণা দেখতে।”
“সেটা কোথায়?
“আলিমনগর এর মেয়ে হয়ে এটাই জানো না! আমাদের গ্রামের প্রায়ই শেষ সীমান্তে ঝর্ণাঘাট আছে। সচরাচর সেখানে কেউ যায় না, কিন্তু আমরা যাব।”
ফারদিনা ভেবে বলল “মনে পড়েছে,আদিব ভাই এর কাছে ঝর্ণা ঘাট এর নাম শুনেছি। পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থিত।বলা হয়,সেখান থেকে কেউ একবার পড়ে গেলে আর বেঁচে ফিরতে পারে না। তুমি সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছো!”

সুফিয়ান মসৃণ হেসে বলল “তোমার বিপদে আমিই ঢাল হয়ে দাঁড়াব।আমি থাকতে তোমার কোন ক্ষতি আমি হতে দেব না।”
“তুমিই যদি আমার ক্ষতির মূল কারণ হও!” বলে ফারদিনা চাপা স্বরে হাসল। সুফিয়ান হাঁফ ছেড়ে বলল “তোমার সাথে কথা বললে আমার মেজাজ বিগড়ে যাবে।আমি যাচ্ছি।”
“ঝর্ণা ঘাট যাবে না!”
“না, আমার সাথে যেও না। পাহাড়ের ঢালু থেকে ফেলে দেব তোমায়।”
“রাগ করছো কেন! তুমি যাও,আমি ঝিলমিল কে সাথে নিয়ে বের হচ্ছি। মিথ্যা বলে বের হতে হবে।”
“আমার জন্য না হয় একটু মিথ্যাই বললে।”

রশীদ তালুকদার বাগানে বসে আছে।সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খায়নি সে। কুদ্দুস এর চিন্তা করছে সে। কুদ্দুস এর বাবা মা কেউ বেঁচে নেই।গত নয় বছর ধরে কুদ্দুস তাঁর সাথেই আছে।সেও ওকে নিজের সন্তানের মতই দেখত।আজ সারাদিন পার হয়ে যাচ্ছে কুদ্দুস এর হদিস সে পায়নি। শফিক একটু পর পর এসে জিজ্ঞেস করছে তাঁর কিছু চাই কিনা,সে প্রতিবারই কিছু চাই না বলেছে। শেষবার শফিক বলেছে রশীদ এর চোখমুখে চিমশে ভাব চলে এসেছে। রাতে ঠিকঠাক মতো ঘুম না হলে মুখে এরকম ভাব চলে আসে। রশীদ এর ঘুম হয়েছে ঠিকঠাক। সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখেছিল গতকাল রাতে।এখন স্বপ্নের কথা মনে পড়ছে না। আজকের রাতে মনে পড়বে। রশীদ রাতে যখনই স্বপ্ন দেখে, পরদিন দিনে সেটা মনে পড়ে না।ঘুরেফিরে রাতেই মনে পড়বে।
কুদ্দুস কোথায় আছে কে জানে। রশীদ চিন্তিত। নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে বসে আছে। বেশিক্ষণ রশীদ লুকিয়ে থাকতে দিবে না।সে বের হবে ওকে খুঁজতে।মনে মনে নিশ্চিত করল।

বেলা এখন ঠিক একটার কাছাকাছি। সূর্য মাথার উপরে উঠেছে। রশীদ ঘাড় কাত করে সূর্যের দিকে দেখল।কড়া রোদ।ঘাড় সোজা করল।চোখ তুলে সামনে তাকালো। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামের নাম করা জ্যোতিষী গদাধর পণ্ডিত। বয়স তাঁর পঞ্চাশ ছুঁয়েছে, তবু চোখ দুটি এখনো আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। কপালের বলিরেখায় বয়সের ছাপ, কিন্তু ভেতরে যেন গ্রহের আলো লুকানো।গায়ে তাঁর গাঢ় গেরুয়া রঙের ধুতি, তার ওপরে সাদা পাতলা চাদর, যা হালকা বাতাসে দুলছে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে এক পুরনো তামার আংটি। কানের কাছে পাক ধরা দাড়ি, আর কপালে গাঢ় চন্দনের টিপ।রশীদ বেশ সম্মানসূচক কন্ঠে বলল “বসুন গদাধর বাবু। আপনি এখানে কেন? আপনি লোক পাঠালে আমিই চলে যেতাম।”

গদাধর আস্তেধীরে বসে।বলল “আপনার ভক্তিশ্রদ্ধা বরাবরই আমাকে মুগ্ধ করে।আজ বুধবার। আজকের দিনে দুপুরের রোদে হাঁটাচলা করা উত্তম।তাই হাঁটতে বের হয়েছি।পথে আপনার বাড়ি পড়ল। ভাবলাম বসে যাই।”
“অনেক খুশি হয়েছি আমি। আপনার পায়ের ধুলো পড়েছে আমার বাড়িতে,আমি ধন্য। আশাকরি শিগগিরই সুসংবাদ পাব।”
গদাধর চোখ বুজে কিছু ভাবতে শুরু করল। ততক্ষণে আরিব, রায়ান, সায়েম বাগানে উপস্থিত হয়। তাঁরা ভক্তির সাথে গদাধর এর পা ধরে সালাম করল। গদাধর চোখ মেলে তাকাল।বলল “
ছেলেদের আদব কায়দা বেশ গভীর। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?”
সায়েম আগ বাড়িয়ে জবাব দিল “সব ঠিকঠাক আছে। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন।আরো ভালো কিছু করতে পারব।”

রায়ান বলল “আমাদের নামডাক আলিমনগরে এখন পর্যন্ত প্রভাব ফেলছে। আগাম দিনেও ফেলবে কিনা জানিনা। তবে আপনি আমাদের নির্দেশনা দিবেন,কি করলে আমাদের বংশের নাম উজ্জ্বল হবে।”
গদাধর বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তাঁর নীরবতা সবাইকে ভাবাচ্ছে। তাঁরা তিন ভাই একে অপরের সাথে চাওয়াচাওয়ি করল। গদাধর নীরবতা ভেঙ্গে কিছু বলবে, সে-ই অপেক্ষা করছে তাঁরা। গদাধর এর পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষা করছে তাঁরা।সে ধ্যান ভেঙ্গে বলল “অমঙ্গল।ঘোর অমঙ্গল। শিগগিরই তোমাদের উপর অমঙ্গলের ছায়া নেমে আসবে। মিলিয়ে নিও।”

রশীদ বেশ আকস্মিক হকচকিয়ে গেল।রায়ান কপালে ভাঁজ এনে দুই ভাইয়ের সাথে চোখ মিলাল।রায়ান তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল “কিসের অমঙ্গল, খোলামেলা ভাবে বলুন।”
গদাধর বলল “অমঙ্গলের ছায়া আমি দেখতে পাচ্ছি।কি হবে জানিনা।চোখকান খোলা রেখে চলো।”
বলে গদাধর উঠে দাঁড়ালো। তাঁর কথার উপর আর কেউ প্রশ্ন তুলতে পারল না। তাঁর সাথে সাথে রশীদ ও উঠে দাঁড়াল। রশীদ বিনয়ের সাথে বলল “আজ দুপুরে যদি আমাদের সাথে অন্ন মুখে তুলতেন”
“না,আজ আমি উপোস করেছি। আজকের দিনে আমি কখনোই অন্ন মুখে দেই না।ভুলে গেছেন নিশ্চয়ই।” গদাধর রেগে বলল। রশীদ বলল “মাফ করবেন। আমার ভুল হয়েছে। সত্যিই মনে ছিল না।কিন্তু আমাদের অমঙ্গল এর কথা বললেন,কি..কি হবে, যদি বলতেন।”

“শুধু এতটুকুই বলব সাবধানে থাকবেন।” বলে গদাধর যেতেই তাঁর সামনে পড়ে সুফিয়ান। সুফিয়ান রশীদ এর কাছেই আসছিল। গদাধর সুফিয়ান কে চোখ আধখোলা করে তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করল। সুফিয়ান গদাধর কে সালাম দিল।
গদাধর সালামের জবাব না দিয়ে ধীরে বলল
“তোমার জন্মরাশি ‘অশ্বিনী’। এই মাসে মঙ্গল তারার ক্রোধ আছে সতর্ক থেকো, জল আর অগ্নি দুই-ই বিপদ বয়ে আনবে। তোমার আশেপাশের কিছু মানুষ আছে,যারা অচিরেই তোমাকে ধ্বং’স করার চেষ্টা করবে।” সুফিয়ান কোন জবাব দিল না।সায়েম বলল “ওর কে ক্ষতি করবে,ওর তো কোন শত্রুই নেই।”
গদাধর বলল “শ’ত্রু চোখে দেখা যায় না।শত্রু তাঁর আক্রমণ এর আগে কখনোই ইঙ্গিত দিবে না যে,আমি তাঁর ক্ষতি করার জন্য ওত পেতে বসে আছি।শ’ত্রু লক্ষ্য রাখে তাঁর শিকারের উপর। অপেক্ষা করে উপযুক্ত সময়ের।এর দিকেও কিছু মানুষের নজর আছে।যা শিগগিরই ধ্বং’সের বার্তা দিবে।হয়ত ধ্বং’স করেই ফেলবে।”

রশীদ সুফিয়ান এর পাশে দাঁড়াল। তাঁর কাঁধে ভরসাসূচক হাত রেখে বলল “সুফিয়ান আমাদের গ্রামের একটি নক্ষত্র। আপনি হয়ত জানেন না,ও কিভাবে আমাদের কৃষি কাজকে কতটা উন্নত করেছে। আমার বিশ্বাস ওর কোন শত্রু নেই।আর হবেও না।যদি কেউ ওর দিকে তেরে আসে তবে আমরা রুখে দাঁড়াব।”
রায়ান রশীদ এর রেশ টেনে বলল “ঠিক বলেছেন আব্বা, সুফিয়ান এর আমরা থাকতে কোন ক্ষতি হবে না।” থেমে গদাধর এর দিকে তাকিয়ে বলল “আমাদের একমাত্র বোন ফারদিনা,ওকে নিয়ে যদি কিছু বলতেন!” গদাধর অগ্নি চোখে হঠাৎ করে সুফিয়ান এর দিকে তাকাল। সুফিয়ান সবার নজরের আড়ালে বাড়ির ছাদের দিকে তাকাল।ফারদিনা দাঁড়িয়ে আছে রেলিঙ ধরে।চেয়ে আছে ঠিক তাঁদের পানে। গদাধর ফারদিনাকে নিয়ে কিছু বলবে, তাৎক্ষণিক মসজিদ থেকে আযান এর ধ্বনি ভেসে আসে। গদাধর তিন অক্ষরে একটা শব্দ বের করল শিগরি..! এরপর থেমে গেল।তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের নিশ্চুপ গম্ভীরতা। গদাধর রশীদ এর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।যেন তাঁকে কেউ ধাওয়া করছে,ঠিক সেভাবেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায়।

রায়ান বলল “ জ্যোতিষী আসলে কাকে বাঁচাতে চাইছে, আমাদের নাকি, ঘনিয়ে আসা বিপদ কে! স্পষ্ট করে কিছুই বলল না।”
সুফিয়ান বলল “এদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই।চলি।” বলে ফারদিনার দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায়।
দিন ফুরিয়ে বিকেলের আগমন ঘটল ধরণীতে। রশীদ বাড়ির মূল ফটক ছেড়ে বাইরে বের হন। সাথে দু’জন অনুচারী।সে হেঁটে যাচ্ছে নিকটবর্তী নদীর পাড়ের দিকে। তাঁদের দূর থেকে অনুসরণ করছে শফিক। কুদ্দুস চলে যাওয়াতে ওর জায়গাটা কয়েকঘণ্টা হয় দখল করেছে।ওর মূল উদ্দেশ্য রশীদ তালুকদার এর মন জয় করা। তাঁর খাস চাকর হওয়া। কিন্তু তাঁর খাস চাকর হওয়া বেশ কঠিন বিষয়। কুদ্দুস চলে যাওয়াতে ও বেশ খুশি হয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে একবারো শফিক রশীদ এর সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে পারেনি।ওর সুযোগ হলেও যেন রশীদ সে-ই সুযোগ কাজে লাগাতে দেয় নি।

রশীদ এর উদ্দেশ্য কুদ্দুস কে খোঁজা।পাড়ার লোকে যদি জানে, জমিদার রশীদ তালুকদার সামান্য একজন কাজের লোক কে খুঁজতে বের হয়েছে,তবে কি মন্তব্য করবে তাঁরা?নানান ধরণের মন্তব্য করবে। হাসাহাসি করবে। হয়ত আড়ালে নয়ত নিঃশব্দে। কুদ্দুস অন্যদের কাছে সামান্য কাজের লোক হলেও রশীদ এর কাছে সামান্য, কিংবা ও তুচ্ছ নয়। রশীদ ওকে স্নেহ করে।কিছু মানুষ যেমনি হোক, সময়ের সাথে সাথে তাঁদের সাথে মিশতে মিশতে মানুষ গুলো আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। কুদ্দুস তেমনি ভাবে রশীদ এর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।আজ সারাদিন কারো সাথে সে রাগ দেখাতে পারেনি।গা এখন ঝিম ঝিম করছে।

নিকটবর্তী নদীর তীরে তাঁরা পৌঁছে যায়। কুদ্দুস এর মন খারাপ হলে নদীর তীরে এসে বসে থাকে।বেশ কিছুদিন আগেও রশীদ এর সাথে ঝগড়া করে কুদ্দুস নদীর তীরে এসে বসেছিল। রশীদ আন্দাজ করল,আজও এসেছে। নদীতে জোয়ারের কলকল শব্দ বইছে। বাতাসে ভেজা ঘাসের ঘ্রাণ। তীব্র বাতাসে রশীদ এর ঝমকালো পোশাক এর এক অংশ উড়ে গেল। সচরাচর তাঁর নদীর তীরে আসা হয় না।আজ এসেছে। তাঁর কারন কুদ্দুস। প্রাকৃতিক পরিবেশে মাঝেমধ্যে বের হওয়াটা মন্দ নয় বলে রশীদ স্বীকার করল।সে দম ছেড়ে ডানে তাকাল।কেউ নেই। এরপর বামে তাকিয়ে দেখল দূরে কুদ্দুস পা বিছিয়ে ঘাসের উপর বসে আছে।

রশীদ খুশি হল। কুদ্দুস তাঁকে ছেড়ে যায়নি। সত্যি সত্যি ছেড়ে গেলে নদীর তীরে নয়,বরং গ্রাম ছেড়েই চলে যেত। রশীদ হাঁফ ছেড়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। কুদ্দুস আড়চোখে রশীদ কে দেখেছে।দেখেও না দেখার ভান ধরছে এখন।রশীদ কুদ্দুস এর ঘাড়ের কাছে ছড়ি ঠুকে বলল “কালু,তুই অনেক বড় অন্যায় করেছিস,আজ সারাদিন আমি তোর জন্য অপেক্ষা করেছি।আর তুই এখানে এসে বসে আছিস!” রশীদ ভাবছে কুদ্দুস জবাব দিবে। কিন্তু না।ও মুখ গম্ভীর করে বসে আছে।কোন প্রতিক্রিয়া করছে না। রশীদ নীরব কন্ঠে আবার বলল “আমি ভেবেছিলাম তুই সত্যি সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে গেছিস, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না,আমি আমার সেবার জন্য সঠিক কাউকে বেছে নিয়েছি।তুই আমার সাথে আর রাগ করিস না।

আমি আর তোকে বকাঝকা করব না। কিন্তু তুই হয়ত জানিস না,আমি আমার রাগের মধ্যেই আমার ভালোবাসাটা প্রকাশ করতাম। তুই আমার রাগটাই দেখেছিস, ভালোবাসাটা না।” কুদ্দুস হাতে ভর দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নির্বিকার দৃষ্টিতে রশীদ এর দিকে তাকাল। এরপর নিশ্চুপ ভঙ্গিতে পথের উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। রশীদ দ্রুত হেঁটে কুদ্দুস এর পথ রোধ করে বলল “তুই আমার সাথে ভাব নিচ্ছিস,আমি তোর যেভাবে রাগ ভাঙ্গাচ্ছি সেভাবে আমার সহধর্মিণীরও রাগ ভাঙ্গাইনি। সারাদিন ধরে এখানে বসে ছিলিস,চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে,চল বাড়ি চল। আমাকে লোকজন দেখে ফেললে ভীর জমাবে। আবার অভিযোগ নিয়ে আসবে।” কুদ্দুস এবার মুখ খুলল।বলল “আপনি চলে যান।আমি আর তালুকদার বাড়ি ফিরব না। আপনার সাথে আর কথাও বলব না।”

রশীদ বলল “আহ্,এবার তুই বেশিই বাড়াবাড়ি করছিস।শোন,কারো অনূভুতি আর মন বদলানোর আগেই তাঁর ইচ্ছাকে মূল্যায়ন করতে হয়।এই দ্যাখ,তুই রাগ করে আছিস,আমি তোর রাগ ভাঙ্গাতে আসছি। কিন্তু বারবার আমার অনুরোধ কে তুই প্রত্যাখ্যান করছিস। এরপর যখন আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলব তখন আর তোর রাগকে মূল্য দেব না।”
কুদ্দুস দৃষ্টি আরেক-দিকে নিয়ে বলল “আপনার মন পরিবর্তন হোক। আমাদের তাতে কিছুই যায় আসে না।আমি যাব না আপনার সাথে।ফিরে যান।” বলে কুদ্দুস হাঁটা শুরু করলেই রশীদ ওর হাত ধাবা মেরে ধরল।

বলল “চল আমার সাথে।তুই যেতে চাইবি না আর আমি তা মেনে নেব।” বলে রশীদ কুদ্দুস কে টেনে হেঁচড়ে বাড়ির দিকে নিতে চাইল। কুদ্দুস ওর শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে দিল।ও কোনমতেই যেতে রাজি নয় রশীদ এর সাথে। রশীদ টেনে হেঁচড়ে কুদ্দুস কে নিতে পারল না। কুদ্দুস মাটিতে চিত হয়ে পড়ে যায়। রশীদ বলল “আমার টা খেয়ে শরীর বেশ মোটাতাজা করেছিস। অনেক ভারী তুই। হাঁপিয়ে গেছি।নাটক না করে উঠে চল আমার সাথে।”

কুদ্দুস মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বলল “আমি যাব না। আপনি ফিরে যান।আমি এভাবেই এখানে শুয়ে থাকব।”
“হতচ্ছাড়া তোর মুখে কুকুরে প্রস্রাব করবে।তখন বুঝবি মজা।ভালোয় ভালোয় উঠে আয়।”
“করুক। আপনি যতক্ষন না এখান থেকে যাবেন,আমি কুকুরকে প্রস্রাব করতেও বাধা দেব না।”
রশীদ এবার প্রচন্ড রেগে গেল।ঘাড় এর শিরা ফুলে গেল। কিন্তু কোনভাবে রাগ কে নিয়ন্ত্রন করে তাঁর সাথে থাকা দু’জন অনুচারী কে বলল “ওকে তুলে নিয়ে চল।ও নাকি যাবে না।তুই যাবি তোর বাপ যাবে।”
কুদ্দুস বলল “পারলে আমার বাপকে নিয়ে যান।তবুও আমি যাব না।” ও কথা শেষ করতে না করতেই অনুচারী দু’জন কুদ্দুস কে তুলে নিল। কুদ্দুস পা নাচিয়ে বলল “ছাড়ুন আমাকে।”
রশীদ বলল “বেশি ছটফট করিস না।মন পরিবর্তন হয়ে গেলে নদীতে ছুঁড়ে মারব।”
কুদ্দুস অনুচারীদের হাতের উপর থেকে বলল “আমি আপনাকে ছেড়ে দেব ভাবছেন,ম’রার পর ভুত হয়ে আপনাকেও জলে ডুবিয়ে মারব।”

দিন ফুরিয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে। সন্ধ্যা ঠিক সাতটা। সুফিয়ান লেবু দিয়ে চা করেছে। চায়ের কাপটা তাঁর সামনে। ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়া থেকে লেবুর গন্ধ আসছে। সুফিয়ান বেশ কিছুক্ষণ ধরে লিখতে ছিল। মাত্র কয়েক মিনিট এর জন্য বিরতি নিয়ে চা করেছে।ঘরের দরজাটা খুলে রেখেছে।একটু পরপর কাঁধের উপর দিয়ে রাঙার দিকে দেখছে।ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকাল রাঙা বেশ শান্ত হয়ে থাকে। অদ্ভুত মনে হয় রাঙার নিস্তব্ধতা সুফিয়ান এর কাছে।

চায়ে চুমুক দিল সুফিয়ান।পাশে কাপটা রেখে নিব কলমটি কালির দোয়াতে ডুবিয়ে পুনরায় লিখতে শুরু করেছে। ‘আজ ফারদিনাকে নিয়ে ঝর্ণা ঘাট যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ফারদিনা সংবাদ পাঠিয়েছে সে সুযোগ করে ঘর থেকে বের হতে পারেনি।ফারদিনা কখনো সুযোগ করতে চেয়েছে,আর সুযোগ হয়নি এমনটি কখনো হয়নি।আজ হয়েছে।ফারদিনা বারবার বলছে,তাঁকে নিয়ে যেন দূরে চলে যাই। কিন্তু আমি কাপুরুষ এর মত লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে চাই না।আমি রশীদ তালুকদার এর সাথে কথা বলব। ওনাকে মানানোর চেষ্টা করব। আশাকরি উনি মানবেন। কিন্তু কোনভাবে যদি আমার ধারণা ভুল হয়, সেদিন আমিই ফারদিনাকে নিয়ে চলে যাব।দূর দেশে। যেখানে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।পুচকি একটা মেয়ে বাবু হবে।

সারাদিন দুটো বাচ্চা কে সামলাব।ফারদিনা আমার কাছে একটা বাচ্চার মত।একজন পুরুষের কাছে তাঁর সখের নারী বাচ্চার মত।সে বাচ্চার মত তাকে লালন-পালন করে।’ সুফিয়ান লেখা থামাল।অমৃত এক হাঁসি আনল ঠোঁট এর কোণে।বা হাতে গালের ভর দিয়ে ভাবল ফারদিনার কথা। তাঁর বাচ্চাসূলভ আচরণ তাঁকে ভাবায়, কখনো মুগ্ধ করে।কখনো হাসায় তো কখনো রাগায়।

চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দিল। কলমটি তুলে আবার লেখা শুরু করল। কবিতা লিখতে চাইলো।কিন্তু আজ কবিতার লাইন মনে পড়ছে না।চোখ বুঁজে ফারদিনার রুপ ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তাঁর রুপ অপার্থিব সুন্দর।যেন স্বর্গীয় পরী। সুফিয়ান চোখ মেলে তাকাল। নিঃশব্দে হেসে লিখল -‘তোমার রুপের সৌন্দর্য বাঁধানো একটি রত্নে’ যতবার তোমার রুপ ভেসে উঠে আমার নয়নে, ততবারই আমি হারিয়ে যাই অসীম প্রেমের সীমান্তে-

একাধিক লোকের পায়ের আওয়াজ পেল সুফিয়ান।লেখা বন্ধ করে ঘরের বাইরে এল। জেবুন্নেছা এসেছে।সাথে চারজন অনুচারী। জেবুন্নেছা হেঁয়ালিপূর্ণ ভাবে বাড়ির চারদিকে তাকাল।তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে সুফিয়ান এর বাড়ি।সে সেই চোখেই দেখছে। সুফিয়ান জেবুন্নেছার কাছে এগিয়ে বলল “আপনি এখানে?কি জন্য এসেছেন?
“গ্রামটাই তো আমাদের।যখন যেখানে খুশি যেতে পারি। তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে না কি!”
“বলতে হবে, পুরো গ্রামটা আপনাদের নামে লিখে দেয়নি সরকার। সামান্য জমিদার আপনারা। সামান্য দায়িত্বে আছেন। তারমানে এই নয় যে সবাইকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছেন।”

“তোমার খুব তেজ দেখছি।চার আনার রাখালের বড়বড় কথা‌!”
“চার আনার রাখাল এর এত বড় কথা, যদি দশ আনার হতাম তাহলে এতক্ষণে আপনাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দিতাম না। আমার তেজ এর আগুনেই জ্বলে পু’ড়ে ছা’রখার হয়ে যেতেন।”
জেবুন্নেছা তিক্ত স্বরে মুখ চিমটি কেটে বলল “তোমার সাথে আমি ঝগড়া করতে আসিনি।আর তোমাকে দেখলেই আমার গা কেন জানি জ্বলে উঠে। না চাইতেও ঝগড়া হয়ে যায়।”

The Silent Manor part 29

“সা’প আর বেজির মত। আপনি বেজি আমি সা’প।যে সে সা’প না,বিষাধর সা’প।ছোবল দেয়ার আগে কেটে পড়ুন।”
“শোনো রাখাল,আমি একটা সংবাদ দিতে এসেছি। ঝগড়া করতে না।”
“আমিও একটা সংবাদ দেব।সত্য ঘটনা জেনেছি। আপনি আগে বলবেন না আমি?”
জেবুন্নেছা চোখ মুখ লাল করে বলল “তুমিই আগে বলো’
সুফিয়ান ফিসফিসিয়ে বলল“আপনি আপনার স্বামী কে নিজের হাতে খু’ন করেছেন।আমি কিন্তু সব জেনে গেছি।”

The Silent Manor part 31

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here