The Silent Manor part 10

The Silent Manor part 10
Dayna Imrose lucky

আরিবের কথার রেশ টেনে সায়েম বলল “হুম ভাই, ওকে কুমিরের কুপে ফেলে দাও।তাজা মানুষ পেয়ে ওর ভীষণ আনন্দ হবে।দাও দাও’ বলে স্বশব্দে হেসে উঠলো সায়েম।রায়ান তখন হাত থেকে চাপাতি টা ফেলে দিল। এরপর কাতরানো লোকটিকে তুলে কুপের মধ্যে ফেলে দিল।সবাই আনন্দে মেতে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ কিসের তা ফারদিনার কাছে অজানা। তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।স্বপ্ন না সত্যি বুঝতে পারছে না। সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।ফারদিনার চোখ গুলো মার্বেল পাথর এর মত হয়ে গেল।অবশ হয়ে গেল পা। তখনি পেছন থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে ‘কি করছিস তুই এখানে?

হঠাৎ কারো কন্ঠের স্বরে ফারদিনা চমকে উঠল। পেছন ঘুরে দেখল আদিব।ফারদিনা আদিবের সম্মুখীন হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ‘ভাই তোমার সাথে কথা আছে আমার।’ বলে ফারদিনা আদিবের হাত ধরে নিয়ে গেল তাঁর ঘরে।
ফারদিনা ঘরে ঠুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। নিজেকে কোন ভাবে সামাল দিল।আদিব বরাবরই শান্ত চুপচাপ।সে একটা চেয়ারে বসে। এরপর একটা সিগারেট বের করল।সেটি ধরিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল “কিছু হয়েছে?আর তুই এভাবে হাপাচ্ছিস কেন?
ফারদিনা আদিবের পায়ের কাছে বসল। এরপর বলল “আমি হাঁটতে হাঁটতে ঐ গোপন ঘরে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐখানে যা ঘটলো তা দেখার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি দেখেছিস? নীরব প্রশ্ন আদিবের।
“ঐ গোপন ঘরে,একটা লোককে নৃ’শংস ভাবে হ’ত্যা করেছে আমার তিন ভাই মিলে।ঐ ঘরের কুপতাটে কুমির ছিল। কুমিরের খাদ্য কি মানুষ হতে পারে ভাই?’ ফারদিনার প্রচুর কষ্ট হল।আদিব দৃষ্টি সরিয়ে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ রইল। এরপর ক্ষীণ চোখে জবাব দিল “যা দেখেছিস, ভুলে যা।তোর আর আমার কিছুই করার নেই।আমিও জানি না ওরা কুমিরের খাদ্য হিসেবে মানুষ কেন বেছে নিয়েছে?”
“মানুষের থেকে কি কুমিরের বেঁচে থাকা বেশি মূল্যবান?
আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য কখনো অন্যকে স্বার্থপরের মত বিপদের মুখে ঠেলে দিতে হয়।কখনো জীবন কেড়ে নিতে হয়।”

“এর মানে? ফারদিনা উঠে দাঁড়ালো।
আদিবও উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে করতে জবাব দিল “তুই তো জানিস,আমরা যেখানে অবস্থান করছি এটা একটা প্রাসাদ ছিল।যে প্রাসাদের নাম দেয়া হয়েছিল সাইলেন্ট ম্যানর’।নামটি দিয়েছিল ব্রিটিশ একজন যোদ্ধা আলগেমি ফর্ন্ডআর্ট্রিস্ট।ওনারা এই অঞ্চলটি যখন দখল করতে আসে তখনই প্রাসাদটি চোখে পড়েছিল সর্বপ্রথম।আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই প্রাসাদটি যিনি তৈরি করেন তিনি ছিলেন রাজা সিরাজউদ্দৌলার পূর্ব তৃতীয়তম বংশধর।উনি এমন ভাবে এটি তৈরি করেছিলেন যাতে বাইরে থেকে শত্রু বাহিনী দেখে বুঝতে পারে ভেতরে কেউ নেই। প্রাসাদ ফাঁকা। সুনসান নিস্তব্ধ।এবং ওদের যেন রহস্যময় মনে হয়।আর ওরা ভেতরে এলেই আক্রমণ করত।আর ওরা যখন প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইত তখন ওদের একটি চামড়ার সেতু পাড়ি দিতে হত। এবং ওরা যখনই সেতুতে পা রাখত,তখন অপরপ্রান্ত থেকে সেতুর দড়িটি কেটে দেয়া হত।আর ওরা সেতুর নিচে অবস্থিত পরিখার মধ্যে পড়ে যেত।পরিখার ভেতরে থাকত কুমির।কুমির ওদের খেয়ে ফেলত।ব্যস। শত্রু শেষ।” আদিব সিগারেট ফেলে দিল।

ফারদিনা আশ্চর্য হয়ে বলল “তাঁরা নেই আজ বহুবছর।কত সময় তা আমরাও বলতে পারব না। কিন্তু সেই রাজার কি হয়েছিল যিনি এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন?ত
“মায়া গেছে‌। এরপর তাঁর ছেলের বংশধর, সে-ই বংশের নতুন বংশধর হতে হতে এক সময় পতন ঘটে। এরপর জমিদার বংশ দখল করে এই প্রাসাদ। প্রাসাদ বদলে হয়ে যায় জমিদার বাড়ি।”
“কিন্তু,সেই পূর্বের ঘটনার সাথে আজকের ঘটনার সংযোগ কোথায়?
আদিব ফারদিনার কাছে এল। তাঁকে খাটের উপর বসিয়ে নিজেও সামনে বসল।এরপর বলল “সংযোগ আছে। সাইলেন্ট ম্যানর’ এর মানুষ গুলো দুনিয়া থেকে চলে গেলেও প্রাসাদের কাঠামো কিন্তু আগের মতই আছে। শুধু পরিখার বিষয়টি বদলে গেছে। সেই কত আগের কুমির কি এখনো বেঁচে থাকে! অবশ্যই না।সেই ফাঁদ অর্থাৎ কুমিরের পরিখা এখন মাত্র একটা আমারে ভাষায় পুকুর।’

ফারদিনা এবার একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল “তাহলে ঐ গোপন ঘরে কুমিরের কুপ কিভাবে আসলো?
“এইতো এবার সঠিক প্রশ্ন করেছিস’শোন, পূর্বের রাজাদের ফাঁদের কথা আমাদের আব্বা এবং আমাদের তিন ভাই যখন জানে তখন কুমিরের জন্য একটু কুপ তৈরি করে। আমাদের বাড়িটির ভেতরে একটি ফাঁদ আছে।কুমিরের ফাঁদ। শত্রু পক্ষ যদি কখনো আমাদের আক্রমণ করতে চায় তখন ওঁরাও ঠিক রাজার শত্রুদের মতই মরবে।”
“কিন্তু, ওদের যে মানুষ খেতে দেয়ার হয়?এটাও কি আব্বা জানেন?’
“না।আব্বা,এই বিষয়ে কিছুই জানেন না।”
ফারদিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল “আচ্ছা, সে-ই ফাঁদে যদি কখনো আমি পড়ে যাই?

“কোন সুযোগই নেই। কেননা সে-ই ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে ব্যতিক্রম গোপন পথের জন্য।আমরা সবসময় আমাদের পথে চলাফেরা করি। কিন্তু শত্রু পক্ষ সবসময় ব্যতিক্রম পথ খোঁজে।বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার জন্য।”
“ভাই, মানুষ কেন, পশুদের ও তো কুমিরের খাদ্য হিসেবে দেয়া যায়।!”
দীর্ঘশ্বাস এলো আদিবের। “বলেছিলাম।কিন্তু, কুসংস্কার ওদের এসব করতে বাধ্য করছে। একজন জ্যোতিষী ওদের বলেছে কুমির কে যদি মানুষের মাংস খাওয়ায় তবে,শত্রুপক্ষ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে।” আদিব থেমে আবার বলল ‘আমি এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না। তবে আমার বাঁধা দেয়ার ও অধিকার নেই।’
“আব্বাকে আমি জানাব।এই অন্যায় আমি হতে দিতে পারি না।”

“না বোন” বাঁধা দিল আদিব। “আমরা দূর্বল।আমরা হেরে যাব। ওদের সাথে আমরা লড়তে পারব না। অনুরোধ,তুই যা দেখেছিস ভুলে যা।আব্বা এসব জানতে পারলে ভেঙ্গে পড়বে।তুই কি এসব চাস?
“না” মাথা আওড়ালো ফারদিনা। তাঁর চোখ বেয়ে জল পড়ল।
আদিব ফারদিনার চোখের জল মুছে দিল।তাকে বুকে আঁকড়ে ধরে বলল “আমি আর কিছুই চাই না। শুধু এতটুকুই চাই,তোকে একটা সুপাত্রের হাতে তুলে দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দেব।এই পাপের রাজ্যে তোকে রাখব না।”
ফারদিনা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল “আমি তোমাকে এই নিষ্ঠুর মানুষ গুলোর কাছে ফেলে রেখে কখনোই যাব না ভাই,আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

“কখনো ভালোবাসার জন্যও দূরে যেতে হয় জানিস তো!’
ফারদিনা আর কি বলল না। শুধু দৃষ্টি নিচু করে রাখল। ঠিকই সে-ই মুহূর্তটাতে তাঁর মনে পড়ল আদিব কিছুক্ষণ আগে কোথাও গিয়েছিল।খুব উদ্বিগ্ন ছিল সে,যা শরীরের ভঙ্গিতে প্রকাশ হচ্ছিল। কিন্তু কেন?ফারদিনা যেন কোন প্রশ্ন চেপে রাখতে পারে না।সে এখনি প্রশ্ন করল “আচ্ছা ভাইয়া, তুমি কি কিছুক্ষণ আগে কোথাও গিয়েছিলে? না মানে,আমি দেখেছি তুমি খুব তাড়াহুড়ো করে বাড়ির ভেতরে ঠুকেছিলে আর এক অনুচারীকে কিছু দিয়েছো”
আদিব কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল যেন। এরপর বসা ছেড়ে উঠে বেশ নরম কন্ঠে জবাব দিল “একজন অসহায় কে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম।তুই তো জানিস,আব্বা এসব পছন্দ করেন না।তাই লুকিয়ে যাই।আর অনুচারী দেখে ফেলায় ওকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দেই।”

ফারদিনা আনন্দিত হল। “আমি জানি ভাই,এই কঠিন নিয়মের বাইরে গিয়ে তুমি ই পারবে অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে।”আদিব কাঁধের উপর থেকে ফারদিনার দিকে তাকাল। এরপর তাঁর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ফারদিনার মনে পড়ে রাখালের কথা।সে বলেছিল আদিব এর কথা।তাঁদের দুজনের মধ্যে কিসের সম্পর্ক তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করল সে।এসব ভাবতেই আদিব এর ঘরের দিকে রওনা হয় ফারদিনা। তাঁর ঘরের সামনে পৌঁছে দেখে দরজা হাট করে খোলা।ফারদিনা অনুমতি না নিয়েই ঘরে প্রবেশ করে।আদিব ঘরে নেই।ফারদিনা একটু বিস্মিত হল। ঘরের ভেতরে আর একটি ঘর। সেখানে ফারদিনা গেল।গিয়ে দেখল আদিব হাতে মোমবাতি নিয়ে একটা পেইন্টিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ফারদিনা দৃঢ় চোখে দেখল পেইন্টিং এর দিকে। কৃষ্ণপুর গ্রামের অন্যতম জমিদার এর মেয়ে নূরজাহান এর পেইন্টিং।বলা হয় কৃষ্ণপুর গ্রামে তাঁর মত সুন্দরী নারী আর নেই। কিন্তু আদিব তাকে দেখছে কেন? প্রশ্ন জাগে ফারদিনার মনে!

সে ডাকল আদিব কে “ভাই,’ আদিব বিষ্ময়ে ঘুরে তাকাল।সে ফারদিনার উপস্থিতির জন্য যেন প্রস্তুত ছিল না। দ্রুত ঘরটি থেকে বেরিয়ে গেল।
হাতের মোমবাতি টা টেবিলের উপর রাখল। এরপর ইজি চেয়ার বসে আদিব।ফারদিনা তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
“তুই হঠাৎ এখানে কেন! আদিব জিজ্ঞেস করল। এরপর একটি সিগারেট ধরাল।
“ভাই, নূরজাহান এর ছবি তোমার কাছে কিভাবে আসলো? ওকে তাকে তুমি কেন দেখেছিলে?
আদিব কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল “তোর কাছ থেকে তো কিছুই লুকাই না।আজ ও লুকাবো না। ‘নূরজাহান’ সে যেন আঁধার রাতের জোনাকির মতন। কৃষ্ণপুর গ্রামের অন্যতম সুন্দরী নারী। গ্রামের সব পুরুষই তার জন্য পাগল ছিল।ওর বাবার সাথে আমাদের এক সময় শত্রুতা ছিল। একবার বড় ধরনের ঝামেলা হয়। পাটের ব্যবসা নিয়ে। সে-ই সময়ে দুই পক্ষ মিলে একটা সভার আয়োজন করেছিল। কিভাবে সমস্যা সমাধান করা যায়!আর সেখানেই আমি নূরজাহান কে দেখেছিলাম।ওর রুপে মুগ্ধ হয়ে যাই। জীবনে প্রথমবার যেন কারো উপর এতটা মুগ্ধ হই। এরপর সেদিনের সভায় আমি ওর জন্য আমাদের পরাজয় মেনে নেই। বিষয়টি নূরজাহান বুঝতে পেরেছিল।কারণ,দোষ ওদের ছিল।” এতটুকু বলে থেমে গেল আদিব।

“তারপর কি হয়েছিল?
“সময় সুযোগ করে নূরজাহান কে আমার মনের কথা বলে দেই। নূরজাহান বলে ভেবে ওর সিদ্ধান্ত জানাবে।আমি অপেক্ষায় রইলাম।ওর সিদ্ধান্ত এর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আরো ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। ভালোবেসে ফেলেছিলাম অনেক।” থেমে গভীর শ্বাস ছাড়লো আদিব। সিগারেট এ লম্বা করে টান দিল।
“তারপর?
“আমি ঠিক দুই সপ্তাহ পর ওদের গ্রামে যাই।গিয়ে জানতে পারি মিশরের এক নাবিকের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর কেটে গেছে নয়টি বছর।আর ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।আজ ও না।”
“গ্রামটি কোথায়?আর তাঁদের জমিদারি এখনো আছে?
“এখান থেকে অনেক টা দূরে। আগের মত আর ওদের গ্রাম নেই।জমিদারিও নেই।আমাদের আমিলনগর গ্রামটিতেই এখন সবার বসবাস।আর এখানকার জমিদারির সমস্ত ক্ষমতা আমার আব্বার।” থেমে আদিব কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল “জানিস এই দুনিয়াতে সবচেয়ে সুন্দরতম অনূভুতি কিসে?

“কিসে?
আদিব ফারদিনার দিকে তাকিয়ে বলল “এই দুনিয়াতে সবচেয়ে সুন্দরতম অনূভুতি হচ্ছে কারো প্রেমে পড়া।’আর সবচেয়ে কঠিন অনূভুতি হচ্ছে নিজের সখের মানুষ টি কে অন্যর সাথে ভাবা।”
ফারদিনা চুপচাপ।আদিব সিগারেট মাটির একটি পাত্রে ফেলে দিল। এরপর ফারদিনার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল “আমার ভালোবাসা সত্য ছিল। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ টি ভুল ছিল। কিন্তু আমি চাই,তুই কারো প্রেমে পড়। সঠিক এবং সৎ কারো।তোর সুখটা আমি দেখতে চাই।”

দিন ফুরিয়ে সকালের সূর্যটা যেন সবেই উঁকি দিল।আকাশে তখন হালকা রোদ উঠেছে। গাছের পাতায় শিশিরের ফোঁটা ঝুলছে,যেন রুপোর দানা।জমিদার বাড়ির সামনের পুকুরঘাটে ঢেউগুলো ধীরে ধীরে কূলে এসে লাগছে।
বাড়ির ভেতর বড় উঠোনে মাটির ঘ্রাণ ভাসছে। দাসীরা ঝাঁটা হাতে উঠোন পরিষ্কার করছে, ঝাঁটার শব্দে হালকা ধুলো উড়ে এসে আলোয় মিশে যাচ্ছে।রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে চাল ধোয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, সঙ্গে ভাজার গন্ধ।মনে হয় ঘি আর পেঁয়াজের গন্ধ একসাথে মিশে গেছে।

রশীদ তালুকদার বারান্দায় বসে আছেন। এক হাতে চা, অন্য হাতে সিগারেট।দূরে দাসেরা মাথা নিচু করে সালাম জানাচ্ছে।দোতলা থেকে তাঁর বড় ছেলে রায়ান এল।সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা, চোখে শান্ত ভাব।সে রশীদকে পায়ে সালাম করল, তারপর পুকুরের দিকে হাঁটল, যেন সকালের নিস্তব্ধতা ভাঙতে চাইল।
পাশের কোণ ঘর থেকে মৃদু হারমোনিয়ামের সুর ভেসে আসছে।ফারদিনা গাইছে আগের সময়ের প্রাচীন ব্রজবুল্লি গান। ছোট্ট বেলা থেকেই ফারদিনার গানের প্রতি ছিল বেশ টান।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিল সে। গতকাল রাতের দৃশ্য সে ভুলতে চাইছে।ভাবছে গানের সুরে যদি সব ভুলে যাওয়া যায়,তবে মন্দ নয়।সে গাইছে গলা ছেড়ে।তার গলায় যেন ভোরের পাখির ডাক মিশে গেছে।এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, বাড়িটা শুধু গরিমা নয়, এক শান্ত মায়ায় ভরে গেছে।

দালানে দালানে হাঁটছে দাসেরা।কেউ পানি নিচ্ছে, কেউ চিঠি নিয়ে ছুটছে কাচারিঘরের দিকে।
আজোও খাজনা আদায়ের দিন। গ্রামের মানুষ আসবে জমিদারের সামনে নত হয়ে দণ্ডবৎ প্রণাম করতে।তবু এই সকালটা অন্যরকম।আকাশ নীল, বাতাসে পাকা ধানের গন্ধ।

বেলা ঠিক এগারোটার দিকে। গতকাল অনেকেই খাজনা দেয়নি।আজ অনেকে হাজির হয়েছে। রশীদ তালুকদার ছড়ি হাতে বসে আছে ঠিক বাড়ির সামনেই। সাথে তাঁর চার ছেলে ও অনুচারীগন।ফারদিনাও এসে দাঁড়ায় আদিব এর পাশে।একে একে এসে অনেকেই চাল,ধান দিয়ে যাচ্ছে।কেউ কম দিলে রশীদ তাকে কটু কথা শোনায়। এবং নির্দিষ্ট সময় দেন বকেয়া দেয়ার জন্য।একে একে সবার দেয়ার শেষে হাজির হয় সুফিয়ান।ফারদিনার চোখ পড়ে তাঁর দিকে। সাধারণ পোশাক তাঁর পরনে। সাদা রঙের পাঞ্জাবি এবং পাজামা। তাঁর উপর মেরুন রঙের শাল পেচানো‌।মাথায় পাগড়ি।কালো রঙের পাগড়ির সাথে খোঁচা খোঁচা দাড়ি যেন তাঁর সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। তাঁর চওড়া পেশীবহুল ভারী সুদর্শন, পুরুষ এর সাথে যেন রাখাল শব্দটি কোনভাবেই যায় না।ভাবে ফারদিনা।তাঁর হাতে ছিল চাল।চালের বস্তা টা রশীদ তালুকদার এর সামনে রাখল। এবং সে-ই সাথে ভারী কন্ঠস্বর নিয়ে বলল “মেপে দেখুন ঠিক আছে কিনা?

পাশ থেকে আদিব বলল “ঠিকই আছে।আর মাপতে হবে না। ভেতরে চল।’
সুফিয়ান বলল “আজ না।কাজ আছে।যেতে হবে।অন্য একদিন’ বলে একবার ফারদিনার দিকে দেখল। এরপর তাঁর পথে চলতে শুরু করল।ফারদিনা তখন সবার নজর এড়িয়ে সুফিয়ান এর পেছন পেছন গেল। কিছুদূর গিয়েই সুফিয়ান বুঝতে পারল তাঁর পেছনে কেউ।সে ঘুরে তাকালো।ফারদিনা স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেল। উশখুশ করতে শুরু করল। সুফিয়ান বলল “আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন?

“আমি আসলে তোমার সাথে কথা বলার জন্য এসেছি।”
“কি কথা?
ফারদিনা থতমত খেয়ে বলল “আদিব ভাইয়ের সাথে কথা বলেছিলাম।সে বলেছে তোমার অভিযোগ নিয়ে সে আব্বার সাথে কথা বলবে।”
“এটা জানানোর জন্য এখানে এসেছেন?
“হ্যাঁ,কেন অসুবিধা হয়েছে তোমার?
সুফিয়ান পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করতে করতে বলল “পাড়ার কেউ দেখে ফেললে সমস্যা।মান সম্মান এর একটা বিষয় আছে।”
“এত ভয় তোমার?
সুফিয়ান ভয়ের কথা শুনে ফারদিনার দিকে চোখ তুলে তাকায়। তাঁর চোখের ভাষায় যেন অপ্রকাশিত বাক্য রয়েছে।যা সে নিরবতায় যেন বোঝাতে চাইছে। “পুরুষের আবার ভয়, আমি কাউকে ভয় টয় পাই না। কিন্তু বিনা দোষে দোষী হতে পারব না।”

ফারদিনা কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। সুফিয়ান তাঁর অভিব্যক্তি বুঝতে পারল।এরপর একবার আশেপাশে তাকালো।কেউ নেই।ফারদিনার দিকে এগিয়ে বলল “কিছু বলার আছে?
‘প্রশ্ন করলে? ফারদিনা চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল।
“জানতে চাইলাম।’ ফারদিনা কিছু বলছে না। তাঁর নিরবতা দেখে সুফিয়ান বলল “আমি চলি,কাজ আছে। আপনি সাবধানে বাড়ি ফিরে যান।”
“তুমি কোথায় যাচ্ছ?
“আমি চৌরঙ্গী হাট বাজার এর দিকে যাব।কাজ আছে।’
“ফিরবে কখন?
“সময় হলেই।”
“তুমি সোজাসাপ্টা জবাব দিতে পারো না? রেগে গেল ফারদিনা।

সুফিয়ান ফারদিনার রাগ দেখে হেসে উঠলো।সে যেন বহুদিন হয়ে গেছে হাসে না।আজ মন খুলে হাসল।ফারদিনা শুধু অপলকে চেয়ে রইল।একজন পুরুষের হাঁসি এত সুন্দর হতে পারে,সে জানত না।এই হাসিতে যে কোন মেয়ে যেন আকৃষ্ট হয়ে যাবে।মনে মনে স্বীকার করল সে।
সুফিয়ান থেমে বলল “আমার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। এখন চলি।’ বলে চৌরঙ্গী হাটের পথে হাঁটা শুরু করল। কিছুদূর যেতেই একটা গরুর গাড়ি সামনে পড়ল।সে গরুর গাড়ি তে করে চলে যায়।ফারদিনা মুগ্ধ হাঁসি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। এতক্ষণ তাঁর এবং সুফিয়ান এর কথোপকথন খেয়াল করছিলো তার ফুফু জেবুন্নেছা।সে প্রচন্ড রেগে গেল।তবে ক্ষোভ প্রকাশ করল না এই মুহূর্তে।

ঝিলমিল।একজন বিশ্বস্ত দাসী ফারদিনার। সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে। চুলগুলো সবসময় ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখে।লাল ফিতে।লাল রং ঝিলমিল এর খুব পছন্দ।ফারদিনা তাঁর নাম দিয়েছে মুচমুচি আর টুংটাং।এই নামের পেছনে কারণ আছে। ঝিলমিল সারাদিন ই কিছু না কিছু খেতে থাকে।তাই তাঁর একটা নাম দিয়েছে মুচমুচি। টুংটাং।যখনই ও কোন কাজ করে তখন ওর কাজে শব্দ হবেই।হয় কিছু ফেলে দিবে ফ্লোরে নয়ত ভেঙ্গে ফেলবে। এইজন্য তাঁর আরেক নাম দিয়েছে টুংটাং।ফারদিনা যখনই ঝিলমিল কে ডাকে তখনি বলে ‘এই মুচমুচি শোন’। ঝিলমিল ও তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। ঝিলমিল এসেছে তাঁর ঘরে। চুলের বেনুনি টা এদিক সেদিক নাচাচ্ছে।
ফারদিনা ঝিলমিল কে ফিসফিসিয়ে বলল “একজায়গায় যাব। তোর আমার সাথে যেতে হবে।’

‘কই যাইবা এই রাইতে’বড় ভাইরা দেইখা ফালাইলে মহা বিপদ।”
“তুই থাকতে কিভাবে জানবে,তোর মাথায় যে বুদ্ধি।’
“হইছে,এহন কও কই যাইবা?
‘সুফিয়ান আছে না,যে বাঁশি বাজায়।যাকে সবাই রাখাল ছেলে বলে চিনে ওর বাড়িতে যাব।’
ঝিলমিল মুখের হাবভাব পরিবর্তন করে হেঁয়ালিপূর্ণ ভাবে বলল “ওই সুফিয়ান,ওরে কিন্তু আমার খুবই ভালো লাগে,কি সুন্দর ও।ওরে যদি নিজের কইরা পাইতাম।’
“চুপকর টুংটাং।এখন চল।’
“কিন্তু কারণটা কি?
“পড়ে বলব।’

ফারদিনা ও ঝিলমিল রাতের আঁধারে সুফিয়ান এর বাড়ি উপস্থিত হয়।মাটির ওপর উঁচু একটা পাটের তলা। দেয়াল বাঁশ আর মাটির মিশ্রণ, ছাদ খড় আর বাঁশের তৈরি। ভিতরে একমাত্র ঘর, যেখানে সুফিয়ান থাকে। ছোট জানালা দিয়ে ধুলো-আলো ঢোকে, এবং ঘরের এক পাশে কাঠের এক ছোট আলমারি।পাশে চৌকি। বারান্দা নেই, সরাসরি মাটির পথের সঙ্গে ঘর জুড়ে। ঘরটিতে শুধু স্লিপিং ম্যাট আর কয়েকটি জিনিসপত্র।সবই যেন সাদামাটা, গ্রামীণ জীবন অনুযায়ী।

ঘরের সামনে খুঁটির সাথে জ্বলছে মশাল। তাঁরা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।ঘরের চারপাশে লন্ঠন জ্বলছে। টেবিলের উপর মোমবাতি। তাঁর আলো ধরে সুফিয়ান বসে বসে কিছু লিখছে। টেবিলের একপাশে কিছু বই। সুফিয়ান ফারদিনার উপস্থিতি টের পেয়ে কাঁধ এর উপর থেকে ঘুরে তাকাল।ফারদিনা ও ঝিলমিল চাওয়াচাওয়ি করল। ঝিলমিল চলে যায় ঘর থেকে। সুফিয়ান দাঁড়িয়ে বলল “আপনি এই রাতে এখানে?
“তোমাকে দেখতে আসলাম। অসুবিধে হল?
“না। কিন্তু এসেছেন কেন?
“তোমাকে দেখতে বলেছি তো।’

“সত্য বলা মনের জন্য ভালো।’ বলে সুফিয়ান চেয়ারে ফারদিনাকে বসতে বলে।সে বসে। টেবিলের উপর বই দেখে সে জিজ্ঞেস করল “এগুলো কিসের বই?
“গল্প। প্রেমের গল্প। কিছুক্ষণ আগে একটা বই শেষ করলাম। গল্পের নায়িকা ছিল জোৎস্না।যার রুপে নাকি রাতের অন্ধকার পরিষ্কার ভাবে দেখা যেত।”
“তোমার জীবনে জোৎস্নার মত কেউ আছে?
“উমম পড়ে একদিন বলব।’
ফারদিনা আবার ঘুরে ছোট্ট টেবিলটির দিকে দেখল। কিছু সাদা পৃষ্ঠায় ধাতব নিব দিয়ে কিছু লেখা। পৃষ্ঠাটা ফারদিনা হাতে নিতেই সুফিয়ান টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে নেয়।

“কি লেখা?
“গল্প!
“তুমি গল্প লিখতেও পারো?
“চেষ্টা করি’
“কাল্পনিক?
সুফিয়ান ভেবে বলল “বাস্তবতা নিয়ে লিখতে চাই।’
“প্রেমের গল্প?
“বোধদয়।’ বলে মৃদু হাসে সুফিয়ান।
কিছুক্ষণ নিরবতা কাটল। ওদিকে ঝিলমিল পাহারা দিচ্ছে।ফারদিনা আগ বাড়িয়ে বলল “আজ আমি শিমুল তলায় আসতে বলেছিলাম।আসলে না কেন?
“আমি গেলে এখানে আপনি আসতেন?

The Silent Manor part 9

“তুমি খুব শেয়ানা। খুব ভালো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারো।”
সুফিয়ান কিছু বলবে ঠিক তখনই ঘরের বাইরে থেকে এক শক্ত কন্ঠস্বর ভেসে এলো। “সুফিয়ান,ঘরে আছো? মজিদ মিয়ার গলা। সুফিয়ান বাইরে এল। ‘কি হয়েছে চাচা?
“গত কয়দিন ধইরা সামসুল এর দুধের পোলাডারে পায় না।হুনছি গত বৃহস্পতিবার রাইতে তিনজন মিলা ঘুমাইছে। সামসুল ওর বউ আর দুই বছরের পোলা পাঁচু। সকালে দেহে পাচু নাই।….

The Silent Manor part 11

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here