The Silent Manor part 19

The Silent Manor part 19
Dayna Imrose lucky

নদীর তীরে সুফিয়ান ও সোলেমান বসে আছে, মন তার ভারী,চোখে কুয়াশা, জলে চাঁদ ঝাপসা আধো আঁধারি।মাঝিরা জাল ফেলছে ঢেউয়ের বুকে।নৌকায় লন্ঠন জ্বলছে। প্রকৃতি একদম নিস্তব্ধ।যেন বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ টা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে।তিনটে নৌকায় তিনজন মাঝি। একজন অন্য জনকে বলছে – ও মাঝি গান ধরো।নীরব রাইত ভাইঙ্গা দাও।সে মসৃণ কন্ঠে গান ধরলো।
হাওয়া বলো, কই নিয়ে যাও,
আমার প্রাণের তরী ভাসাও…
প্রেম যদি হয় নদীর ঢেউ,
তবু কেন সে তীরে আসাও?
চাঁদনি রাতে মন উদাস,
তুমি নাই, তবু আকাশ ভাস,
জীবনটাও ভেসে চলে,
তোমার স্মৃতির আশে-পাশে…
হাওয়া বলো, কই নিয়ে যাও,
আমার প্রাণের তরী ভাসাও…

সুফিয়ান নিষ্প্রান চেহারা নিয়ে বসে আছে।তার বুকের ভেতর নদীর মতোই ঢেউ উঠছে।মাঝির গানের সুরে যেন তার নিজের কষ্ট ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে জলের গভীরে।
পরপার কয়েকটি সিগারেট ধরিয়ে ছিল।একটা দুটো টান দিয়ে ফেলে দিয়েছে। সিগারেট শেষ। সোলেমান ওর পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিল। ইশারায় বোঝাল ‘সিগারেট চাই না।’
পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ আসছে। কাঁধের উপর থেকে সুফিয়ান ঘুরে তাকাল। লন্ঠন হাতে ফর্সা কেউ এগিয়ে আসছে।কাছে আসতেই স্পষ্ট হল মুখটি। আজমাত নুরবেক।সে এসে দাঁড়ায় সুফিয়ান এর পেছনে। সুফিয়ান এর রাগ উঠল।ফারদিনার সাথে সারাদিন কথা বলার চেষ্টা করে। অতিথি বলে ফারদিনাও সঙ্গ দেয়। সুফিয়ান এর এটা মোটেই ভালো লাগে না।চরম অন্যায় এটা ওর।রাগে শরীর জ্বলে উঠল।
সুফিয়ান এর পাশে বসল আজমাত। দু’জনের মাঝখানে সুফিয়ান।ডানে আজমাত বামে সোলেমান। আজমাত আগ বাড়িয়ে বলল “তুমি নিশ্চয়ই সুফিয়ান? তোমার কথা ফারদিনা অনেক বলেছে। সেদিন তোমাকে বিচ রোপণ করতে দেখেছিলাম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি জানি।ও সবার কাছেই আমার কথা বলে।” সুফিয়ান অকারণেই বিরক্ত হল। রাগ হল।এখানে রাগ করার মত কি বলেছে?আমি তোমাকে চিনি-তোমার কথা ফারদিনা সবসময় বলে। সাধারণ ব্যাপার। সুফিয়ান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল।
আজমাত বলল ‘নস্যি টানবে?
“না।এসব পছন্দ করি না। তুমি কোন দেশ থেকে যেন এসেছো?
“রাশিয়া তুর্কেস্তান।আমি কিরগিজ শহরে থাকি। আমার ছোট্ট বেলা থেকেই ঘোরাঘুরি পছন্দ।তাই এখানেও চলে আসলাম।এখানে না আসলে ফারদিনা কে পেতাম না।কত সহজ সরল সুন্দরী নারী।”
সুফিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। বিড়বিড় করে বলল “শা’লা,ইচ্ছে করছে তোকে নদীতে ডুবিয়ে মা’রি!”

“কিছু বললে?
“না। বলছিলাম, তুমি সাঁতার কাটতে জানো?
“হ্যাঁ।’
“তাহলে তোমাকে আর ডুবতে হবে না।”
‘মানে? সোলেমান ঠোঁট চেপে হাসল।
আজমাত নদীর দিকে দেখল। কিছু নৌকা ও মাঝি দেখা গেল।এরা কি করছে!সে বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল “ওনারা কি করছে?
সুফিয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হতাশ ভঙ্গিতে বলল “নদীতে জেলেরা মাছ ধরছে।মানে জাল ফেলছে।ওটা এমন জাল যা দিয়ে তোমাকে ও পেঁচিয়ে রাখা যাবে।আর ছুটতেই পারবে না।”
আজমাত হাসল। আনন্দ পেয়েছে তার কথায়। সুফিয়ান রাগ প্রকাশ করেছে।গা’ধা রাশিয়ান বুঝতে পারছে না। সোলেমান সুফিয়ান কে ফিসফিসিয়ে বলল “মনে হয় লোকটা আধা পা’গল!”

“পুরোটাই পা’গল।”
“আপনার নিশ্চয়ই হিংসে হচ্ছে।আমি বুঝি। নিজের ভালোবাসার মানুষটির নাম অন্য কোন পুরুষের মুখে শুনতে ভালো লাগে না।সে,যদি বাবা অথবা ভাই না হয়।”
সুফিয়ান ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। তাকে উদ্বিগ্ন দেখে আজমাত বলল “তুমি কোন কারণে চিন্তিত?
“তুমি জেনে কি করবে?
“যদি তোমার মনে হয় আমি সাহায্য করতে পারব,তবে বলতে পারো!”
“পারবে না।”
“বলেই দেখো”

সুফিয়ান নীরব।মাথার নিচে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সোলেমান চলে যায়।ওর দায়িত্ব পালনের সময় চলে এসেছে।বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করে গ্রামে টহল দেয়ার জন্য বের হবে।
রাত ঠিক দশটার কাছাকাছি। হঠাৎ চাঁদের আলো তলিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে।খন্ডে খন্ডে মেঘ উড়ে যাচ্ছে।মেঘ উড়ে যাওয়া শেষেই চাঁদের আলো নেমে আসল।
আজমাত নস্যি টানছে। সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল “আজ তুমি এখানে কেন?ফারদিনার সাথে আড্ডা দিলে না?”
“একা একা ভালো লাগছিল না। তোমাকে দেখেছি এদিকে আসতে।তাই আমিও এসেছি।”
“দুটো প্রশ্ন করেছি’একটার উত্তর পেয়েছি।” সুফিয়ান এর সোজাসাপ্টা প্রশ্ন। আজমাত নস্যি রেখে বলল “ফারদিনা কে সন্ধ্যার পর থেকে দেখিনি।”
সুফিয়ান শঙ্কিত হয়ে উঠে বসে। “দেখোনি মানে? রশীদ চাঁচা, আদিব,রায়ান তাঁরা কোথায়?
“তোমার রশীদ চাঁচা ঘরেই আছেন।চার ভাই কোথায় জানি না। ফারদিনা কে কোথাও পাইনি বলেই বাইরে বের হয়েছি।”

সুফিয়ান কিছুটা চিন্তিত হল। এরপর লম্বা একটা শ্বাস এর সাথে সমস্ত চিন্তাভাবনা দূর করল।বলল “রশীদ চাঁচা যখন ঠান্ডা মাথায় ঘরে আছেন এর মানে ওরা হয়ত কোন কাজ করছে।” আজমাত সুফিয়ান এর রেশ টেনে বলল “এটাই হবে। আচ্ছা তোমার আর ওর সম্পর্ক টা কি? বন্ধুত্ব?
সুফিয়ান কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল “আমি এতদিন সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম সম্পর্ক টা শুধু বন্ধুত্বে নয়,এর চেয়েও গভীরে চলে গেছে।আজ বিকেলে যখন ও জঙ্গলে বসে চিৎকার করল,তখন বুঝতে পারলাম,আমি ওর আর্ত’নাদ সহ্য করতে পারব না।আজ সন্ধ্যার পর থেকে যখন ওর দেখা মিলল না,আমি চিন্তিত হলাম।এর মানে আমি ওকে ভালবাসি।”

“দুনিয়ার প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে ভালোবাসা রয়েছে। তাঁর মধ্যে শ্রেষ্ঠ জীব ভালোবাসা কে সুন্দর রুপ দিয়েছে।” আজমাত থেমে কিছু বলতে চাইল। সুফিয়ান বাকি কথা কেড়ে নিয়ে বলল “ভালোবাসাকে সব চেয়ে খা’রাপ এবং নিষ্ঠুর ভাবে পূর্ণ করে দেয় সেই মানুষ ই।’এটাই বলতে চেয়েছো তো?
আজমাত শব্দ ব্যতীত হেসে মাথা আওড়ালো হ্যাঁ।আমি এসব প্রেম ভালোবাসা বিশ্বাস করিনা। ভালোবাসায় ধোঁকা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই নেই।”
সুফিয়ান বলল “ভালোবাসা আমাদের পূর্ণ করে’ ভালোবাসাই আমাদের শূন্য করে।আমি ফারদিনাকে ভালোবাসি।তবে এখনো মুখ ফুটে বলিনি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’
আজমাত উৎফুল্ল হয়ে বলল ‘এর মানে প্রেম নিবেদন। তুমি ওকে এখনো প্রেম নিবেদন করনি?

‘উমম না।’
“কবে করবে?
“আমার গোলাপ গাছে পরবর্তী যেদিন গোলাপ ফুটবে সেদিন।”
“সময়টা কবে?
“অল্প কিছুদিন।”
“যদি গোলাপের পাপড়ি ঝড়ে যায়?
“ঝড়ে যাওয়ার আগেই আমি ওকে বলে দেব।”
“দ্রুত কর। আমি আবার ফিরে যাব রাশিয়ায়। তুমি জানো, রাশিয়া থেকে তোমাদের এখানে আসতে আমার দেড়মাস সময় লেগেছে। আমার দীর্ঘ ভ্রমণ ভালোই লাগে।”
“তুমি ফিরে যাওয়ার আগেই আমি ওকে প্রেম নিবেদন করব।”
আজমাত আশপাশে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলল “ফারদিনার বাবা, তাঁর ভাইয়েরা তোমাদের সম্পর্ক কি…” দ্বিধাবোধ করল আজমাত। সুফিয়ান বলল ‘কপালের লিখন,যদি আমার ভাগ্যে তাঁর নাম লেখা থাকে,তবে অবশ্যই ওকে পাব।নয়ত হাজার চেষ্টা করেও পাব না।”

“তুমি ভীষণ বুদ্ধিমান। তোমার বুদ্ধি দিয়ে একদিন ভালো কিছু করতে পারবে। তোমার চো’রদের খবর কি?
“এখন পর্যন্ত আমার কথা মত কাজ করছে। ওঁরা পরিবর্তন হবে।’
‘যারা অন্যর হক ছিনিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়,ওরা কি কখনো পরিবর্তন হবে? আমার মনে হয় না ওরা পরিবর্তন হবে”
সুফিয়ান আত্মবিশ্বাস এর সাথে বলল ‘আমি যদি এখন মরেও যাই, মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে ও বলতে পারব,ওরা ঠিক পরিবর্তন হবে।আমার উপদেশও মনে রাখবে।”
আজমাত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল ‘তোমার মা বাবা কোথায়?
সুফিয়ান সময় নিয়ে বলল ‘বেচে নেই।’
‘কিভাবে মা’রা গেল?

‘সেসব বলে লাভ কি।সেসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
‘বোন নেই?
না বোধক মাথা আওড়ালো। মুখটা শুকিয়ে গেল সুফিয়ান এর।ঘাস টেনে টেনে ছিঁড়ছে। আজমাত তাঁর ভাবমূর্তি দেখে বলল ‘তোমাকে দেখে কখনো, মনে হয় তুমি ভীষণ খুশি, কখনো মনে হয় তোমার ভেতরে চাঁপা কষ্ট লুকিয়ে আছে! আমি ঠিক বললাম তো?
“না। তুমি দুচোখে দু’রকম ভাবে আমাকে দেখেছো,আমি সবসময় সুখি এবং খুশি।’
‘আমি আদিব এর থেকে জানতে পেরেছি, বাঙালিদের মধ্যে কেউ কষ্ট পেলে নদীর তীরে বসে বসে থাকে। তুমি বসে আছো কেন?

“ফারদিনা আজ বিরক্ত করছে না।ও বিরক্ত করলে বিরক্ত হই না।অথচ বিরক্ত করছে না বলে বিরক্তি হচ্ছি।’
‘এই অনূভুতি কে কি বলে? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো আজমাত।
‘প্রেমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।প্রেমে পড়লেও জ্বালা, না পড়লেও জ্বালা। একবার পড়ে গেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিবেই।’ বলে সুফিয়ান হাসল। আজমাত আওয়াজ করে হাসল। সুফিয়ান তাঁর হাঁসি দেখে বলল ‘বিনোদন পেয়েছো,তাই না! তোমাকে আনন্দ দেয়ার জন্য ই বলেছি।’
আজমাত হাঁসি থামিয়ে বলল ‘তুমি খুব মজার মানুষ,তোমাকে ফারদিনা পেলে সে ভীষণ আনন্দে থাকবে।’
সময় গড়াচ্ছে। দু’জন উদ্দেশ্যহীন পথে গন্তব্যহীন হাঁটছে। তালুকদার বাড়ির পুব দিক ছেড়ে যাচ্ছে সুফিয়ান।চোখ তুলে কয়েকবার ফারদিনার ঘরটির দিকে দেখছে। অন্ধকার ঘর।ঠিক আছে তো ফারদিনা? সুফিয়ান চিন্তা করতে চাইছে না।অথচ ভেতরে প্রবল চাপ চাপ ব্যথা হচ্ছে।

উদ্দেশ্যহীন পথে হাঁটার ইচ্ছে নেই তার। আজমাত কে নিয়ে তালুকদার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। পরিবেশ শান্ত।এতটা শান্ত আগে কখনো ছিল না। আশেপাশে কিছু অনুচারীগন বসে বসে গল্প গুজব করছে।অশ্বরা হ্রেষাধ্বনি তুলছে।পশু প্রাণি যা টের পায় মানুষ তা পায় না। মানুষ শুধু পশুর চিৎকার শুনতে পায়।
আজমাত বলল ‘তুমি ভেতরে যাও,আমি পড়ে আসছি।’
সুফিয়ান ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে অনুচারী,দাসী কাউকে দেখা গেল না। রশীদ তালুকদার বসে আছে বৈঠকখানায়। কুদ্দুস তাঁর পাশেই দাঁড়ানো। সুফিয়ান গলায় কাশি দিয়ে রশীদ এর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।উনি বলল ‘সুফিয়ান যে,আয় বোস।’ সুফিয়ান বসে। চারদিকে দেখল।’
“কি ব্যাপার,এই রাতে তুমি? কিছু দরকার, না অভিযোগ নিয়ে এসেছিস?

সুফিয়ান এর উদ্দেশ্যে ফারদিনা।সে কোথায়?ঘর অন্ধকার কেন?।এসব বলা যাবে না।আজ মিথ্যা বলতে হবে। শুক্রবার। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।রাত এখনো বারোটা ছুঁয়ে যায় নি।রাত এখন পর্যন্ত শুক্রবারে আটকে আছে। সুফিয়ান এর দ্বিধাবোধ হল। রশীদ তাকে চুপচাপ দেখে বলল ‘একি চুপ করে আছিস কেন,টাকা পয়সা দরকার,জমি দরকার,তুই তো আমাদের গ্রামে পুন্য নিয়ে এসেছিলিস,তুই মানে বরকত।যে জমিতে হাত দিস,ফসল ফলে যায়।” বলে হো হো শব্দে হেসে উঠল।

সুফিয়ান বলল ‘হ্যাঁ, জমির বিষয়ে কথা বলতে আসছিলাম।আমি চারজন কে জমিতে চাষ করে আয় করার উপায় তৈরি করে দিয়েছি।ওরাই আমার জমিতে চাষ করছে। আমার কাজটা ওরাই করে দিচ্ছে।আমি বেকার ঘুরছি।তাই ভাবছিলাম, আপনার থেকে আরো কিছু জমি বরাদ্দ নিয়ে চাষ করি।’
রশীদ টান চোখে সুফিয়ান কে দেখল। সুফিয়ান এর দৃষ্টি অস্থির। রশীদ একরকম প্রশ্রয় এর হাঁসি দিল।বলল ‘তোর মত কর্মঠ ছেলেই দরকার। প্রতিটি ঘরে ঘরে। তুই আগামীকাল থেকে আমার পশ্চিমের খালি জমিটাতে চাষ করবি।’
সুফিয়ান নীরব দর্শক এর মত রশীদ এর আড়ালে এদিক ওদিক দেখছে। রশীদ কুদ্দুস কে লক্ষ্য করে বলল “অতিথি এসেছে,চা নিয়ে আয়,এটাও কি বলে দিতে হবে হতচ্ছাড়া।’

কুদ্দুস মাথা নিচু করে চলে গেল। সুফিয়ান আরো কিছুক্ষণ থাকার সুযোগ পেল। যতক্ষণ না চা আসছে,পান করা হচ্ছে ততক্ষণে ফারদিনার জন্য অপেক্ষা করা যাবে।চা খেলে ঘুম হবেনা।আজ ঘুম এমনিতেও আসবে না।চা খেলে দোষের কিছুই হবে না।
জেবুন্নেছা পানের থালা নিয়ে বৈঠকখানায় উপস্থিত হল। সুফিয়ান কে দেখেই জেবুন্নেছার মুখ শক্ত হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে হালকা বিদ্রূপের রেখা‌।চোখে একফোঁটা উষ্ণতাও নেই।যেন সে মানুষ নয়, কেবল বাতাসের কোনো অবাঞ্ছিত ছায়া। সুফিয়ান জেবুন্নেছা কে সালাম দিল। জেবুন্নেছা ঠোঁট কেচে হালকা হাঁসি নিয়ে বলল ‘তুমি নিশ্চয়ই ফারদিনার খোঁজ করতে এসেছো?

রশীদ কৌতুহল নিয়ে বলল “ওর খোঁজে আসবে কেন?
জেবুন্নেছার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে।ফারদিনার কথা বলতে চায়নি।আদিব এর কথা বলতে চেয়েছে। হেঁসে উড়িয়ে দিয়ে বলল “আদিব,আদিব এর কথা বলছিলাম। ওঁরা তো ভালো বন্ধু।আদিব এর সাথে একজন রাখালের বন্ধুত্ব..!মানে কি করে সম্ভব, কোথায় ও আর কোথায় তুমি। তাঁর উপর শুনেছি একটা অশ্ব কিনেছো,চুরি টুরি করছো না তো?” বলে পান মুখে দিল। সুফিয়ান রেগে গেল।সে বয়সে বড় না হলে এতক্ষণে তির্যক কন্ঠে জবাব দিত। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।হল না। ব্যর্থ হল। উচ্চ স্বরে জবাব দিয়েই দিল।বলল ‘আমি হালাল টাকা আয় করি।অন্যর হক ছিনিয়ে নেই না।আদিব আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছিল,আমি না।ধনী গরীব,জাত বেজাত,এসব দেখে কখনো বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসা কোনটাই হয় না।’
‘তুমি বলতে চাইছো আমরা অন্যের হক ছিনিয়ে নিয়ে খাই?

সুফিয়ান বসা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল ‘যে যেমনটি করে সে অন্যকেও নিয়েও তেমনটি ভাবে।আপনারা বোধহয় চুরি আয় করেন।তাই বললেন।আমি না।’ থেমে রশীদ এর দিকে তাকিয়ে বলল ‘চাচা আজ চলি। মাথাটা রাগে ধরে গেছে। আগামীকাল আসব’ বলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ঘর থেকে চলে গেল।
রশীদ কোন জবাব দিল না।হা হয়ে তাকিয়ে রইল। জেবুন্নেছা বলল ‘ও আমাকে অপমান করে চলে গেল,আর তুই চুপচাপ শুনলি?তোর বোনের অপমান সহ্য করলি?

রশীদ কঠিন গলায় বলল ‘বাপের বেটা সুফিয়ান।কি হিম্মত ওর, জমিদার এর বোনকে তাঁর সামনেই কথা শুনিয়ে গেল।কি সাহস ওর।সাড়া দেশ খুঁজলেও ওর মত ছেলে পাওয়া যাবে না।’ বলে গর্বের সাথে হেসে উঠল।
“ভাই তুই বদলে গেছিস। আমাকে কত গুলো কথা শুনিয়ে গেল,আর তুই হাসছিস!”
“তুই ওর আত্মসম্মানে আঘাত দিয়ে কথা বলবি,আর ও চুপচাপ থাকবে!আমরা অন্যকে চারটে কথা শোনাতে পারব,আর সে জবাবে দুটো শোনালেই দোষ!’ রশীদ থেমে গেলেন।হাত বাড়িয়ে পান মুখে দিল। বিচিত্র গলায় বলল “আমি ওর জবাবের উপর প্রতিক্রিয়া করলে হয়ত থেমে যেত, কিন্তু তুই কি জানিস কেউ রেগে গেলে তার রাগটা বহিঃপ্রকাশ করতে দিতে হয়।এতে তাঁর মনের ভেতর অস্থিরতা দূর হয়। সুফিয়ান এর ভীষণ তেজ।” তাঁর মুখে প্রশংসা জেবুন্নেছার মোটেই ভালো লাগল না।মুখ ভেংচে দিল।বলল “তোর জ্ঞান নিয়ে তুই থাক, আমাকে জ্ঞান দিবি না।’

‘রাগ করলে শরীর খারাপ হয়।এত রাগ ভালো না।’ বলে পিকদানিতে পিক ফেলল রশীদ। জেবুন্নেছা খিটখিট মেজাজে বলল ‘ঐ রাখালের শরীরের জন্য ভালো ছিল?
রশীদ এবার একটু হাসল। ঠোঁট দুটো লাল হয়ে গেছে।পানের রসে মুখ ভরে গেছে। “পুরুষ রাগলে হয় বাদশা,জানিস তো’?
‘জানি না।জানতেও চাই না। অপমান আমার সহ্য হয় না।এর শোধ আমি নেব।’ বলে ক্রোধের আগুনে উপরের চলে গেল। রশীদ আওয়াজ করে হাসল। কুদ্দুস চা নিয়ে আসলো। সুফিয়ান নেই। জিজ্ঞেস করল “সুফিয়ান দাদা,চা না খেয়েই চলে গেছে, আমার কষ্টটাই বেফলে গেছে।”
‘চা’টা আমাকে দে।আর যা দেখে আয়, খামারে সব গরু,ছাগল, ঠিকঠাক আছে কিনা!
কুদ্দুস মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে চলে যায়।

রাত ঠিক একটার কাছাকাছি।রাঙা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খড় খাচ্ছে।বালতি ভরে জল রেখেছে।খড় খাওয়া শেষে জল খেল। ওদের চোখে ঘুম নেই।সব মিলিয়ে দু’তিন ঘন্টা ঘুমোয়।চাঁদের আলো আজ অদ্ভুত নির্জন।সুফিয়ান মাটির উঠোনে বসে আছে।সামনে তার প্রিয় অশ্ব রাঙা, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ তুলে একবার রাঙার দিকে তাকাল।রাঙার চোখে যেন কেমন এক ক্লান্ত দৃষ্টি, ঠিক তার মতো। হাতে কলম, কাগজে অর্ধেক লেখা বাক্যগুলো ছড়িয়ে আছে।কিছু গল্প, কিছু স্মৃতি, কিছু না বলা কথা।
আজ রাতে ফারদিনা আসেনি।প্রতিদিনের মতো আজও সে চাঁদের আলোয় দেখা দিবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু পথ ছিল ফাঁকা।বাতাসে কেবল পলাশপাতার মৃদু নড়াচড়া ছিল। সুফিয়ান লিখেছিল “আজ সারাদিন কেমন কেটেছে” কিন্তু শব্দগুলো যেন তার হাতের মুঠো থেকে ফসকে যাচ্ছে। কলম কাগজে লাগে, আবার থেমে যায়।লেখা এক পর্যায়ে বন্ধ করল।

রাঙা হালকা করে হ্রেষা দেয়, যেন বলে “আর লিখো না, মন তো আজ তোমার ফারদিনার কাছেই রয়ে গেছে।”
সুফিয়ান মৃদু হেসে ওঠে, কিন্তু চোখে জল টলমল করে। সে খাতা বন্ধ করে রাখে বুকের কাছে।
চাঁদের আলোয় তার মুখে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা।
আজ লেখার কালি ফুরোয়নি।মনটা যেন শুধু শুকিয়ে গেছে।
আজ ঘুম আসবে না। উঠোনে পায়চারি করতে করতে এক পর্যায়ে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে তালুকদার বাড়ির পুব দিকে এগিয়ে গেল।পথের দুধারে ধানের ক্ষেত। বাতাসে দুলছে।একটার সাথে আর একটা মিলে চিরিচিরি শব্দ তৈরি করছে।
তালুকদার বাড়ির পুব দিকে খামার।খামার ছাড়িয়ে সুফিয়ান যেতেই লন্ঠন হাতে কুদ্দুস এর সাথে দেখা হয়। কুদ্দুস বলল ‘আপনি এত রাতে?ঐদিকে কোথায় যান?

সুফিয়ান মিথ্যা বলবে না। সত্য বলবে।তবে অন্য রকম ভাবে।যাতে মিথ্যের আশ্রয় না নিতে হয়। সুফিয়ান পাল্টা প্রশ্ন করল ‘তোর ফারদিনা আপা কোথায়?তখন গেলাম দেখলাম না তো?
কুদ্দুস নির্বাক হয়ে চুপ থাকল কিছুক্ষণ। এরপর বলল “আমি আজ সন্ধ্যার পর তাকে দেখিনি।’
“আচ্ছা তুই যা‌!”
“আপনি কোথায় যান?
“কাজ আছে।” বলে সুফিয়ান হাঁটতে শুরু করল।কারো খোঁজ নেয়াটাও একটা কাজ। গুরুত্বপূর্ণ কাজ।সে মিথ্যা বলেনি।এটাই সত্যি।

পুব রাস্তার মাঝ বরাবর পথে দাঁড়িয়ে পড়ল সুফিয়ান।উদাস মনে তিন চার হাত জায়গায় মধ্যে পায়চারি করছে।একটু পরপর ফারদিনার ঘরের দিকে দেখছে।ঘর অন্ধকার। সুফিয়ান সিগারেট বের করল। কিন্তু ধরাল না।ফারদিনা বলেছিল ‘আমি সাথে থাকলেও তোমার মন সিগারেট এর দিকে থাকে, আমার দিকে না।’ আজ সে কাছে নেই। সিগারেট এর দিকেও মন নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো সুফিয়ান।

রাত বাড়ছে।মাঝরাতের রাস্তায় নিস্তব্ধতা পুরু কুয়াশার মতো ঘন। চাঁদের অর্ধেক দাগেলা আলো জমিনে ছাপ ফেলছে, ঠিক তখনই ফারদিনার ঘরের হালকা সোনালী ঝলক যেন নিঃশব্দে ফারদিনার উপস্থিতি ঘোষণা দিল।সূফিয়ান ধীরে ধীরে পুবের দিকে এগোতে লাগল, তার পদধ্বনি নীরবতার মাঝে কেবল তার নিজের কানেই বেজে উঠছে। বাতাস শীতল, আর মাঝে মাঝে শুকনো পাতা হোঁচট খেয়ে পড়ছে পথের ধারে। আকাশের তারা যেন তার অপেক্ষার সঙ্গী, আর ঘরের জানালার আলো তাকে এক মৃদু অনুপ্রেরণা দিচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কৌশলে দেখবে ফারদিনাকে।
বাড়ির পেছনে পৌঁছালো সুফিয়ান।দোতলায় ফারদিনার ঘর।

প্রাচীর টপকে উপরে উঠা কষ্টকর।প্রাচীর উঁচু।এদিক ওদিক তাকিয়ে ভর দিয়ে ওঠার মত শক্ত কিছু খুঁজল। গাছের খন্ড পড়ে আছে।ভর দিয়ে প্রাচীর এর ছুঁতে পারল। ধীরে ধীরে ফারদিনার ঘরের জানালার দিকে এগোলো।জানালা খোলা। মোমবাতি লন্ঠন এর আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘরে। কিছু দাসীরা একজন কে ঘিরে রেখেছে। কারো হাতে ধুপ।কারো হাতে শাড়ি। দাসীরা দুই দিকে সরে গেল। সুফিয়ান কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওদের মাঝে ফারদিনা বসে আছে। শরীর ভেজা।চুল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। একজন দাসী চুল মুছিয়ে দিচ্ছে।চুল মোছা শেষে সরে যায়।আর একজন চুলে ধুপ ধোঁয়া দিচ্ছে।

The Silent Manor part 18

ফারদিনা মাঝরাতে গোসল কেন করেছে? শীতের সময়ে প্রতিদিন কেউ গোসল করে না। শীতের রাতে গোসল করা তো বোকামি মাত্র।যার মাথায় সমস্যা আছে একমাত্র সে-ই করবে!। একজন দাসীর কন্ঠস্বর ভেসে আসলো _ কি, তুমি খুশি তো?

The Silent Manor part 20

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here