The Silent Manor part 2
Dayna Imrose lucky
মীর জাফান শন তখন মায়াকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল “তোমার নাম?
“মায়া।”
মায়া নির্লিপ্ত ভাবে মীর কে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল “আপনি কতক্ষন থেকে জঙ্গলে ছিলেন?
“অনেক সময়”
“কিন্তু কেন?
“শিকার করতে”
“শিকার করলেন?
“করার আগেই তো তুমি চলে আসলে”
“আপনি বাঁশির সুর এর শব্দ শুনেননি?”
মীর অশ্বের লাগাম টেনে দাঁড়িয়ে পড়ল।মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল “এই জঙ্গলে আমার জানামতে কেউ আসে না।যদিও কেউ এসে থাকে তবে তাঁরা সাহসী।আর সে-ই সাহসীদের মধ্য আমিও একজন।আমি জঙ্গলের ভেতরে অনেক টা সময় ছিলাম। কিন্তু কোন বাঁশির সুর এর শব্দ পাইনি। তোমার হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে,ভুল কিছু শুনেছো।”
মায়া মীর এর রেশ টেনে বলল “হয়ত তাই হবে।আমি ভুল শুনেছি। কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন?”
“দেখছি কোথায় যাওয়া যায়।”
“আপনি মুখোশ পড়ে কেন আছেন?
“শুনেছি আলিমনগর গ্রাম টা সুবিধের নয়। কোথায়, কখন কার নজরে পড়ে যাই বলা যায় না।” বলে চাপা স্বরে হাসলো মীর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়া তাঁর অশ্বের লাগাম টেনে চৌধুরী নিবাসন এর উদ্দেশ্যে চলে যায়।মীর তাঁর পেছন পেছন গেল। মায়া বুঝতে পারল মীর তাকে অনুসরণ করছে।মীরের অনুসরণ তাঁর কাছে অদ্ভুত মনে হল। কিন্তু কিছু না বলে সোজা চলে যায় তাঁর গন্তব্যে।বাড়ি পৌঁছাতে তাঁর অনেক টা সময় লেগে যায়। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এর আগমন ধরণীতে নেমে আসে।বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ায় মায়া।
পেছন ঘুরে দেখল মীরও তাঁর পেছন পেছন বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে ভেতর অবধি চলে এসেছে।এই দেখে মায়া আমজাদ চৌধুরীর ভয়ে দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে যায়।ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে সদর দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলে মীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। এবং নির্বিকার কন্ঠে বলল “এই মেয়ে, আমাকে ফেলে চলে এলে কেন? তোমার মধ্যে দেখছি কৃতজ্ঞতা ও নেই।একটা ধন্যবাদ ও দিলে না।”
মায়া ভ্রু কুঁচকে বলল “একটা ধন্যবাদ এর জন্য আপনি আমার বাড়িতে এবং কি ঘরের ভেতর অবধি চলে এসেছেন?”
“তো,একটা ধন্যবাদ এর ও অনেক মূল্য।আর তুমি আমাকে ধন্যবাদ না দিয়েই চলে এসেছো। অপেক্ষা কর, তোমার বাড়ির বড়দের ডেকে জিজ্ঞেস করছি, তাঁরা তোমায় সঠিক শিক্ষা কেন দিল না?”
মায়া কিছুটা রেগে বলল “আপনি দেখছি ভারী বেয়াদব”
মীর এবার হাস্যকর কন্ঠে বলল “তোমারই বা এটা কেমন আদব! আমাকে বেয়াদব বলছো?”
মায়ার ঠোঁট কেঁপে উঠল।মীর তখন বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আন্টি, আঙ্কেল বলে ডাকতে শুরু করে।মায়া ভয়ে আধমরা হয়ে গেল।মায়া মীর এর কাছে ঘেষে হাতজোড় করে বলল “আপনি আমার বাড়ির লোকদের ডাকবেন না। আমি আমার জীবনের সমস্ত ধন্যবাদ আপনাকে দিচ্ছি। এবার আপনি এখান থেকে চলে যান।”
মায়ার মিনতির আগেই দোতলা থেকে নেমে আসে মায়ার মা’ শালুক বেগম, তাঁর দাদী জয়ন্তন বেগম,তাঁর চাচী শাহানারা এবং তাঁর মেয়ে তৃষ্ণা।মায়া সকলকে দেখে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। ততক্ষণে বাড়ির কাজের মেয়ে শেফালী এবং অনুচারীগন হাজির হয়।
শালুক তার মাথার কাপড় ঠিক করে মীর এর সামনে এসে দাঁড়ায়।মীর শালুক এর পায়ে সালাম করতে চাইলে শালুক বাঁধা দিয়ে বলল “সে-ই সকাল থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি মীর। আমাদের লোক তোকে স্টেশনে নিতে অবধি গিয়েছিল। কিন্তু তোকে পেল না। কোথায় ছিলিস সারাদিন?
মীর জবাব দিল “আমি আজকে সকালে পৌঁছেছি এখানে। কিন্তু তুমি তো জানো বরাবরই আমার শিকার করতে ভালো লাগে।আলিমনগর আসলেই আমি শিকার করেই থাকি।তাই উত্তরের জঙ্গলে হরিণ শিকার করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি জানো ছোট মা, সেখানে আমার সাথে এক নাগীনির দেখা হয়”
জয়ন্তন বেগম মীর এর রেশ টেনে বলল “নাগীন তোরে ছোবল দেয় নাই তো মীর?
মীর জয়ন্তন এর রেশ টেনে বলল “না দাদী, আমাকে ছোবল দেয়া কি এত সহজ!” বলে হাসে মীর। উপস্থিত হল রাফিদ চৌধুরী।রাফিদ মীর এর সাথে আলিঙ্গন করে।এসব দৃশ্য দেখে মায়া হা হয়ে রইল।মীর তাদের পরিচিত।কোন ভাবে বুঝতে পারল না।তাকে বোকা বানিয়েছে।বলতে পারত,আমি চৌধুরী বাড়ি এসেছি। তাহলে এত বিভ্রান্ত হতে হত না।মায়া ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠলো। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ করল না।
সবার সাথে মীর এর দেখাসাক্ষাৎ শেষ হওয়ার পর শালুক বলল “এবার তো মুখোশ টা খোল,চোখ মুখ কি রকম লাল হয়ে গেছে।” মীর তখন পাগড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকা মুখটি সবার সামনে প্রদর্শন করে।মায়া মীর এর সৌন্দর্য দেখে হতবাক হয়ে রইল।তাঁর ফর্সা গলার ঠিক পাশেই একটা তিল।যেটা নজর কাড়ে মায়ার।
রাফিদ মায়াকে নিজের কাছে টেনে বলল “মীর এই হচ্ছে আমাদের ছোট্ট মায়া।” মীর মায়ার দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে বলল “আসসালামুয়ালাইকুম আপু।আমি এই বাড়ির নতুন অতিথি।”
মায়া নিঃশব্দে গা’লি দিল অসভ্য’।শালুক বলল “চল বাবা, তোকে খেতে দেই।” বলে মীর কে নিয়ে সবাই খাওয়ার ঘরে চলে যায়।
মায়া দু কোমরে হাত চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল “এই বাড়ির মেয়ে আমি, সারাদিন আমিও না খেয়ে ছিলাম। আমাকেও ডাকা উচিত ছিল।”
তার পাশ থেকে শেফালী বলল “হ মেম সাহেব,আমি আপনার লগে একই মত। কিন্তু হেয় তো থাইল্যান্ডের অতিথি।তাই গুরুত্ব বেশি।”
মায়া বলল “মানে!কে ও?আমিতো ভাবছি আমার কোন আত্মীয়ের মধ্যে কেউ!
“তেমনই মেম সাহেব,উনি হইতাছে থমাস শন এর পোলা।মীর স্যার এর বাবা থাইল্যান্ডের নাগরিক। কিন্তু তাঁর মা ছিলেন বাঙ্গালী।আর আর তার মা ছিলেন আপনার মায়ের আপন ছোট বইন।উনি অনেক আগেই মা’রা যান।”
“তুই এত কিছু কিভাবে জানলি?মায়া আশ্চর্য হল।
শেফালী ফিসফিস করে বলল “আপনে তো অনেক দিন বিদেশ আছিলেন।আর আমি তাঁর ও অনেক আগে থেকে আপনাগো বাড়িতে কাম করি।সব জানি আমি, আমি যা জানি তা আপনেও জানেন না। কিন্তু আপনার বাপ আর ঐ বিদেশি স্যার এর বাপ ভালো বন্ধু এটাও সত্যি।”
মায়া কিছু বলল না। শেফালী হেসে বলল “যাই বলেন না কেন, বিদেশি বাবু কিন্তু অনেক সুন্দর।”
মায়া মুখে মলিন হাঁসি আনল। শেফালী তাঁর হাঁসি লক্ষ্য করে বলল “হাইসা লাভ নাই,উনি কিন্তু আপনারে বইন ই ডাকছে।” বলে খাওয়ার ঘরের দিকে চলে যায় শেফালী।
দিন ফুরিয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে ধরণীতে।রাত ঠিক বারোটা। ঘড়ির কাঁটা যেন ঠিক বারোটায় এসে বিঁধছে।এ যেন থমকে যাওয়া একটি প্রহর।নীরব সুনসান রাত ঘিরে আলোকিত লক্ষ্য তাঁরারা আকাশে জড়ো হয়েছে। ওদের সর্দার হিসেবে চাঁদ যেন ঠিক মাঝেই সীমাবদ্ধ। চাঁদের আলো কখনো প্রকৃতিতে ঝলমলিয়ে উঠছে, কখনো আবার মৃদু মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। চাঁদের এক খন্ডিত আলো ধরে জানালার পাশে বসে আছে মায়া।আজ বাড়িতে নতুন অতিথি আসায় সবাই অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা জমিয়েছিল। মিনিট বিশেক হয় সবাই ঘুমের জন্য যে যার ঘরে চলে গিয়েছে।আজ বাড়িতে আমজাদ চৌধুরী উপস্থিত নেই।উনি এবং থমাস মিলে শহরে গিয়েছে। তাঁরা আজ আর ফিরবে না।
তৃষ্ণা তাকের বই গুলো গোছাতে গোছাতে মায়াকে বলল “মীর কিন্তু ছেলে হিসেবে খুবই ভালো।”
মায়া কোন প্রতিক্রিয়া করছে না।সে জানালা থেকে তাকিয়ে আছে বাইরে। তৃষ্ণা দেখল মায়ার কোন হুশ নেই।সে মায়ার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল “আমি কি বলছি,তোর কানে যাচ্ছে না?
মায়া বলল “জানিস, আজকে আমি উত্তরের জঙ্গলে গিয়েছিলাম।”
“তারপর”?
মায়া পায়চারি করতে করতে বলল “তখন আমি একটা বাঁশির সুর পাই। আমি সুরটি অনুসরণ করে সেদিকে চলে যাই।আর সেখানে আমি মীর কে দেখতে পাই। কিন্তু মীরের হাতে শুধু একটা রাইফেল ছিল। বাঁশি ছিলো না।তবে আমি কি ভুল শুনেছিলাম।?”
তৃষ্ণা বলল “তুই আবার সে-ই গল্পের কাহিনী বানাচ্ছিস।”
“আমি সত্যি বলছি তৃষ্ণা।তোর সাথে আমি কখনো মিথ্যা বলি না।”
“ধরে নিলাম তুই সত্যি বলছিস। তবে বাঁশিটা কে বাজাচ্ছিল?”
মায়া চুপসে গেল।সে বসে পড়ে খাটের উপর। তৃষ্ণা হাতের কাজ শেষ করে শুয়ে পড়ল।বলল “তুই কি দাদুর সাথে ঘুমাবি?”
মায়ার গতকাল রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। “না।আজ তোর সাথে ঘুমাবো।”
তৃষ্ণা শুয়ে শুয়ে বুকের উপর বই রেখে পড়ছে।মায়া কিছুক্ষণ পায়চারি করে বলল “তুই থাক, আমি মীর এর ঘর থেকে আসছি। আমার কেন যেন ওকে বেশ সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। আমি নিশ্চিত ঐ বাঁশিটা বাজিয়েছে।” বলে তাৎক্ষণিক ঘর থেকে বেরিয়ে মীর এর ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। দোতলার একদম পুব পাশে মীর এর ঘর। এতক্ষনে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।বাড়ির সমস্ত বাল্ব নেভানো থাকলেও কিছু মশাল জ্বলছে।জ্বলছে স্ফটিক ঝাড়বাতি।যার জন্য চারদিকে মৃদু আলো ছড়িয়ে আছে।
মায়া মীর এর ঘরের দিকে যেতেই পেছন থেকে মায়া ডাকটি ভেসে আসে।মায়া আঁতকে উঠল।পা স্থির হয়ে গেল। ধীরস্থির ভাবে পেছন ঘুরে দেখল জয়ন্তন বেগম দাঁড়িয়ে আছে।খুব রেগে আছে সে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে।মায়া এখন কি জবাব দেবে?মীর এর ঘরের দিকে কেন যাচ্ছে?তাও এত রাতে?
“তুই এত রাইতে এইহানে কি কর?”
মায়া তোতলে জবাব দিল “শুধু তোমার ই জন্য।আমি জানি, আমি এত রাতে বের হলেই তোমার সাথে দেখা হবে।”
জয়ন্তন বলল “হইছে হইছে। আমার লগে নাটক করতে হইবে না।আমি তোর ঘরে যাইতে আছিলাম,এইডা কওয়েন লইগা যে,আজ তুই তৃষ্ণার লগে ঘুমা। আমার শাহানারার লগে কাম আছে।একটা বিষয় হিসাব নিকাশ বাকি আছে।”
মায়া বলল “আচ্ছা। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়।”
“বাইরে হাঁটাচলা করিস না। দিনকাল ভালো না।তোর বাপে বাড়িতে নাই।যা ঘরে যা।” বলে জয়ন্তন তাঁর ঘরের দিকে চলে যায়।
মায়া উঁকি মেরে দেখল জয়ন্তন চলে গেছেন। এরপর দ্রুত পায়ে মীর এর ঘরের দিকে হাঁটল।
মায়া স্থির হয়ে দাঁড়ায় মীর এর ঘরের সামনে। ঘরের দরজা খোলা ছিল।মায়া ভাবছে, ‘মীর হয়ত মনের ভুলে দরজা লাগাতে ভুলে গেছে।সতর্কতার সাথে এদিক সেদিক তাকিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।ঘরের কিছু বাল্ব নিভিয়ে রাখা।যার ফলে আবছা আলোয় বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ঘরটি। কিন্তু মীর কোথাও নেই।মায়া অবাক হল। অতিথি ঘরটি বেশ বড়সড়।ঘরের ভেতরে আর একটি ঘর আছে। সচরাচর ঘরটি কেউ ব্যবহার করে না।মায়া সে ঘরের দিকে গেল।
সেই ঘরের ও কিছু বাল্ব নেভানো। চৌধুরী নিবাসন এর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মায়া মনে মনে বলল ‘অতিথি ঘরের ভেতরের ঘরটি কেউ ব্যবহার করে না।এই ঘরটি মূলত অতিথিদের জিনিসপত্র রাখার জন্য। কিন্তু মীর এর সাথে কোন ব্যাগপত্র ছিল না।তবে সে এখানে কি করছে?মায়া এখনো স্বচোক্ষে দেখেনি মীর এ ঘরে। কিন্তু সে ধরে নিয়েছে মীর এখানেই।সুইচ চেপে বাল্ব জ্বালাতে চাইলো। কিন্তু আলো জ্বলল না। কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল মায়া।ঠিক তখনই পেছন থেকে ছুরি ধার দেয়ার শব্দ ভেসে আসল।মায়া আশ্চর্য হল। পেছন ঘুরে দেখল মীর একটা পাথরের সাথে ছুরি ধার দিচ্ছে।পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি তাঁর।মায়ার থেকে ঘুরে বসা। মায়া মীর এর উদ্দেশ্যে বলল “আমি আগেই জানতাম, আপনি সুবিধার না। এখন ছুরি ধার দিচ্ছেন!”
মীর মায়ার দিকে ঘুরতেই ছু’রিটা হাত থেকে পড়ে মায়ার পায়ের কাছে চলে যায়।মীর কিছু বলল না।মায়া পুনরায় বলল “চুপ আছেন যে!কি করছিলেন এখানে?
মীর ছুরি টা মেঝে থেকে তুলে বলল “দেখছো না ছুরি ধার দিচ্ছি।”
“তা আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কিসের জন্য?
“ছুরি দিয়ে কি করে জানা নেই তোমার?বলে মীর তাঁর শোয়ার ঘরের দিকে চলে যায়। গিয়ে বিছানায় ছুরি টা ছুড়ে ফেলল। এরপর জগ থেকে জল ঠেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিল।মায়া তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে।সে বলল “আপনি শহর থেকে এসেছেন!তবে অশ্ব কোথায় পেলেন?
“স্টেশনে একজনের থেকে কিনে এনেছি।”
“জঙ্গলে কি করছিলেন, সত্যি বলুন!”
“এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না।”
“কিন্তু আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি না”
“সেটা তোমার ব্যর্থতা!” বলে মীর বিছানায় বসে ছুরিটা হাতে নেয়। এরপর সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। মায়া বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে বলল “বলুন না ওটা নিয়ে কি করবেন?”
মীর হঠাৎ বসা থেকে উঠে মায়ার গলায় ছুরি টা ধরে বলল “তোমার জন্যই এটা ধার দিচ্ছিলাম।জঙ্গলে আমাকে দেখে ফেলেছিলে না, যদি সেটা সবাইকে বলে দাও না, তবে আমার সমস্যা হবে।তাই তোমাকে শেষ করে দেয়ার চিন্তাভাবনা করি।”
মীর এর এরকম আচরণে মায়া বিষন্ন হয়ে পড়ল।চোখে জল টলমল করতে শুরু করল।মীর ছুরি টা গলা থেকে সরিয়ে মসৃণ ভাবে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল “ভয় পেয়েছো?আরে বোকা মেয়ে, ছুরিটি ভালো করে দেখো এটা ফল কাঁটার ছুরি।ধার ছিল না।তাই ধার দিলাম। ছোট মা তখন আমাকে ফল দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছুরি দিতে হয়ত ভুলে গেছে।” মায়া ধীরে ধীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
মীর বলল “জঙ্গলে আমি শিকার এর জন্য ই গিয়েছিলাম।অন্য কোন কারণ ছিল না।আর বাঁশির সুর ওটা হয়ত ভুলেই শুনে থাকবে।”
মায়া বলল “আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।আমি আপনার জন্য এখানে এসেছি এটা অন্য কাউকে বলার দরকার নেই।” বলে মায়া চলে যেতেই মীর বলল “পায়ের ব্যথা কমেছে?
মায়া থমকে দাঁড়িয়ে বলল “হাঁটতে পারছি।”এরপর চলে যায়। মায়া মীর এর ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁর ঘরের দিকে হাঁটলে তাঁর মনে হল মীর এর ঘরে এক্ষুনি কেউ গেল। এরপর দরজা লাগিয়ে দিল। মায়া পুনরায় দাঁড়িয়ে পড়ল।চোখ তুলে তাকায় দেয়াল ঘড়ির দিকে, রাত ঠিক একটা ছুঁই ছুঁই।সে আবার মীর এর ঘরের সামনে গেল। কিন্তু এবার দরজা বন্ধ। চোখ পড়ে পাশের জানালার দিকে।সেখানে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে সরু চোখে দৃষ্টি মেলে দেখল রাফিদ মীর এর কাছে বসে আছে।রাফিদ বিছানায়,মীর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে হয়ে কিছু বলছে।রাফিদ মীর এর কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছে। কিন্তু মায়া স্পষ্টভাবে তা শুনতে পাচ্ছে না।মীর কথা থামানোর পর রাফিদ হাতে ছু’রি টা নিয়ে কারো গলা কাঁ’টার মত ইশারা করে কিছু বলল। মায়াকে এমন দৃশ্য নাড়ালো।
মায়া তাৎক্ষণিক কিছু না ভেবে তাঁর ঘরের দিকে চলে যায়।মীর এবারো তাঁর সাথে মিথ্যা বলেছে, বিষয়টি মায়ার মোটেই ভালো লাগেনি। তাঁর উপর রাফিদ মীর এর সাথে। তাঁরা কিছু গোপন কিছু করার চেষ্টা করছে।এসব চেতনার জন্য যেন মায়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।
নির্জন নিহারিকা রাত কেটে ভোরের কৃষ্ণন আলো ফুটে উঠে।ভোর ছয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠে যায় শালুক। তাঁর সাথে শাহানারা। তাঁরা মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হয়। রান্নাঘরে আগে থেকেই উপস্থিত ছিল শেফালী। শেফালী বসে বসে মশলাবাটা তৈরি করছিল। চুলায় বসানো দুধ। শেফালীর সেদিকে খেয়াল নেই।দুধ উতলে পড়তে শুরু করে। তখন এসে হাজির হয় শালুক।শালুক চুলার আঁচ কমিয়ে দেয়। শেফালী দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল “দুধের কথা খেয়াল আছিলো না। বকবেন না।আমি নাস্তা অহনি বানাই দিতাছি।”
শালুক বেশ কর্কশ শব্দে চেঁচিয়ে বলল “কাজ করার ইচ্ছা থাকলে,করার মত করিস।আর ঐ রহিমা কোথায়?ও কাজে আসছে না কেন? বাড়িতে মেহমান আছে।এটা কোন দু পয়সা ওলায়ার বাড়ি নয়, প্রতিদিন নামিদামি লোক আসা যাওয়া করে। তাঁদের আপ্যায়ন করতে হয়।এত কাজ তো তোর একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।!”
শেফালী প্রত্যুত্তরে বলল “মালকিন রহিমা খালার শরীর টা ভালো না।হুনছি ওনার একটা রোগ ধরা পড়ছে।এইর লইগা কামে আয় না”
শাহানারা বলল “সে কাজে আসতে না পারলে তাঁর মেয়েকে আসতে বলবি।ঘরে বসে থেকে তো কোন লাভ নেই।যা,তুই গিয়ে খবর দিয়ে আয়,বলবি সে যদি কাজ করতে না পারে,তবে তাঁর মেয়েকে পাঠায় যেন।নয় গত মাসের বেতন ও পাবে না।”
শেফালী মাথা আওড়ালো ‘আচ্ছা’। এরপর ও রহিমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। শাহানারা শালুক কে লক্ষ্য করে বলল “আপা তুমি চিন্তা কর না, আমি সবার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”
এতক্ষণ রান্না ঘরের দৃশ্য দেখল মীর। শেফালী কে কিভাবে কথা শোনালো শালুক।মীর এর খারাপ লাগল। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মীর গাড়ি নিয়ে শেফালীর পেছন পেছন গেল। কিছুদূর গিয়ে শেফালীর দেখা পায় মীর।গাড়ি থামিয়ে দিল। শেফালী মীর কে দেখে বলল “বাবু আপনে এইহানে?”
“তুই গাড়িতে ওঠ বলছি।”
শেফালী ইতস্তত বোধ করল। “না বাবু,বড় মালকিন জানতে পারলে আমায় আস্ত রাখবে না।”
“আরে উঠতে বলছি ওঠ।” মীর এর ধমকের সুরে শেফালী গাড়িতে উঠে বসে। এরপর মীর গাড়ি স্টার্ট করে।মীর বলল “রহিমা খালার বাড়ি কোথায়?
“সোজা গেলে ডান দিকে রাস্তার পাশে।”
“রহিমা খালার কি হয়েছে?
“একটা অসুখ।যে অসুখের চিকিৎসা নাই।”
“কি বলছিস!”
“হ বাবু। আগে একটু সুস্থ আছিলো। কিন্তু অহন বেশিই অসুস্থ।”
ঠিক কিছুক্ষণ এর মধ্যে রহিমাদের বাড়িতে পৌঁছে যায় তাঁরা। শেফালী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।মীর নামল। শেফালী মীর কে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল “আচ্ছা আপনে আমার লগে আইছেন কেন?”
“পড়ে দেখবি।আগে চল।”
কাঁচা মাটির ঘর, চারপাশে বাঁশের বেড়া। দেয়াল মাটি দিয়ে লেপা, অনেক জায়গায় ফেটে গেছে। ছাউনিতে খড় বা কখনো টিন, খড় থাকলে বর্ষায় ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে ঘরে ঢোকে। মেঝে খালি মাটি, মাঝে মাঝে গরুর গোবর আর মাটি মিশিয়ে লেপা হয়, তাই ঠান্ডা আর স্যাঁতসেঁতে ভাব লেগেই থাকে।রহিমার ঘরের ভেতরে খুব বেশি আসবাবপত্র নেই। বারান্দায় একটা মাচা।ঘরের ভেতরে কাঠের চৌকি।ঘরের এক কোণে মাটির হাঁড়ি,পাতিল সাজানো। একটা লণ্ঠন ঝুলছে, দিনে জানালার ফাঁক দিয়েই আলো আসে। জানালা বলতে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো ছোট ফাঁকা।
ঘরের সামনে উঠোন মাঝে গরুর খোঁয়াড়, একপাশে কলসির সারি। উঠোনের এক পাশে টুলে রাখা আছে কাঁসার থালা-বাটি। কোথাও শুকাতে দেওয়া আছে ধান এবং শাকপাতা। ঘরের সামনে একটা কুঁড়েঘরের বারান্দা, যেটা বৃষ্টির দিনে ভিজে কাদায় মাখামাখি হয়।
সব মিলিয়ে একেবারে সাধারণ, কষ্টভরা অথচ ঘরোয়া উষ্ণতার টান আছে এমন এক সেকেল নিম্নবিত্ত গ্রামীণ বাড়িতে।মীর প্রথমবার এরকম বাড়ি দেখেছে। তাঁর কাছে ভীষণ অদ্ভুত লাগল। থাইল্যান্ডে এরকম বাড়িঘর নেই। আলিমনগর আসলেও কখনো চারপাশ টা সে ঘুরে দেখেনি।আজ এরকম একটি পরিবেশ দেখে অবাক হল মীর। শেফালী ঘরের ভেতর। রহিমা খাটের উপর শুয়ে আছে। শেফালী বলল “খালা, তুমি কি জমিদার বাড়িতে আর কাজ করতে যাইবা না! যদি না যাও তাইলে তোমার মেয়েরে পাঠাও।নয় গত মাসের বেতন কিন্তু মালকিন দিত না।আর যদি কখনো কাজ নাই কর তাও আমারে কইয়া দেও”
রহিমা কাশতে কাশতে উঠে বসে। জীর্ণ শীর্ণ শরীর।গায়ের রং কালো।।বয়স মাত্র পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু রোগের জন্য কাবু হয়ে গেছে সে। রহিমা ধীর স্থির হয়ে বলল “বেতনের টাকা না দিলে চলমু কেমনে, ঔষধ কিনমু কেমনে?”
“তা কি আমি জানি। অহন কও কি করবা। আমার আবার তাড়াতাড়ি যাইতে হইবে। অনেক কাজ আছে।”
রহিমা চোখের জল ফেলে বলল “আমার যা অবস্থা,আর কামে যাওন যাইবো না।মালকিন রে বইলা দিস।”
শেফালী আর কোন কথা না বাড়িয়ে ঘরের বাইরে বের হয়।মীর এতক্ষণ সব শুনছিল।সে শেফালী কে বলল “ শোন,আমি কিছু টাকা দিচ্ছি। খালাকে দে।” বলে মীর কিছু টাকা শেফালী কে দেয়। শেফালী টাকাগুলো রহিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “জমিদার বাড়ির এক ছোট সাহেব তোমারে দেছে।এটা রাহো।” রহিমা টাকাটা নিল।
শেফালী ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো। “শেফালী আপা, টাকাটা নিয়ে যান,গরীব হতে পারি। কিন্তু কারো দয়া নিয়ে বাঁচতে চাই না।আর আমি আগামীকাল থেকে কাজে আসব।” বলা শেষে ঘরের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে আসল।মীর দেখল। এবং শুনল। শেফালী বাধ্য হয়ে টাকাটা ফেরত নেয়।মীর শুধু হাতটা দেখল।
মীর এবং শেফালী পুনরায় জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।মীর খানিকটা চুপচাপ।বেশ কিছুদূর গিয়ে শেফালী কে জিজ্ঞেস করল “রহিমা খালার মেয়ের অনেক দেমাগ। আচ্ছা ওর বাবা কোথায়?
শেফালী বলল “গায়েব হয়ে গেছে।”
“মানে?” মীর একটু বিচলিত হল।
The Silent Manor part 1
“বাবু, অনেক আগে হুনছি ওনারে কেউ মাইরা ফালাইছে। একদিন রাইতে কিছু লোক আইসা রহিমা খালার স্বামীরে ডাইকা নেয়। লোকগুলো কারা তা খালা জানতেন না। সে-ই রাইতে আর খালু বাড়ি ফেরে নাই। পরদিন সকালে দেহে ওনার লা’শ বাড়ির উঠানে পইরা আছে।” মীর হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দিল।
শেফালী অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল “খালা কয় শেষ ভাত কয়টাও খালু খাইতে পারে নাই।”
“কিন্তু, ওনাকে কে খু’ন করলো! সাদামাটা জীবন ছিল।ওনার তো কোন শত্রুও ছিল না হয়ত।”
“জানি না বাবু”’’’
