The Silent Manor part 20
Dayna Imrose lucky
ভোরের আলোটা এখনও নরম,ধানক্ষেতের ওপর কুয়াশা হালকা ঘোমটার মতো ঝুলে আছে। শিশিরে ভেজা বাতাসে ধানের মিষ্টি গন্ধ। দূরে কোথাও মুরগির ডাক, দিঘীরপাড়ে একটা ব্যাঙ ছপাৎ করে লাফ দিল।সকালটা অন্য দিনের মতো শান্ত, কিন্তু আজ গ্রামের বাতাসে অজানা এক অস্থিরতা।
সুফিয়ান খুব ভোরে উঠেছে। তার চোখ লাল, ঘুম আসেনি সারারাত। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে, মাথার ভেতর একরাশ চিন্তা ঘুরেছে। কাল রাতে যা ঘটেছে, তা যেন তার মনে ছায়ার মতো লেগে আছে।সে চুপচাপ কলসি থেকে জল নিয়ে মুখ ধুয়ে, মাথায় গামছা বেঁধে বেরিয়ে পড়ল ক্ষেতে।
পথের ধারে মাটির গন্ধ ভারি, শিশির পড়ে জমে থাকা ঘাসে তার পায়ের ছাপ পড়ে রইল। দূর থেকে দেখা যায়,বদরু, হাবলু, লাল মিয়া আগেই এসেছে। তিনজনেই কাজে ব্যস্ত।
বদরু সুফিয়ানকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল,
“আজ আপনি মাঠে!বউঝি স্বপ্নে তাড়িয়ে দিছে নাকি?”
সোলেমান হেসে উঠল বলল “না রে, ফারদিনার খবর পায়নি মনে হয়! গতকাল রাতে নাকি দেখা দেয়নি”
সবাই হাসে, কিন্তু সুফিয়ানের মুখে কোনো কথা নেই। গামছাটা একটু শক্ত করে বেঁধে নিয়ে সে কাজ শুরু করল চুপচাপ, মনোযোগহীনভাবে। মাটিতে কোপ বসাচ্ছে, কিন্তু চোখ বারবার থেমে যায় দূরের দিকে, তালুকদার বাড়ির দিকটায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সোলেমান আজ এসেছে।ও সাধারণত দিনে কাজ করে না।ওর কাজ রাতে।
বদরু বলল, “আরে রে! সোলেমান আজ ক্ষেতে! পৃথিবী পাল্টাল নাকি?”
সোলেমান কেমন এক গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল, “ঘরে থাকা যায় না রে ভাই, অমন খবরের পর মন স্থির থাকে?”
সুফিয়ান কপাল কুঁচকে তাকাল, “কোন খবর?”
সবাই একসঙ্গে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর সোলেমান নিচু গলায় বলল,
“শুনেন নাই? গত পরশু রাতে গ্রামের উত্তরপাড়ার তিন বছরের বাচ্চা নি’খোঁজ হয়েছে।’
সুফিয়ান থেমে গেল, কোদাল হাতে স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
“কোন বাচ্চা?”
“জয়নব খাতুনের নাতি, ঝুমকু । বিকেলের পর থেকে নিখোঁজ। সবাই রাতভর খুঁজছে। আশেপাশের লোক বলে,হয়তো নদীর দিকে গেছিল।তবে এখনো পাওয়া যায়নি।”
বাতাস যেন থেমে গেল এক মুহূর্তে। মাঠের পাখির ডাক মিলিয়ে গেল দূরে।সুফিয়ান মাথা নিচু করে কাজ চালিয়ে গেল। তার মনে অজস্র প্রশ্ন, কিন্তু মুখে কিছুই নেই।মাঠে বাতাস বইছে, ধানের গাছের মাথা দুলছে, আর সূর্যের আলো পড়ে ধানের রঙ সোনালি হয়ে উঠছে। তার চোখে সেই আলো ঢোকে, কিন্তু মন অন্য কোথাও,গতরাতের অন্ধকারে।
সে মনে মনে ফিরে যায় সেই সময়ে। সমুদ্রের পাড়ে ছিল চাঁদের আলো, জলের ঢেউ টলমল করছিল।ফারদিনা এবং সে পাশাপাশি বসেছিল।ফারদিনা এক পা দু পা করে জলের দিকে গেলেই এক নরম বস্তুর সাথে পা ঠেকে।মৃ’ত শিশুর দেহ।
সুফিয়ান ক্ষেত ছেড়ে বাড়ির দিকে গেল।ক্ষেতে মন বসছে না।মন বসাইতে চাইছে কিন্তু পারছে না। প্রতিটা কাজ মন দিয়ে করা উচিত হোক সেটা ক্ষেতে চাষ,হোক সেটা অন্য কাজ।রাঙা হ্রেষাধ্বনি তুলল তাকে দেখেই।ওকে কিছু খড় দিল।জল দিল।আরাম করে খাচ্ছে। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি ওর। শরীরে হাত বুলিয়ে দিল।আদর করার সময় সময় মাথাটা নুইয়ে দেয়।যেন আরো আদর চাই।
দিঘীর ধারে পৌঁছালো। গোসল দরকার। সকাল সকাল গোসল করলে মন সতেজ হয়। রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
গামছা মাথা থেকে খুলে ঘাটের উপর রাখল। এরপর জলের দিকে নামল। শেষ সিঁড়িতে নামতেই একটা কন্ঠস্বর ভেসে এলো – এত সকালে গোসল করছো? ঠান্ডা লেগে যাবে তো?’
পেছনে ঘুরল না।ফারদিনার কন্ঠ। তাঁর প্রশ্ন সম্পুর্ন ভাবে অগ্রাহ্য করে জলের মধ্যে নেমে গেল।ঘাটের দিকে ঘুরে জলে ডুব দিল।কিন্তু ফারদিনার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।কেন তাকাবে? গতকাল ছুটে চলে গেছিল। একটাবার পেছন ঘুরে অবধি দেখেনি।রাতে দেখা দেয়নি।জটিল সমস্যা হলে সংবাদ পাঠাতে পারত।সেটাও করেনি। প্রচন্ড অভিমান জমেছে।একরাত কেউ দেখা না দিলে তাঁর সাথে অভিমান করা কতটুকু কাম্য? এরকম প্রশ্ন করলে সবার জবাব মিলবে ‘অভিমান করা উচিত নয়। হঠাৎ আচরণ বদলে যাওয়ার পেছনে,গায়েব হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ থাকে। আমাদের উচিত সে কারন খুজে বের করা।’ সুফিয়ান খোঁজ নিয়েছিল।কারণ জানতে চাইছিল। অতঃপর সে দেখেছে মাঝরাতে ফারদিনাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে! আশ্চর্যজনক ঘটনা।
সুফিয়ান ডুব থেকে উঠল।জলে যেন তাঁর পুরো শরীর ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। রোদের আলো পড়ে তার শরীর যেন চিকচিক করছে।চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সুফিয়ান মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে চুল ঝাড়ল। শরীর তাঁর আধ ডোবা।ফারদিনা মুগ্ধতার সাথে দেখছে।পাশ থেকে ঝিলমিল ফিসফিসিয়ে বলল ‘তার শরীর দেখছো,মনে হইতাছে কুস্তিগিরের শরীর।মনে হয় আখড়ায় শরীর চর্চা করে।কি সুন্দর ই না লাগতেছে।’ ফারদিনা হাতের কনুই দিয়ে ওর পেটে আঘাত করে বলল “নজর দিস না মুচমুচি।”
“মনে হয় হেয় তোর লগে রাগ করছে।’
“তাই মনে হচ্ছে।চোখ মুখ নির্বিকার।’
সুফিয়ান জল থেকে উঠে যায়। গামছা দিয়ে চুল মুছল। ভেজা চুল। রক্তমাখা চোখ।ফারদিনা প্রশংসা না করে পারল না।বলল “তোমায় ভেজা চুলে,ভেজা শরীরে,লাল চোখে সুন্দর লাগছে।”
সুফিয়ান বাড়ির দিকে হাঁটল।ফারদিনার প্রশংসা হাওয়া তে উড়ে গেল। সুফিয়ান এর কানে পৌঁছাল না।
ফারদিনা সুফিয়ান এর সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল।বলল “তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন,কি অপরাধ করেছি!বলবে তো?
সুফিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।ফারদিনা একরাশ ব্যাকুলতা নিয়ে বলল “আজকে আব্বা, ভাইয়েরা রাজস্ব আদায় নিয়ে ব্যস্ত।এই সুযোগে আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।চুপ করে থেকো না।”
সুফিয়ান ফারদিনার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে দেখল।ফারদিনা তাঁর চাহনি দেখে চুপ হয়ে গেল। সুফিয়ান তার পাশ কেটে চলে গেল জবাবহীন মানবের মত।ফারদিনা তির্যক কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল ‘তুমি যতক্ষণ আমার সাথে কথা না বলবে,আমি এই দিঘীর পাড়েই বসে থাকব।আমি কিন্তু সাঁতার জানি না। দিঘীর জলে ঝাঁপ ও দিতে পারি।” সুফিয়ান ঘুরে তাকাল না।চলে গেল।
ঝিলমিল আপেলে কামড় দিতে দিতে বলল “ভাব দেখছো, আমার তো তাঁর ভাব ও ভালো লাগছে।কি তেজ বাবা।”
“কি করি বলতো?
“তুই এইখানেই বইসে থাক।আমি যাই। সরদার আর তোর রাক্ষুসে ভাই গুলার উপরে নজর রাখি।”
ফারদিনা পুরো দিঘীর পাড়টার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।চারপাশে বড় বড় গাছের সারি। আশেপাশে ঘরবাড়ি নেই। সামনের দিকে সুফিয়ান এর বাড়ি ব্যতীত। ঝিলমিল চলে যেতেই ফারদিনা দাঁড় করিয়ে বলল “শোন,এই দিঘী কাদের জানিস?
“তুই জাইনা কি করবি?
“আশেপাশে আর ঘর নেই,তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“গ্রামে এইরকম কত দিঘী পইড়া আছে।যাই আমি,নজর রাখতে হইবো।” ঝিলমিল চলে যায়।
সুফিয়ান ভেজা পোশাক বদলে পাঞ্জাবি
এবং পাজামা পড়ে নেয়। সাদা রঙের পাঞ্জাবি। সুফিয়ান এর বাবা সিলমন হায়দার বলতেন সাদা পাঞ্জাবি পড়া সুন্নত।পুরুষের জন্য পাঞ্জাবি উপযুক্ত পোশাক।সাদা রঙে সুফিয়ান এর সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বলেছিলেন তাঁর বাবা। সুফিয়ান এর তাঁর বাবার কথা মনে পড়ল। গভীর শ্বাস ফেলল।
খাতা কলম বের করে টেবিলে বসে। উঁকি দিয়ে রাঙার দিকে দেখল।রাঙা দাঁড়িয়ে আছে।লেচ টা নাড়াচ্ছে। দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল।নিব কলম কালির দোয়াতে ডুবিয়ে লিখতে শুরু করল। গতকাল লিখেছে,ফারদিনা অদ্ভুত আচরণ করে সন্ধ্যায় ছুটে চলে গেছে।রাতে তাঁর জন্য প্রহরের পর প্রহর অপেক্ষা করেছে। তাঁর দেখা মিলেনি। শেষ রাতের দিকে তাঁর দেখা অবশ্য মিলেছিল। প্রাচীর টপকে তাকে দেখেছে।এই দেখা নিশ্চয়ই দেখা নয়।এটি অন্যায়।কারো অনুমতি ব্যতীত তাঁর ঘরে উঁকিঝুঁকি মারা ঠিক নয়।এখন লিখছে -ফারদিনা এসেছে।আমি যতক্ষন দিঘীর জলে ছিলাম সে দাড়িয়ে ছিল।জল থেকে উঠার পর আমার প্রশংসা করেছে। ভেজা চুলে আমাকে সুন্দর লাগছে।আমি প্রতিক্রিয়া করলাম না।এক রাতে তারে দেখা না পেয়ে অভিমান জমেছে।
অভিমান টা তীব্র পর্যায়ে চলে গেছে।আমি বুঝতে পারছি, এতটা অভিমান করা ঠিক নয়। দিঘীর পাড়ে সে আমার পথ আটকে দাঁড়াল।বলেছে আমি ওর সাথে কথা না বলা পর্যন্ত দিঘীরপাড়ে বসে থাকবে। সাঁতার জানে না। ইচ্ছে হলে জলে ঝাঁপ দিতে পারে।আমি ততটা বোকা নই।ওর কথা বিশ্বাস করে নেব।_
সুফিয়ান থেমে যায়।ফারদিনার শেষ কথাটা কানে বিঁধছে,আমি সাঁতার জানি না,জলে ঝাঁপও দিতে পারি। পাগল মেয়ে। বিশ্বাস নেই।দিতেও পারে। সুফিয়ান খাতা কলম রেখে দিল।ঠিক সেই মুহূর্তে জলে ভারী কিছু পড়ার গলপ শব্দ আসল। সুফিয়ান হন্তদন্ত হয়ে গেল।ছুটে গেল দিঘীর পাড়ে। আশেপাশে কোথাও ফারদিনা নেই।জলে ঢেউ খেলছে। গভীর ঢেউ। সুফিয়ান তির্যক কন্ঠে ফারদিনা বলে চেঁচিয়ে শেষ সিঁড়িতে নামতেই ফারদিনার হাসির শব্দ ভেসে আসল।কাঁধ শক্ত করে পেছনে তাকাল।ফারদিনা হাসছে। তাঁর সম্মুখে এসে দাঁড়ায় সুফিয়ান।ফারদিনার হাসি দেখছে।সে ঠিক আছে।সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।ফারদিনার হাসি দেখে তাঁর ও হাঁসি পাচ্ছে।হাসা যাবে না।অভিমান অভিব্যক্তি ধরে রাখতে হবে।
ফারদিনা থেমে বলল “কি বাঁশিওয়ালা,ভয় পেলে বুঝি,আমি এত সহজে তোমাকে ছাড়ছি না।আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাব, এরপর অন্য কেউ এসে সেই জায়গাটা দখল করুক, না এটা আমি কখনোই চাই না।” সুফিয়ান ঠোঁট এর কোণে কেচে হালকা হাঁসি আনল।ফারদিনা বিনা বাধায় গতকাল কি করেছে না করেছে সব খুলে বলল। সুফিয়ান সেসব তোয়াক্কা না করে বলল ‘ভালোই লাগছে”
ফারদিনা থেমে বলল ‘কি ভালো লেগেছে?
“তোমার রঙে ঢঙে কথা কথা বলা।”
“তারমানে তুমি গতকাল আমাকে মনে করেছো, আমার কথা ভেবে তোমার মন খারাপ হয়েছে, সত্যি না?
সুফিয়ান একরাশ নীরবতা নিয়ে গভীর শ্বাস ফেলল।
“বলো না? ফারদিনা তারা দিল।
“তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো, প্রতিদিন কানের কাছে বসে ইতিহাস শোনাতে থাকো,আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এতদিন বিরক্ত করেছো, বিরক্ত হইনি। গতকাল রাতে বিরক্ত করনি,তখন আমি বিরক্ত হয়েছি।তোমার দেখা মিলেনি, আমি তখন বিরক্ত হয়েছি।”
ফারদিনা নির্বিকার কন্ঠে বলল “গতকাল আমরা একটা বিশেষ দিন পালন করেছি।তোমাকে এর ব্যাখ্যাও দিতে পারিনি। আমি দুঃখিত।”
ফারদিনার কথা গুলো অন্য রকম শোনালো। সুফিয়ান প্রসঙ্গ পাল্টে বলল ‘তুমি এভাবে কাউকে না জানিয়ে শুনিয়ে, আমার কাছে চলে আসো, তোমার আব্বা জানতে পারলে আমাকে ভুল বুঝবেন, আমার সততায় আঘাত হানবে।”
“তোমার সততা আগে না আমি? ফারদিনার ভ্রু ভাঁজ হল।
“সততা প্রেমের মহান উপাখ্যান।’ চলো বসি।
দুপুর গড়াচ্ছে। সূর্য টা মাথার উপরে খাড়া হয়ে আছে যেন।আজ শীত কম। জৈষ্ঠ্য মাসের সূর্যের মত কিরণ দিচ্ছে।তাঁরা দিঘীর ঘাটে পাশাপাশি বসে আছে।ফারদিনার পরনের শাল রঙের শাড়ি টা ঝলমল করছে।কানের স্বর্ণের দুল চিকচিক করছে।দুধে আলতা গায়ের রং। সুফিয়ান চেয়ে ছিল তার দিকে। দৃষ্টি সংযত করল।বলল “সময় বাড়ছে, তোমাকে খোঁজাখুঁজি করবে।চলে যাও”
“তাড়িয়ে দিও না, কাল রাতে দেখা হয়নি।মনে হচ্ছে অনেক বছর দেখা হয়নি।”
সুফিয়ান কিছু না বলে সিগারেট বের করল। সিগারেট ধরাল।ফারদিনা বিস্ময়ে বলল “আগে তুমি সিগারেট ধরানোর সময় আমার অনুমতি চাইতে,এখন আর অনুমতি চাইছো না, মাঝেমধ্যে তোমাকে অপরিচিত মনে হয়।”
“আমার এক হৃদয়,এক রুপ,আমি কখনো রুপ বদলাই না।সা’প খোলস বদলায় মানুষ নয়।”
“কিছু কিছু মানুষ আছে,যারা সা’পের থেকে ও ঘনঘন খোলস বদলায়।”
“তুমি সেসব মানুষের সাথে আমাকে তুলনা করছো না তো? সিগারেট ফুঁকে ধোঁয়া ছাড়ল। দোয়া আজ অন্য দিকে গেল।
ফারদিনার ধোয়ার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলল “আদিব ভাই একদিন বলেছিল, নীরবতার মাঝে ভয়ংকর রুপ থাকে!”
সুফিয়ান তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল “আমিও ভয়ংকর’। তবে আমার ভয়ংকর তখনি দেখবে যখন আমার ভালোবাসা কে কেউ আঘাত করবে।”
“তোমার ভালোবাসা আমিই তো? বড্ড উদাসীন হল ফারদিনা।
“তুমি এখনো বুঝতে পারছো না?
ফারদিনা মাথা আওড়ালো না। “ভালোবাসি কথাটা বললে না তো?
“আমি তোমাকে ভালোবাসি,তিনটে শব্দ মাত্র। ভালোবাসা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না রুপবতী। ভালোবাসার অনুভূতি বুঝে নিতে হয়।”
“অনুভূতির ব্যাখা না দিলে কিভাবে বুঝব?
“কবিতা শুনবে?
“কেমন কবিতা?
“প্রেমের কবিতা।”
“তুমি কি সেদিনই আমাকে প্রথম দেখেছিলে,যেদিন তোমার বাঁশির সুর শুনে ছুটে গেছিলাম?
সুফিয়ান রহস্যময় হাঁসি দিয়ে বলল “না।” ফারদিনা অবাক হল। সুফিয়ান এর চোখ মুখের দিকে তিক্ত চোখে তাকাল।
“তাহলে কোথায় এবং কিভাবে দেখেছিলে?
সুফিয়ান লম্বা শ্বাস ছাড়ল। শান্ত কন্ঠে বলল ‘বলব একদিন।কবিতা শোনো, হঠাৎ মাথায় দাদা জান এর একটা কবিতা এসেছে। তাঁর কবিতার উদ্দেশ্যে ছিল এক, আমার উদ্দেশ্য অন্য এক।”
“তোমার কথা অর্থহীন মনে হয়।কিছুই বুঝতে পারছি না। কবিতা বলো”
“সন্ধ্যার আকাশে লালিমা মিশে,
নদীর ধারে বাঁশি বাজে চুপচাপ।
সে বাজায় মনের অজানা সুর,
প্রেমিকা শুনে বসে বসে সে-ই সুর।
তাঁর চোখে ঝিলমিল বাতি,
সে যেন আমার সন্ধ্যা মালতী।
বাঁশির সুরে তার হাসি ভাসে,
মনের গভীরে, নিঃশব্দ প্রেমের ঘরে।
পাহাড়ি বাতাস বয়ে আনে তার গন্ধ,
ফুলের মতো কোমল, মাটির মতো প্রিয়।
প্রতিটি নোটে তার ছায়া থাকে,
বাঁশিওয়ালার হৃদয় যেথায় শোনে শুধু।
নদীর জলও যেন সে প্রেমে মজে,
তাঁর হাসিতে ঢেউ ওঠে চুপচাপ।
এই প্রেমের বাঁশি, এই মনের গান,
চিরকাল বাজুক, নিঃশেষে, অবিরত।
“কবিতার অর্থ হয়? ফারদিনা জিজ্ঞেস করল।
“সবকিছুর অর্থ হয়। শুধু খুঁজে বের করতে হয়।’
“তুমি প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাবে দিতে পারো না?
সুফিয়ান মসৃণ হেসে বলল “প্রশ্ন কঠিন হলে উত্তর কঠিন হবে।”
“তোমার সাথে আমি কথায় পারব না।’ সুফিয়ান সিগারেট ফেলে দিল।ফারদিনা বলল “ আমাকে তুমি প্রথম কোথায় কিভাবে দেখেছিলে, আমি জানতে চাই। আমার প্রশ্নের উত্তর চাই’
‘বললাম তো সময় হোক।সব বলব”
দুপুরের রোদে গ্রামের লোকজন জমিদারবাড়ির উঠোনে জড়ো হয়েছে।বছরে দু’বার রাজস্ব হয়।পৌষের শুরুর দিকে রাজস্ব তোলা হয়নি। শেষের দিকে পরপর দুবার তুললেও সবাই খাজনা দিতে পারেনি।এখন মাঘ মাসের শুরু।আজ বকেয়া রাজস্ব তোলার দিন।রশীদ তালুকদার, চুপচাপ চেয়ারে বসে খাতা উল্টাচ্ছেন। সামনে মৌলভী সাহেব, কেরানি, আর দু’জন পাহারাদার দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ দেখা গেল, দুই কৃষক, চাঁদ মিয়া আর ছলিমুদ্দিন,তাদের মধ্যে তর্ক লেগে গেল। চাঁদ মিয়া বলল, “আমার জমির অর্ধেক জল খেয়ে নষ্ট, আমি পুরো খাজনা দিতে পারব না।”
ছলিমুদ্দিন প্রতিবাদ করল, “জমিদার সাহেব, এই লোক তো নিজের দোষে জমি নষ্ট করেছে, এখন রাজস্ব বাঁচাতে চায়!”
রশীদ তালুকদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বললেন,
“সফিক তোর জমি যদি নষ্ট হয়, আমি নিজে দেখে আসব। আজ অর্ধেক দে, বাকি অংশ ধান উঠলে দিস। ছলিমুদ্দিন, তুইও শান্ত হ।”
আদিব রশীদ তালুকদার এর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান কে কোথায় দেখতে পেল না। সুফিয়ান এর বকেয়া খাজনা নেই। বর্গা জমি ছাড়াও তাঁর নিজের জমি আছে। বকেয়া না থাকলেও সে রাজস্বের দিন উপস্থিত থাকে।আজ নেই।আদিব সায়েম কে লক্ষ্য করে বলল “আব্বা ব্যস্ত,এই সুযোগে চল সুফিয়ানদের বাড়ি থেকে আসি। আজকাল ওকে দেখাই যায় না।”
সুফিয়ান ঘাট পাড় থেকে উঠে আসল।ফারদিনা ও বাড়ির যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল।তখন উপস্থিত হল সোলেমান।হাতে বাজারের ব্যাগ।বাজার করে ফিরছিল। সুফিয়ান এর বাড়ির সামনে থেকে যাচ্ছিল। কিছু টাকা দরকার। সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল “তুই এখানে?
“হু, কিছু টাকা দরকার । ঔষধ কেনার জন্য। বারবার চাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু…
বাকি কথা বলল না। সুফিয়ান বলল “এভাবে বলার কি আছে, দিচ্ছি।” সোলোমান ফারদিনার দিকে তাকাল। দ্বিতীয় বার চোখ তুলে সুফিয়ান এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল “গতকাল মজিদ মিয়ার সাথে রাতে দেখা হইছে।একখান কথা বলল। তাঁর চোখ মুখ জুড়ে আতঙ্ক এর ছাপ দিল।”
The Silent Manor part 19
“কি বলেছে?
‘তাদের ডাক শোনা যায় অমাবস্যার রাতে’ কে জানে ওটা পাখি না পাপের স্মৃতি।’
‘কাদের ডাক শোনা যায়?
‘ছোট ছোট বাচ্চাদের ডাক_____
