The Silent Manor part 21

The Silent Manor part 21
Dayna Imrose lucky

আদিব ও সায়েম সুফিয়ান এর বাড়িতে উপস্থিত হল।আদিব গলা উঁচিয়ে ডাকল ‘সুফিয়ান’। কন্ঠে তির্যক আওয়াজ। তাঁর স্বর দিঘীর পাড়ে পৌঁছাল। সোলেমান প্রথমে বাড়ির দিকে ঘুরে তাকালো। সুফিয়ান ও ফারদিনা নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করল। সুফিয়ান বলল “আদিব এসেছে, তুমি ঘাটের শেষ সিঁড়িতে নেমে বসো।ফারদিনা তাই করল।
সুফিয়ান ও সোলেমান ঘরের দিকে এগোলো।আদিব এগিয়ে আসল।রাঙার দিকে একবার তাকালো।বলল ‘তোর পোষা অশ্বের নাম কি রেখেছিস?
“রাঙা?
‘এই নামের অর্থ কি?
‘অর্থ খুঁজে নাম রাখিনি।ও দেখতে ভারী সুন্দর।গায়ের রংটা চকচক করছে।এইজন্য ওর নাম রাঙা।’
সায়েম এর দৃষ্টি এলোমেলো।সায়েম কখনোই স্থীর হয়ে থাকতে পারে না।চেয়েও থাকতে পারে না। সর্বদা ভাবে সে কাউকে খুঁজছে। নতুন শিকার এর জন্য।

_ আদিব সুফিয়ান কে বলল “আজ রাজস্ব ছিল,তুই আসলি না কেন?
সুফিয়ান হালকা করে অবাক চোখে বলল ‘আজ রাজস্ব ছিল?
‘আজকাল সব ভুলে যাচ্ছিস!কি ব্যাপার? কিছু হয়েছে?কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বল।’
ভুলে যাওয়ার রোগ সুফিয়ান এর ছিল না। আজকাল সে ফারদিনাকে নিয়ে প্রচন্ড ভাবছে। মানুষ এর সারাদিন অনেক ভাবনা থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কি করবে, সারাদিনে তাঁর কি কাজ, কোথায় যেতে হবে,কার সাথে দেখা করতে হবে! সে’সবকিছু ছেড়ে এখন শুধু ফারদিনাকে নিয়ে ভাবছে।অন্য কিছু ভাবার সময় কোথায়?আজ মিথ্যা দিবস না। কিন্তু আজ মিথ্যা বলতে হবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আদিব হাতে তুরি মেরে বলল ‘কি ভাবছিস?
“গত কয়েকদিন ধরে শরীর টা খারাপ। এইজন্য কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।”
“শুনলাম তুই কোন চোরদের ভালো মানুষ বানানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছিস? স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করল।
সুফিয়ান বিব্রতকর অবস্থায় পড়ল। সোলেমান ঢোক গিলল।আদিব নরম মনের মানুষ। চোরদের কথা সে জানলে কিছু বলবে না। কিন্তু সামনে উপস্থিত সায়েম।সায়েম ভেবেচিন্তে কাজ করে না।হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়। বিপরীত পাশের মানুষটির অনুভূতির ব্যাখা দেয়ার সময় দেয় না। তাঁর আগেই আক্রমণ।
সুফিয়ান এর এখন আর একটা মিথ্যা বলতে হবে।তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সত্য মিথ্যা দুটোই বলবে।বলল “খুধার্তরা যখন খাবারের জন্য চুরি করবে,তখন চোর এর নয়,গ্রাম প্রধানের হাত কেটে দেয়া উচিত।”
“তুই কি বলতে চাইচিস? তিক্ত চোখে তাকাল সায়েম।

সুফিয়ান মৃদু কন্ঠে বলল “অভাবে স্বভাব,নষ্ট হয়। স্বভাব একটা সময় অভ্যাসে পরিণত হয়।গ্রামে অনেক অসহায় মানুষ আছে, না খেয়ে দিন পাড় করছে। আমাদের উচিত ওদের অর্থ উপার্জন এর ব্যবস্থা করে দেওয়া।” থেমে আবার বলল ‘আমি চারজন অসহায় এর কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।ওঁরা চোর নয়।”
সোলেমান সুফিয়ান এর কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনল। তাঁর মত যদি সবাই ভাবত,তবে গ্রামে গরীব অসহায় বলতে কেউ থাকত না।হাতে বাজারের ব্যাগ এর দিকে দেখল।হালাল টাকার বাজার।হাতে নিয়েও এক প্রকার স্বস্তি পাওয়া যায়।আজ তাঁর এরকম জীবন শুধু মাত্র সুফিয়ান এর জন্য।
আদিব বলল “তুই তো জানিস, প্রতিবছর এই দিনে রাজস্ব তোলার পর মেলার আয়োজন করা হয়। আগামীকাল সেই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সব কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।,” আদিব বেশ আনন্দ এর সাথে কথা গুলো বলছে। এখানে আনন্দিত হওয়ার কি আছে? প্রতিবছর মেলা হয়। ভিন্ন ধরনের কিচ্ছু হচ্ছে না। পূর্বের মতই একই নিয়মে হবে।এই সময়টা আসলে আদিব খুশি থাকে।কোন এক কারনে।

সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল “এতে তুই এত খুশি হচ্ছিস কেন?
‘তুই ভুলে গেলি? আশ্চর্য হল আদিব।
সায়েম রাঙার কাছে এগোলো। সুফিয়ান তাঁর দিকে একবার তাকালো। অন্যদিকে ফারদিনা।মাথা থেকে সব বেড়িয়ে যাচ্ছে।আদিব এই সময়ে কেন খুশি থাকে?মনে করার চেষ্টা করল।মনে পড়ল না। পাল্টা প্রশ্ন করল “ভুলে গেছি।তুই বল, খুশি কেন?
আদিব ভারী শ্বাস ফেলে বলল “নূরজাহান। কৃষ্ণপুর গ্রামের লোকেরাও এই মেলাতে উপস্থিত থাকে।গত কয়েক বছর ধরে,এই দিন আসলেই ওর জন্য অপেক্ষা করি, কেমন আছে,কি করছে একটু জানতে চাই।গত সময়টাতে আর দেখা মিলেনি।আজ ও আমি ওর দেখা পাওয়ার অপেক্ষা করি।”
সুফিয়ান এর এবার স্পষ্ট মনে পড়ল নূরজাহান এর কথা।তাকে আদিব ভালোবাসত। নূরজাহান এর বিয়ে অন্য কোথাও হয়ে যায়। কিন্তু আদিব এর মনে এখনো নূরজাহান এর বসবাস।
সুফিয়ান হেসে বলল “তোরা মেলার ব্যবস্থা কর।তোরা দায়িত্বে হাত না লাগালে মেলার আয়োজন ঠিকঠাক মত হবে না।” আদিব তাঁর রেশ টেনে বলল “তুই যাবি না?

‘আমার শরীর ভালো না, তাঁর উপর ঘরে একটু কাজ আছে, সেরে আসব।’
সায়েম রাঙাকে দেখছে।রাঙা খুবই সুন্দর। দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতন।সায়েম এর চোখ পড়ল বাড়ির কোণাকুণির দিকের ছোট্ট ছোট্ট গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে দিঘীর পাড়ের দিকে।লাল লাল কিছু উড়ছে।সায়েম আদিব কে লক্ষ্য করে বলল “ভাই, দিঘীর পাড়ে কেউ আছে, তুই থাক আমি দেখে আসছি।”

দিঘীর পাড়ে ফারদিনা। সুফিয়ান বিস্ময়ে তাকাল সায়েম এর দিকে।বলল “যাস না! মানে.. থেমে গেল সুফিয়ান। পুনরায় বলল “আমি অশ্বের জন্য একটা লাল চাঁদর কিনেছি।ওর ঠান্ডা লাগে। মাঝেমধ্যে শীতে কাঁপে।তাই!” আদিব হা হয়ে বলল “ অদ্ভুত, আজকাল তোর কর্মকাণ্ড পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।সে ছাড়,আমরা যাই‌।তুই আগামীকাল সময় মত পৌঁছে যাস সমুদ্র পাড়ে।মেলায় কিন্তু খুব মজা হবে।” সুফিয়ান মুখে হাঁসি নিয়ে মাথা আওড়ালো।সে আসবে।’
আদিব চলে যায়।সায়েম দিঘীর পাড়ে ঘুরে একবার দেখল।লাল রং টা দেখা যাচ্ছে না।হয়ত বাতাসে গাছের আড়ালে চলে গেছে।
সুফিয়ান হাফ ছেড়ে বেঁচে দিঘীর পাড়ের দিকে গেল।ফারদিনা সিঁড়িতে বসে আছে। তাঁর মাথায় আদুরে হাতে সুফিয়ান আঘাত করে বলল “তোমার ভাইয়েরা আর একটু হলেই তোমাকে দেখে ফেলত।তখন কি হত? সে পাশে বসল।

“তুমি তাদের ভয় পাও?
“বললাম তো,আমি আমার জন্য কাউকে ভয় পাই না।”
“আমার জন্য ও তোমাকে ভয় পেতে হবে না।এখন বলো,প্রথম আমাকে কোথায় দেখেছো?
“তার আগে তুমি এটা বলো,তখন জলে কিসের শব্দ আসলো?
“আমি বড় একটা মাটির চাক ফেলেছি।আমি জানতাম জলে কিছু পড়েছে,আলাপ পেলেই তুমি ছুটে আসবে।তাই হল!” বলে শব্দ করে হাসল। সুফিয়ান হেসে বলল ‘এই হাঁসি চিরদিন অক্ষয় থাকুক।’
ফারদিনা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল ‘ আগামীকাল মেলা বসবে। তুমি আসবে তো?
‘নিশ্চিত বলতে পারছি না। চেষ্টা করব আসার জন্য।’
‘নিশ্চিত কেন না?

সুফিয়ান সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল ‘আসব।আদিব মেলার জন্যই আমাকে বলতে এসেছিল। তুমি জানো,প্রতি বছর এই মেলায় নূরজাহান এর আসার সম্ভাবনা থাকে।’
“কাল ও কি সম্ভাবনা আছে?
‘উমম,সম্ভবনা আছে।তবে আসলে আদিব এর জন্য ভালো ই হবে।’
‘আদিব ভাই এখনো তাকেই ভালবাসে ? মলিন কন্ঠে প্রশ্ন করল ফারদিনা।
‘বাসে।আর হয়ত চিরদিন বাসবে।’
‘আমি যদি কোনদিন হারিয়ে যাই?
‘তুমি হারিয়ে গেলে,সেদিন আমি নামক মানুষ টাও আর হারিয়ে যাবে।’

বিকেলের আলোটা যেন সোনার গুঁড়োর মতো ছড়িয়ে পড়েছে তালুকদার বাড়ির বাগানে।চারপাশে বড় বড় গাছ, পাখিরা ডাকছে “চি-চি”, ফোয়ারা থেকে টুপটাপ করে জল পড়ছে।বাগানের এক কোণে কাঠের বেঞ্চে বসে আছে রশীদ তালুকদার।হাতে ছড়ি, পাশে চায়ের কাপ, আর মুখে একরাশ গাম্ভীর্য।
বাতাসে শিউলির গন্ধ, কিন্তু তাঁর মুখে ভাঁজ যেন দুপুরের রোদে জমে থাকা রাগ।আজ একজন খাজনা বকেয়া রেখেছে।তখন হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন রাগ হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে। প্রকাশ করতে পারছেন না।রাগ ভেতরে চেপে রাখা উচিত নয়।

ঠিক তখনই কুদ্দুস ঢুকল বাগানে।হাতের ঝুড়িতে আধা ডজন কলা, আর মুখে একটু ভয় আর একটু ঢং। রশীদ রাগ দেখানোর মানুষ পেল।ওর উপরে আজ রাগ দেখাবে।
রশীদ কুদ্দুস এর দিকে তাকিয়ে বলল
“এইটা কী রে? গোলাপগাছের ডাল কে ভাঙছে?”
কুদ্দুস হকচকিয়ে গেল।
“বাবু,ওই ছাগডা ঢুইক্যা পড়ছিল, আমি ধরতে গেছিলাম…”
‘এটা কেমন ভাষা ?ছাগডা কি!বল ছাগল!কি?
‘ছাগল।’

“ধরতে গেছিলি, নাকি তুই নিজেই ভাঙছিস?”
রশীদ এর গলা ভারী হয়ে উঠল।“তোকে তো বলেছিলাম গাছগুলা রাজার মালের মতো দেখবি! এখন দেখ,পাতা কাটা, ডাল ভাঙা! ছাগল আমাদের খামার থেকে এসেছিল?
“জ্বে’
‘জ্বে না বল,জ্বী। আজকাল তোর কি হয়েছে!’
কুদ্দুস ফারদিনার কথা ভাবল। রশীদ বলল ‘ছাগল কে মারিসনি তো?
কুদ্দুস মাথা নিচু করে বলল,
“বাবু, ছাগলটাকে মারছিলাম না, শুধু ধমক দিছিলাম।”
“ধমক দিছিলি?” রশীদ হেসে উঠল ঠোঁট বাঁকিয়ে।“তোর ধমকেই মনে হয় ছাগলও লজ্জা পায়!” কুদ্দুস হাসল। রশীদ রাগ দেখাতে চেয়েছিলেন।হল না। হাসতে চেয়েছিলেন না, কিন্তু হেসে ফেলল।বাতাসে হাসির হালকা ঢেউ উঠল। পেছনের নাশপাতি গাছ থেকে একটা পাকা নাসপতি পড়ল “ধুপ” করে।
রশীদ চমকে তাকিয়ে বললেন,

“ তোর ভাগ্যো ভালো, কুদ্দুস, তোকে যদি বকাঝকা না করতাম, হয়তো এটাই তোর মাথায় পড়ত!” বলে হো হো করে হেসে উঠলেন।এক চুমুক চা নিল মুখে।খেতে ভালো লাগছে না।পান মুখে দিল।
কুদ্দুস দাঁত বের করে হাসল, “তাহলে ভাগ্য ভালো বাবু, আপনি হুদাই রাগ করেন।”
রশীদ তালুকদার ছড়ি ঠুকে বললেন,
“তুই ভাগ্যবান কুদ্দুস, কিন্তু আর একবার গাছের ডাল ভাঙলে,তোর ভাগ্য আমি নিজেই ভাঙবো!”
বাগানে হাসির রোল উঠল। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমে, রোদ নরম হয়ে এসে গাছের পাতায় ঝলমল করছে।
রশীদ তালুকদার পান চিবোলো।আর কুদ্দুস গাছের চারপাশে জল ঢালছে, গুনগুন করে গান গাইছে
“বাবু রাগ করেন, তবু মন তার সোনা…” রশীদ এর কানে কুদ্দুস এর গানের সুর ভেসে যায়।পিকদানিতে পিক ফেলল।বলল “তোর মালকিন বেঁচে থাকতে কোনদিন আমায় নিয়ে গান করল না।আর তুই করলি।এত বকাঝকা করার পরও আমাকে ভালোবাসিস!”

“হু, আপনার বকার মাঝেই ভালোবাসা লুকিয়ে আছে।’ এভাবেই বাগানের বিকেলটা হাসি, রোদ আর একটু বকাঝকায় মিশে একদম জীবন্ত হয়ে উঠল।
জয়নব বেগম। বয়স আনুমানিক ষাট এর উপরে।লাঠির উপর দিয়ে চলতে হয় তার। শ্যামলা গায়ের রং।চুল গুলো পেকে গেছে। সামনে একটি দাঁত নেই।দাঁত না থাকায় চেহারা বদলে ভিন্ন রুপ নিয়েছে। ছিপছিপে গড়ন। তালুকদার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।বাড়ির ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারল।উদ্দেশ্য তাঁর রশীদ তালুকদার এর সাথে দেখা করা। একজন পাহারাদার এসে সামনে দাঁড়ালো।ভারী দেহ সাথে কঠিন কন্ঠে বলল “কি চাই এখানে?
‘জমিদার বাবুর লগে একটু জরুরি কথা কওয়া দরকার।’

“উনি এখন কারো সাথে কথা বলবেন না।কাল আসুন‌!”
জয়নব আকুতি কন্ঠে বলল ‘কথা আমার কওনই লাগব।যাইতে দেন।’ পাহারাদার ক্ষেপে গেল। তাঁর ক্ষেপে যাওয়ার পেছনে কারণ আছে।এক বৃদ্ধা একবার সাহায্যের জন্য এসেছিল। পাহারাদার রশীদ এর অনুমতি ব্যতীত ঢুকতে দেন বাড়ির মধ্যে। প্রচন্ড রেগে ছিল সেদিন রশীদ।হঠাৎ একজন বৃদ্ধা সাহায্য চাওয়াতে তিনি রেগে গেল।যাতা কথা শুনিয়েছিল। বৃদ্ধা এবং পাহারাদার দুজনকেই। তারপর থেকেই পাহারাদার কাউকে বিনা অনুমতিতে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।আজ ও দিতে চাচ্ছে না।

রশীদ ঘরের ভেতরে যেতেই চোখ পড়ে বাড়ির ফটকের দিকে। একজন বৃদ্ধা মহিলা সাদা কাপড়ে দাঁড়িয়ে পাহারাদার এর সাথে কিছু বলছে। রশীদ পাহারাদার কে লক্ষ্য করে উচ্চ স্বরে বলল ‘কে’রে? কে এসেছে? ভেতরে নিয়ে আয়!”
জয়নব অবশেষে ভেতরে প্রবেশ করল। রশীদ পুনরায় বেঞ্চে বসল। জয়নুল ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াল। সম্মানের সাথে সালাম দিল। রশীদ সালামের জবাব দিল।বলল “ওয়ালাইকুমু সালাম।তা এই সময়ে এখানে কি চাই?

‘বাবু, আমার নাতনি,ঝুমকু।গত দুইদিন ধইরা নি’খোঁজ।বুড়ো মানু,একলা একলা কত আর খুঁজতে পারি,তাও অনেক খুজজি।পাইলাম না।আপনে যদি সাহায্য করতেন”
রশীদ বিশ্রী কন্ঠে বলল ‘ আপনার নাতনি কে কি এখন হারিকেন নিয়া আমি খুঁজব? বাক্যটি জয়নব এর কানে পৌঁছানো মাত্র আঘাত হানল। রশীদ রাগতে চাইলো না। হঠাৎ কি অদ্ভুত স্বরে ভাষা ব্যবহার করে ফেলল বুঝতে পারল না। ঠান্ডা গলায় বলল ‘ বয়স কত ছিল?
‘জ্বে,তিন বছর।’
“আপনার বাড়ি কোথায়?
“পুরান নদীর পাড়ে।”
“নদীতে ডুবে যায় নাই তো’ চিন্তিত অভিব্যক্তি করল সে।

“ও কথা কইবেন না বাবু,বাপ মা মরা নাতনি আমার।’ জয়নব থেমে আবার বলল ‘ ঝুমকু সন্ধ্যার সময় নিখোঁজ হইছে। উঠানে বইয়া খেলতে আছিল।সন্ধ্যায় আযান পড়ে।আমি ওরে কইলাম আযান পড়তেছে,তুই ঘরে আয়,আর খেলিস না।বইলা আমি ঘরে লন্ঠন জ্বালাইতে ঢুকলাম। এরপর সব চুপচাপ।আমি বাইরে আইয়া দেহি,খেলনা বাটি পইরা আছে। আমার নাতনি নাই।” বলে কাঁদল জয়নব। রশীদ ছড়িটা মাটির উপর ঘোরাচ্ছে।পানের থালা থেকে একটা পান মুখে দিল।পান চিবোতে চিবোতে বলল ‘ইতিহাস তো জানতে চাইনি।বলছেন খারাপ না,ভালোই হইছে।কেউ হারিয়ে গেলে খোঁজার দায়িত্ব তো আমার না। দারোগার সাথে কথা বলব।দেখি কি করা যায়।’
জয়নব আবেগ এর সাথে বলল “আমার নাতনিডারে যেন আল্লাহ বাচাই রাখে।আমি অপেক্ষায় থাকমু।’
জয়নব সালাম দিয়ে যেতেই রশীদ পুনরায় প্রশ্ন করল “সেদিন সন্ধ্যায় কাউকে দেখেছিলেন! সন্দেহ জনক মনে হয়েছে এমন?

জয়নব ভেবে জবাব দিল ‘সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ে একজন লোক পাগড়ি দিয়া মুখোশ পইড়া নদীর পাড়ে ঘুরঘুর করছিলো।আমি গ্রাহ্য করি নাই।”
“সে কে হতে পারে?
“কইতে পারুম না বাবু,
রশীদ ইশারায় জয়নব কে যেতে বলল।উনি চলে যায়।
কুদ্দুস পাশে বসে সব শুনেছে এতক্ষণ। রশীদ এর কাছে এগিয়ে বলল ‘একটা কথা বলব?
রশীদ বিরক্ত স্বরে বলল “আবার কি হল?
‘ক’দিন আগে সামসুল এর ছেলে পাঁচু এভাবেই নি’খোজ হয়।পড়ে ওর লা’শ মিলে। আমার তো ভয় হচ্ছে,যদি ঝুমকু..’

আহ্ শব্দ করে রশীদ বলল ‘মরন এক ভাবে হবেই,তাতে এত ভাবার কি আছে! দারোগা তদন্ত করছে। আশাকরি খু’নি যেই হোক, শীঘ্রই ধরা পড়বে‌।’
আজমাত সন্ধ্যার শীতল হাওয়া উপভোগ করছে বাড়ির ছাদে বসে।হাতে সিগারেট।রাশিয়ায় থেকে নিয়ে আসা নস্যি শেষ। কুদ্দুস কে দিয়ে সিগারেট আনিয়েছে। একেকটা সিগারেট এর মূল্য আট আনা।আজ সে কোথাও বের হয়নি। আগামীকাল গ্রামে মেলা বসবে।মেলার কথা প্রথম শুনে অবাক হয় আমজাত।মেলা সম্পর্কে জানার জন্য আদিব এর কাছে যায়।আদিব মেলার বর্ননা দেয়া।

নুপুর এর আওয়াজ পাওয়া গেল। আজমাত ঘুরে তাকাল।ফারদিনা এসেছে।কালো রঙের শাড়ি পড়া।চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া। ভেসে আসা মৃদু বাতাসে দুলছে চুল গুলো।ফারদিনা শাড়ির আঁচল মোড়াচ্ছে। আজমাত বলল “তোমাকে কালো রং এর সুন্দর দেখাচ্ছে। তোমার মত সুন্দরী নারী হয় না।” ফারদিনা হেসে বলল ‘তুমি ও অনেক সুন্দর। বিদেশি ছেলে আমি কোনদিন দেখেনি। শুধু নাম শুনেছি।’
‘শুক্রবার রাতে সুফিয়ান তোমার খোঁজে এসেছিল।ও তোমাকে খুব ভালোবাসে।’ ফারদিনা সুফিয়ান এর বিষয়টা অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দিয়ে বলল ‘আমাকে ওর মত অনেকেই ভালোবাসে.”
“তুমি ও নিশ্চয়ই ওকে ভালোবাসো?
‘আমি ওর মত সাধারণ একজনকে কেন ভালোবাসতে যাব?
‘কি বলছো? আজমাত ফারদিনার মুখোমুখি হল।ফারদিনা রেলিং ধরে দাঁড়াল।বলল ‘ও আমার বন্ধুর মত।এর বেশি কিছুই নয়।’

“সত্যি বলছো? আজমাত ফারদিনার দিকে আর একটু এগিয়ে গেল।
‘আমি মিথ্যা বলি না।’
আজমাত হাসল। তাঁর হাঁসি শব্দহীন।ফারদিনা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল ‘ওর কথা বাদ দাও। তোমার প্রেয়সীর নাম বলো?
‘প্রেয়সী?
“প্রেয়সী মানে ভালোবাসার মানুষ। তোমার স্ত্রী অথবা প্রেমিকা!”
আজমাত রেলিং ধরে বলল ‘আমার জীবনে মা ব্যতীত বিশেষ কোন নারী নেই।’
“কারো জীবনে বিশেষ কেউ থাকে না।খুঁজে, তৈরি করে নিতে হয়।”
‘ভাগ্যির লিখন, কপালে যা আছে তাই হবে।’
ফারদিনা কথাটা শুনে আজমাত এর দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকালো। আজমাত তাঁর চাহনি দেখে বলল ‘কথাটা সুফিয়ান এর কথার সাথে মিলে গেছে তাই চেয়ে আছো তো।আমি তাঁর কাছেই শুনেছি। অদ্ভুত এবং অবাক করার মতো, যুক্তিপূর্ণ উক্তি সুফিয়ান ই তৈরি করতে পারে।’
ফারদিনা বিরক্ত হয়ে বলল ‘উফ ওর কথা শুনতে চাচ্ছি না,ওর সাথে তো..। বাকি কথা বলার আগেই ঝিলমিল উপস্থিত হয়।হাতে খাবার নেই।হাঁটায় আওয়াজ নেই।নুপুরের শব্দ নেই। অদ্ভুত।ফারদিনার দিকে এগিয়ে দিল একটি খাম।

“কি এটা? ফারদিনা জিজ্ঞেস করল।
“একজন তোর উদ্দেশ্যে চিঠি দিয়া গেছে।”
‘কে সে?
“চাদরে মুখ ঢাকা ছিল। ফটকের বাইরে দাঁড়াইয়া আছিল। ভাগ্যিস অন্য কেউ দেহে নাই।লোকটা বৃদ্ধা।এক টা চোখ নষ্ট।’
ফারদিনা চিঠিটা খুলে দেখল। জীর্ণশীর্ণ হাতে লেখা _ তুমি যার উপর ভরসা করছো!সেই তোমার জীবনের ইতি টানবে।”

The Silent Manor part 20

ফারদিনা আতঙ্কে জড়সড় হয়ে গেল। এরকম চিঠি সে আরো একবার পেয়েছে।রশীদ কে সে সব চেয়ে ভরসা করে।আদিব কে সে ভরসা করে, বিশ্বাস করে। ঝিলমিল একজন দাসী হলেও তাকে বন্ধুর মতন বিশ্বাস করে।
বাকি তিন ভাইকেও বিশ্বাস করে।আর কেউ নেই,যাকে সে ভরসা করে। মস্তিষ্কের নিউরন গুলো যেন হঠাৎ তার ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল।ঠিক সেই মুহূর্তে বাঁশির সুর আসলো। ঝিলমিল এবং আজমাত শুনতে পেল।আজমাত বলল ‘কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে।সুরটা সুন্দর।’ ঝিলমিল তাঁর রেশ টেনে বলল ‘হু।মনে হচ্ছে নতুন কিছুর আগমন।’ ফারদিনা আকস্মিক হকচকিয়ে বলল ‘কোথা থেকে বাঁশির সুর আসছে?আমি কেন শুনতে পাচ্ছি না।!
‘ঢং করিস না।তুই যার সুর শোনার লইগা অপেক্ষা করিস তাঁর সুর, আবার মিথ্যা বলিস!’ ঝিলমিল বলল।
‘সত্যি বলছি,আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’

The Silent Manor part 22

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here